.header-button .inner > span { font-size: 18px !important; } .header-button .inner i.fa { font-size: 40px !important; } .comment-form-message { background-color: #f4f4f4 !important; font-size: 14px !important; }

ভাষার মুক্তি, ভাষার কারাগার | অরুণেশ ঘোষ

ভাষার মুক্তি, ভাষার কারাগার | অরুণেশ ঘোষ
ভাষাকে শুধু জীবন্ত হলেই চলবে না তাকে মুক্ত হতে হবে। ভাষাকে মুক্তির দিকে নিয়ে যেতে হবে। ভাষাকে শুধু তীব্র তীক্ষ্ণ ও একমুখী করে তুললেই চলবে না, তাকে নিয়ে আসতে হবে জীবনের কাছাকাছি, জীবনের প্রবাহের সঙ্গে তাকে যুক্ত করতে হবে। ভাষাকে শুধু স্মার্ট বা চিত্রবহুল, সংযত বা বিশৃঙ্খল করলে কিছু পাব না আমরা, যদি পরিত্যাগ করতে না পারি গোঁড়ামি ও ক্ষীণ দৃষ্টি, অর্জন করতে না পারি সমগ্রতার বোধ ও মুক্তদৃষ্টি। ভাষা যে আজ জীবনের সমগ্রতাকে, সৌন্দর্যের সমগ্র রূপকে ধরতে পারছে না, সে দায় আমাদেরই, জীবন এগিয়ে গেছে, ভাষা এগিয়ে যায়নি অর্থাৎ ভাষাকে আমরা এগিয়ে নিয়ে যেতে পারিনি।

যুক্তি, বুদ্ধি ও দক্ষতা ভাষাকে কৃত্রিম ও আড়ষ্ট করে তুলতে চায়। এরা চায় ভাষার শৃঙ্খলা। যদি ভাষার শৃঙ্খলা আনা যায়, একধরনের উজ্জ্বলতা ভাষা শরীরে দেখতে পাব ঠিকই, কিন্তু সেই উজ্জ্বলতা ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া সিগারেট বাক্সের রাংতার মতোই, যা মানুষের কোনো কাজে লাগে না। যা আমাদের জীবনের গভীরে নিয়ে যেতে পারে না। কৃত্রিমতার স্পর্শে সবকিছুকে কৃত্রিম করে তুলতে চায়, কৃত্রিমতার কারবারিরা এভাবেই তাদের চিন্তাকে আর চিন্তার প্রকাশকে যথাযথ, প্রায় আবেগহীন ও একটা নিয়মে বেঁধে দিতে চায়। ভাষা দিয়ে আমরা যে বিশালতাকে, যে আ-অসীম জন্ম-যোনি-সমুদ্র-নিসর্গ- মৃত্যু-প্রেম-গতি ও মানুষের বিবর্তন পরম্পরাকে ধরতে চাই, এক জীবন থেকে অন্য জীবনে, এক জীবন থেকে বহু জীবনে চলে যেতে চাই, সেই আকাঙ্ক্ষার একটি রোমও এই পথে স্পর্শ করা যাবে না। মানুষ হতাশ হয়েই লক্ষ্যে পৌঁছবার গতিতে পরিত্যাগ করে আর নিজেকে বোঝায়, মুক্তি অবাস্তব, মুক্তি পেতে হলে ভাষাকে শব্দকে আর এমনকী সমস্ত অক্ষর পরিকল্পনাকে বর্জন করতে হবে। চলে যেতে হবে শূন্যে-নীরবতায় নিঃশব্দতার কারণ ভাষার শুরুটা নাকি কৃত্রিমতা থেকেই রয়েছে। এর চেয়ে বড় মিথ্যা আর কী হতে পারে।

