রাজীব দত্ত, কবি ও চিত্রশিল্পী। ১৯৮৩ সালে বাঙলাদেশের চট্টগ্রাম জেলায় জন্মগ্রহণ করেছেন। চিত্রকলা বিষয়ে একাডেমিক পড়াশুনা করেছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। প্রচ্ছদের জন্য তিনি বর্তমান লেখকদের অত্যন্ত পছন্দের শিল্পী। ২০১৫ সালে মিতাক্ষরা থেকে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর কবিতার বই ‘সাবানের বন’। সম্প্রতি প্রচ্ছদশিল্প এবং সাহিত্যের বিভিন্ন দিক নিয়ে বিন্দুর পক্ষ থেকে তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন কবি ও গদ্যকার নাজমুস সাকিব রহমান। এইবার পাঠক, আপনি পাঠ ও মন্তব্যের মধ্য দিয়ে আমাদের এই যৌথশ্রমের ষোলকলা পূর্ণ করুন।
নাজমুস সাকিব রহমান : রাজীবদা, প্রথমেই জানিয়ে রাখছি, আপনার ‘সাবানের বন’ (২০১৫) আমার পছন্দের একটা বই। আমি আপনার কবিতা পড়তে পছন্দ করি। আমার ধারণা, আরো অনেকে করেন। আমি প্রথমেই জানতে চাই ‘সাবানের বন’ নিয়ে। ওই সময় বইটা কীভাবে তৈরি হয়েছিল?
রাজীব দত্ত : ‘সাবানের বন’-এর কবিতাগুলা একরকম অটোমেটিক রাইটিং। অটোমেটিক বলতে এক বসাতে একেকটা লেখা। মানে একটু একটু করে, এমন না। লেখার পর এডিট করা হয়েছে অনেক, তাও না। খুব কম এডিট। দুয়েকটা শব্দ হয়তো। কবিতাগুলা আমার ওই সময়ের ভাবনা-চিন্তাকে ধারণ করে হয়তো। এখন আর ওইভাবে লিখতে পারব না। এখন একটা-দুইটা লাইন হঠাৎ মাথায় আসে। টুকে রাখি কোথাও। পরে ওইগুলাকে একটা আকার দিই।
ওই বইয়ের অনেক কবিতা এখন আমার নিজেরই ভালো লাগে না। ওইগুলো বই বের হবার আশপাশ সময়ের লিখা। মানে তার আগের কয়েক বছর বা এমন। আরো বেশ কয়েক বছর পরে বই করলে হয়তো অনেক কবিতাই রাখতাম না, বা বইই করতাম না।
তখন আমাদের এক বন্ধু, দ্বৈপায়ন, চিটাগংয়ের। সে কিছু বই করার প্ল্যান করে। আরো কয়েকজনের সাথে আমাকেও বলে পাণ্ডুলিপি রেডি করতে। করি। সে ছাপায়। আমার সাথে মাহমুদ আলম সৈকত এবং জাহেদ মোতালেব ভাইয়ের বই ছাপানো হয়।
সাকিব : আপনি কি কবিতা লেখা কমিয়ে দিয়েছেন?
রাজীব : হ্যাঁ। কবিতা কমই লিখি এখন।
রাজীব দত্ত-র প্রচ্ছদ |
রাজীব : মারজুক ভাইয়ের কবিতা আগে মোটামুটি পড়া ছিল। তো, বইটার প্রচ্ছদ করার যখন প্রস্তাব পাই পাবলিশারের পক্ষ থেকে, একটু দ্বিধা নিয়ে শুরু করি। দ্বিধা বলতে উনার (মারজুক রাসেল) পছন্দ হয় কিনা। উনার আগের বইগুলোর কাভার দেখা ছিল। মনে হয়েছিল, এইগুলো উনারে রিপ্রেজেন্ট করে না প্রপারলি। মানে উনার বইয়ের যে টোন, বলার যে ধরন-তা উঠে আসে নাই ঠিক।
তো, মনে হইল, তথাকথিত সুন্দর কিছুর বদলে আমার যে ছবি আঁকার স্টাইল, ওইটা অ্যাপ্লাই করি কাভারে। তো করি। উনারও পছন্দ হয়। এইই। এরকম কাভার, মানে এই যে স্টাইল, আমার পেইন্টিংয়ের মতোন করে, এরকম আগেও করেছি বেশ কিছু। এটাই প্রথম এমন না। তবে উনি যেহেতু পপুলার অনেক, কাভারটা প্রচুর পরিচিতি পায়। আর সবাই এটার কথাই বেশি বলে। পরে ওই স্টাইলে কয়েকটা বইয়ের কাভার করার প্রস্তাব পেয়েছিলাম। যেটা বলা দরকার, প্রচ্ছদ করতে গিয়ে প্রকাশক এবং মারজুক ভাই যে ফ্রিডম দিলেন, ওইটা জরুরি ছিল। ওইটা না পাইলে নিজের মতোন করে কাজ করা যাইতো না।
