.header-button .inner > span { font-size: 18px !important; } .header-button .inner i.fa { font-size: 40px !important; } .comment-form-message { background-color: #f4f4f4 !important; font-size: 14px !important; }

মাসুমুল আলমের ছোটগল্প ‘আনন্দ কোথা থেকে আসে’


টানা তিন দিনের প্রবল বৃষ্টিপাতে বাড়ির কনস্ট্রাকশনের কাজ বন্ধ থাকার পর রোদ্দুর উঠলে রাজমিস্ত্রির সঙ্গে সহকারী হিসেবে নতুন যে জোগালে এল জ্যোতি তাকে দেখে প্রথমে বিস্মিত হয়। লোকটিকে সে চিনত, জানত মোটামুটি যে, মোটের ওপর লোকটি অন্যরকম। এই লোকটিকে সে এ অবস্থায় তাদের বাড়িতে মেনে নিতে পারে না। যেমন তার বাবা দরিদ্র আত্মীয় বাড়ি বয়ে গিয়ে  টাকা দিয়ে আসে যেন তারা তাদের শহরের বাড়িতে এসে আত্মীয়প্রীতি না দেখায়। ব্যাপারটা যেন এ-রকম, জ্যোতির মনে হল।

লোকটিকে সে দেখেছে কলেজে ছাত্র সংগঠন আয়োজিত পাঠচক্রে আলোচক এবং অংশগ্রহণকারী হিশেবে। প্যান্ট-শার্ট পরিহিত এবং চোখে কম দ্যাখে বিধায় চোখে চশমা। লোকটিকে জ্যোতি বহুবার দেখেছে তাদের পাড়ার লাইব্রেরিতেও। তো সেই লোক এখন তাদের বাড়িতে হাঁটু পর্যন্ত লুঙ্গি গুটিয়ে কাজ করছে। লোকটি কি তাকে দেখলে চিনবে? সে পারতপক্ষে ঐ নির্মাণযজ্ঞের কাছে যায় না। জ্যোতি তার ঘরের বেড়া-কাটা জানালার ফাঁক দিয়ে দ্যাখে বিন্দুমাত্র সংকোচহীন লোকটি কাজ করে চলেছে। সেই কবে মহামতি লেনিনের মূর্তি পতন ঘটল, বার্লিন প্রাচীর ভাঙল, সমাজতান্ত্রীক ইউরোপের স্বপ্নভঙ্গ ঘটেছে তা-ও সেই কবে। অথচ লোকটি পাঠচক্রে, পাঠচক্রে ভাঙা-সাইকেল নিয়ে এখনো বয়ে বেড়ায় পুস্তক। পড়ে আর রাজধানীতে থাকা বুদ্ধিজীবীদের কাগজে বিবিধ মতামত লিখে পাঠায় আর পরিচিতদের তা দেখায়। কেউ যদি-বা তাকে বলেন আর কেন, লোকটি নীরব থাকে এবং মৃদু হাসে। এই মতো লোক যার স্বপ্নভঙ্গ হয়নি, হয় না, তাকে নিয়ে এতটুকু জানাই জ্যোতির মতো নয়া তরুণ বাস্তববাদী ছেলের জন্য যথেষ্ট। বরং জ্যোতি তার ঘরে বসে সুতিঘাটা থেকে আসা লোকটির বিপরীতে প্রতিস্থাপিত করে তাদের পাড়ার আকবর ভাইকে।