আর ঠিক এর উল্টোদিকেই রয়েছে ভাষাকে বিশৃঙ্খল বা ধোঁয়াটে করে তোলা, তাকে আবেগসর্বস্ব বা ভারাক্রান্ত করে শুধু নিজের অহংকে পরিতৃপ্ত করার জন্য কাজে লাগানো। ভাষা বিপ্লব আমাদের কাম্য, কিন্তু ভাষার নৈরাজ্য হাস্যকর ও অর্থহীন। রক্ষণশীলরা যুক্তি দিয়ে ভাষাকে বাঁধতে চায়, গতিকে তারা ভয় পায় বলেই তাদের চাই সেই মনোমতো রুদ্ধভাষা। নৈরাশ্যবাদীরা উল্টোদিক থেকে একই রকমভাবে ভাষাকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে নিয়ে আসতে চায় আরেক কৃত্রিমতা। দু-পক্ষই ভয় পায় গতি ও সৃষ্টিকে। বুদ্ধি ভাষাকে পরিচালিত করুক, আমরা তা চাইনি, চেয়েছি হৃদয়ের ভাষা। আর গল্পের সেই কল্পতরুর মতোই চাওয়ামাত্র শুরু হয়ে গেল চিৎকার, আর্তনাদ, আত্মবিলাপ গর্জন ও উল্লাস। না- বাদীরা সব বাক্যের শেষে একটা করে না বসিয়ে দিয়ে বেরিয়ে যেতে চায় ভাষার বাইরে। ভয়ে চিৎকার করে ওঠে তারা, যারা এই ভাষার মধ্যে আশ্রয় নিয়েছে, ঝুলে আছে। ভাবে, ভাষা বুঝি ধ্বংস হয়ে যাবে। হেসে উঠতে হয় আমাদের, ভাষা ধ্বংস হয় না-প্রসারিত হয় মাত্র, সমগ্রের পরিপ্রেক্ষিতে তুলনায় সে-ও কত সামান্য। ভাষার মধ্যে শক্তি লুকিয়ে থাকে, ঘুমন্ত অবস্থায় থাকে যে শক্তি ভাষাকে ছাড়িয়ে যেতে চায়। ভাষাকে স্বচ্ছ ও আবর্জনা মুক্ত করতে আমরা হৃদয় থেকে বুদ্ধিতে ফিরতে পারি না কোনো মতেই, তাকে নিয়ন্ত্রণ করার গতানুগতিক খাতে প্রবাহিত করার অপচেষ্টার পরিবর্তে তার গতিমুখের সব বাধাগুলি সরিয়ে তাকে নিয়ে যেতে হবে আমাদের স্বপ্নের ভাষার দিকে। আসলে ভাষার আমূল পরিবর্তন, সম্পূর্ণ বদলে যাওয়া... আমাদের স্বপ্নের সেই ভাষা বিপ্লব বাস্তবে সংঘটিত হয় না। বিপ্লবের সূচনা হওয়ামাত্র প্রতি বিপ্লবের ভূণগুলি পাশাপাশি হতেই গর্ভে দানা বাঁধতে থাকে, ক্রিয়ায়-প্রতিক্রিয়ায়, সংঘর্ষে দ্বন্দ্বে যেটা ঘটে সে হল বিবর্তন। ভাষা এই বিবর্তনের মধ্যে দিয়ে চলেছে।

