গত শতাব্দীর সবচেয়ে প্রভাবশালী লেখক ফ্রানৎস কাফকা। মাত্র ৪০ বছর বয়সে পৃথিবী ছেড়ে যাওয়া এই লেখককে বলা হয় সাহিত্যে আধুনিকতাবাদের প্রবর্তক। তিনটি অসম্পূর্ণ উপন্যাস, কিছু ছোট গল্প, কিছু চিঠি ও দিনপঞ্জি—এত কম লিখে এবং বেঁচে থাকতে একটা উপন্যাসও সমাপ্ত না করার পরও কাফকা বিশ্বসাহিত্যে অন্যতম প্রধান চিরায়ত লেখকের স্থান পেয়ে গেছেন। এখন পর্যন্ত প্রায় ১২৫ জন নোবেলজয়ী সাহিত্যিকের এক-তৃতীয়াংশই তাঁদের লেখায় কাফকার প্রভাবের কথা সরাসরি স্বীকার করেছেন। শেক্সপিয়ারের পর আর কোনো লেখককে নিয়ে এতটা লেখালেখি হয়নি, যতটা হয়েছে কাফকাকে নিয়। গত নব্বই দশকের মধ্যভাগের আগেই তাঁকে নিয়ে লেখা হয়ে গেছে ১০ হাজার গবেষণাগ্রন্থ।
আইনের দরজায় প্রহরী দাঁড়িয়ে আছে। গেঁয়ো এক লোক এসে ভেতরে যাওয়ার আবেদন করলে প্রহরী তাকে বাঁধা দেয়— এই মুহূর্তে ভেতরে যাওয়া সম্ভব নয়। লোকটি কিছুক্ষণ ভেবেচিন্তে জানতে চায়, পরে কোনও এক সময় এলে তাকে ঢুকতে দেওয়া হবে কি না। “হতে পারে, কিন্তু এখন নয়”- প্রহরী উত্তর দেয়।
বরাবরের মত সে সময়ও আইনের দরজা খোলাই ছিল। প্রহরী একপাশে সরে দাঁড়ালে লোকটি ঝুঁকে দরজার ভেতরে দেখতে লাগল। ব্যাপারটা খেয়াল করে প্রহরী হাসতে লাগল, “এতই যদি শখ থাকে, আমার কথা না মেনে ভেতরে ঢুকার চেষ্টা করে দেখতে পার, কিন্তু মনে রেখ- আমিও অক্ষম নই। আর কেবল আমিই নই প্রত্যেকটি ঘরের সামনেই প্রহরী রয়েছে, এবং এদের একেকজন অন্যজন থেকে আরও বেশি ক্ষমতাশালী। আমি নিজে এমনকি তৃতীয়জনের একটা পলকও সহ্য করতে পারি না”
লোকটি এতসব জটিলতা আশা করে নি: আইনের দরজা সর্বদা সকলের জন্যই খোলা থাকা উচিত— সে ভাবে, কিন্তু লোমশ কোট গায়ে প্রহরীকে যখন সে কাছ থেকে দেখে— তার লম্বা খাড়া নাক,পরিপাটি করে সাজানো, দীর্ঘ ও পাকানো কাল দাঁড়ি, প্রহরীর এমন মূর্তি দেখে সে অনুমতি না পাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত নেয়। প্রহরী তাকে একটা চেয়ার দেয় বসার জন্য এবং দরজার সামনেই এক পাশে বসার অনুমতি দেয়। সেখানেই সে বসে থাকে দিনের পর দিন বছরের পর বছর। ভেতরে যাবার বহু প্রচেষ্টা চালায়, প্রহরীকে অনুরোধ করতে করতে ক্লান্ত করে তুলে। প্রহরী তাকে মাঝে মাঝেই এটা সেটা জিজ্ঞেস করে। বিভিন্ন বিষয়ে জানতে চায়। এ সবই গতানুগতিক প্রশ্ন, স্বাভাবিক সৌজন্যতামূলক, ভদ্রলোকেরা যেমন করে থাকে। কিন্তু লোকটিকে যে তখনও ভেতরে ঢুকতে দিতে সে অপারগ এ কথাটাও বারবার জানিয়ে দিতে থাকে ।
