এক পশলা বৃষ্টি তীব্র গরমের পর। চারিদিকে ছড়িয়ে থাকা গরমি গুমোট উধাও হচ্ছে থেকে থেকে। হালকা হাওয়া আমাদের পাশের বাড়ির নারকেল গাছের মাথা নিয়ে ছিল টানার মতো এদিক ওদিক টানছে। মাথা ভারি হয়ে আছে গাছের অজস্র নারকেল হওয়ায়। আমাদের নয়ের দশকের জীবন। একদিকে লেখার গতি, চিন্তার গতি কমে আসছে অন্যদিকে মানব সভ্যতায় একটু একটু পা রাখছে বিজ্ঞানের শ্রেষ্ঠ প্রযুক্তি কম্পিউটার। আর এর পরের দশকেই আসতে আসতে গ্রামের মাঠে বা শহরের আনাচে কানাচে বসছে টেলিফোনের টাওয়ার। বিংশশতাব্দীর শেষ দশকের স্মৃতি উস্কে কেমন যেন একটা গান আকাশবাণী কলকাতা দূরদর্শন থেকে প্রায় সম্প্রচার হতো। নাম 'মিলে সুর মেরা তুমহারা'। ছোটবেলার নস্টালজিয়া উস্কে দিয়েছে দোঁহার এই অভাবনীয় আয়োজন। যেদিন থেকে পোষ্টার দেখেছিলাম, মনে আর মাথায় একটাই ছবি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে আমাদের নব্বই দশকের সেই সাদা কালো ছবির ডিসপ্লে। আসলে আজকের একটি বিষয় ভীমসেন জোশী। ভারতবর্ষের ইতিহাস ও সংস্কৃতি এবং এর সঙ্গে জড়িয়ে থাকা গান কোথাও হয়তো জীবনের গান। ছোটবেলায় আমাদের শাসন আর আজকের শাসনের মধ্যে যে বিরাট পার্থক্য সেটা এখন খুব ভালোভাবেই উপলব্ধি করতে পারি। আর আমাদের সময় গানের কদর যেমন ছিল, তেমনই ছিল শ্রোতা। আমার এক এক সময় মনে হয় উচ্চ মার্গের শিল্পের যদি কখনও কোনো তালিকা করা হয় সেখানে, সুরের প্রাধান্য থাকবে ওপরে।
মিলে সুর মেরা তুমহারা,তো সুর বানে হামারাসুর কি নাদিয়া হার দিশাসে ব্যেহেকে সাগর সে... মিলে
আমাদের জীবন এবং প্রবাহ আর এই প্রবাহের সঙ্গেই মিশে আছে সংগোপনে আমাদের সুর। সপ্তম সুর যেভাবে আমাদের মনকে করে বিচলিত, প্রাণময় সেই সুরের আবেশ অনেকটা ভারী হয়ে থাকে শ্রোতার মনে। আর বাজতে থেকে অহরহ। একের পর সঙ্গীতের মার্গ তিনি রচনা করেছেন সময়ের সঙ্গে সঙ্গে। আরও একটি অনুষ্ঠান হতো দূরদর্শনে ধারাবাহিকভাবে। সেটা একটা দীর্ঘ খেয়াল। অসাধারণ কম্পোজিশন। সুর কোথাও উঠছে আবার কোথাও নামছে। ক্রমাগত নামা ওঠা।