জীবনানন্দ ও কমলকুমার যাঁদের ভাষার শরীর জুড়ে ছবির পর ছবি, শব্দ দিয়ে ছবি আঁকা, এদিক দিয়ে দুজনকে মনে হবে প্রতিবেশী। রূপকে রূপান্তরিত করে ভাষার মধ্যে এনে আবার তাকে ছবি করে তোলা, চিত্র পরম্পরতায় চলে যাওয়া এক অসীমের দিকে, এই শক্তির উৎস হৃদয়। নিছক বুদ্ধি কোনো ছবি আঁকতে পারে না। কমলকুমারকে এখনও দুরূহ লেখক বলা হয়, একটু লক্ষ করলেই দেখা যাবে তাঁরও উদ্দেশ্য হৃদয়-উন্মোচন। কিন্তু বাংলা ভাষা বলতে আমরা যে ভাষাকে বুঝি যে ভাষাকে রবীন্দ্রনাথ আমাদের জন্য সাহিত্যের উপযোগী করে রেখে গেছেন, সেই ভাষাকে কমলকুমার সম্পূর্ণই অস্বীকার করে যেতে পেরেছেন। কমলকুমারের ভাষা বিদ্যাসাগরের সময়ের ভাষা নয়, নয় কোনো অঞ্চলের বা কোনো উপজাতি গোষ্ঠীর লোকভাষা, ফরাসি ভাষার প্রেরণাতেই শুধুমাত্র তাঁর ভাষা গড়ে ওঠেনি, অবশ্য এ সবই তাঁর ভাষায়-ভাষার আত্মায় নিঃশব্দই রয়ে গেছে। কমলকুমারের ভাষা আমাদের এই ভাষার বিপরীত, যে ভাষার জন্ম ইংরেজদের আসার ফলে মধ্যবিত্ত বাঙালির চেতনায়-মুহূর্তে যে ভাষা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল এই মাটি থেকে। জীবন-বাঙালি জীবন আর মূল রয়ে গেছে আরও পেছনে আরও দূরে- কমলকুমার চলে যেতে চেয়েছেন সেই উৎসে। তিনি ধরতে চেয়েছেন আমাদের ভাষার সমগ্রতাকে। আরও একজন, জীবনানন্দ যিনি অস্বীকার করেছিলেন এই ভাষা কাঠামোকে। সঙ্গে সঙ্গে তাকে ভাষার জন্য-এক নতুন ও সৃষ্টি-উন্মুখ ভাষার জন্য যেতে হয়েছিল সরাসরি জীবনের কাছে, জীবন ও নিসর্গের কাছে। ভাবি, কেন হঠাৎ বন্ধ্যা হয়ে উঠল এই ‘আধুনিক বাংলা ভাষা’—? কারণ, তা কি ছিল শুধুমাত্র মধ্যবিত্তের ব্যবহারের জন্য মধ্যবিত্তের সৃষ্ট ভাষা? বাঙালি মধ্যবিত্ত গড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে এই ভাষাও কি গড়ে উঠেছে? ওই ভাষার শেষতম কবি ও গদ্য লেখক যারা, তারাও এর মধ্যেই আমাদের মন থেকে মুছে গেছে। কী পরিহাস! আজ যখন জীবনানন্দ ও কমলকুমার পড়ি, বুঝতে পারি এই দুজনই এই শতাব্দী জুড়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকবেন। তবু আমাদের আত্মা রয়ে যায় অতৃপ্ত-আমরা আরও এগিয়ে যেতে চাই, এমন এক ভাষা চাই যার স্পষ্ট রূপ কী হবে তা ঠিক জানি না, শুধু কল্পনায়, হৃদয় আর বিরতিহীন সমুদ্রে গর্জন শুনে যেতে থাকি, সেই না পাওয়া ভাষার আলোড়ন। ধ্বংস ও সৃষ্টির মধ্যে দিয়ে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে তার সন্ধানে।

