আজিমপুর হয়ে যে–রাস্তাটি পিলখানা রোডের দিকে চলে গেছে তারি বাঁ পাশে গাছপালার ভেতর এগিয়ে গিয়ে একখানি ছোট্ট কুটীর। ঘরের মেটে দেয়ালগুলির উপরের অংশ গলে গেছে অনেকদিন–রোদ-বৃষ্টি আর হাওয়ার অবারিত যাতায়াত এই ঘরের মধ্যে। মরচে-ধরা বহু পুরানো টিনের সুরাখ দিয়ে দেখা যায় নীল আসমানের ছিটে-ফোঁটা।
মা ও ছেলে শুয়ে আছে চাটাই বিছিয়ে।
সন্ধ্যাবেলা হালিমা খুবই মেরেছিলো নবীকে। সাত বছর গিয়ে আট বছরে পা দিয়েছে নবী। হালিমা তাকে এক বিড়ির কারখানায় ভর্তি করে দিয়েছে। কাজ না শিখলে দিন-গুজরানোর উপায় থাকবে না। নবীকে দুধের বাচ্চা রেখেই বাপ তার ইন্তেকাল করেছে। একা হালিমা তার জন্যে কী-ই-বা করতে পারে?-নিজের পেট পালতেই তার সাত বাড়ি ঘুরতে হয়; কাজ না পেলে ভিক্ষা করতে হয় এবং সন্ধ্যাবেলা গিয়ে বসে থাকতে হয় গোরস্তানের গেটের কাছে। কবর জেয়ারত করতে এসে অনেকেই দান-খয়রাত করে, তাদের কাছ থেকে দু’চার পয়সা হালিমার বরাতেও জুটে যায় কখনো-কখনো। নবী অবশ্যি বিনে মাইনেই বিড়ির কারখানায় কাজ করে। মালিক শুধু দুপুরবেলা একবার খেতে দেয়। এখনো সে পাকা হয়ে ওঠেনি বিড়ি বাঁধায়। কাজ সম্পূর্ণ শেখা হয়ে গেলেই সে মাস মাস পাঁচ টাকা করে পাবে মালিকের কাছ থেকে।
কিন্তু নবী আজকাল ফাঁকি দিতে শুরু করেছে। কোন অছিলায় কারখানা থেকে বেরিয়েই সে যে কোথায় চলে যায়, কেউ বলতে পারে না। সন্ধ্যা পর্যন্ত তার আর দেখাই মেলেনা। এ নিয়ে কারখানার মালিক তিন দিন নালিশ করেছে হালিমার কাছে- আজ তাকে হুঁশিয়ার করে দিয়েছে, সে নবীর কাজ ছাড়িয়ে দেবে, অমন দুষ্ট ছেলেকে দিয়ে তার দরকার নেই।
সারাটা বিকাল গোস্বায় আগুন হয়ে ছিল হালিমা। ছেলে যদি কোন কাজ না শিখে, তার কি কোন ভবিষ্যত আছে? অথচ, ছেলে এমনি মগড়া যে এদিকে তার মনই বসে না। মন বসবেই বা কেন? মা তো রয়েছে তার জন্যে ভিক্ষা করতে, বাঁদীগিরি করতে।
সন্ধ্যায় নবী বাড়ি ফেরার সঙ্গে সঙ্গেই হালিমা ধুমধাম করে কতকগুলি কিল বসিয়ে দেয় তার পিঠে। সারাদিন কাটায় কোথায় নবী?- জানতে পীড়াপীড়ি করেছিলো হালিমা; কিন্তু ওর কাছ থেকে জবাব পাওয়া কঠিন। সে শুধু ফুলে ফুলে কেঁদেছে। কাঁদতে কাঁদতে না খেয়েই সে ঘুমিয়ে পড়ে।
হালিমা খেতে বসেছিলো, কিন্তু দু’এক লোকমা গিলেই সে উঠে পড়ে–তার পেটেও আজ ভাত গেলোনা। কতো অনুনয়-বিনয় করেছে হালিমা, কিন্তু তাতে অভিমানী শিশুর মন গললো না, শুধু দু’একবার চোখ মেলে হালিমার দিকে তাকিয়েছিলো। তারপর মুখ গম্ভীর করে সে নিজেকে ঘুমের কোলে সঁপে দেয়।
গলে-যাওয়া দেয়ালের উপর দিয়া হালিমা তাকিয়ে আছে আসমানের দিকে। একটা হাত তার নবীর উপর রাখা। ওর পিঠে কঞ্চি ভেঙ্গেও কোন দিন খুব ব্যথা পায় না হালিমা,–কিন্তু আজ এই মুহূর্তে ঘুমিয়ে পড়া ছেলের উপর হাত রেখে তার বুকটা হু-হু করে ওঠে। সত্যি এতোটুকু ছেলে, কী-ই-বা বোঝে? বাপতো মরে গিয়ে বেঁচে গেছে, বাপ-মার যুগল দায়িত্ব নিয়ে বেঁচে আছে হতভাগিনী হালিমা। এভাবে যখন-তখন ওকে মারপিট করা খুবই অন্যায়। কিন্তু কাজ যদি কিছুই না শিখে সংসারে ও বাঁচবে কি করে? হালিমা তো আর চিরদিন বেঁচে থাকবে না যে, নিজের দিন গুজরানোর কথা নবীর না ভাবলেও চলবে!
হালিমা চোখ আঁসুতে ভরে আসে। আসমান থেকে নজর ফিরিয়ে নিয়ে সে চুমা খায় নবীর কপালে।
নবী আস্তে আস্তে চোখ মেলে চায়, আর দরজার দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে বলে ওঠে-মা, এইডা কে?
–কই রে? বিস্মিত হালিমা প্রশ্ন করে।
–উই যে গেলো, ডান হাত বাড়িয়ে নবী অপরিচিতের যাওয়ার পথটি দেখায়।
–কেউ না, উত্তর দেয় হালিমা।
–তুমি লুকাইবার চাও?–নবীর অভিমান যেন ফুলে ওঠে–খুব ছুন্দর একটা মানুষ গেছে না? রাঙ্গা ধবধবা–আর পিন্দনে ছুন্দর কাপড়?
–ছুন্দর মানুষ? হালিমার বিস্ময় এবার আরও বেড়ে যায়।
–হ, চোখ দু’টি বড় করে নবী বলে–মিঠাই লিয়া আইছিল, তোমার কাছে দিয়া গেছে না মা?
–হ, দিয়া গেছে, একটা করুণ হাসিতে হালিমা প্রায় আর্তনাদ করে উঠে–তারপর একটু শান্ত হয়ে বলে, নবী এখন তুই ঘুমা–বিহান বেলা খাবিনে মিঠাই?
–লোকটা কোত্থে আইছিল মা? নবী আবার প্রশ্ন করে–দুইডা পাখনা দেখছ পিঠে?
–পাখনা?-হালিমার আক্কেল সত্যি এবার হার মানে। আধো আলো আধো অন্ধকারের মধ্যে দিষ্টি তীক্ষ্ণতরো করে সে তাকায় নবীর মুখের দিকে, কিছুই ঠাহর করে উঠতে পারে না।
নবী আবার বলে–হ, পাখনা; মউরের পেখমের মত ছুন্দর!
হালিমা এবার আরও কাছে টেনে নেয় নবীকে, পিঠের উপর হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে–ফিরিছতা আইছিলরে–ফিরিছতা! আইছ ছবে–বরাত না! ঘরে ঘরে আইয়া খোঁজ–খবর লিছে মানুষের! ফিরিছতাগো আইজ ছুটি!