আসলে ভারতবর্ষের মতো দেশে যেখানে জাতি ও সংস্কৃতির এতো গায়ে গায়ে বাস,সেখানে একটি সুর কখনও বিচ্ছেদের মতো থাকে না, থাকে এক সুরে মালার মতো। ভিম সেন জসী। ভারতীয় মার্গ সঙ্গীত বা হিন্দুস্থানী শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের প্রবাদপ্রতিম শিল্পী। তিনি মূলত ধ্রুপদী সঙ্গীত গাইলেও খেয়াল গায়ক হিসাবে বেশি পরিচিত। এছাড়াও ভজন, ঠুংরি, দাদরার মতো শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের অন্যান্য ধারায় ছিল তাঁর সহজাত। ১৯৭২-এ পদ্মশ্রী, ’৭৫-এ সঙ্গীত নাটক অ্যাকাডেমি, ’৮৫ সালে পদ্মভূষণ এবং ২০০৮ সালে ভারত সরকার তাকে দেশের সর্বোচ্চ অসামরিক পুরস্কার ভারত রত্ন প্রদান করে। গান গেয়েছেন হিন্দি, কন্নড়, মরাঠির মতো একাধিক ভাষার চলচিত্রে।
আমাদের তিনতলার ঘরের রাস্তার ধারের জানলা। মুষল ধারায় বৃষ্টি শুরু হয়েছে। সকাল থেকেই ভাবছি স্কুল যাব কিনা। স্কুল কামাই বিষয়টা ছোট থেকেই কেমন যেন নেগেটিভের লিস্টে থেকে গেছে। বাড়ির রেডিও তখন আসতে আসতে সরে যাচ্ছে, নেগেটিভ ফিল্মের রিলের ক্যাসেট ঢুকছে। আমরা তখন মাথার চুল একটু উল্টে আঁচড়ানো শিখছি। গানের তালিম কিছুটা জেনেছিলাম মানে শিখেছিলাম তবলা শিখতে গিয়ে। দাদরা, ত্রিতাল, কাহারবা, তেওড়া একের পর পর সব এক তাল। কখনও কখনও স্কুলের তবলার স্যার রেডিওতে চালিয়ে দিয়েছেন পণ্ডিত ভীমসেন জোশীর শাস্ত্রীয় খেয়াল। হয়তো একটি তাল তেওড়া চলছে-
ধা দেন তা তেটে কতা ঘদি ঘেনে
অথবা
ধা ঘেরে নাগ তে টে গদ্দি ঘেরে নাগ
প্রায় ঘন্টা খানেক টানা চলছে। আমরা ক্ষুদে তবলচি। বিস্ময় দেখছি। একদিকে পণ্ডিতজির গভীর মগ্নতা যেন একেবারে আত্মমগ্ন হয়ে তিনি ভেতরে প্রবেশ করেছেন সুরের। কোথাও 'মা ' 'পা ' ধরে টানা বিলম্বিত লয় আবার কোথাও তিনি তেহাই ধরছেন থেকে থেকে। গান যে কি বিরাট মাপের শিল্প তাঁর সবচেয়ে বড় উদাহরণ হয়তো আমাদের রবীন্দ্রনাথ। প্রায় আড়াই হাজার গান। সঙ্গে সুর। এই সুরের কত পথে আমাদের বাঙালির মানুষ হেঁটেছেন এবং হাঁটছেন।
একের পর এক তিনি ভজন গেয়েছেন। 'রাম রাম জও ', ' জয় দুর্গে দুর্গতি পরিহারিণী '। গান কোথায় যেন জীবনের মন্ত্রের কথা বলে তাঁর গলায়। উচ্চাঙ্গ রাগের ক্ষেত্রে গলার যে সরলীকরণ বা গলার যে কম্পনতার কারুকর্যতা তাঁর প্রতিটি স্কেল বা নোট যে এতো বিশুদ্ধ তা আমরা সাধারণ শ্রোতা হিসেবে খুব ভালোভাবেই বুঝতে পারি। এই যে স্কেলের কথা বললাম, এই স্কেল অর্থাৎ আমি বলব এখানে কম্পনের মাত্রা। এই মাত্রায়তো আমাদের উপলব্ধি করাতে শেখায় মানবজাতির সঙ্গে প্রাণীর, গ্রহের সাথে ব্রহ্মের অথবা সদ্যজাত সন্তানের সাথে জন্মদাত্রীর। সঙ্গীতের ভাব আর আমাদের মতো সাধারণ শ্রোতাদের অমরত্ব লাভ কোথাও যেন এক হয়ে যায়। আমরা যখন শাস্ত্রীয় সঙ্গীত বা শাস্ত্রীয় মার্গের শিল্পের কথা ভাবি, দেখি শুনি বা বোঝার চেষ্টা করি, তখন সেখানে আমাদের সবচেয়ে বেশি নকিং সেন্স যাতে কাজ করে, সেটা হল নিজেদের কান। এই কান ছোট থেকেই অদ্ভুতভাবে তৈরি হয়ে যায়। শ্রবণের মধ্যেই আমরা নিজেদের সাপোর্ট সেন্স( মানে আমি বলতে চাইছি, আমাকে কীভাবে প্রলোভিত করা হচ্ছে, একটা নির্দিষ্ট শব্দের মধ্য দিয়ে ) খুঁজে পাই, সেই সেন্স বা অনুভূতি আমাকে উপলব্ধিতে উত্তীর্ণ করে। পণ্ডিতজির বিখ্যাত গান -" মিলে সুর মেরা তুমহারা".. কি অসাধারণ সুর দিয়ে তৈরি আমরা দেশবাসী জানি। একটা সুরকে খাদ থেকে অনায়াসে চড়া'তে নিয়ে যাচ্ছেন। একটা দেশের গান, দেশের ঐক্য হওয়ার সুর, একটা নয় নানা বিধ নানা জাতির মধ্যে সেই সুরকে রাখতে হবে। হিন্দু, জৈন, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, ইসলাম সবকেই একটা তারের মধ্যেই বেঁধে একটাই সুর নির্মাণের কাজ করেছেন। আজকের শতাব্দীতে এই গানের শ্রোতা প্রায় ১৩০ কোটির বেশি। যে গানে বর্ষার প্রকৃতি বা সুরের ধরণের মধ্যে আছে একটা স্বতন্ত্র সুর। সেই সুর কোথাও আমাদের প্রতিটি ভারতবাসীর এক এবং অদ্বিতীয় হয় আছে, সুরের মহাত্ম এইখানেই যে একটা বিরাট জাতি ও জনগোষ্ঠীর একমাত্র ধারক হয়ে থাকবে। একই গানের লিরিকও দেশের বিভিন্ন ভাষাভাষী মানুষের মুখে নিজের শব্দ ও স্বর হয়ে সুর হচ্ছে, এও এই গানের একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য। একই গানের এই বিরাট একটা কম্পোজিশন, শুধুমাত্র ভারতবর্ষের সঙ্গীত স্রষ্টার ক্ষেত্রেই এক এক কালে সম্ভব হয়েছে। আমরা গান শুনি, যুগে যুগে গান আমাদের কাঠিন্যতা থেকে তরলতা দান করেছে, সুর আমাদের পৈশাচিকতা থেকে মনুষ্যত্বের আদল মন নির্মাণ করেছে।
সবশেষে বলতে পারি, আসলে P. B . Shelly এর সেই বিখ্যাত উক্তি, Our sweetest songs are those that tell of saddest. সত্যিইতো আমাদের চির বিরহের গান আমাদের আনন্দের গাঁথা। সাধারণ একজন গানের শ্রোতা হয়ে আমরা অদ্ভুতভাবেই পণ্ডিত ভীমসেন জোশীর গানের স্পর্শ পেয়েছি, পেয়েছি চেতনার স্পর্শ আর আত্মার উত্তরণ।
তোমার সুর আমার সুর, সৃষ্টি করুক ঐক্যসুর
ভিমসেন জোশী: স্বর চেতনার স্পর্শ আর আত্মার উত্তরণ
ধীমান ব্রহ্মচারী
ভিমসেন জোশী: স্বর চেতনার স্পর্শ আর আত্মার উত্তরণ
ধীমান ব্রহ্মচারী
মন্তব্য