রিমিরা থাকত যে শহরে, সেই শহরে আছে এক মৃত নদী। দক্ষিণের সেই শহরে শীত-হেমন্ত ছাড়া মৃত নদী সর্বদাই যেন উষ্ণ নিঃশ্বাস ফেলে চলেছে। ফলত শহরের বাতাস ঈষদুষ্ণ এবং একটুখানি ‘ঘূর্ণি’ উঠলেই ঝরাপাতা আর খড়কুটোসমেত ধুলোওড়া সেই শহরে ‘বাও বাতাস’কেবল ঘুরতে ঘুরতে যায়... বুড়ি ভৈরব তীরবর্তী সেই শহরে রিমির বড় বোন, বাবা—দু’জনই খ্যাতিমান শিল্পী ও সাংস্কৃতিক কর্মী। উচ্চমাধ্যমিকের পর পারিবারিক ধারাবাহিকতায় রিমি এবং রিমিও তথৈবচ। অর্থাৎ ঐ শিল্পী ও সাংস্কৃতিক কর্মী। তার সুললিত কণ্ঠে বিমোহিত শহরের অগ্রগামী চেতনার কতিপয় শিল্পী দ্বিতীয় কোনো মিতালি মুখার্জীকে খুঁজে পায়। ক্রমান্বয়ে সে, মানে রিমি সাংগঠনিক সাংস্কৃতিক চর্চা থেকে ক্রমশ দূরে সরে গিয়ে ইদানীং তার একক বিরল প্রতিভায় গুণমুগ্ধ শিল্পীদের আড্ডাস্থল ফুটপাথের টি-স্টল কিংবা কোনো ময়দানের মধ্যে আলোকদায়ী নক্ষত্র হয়ে বসে থাকে। যেহেতু একমাত্র মেয়ে, পরন্তু সুন্দরী, তাই সে ওদের মধ্যে একটি ফোটা ফুল—এবং সপ্রতিভ গদ্যশিল্পী, চৌকস চিত্রশিল্পী আর কবিতা কারুকর্মের প্রতিবাদী শিল্পীবৃন্দ মনের মধ্যে বিহ্বলতা নিয়ে ওপরে ওপরে স্বাভাবিক থেকে মেয়েটির শিল্প আর শিল্পচেতনার পরোক্ষে কেবল প্রশংসা করে যায়। অচিরে তাদের নিজেদের মধ্যে শুরু হয়ে যায় খুন-প্রতিযোগিতা। ব্যাপারটি রিমি বোঝে এবং সে মজা পায়। খেলা হয়তো আরো চলত, কিন্তু, তবে, এহেন রিমির এক ফরাসি প্রবাসীর সাথে বিয়ে হয়ে গেলে প্রতিবাদী চেতনার শিল্পীসম্প্রদায় পারস্পরিক হিংসার মানচিত্র থেকে সরে যায় এবং সদলবলে গিয়ে তার বিবাহভোজ খেয়ে আসে। তারপর আগের মতোই টি-স্টল কিংবা ময়দানের আড্ডায় ফিরে তারা দ্যাখে যে কথা মোটে এগোচ্ছে না, হৃদয় সমাহিত এবং তারা বোঝে তাদের এতটুকুন জীবনে মেয়ে-সংশ্লিষ্ট আরো একটি পর্ব সাঙ্গ হয়ে গেল।
সেই শহরে নিস্তরঙ্গ সময় বয়ে যাচ্ছিল ধীরে। একঘেয়ে শিল্পচেতনায় সমাচ্ছন্ন শিল্পীরা ঘুরেফিরে সেই একটি টি-স্টল থেকে নীরবে চা পান করে ময়দানে গিয়ে বসত... কোথাও কোনো অভিঘাত নেই যখন, তখন, সময় এবং সব্বাইকে চমকে দিয়ে ময়দানের সামনের রাস্তা দিয়ে অনেকগুলো আর্মি জিপ আর ট্যাংক চলে যায়। পরপরই তারা লোকমুখে জানতে পারে দেশে সামরিক শাসন জারি হয়ে গেছে। দীর্ঘ সামরিক শাসনকালে সময় যেন আবার নিস্তরঙ্গ, আর যেন তা শেষ-ই হতে চায় না, ‘সময়’যেন দীর্ঘ পথটাকে সামনে রেখে প্রচণ্ড ধীরগামী একটা শামুকের পিঠে সওয়ার হয়ে গেছে... এ-রকমটা ভাবতেই সপ্রতিভ গদ্যশিল্পীর চোখে তন্দ্রা নেমে আসে। এই ভাবনা অন্যদেরকে সংক্রমিত করলে চৌকস চিত্রশিল্পী আর কবিতা-কারুশিল্পীদের ক্লান্তিতে কেমন ঝিমুনি এসে যায়। এমতাবস্থায়, শিল্পীসমাজের সময়-চেতনায় দ্বিতীয় অভিঘাতটি আসে।
কী?
না, একটা খবর :
রিমি ফিরে এসেছে, তবে একা।
সামরিক শাসনকালে গোপনে গোপনে দেশজুড়ে আন্দোলন-সংগ্রামের প্রস্তুতির আহ্বানে নয়, শিল্পীবৃন্দ কেবল রিমির প্রত্যাবর্তনে উজ্জীবিত বোধ করল এবং কৌতূহলবশত খোঁজ নিয়ে জানল যে রিমি-কে রেখে তার স্বামী একাই ফ্রান্সে চলে গেছে। রিমি এক-দেড় বছর রাজধানী শহরে থেকে ফের তাদের শহরে চলে এসেছে।
বছর-বছর ব্যাপী সামরিক শাসনের শেষান্তে এসে শহরের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড ক্রমশ প্রতিবাদী রূপ নিতে থাকে। শহরে ধর-পাকড় বেড়ে যায় বিস্তর এবং বহু লোককে ধরে নিয়ে যাওয়ার পর তারা কোথায় আছে — স্বজনেরা তার হদিস পায় না। তখন, অসাংগঠনিক চেতনার সপ্রতিভ গদ্যশিল্পী, চৌকস চিত্রশিল্পী আর কবিতা-কারুশিল্পীবৃন্দ ফুটপাথের টি-স্টল কিংবা ময়দানের আড্ডায় ‘মধ্যবিত্ত মূল্যবোধ ভাঙো’কিংবা ‘Kick the cultural climbers’ অথবা ‘প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা দীর্ঘজীবী হোক’উৎকীর্ণ টি-শার্ট বা গেঞ্জি পরে রিমির আগমনের প্রতীক্ষা করে। রিমি আসে এবং ভেতরে-ভেতরে তারা মোহাবিষ্ট আলোচনায় গতি সঞ্চারকরত: শেষ পর্যন্ত রিমির শিল্পপ্রতিভার এহেন অপচয়ে খুবই হা-হুতাশ করে। সপ্রতিভ গদ্যশিল্পী সংগীতের রিমি-কে গদ্যে অভিষেক ঘটাতে মরিয়া : আপনি লেখেন। আপনি পারবেন। এভাবে, অন্যরাও, মানে চৌকস চিত্রশিল্পী আর কবিতা-কারুশিল্পীবৃন্দ সমান সচেষ্ট : আপনার হবে। আপনি পারবেন, আপনি পারবেন। তারা সবাই, রিমির ভেতর, ভুললে চলবে না যে সামরিক শাসন-বিরোধী প্রস্তুতির মুখে, কেবল রিমির মুখের দিকেই তাকিয়ে দ্যাখে : এ ক আ শ্চ র্য বি র ল প্র তি ভা!
কিন্তু বিরল প্রতিভাধর মেয়ে, মানে রিমি, তার কণ্ঠতে কী যাদু আছে, খুব নিশীথে সেই কণ্ঠ মনে করে — কেমন যেন শীৎকার শীৎকার... সপ্রতিভ গদ্যশিল্পীর নাইটফল হয়ে যায়। সে ভাবে; একবার যখন বিয়ে হয়েছে, মানে রিমি তো শুয়েইছে লোকটার সঙ্গে। রিমি তখন কতবার কে জানে দাম্পত্য মিলনে অ-আ এসব স্বরধ্বনি উচ্চারণ করেছে? এমন ভাবনা রিমি-কে নিয়ে অন্যরাও হয়তো ভেবেছে, কিংবা নয়। যাই হোক, পুরো সামরিক শাসনকাল জুড়ে শহরের পাড়ায় পাড়ায় সাপ্তাহিক ছুটির দিনে কালো প্যান্ট শাদা শার্ট পরিহিত বাটি-বসানো মাথায় কদমছাঁট চুলের রোগা তরুণ অফিসাররা ঘুরে বেড়াত। সেই রাস্তাঘাট, টি-স্টলগুলো ছিল অস্বাভাবিক ফাঁকাফাঁকা। মহল্লার তরুণযুবাপুরুষ প্রায়শ বিরল এবং পাড়ার মেয়েরা সাধারণত বিকালবেলায় ছাদে, ব্যালকনিতে অথবা জানালায় নিদেনপক্ষে বাড়ির সামনের উঠানে পায়চারি করত। ঐ সময়ে তরুণ অফিসাররা পাড়ায়-মহল্লায় আদতে মেয়ে দেখতেই বেরুত। তারা জানত যে, সময়ের বাস্তবতায় অভিভাবকদের কাছে তাদের সবিশেষ প্রাধান্য রয়েছে।