চিত্রকল্প, প্রতীক ও রূপক ভাষাকে মুক্তি দিতে পারেনি। কিন্তু অনেকদূর পর্যন্ত প্রসারিত করেছে। আজও যে আমরা ওই চিত্রকল্প বা প্রতীক রূপক যা উপমার সাহায্য নিই, সে আমাদের অনেকটা অজান্তেই ভাষায় যা প্রকাশ পায়, তা কত সামান্য-আহ্, কী ক্ষুদ্র- কী অণুমাত্র। যার সম্পূর্ণ আবার আমাদের হৃদয়ের বিশালতার নীচে এখনও অজ্ঞাত। সেই বিশালতার সামান্য অংশ মাত্র আমাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। যেন সম্পূর্ণতার সামান্য বা অসামান্য আভাস আসে ভাষায়, সে জন্যেই বিরামহীন পথ খোঁজা। প্রতীক, রূপক ও চিত্রকল্প সে জন্যেই এসে গেছে আজ আবার মনে হচ্ছে। এসবই ভাষার শেকল, ভাষাকে বন্দি করে রাখছে। কমলকুমার ধ্রুপদি ভাষার সঙ্গে লোকায়ত ভাষাকে মিশিয়ে আনতে চেয়েছেন সেই ব্যাপ্তি, সেই ব্যাপ্তি সেই মুক্তির আস্বাদ-যা প্রায় প্রতি বাঁকে তিনি ধরতে চেয়েছেন। যখন ওই ভাষার মধ্য দিয়ে আমাদের যাত্রা শুরু হয় হঠাৎই উপলব্ধি করি, স্পষ্ট দেখতে 'পাই, ভাষা কারুর একার সৃষ্টি নয়। ভাষার মূল রয়ে গেছে সম্মিলিত মানুষের রহস্যময় চেতনায়। কমলকুমার ছিলেন ঐশী শক্তিতে বিশ্বাসী। জীবনানন্দের ছিল সংশয়, তাঁর ভাষার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল শরীর, সত্তা ও প্রকৃতি চেতনা। যে প্রকৃতি ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য। আর মৃত্যু, অবলুপ্তি ও রহস্যের প্রতি তাঁর অদ্ভুত আকর্ষণ। যা তাঁকে তাঁর সংশয়ের ভাষার পরিধি ছিঁড়ে আরও দূরের অন্য এক ভাষার দিকে নিয়ে যেতে চায়। আসলে তাঁর ভাষায় এসে পড়ে একই সেই আধ্যাত্মিক অনুভূতির আলো। আধ্যাত্মিক অনুভূতি...। ঐশী শক্তি। আমরা বিশ্বাস করতে চাই না আর। অদ্ভুত এই যে বিশ্বাস ও অবিশ্বাস, সংশয় ও বিদ্রোহ, ঐশী চেতনা ও বস্তু চেতনা-ভাষাকে ভেতর থেকে পরিচালিত করে একেকটি সভ্যতায়, সময়ে ও সন্ধিক্ষণে। একের সঙ্গে অন্যের যে সংঘর্ষ চলছে, তারও ছায়া এসে পড়ে ভাষায়। আর প্রবল সক্রিয়তা ভাষাকে একটা রূপ দেয়, নিষ্ক্রিয়তা আরেক রূপ। সক্রিয়তা ভাষাকে কি অবেশেষে পৌঁছে দিতে চায় যান্ত্রিকতায়? আর নিষ্ক্রিয়তা ভাষাকে করে তুলতে চায় জড়?

ইউরোপ ও আমেরিকায় ঠিক এই সময়ে এমন কিছু লেখা হচ্ছে, কবিতা বা গদ্য, যা পড়ে ক্লান্ত পাঠক সম্ভবত খানিকটা স্বস্তি পায়। পাঠক, আসুন, তাকাই এই কবিতাটির দিকে,
ধীরে ধীরে মোজা খুলতে খুলতে বলল মেয়েটি
হ্যাঁ
স্বর্গে যেতে হলে দশ ডলার মাত্র লাগে
কিন্তু আমার কাছে তো দশ ডলার নেই
বলল লোকটি
মিষ্টি হেসে বলল মেয়েটি
তাহলে নরকে যাও।
–চার্লস্ বাকোস্কি