রাজীব দত্ত-র বই ‘ফরসা একটা ফল গড়িয়ে যাচ্ছে’ |
রাজীব : রিয়েলিস্টিক আঁকাআঁকিটা আমাদের শিখতেই হয় পড়তে গেলে। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা তো ইংরেজদের চালু করা শিক্ষা ব্যবস্থার সম্প্রসারণ। চারুকলাও এর বাইরে না। জয়নুলও এখানে যা দেখতেছি, তা হুবহু আঁকার স্কিল শেখাতে চাইছিলেন। মানে মোটাদাগে। তো, আমরা ওই শিক্ষার বাই প্রোডাক্ট। এ কারণেই শিখছিলাম। তখন ভালোও লাগত। কিন্তু আমাদের একাডেমিক শিক্ষার শেষের দিকে এসে, মানে চিটাগং চারুকলায়, নিজের মতোন করে আঁকার সুযোগ দেয়া হতো। তখন আঁকতে আঁকতে মনে হল, এই যে যেরকম দেখি ওইরকম আঁকার যে ধরণ, এটার কিছু কৌশলগত সমস্যা আছে। যেমন ধরেন, আপনি পুরা একটা পেইন্টিং খুব স্কিলফুলি আঁকলেন। কিন্তু শেষে গিয়ে কোথাও এটা ভালো হলো না। হয়তো অল্প একটু মাত্র। ধরেন, পুরা একটা ফিগারের একটা আঙুল জাস্ট কোনো কারণে ডিস প্রোফেশনেট হয়ে গেল। তখন পুরাটাই ইমব্যালেন্স লাগতে পারে।
রাজীব দত্ত-র প্রচ্ছদ |
রাজীব : রিয়েলিস্টিক স্টাইলে আঁকার আরেকটা যেইটা সমস্যা এইটাতে কী বলতেছি ওইটার চেয়ে, কীভাবে বলতেছি ওইটাই বেশি পাইওরিটি পেয়ে যায় বেশি। অন্তত আমাদের দেশে। আমাদের এখানে এরকম আঁকতে পারার একটা পপুলার সাইডও আছে। ওইটার কারণেও অনেকে চারুকলায় পড়তে আসে। অথচ ইংরেজরা আসার আগে এখানে আর্ট এমন ছিল না।
এখানকার নকশী কাঁথা এমনভাবে আঁকা হয়, আপনাকে কাঁথার চারপাশ ঘুরে দেখতে হবে। এখানে রাবণের দশটা মাথা। গনেশের হাতির মাথা। চিন্তা করেন কী ভয়াবহ ইমাজিনেশন। আবার শিবলিঙ্গ দেখেন- কীরকম বিমূর্ত! তান্ত্রিক আর্টেও এ বিমূর্ততা আছে। এখানকার আর্ট ফিগারেটিভও। অ্যাবস্ট্রাক্টও। কালারফুলও। আবার মিনিমাম কালারেও। মিনিমালও। ইংরেজরা আসার পর এখানকার আর্টের এসব বিষয়গুলা আস্তে আস্তে গৌণ হয়ে গেল।
রাজীব দত্ত-র প্রচ্ছদ |
রাজীব : কী প্রসঙ্গে কী বলছিলাম ভালো মনে নাই এখন। যা মনে হচ্ছে, বড় হতে হতে আমাদের যে ইমাজিনেশন পাওয়ারটা আমরা হারায় ফেলি ওই রকম কিছু মেবি। যেটা একটু আগে বলতেছিলাম, গনেশের মাথা হাতির। সাথে চারটা হাত। এই যে ইমাজিনেশনটা, এটা বাচ্চারা বেশ পারে। তারা সহজাতভাবে এটা পায়। তারা যা-ই আঁকে, তার পিছনে একটা গল্প থাকে। ওদের মতোন করে একটা লজিকও থাকে।
কিন্তু বড় হইতে হইতে এটা কমতে থাকে। মানে আমাদের যে স্যোশাল স্ট্রাকচার, ওইটা ওদের এই বিষয়গুলা আস্তে আস্তে নষ্ট করে দেয়। ইমাজিনেশনের যে ওয়াইল্ড দিকটা থাকে, তা কমতে থাকে। সো কলড লজিক্যাল হয়ে উঠতে থাকে। ফলে ইমাজিনেশনের সাথে সাথে যে গল্পগুলা তৈরি হতো ওইগুলা আর থাকে না। তাকে তখন একটা হাতিকে আকাশে উড়াবার আগে ভাবতে হয়, হাতি এত বড় উড়বে কেমনে? বা আকাশ কি গোলাপী হয় নাকি! ও না ভাবলেও আমরা নানানভাবে ফোর্স করি, যেন ভাবে।
সাকিব : আপনার লেটারিং ইউনিক, কিন্তু মনোটোনাস। এরকম একটা প্রসঙ্গে আপনি বলেছেন, একজনের লেখাই তো। নানান রকম লেখা কঠিন। আমরা প্রত্যেকে প্রত্যেকের কাছে এত ভার্সেটেলাইটি আশা করি কেন?