ফেরেশতা এসেছিলো! নবীর সারা গা হঠাৎ রোমাঞ্চিত হয়ে উঠে! এক দারুণ উত্তেজনায় সে উঠে পড়ে বিছানা ছেড়ে।
রাতটা কী চমৎকার! রূপা-গলা জোছনায় ধুয়ে ঢলঢল করছে সারা পৃথিবীর গা! সন্ধ্যায় ঘরে ফেরার সময় নবী দেখেছে মসজিদে মসজিদে কুরআন তিলাওৎ করছে ছেলেমেয়েরা। এখন রাত হয়েছে অনেক, তবু শাহ–বাড়ির মসজিদ থেকে কুরআন তিলাওতের শিরীন আওয়াজ ভেসে আসছে–গোরস্তান গমগম করছে মানুষে! আজ ঘুমিয়ে নেই কেউই, ফেরেশতার সঙ্গে, মৃতদের রূহের সাথে আজ মোলাকাত করবে সবাই, নিজেদের সুখ-দুঃখ, আশা-আকাঙ্ক্ষার কথা ফেরেশতা মারফত জানাবে আল্লাহর কাছে। শুধু নবী আর হালিমাই ঘুমিয়ে সুযোগটা নষ্ট করেছে। তাদেরই দুয়ারের সুমুখ দিয়ে চলে গেছে আল্লাহর ফেরেশতা অথচ তাদের চাওয়ার কথা–দুঃখ যন্ত্রণার কথা কিছুই জেনে যায়নি–কিছুই জানানো হলো না তাকে!
বাতি ধরিয়ে হালিমা ছেলের হাব ভাব পরীক্ষা করে। একবার বলে–কিরে, তোর খিদা লাগছে খুব? ভাত খাবি এখন?
নবী কোন জবাব দেয় না। খিদার কথা সে ভুলেই গেছে একদম। মন তার আচ্ছন্ন হয়ে আছে এক মধুর কঠিন ভাবনায়। ফেরেশতারা খবর নিয়ে যায় আল্লাহর কাছে! তাদের খবরও কি নিয়ে গেছে ফেরেশতা? সে কি গিয়ে বলবে না, শবে বরাতের রাতেও সে ঘুমে দেখে গেছে নবী আর হালিমাকে?
–ফিরিশতারে কিছু কইয়া দিছো মা? আবার জিজ্ঞাসু হয় নবী।
কিছু বুঝতে না পেরে হালিমা চুপ করে থাকে।
–দুয়ারের কাছ দিয়া গেলো, আর কিছু কইয়া দিলা না? করুণ হয়ে উঠে নবী–আমারে ডাকলা না ক্যান মা?
–আরে পাগল, হালিমা তার জ্বালা চেপে রাখতে পারেনা, ফিরিছতা আমাগো কতা ছুনবো ক্যান? বড় লোকগো খোঁজ–খবর করবার লাই না আইছে! আমাগো দুয়ারের কাছ দিয়া তাগো বাড়িই হে গেছে।
নবী চুপ করে থাকে কিছুক্ষণ, তারপর হঠাৎ প্রশ্ন করে বসে–তুমি নামাজ পড়ো না ক্যান মা?
–কি অইবো নামাজ পইড়া? হালিমার কন্ঠে একটা পরম বিতৃষ্ণা প্রকাশ পায়।
–কী অইবো কি! নবী বিস্মিত হয়, যারা নামাজ পড়ে, তাগো বাড়িতেই না ফিরিছতা আহে; আল্লা তো তাগো কতাই ছোনে।
–না রে না, হালিমা একরকম চিৎকার করে ওঠে, আল্লা তো ঘুমাইয়া রইছে। ছুন্না–রুপা দিয়া ছেজদা করলেই হে চায়। গরীবের সোদা নামাজে হের মন ভিজে না।
নবী ঘাবড়ে যায়। কাঙ্গাল যারা, মিসকিন যারা, তাদের আর কোন ভরসাই তাহলে নেই। এতো সোনা–রুপাও তারা পাবে না, তাদের আরজুও গিয়ে পৌঁছুবে না আল্লাহর কাছে। আর এ জন্যই তো গরীবদের যারা নামাজ পড়ে তাদের মালদার হতে দেখা যায় না। দুঃখ তাদের ঘুচছে কই! সোনা–রূপার শিরীন আওয়াজেই তাহলে ঘুম ভাঙ্গে আল্লাহর! সেই জন্যই বুঝি মালদারেরা আরো মালদার হয়, একগুণ দিয়ে পায় সত্তর গুণ।
কিন্তু তিনি তো পয়দা করেছেন সবাইকে। তিনি কেন তার রহমত একতরফা কেবল মালদারের মধ্যেই বিলিয়ে দেবেন! কোনদিন কি ঘুমের ঘোরেও দরিদ্র বান্দার দুঃখে অশ্রুসিক্ত হয়ে ওঠে না তাঁর চোখ? সত্যি কি গরীবেরা তাঁর ঘুম ভাঙ্গাতে পারে না?
হতাশার আঁধারে নবীর মন হাতড়ে ফিরতে থাকে। দুয়ারের সুমুখ দিয়ে ফেরেশতা চলে গেল, দবদবে আগুনের মতো রঙ, ময়ূরের পেখমের মতো বিচিত্র বর্ণের দু’টি ডানা তার পিঠে, আর গায়ে সে কী খোশবু! শাদা ধবধবে তাজী ঘোড়া কোমর নাচিয়ে নাচিয়ে চলছে ফেরেশতাকে নিয়ে। নবী জেগে থাকলে আজ শুয়ে পড়তো ফেরেশতার পথে, আর মিনতি করে বলতো তাদের রক্তের ঢেউ–ওঠা অফুরন্ত দুঃখের কাহিনী। কথা না শুনলে সে ঝুলে পড়তো তার ডানায় ধরে–ফেরেশতার সাথে সাথে উড়ে উড়ে সেও চলে যেতো একেবারে আল্লার কাছে! অমনি চোখ না মেললে নবী চিৎকার করতো গলা ফাটিয়ে, খামচিয়ে রক্তাক্ত করে ঘুম ভাঙ্গাতো আল্লাহর!
কিন্তু তা তো আর হলো না। অথচ সবকিছুরই চাবি রয়েছে আল্লাহর হাতে। তাঁর ঘুম ভাঙ্গাতে না পারলে ভাগ্যের মণি–কোঠা আর কে-ই বা খুলে দেবে!
আবার বিছানায় শুয়ে পড়ে নবী। রাজ্যের যত চিন্তা এসে জটলা পাকায় তার মনে। হালিমাও বাতি নিবিয়ে নবীর কাছে গা এলিয়ে দেয়। ছেলে দু’চোখ মেলে তাকিয়ে আছে বাইরের দিকে, হালিমা তা দেখছে না, শুধু বুক দিয়ে অনুভব করছে নবীর বুকভরা অস্বস্তি। একবার পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে হালিমা বলেঃ নবী, অনেক রাত অইছে- তুই এখন ঘুমা!
