.header-button .inner > span { font-size: 18px !important; } .header-button .inner i.fa { font-size: 40px !important; } .comment-form-message { background-color: #f4f4f4 !important; font-size: 14px !important; }

মাসুমুল আলমের ছোটগল্প ‘মাকড়সা এবং অন্ধকারের গান’


আদ্যপর্ব ১: মাকড়সা-মা পেটুক ছিল কি-না এখন আর মনে পড়িল না। তবে ছানাগুলির এক-একজনকে এক-একদিকে পাঠাইয়া সে অপেক্ষা করিয়া রহিল। অতঃপর একটি ছানা আহার্য দেখিবামাত্র সুতায় টান দিলে মাকড়সা-মা সেদিকে ধাবিত হইতে গেলে অপরদিক হইতেও টান পড়িল। বাধাপ্রাপ্ত হইল। অন্য আরেক দিক হইতে টান অনুভবেও ব্যস্ত হইল। উল্লসিত ছানাসকল মা-কে আকাঙ্ক্ষা করিয়া সকল সুতায় টান বাড়াইতে লাগিল। টানের তীব্রতায় মাকড়সা-মায়ের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ছিঁড়িয়া শ্বাসরোধের উপক্রম হইল।

নিজেকে তার পরিত্যক্ত মনে হয়। এমতো মনে হয় যে, বিশ্বসংসারে এবং তিল তিল গড়ে ওঠা সংসারটিতেই নিজেকে অপাঙ্ক্তেয় বোধ হয়। কিন্তু এই সংসার তো তার নিজ হাতে গড়ে তোলা। তার সংসার। ধনুকবাঁকা  শরীরটা টানটান আর কোমরের ব্যথা তড়িৎ সঞ্চালনের মতো দ্রুততায় সমস্ত শরীরে ছড়িয়ে যায়। চিন্তাসূত্র ছিঁড়ে গেলে পর নিজেকে নির্ভার এবং উল্টো, জগৎ সংসারের সব কিছুই তার কাছে নিরর্থক বলে মনে হয়। সে এক বিচ্ছিন্ন সত্তা হিসাবে মৃতজনের আত্মার মতো বিরাজমান। কিন্তু প্রথম প্রথম প্রিয় সবকিছুর প্রতি টানবশত অবলোকন করে যেত, এখন সেই আত্মা সবকিছু থেকে স্বাভাবিকভাবে চ্যুত হয়েছে, যেমন— জীবিতেরা একসময় স্বাভাবিকভাবেই মৃতজনদের ভুলে যায়— কিংবা তাঁরা মৃতের স্মৃতির জন্যেই শোকার্ত অতঃপর তাঁদের স্মৃতি বিস্মৃত হয়ে যায়।

আদ্যপর্ব ২: ‘তোমরা কি ফিরে এলে? বলো, বলো, মৃতগণ, বলো এ দুর্গের জন্য কী এনেছ তোমরা প্রত্যেকে?—‘আমি সাগরের থেকে নুন।’ ‘আমি দূর দ্বীপ থেকে এনেছি প্রাচীন ফল।’—‘আমি তেল।’ ‘আমি হাড়।’ — ‘আর আমি মশলা ও পানীয়।’ তবে তুই? হাড়ের মুকুটপরা মেয়ে, তুই কিছু আনিসনি?— ‘আমার জরায়ু আমি মাথায় কলস করে আনলাম, এ দূর্গের সমস্ত মৃতকে আবার জন্মাতে দেব বলে।’

একসময় সে চতুর্পার্শ্বের নক্ষত্রলোকের দ্বারা স্নাত হয়ে ওঠে; ততক্ষণে নিজেকে ভারহীন ওজনহীন বলে বোধ হয়।— প্রথমে মনে হয় আধিভৌতিক কারণে- বুঝি-বা আগাম আলোকরশ্বির রেখা ধরে অনেক আগে হারিয়ে যাওয়া মানুষেরা নিঃশব্দে বেলুনের মতো হামা দিয়ে হালকা স্বচ্ছ মেঘের ভেতর গড়িয়ে নিকটতরও হয় : তোমরা??? সে হতচকিত হয়।— এ কী! সে প্রচণ্ড ভয়ে ভীত নয় যে সমস্ত শরীর নীলবর্ণ হবে এবং তৎক্ষণাৎ তার ঠোঁট নড়লেও কোনো শব্দের উৎসারণ ঘটে না।