এই আকবর ভাই, সম্বোধনে তার বাবারও যেমন ভাই তেমন বড় ভাইদেরও। আকবর ভাই অকৃতদার, তিন কাঠা জমির উপর দুটো জারুলগাছ আর জরাজীর্ণ টিনের ঘর, যেদিন সকালে তার মা মারা যান, তিনি দুপুর পর্যন্ত খবরটা গোপন রাখেন, তারপর বিকালে প্রতিবেশীদের ডেকে কয়েকজনের নিষেধ বা পরামর্শ সত্ত্বেও—তিনি হুজুর ডেকে বাড়ির উঠানে মায়ের কবর দেন। এবং ঐ দিন সন্ধ্যাবেলায় তার একটিমাত্র ঘর মাটিতে নিঃশব্দে ধসে যায়। তিনি আমাদের বাড়িতে আসেন যেমন দুই-একদিন পর পরই, অতএব নিয়মিতই বলা যায়। এসে জ্যোতির বাবা-মার কাছে বাড়িটি ওঠানো না-পর্যন্ত তাদের পরিত্যক্ত ঘরটিতে রাত্রে থাকার সসংকোচ প্রস্তাব রাখেন। বলা বাহুল্য বাবা-মা দোনোমোনো করতে থাকলে তিনি অন্য প্রসঙ্গই পাড়েন। গল্প করেন। আকাশবাণী থেকে প্রচারিত খবর শোনেন আর গল্প করেন বাবার সঙ্গে। রাজধানী থেকে আগত জ্যোতির বড় ভাই’র সঙ্গে, বাণিজ্যিক শহর থেকে আসা মেজো ভাই’র সঙ্গে, তারপর ঐদিন রেডিওতে রাতের বেলার শেষ সংবাদ শুনে ছানি-পড়া প্রায় অন্ধ চোখ নিয়ে তিনি তিনমাথা রাস্তার মোড় থেকে গলি ধরে চলে যান। আকবর কামাল, জ্যোতির কাছে একসময় গ্রেগরি পেক, তারও আগে তার কাছে হুবহু অমিতাভ বচ্চন। এই লোক ধারাবাহিকভাবে মিশে গেছেন জ্যোতির বড় ভাইদের সঙ্গে, এক পর্যায়ে তারা আরো বড় হলে আরো ‘বড়’কিছু হওয়ার প্রত্যাশা নিয়ে একে একে মফস্বল ত্যাগ করলে শেষে জ্যোতির সঙ্গেই গল্প করতেন। 

জ্যোতি তখন নবম শ্রেণি, সদ্য গলার স্বর ভাঙছে, তখন আকবর ভাই স্মৃতি থেকে আবৃত্তি শোনাতেন তাকে, সে-ও অতঃপর ‘সঞ্চিতা’ বা ‘সঞ্চয়িতা’থেকে অস্বচ্ছ দৃষ্টির আকবর ভাইকে শোনাত। আর গমগমে কণ্ঠস্বরের লোকটি কেবল তার প্রশংসা করে যেতেন। ধরিয়ে দিতেন উচ্চারণ। এই লোকটি ছিলেন কোলকাতার, একদম শান্তিপুরের। চন্দ্রবিন্দু আর ‘চ’টা বেশি এসে যেত কথায় কথায়। এই লোকটি ধীরে তার ভেতরে সাংস্কৃতিক আর রাজনৈতিক চেতনায় কী-একটা জগৎ তৈরি করে দিচ্ছিলেন। জ্যোতির কাছে আকবর ভাইয়ের সঙ্গ আনন্দের, কেননা তিনি কোনো কিছু চাপিয়ে দেন না, তত্ত্বকথা বলেন না; জ্যোতি নিজে নিজে পড়ার ভেতর আনন্দ খুঁজে নিয়ে আকবর ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলত অধীত বিষয় নিয়ে। সমবয়সীদের সঙ্গে সে আর আনন্দ পেত না। সেই সময় সে একতরফা প্রেমে পড়েও আনন্দ পেয়েছে বিস্তর। একটা বয়স্ক ব্যাটার সঙ্গ, নাটক-সিনেমা-বই পড়ায় ক্রমশ ঘরকুনো স্বভাব জ্যোতি সেই সময় সমবয়সীদের ঠাট্টা আর বড় ভাইদের তিরস্কার সত্ত্বেও নিজেই নিজেকে আনন্দিত করেছে। জ্যোতি স্বমেহনেও আনন্দিত হয়েছে। নিজেই নিজের ভেতর একচ্ছত্র স্বাধীনতা উপভোগ করেছে। রাহুল সাংকৃত্যায়নের ‘ভবঘুরে শাস্ত্র’ পড়ে ভেবেছে, হায় আকবর ভাই ক্যানো বেরিয়ে পড়ছেন না এত দিনেও? একথা শুনে তিনি হাসলেন কেবল, বললেন না কিছুই। এরপর থেকে জ্যোতি দুরত্ব বোধ করতে থাকল; আকবর ভাই বাড়িতে এসে বাইরের বেঞ্চে বসে থাকতেন; রেডিওটা ‘অন’করে দিয়ে আসত সে, তিনি খবর শুনতেন, এই একটা নেশা ছিল তার, আরো কিছুক্ষণ বসে থাকতেন এবং সে হয়তো পড়ছে—তার ডিস্টার্ব হবে ভেবে না ডেকে চলে যেতেন। 