ছেলে আসমানের দিকে চেয়ে থাকে চুপ করে, আর একটা পথের খোঁজে কল্পনা তার হয়রান হয়ে পড়ে। আকাশ ভরে, পৃথিবী ভরে এতো জোছনা- তবুও যেন কতো অন্ধকার, চোখের সাথে মনও হারিয়ে যায় সে অন্ধকারে।
হঠাৎ একবার তার চোখে বিজলি ঝিলিক দিয়ে যায়, অকুল দরিয়ায় যেন নারিকেলকুঞ্জ–ছাওয়া উপকূলের আভাস পেয়েছে নবী। খুশিতে, আবেগে রোমাঞ্চিত হয়ে ওঠে তার সারা দেহ। হয়েছে, আর ভাবতে হবে না। আরশের পারায় রশি লাগিয়ে সে টান মারবে। রশিতো তার হাতেই রয়েছে। এবার থেকে নির্বিকার ভাব ঘুচে যাবে আল্লাহর।
পরদিন গতরাতের পানিভাত খেয়ে কারখানায় কাজ করতে যায় নবী। যাবার ইচ্ছা তার মোটেই ছিলো না, হালিমাই পাঠালো অনেক শাসিয়ে।
হালিমা বলে–নিজের হাতেই গড়তে হবে কপাল, খালি আল্লাহর কাছে আরজি পেশ করলেই চলবে না।
কয়েকটা ছেলের সাথে নবী বিড়ি বাঁধছে, কিন্তু মন তার পড়ে আছে পিলখানার ওপাশে, ফণিমনসায় ঘেরা নির্জন জায়গাটুকুতে। কারখানা পালিয়ে লোকচক্ষুর আড়ালে ঐখানে সে রোজই আপন মনে ঘুড়ি ওড়ায়। এ খবর সে ছাড়া আর কেউ জানে না। পৃথিবীতে লুকিয়ে শিশু তার কচি হাত দুটি বাড়িয়ে দেয় আসমানের দিকে। কিন্তু হাত আর কদ্দুরই-বা ওঠে? নবীকে তাই নিতে হয়েছে ঘুড়ি– ঘুড়ি উড়িয়ে সে তার আর্তি এতদিন অজান্তেই উপর হতে আরও উপরে, আরশের দিকেই তো পাঠিয়েছে।
পেট ব্যাথার অজুহাত তুলে নবী বেড়িয়ে পড়ে কারখানা থেকে। মুহূর্তের জন্যও আজ সে স্থির হতে পারছে না। অতি সন্তর্পণে বাড়ি পৌঁছে নবী। মা বাড়ি নেই। নবীর আনন্দের সীমা থাকে না। তিনটা পাতিল তচনচ করে সে বার করে দু’আনা পয়সা–ওহ! দু’আনা পয়সা তো নয়, সাত রাজার ধন! পয়সাগুলি মুঠায় পুরে নবী ছুটে যায় নবাবগঞ্জে। সুতা কিনে সে আবার দৌড়াতে শুরু করে দেয়। এক নতুন অভিযানের নেশায় বুক তার কাঁপছে।
জঙ্গলের ভেতরকার এক পরিত্যক্ত ভাঙা দালানের অন্ধকার গুহা থেকে নবী বার করে একটা ঘুড়ি আর লাটাই। এই ঘুড়িই তাকে রোজ কারখানা থেকে বার করে আনে কাজ ভুলিয়ে, এই ঘুড়িই তাকে পৃথিবীর সীমানা ছাড়িয়ে আসমানের পথে নিয়ে যায়। আর সব ব্যাপারেই নবীর মুখে খই ফোটে, কিন্তু এই ঘুড়ির কথা সে কারো কাছে বলে না। এ যেন তার নেহাতই পুশিদা খেলা, একান্তভাবেই নিজস্ব।
এক সময়ে নবী চলে যায় পিলখানার পাশে, সেই ফণিমনসায় ঘেরা নির্জন জায়গাটুকুতে। পুরানো সুতাটার সঙ্গে নতুন সুতা গেরো দিয়ে সে ঘুড়ি উড়িয়ে দেয় আসমানে। ঘুড়ি যতই উপরে উঠতে থাকে উল্লাসে অধীরতায় নবী ততোই উত্তেজিত হয়ে ওঠে। একটা স্মিতহাস্যে তার মুখ থেকে চোখ পর্যন্ত ঝিলিক দিয়ে ওঠে বার বার; আরশের পায়ায় রশি লাগিয়ে আজ সে সজোরে টান মারবে।
ক্রমেই ঘুড়িটা ছোট হয়ে আসে। এক সময়ে যখন হাতের সুতা শেষ হয়ে গেলো, নবীর দুঃখের সীমা রইলো না। সুতা শেষ হয়ে গেছে, কিন্তু ঘুড়ি যে দেখা যাচ্ছে এখনো। আল্লাহ কি এতো কাছে? তা তো নয়, মানুষের দৃষ্টি সীমার বাইরে অনেক–অনেক দূরে আরশের উপর ঘুমিয়ে আছেন তিনি। এতো কাছে হলে তো খালি চোখেই তাঁকে দেখা যেতো। সুতা চাই তার, আরও অনেক সুতা–যা তার ঘুড়িকে নিয়ে যাবে মেঘের ওপারে, আরশের একেবারে কাছটিতে। কিন্তু তার জন্যও দরকার পয়সা। সে যে সুতা কিনবে, সে পয়সাই বা তার কই? তাদের দুর্দশা তা হলে আর ঘুচবে না! আসমানের দিকে তাকিয়ে নিজের ব্যর্থতায় সে আর্তনাদ করে ওঠে।
কিছুক্ষণ ঘুড়ি উড়িয়েই বাড়ি চলে আসে। এই সুতায় হবে না, আরও অনেক সুতা চাই। বামনের হাত বাড়িয়ে আরশের পায়া ধরা অসম্ভব। পরম যত্নে সে ঘুড়িটা লুকিয়ে রাখে ভাঙা দালানের নির্জন অন্ধকারে।
বেলা চলে যাচ্ছে, ঘরেও পয়সা নেই। পয়সা চাইতে গেলে হালিমা কঞ্চি দিয়ে তার পিঠের ছাল না তুলে ছাড়বে না। যা দু’আনা পয়সা আজ সে আলগোছে সরিয়েছে তার জন্যই তার বরাতে কী আছে, কে জানে?