—আমি তোমার… এবং তুমি… এবং… এবং… এবং আমি হলাম… এবং তাদের ক্রমশ পরিচয়ের প্রেক্ষিতে সে নিজেও ব্যাকুল, উৎসুক হয়। আশ্চর্য! সে বিহ্বল হয়ে ওঠে।

মধ্যপর্ব ১ : ‘সমস্ত প্রলাপ জ্ঞান করো বন্ধু, বন্ধু নও, কবি, কভিজান-পহেচান হয়নি তোমার সঙ্গে।’

সাদা সাদা মেঘপুঞ্জ উড়ে যায়। আর অনেক উপরের নীল নীল মেঘের ভেতরে সাঁতার কাটতে কাটতে মীরার হঠাৎ আরো নিচে স্তূপীকৃত মেঘের ভেতরে গিয়ে ডুবতে ইচ্ছা করে। কিন্তু সে ক্ষতিগ্রস্ত হবার আশংকা করে, তাই সে ইচ্ছা দমন করে রাখে।

—মীরা চল, আমরা ওই মেঘের ভেতর লাফিয়ে নামি। সুন্দর, পেঁজা তুলোর মতোন

মীরা মুগ্ধ চোখে তাকায়। সে চোখে বিস্ময় — এই কারণে যে, তার অন্তরের এই ইচ্ছেটাকে সে কেমন করে জেনে যায়? 

—কী হলো?

—তাই?

—দেখবে চলো। দেখবে, শরীরের স্পর্শে মেঘ কেমন গলে গলে জলকণা হয়ে যায়। আর মহাশূন্যের একটা স্তরে জমা হয় স্ফটিকের মতোন কেমন স্বচ্ছ হয়ে ভাসতে থাকে।

অতঃপর তারা গভীর জলাশয়ে যেমন মাছ তেমনই মেঘ কেটে কেটে সাঁতার যায়। উচ্ছল কিশোরীর মতো মীরা বানু এক-একটা মেঘের স্তূপ দু’হাতে আলিঙ্গন করে, ভেঙে দিয়ে ডুব দেয়, ডুব দিয়ে দিয়ে লুকোচুরি খেলে, আর তার শরীর জলকণায় সিক্ত হতে থাকে। যখন মীরা পরিশ্রান্ত, দেখতে পায়, তার স্বামী একদৃষ্টে তার দিকে তাকিয়ে আছে। এবং হাতে তার নিজের পরিধেয় সম্পূর্ণ শুকনো অবস্থায় সংস্থাপিত। মীরা বানু বিস্মিত হয় কী উপায়ে এই দুরূহ কর্মটি সম্পন্ন করেছে। তখন, সে, প্রাকৃতিক প্রতিকূলতার সম্মুখীন হতে গিয়ে, কখনো বা গুরুজনদের দেয় প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ সতর্কতার কথা, এবং অনেকটা স্বাভাবিক প্রবৃত্তির কারণে এখনো সে প্রথমেই বুকে হাত রেখে আবৃত করায় সচেষ্ট হয়।— বলে— ছিঃ আনোয়ার! কোন সময় অলক্ষে, বস্ত্রহরণ করেছ? কেমন খসখসে কণ্ঠে শীৎকারধ্বনি সমৃদ্ধ বিদ্যুৎ হেসে অদ্ভুত ভঙ্গিমায় শরীরে হঠাৎ মোচড় দিয়ে মীরা বানু বিগলিত হয়: ‘আহ্ দাও না’— এমতো উস্কানিমূলক মুদ্রায় আনোয়ার তবু নির্বিকার। নিজের বিবস্ত্র অবস্থা বিস্মৃত সে তার স্বামীর সুশ্রী যৌবনলাবণ্য প্রত্যক্ষ করতে থাকে। তখন আনোয়ার খুব ঘনিষ্ঠ হয়ে তার শরীর বস্ত্রে আচ্ছাদিত করতে শুরু করে নিপুণ পরিচারিকার মতো। এবং এক পর্যায়ে আনোয়ার যখন তার চিবুক ছোঁয় তখন মস্তিষ্কে মুহুর্মুহু বজ্রপাতসহ বক্ষে মেঘের মন্দ্রধ্বনি রণিত হতে থাকে।

