পরিচয়পর্ব
“হাংরি মুভমেন্ট খায় নাকি মাথায় দেয়?” এই বাক্য থেকেই হাংরির সাথে আমার পরিচয় ঘটে সৃজিত মুখার্জি পরিচালিত ‘২২শে শ্রাবণ’ ছবিতে। এরপর নানান ব্লগ আর পত্রপত্রিকার সহায়তায় এই মুভমেন্টের অদ্যোপান্ত জানতে পারি। এবং মলয় রায়চৌধুরী নামটার সাথেও আমার সেই স্টাডি থেকেই পরিচয়। হাংরি মুভমেন্টকে আদতে বলা যায়, সিস্টেমের গালে কড়া একটা থাপ্পড়।
এক তেজী নক্ষত্র
অক্টোবরের ২৬ তারিখ রোজ বৃহস্পতিবার যেন নির্বিঘ্নে নিঃশব্দে বিদায় নিলেন মলয় রায়চৌধুরী। ৮৪ তম জন্মবার্ষিকীর ঠিক ৩দিন আগে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে তিনি অসীমের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন। তিনি একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, প্রাবন্ধিক এবং হাংরিয়ালিস্ট ছিলেন। হাংরি মুভমেন্টের ইতিহাসে যাকে আমরা সবচেয়ে তেজী ঘোড়া বলতে পারি। যদিও পৃথিবীর বাতায়নে মলয় আজ আর নেই, তবু এই বাংলা সহিত্যের আকাশে তিনি রয়ে যাবেন উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতন। কারণ হাংরিই হলো বাঙলা সাহিত্যের না-বালকত্ব ঘোচানোর পথে বিশেষ প্রয়াস। রাবিন্দ্রীক লালিত্যকে ঝেড়ে ফেলে স্ব-কণ্ঠে নিজস্ব ভঙ্গিমায় নিজের বক্তব্য প্রকাশের সূচনা এবং সিস্টেমের গালে কষে থাপ্পড় মারার নাম হলো এই হাংরি মুভমেন্ট। প্রতিষ্ঠান-বিরোধীতা আসলে কেমন হতে পারে এই বিষয়ে জানতে তাঁর টেক্সট পড়লেই বোঝা যায়। লেখার জন্য যিনি কোনো-রকম পুরস্কার তাঁর জীবদ্দশায় গ্রহণ করেননি। এই সাহসকে অনেকে অহমিকা বলে থাকতে পারে, তবে আমি এই বিষয়কে দেখি আপোষহীনতা হিসেবে।
মলয় রায়চৌধুরীর সাক্ষর |
প্রচন্ড বৈদ্যুতিক ছুতার কেন
মলয় রায়চৌধুরী’র সাথে আমার পরিচয় ভার্চুয়াল জগতে। তাঁর সাথে কথাবার্তাও ঐ ভার্চুয়াল সীমানাতেই সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু তাঁর টেক্সট আমাকে নাড়িয়ে দিয়েছিল। এখনও মনে পড়ে সেইদিনটার কথা, যেই দিন আমি প্রথম ‘প্রচন্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ পাঠ করেছিলাম। তখন আমি কেবল কলেজে পড়তাম। আমার সাহিত্যপাঠকে দুই ভাগে ভাগ করা যেতে পারে। ১ম ভাগ ‘প্রচন্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ পড়ার আগের পর্ব এবং ২য় ভাগ হচ্ছে কবিতাটা পাঠের পরের পর্ব। ৯০ লাইনের এই কবিতা পড়ার পর সাহিত্য সম্পর্কে আমার ধারণা পাল্টে যায়। আমি বুঝতে শিখি শব্দের শ্লীলতা/অশ্লীলতা বলে কিছু নেই। কবি তাঁর প্রেমিকার প্রতি প্রেম নিবেদনের উদগ্র বাসনাকে সোজাসাপটা নিঃসংকোচে বলে গেছেন, এই যে কবিতায় ভণিতাহীন নিঃসংকোচে নিজেকে প্রকাশ করার সাহস, এই সাহস আমি ঐ ৯০ লাইনের কবিতাটা পাঠের পরই উপলব্ধি করতে পেরেছিলাম। প্রেমিকার প্রতি প্রেমে শরীরের ভিতর যে হাজার ভোল্টেজের বিদ্যুৎ খেলে যায়, সেই অনুভূতিরই নিরেট প্রকাশ এই ‘প্রচন্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’। মলয় রায়চৌধুরী’র