তবু নবী লোভ সামলাতে পারে না। আজকের লেখা পালটাতে হলে কিছু খরচ, কিছু ক্ষতি স্বীকার করতে হবে বৈ কি! মা’র অবর্তমানে নবী উলটিয়ে পালটিয়ে দেখে ঘরের সব ক’টা হাড়ি–পাতিল–ছেঁড়া কাপড়ের বোঁচকাগুলি খোঁজে তন্নতন্ন করে। একটা পয়সা নেই কোথাও। থাকবেই বা কী ক’রে। ভিক্ষা করে, পরের বাড়ি কাজ করে যা দু’চার পয়সা পায় তাতে করে মা–বেটার আধপেটা খাবারই হয় না কোনোদিন, তারা আবার জমাবে পয়সা।
হঠাৎ নবীর মনে পড়ে গেলোঃ ইস্টিশনে গেলে দু’চার পয়সা পাওয়া যেতে পারে। তার বয়সী ছেলেদের সে কুলিগিরি করতে দেখেছে অনেকদিন। সে আর ভাবতে পারে না, এক পেট খিদা নিয়েই ছোটে ইস্টিশনের দিকে। অনেকক্ষণ বসে থকতে হলো। তারপর গাড়ি যখন এলো, নবী তাজ্জব বনে যায়–কত বিচিত্র রকমের মানুষ আর কত রঙ–বেরঙের পোশাক! বাক্স, বিছানা, পেটরা প্রভৃতিতে স্তূপীকৃত হয়ে ওঠে লাইনের কাছটুকু। ‘মুটে চাই’, ‘কুলি চাই’ চিৎকারে হারিয়ে যায় আর সব আওয়াজ।
সবার বরাতেই একটা না একটা কিছু জুটলো; কিন্তু নবীর কপাল বড় খারাপ। ‘মুটে চাই’ বলে চিৎকার করতে গিয়ে আওয়াজ এলো না তার গলায়। হাত দু’টি চাওয়ার ভঙ্গিতে উপর দিকে উঁচিয়ে সে ছুটে যায় এক কামড়ার সুমুখ থেকে আরেক কামড়ার সুমুখে–চোখ তার করুণ, আঁসুতে টলোমলো।
কিন্তু ভিক্ষুক মনে করে কেউ কেউ তাকে নসিহত করে শ্রমের মর্যাদা সম্বন্ধে, আর অতি আধুনিক কেউ–কেউ দেয় গলাধাক্কা, কারো কাছ থেকে কিছু পেলো না। ট্রেন চলে গেছে। ইস্টিশনে বসে বসে নিজের বদ–নসীবের জন্য বেদনায় নবীর মন ভরে আসে। দুঃখটা তার কাছে এবার আরও বড় হয়ে দেখা দেয়। মায় বেটায় কোনদিন একবেলা পেট ভরে খেতে পায় না। কোনদিন একেবারেই উপাস করতে হয়। বছরে একবার করেও যদি একটা কাপড় কিনতে পারতো। সেই যে তার বাপ ছেঁড়া শততালি দেওয়া কাপড়গুলি রেখে গিয়েছিলো সেগুলিই আরো তালি দিয়ে এবং গেরোর উপর গেরো দিয়ে তারা দু’জনে পরছে। ঘরে মেটে দেয়াল তো প্রায় সবটাই গলে গেছে, বৃষ্টি হলেই টিনের সুরাখ দিয়ে ‘উসসিলা’ পড়ে ঘর ভেসে যায়; দুর্দশার আর সীমা–পরিসীমা নেই। কেবল আল্লাহর কাছে তাদের দীলের আরজু পৌঁছাতে পারলেই অবসান হতো এই দুঃখ–রাতের।
কিন্তু হালিমা নামাজ পড়ে না, নবীও সূরা এবং রাকাতগুলি শিখবার সুযোগ পায়নি। ওদের কথা আল্লাহ কেনই–বা শুনবেন?
ঘন্টাখানেক পরে আরেকটা ট্রেন যখন এলো নবীর আনন্দ দেখে কে। ট্রেন থামাবার আগেই ‘মুটে চাই’ ‘কুলি চাই’ বলে হাত তুলে সে চিৎকার শুরু করে দিলো।
ট্রেন থামলে ঘড়ি–পরা একটা বলিষ্ঠ হাতের ইশারায় নবী প্রথম শ্রেণীর কামড়ার সুমুখে এসে দাঁড়ায়। ভদ্রলোক একটা এটাচি ও হোল্ডঅল দেখিয়ে দিয়ে বললেন– ওয়েটিং রুমে নিতে পারবি?
–ক্যান পারুম না? তাচ্ছিল্যের সাথে নবী জবাব দেয়– দেন আমার ঘাড়ে তুইল্যা।
–কত নিবি?–ভদ্রলোকের ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠে।
–আমার বহুত পইছা লাগবো–চোখ দুটি বড় বড় করে সে বলে–আপনে কতো দিতে পারবেন?
ভদ্রলোক এবার দৃষ্টি প্রখরতরো করে নবীর মুখের দিকে তাকান। অদ্ভুত ছেলে তো! বলেন–এতো পয়সা দিয়ে কী করবি?
–বা রে, পইছার বুঝি কাজ নাই! নবী বিস্ময় প্রকাশ করে–ঘুড্ডির রছি কিনুম যে–অনেক রছি!
ভদ্রলোক এবার সত্যিই হেসে ফেললেন। হোল্ডঅলটা নবীর মাথায় দিয়ে এটাচিটা হাতে করে তিনি নেমে পড়েন গাড়ি থেকে। ওয়েটিং রুমে এসে চার পয়সার জায়গায় চার আনা দিয়ে বলেন– এই নে, অনেক সূতা হবে।
নবী সিকিটা ছুঁড়ে মারে ওয়েটিং রুমের মেঝেয়– না, আমি নিমু না। চার আনায় আমি কী করুম? আমার অনেক রছি লাগবো। আমার ঘুড্ডি আসমান ছুইবো গিয়া।
ওর মেজাজ দেখে সবাই অবাক হয়। ভদ্রলোক সিকিটা হাতে নিয়ে হাসতে হাসতে বললেন– ঘুড়ি আসমান ছুঁলে তোর কী হবে?
–ক্যান, আরছের পায়ায় বাজাইয়া টান দিমু– এক স্বপ্নিল নেশা আর শক্তির স্ফূর্তিতে নবী মুহূর্তে যেন বিরাট কিছু হয়ে ওঠে– আল্লা খালি আপনাগো কতাই ছুনবো, আমাগো কতা বুঝি হের ছুনোন লাগবো না?
এবার সকলে এ–ওর মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে থাকে। পরিবেশটা মুহূর্তে যেন কেমন থমথমে হয়ে ওঠে। কারো মুখে টু শব্দটি নেই। ভদ্রলোক পকেট হতে একটা আধুলি বের করে বলেন– এই নে, এখন হবে তো?
আধুলিটা হাতে নিয়ে কৃতজ্ঞতায় আঁখি ছলছল করে ওঠে নবীর। আন্তরিকতা মিশিয়ে বলে– আমাগো যখন অনেক পইছা অইবো, তখন আমাগো বাড়ি আইয়েন–জেব ভইরা দিয়া টাকা পইছা দিমু আপনেরে।
ওর কথায় সবাই হেসে ফেলে। যিনি আধুলিটা দিয়েছেন তিনি তো একেবারে উচ্ছসিত হয়ে উঠলেন। তাঁর আজকের এই মেহেরবানীর কথা নবী কখনো ভুলবে না– দিন যখন ফিরবে, নবী দুই জেব ভর্তি করে পয়সা দিয়ে তার ঋণ শোধ করবে। হাসতে হাসতেই বলেন– হাঁ, হাঁ, নিশ্চয়ই আসবো, আমরা সবাই আসবো সেদিন– আল্লাহ তোকে অনেক টাকা পয়সা দিন।
নবী এসব শুনবার জন্য অপেক্ষা করে না। সে সোজা চলে যায় চকের দিকে। অনেকটা সুতা কিনে যখন বাড়ি ফিরল তখন সন্ধ্যা মিলিয়ে গেছে। সে সুতাটা লুকিয়ে রেখে আসে ভাঙা দালানে– তার ঘুড়ির পাশে।
হালিমা ভিখ করে আনা চাল জ্বাল দিচ্ছে আর সুরবুর হচ্ছে ধোঁয়ায়। গাছতলা থেকে ভেজা– বন কুড়িয়ে এনেছে আগুন ধরবার জন্য। নবীকে দেখেই চোখ কচলাতে কচলাতে বলে– কিরে, অতক্ষণে কোত্থে আইলি?
মা’র দরদ–ভরা প্রশ্নে নবী ভারি খুশি হয়। তার মেজাজ তাহলে আজ বিগড়ে যায়নি। হয়তো পাতিল তচনচ করে পয়সা নেবার খবরটি মা এখনো জানতেই পারেনি। মনে মনে আল্লাহকে সে শুকরিয়া জানায়।
–কারখানা থে বার হইয়া একটু ঘুইরা আইলাম মা, মার দিকে চেয়ে সহজ গলায় সে বলে!