—মীরা। সে মূক হয়ে থাকে যেন।

—তুমি জানো তুমি স্বপ্নাবিষ্ট। সে কোনো উত্তর করে না, কোনো শব্দ তার কর্ণকুহরে প্রবিষ্ট হয় না। মনে করা যেতে পারে যে, সে শুধুমাত্র অপলক তাকিয়ে—  শুনতে পায়নি কিছুই। যেন-বা অতি ঘনিষ্ঠজন মুহূর্তে অপরিচিত বনে গেছে। আনোয়ার অস্থির হয়ে ওঠে— মীরা! তীব্র তীক্ষ্ণ শিসের মতো সম্বোধন স্তূপিকৃত মেঘের ভেতর ঢুকে বেগহীন নিঃশব্দ হয়ে পড়ে। আর চোখের পাতা একটু নড়ে উঠে স্থির এবং পূর্ববৎ নির্বাক তাকিয়ে থাকে। এবং তাকিয়ে দ্যাখে উপবৃত্তাকার একটি ঘূর্ণ্যমান গ্রহের উপর পতিত আলো এবং আলোকের অনুপস্থিতি, ফলত অন্ধকার— এদু’টি অবস্থার অতিদ্রুত থেকে মন্থর এবং অতিমন্থর ক্রম পরিবর্তনের মাধ্যমে একসময় শুধুমাত্র অন্ধকারই দৃশ্যমান হয়ে থাকে : 
এ অন্ধকারে হঠাৎ ঘুমভাঙা প্রাণীর মতো আরো এক প্রাণী তার স্বামী—  জেগে ওঠে। অবশ্য মীরা নিজেও ভীষণ কাম-উৎসাহী এবং স্বামী বেচারা যেন অগ্নিকুণ্ড। স্বাভাবিকভাবে হতে গিয়েই বিপত্তি ঘটে যায়। শিশু চিৎকার দিয়ে কেঁদে ওঠে। আর হঠাৎ অগ্নিকুণ্ডে একতাল বরফ পড়ে যায়— এরকম হলে নিরস্ত হতে হয় প্রচণ্ড অস্বস্তিভরে। আর মীরাও স্তনবৃন্ত শিশুর মুখে প্রোথিত করে দ্রুত নিঃশ্বাস ছাড়ে। কিন্তু ওই ভাবটা ছাইচাপা আগুন হয়ে থাকে। এমতো ব্যর্থতায়, শিশু এবং ক্ষেপে-ওঠা স্বামী, ক্রমসংকুচিত লিঙ্গ নিয়ে ঘুমিয়ে গেলেও ওই ভাবটা শরীর চাগিয়ে রাখলে পর মেজাজ খচে যায় শিশুর ওপরই। কিন্তু এরকম এক রাত্রে স্বামী ক্ষান্ত না দিয়ে জোর করলে মীরা এলিয়ে যেতে চায়। শিশু তারস্বরে কাঁদতে থাকে। যখন অন্ধকারের ভেতর আর একটা ছায়া সমস্ত অন্ধকারময় সম্ভাবনাকে ধারণ করে বিলীন হতে চায় অন্ধকারের যোনির ভেতরে, তখন, ঠিক তখন মীরা প্রবল আলোড়িত হয়, এবং অতিদ্রুত, যেন পলকের ভেতরেই, সে তার হাঁটু ভাঁজ করে ঊর্ধ্বে উত্তোলিত করে। ফলত ক্ষিপ্র গতিতে উপগত হতে গিয়েই আনোয়ার হঠাৎ আঘাত পেয়ে পাশে পড়ে যায়, স্থানটি চেপে ধরে যন্ত্রণায় চাপাস্বরে কাতরে ওঠে। এদিকে মীরা বানু শিশুর প্রতি মনোযোগী হয়ে পাশ ফিরলে পর দৃশ্যদর্শনে তার খুব হাসি পেয়ে যায়।

মীরা হঠাৎ শরীর কাঁপিয়ে হাসিতে ফেটে পড়ে। সেই হাসির গমকে মেঘে মেঘে কম্পন জাগে।— হাসছ কেন মীরা? মীরা হাসছে।— হেসো নাতো! সে আর্তকণ্ঠে বলে। মীরা অবাক! কী বলছে লোকটা! মীরা হাসতে থাকে। আর লোকটা ক্ষিপ্তোন্মত্ত সরীসৃপ শব্দে বিষোদগার করতে থাকে : স্পাইডার উওম্যান, স্পাইডার উওম্যান। 

—কিছু বলছ!