অধিকাংশ লেখাই চাঁছাছোলা, ব্যাকরণকে ভেঙে সোজাসাপটা, প্রতিষ্ঠান-বিরোধী। তাঁর লেখালেখি বিষয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ করার ইচ্ছে আমার নেই। তাঁর সাহিত্য পড়ে মনে হয়েছে, সাহিত্যে তিনি অ্যানার্কিকেই হয়তো অস্ত্র হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। এবং দিনের পর দিন তিনি আপোষহীন সেই অস্ত্রে শাণিত করে গেছেন বাঙলা-সাহিত্যকে।
জঙ্গলরোমিও সম্পর্কে আলাপ
একটা নভেলা। ছোট্ট পরিসরে নিজস্ব ঢঙে গল্প বলে গেছেন। এই নভেলাটা আবার অসামাজিক গাধা এবং মানুষের গুয়ের গন্ধ নামে ২টা পর্বে বিভক্ত। এই গল্পে কোনো দাঁড়ি-কমা নেই, টানাগদ্যে লেখা। গল্পের শুরুর বক্তব্যতেই কেমন একটু অসহায় রকম কুন্ঠা জাগে।
কেন-কিঁ কেন-কিঁ কেন-কিঁ কবি লেখক নাট্যকার চিত্রকর অভিনেতা ভাস্কর স্হপতি এরা সবাই অসামাজিক গাধা…
যেন আয়নার সামনে নগ্নভাবে দাঁড়িয়ে গেছি। আর পরিত্রাণ নেই। যেন নিজের কাছেই নিজে ধরা পড়ে গেছি। আর কোনো ভ্রান্তিবিলাসের সুযোগ নেই। আত্মার ভীষণ গোপন কথাটিও যেন চাউর হয়ে গেছে। রটে গেছে সব জায়গায়। কোটেশন দেয়ার লোভ সামলাতে পারছি না। আরো ২টা কোটেশন আমাকে এখানে যোগ করতেই হবে।
…এই তো জঙ্গলে যে গাছ যতো উঁচুতে ওঠে সে তার শেকড়কে তত তলায় নামাতে থাকে...ওপরে উঠতে শোষণের জন্য নিচে নামতেই হবে...গোড়ার কাছে কাউকে মাথা তুলতে দেয়া হয় না...প্রকৃতির রাজনৈতিক নিয়ম...
অমোঘ এক সত্যকে লেখক এইখানে অবলীলায় প্রকাশ করেছেন। একেবারে মোক্ষম সাহিত্যিক উপায়েই তিনি এই কাজটি করেছেন।
…পরিবার হলো অতীতের পরানো আপনার পায়ের মরচেপড়া বেড়ি… আর ভবিষ্যৎ হলো আপনার সামনে লোভের সরকারি সেতু…
এই সত্যকে আপনি নাকচ করবেন কোন শক্তি দিয়ে? কোন যুক্তি দিয়ে আপনি বলবেন এই বক্তব্য মিথ্যে? আপনার মগজের জাদুবাক্সে এই কথাগুলো সুরসুরি দিবে। আপনি এই বিষয়ে নতুন করে ভাবতে বসতে বাধ্য হবেন। জঙ্গলরোমিও গল্পটা আদ্যোপান্তই এনার্কিতে ভরপুর। গল্পে থাকা গল্পটা সম্পর্কে আমি এইখানে তেমন কিছুই বলবো না। শুধু গল্পে থাকা নামহীন চরিত্রগুলো সম্পর্কে কিছু বলা যেতে পারে। ব্যাকরণগত গল্পে যেমন প্রোটাগনিস্ট থাকে, এই গল্পে তেমন কোনো কিছু নেই। শুধু আছে কয়েকজন পশুকামী ফেরারি এনার্কিস্টদের অগোছালো গল্প এবং বক্তব্য।
শেষ বললেই হয় না তো শেষ
এখন কথা সংক্ষিপ্ত করতে হবে। কথা শেষ বললেই তো আর শেষ করা যায় না। আরো অনেক থেকে যায় বাকী। কবি মলয় রায়চৌধুরী চলে গেছেন, বললেই তো শেষ হয় না, তিনি আরো অধিক রয়ে গেছেন তাঁর না-থাকা জুড়ে। তিনি থাকবেন পাঠকের হৃদয়ে আর বাঙলা সাহিত্যের আকাশে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে।
• আরো পড়ুন: মলয় রায়চৌধুরীর সাক্ষাৎকার
মলয় রায়চৌধুরী: হাংরি মুভমেন্টের তেজী নক্ষত্র
অসীম নন্দন
অসীম নন্দন
Lekhata valo lagse vai. Kintu short hoye gese. R o boro korle valo hoto
উত্তরমুছুন