চুলায় বন ঠেলতে ঠেলতে হালিমার কন্ঠে দরদ ভেঙে পড়ে–কাজ থুইয়া পালাস নে বাপ! কাজটা ছিখলে না ঘরে টাকা পইছা আইবো। কাজ না জানলে ভাতকাপড় জোটে না রে! কাজ ছাড়া আমাগো মা–পুতের কি উপায়ই বা আছে। এবার ছেলের মুখের দিকে চেয়ে হালিমা প্রশ্ন করে– হারে নবী, তোর খিদা লাগছে–না?
মা–র আন্তরিকতায় নবী তার খিদার কথা একরকম ভুলেই যায়। তাছাড়া, একদিকে রশি কেনার আনন্দ, অন্যদিকে মার স্নেহ–দু’য়ে মিলে আজকের দিনটিই যেন অপূর্ব হয়ে উঠেছে। নবী হেসে বলে–না মা, আমার খিদা লাগছে না। কারখানায় আমাগোরে দুপুর বেলা খাওয়ায় কিনা!
–তাই ভালা, হালিমা সায় দেয়–ভিখের ভাত পেডে যতো কম যায় ততোই ভালা। এ ভাতে ছেলে–মাইয়াগো ‘বাইড়’ থাকে না।
রান্না হ’লে নবী ও হালিমা, দুজনেই কিন্তু ভিখের ভাত পেটে ঢেলে কিছুটা স্বস্তি বোধ করে।
পরদিন কারখানার কথা বলে নবী একটু সকাল সকালই ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ে। আজ আবহাওয়া খুবই অনুকূল এবং নবীর হাতে অনেক সুতা! পৃথিবীতে দাঁড়িয়ে আজ সে অনায়াসে তার হাত পৌঁছে দেবে আসমানে।
নবী ঘুড়িটাকে পয়লা বুকের কাছে চেপে ধরে–বুক তার ঢিপ ঢিপ করছে। কিছুক্ষণ পরেই ঘুড়ি উড়লো আসমানে- হাওয়ার ভরে নেচে নেচে, দুঃসাহসের দোলায় কেঁপে কেঁপে ঘুড়ি উঠে যায় উপর হতে উপরে–আরো উপরে! সুতা আজকে ফুরাতে চায় না, ঘুড়ি ক্রমেই ছোট হয়ে আসছে–অই বুঝি ঘুড়ি হারিয়ে যায় দৃষ্টির ওপারে, অসীম শূন্যতায়! আবেগে ঔৎসুক্যে বড় হয়ে আসে নবীর চোখ দু’টি। তার বুকের শ্বাস দীর্ঘ হতে দীর্ঘতর হয়ে আসে, ঠোঁটের বাঁধন খুলে গিয়ে একটা অদ্ভুত হাসির আমেজ লাগে তার সারা মুখে। ঘুড়ির নাচের সঙ্গে সঙ্গে একটা অপূর্ব চঞ্চলতায় নবীর বড়–হয়ে আসা চোখের চকচকে তারা দু’টি নাচতে থাকে।
এক সময় নবী টের পায়–লাটাই আর ঘুরছে না–সুতা শেষ হয়ে গেছে। সেই নির্জন ফণীমনসায় ঘেরা জায়গাটুকুতে নবীর বুক ছাপিয়ে কান্না আসে। ঘুড়ি এখনো দৃষ্টি-সীমার ভেতরেই উড়ছে!
নবী ঘুড়ি নামিয়ে আনলো। আরো রশি চাই তার–অ-নে-ক রশি! আল্লাহ তাঁর আসন এত দূরে পেতেছেন কেন, নবী বুঝতে পারে না! কিন্তু দূরে আসন পাতলেই কি তিনি আরশে বসে নির্বিকার থাকতে পারবেন? সংসারে কি রশি নেই যে তাঁর আরশ ছোঁয়া যাবে না, টলিয়ে দেয়া যাবে না পায়ায় রশি লাগিয়ে? বাধা পেয়ে নবীর আকাঙ্ক্ষা আরো প্রবল হয়ে ওঠে।
চিরদিনকার মতোন ঘুড়ি আর লাটাই লুকিয়ে রেখে আজো সে ছুটে ইস্টিশনের পথে। পয়সা চাই, তার রশি কেনার পয়সা–যে রশি আরশের পায়ায় বেঁধে আল্লাহকে সে নামিয়ে আনবে মাটির মানুষের মধ্যে!
শেষ পর্যন্ত দু’আনার বেশি জোটে না। কিন্তু তা দিয়ে কতটুকু সুতাই আর কেনা যায়!
এমনি করে রোজ কিছু কিছু পয়সা আয় করে নবী- আর তাই দিয়ে সুতা কিনে সুতাটায় জুড়ে দিয়ে ঘুড়ি উড়িয়ে দেয় আসমানে।
পিলখানার ওপাশে ওই স্থানটুকু সে একান্ত আপন করে নিয়েছে, অনেকদিন। অমন নির্জন নীরব পরিবেশে আসমান ছাপিয়ে ওঠে তার দুর্জয় সাহস। কিন্তু হাতের সুতা যখন শেষ হয়ে যায় এবং ছোট হতে হতেও ঘুড়ি যখন থেকে যায় দৃষ্টির ভিতরেই, নবীর তখনকার দুঃখ দেখে কে? তবু মন তার ভেঙে পড়ে না–সাফল্যের নিকট–সম্ভাবনা তাকে করে তোলে আরো সাহসী, আরো জেদী।
রোজ সে কারখানার কথা বলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়–কিন্তু কোথায় বা কারখানা, আর কোথায় বা নবী? ইস্টিশনে, বাজারে নটিগিরি করে যা দু’চার পয়সা পায়, সবই খরচ করে সূতা কেনে। দিনে দিনে সূতা দীর্ঘ হতে দীর্ঘতর হয়ে ওঠে।
একদিন সত্যই ঘুড়িটা ছোট হতে হতে একটা কালো বিন্দুর মতো হয়ে আসমানের অসীম শূন্যতায় হারিয়ে গেল।
ডোর ধরে রেখে আসমানের দিকে চেয়ে আছে নবী, আর প্রচন্ড কাঁপুনিতে থর থর করে উঠছে তার শরীর। উত্তেজনায় তার কপাল দিয়ে ঘাম বেরিয়ে এলো, বিস্ময়ে বিহ্বলতায় দম যেন বন্ধ হয়ে আসতে চাইছে–একটা করুণ হাসিতে মধুর হয়ে উঠলো শিশুর মুখ। আজ যেন টানাটানি পড়ে গেছে আসমান আর পৃথিবীর মধ্যে–কে হারে কে জেতে–এবং তারই আকর্ষণ যেন সে অনুভব করছে হাতের রশিতে। শুধু একটা রশি–টনটন করছে আসমানের আকর্ষণে। হয়তো দৃষ্টির আড়ালে থেকে কেউ টানছে রশি ধরে–আর সেই টানে ফুলে ফুলে উঠছে নবীর হাতের শিরা–উপশিরা।
রশি বেয়ে বেয়ে নবীর বিস্মিত দৃষ্টিও হারিয়ে যায় আসমানে। আজকে আর ঘুড়ির রশি গুটাবে না, লোকচক্ষুর ওপারে ঘুড়ি উড়ে বেড়াক আপন ইচ্ছায়–আপন খুশিতে। এক সময় হয়তো আটকে যাবে আরশের পায়ায়–আরো শক্ত টান পড়বে হাতে, তখন রশিতে টান দিয়ে সে টলিয়ে দেবে আল্লাহর আরশ! চকিত আঁখি মেলে আজ আল্লাহ মাটির মানুষের দিকে তাকাবেন–অনিচ্ছায়ও শুনতে হবে তার দুঃখী বান্দার কাহিনী–তাদের বঞ্চনা, লাঞ্ছনা ও যন্ত্রণার কথা!