রাজীব দত্ত-র প্রচ্ছদ |
রাজীব : আমাদের এখানে মহাভারতেও দেখবেন, সবাই নানান বিষয়ে এক্সপার্ট। আমরা ছোটবেলায় দেখতাম, মেয়েরা বিশেষ করে হারমোনিয়াম শিখতোই। এটা একরকম অলিখিত নিয়ম ছিল। সাথে রান্না-বান্না, সুঁই-সুতার কাজ। কিন্তু এখন এত সময় কই! বাপ-মা বাচ্চার নাম রাখার আগেই ঠিক করে ফেলে, সন্তানকে ডাক্তার বানাবে নাকি ইঞ্জিনিয়ার।
আমরা আস্তে আস্তে একটু একটু করে কমপার্টমেন্টাল হয়ে গেছি। জানাশোনার সাথে আয়-রোজগারের সম্পর্ক এখন মাস্ট। অনেক কিছু শিখে সময় নষ্ট করার বদলে একটা কিছু শিখে ওইটা দিয়েই আমাদের যত দ্রুত পারা যায় আয়-রোজগারে নেমে যেতে হচ্ছে। ইকনোমিকাল দিকটা মুখ্য হয়ে উঠাতে সাধ থাকলেও সাধ্য কমে গেছে। সময় কমে গেছে। কম্পিটিশন বেড়ে গেছে। তাই আমরা যে প্রত্যেকে প্রত্যেকের কাছে ভার্সেটাইলিটি আশা করি, এটাতে আমি দোষের কিছু দেখতেছি না। আমরা যে পারতেছি না, এটাই সমস্যা।
রাজীব দত্ত-র প্রচ্ছদ |
সাকিব : আপনার কি কখনো মনে হয়েছে, বইয়ের চেয়ে প্রচ্ছদ ভাল হয়ে যাচ্ছে? সেক্ষেত্রে কীভাবে ডিল করেন?
রাজীব : বইয়ের কনটেন্ট ভালো না খারাপ এটা আমি খুব একটা দেখি না। দেখা জরুরিও না মনে হয়। দেখি বইটা কী নিয়ে। আর আমাকে পর্যাপ্ত ফ্রিডম দেয়া হচ্ছে কি না। দিলে কাভার ভালো হয়। প্রচ্ছদকে তো এখানে খুব বেশি আক্ষরিকভাবে মিলানো হয় বইয়ের বিষয়ের সাথে। এটা করার ফলে কাভার খুব ইলাস্ট্রেটিভ হয়ে ওঠে। এটা থেকে মুক্তি পেলে প্রচ্ছদ এজ এ শিল্প আরো ভালো হয়ে উঠবে।
সাকিব : হাসনাত শোয়েবের ‘ব্রায়ান অ্যাডামস ও মারমেইড বিষ্যুদবার’ (২০১৭) বইয়ের প্রচ্ছদ নিয়ে কোনো স্মৃতি কি শেয়ার করবেন? ডালিম কি আপনার পছন্দের ফল?
রাজীব : শোয়েবের দুইটা বই বাদে বাকিগুলা মনে হয় আমার করা। শোয়েবকে তো অনেকদিন ধরে চিনি। ওর লেখার ধরনের সাথেও আমি রিলেট করতে পারি। মনে হয় এ কারণে ও আমাকে করতে দেয়। আমার মতোন করে করার ফ্রিডমও দেয়। তাই ওই ফ্রিডমটাকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করি। স্রেফ বিউটিফুল কিছু করার বদলে, কনসেপচুয়াল কিছু করার চেষ্টা করি।
আমাদের এখানে বিউটি ক্রিয়েট করাটা বেশি প্রাইওরিটি পেয়েছে বরাবর। আমি চেষ্টা করছি এটা থেকে বেরোতে। তবে বিউটিফুল কাভার আমাকেও করতে হয়। কনসেপচুয়াল কাভার এখানে আগেও হয়েছে। ব্রাত্য রাইসু, সাখাওয়াত টিপু, রনি আহম্মেদ, উনাদের বইয়ের কাভার এমন। তবে যে পরিমাণ বই বের হয় রিগুলার, এরকম কাভার খুবই কম। ডালিম পছন্দের ফল বা এমন কিছু না। আর ওই একটা কাভারেই আমি শুধু ডালিম ইউজ করেছি।
আরও পড়তে পারেন:
দারুণ৷ সাক্ষাৎকার আরো পড়তে চাই এই সময়ের সাহিত্যকর্মীদের
উত্তরমুছুনদারুণ লাগল৷ আমি রাজীব দত্তের প্রচ্ছদের ফ্যান৷ তার কবিতা পড়েছি শুধু বিন্দুতে৷ তার কথাগুলোও ভাল লাগল৷ মুফতে তার কয়েকটা প্রচ্ছদ দেখলাম৷ কিন্তু মানুষটার কোন ছবি নেই, ক্যামন হয়ে গেল না?
উত্তরমুছুনহঠাৎ করেই শেষ হয়ে গেল যেন... তবু ভালো লাগলো... জানতে পারলাম অনেকটাই... 💖
উত্তরমুছুন