‘বাহ’— পাঠক আপনার অজান্তেই আপনার মুখ থেকে বেরিয়ে আসতে পারে। এর পরেই আপনাকে চলে যেতে হবে পেচ্ছাপখানায়, পেচ্ছাপ সেরে এসে আবার হঠাৎ যদি কবিতাটির দিকে চোখ পড়ে, তবে দেখবেন, গোটা ইউরোপ আমেরিকার আরেনেসাঁস যে সক্রিয়তার কথা আমরা জানি, ভাষাকে কবিতার ভাষায়, ছবির ভাষায় ও গদ্যের ভাষায় যে বিপ্লব পরিবর্তন একের পর এক স্রষ্টারা আনতে চেয়েছেন, এ যেন তারই শেষ পরিণাম ও পরিণতি। উপসংহার কী? ভাষা এখানে যান্ত্রিক, স্মার্ট ও কৃত্রিম। এ যেন মুক্তির পথ খুঁজতে খুঁজতে অবশেষে কাফকার সেই অদ্ভুত ও প্রতিকী মেশিনটিতে মৃত্যু বেছে নেওয়া। ঠিক এই ভাষাতেই ওইসব দেশে এখন তথাকথিত প্রতিবাদের কবিতা বা সাহিত্য করা হয়। এ যেন বড় যন্ত্রের চাপের বিরুদ্ধে ছোট যন্ত্রের গুমরে ওঠা। সত্যি, আজ গোটা ইউরোপকে নিঃশব্দে যুদ্ধ করতে হচ্ছে আবার এক জীবনের ভাষার জন্য, জীবন্ত ভাষার জন্য। তার চিন্তা চেতনার কেন্দ্রবিন্দুতে ফিরিয়ে আনতে চায় আবার মানুষ, যে মানুষ এর মধ্যেই সেখান থেকে বিতাড়িত। সেখানে জাঁকিয়ে বসেছে এক উদ্ভট, এই যন্ত্রসভ্যতা। যা তাকে ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাচ্ছে, তার ভাষাকেও কৃত্রিম করে তুলবে, স্বাভাবিকভাবেই।

আমাদের অবস্থাটা কিছুটা ভিন্ন রকম, আমরা বোধের উন্মেষের পর যে ভাষার কাছে আসি তা প্রায় জড় ভাষা। কারণ আমাদের ভাষা মূলত মধ্যবিত্ত ভাষা। যদি কেউ আমাদের, বাঙালি মধ্যবিত্তের শিশুদের কণ্ঠস্বরের দিকে কান পাতে, তাকে আতঙ্কে অস্থির হতে হবে। তার শ্রেণীর ভাষার মতোই তার গলার স্বরটিও হয়ে উঠেছে কী বীভৎসভাবেই না কৃত্রিম। এটা ঠিক যে বাঙালি মধ্যবিত্তরা এসেছে, পুব পশ্চিমবাংলার নানান অঞ্চল থেকে, কিন্তু তারা আঞ্চলিক ভাষার শেষ টানটুকুও হারিয়ে ফেলেছে মধ্যবিত্ত শ্রেণীতে উন্নীত বা অধঃপতিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে। এর জন্য দুই বা তিনটি জেনারেশনের প্রয়োজন হয়নি, এক জেনারেশনেই এটা ঘটে গেছে। আমাদের আঞ্চলিক ভাষাগুলি, তার সীমাবদ্ধতা ও সংকীর্ণতা নিয়ে এখনও জীবন্ত কিন্তু সেই ভাষায় কোনো সাহিত্য সৃষ্টি এখন আর হয় না, সম্ভবও নয়। তা রূপান্তরিত হয়ে যাচ্ছে মধ্যবিত্ত ওই ভাড়াটে ভাষায়। এই তৈরি করা ভাষার সঙ্গে এসে মিশে যাচ্ছে পশ্চিমের যান্ত্রিকতা, অনেকটা আমাদের অজান্তেই। আমরা, যেমন বঙ্কিম ও রবীন্দ্রনাথ ইউরোপ থেকেই প্রেরণা পেয়েছিলেন, অনুসরণ করেছিলেন অনেকখানি সে রকম এখনও সেখান থেকেই প্রেরণা পাই। এই সভ্যতাকে ধ্বংস করার প্রেরণা বা তাকে টিকিয়ে রাখার প্রেরণা, একই উৎস থেকে আসে। আর এই বিদ্রোহ বিপ্লব বা প্রতিবাদ...সব ধারণাগুলিই আমরা পেয়েছি সেখান থেকেই। গিনস্বার্গের কবিতা আমাদের আলোড়িত করে, প্রেরণা জোগায় এই জন্যে যে, তা আমেরিকার যন্ত্রজঙ্গলকে অস্বীকার করে মানবিক সৃষ্টি এবং যারা ছিটকে পড়েছে বাইরে তাদের এক সম্মিলিত কণ্ঠস্বরের প্রকাশ। কিন্তু যখন দেখি অবশেষে গিনস্বার্গ ধর্মে আশ্রয় নিতে যাচ্ছেন বা আধ্যাত্মিকতায় নতুন জীবন খুঁজে পাচ্ছেন-ছুটে পালিয়ে আসতে হয় আমাদের। আমরা বিভ্রান্ত হয়ে পড়ি। আসলে গোটা ইউরোপীয় চেতনার সঙ্গে আমাদের এমন একটা তফাত ঘটে গেছে, যা হয়তো আর কোনোদিনই মেলানো যাবে না।