মীরা লোকটির ওষ্ঠের অবিরাম যুক্তি-বিযুক্তি লক্ষ করে। ক্ষিপ্র ভঙ্গিতে শরীর সঞ্চালনে দন্তে দন্তে ঘর্ষণসহ মেঘে মেঘে ঘর্ষণ জাগে এবং বিদ্যুৎ চমকিয়ে অসহ্য ধাতব শব্দের বিস্ফোরণ ঘটে : থু দিই, থু :

—কী ব্যাপার? 

—তাই! শালা বুড়ি মাগীরে কিছু না বলে...! ক্রুদ্ধ-উন্মত্ত খিস্তি খেউড়ে প্রথমে মীরা বানুকে কোপিত এবং উপলব্ধির উপকূলে পৌঁছে নিজেও সে সংসারের আটপৌরে গৃহিণী বনে যায়।— মুখ খারাপ করবে না বলছি। যেন-বা রণে ভঙ্গ। এবং নিঃস্তব্ধতা। আবার— হুঁহ্। জবাব নেই। একটু বাদে পূর্বরেশ টেনে— আর তুমি কী যুবকরে! নিঃস্তব্ধতা। মীরা বানু বিস্মিত; সামনের লোকটি আসলে অনিন্দ্যসুন্দর যুবক ভিন্ন প্রৌঢ় অথবা বৃদ্ধ নয়। 

—আমার সঙ্গে তো সারাজীবন খ্যাচাখেচিই করে গেলে। এমতো অনুযোগে লোকটি কোনো কর্ণপাত করে না বরং তার মুখগহব্বর জ্বালামুখ হয়ে অগ্ন্যুৎপাত ঘটায় : চুপ যা ভাতারখাগী বাহোত্তারা!

তাজ্জব! মীরা যেন ঠিক বুঝে শুনে বিপরীত মেরুতে অবস্থান নেয়। শান্ত-সমাহিত কিন্তু ব্যথা-দীর্ণ কণ্ঠে বলে— কী করেছি আমি?

—আ - হ্!

—তুমি শিক্ষক ছিলে।

সে কি অগ্নিতে ঘৃত সংযোগ করে?— মীরাকে পস্তাতে হয়।

—চো-প !

—তুমি রাজনীতি করতে...

—চুপ করো।

—তুমি...

—একদম চুপ।

—ক্যানো?

—ওটাই তো পেয়েছো মওকা। খুনটা যে রাজনৈতিক গুম খুন হয়ে গেল। মাঝখান থেকে ফায়দা লুটলে... বলতে চাই না। ... জারজ ছেলেকে দেখে একনায়কের দরদ উথলে উঠল।— হা!— আর সাহায্য! থুক্!— শুনতে শুনতে মীরা সাময়িক বধির এবং বাকশক্তিরহিত হলে পর কালো-রঙ জমাট মেঘের ভেতর ডুবতে ইচ্ছা করে।

মধ্যপর্ব ২ : বিশাল বাষ্পের মতো সে একাকী উঠে যায় শূন্যের চূড়ায় মুখের গহবর থেকে প্রতি পলে ঝলকে ঝলকে উদগীরণ করে আলো, অতিকায় গ্যাস পিণ্ডময় নীহারিকা তোমার জরায়ু-ছেঁড়া ওই শিশু তোমার পিতা ওই—’

ওরা তোমাকে কেমন রেখেছে?— মীরা কি বোঝে বিষণ্ন হাসে। তবু মৃত্যুটা রাজনৈতিক ফলশ্রুত। একটু থেমে মীরা বলে, রাজনীতির সঙ্গে সংশ্রব তো ছিল তোমার। অতঃপর? অতঃপর কিছু না; কারণ, একটি প্লুতস্বর তাকে স্তব্ধ করে দেয়: ছেলের সংসারে সুখে আছো মীরা?