লোকটি তার ভ্রমণের পাথেয় হিসেবে সাথে করে যা কিছু এনেছিল, এমনকি বহুমূল্যবান সামগ্রীও সে ঘুষ হিসেবে প্রহরীকে দিয়ে দেয় তাকে প্রলুব্ধ করার জন্যে। প্রহরী সে-সবই গ্রহণ করে কিন্তু বরাবারই বলে যায়, “আমি কেবলমাত্র এইসব নিচ্ছি এ জন্যেই যাতে করে তুমি এমনটা না ভাবো যে চেষ্টার কোনও ত্রুটি তুমি করেছিলে”।
এই এত বছরের মধ্যে লোকটি প্রহরীকে অক্লান্তভাবে পরখ করতে থাকে। সে অন্য প্রহরীদের কথা ভুলেই যায়, এই একজনকেই তার আইনের পথে একমাত্র বাঁধা বলে মনে হয়। সে নিজের দুর্ভাগ্যকে অভিশাপ দিতে থাকে, প্রথম কয়েকবছর রূঢ় এবং উচ্চস্বরেই সে অভিশাপ বর্ষণ করত, ধীরে ধীরে যতই সে বৃদ্ধ হয়ে আসতে থাকে কেবল নিজে নিজেই বিড়বিড় করতে থাকে, তার মধ্যে পাগলামির লক্ষণ ফুটে ওঠে, এতবছর ধরে প্রহরীকে দেখতে দেখতে এমনকি তার কলারে বসে থাকা মাছিগুলোকেও এখন সে চিনতে পারে, সেই মাছিগুলিকেও সে অনুরোধ করে প্রহরীর মন গলিয়ে দেওয়ার জন্যে।
অবশেষে তার চোখের পাতা ভারি হয়ে আসতে থাকে, সে ঠিক বুঝতে পারে না চারপাশের পৃথিবীই কি অন্ধকার হয়ে আসছে নাকি তার দৃষ্টিই তার সাথে প্রতারণা শুরু করেছে। এমনকি এই অন্ধতা সত্ত্বেও আইনের প্রবেশপথ হতে বিচ্ছুরিত এক অদম্য আভা সে দেখতে পায়। আর বেশি সময় নেই। মৃত্যুর পূর্বে এতবছরের সমস্ত স্মৃতি তার চিন্তার কেন্দ্রবিন্দুতে জড়ো হতে থাকে, একটি প্রশ্ন সে এখনও জিজ্ঞেস করেনি প্রহরীকে। প্রহরীর উদ্দেশ্যে সে হাত নাড়ে, নিজের এই জড়তাগ্রস্ত শরীর নাড়াতেও সে অক্ষম। প্রহরী লোকটিকে কুঁজো হতে হল, দুইজনের উচ্চতার পার্থক্যই লোকটির অসুবিধার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। “বড্ডো নাছোরবান্দা লোক দেখছি তুমি, কী জানতে চাও বল?”- প্রহরী বলল। লোকটি জিজ্ঞেস করে “আইনের অধিকার পাবার জন্যে সবাই লড়াই করে, কিন্তু এত এত বছরে আমি ছাড়া আর কাউকেইতো আসতে দেখলাম না এখানে?” প্রহরী বুঝতে পারল লোকটির অন্তিম অবস্থা সমাগত। লোকটির কানের কাছে সে চিৎকার করে বলল যাতে তার বিকল ইন্দ্রিয়গুলো সেই শব্দ ধরতে পারে, “আর কেউ কোনও কালেই এখানে প্রবেশের অনুমতি পাবে না, এ দরজা কেবলমাত্র তোমার জন্যেই তৈরি হয়েছে যা এখন বন্ধ হয়ে যাবে।”
কৃতজ্ঞতা: মাসরুর আরেফিন
Image source: Drawings by Franz Kafka from his sketchbook, circa 1901-7.Credit...Literary Estate of Max Brod, National Library of Israel, Jerusalem. Photo by Ardon Bar Hama/ Courtesy Yale University Press
ভা ষা ন্ত রি ত গ ল্প
আইনের দরজা
ফ্রানৎস কাফকা
আইনের দরজা
ফ্রানৎস কাফকা
মন্তব্য