তাহলে কি আমাদের অপেক্ষা করতে হবে, নতুন এক ভাষার জন্য? অপেক্ষায় বসে থাকতে হবে? যতক্ষণ না এই শ্রেণীর অবলুপ্তি ঘটছে? সত্যি, মধ্যবিত্তের এই অসাড় ভাষা দিয়ে আর সৃষ্টি সম্ভবই নয়, যে-কোনো একজন তরুণ কবি ও লেখক এই ভাষার সামনে এসে থমকে দাঁড়াবে, কীভাবে সে এই কারাগার ভাঙবে, ভাবে। সে অসহায় বোধ করে হয়তো এলোপাথাড়ি কিছু আঘাত করে, তারপর নৈরাশ্যে ভেঙে পড়ে একদিন, হতাশা এসে তাকে গ্রাস করে, সে নিজেকে সান্ত্বনা দিতে চায় এই বলে যে, এই বিশাল অসাড়তাকে-জগদ্দলকে তার একার পক্ষে সম্ভব নয় অপসারিত করা। সে মুছে যায়। কিন্তু এর মধ্যেই যে সৃষ্টি সম্ভব, সম্ভব এদের ব্যবহৃত শব্দগুলি ব্যবহার করেও নতুন এক ভাষার দিকে যাওয়া-তার দৃষ্টান্ত জীবনানন্দ ও কমলকুমার। জীবন থেকে তুলে নিতে হবে সেই শক্তি, যা এই ভাষার মধ্যে থেকেও নতুন ভাষার সৃষ্টিতে উন্মাদ হয়ে ওঠে। শক্তি ছড়ানো রয়েছে জীবনের সর্বত্র, শুধু তা তুলে নেওয়ার অপেক্ষা। এ জন্যেই প্রয়োজন সাহস। ভাষা আকাশ থেকে নেমে আসে না, সে থাকে এখানেই, কোথায় সে জীবন্ত আর কোথায় সে মৃত। কেউ কেউ, এই পৃথিবীতে এসেই কয়েক মুহূর্তেই তা টের পেয়ে যায়... পৃথিবীতে এমন দিন কখনোই আসবে না, যখন ভাষা থাকবে কিন্তু মানুষ থাকবে না।