—স্পাইডার উওম্যান। 

—মানে?

—মাকড়সার মতোন।— বললে যে— ওরকমই।— তুমি কিন্তু বেঁচে গেছ। 

—মিথ্যে! সহসা বিদ্যুৎস্পৃষ্ট ব্যাঙের মতো একবার নড়ে উঠে স্থির, অতঃপর চণ্ডালমূর্তি ধারণপূর্বক বীভৎসরূপ পরিগ্রহ হয় : মিথ্যা কথা!

—কি? মীরাও উচ্চ কণ্ঠে— বলছ কী?

—থাক্!

লোকটির ধ্বসে-যাওয়া কণ্ঠস্বর।

—বুঝতে আমি চাই না।

—যাও তুমি!

—না।

—তফাৎ যা হারামজাদি!

ঠিক তখন ঘিরে থাকা মেঘবলয় ভেঙে যায়। বিচিত্র রঙ মেঘপুঞ্জের সঞ্চালন দ্রুততর হয়। আর মীরা নিজেকে পূর্বাবস্থা থেকে নিচেয় ভাসমান দেখতে পায় এবং লোকটিকেও ক্রমে ঊর্ধ্বলোকে উড়ে যেতে দেখতে পায়। একটি কণ্ঠস্বর তাকে অনুসরণ করে এবং  শ্রুত হয় যে, অলৌকিক স্বরটি একটি বাক্যেরই ক্রমাগত অনুরণিত রূপ : ফিরে যাও মীরা!

—ফিরে যাও!

—ফিরে যাও!

—ফিরে যাও!— ক্রমশ ঊর্ধ্বগামী লোকটির সমস্ত শরীর ভেঙে ভেঙে যাচ্ছে, ঊর্ধ্বে উড়ে যাচ্ছে— এবং সে আরো একবার রূপান্তরিত হয় অতিশয় বৃদ্ধের আদলে, যে, সে কিছু বলতে গেলে পর শুধুমাত্র ঠোঁট এবং জিহ্বাই আলোড়িত হয়; তখন বৃদ্ধ প্রচণ্ড আক্রোশে এক হ্যাঁচকা টানে জিহ্বা উপড়ে ফেলে। এমতো দৃশ্যে মীরা চোখ মুদিত করে এবং কিছুক্ষণ বাদে ধ্বকধ্বকে একটি মস্তক আরো দূরে উড়ে যেতে যেতে কেবল নক্ষত্রসম জ্বলতে দেখে। অনেকক্ষণ ওই নক্ষত্রে দৃষ্টি নিবদ্ধের পর তার সম্মুখে সব কিছুই ঝাপসা হয়ে আসে, চোখ রগড়ে দৃষ্টি দিতে গেলে সে বোঝে ধ্বকধ্বকে মস্তকটি আরো দূরবর্তী হয়ে দীপ্তিমান বা দৃষ্টিসীমার বাইরে অথবা তার নিজেরই নিুগামিতার ফলে সৃষ্ট দূরত্বের কারণে অদৃশ্য।

অন্তপর্ব ১: ‘ভেসে চলে যেতে যেতে ঠেকে গেল পাথুরে চড়ায়—’