তো, এমতাবস্থায়, সামরিক শাসন যখন শেষ হতে চলেছে, ছোট-ছোট বিক্ষোভ-আন্দোলন যখন বিক্ষিপ্তভাবে পরিলক্ষিত হচ্ছে, তখন, একদিন বাড়ির সামনের রাস্তা দিয়ে রিকশা করে কয়েকবার চক্কর দেয়ার পর দু’জন তরুণ অফিসার রিমিদের সদর দরজায় গিয়ে নিঃসঙ্কোচে কড়া নাড়ে। এই ঘটনার পর রিমি শিল্পী-সন্নিকটে বেশ কয়েক দিন আর আসে না এবং তার দ্বিতীয় বিয়েটি এইবার নীরবে-নিভৃতে হয়ে যায়। ফলত এই তৃতীয় অভিঘাতটি অগ্রগামী চেতনার শিল্পীসমাজকে আরেকবার হতাশ করে। সপ্রতিভ গদ্যশিল্পী বলে : আমি জানতাম। একে তো সুন্দরী মেয়ে, আর সুন্দরী মেয়ের বিয়ের অভাব হয় না। অন্যরা চুপ।
কেবল পারস্পরিক নির্লিপ্ত তাকায় এবং অবশেষে সিগ্রেট।
সামরিক শাসনবিরোধী একটা মিছিলের প্রতি তাদের মনোযোগ আকৃষ্ট হয়। ককটেল ফোটার শব্দ। হৈ চৈ, মুহুর্মুহু শ্লোগান।
সামরিক শাসন কত দিন টেকে? কতবছর বাঁচে সামরিক শাসক? না-কি টিকে যায় অগণন কাল? শুধু রূপবদল হয় তাদের? এক্ষণে বলা যায় যে, তাদের শাসকের মেয়াদকাল ছিল মাত্র সাড়ে ন’বছর। বিরাজমান এই স্বৈরদশায় দ্বিতীয় বিয়ে রিমির শিল্পচর্চা ব্যাহত করবে না? অথচ রিমি শিল্পী ছিল, তার জন্য শহরের প্রতিবাদী চেতনার শিল্পীদের মন খারাপ হলো? এদিকে, প্রধান সামরিক শাসক কত যে কবিতা গান রচনা করেছেন...!
স্বৈরশাসকের পতনের কয়েকদিন আগে, তখন সবে সাপ্তাহিক ছুটি দুই দিন করা হয়েছে, রিমি তার স্বামীর সঙ্গে রাজধানী শহরের আশুলিয়ায় বেড়াতে যায়। বেড়াতে গিয়ে দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পর সে হঠাৎ আশুলিয়া বিশ্বরোডের দু’পাশে বিস্তীর্ণ জলরাশি দেখে বোটে চড়ার দুরন্ত ইচ্ছা প্রকাশ করে। অথচ রিমি সাঁতার জানে না। আর রূপমুগ্ধ স্বামী সুন্দরী স্ত্রীর ইচ্ছাপূরণে তার সাথে বোটে চড়ে ঘুরতে থাকে। ঘুরতে ঘুরতে মৃদুমন্দ বাতাস একটু প্রবল হয়, কিন্তু তাতেই কিংবা তাদের অসাবধানতায় বোট কাত হয়ে গেলে তারা দু’জন পানিতে পড়ে যায়। পানির নিচে কি কিছু আছে? জলদানো? তা না-হলে ঐ সামান্য বুকসমান পানিতে সাঁতার-জানা লোকটি ডুবে মরবে ক্যানো? আর পানির পীর খোয়াজ খিজির কি তাহলে বাঁচিয়ে দিল রিমিকে ফের কোনো ‘অভিঘাত’সৃষ্টির জন্য?
খবরটি যেদিন জেলা শহরে পৌঁছলো উত্তুঙ্গ আন্দোলনের মুখে সেদিনই দেশের প্রধান সামরিক শাসকের পতন ঘটে গেছে। হৈ চৈ আর ককটেল ফাটিয়ে জয়োল্লাস প্রকাশ করছে জনগণ। টি-স্টল আর ময়দানের আড্ডায় লীন ‘বন্ধুরা’সেদিনও নীরবে বসে ছিল : রিমি তাহলে আবার ফিরে আসবে এবং রোহিনীর মতো জলের তলে জল আলো করে নতুন স্বৈরিণীরূপে তাদের মাঝে আবির্ভূত হবে। ততদিন এই মৃত নদী আর ধুলোওড়া শহরে তার জন্য কয়েকটি সামান্য করুণার্দ্র অন্তঃকরণ হয়তো প্রতীক্ষা করে থাকবে!
বই: নামপুরুষ ও অন্যান্য /গল্প / ২০১১, উলুখড়
আরো পড়ুন:
লেখকের প্রকাশিত গ্রন্থ:
বরফের ছুরি, ছোটগল্প (২০২০)
দর্শনীর বিনিময়ে, ছোটগল্প (২০১৯)
মৌনধারাপাত, উপন্যাস (২০১৭)
আরব্যরজনীর ঘোড়া, উপন্যাস (২০১৬)
মেন ইন দ্য সান- ঘাসান কানাফানি [ফিলিস্তিনি উপন্যাসের অনুবাদ] (২০১৫)
র্যাম্প, বার-বি-কিউ আর কানাগলির হুলো, উপন্যাস (২০১৩)
নামপুরুষ ও অন্যান্য, গল্পগ্রন্থ (২০১১)
কথাপরিধি: ২২ পয়েন্ট বোল্ড ও অন্যান্য, গদ্য (২০২০)
মন্তব্য