নবী চেয়ে আছে উপর দিকে–শুধু একটা সুতা–সিরাতের পুলের মত সূক্ষ্ম একটা সিঁড়ি–বেহেশত আর দুনিয়ার মাঝখানে। মাঝে মাঝে সাদা, কালো, নানা রঙের মেঘ আনাগোনা করছে এবং আতকা টান পড়ে পড়ে ঝন ঝন করে উঠছে সুতাটুকু- মেঘ টুকরা হয়ে যাচ্ছে সে সুতার ধারে।
এক সময় চোখ দু’টি পানিতে ভরে এলো। আল্লাহর আরশ ঠিক কোনখানটিতে রয়েছে তা সে জানে না; কিন্তু আজ তার মনে হল–সে যেন তার বিদ্রোহের নিশান আরশের কাছাকাছি কোথাও পাঠিয়ে দিয়েছে–আর যেন দূর নয় বেশি।
পেটের খিদা, মা ও সমস্ত সংসার–সব কিছুই ভুলে যায় নবী। সন্ধ্যার পরও অনেকক্ষণ ডোর ধরে ও দাঁড়িয়ে থাকে। কই, কোথাও তো আটকে গেল না ঘুড়ি। এক সময় সে সুতা গুটিয়ে ঘুড়ি নামিয়ে আনে নিচে এবং জমিন ছুঁবার আগেই ঘুড়িটাকে চেপে ধরে তার বুকের মাঝে; ঘাড় নিচু করে সে পরশ নেয় ঘুড়ির- কেমন যেন একটা অদ্ভূত গন্ধ পায় নাকে আর ঘুড়িটাকে মনে হয় ভেজা–ভেজা।
আহ! নবীর বুকে খুশি আর সামাই পায় না যেন। বহুদিন পর আল্লাহ আজ তার গরীব বান্দার দুঃখে কেঁদেছেন আর তাঁরই আঁসুর ধারায় সিক্ত হয়ে উঠেছে নবীর ঘুড়ি।
আরশের পায়া ধরে আর টান দিতে হলো না; এর আগেই আল্লাহ কেঁদে ফেলেছেন তাঁর বান্দার দুঃখে। নবী আজ সত্যিই বিজয়ী–তার অভিযান সফল হয়েছে। আজ থেকে আর কোন দুঃখই থাকবে না তাদের।
বাড়ি ফিরে দেখে হালিমা বিছানায় পড়ে কোঁকাচ্ছে। জ্বর এসেছে! জোহরের সময়ই ঘরে চলে এসেছিলো–আজ কপালে কিছুই জোটেনি। মনটা খারাপ হয়ে গেল নবীর–আল্লাহ যদি তাঁর বান্দার দুঃখে কাঁদবেন তো তার মা–র জ্বর কেন আজ? তাদের ঘরে আজ ভাত জুটবেনা কেন? এ তাহলে আল্লাহর আঁসু নয়– শয়তানের পেশাব! শয়তান চায় না যে, মানুষের দিলের আরজু পৌঁছুক গিয়ে আল্লাহর কাছে।
নবী বুঝতে পারে–তার আরও অনেক সুতার দরকার হবে। সাত তবক আসমান পেরিয়ে গিয়ে তবেই না আল্লার আরশ! সকাল বেলা জ্বর নিয়েই হালিমা উঠে পড়ে। কয়েক বাড়ি ঘুরে কিছুটা ফ্যান যোগাড় করে নিয়ে আসে তার জন্যে।
নবী বলে–তুমি খাবা না, মা?
–না, হালিমা ধীরে ধীরে বলে–তুই খাইয়া কারখানায় যা!
নবী পিয়ে পিয়ে ফেনটা গিলে নেয়। তারপর মাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলে–তুমি চিন্তা কইরোনা মা–আল্লা আমাগো উপরে মুখ তুইলা চাইবো। এ হাল আমাগো বেছি দিন থাকবো না।
হালিমা ছেলের দিকে চেয়ে একটু করুণ হাসি হাসে– কিছু বলে না। টলতে–টলতে এক সময় ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। সে জানে না যে নবী কারখানায় যায় না এক দিনও– বাজারে, ইস্টিশনে মুটেগিরি করে আর পিলখানার পাশে গিয়ে ঘুড়ি উড়ায়।
নবী মুটেগিরি ক’রে ক’রে রোজ কিছুটা সুতা কেনে। ঊর্ধ্ব হতে আরও ঊর্ধ্বলোকে পাঠিয়ে দেয় তার দুঃসাহসী নিশান!
কিন্তু যতই সুতা জুড়ে দিচ্ছে–ঘুড়ি ততই উপর হ’তে আরো উপরে উঠছে- কোন কূলকিনারাই পায় না সে। এতোদূরে–মানুষের নাগালের বাইরে এভাবে আত্মগোপন করার কী মানে থাকতে পারে, নবী বুঝতে পারে না।
একদিন সে সন্ধ্যার সময় ঘুড়ি উড়িয়ে ফিরে এসে দেখে–মা আজ বড় খুশি! পরনে তার নতুন শাড়ি–সানকি আর বাটিতে ভাত–সালুন বেড়ে বসে আছে নবীর অপেক্ষায়।
বহুদিন পর সানকি–ভরা ভাত দেখে ওর পেট জ্বালা করে ওঠে। সোজা গিয়ে সে বসে পড়ে হালিমার কাছে। খেতে খেতে বলে–মা এই ছব পাইলা কই আইজ?
আজো জ্বড় ছিলো হালিমার। কিন্তু এই মুহূর্তে নবীর খাওয়া আর খুশি দেখে সে যেন হঠাৎ সুস্থ হয়ে ওঠে। ধীরে ধীরে বলে–কাহারটুলির জমিদার বাড়ির বউ মরছিলো না! তারি ফাতিহা অইছে আইজ–বহুত কাপড়–চোপড় আর টাকা–পইছা দান–খয়রাত করছে। দেখনা– তোর লাইগা একটা লুঙ্গিও আনছি। হালিমা উঠে পড়ে এবং একটা ছোট্ট নতুন লুঙ্গি এনে নবীর হাতে দেয়। নবী বিস্ময়ে অবাক হয়। আজ বুঝি সত্যিই মুখ তুলে চেয়েছেন আল্লাহ, ঘুম তাহলে তাঁর ভাঙছে! শুকরিয়ার বান ডেকে যায় তার বুকে। ছলোছলো চোখে মা’র দিকে চেয়ে বলে–কইছিলাম না মা–এ হাল আমাগো বেছি দিন থাকবো না!
অন্য দিন হালিমা ছেলের এ–কথায় সায় দিতে পারতো না; কিন্তু এই মুহূর্তে সে সায় না দিয়ে পারলো না। নবীর চোখে যেন সে দেখতে পাচ্ছে তাদের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের ছায়া।
জমিদার–বাড়ির দেয়া পয়সা আর চালে দু’দিন ভালোই গেল। আবার শুরু হয় আধ–পেটা খাওয়া আর উপাশের পালা। নবীর মন ভেঙে যায়, একি ছলনা–একি ছিনিমিনি খেলা বান্দার জীবন নিয়ে! তাদের আরজু তাহলে এখনো আল্লাহর কাছে গিয়ে পৌঁছায়নি!