পতনোন্মুখ মীরা মহাশূন্যের এমন একস্থানে পৌঁছয় তার ন্যুব্জ ভাঙা-চোরা শরীরে ওজন এবং ভার ক্রিয়া করে এবং পৃথিবী নামক একটি গ্রহের অভিকর্ষক বলের প্রভাবে প্রবল বেগে নিচে পতিত হতে থকে। এরকম ভয়ঙ্কর পতন রোধে সে মরিয়া হয়ে ওঠে। ফলত : অবচেতনে তার শায়িত শরীরের প্রত্যঙ্গ—দুটি পা সামান্য ঊর্ধ্বে উঠে এবং পায়ের গোড়ালি মৃদু ভোঁতা শব্দে বহুকালের খাটের উপর বিছানায় পতিত হয়। মীরা বানু জেগে উঠে। সে অত্যাশ্চর্য হয়—যেন সে জেগে ছিল কিংবা ঘুম-জাগরণের ঘোরে তন্দ্রামতো অবস্থায় স্বপ্নাবিষ্ট হয়ে চমকে উঠেছিল। পুনর্বার চোখ মুদিত করে, স্বপ্নটি জোড়া লাগে যেন এই ইচ্ছা। সম্ভবত সে আর স্বপ্ন ফিরে পায় না। কিন্তু সে পূর্বরূপ আচ্ছন্নের মতো পড়ে থেকে একটি দৃশ্য ভাবে : ধরে নেয়া যেতে পারে মীরা আবার স্বপ্নযাত্রায় আরোহী হতে ইচ্ছা করে। এরপর যখন স্বপ্নযোগ ঘটে, তখন, আবর্তিত ঘূর্ণ্যমান একটি নাগরদোলায় সে স্থিত; যেখানে তার কৈশোর অথবা উষ্ণ যৌবনবতী বয়সে প্রচণ্ড উল্লসে আরোহণ করে। কিন্তু পর্যায়ক্রমিকভাবে তার আসনটি যখন উত্তোলিত হচ্ছে তখন সে প্রচণ্ড ভয়ে ভীত হয়ে উঠে। আর মীরা স্বপ্নভ্রষ্ট হয়, এবং বিস্মিত হয় একারণে যে আগের মতোই ঘটনাটির পুনরাবৃত্তি ঘটে। তবে সে চোখ মুদে অনড় থাকে— সম্ভবত এজন্যে যে, এক : তার স্মরণে আসে যে কোমরে তার প্রচণ্ড ব্যথা। এরকম অবস্থা সে অনুভব করে না যে নড়তেই হবে কারণ অনেকক্ষণ একইভাবে থেকে শরীরে খিল ধরে গেছে : আর দুই : স্বপ্নজালে সে জড়িয়ে পড়তে চায় তা সে যতই মর্মান্তিক কিংবা সুখদ স্বপ্ন হোক; এবং তিন : ইচ্ছামতো স্বপ্ন দেখায় ক্ষমতায় সে আবিষ্কারকের মতো উত্তেজনাবোধ করে। 

আর এতসব অলৌকিক কাণ্ডের ভেতর লোকসমাজের মেলায় ঘূর্ণনরত নাগরদোলায় আপাত অলৌকিক অযৌক্তিক অবৈজ্ঞানিক কেন্দ্রাতিগ বলের তীব্র টানে শুধুমাত্র মীরার আসনটিই ছিটকে যায় অনতিদূরে। আর সঙ্গে সঙ্গে চারদিক থেকে শর নিক্ষেপিত হতে থাকে : যৈবনের ভার সইয্য করতে পারে নাই হে।

হাসির রোল ওঠে 
—সব্বোনাশ! ওর ভাতার—

কারো বিপন্ন উৎসুকতা। 

কান ঝাঁ ঝাঁ করে। কাপড় ঠিক করে মীরা ত্রস্ত ভঙ্গিতে তাকায়। কালা নাগর ভি দেখলোম ধলা নাগর ভি দেখলোম এলা গজবী নাগর না দেখলোম রে পুত! একজন খোনাস্বরে রসিকতা করে উঠে। আবার হাসির হুল্লোড়। 

—থামুন! গলা-ফাটা চিৎকারে তাদের মুখ কুলুপ এঁটে যায়। কিন্তু থোতামুখ ভোঁতা করে বৃত্তস্থ অতঃপর গা টেপাটেপি চোখ চালাচালি চলতে থাকে। এমতাবস্থায় সৌম্যদর্শন একজন এগিয়ে এসে অসহায় মীরার হাত ধরে। সকল চক্ষু আড়াল করে দেয় তার চওড়া কাঠামো। মীরা বানু স্বস্তি অনভব করে; লোকটির একটি হাত মুঠোয় ধরে কৌতূহলী দৃষ্টির বাইরে নিষ্ক্রান্ত হয়। আর সমস্ত কিছু থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে মীরা যখন লোকটির সম্মুখে তখনই বিভ্রান্ত হয়। লোকটি তার স্বামী। (তার তরুণ প্রণয়ী হতচ্ছাড়া দেবর কোথায় অন্তর্হিত হয়ে গেছে!) কিন্তু স্বামী যেন অন্য কোটির মানব, মীরাকে সে কিছুই বলে না। উচ্চবাচ্য কিছু করে না। তবু সে নিজেকে নমিত করে রাখে। এবার সে একটা ঝুঁকি নেয়, কৃতকার্য হয় এবং বিজয়গর্বে আত্মহারা হয়ে পড়ে: বহুদিন আগে অপঘাতে মৃত তার স্বামী পূর্ণ যৌবন নিয়ে তার পাশে স্থিত হয়। পাশে অথচ দূরাগত কণ্ঠস্বর : আমার চোখে চোখ রাখো তো মীরা। যেন এমন এক সিনেমাটিক দৃশ্য, যেন একান্ত দাম্পত্য দৃশ্য— মীরা রক্তিম হয়। অতঃপর ইচ্ছা জাগলে সমর্পিত হতে চায়। আর তক্ষুনি ছন্দপতন ঘটে যায়—  ট্রে-ভর্তি পেয়ালা, পিরিচ সব মেঝেয় পড়ে ছত্রখান হয়ে য়ায়। 