অথবা রয়ে যাবে এক নিঃশব্দ ও মূক মানবসমাজ, তাদের ভাষা মিলিয়ে যাবে বিবর্তনের শেষ ধাপে এসে। তাকে আবার খুঁজে নিতে হবে আদিম আওয়াজ। এই কল্পনা আমাদের শিহরিত করতে পারে মাত্র, কিন্তু সত্য তা নয়। ভাষাকে নির্মাণ করা হয়নি, ভাষা মানুষের চেতনা থেকে জন্মগ্রহণ করেছে অনেকটা তার অজ্ঞাতে তার অস্পষ্ট অথচ অশান্ত, বিক্ষুব্ধ ও কলোচ্ছাসময় অভ্যন্তরের এক নীহারিকা স্রোত থেকে। আমি শুনি সেই মানুেষের আদিম আওয়াজ-শিশুর প্রতি মায়ের এক দুর্বোধ্য হাম্বা রব। মানুষের প্রতি মানুষের পশুর করুণ চোখ তুলে তাকিয়ে থাকা, এখনও এই ভাষার মধ্যে শব্দের মধ্যে ও অক্ষরের গভীর গহ্বরে সেই অতৃপ্তি, অতৃপ্তির বেদনা, যন্ত্রণা, আকুলতা ও উন্মাদনা-যা থেকে শুরু হয়েছিল, তা আজও বহমান, বহমান বলেই ভাষা সজীব ও গতিশীল। আমরা সেই পরম ভাষা-ভাষার সম্পূর্ণ মুক্তি হয়তো কোনোদিনই পাব না, কিন্তু সেই মুক্ত ভাষার দিকেই আমাদের যাত্রা...।

১৯৭১

সূত্র: কবিতার অন্ধকার যাত্রা, অরুণেশ ঘোষ, পৃষ্ঠা: ৮৩–৮৮, প্রথম প্রকাশ: জানুয়ারি ২০০৪, প্রকাশক: উৎপল ভট্টাচার্য, কবিতীর্থ, ৫০/৩ কবিতীর্থ সরণী, কলকাতা–৭০০০২৩