সুতিঘাটা থেকে আসা লোকটিকে দেখে তার আকবর কামালের কথা হঠাৎ-ই মনে পড়ল। স্বপ্নভঙ্গ হয়েছিল তার? রাষ্ট্রীয় দণ্ডাদেশ মাথায় করে ৩৪-বছর পলাতক থাকার পর যখন একজন নিষিদ্ধ ঘোষিত নেতা আবদুল হক কেবল তার মৃত্যুর পরে ঐ রাষ্ট্রই তার লাশের উপর পুষ্পস্তবক অর্পণ ক’রে, রাষ্ট্রীয় সম্মান জানায় এবং রেডিও-টেলিভিশনে বিবৃতি দেয় নেতৃবৃন্দ, তখন, আকবর কামাল বিভ্রান্ত হয়ে পড়েন? নেতৃবৃন্দ বলেন, আমরা তার পায়ের কাছে বসেই রাজনীতি শিখেছি। তখন আকবর কামাল গৃহত্যাগ মায় দেশত্যাগ করতে চান কিন্তু বুড়ো ছেলেটির বৃদ্ধতর মায়ের কথা ভেবে শেষমেশ কোথাও যাওয়া হয় না। 

ঘর ধসে পড়ার পর, নতুন ঘর উঠানোর সামর্থ্য কিংবা তাগিদ কোনোটাই না থাকায় এবং আমাদের বাড়িতেও আশ্রয় না পাওয়ার আকবর কামাল কোথায় কোথায় যে থাকতেন জ্যোতি তা জানত না। সপ্তাহে একদিন হয়তো আসতেন, উস্কুখুস্কো দশা, যথারীতি খবর শুনতেন, জ্যোতির মা খেতে দিতেন এবং অতঃপর উনি চলে যেতেন। জ্যোতি একদিন দেখল অম্বিকা বসু লেনের গলিতে মৃতপ্রায় কৃষ্ণচূড়া গাছটির চারপাশে আড়াই চক্কর মেরে চলে যাচ্ছেন আকবর কামাল। কোন দিকে? জ্যোতির সময় নেই, জ্যোতি তখন প্রেমে পড়ে গেছে, সে লিফলেট বিতরণ করে ছয় মাইল পথ হেঁটে গিয়ে গ্রামের ভেতর, সন্ধ্যায় সবাই যখন নামাজে গিয়ে দাঁড়ায় তখন; অতএব সময় কোথায়?

ঐ বছর খুব শীত পড়ল শহরে। এত শীতে তাদের পাড়ার একজন মহিলা কাপড় কাচতে কাচতে হাড়-কাঁপানো ঠাণ্ডায় মরে গেল। খবরটা শুনল সে। আবার এই ঘটনার পরদিনই আকবর কামাল প্রচণ্ড শীতের ভেতর কুকুর কুণ্ডলী হয়ে তার মাটির সঙ্গে মিশে-যাওয়া টিনের চালের নিচে মরে পড়ে রইলেন। ঠাণ্ডায়। পাশেই ছিল এক মুদি দোকানির বাড়ি। দোকানি তাদের বাড়ি এসে খবরটি দিল। 

সে নাকি গভীর রাতে অস্পষ্ট গোঙানি শুনেছে। জ্যোতি জানত, আকবর কামাল এই দোকানিকে একদমই সহ্য করতে পারতেন না। তার জমির ওপর নাকি লোকটির নজর ছিল। এই জন্য ঐ জমির মধ্যভাগে আকবর ভাই তার মায়ের কবর খুঁড়েছেন। জ্যোতিকে দোকানি বলেছিল আকবর কামাল শীতে কাতরাতে কাতরাতে কেবল কী ঐ বসনিয়া-হার্জেগোভিনা বসনিয়া-হার্জেগোভিনা করছিলেন। বলা বাহুল্য, জ্যোতির একথা বিশ্বাস হয়নি। 

নির্মাণকাজ শেষ হতে হয়তো আর মাসখানেক লাগবে। তারপর সুতিঘাটার লোকটি ফিরে যাবে। তারপর আবার সাইকেল চড়ে ফিরে আসবে তাদের শহরে। ততোদিন জ্যোতি তাদের নিজেদের বাড়ি ছেড়ে অন্য কোথাও গিয়ে থাকবে—আপাতত; নিজের আনন্দের জন্য। কিন্তু জ্যোতি আর ফিরে আসে নি। ফিরে আসে না। সুতিঘাটা থেকে আসা লোকটা কেমন নির্বিকার বেঁচে বর্তে থাকে।

 আরো পড়ুন:                 