—এ কী!

মীরা ভীত। স্বামী হাসতে হাসতে পশ্চাদ্ধাবিত অতঃপর অদৃশ্য।  একটি কথা এবং কথাটির পাথর-ঘষা ধাতব প্রতিধ্বনি তাকে আতংকিত করে তোলে। মীরা আর্তচিৎকার দেয়। কিন্তু এ কণ্ঠ তারই ফ্যাসফেসে— ভাঙা—জড়ানো—

অন্তপর্ব ২ : ‘ঘুমের তলায় এক দূরদেশে ভরে তুলি দ্বীপ সোনাচূড়া—’

অতঃপর মীরা বুড়ি বিলাপ শুরু করে। এদিকে রাত গভীরতর হয়। অন্ধকার নিকষ হয়। নৈঃশব্দ হন্তারক হয়। অন্ধকার দূরীভূত হয়ে ঊষাকাল অবধি তখন বুড়ি বিলাপ থামাবে কিংবা রাত্রেই কোনো সময়ে শ্রান্ত-ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে যাবে। কিন্তু এখন বুড়ি একটানা গোঙিয়ে অথর্ব শকুনির মতো অমঙ্গলের কালো ছায়া বিস্তার করে, মড়ক-ডাকা ইঁদুরের মতো লালাসিক্ত ঠোঁট ঝুলিয়ে বিলাপ চালিয়ে যেতে থাকে। পাশের ঘরটিতে, তখন, প্রাণবীর্য অন্ধকার জরায়ু মুখে পতিত, প্রোথিত হলে পর রতি-ক্লান্ত ছেলে এবং ছেলে-বউ কোলকুঁজো বুড়ির একনাগাড়ে খিনখিনে বিলাপ শুনতে শুনতে হয়তো-বা আবার ঘুমিয়ে যায় কিংবা বিরক্ত হয়ে ঘুমোবার চেষ্টা করে। 

• আদিপর্ব : ২ থেকে অন্তপর্ব : ২ পর্যন্ত চরণগুলি জয় গোস্বামীর কবিতা থেকে নেয়া

 আরো পড়ুন:                      

 লেখকের প্রকাশিত গ্রন্থ: 
    বরফের ছুরি, ছোটগল্প (২০২০)
    দর্শনীর বিনিময়ে, ছোটগল্প (২০১৯)
    মৌনধারাপাত, উপন্যাস (২০১৭)
    আরব্যরজনীর ঘোড়া, উপন্যাস (২০১৬)
  মেন ইন দ্য সান- ঘাসান কানাফানি [ফিলিস্তিনি উপন্যাসের অনুবাদ] (২০১৫)
    র‌্যাম্প, বার-বি-কিউ আর কানাগলির হুলো, উপন্যাস (২০১৩)
    নামপুরুষ ও অন্যান্য, গল্পগ্রন্থ (২০১১)
  কথাপরিধি: ২২ পয়েন্ট বোল্ড ও অন্যান্য, গদ্য (২০২০)