ভা ষা সি রি জ 
ভাষার মুক্তি, ভাষার কারাগার
অরুণেশ ঘোষ


মন্তব্য

নাম

অনুবাদ,31,আত্মজীবনী,26,আর্ট-গ্যালারী,1,আলোকচিত্র,1,ই-বুক,7,উৎপলকুমার বসু,23,কবিতা,303,কবিতায় কুড়িগ্রাম,7,কর্মকাণ্ড,15,কার্ল মার্ক্স,1,গল্প,54,ছড়া,1,ছোটগল্প,12,জার্নাল,4,জীবনী,6,দশকথা,24,পাণ্ডুলিপি,10,পুনঃপ্রকাশ,14,পোয়েটিক ফিকশন,1,প্রতিবাদ,1,প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা,4,প্রবন্ধ,151,প্রিন্ট সংখ্যা,4,বর্ষা সংখ্যা,1,বসন্ত,15,বিক্রয়বিভাগ,21,বিবিধ,2,বিবৃতি,1,বিশেষ,23,বুলেটিন,4,বৈশাখ,1,ভাষা-সিরিজ,5,ভিডিও,1,মাসুমুল আলম,35,মুক্তগদ্য,36,মে দিবস,1,যুগপূর্তি,6,রিভিউ,5,লকডাউন,2,শাহেদ শাফায়েত,25,শিশুতোষ,1,সন্দীপ দত্ত,8,সম্পাদকীয়,16,সাক্ষাৎকার,21,সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ,18,সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ,55,সৈয়দ সাখাওয়াৎ,33,স্মৃতিকথা,14,হেমন্ত,1,
ltr
item
বিন্দু | লিটল ম্যাগাজিন: ভাষার মুক্তি, ভাষার কারাগার | অরুণেশ ঘোষ
ভাষার মুক্তি, ভাষার কারাগার | অরুণেশ ঘোষ
অরুণেশ ঘোষের ভাষা বিষয়ক প্রবন্ধ
https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEhzt6akeyYJcy2ROXNu5yvTXEjZuT3QBvGDN0fFqwqh332jiUjVb6qou9wN_0SlBewWB3neFhla8m9v6OAml4T_LAfP-AkctxcvgMYiHRkfi6nDr0Bi88naoiEKHQWUabhrzVNWM0KNAGxIc8L-2ffWPE_Uy2HlcnqzQgnoICPVThOhEwnAOljU1T76Tyc/s16000/%E0%A6%AD%E0%A6%BE%E0%A6%B7%E0%A6%BE%E0%A6%B0%20%E0%A6%AE%E0%A7%81%E0%A6%95%E0%A7%8D%E0%A6%A4%E0%A6%BF,%20%E0%A6%AD%E0%A6%BE%E0%A6%B7%E0%A6%BE%E0%A6%B0%20%E0%A6%95%E0%A6%BE%E0%A6%B0%E0%A6%BE%E0%A6%97%E0%A6%BE%E0%A6%B0%0A%E0%A6%AC%E0%A6%BF%E0%A6%A8%E0%A7%8D%E0%A6%A6%E0%A7%81%20%E0%A6%85%E0%A6%B0%E0%A7%81%E0%A6%A3%E0%A7%87%E0%A6%B6%20%E0%A6%98%E0%A7%8B%E0%A6%B7.png
https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEhzt6akeyYJcy2ROXNu5yvTXEjZuT3QBvGDN0fFqwqh332jiUjVb6qou9wN_0SlBewWB3neFhla8m9v6OAml4T_LAfP-AkctxcvgMYiHRkfi6nDr0Bi88naoiEKHQWUabhrzVNWM0KNAGxIc8L-2ffWPE_Uy2HlcnqzQgnoICPVThOhEwnAOljU1T76Tyc/s72-c/%E0%A6%AD%E0%A6%BE%E0%A6%B7%E0%A6%BE%E0%A6%B0%20%E0%A6%AE%E0%A7%81%E0%A6%95%E0%A7%8D%E0%A6%A4%E0%A6%BF,%20%E0%A6%AD%E0%A6%BE%E0%A6%B7%E0%A6%BE%E0%A6%B0%20%E0%A6%95%E0%A6%BE%E0%A6%B0%E0%A6%BE%E0%A6%97%E0%A6%BE%E0%A6%B0%0A%E0%A6%AC%E0%A6%BF%E0%A6%A8%E0%A7%8D%E0%A6%A6%E0%A7%81%20%E0%A6%85%E0%A6%B0%E0%A7%81%E0%A6%A3%E0%A7%87%E0%A6%B6%20%E0%A6%98%E0%A7%8B%E0%A6%B7.png
বিন্দু | লিটল ম্যাগাজিন
https://www.bindumag.com/2024/07/article-on-language-by-arunesh-ghosh.html
https://www.bindumag.com/
https://www.bindumag.com/
https://www.bindumag.com/2024/07/article-on-language-by-arunesh-ghosh.html
true
121332834233322352
UTF-8
Loaded All Posts Not found any posts আরো Readmore উত্তর Cancel reply মুছুন By নী PAGES POSTS আরো এই লেখাগুলিও পড়ুন... বিষয় ARCHIVE SEARCH সব লেখা কোন রচনায় খুঁজে পাওয়া গেল না নীড় Sunday Monday Tuesday Wednesday Thursday Friday Saturday Sun Mon Tue Wed Thu Fri Sat January February March April May June July August September October November December Jan Feb Mar Apr May Jun Jul Aug Sep Oct Nov Dec just now 1 minute ago $$1$$ minutes ago 1 hour ago $$1$$ hours ago Yesterday $$1$$ days ago $$1$$ weeks ago more than 5 weeks ago Followers Follow THIS PREMIUM CONTENT IS LOCKED STEP 1: Share to a social network STEP 2: Click the link on your social network Copy All Code Select All Code All codes were copied to your clipboard Can not copy the codes / texts, please press [CTRL]+[C] (or CMD+C with Mac) to copy