রোজ রোজ সে ঘুড়ি উড়ায় আর মনে মনে বলে– আল্লার আরশ পর্যন্ত পৌঁছুতে পারে এতো সুতা যদি কিনতে না’ই পারে, এতো ফেরেশতা রয়েছে কী জন্যে? তারাই তো মানুষের দিলের আরজু পৌঁছায় নিয়ে আল্লাহর কাছে! আল্লাহর কাছে হতে তারাই তো পয়গাম নিয়ে আসে মানুষের কাছে! কেন তারা ওর ঘুড়ি নিয়ে যায় না আল্লার কাছে!
সেদিন সোমবার। নবী না খেয়েই ঘুড়ি আর লাটাই নিয়ে বেরিয়ে পড়ে চুপি চুপি। সেই ফণিমনসায় ঘেরা নির্জন জায়গাটুকুতে।
নবী দুর্বার উপর বসে নতুন সুতাটা জুড়ে দেয় পুরানো সুতার সঙ্গে। আসমান কেমন যেন আজ মেঘলা মেঘলা। সূর্যের আলো পড়ে মেঘ সাদা হয়ে গেছে, আর ফাঁকে ফাঁকে চকচক করছে গাড় নীল আসমান।
এক সময় নবী ঘুড়িটাকে উড়িয়ে দেয় আসমানে–হাতে তার লাটাই ঘুরছে আর ঘুরি শনশন করে ধাওয়া করছে উপর দিকে। সে অপলক চেয়ে আছে ঘুড়ির পানে–আর রশিতে টান পড়ে পড়ে ঝিন ঝিন করে উঠছে তার সারা শরীর। অকারণ উল্লাসে ভরে উঠছে তার মন। সে কিছু বুঝে উঠতে পারে না। মন তার আবেগে–উৎসাহে থর থর করে কেঁপে উঠছে, স্বর্ণ–ঈগলের মতো কল্পনা তার ডানা মেলেছে আসমানে।
ঘুড়ি ক্রমেই ছোট হয়ে এলো। এক সময়ে নবী বিস্মিত হয়ে দেখতে পায়, তার ক্ষুদ্র ঘুড়িটার চারপাশে একটা মস্ত বড় পাখি উড়ছে আর ঘুরছে। মাঝে মাঝে পাখিটা হারিয়ে যাচ্ছে মেঘের আড়ালে- আবার দেখা যাচ্ছে। বৃহৎ ডানা মেলে ঘুরছে ঘুড়িটাকে কেন্দ্র করে। আশ্চর্য, একবার ঘুড়ির রশি আটকে গেল পাখির গায়, তার হাতে টান পড়ে, আর তাতেই তার সারা শরীর অজানা আশঙ্কায় দুলে ওঠে–পাখিটা ঘুড়ি নিয়েই ঘুরতে থাকে আরও দ্রুত। রশি আরো প্যাঁচ খেয়ে লাগে পাখির ডানায় আর গায়ে। হঠাৎ এক সময় সে টের পেল সুতা ঢিল হয়ে গিয়ে নেমে আসছে আর ঘুড়ি ঘুরছে পাখির পিছে পিছে।
নবীর এতদিনের অহংকার মাটি হয়ে গেল। আরশের পায়ায় রশি লাগিয়ে আরশকে টলিয়ে দেয়া বুঝি জীবনে আর সম্ভব হলো না।
একাকী শূন্য মাঠে ডুকরে কেঁদে ওঠে সে। দু’চোখ ভরা আঁসু নিয়েই একবার সে তাকায় ঘুড়ির দিকে। একটা কালো বিন্দুর মতো পাখির পিছে পিছে ঘুরছে ঘুড়ি, আর পাখিটা শুধু ঘুরে ঘুরে উপর দিকেই উঠছে।
আচমকা ওর মনে হলো–এ তো পাখি নয়–এ যে ফেরেশতা এসেছে পাখির সুরত ধরে, তার ঘুড়ি আল্লার কাছে নিয়ে যাবার জন্য। দু’চোখ ফেটে এবার কৃতজ্ঞতার আঁসু গড়িয়ে পড়লো নবীর গাল বেয়ে; তার আঁসু–ধোয়া মুখে ফুটে উঠলো একটা অপূর্ব হাসি–বেদনা আর আনন্দে ঝলোমলো।
নিজের বোকামির কথা ভেবে নবীর শরম হয়। এতোদিন পর ফেরেশতা এসেছে তার দিলের আরজু আল্লার কাছে নিয়ে যাবার জন্য! আর সে কিনা কাঁদছে, পাখি তার ঘুড়ি নিয়ে গেল ব’লে!
চোখ মুছে সে তাকায় আসমানের দিকে–দেখলো, পাখিও নেই- ঘুড়িও নেই–শুধু সাদা সাদা মেঘ, আর তারি ফাঁকে ফাঁকে চকচক–করা গাঢ় নীল আসমান। অনেকক্ষণ সে চেয়ে রইলো আসমানের দিকে–আবার তার চোখ ফেটে দরদর করে নেমে এলো কৃতজ্ঞতার আঁসু। আজ সে সার্থক–আজ সে জয়ী! আর কোনো ভাবনা নেই তার–জিবরাইল এসে নিয়ে গেছে তার ঘুড়ি– তার জীবনের নতুন পাতা খুলবে এবার!
আবার আসমানের দিকে চেয়ে, এক ঝলক হেসে নবী বাড়ি ফিরে আসে। খুশিতে তার সারা শরীর নেচে উঠছে।
হালিমা উঠানে বসে শাক বাছছিল–মা–মা হুনচো, বলে নবী ঝাঁপিয়ে পড়লো তার কোলে।
হালিমা হঠাৎ গম্ভীর হয়ে ওঠে– তারপর রাগে ঠোঁট কামড়ে টিপে ধরে নবীর ঘাড়ে– গরগর করতে করতে বলে–কোত্থে আইলিরে হারামজাদা? তোর রঙ আমি না বাইর কইরা ছাড়ুম না।
নবী মা’র রাগের কারণ বুঝতে পারে না– তবু তার খুশির খবরটুকু সে না দিয়ে পারছে না মাকে–মা আইজ জিবরাইল রে দেখছি–আমাগো খবর…
সে তার কথা শেষ করতে পারলো না–ধুম ধুম করে হালিমার শক্ত হাতের কিল পড়তে থাকে তার পিঠে। কিলাতে কিলাতেই বলে–ওরা খানা দিবো আর আমরা খামু বইয়া বইয়া? বলতে বলতে একটা শক্ত গাল দিয়ে ওঠে জিবরাইলকে।
–মা–মা, তুমি গাল দিও না–নবী চিৎকার করে ওঠে–গুনা অইবো মা, আল্লা রাগ করবো।
হালিমার রাগ আরো বেড়ে যায়–তার গালির ফোয়ারা কিছুতেই থামতে চায় না।
নিরুপায় নবী কামড়ে ধরলো মা’র হাতে।
এবার হালিমার গায় যেন আগুন লেগে গেল। বিড়ির কারখানার মালিক আজ বলে গেছে–নবী দোকানে যায় না কোনদিনই; সুতরাং আজ থেকে কাজ তার ছাড়িয়ে দেয়া হলো। তার কাছেই হালিমা শুনেছে– ও নাকি কোথায় ঘুড়ি উড়ায় সারাদিন, আর সময় সময় ছোটাছুটি করে বাজারে, ইস্টিশনে। খবরটা পেয়ে অবধি গোস্বায় আগুন হয়েছিল হালিমা। এমন অবাধ্য শয়তান ছেলেকে দিয়ে কাজ কি? হালিমা এবার কঞ্চি হাতে নিয়ে শপাং শপাং মারতে থাকে নবীর পিঠে, হাতে, মাথায়।–হারামজাদা, তোর ভালার লাইগাই না আমার মাথা–বিষ– আর তুই কিনা ফাঁকি দিতাছোস আমারে! আমি মরলে জিবরাইল খাঞ্চা খাঞ্চা খানা লইয়া আইবো না তোর লিগা!