মন্তব্য

BLOGGER: 1
মন্তব্য করার পূর্বে মন্তব্যর নীতিমালা পাঠ করুন।

নাম

অনুবাদ,32,আত্মজীবনী,26,আর্ট-গ্যালারী,1,আলোকচিত্র,1,ই-বুক,7,উৎপলকুমার বসু,23,কবিতা,319,কবিতায় কুড়িগ্রাম,7,কর্মকাণ্ড,15,কার্ল মার্ক্স,1,গল্প,56,ছড়া,1,ছোটগল্প,12,জার্নাল,4,জীবনী,6,দশকথা,24,পাণ্ডুলিপি,10,পুনঃপ্রকাশ,15,পোয়েটিক ফিকশন,1,প্রতিবাদ,1,প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা,4,প্রবন্ধ,152,প্রিন্ট সংখ্যা,4,বর্ষা সংখ্যা,1,বসন্ত,15,বিক্রয়বিভাগ,21,বিবিধ,2,বিবৃতি,1,বিশেষ,23,বুলেটিন,4,বৈশাখ,1,ভাষা-সিরিজ,5,ভিডিও,1,মাসুমুল আলম,35,মুক্তগদ্য,37,মে দিবস,1,যুগপূর্তি,6,রিভিউ,5,লকডাউন,2,শাহেদ শাফায়েত,25,শিশুতোষ,1,সন্দীপ দত্ত,8,সম্পাদকীয়,16,সাক্ষাৎকার,21,সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ,18,সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ,55,সৈয়দ সাখাওয়াৎ,33,স্মৃতিকথা,14,হেমন্ত,1,
ltr
item
বিন্দু | লিটল ম্যাগাজিন: মাসুমুল আলমের ছোটগল্প ‘আনন্দ কোথা থেকে আসে’
মাসুমুল আলমের ছোটগল্প ‘আনন্দ কোথা থেকে আসে’
https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEhKtCAV6AMYJpIAMAUGCbd1ifABKb0BEwIXBfHuAxtaoO2-cieM2ZeAh387UOhVTdcXihxpnSFVpWr3Sf5OVGyXGR9kndEzJoJ5n4lZEToMxbZKnLnRF9wO3vwmnPumhLSyviuJnlQwXfw/s320/%25E0%25A6%25AE%25E0%25A6%25BE%25E0%25A6%25B8%25E0%25A7%2581%25E0%25A6%25AE%25E0%25A7%2581%25E0%25A6%25B2-%25E0%25A6%2586%25E0%25A6%25B2%25E0%25A6%25AE.png
https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEhKtCAV6AMYJpIAMAUGCbd1ifABKb0BEwIXBfHuAxtaoO2-cieM2ZeAh387UOhVTdcXihxpnSFVpWr3Sf5OVGyXGR9kndEzJoJ5n4lZEToMxbZKnLnRF9wO3vwmnPumhLSyviuJnlQwXfw/s72-c/%25E0%25A6%25AE%25E0%25A6%25BE%25E0%25A6%25B8%25E0%25A7%2581%25E0%25A6%25AE%25E0%25A7%2581%25E0%25A6%25B2-%25E0%25A6%2586%25E0%25A6%25B2%25E0%25A6%25AE.png
বিন্দু | লিটল ম্যাগাজিন
https://www.bindumag.com/2020/10/Masumul.html
https://www.bindumag.com/
https://www.bindumag.com/
https://www.bindumag.com/2020/10/Masumul.html
true
121332834233322352
UTF-8
Loaded All Posts Not found any posts আরো Readmore উত্তর Cancel reply মুছুন By নী PAGES POSTS আরো এই লেখাগুলিও পড়ুন... বিষয় ARCHIVE SEARCH সব লেখা কোন রচনায় খুঁজে পাওয়া গেল না নীড় Sunday Monday Tuesday Wednesday Thursday Friday Saturday Sun Mon Tue Wed Thu Fri Sat January February March April May June July August September October November December Jan Feb Mar Apr May Jun Jul Aug Sep Oct Nov Dec just now 1 minute ago $$1$$ minutes ago 1 hour ago $$1$$ hours ago Yesterday $$1$$ days ago $$1$$ weeks ago more than 5 weeks ago Followers Follow THIS PREMIUM CONTENT IS LOCKED STEP 1: Share to a social network STEP 2: Click the link on your social network Copy All Code Select All Code All codes were copied to your clipboard Can not copy the codes / texts, please press [CTRL]+[C] (or CMD+C with Mac) to copy