মন্তব্য

BLOGGER: 1
মন্তব্য করার পূর্বে মন্তব্যর নীতিমালা পাঠ করুন।

নাম

অনুবাদ,32,আত্মজীবনী,26,আর্ট-গ্যালারী,1,আলোকচিত্র,1,ই-বুক,7,উৎপলকুমার বসু,23,কবিতা,319,কবিতায় কুড়িগ্রাম,7,কর্মকাণ্ড,15,কার্ল মার্ক্স,1,গল্প,56,ছড়া,1,ছোটগল্প,12,জার্নাল,4,জীবনী,6,দশকথা,24,পাণ্ডুলিপি,10,পুনঃপ্রকাশ,15,পোয়েটিক ফিকশন,1,প্রতিবাদ,1,প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা,4,প্রবন্ধ,152,প্রিন্ট সংখ্যা,4,বর্ষা সংখ্যা,1,বসন্ত,15,বিক্রয়বিভাগ,21,বিবিধ,2,বিবৃতি,1,বিশেষ,23,বুলেটিন,4,বৈশাখ,1,ভাষা-সিরিজ,5,ভিডিও,1,মাসুমুল আলম,35,মুক্তগদ্য,37,মে দিবস,1,যুগপূর্তি,6,রিভিউ,5,লকডাউন,2,শাহেদ শাফায়েত,25,শিশুতোষ,1,সন্দীপ দত্ত,8,সম্পাদকীয়,16,সাক্ষাৎকার,21,সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ,18,সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ,55,সৈয়দ সাখাওয়াৎ,33,স্মৃতিকথা,14,হেমন্ত,1,
ltr
item
বিন্দু | লিটল ম্যাগাজিন: মাসুমুল আলমের ছোটগল্প ‘মাকড়সা এবং অন্ধকারের গান’
মাসুমুল আলমের ছোটগল্প ‘মাকড়সা এবং অন্ধকারের গান’
https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEhKtCAV6AMYJpIAMAUGCbd1ifABKb0BEwIXBfHuAxtaoO2-cieM2ZeAh387UOhVTdcXihxpnSFVpWr3Sf5OVGyXGR9kndEzJoJ5n4lZEToMxbZKnLnRF9wO3vwmnPumhLSyviuJnlQwXfw/s320/%25E0%25A6%25AE%25E0%25A6%25BE%25E0%25A6%25B8%25E0%25A7%2581%25E0%25A6%25AE%25E0%25A7%2581%25E0%25A6%25B2-%25E0%25A6%2586%25E0%25A6%25B2%25E0%25A6%25AE.png
https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEhKtCAV6AMYJpIAMAUGCbd1ifABKb0BEwIXBfHuAxtaoO2-cieM2ZeAh387UOhVTdcXihxpnSFVpWr3Sf5OVGyXGR9kndEzJoJ5n4lZEToMxbZKnLnRF9wO3vwmnPumhLSyviuJnlQwXfw/s72-c/%25E0%25A6%25AE%25E0%25A6%25BE%25E0%25A6%25B8%25E0%25A7%2581%25E0%25A6%25AE%25E0%25A7%2581%25E0%25A6%25B2-%25E0%25A6%2586%25E0%25A6%25B2%25E0%25A6%25AE.png
বিন্দু | লিটল ম্যাগাজিন
https://www.bindumag.com/2020/10/Masumul-Alam_7.html
https://www.bindumag.com/
https://www.bindumag.com/
https://www.bindumag.com/2020/10/Masumul-Alam_7.html
true
121332834233322352
UTF-8
Loaded All Posts Not found any posts আরো Readmore উত্তর Cancel reply মুছুন By নী PAGES POSTS আরো এই লেখাগুলিও পড়ুন... বিষয় ARCHIVE SEARCH সব লেখা কোন রচনায় খুঁজে পাওয়া গেল না নীড় Sunday Monday Tuesday Wednesday Thursday Friday Saturday Sun Mon Tue Wed Thu Fri Sat January February March April May June July August September October November December Jan Feb Mar Apr May Jun Jul Aug Sep Oct Nov Dec just now 1 minute ago $$1$$ minutes ago 1 hour ago $$1$$ hours ago Yesterday $$1$$ days ago $$1$$ weeks ago more than 5 weeks ago Followers Follow THIS PREMIUM CONTENT IS LOCKED STEP 1: Share to a social network STEP 2: Click the link on your social network Copy All Code Select All Code All codes were copied to your clipboard Can not copy the codes / texts, please press [CTRL]+[C] (or CMD+C with Mac) to copy