আঘাতে আঘাতে ক্ষত–বিক্ষত হয় নবীর পিঠ–চিৎকার করে সে কাঁদে এবং কামড়ে কামড়ে হালিমাকে রক্তাক্ত করে দেয়। এক সময় প্রায় বেহুঁশ হয়ে সে লুটিয়ে পড়লো মাটিতে।
রাতের বেলা হালিমার গায়ে জ্বর এলো।
নবী তার মা’র দিকে একবার চায়– এবং কিছু না বলে ঘরের এক কোনে শুয়ে পড়ে মাটির উপর। পেটে কিছুই পরলো না আজ। শুয়ে শুয়ে, কপাল কুঁচকে, ঠোঁট ফুলিয়ে সে কটমট করে তাকিয়ে রইল মা’র দিকে।
তারপর, কখন যে সে ঘুমিয়ে পড়লো, সে নিজেই জানে না।
ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখলোঃ জিবরাঈল তার ঘুড়ি নিয়ে মেঘের ফাঁকে ফাঁকে আসমানের দিকে ধাওয়া করেছে। একসময় নীল আসমান দু’দিকে সরে গিয়ে পথ করে দিলো জিবরাইলের জন্যে। মেঘের ফাঁকে ফাঁকে আবার যাত্রা শুরু হলো–আবার একটা আসমান ফাঁক হয়ে গেল, আবার আরেকটা,–ষষ্ঠ আসমান খোলার সঙ্গে সঙ্গে আগুন লেগে গেল জিবরাইলের ডানায়,–জিবরাইল তবু আগাচ্ছে ঘুড়ি নিয়ে! তারপর এক সময় খুলে গেল সপ্তম আসমানের দরজা আর তার ফাঁক দিয়ে একটা তীব্র আলোকচ্ছটা এসে ঝলসে দিলো ওর চোখ দু’টি। আর চাইতে পারলো না নবী–দু’চোখে হাত দিয়ে চিৎকার করে উঠলো,– মাগো, আমার চোখ দুইটা পুইড়া গেলো!
চোখ কচলাতে কচলাতে উঠে বসলো নবী–গলে যাওয়া দেয়ালের উপর দিয়ে সূর্যের প্রখর আলো তার নাকে–মুখে এসে লাগছে!
[লেখক পরিচিতি: ১৯৫০-এর দশকের আলোচিত ছোটগল্প ‘জিবরাইলের ডানা’র লেখক অধ্যাপক শাহেদ আলী শুধু বাংলা সাহিত্যের একজন অমর কথাশিল্পীই নন, তিনি ছিলেন সৃজনশীল অনুবাদ-সাহিত্যিক এবং আমাদের অন্যতম গদ্য লেখক।
ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামের শেষ পর্যায়ে পাকিস্তান আন্দোলনের অন্যতম অগ্রগামী সৈনিক। আজকের দিনের বহু লব্ধ-প্রতিষ্ঠিত সাহিত্যিকের লেখালেখির হাতেখড়ি হয়েছে তাঁর হাতে। ভাষা আন্দোলন ও তমদ্দুন মজলিসের অন্যতম নেতা শাহেদ আলী ছিলেন এদেশের অগণিত সংস্কৃতি-কর্মীর প্রেরণার উৎস। তাঁর জন্ম ১৯২৫ সালের ২৬ মে। বর্তমান সুনামগঞ্জ জেলার তাহিরপুর উপজেলার মাহমুদপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন তিনি।
সুনামগঞ্জ সরকারি জুবিলি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ১৯৪৩ সালে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন এই কথাসাহিত্যিক। তিনি সিলেট এমসি কলেজ থেকে ১৯৪৭ সালে স্নাতক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৫০ সালে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে এমএ পাস করেন।
শাহেদ আলী ১৯৫১ সালে বগুড়া আজিজুল হক কলেজে শিক্ষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। এরপর থেকে ১৯৫৪ পর্যন্ত মিরপুর বাঙলা কলেজ, রংপুর কারমাইকেল কলেজ ও চট্টগ্রাম সিটি কলেজে অধ্যাপনা করেন। তিনি ১৯৫৪ সালে সুনামগঞ্জ থেকে আইনসভার সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। অধ্যাপক শাহেদ আলী ইসলামিক ফাউন্ডেশনের (সাবেক ইসলামিক একাডেমি) প্রতিষ্ঠাতা সচিব ছিলেন।
তাঁর প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘জিবরাইলের ডানা’র নামগল্প দিয়েই তিনি সাহিত্যে স্থায়ী আসন পেয়েছেন। এ গল্প নিয়ে বিশ্বখ্যাত অনেক পরিচালক ছবি করার চেষ্টা করেছেন কিন্তু কোথাও কোনো সমস্যা ছিল বিধায় তা আর হয়ে ওঠেনি।
১৯৪০ সালে তিনি যখন স্কুলের ছাত্র তখন তাঁর প্রথম গল্প অশ্রু প্রকাশিত হয় সেকালের প্রথম শ্রেণির পত্রিকা মাসিক সওগাত-এ। তিনি প্রায় পঞ্চাশোর্ধ্ব গ্রন্থের লেখক, যার মধ্যে ‘জিবরাইলের ডানা’ ছাড়াও ‘একই সমতলে’, ‘পোড়ামাটির গন্ধ’, ‘শা'নজর’, ‘অতীত রাতের কাহিনী’, ‘অমর কাহিনী’ বাংলা সাহিত্যের অমর সৃষ্টি। এছাড়া তাঁর উপন্যাস ‘হৃদয় নদী’ এবং নাটিকা ‘বিচার’ও উল্লেখযোগ্য।
বাংলা প্রবন্ধসাহিত্যও তাঁর রচনায় সমৃদ্ধ। ‘বাংলা সাহিত্যে চট্টগ্রামের অবদান’, ‘তাওহীদ’ ইত্যাদি প্রবন্ধে তথ্য ও তত্ত্ব সমৃদ্ধির সঙ্গে তাঁর রসবোধের সম্মিলন ঘটেছে। ইসলামিক ফাউন্ডেশন কর্তৃক আল কোরআনের অনুবাদ সংঘেরও তিনি সদস্য ছিলেন। অধ্যাপক শাহেদ আলী তাঁর কীর্তির স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলা একাডেমি (১৯৬৪), একুশে পদক (১৯৮৯) ও মাতৃভাষা পদক (১৯৮১), সিলেট লায়ন ক্লাব পদক (১৯৮৫), ইসলামিক ফাউন্ডেশন পদকসহ (১৯৮৬) দেশে-বিদেশে বহু পুরস্কার পেয়েছেন। তাঁর ‘জিবরাইলের ডানা’ উর্দু, হিন্দি, ইংরেজি ও রাশিয়ান ভাষায় অনূদিত হয়েছে। বাঙলা ভাষার পাঠকদের জন্য অমর গল্পটি পুনঃপ্রকাশ করা হলো। –সম্পাদক, বিন্দু]
জিবরাইলের ডানা
শাহেদ আলী
শাহেদ আলী
মন্তব্য