কবি মুনিরা চৌধুরী আত্মহত্যা করেছিলেন। ২০১৮ সালের ১৭ই নভেম্বর যুক্তরাজ্যের কার্ডিফ সমুদ্র উপকূলে তাঁর মৃতদেহ পাওয়া যায়। তাঁর গ্রামের বাড়ি সিলেটের গোলাপগঞ্জ উপজেলার কানিশাইল। কবি মুনিরা চৌধুরী ১৯৭৬ সালের ৬ জানুয়ারি যুক্তরাজ্যের গ্লস্টারশায়ারে জন্মগ্রহণ করেন। যুক্তরাজ্যে জন্মগ্রহণ করলেও, বড় হন বাংলাদেশে। দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত বাংলাদেশে লেখাপড়া করেন। পরে লন্ডনে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে স্নাতকোত্তর এবং কার্ডিফ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী অর্জন করেন। ইংল্যান্ডে ফিরে মুনিরা চৌধুরী ইংরেজি ও বাংলায় কবিতা ও গদ্য লেখা শুরু করেন। তাঁর বেশ কয়েকটি বইও প্রকাশিত হয়। তিনি তিন সন্তানের জননী। ব্রিটেনে বাংলাদেশি সংস্কৃতির চর্চায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা মুনিরা ছিলেন সেখানকার বাঙালিদের কাছে পরিচিত মুখ।
তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থগুলো হলো, ‘নয় দরজার বাতাস’, ‘মৃতের মাতৃমঙ্গল’, ‘কাম ক্লোজ টু মাই পেন্সিল’ ও ‘মেহেকানন্দা কাব্য’। বাংলা একাডেমী ইউকে থেকে তাঁর নিজ দায়িত্বে বাংলা কবিতার আন্তর্জাতিক এন্থলজি ২১সেপ্টেম্বর, ২০১৭তে প্রকাশিত হয়। তাছাড়া চারজন কবির একশত কবিতা নিয়ে ‘চন্দ্রাহত কবিতা’ বইটি সম্পাদনা করেন। নিজ সম্পাদনায় আরো বেশ কয়টি কবিতা সংকলের কাজ হাতে নিয়েও সম্পন্ন করে যেতে পারেননি। যেমন, পয়েটা Poeta (Collection of Modern Bengali Poems 1930-1990); দিলওয়ারমঙ্গল এবং নির্বাচিত ডায়াস্পোরা কবিতা।
মৃত্যু ও আত্মহত্যা তাঁর কবিতায় ঘুরেফিরে এসেছে। বিন্দুর পাঠকদের জন্য তাঁর একগুচ্ছ কবিতা প্রকাশ করা হলো। –সম্পাদক
মৃতের মাতৃমঙ্গল
দু’ চোখের পাথর ছিদ্র করে গড়িয়ে পড়ে জল
পৃথিবীর প্রাচীন কবরে
হায়! এ-আনন্দধারায় আমিও জেনে যাই- বর্ষা এসেছে, তাজা জলে ডুব দেবে কঠিন কাছিম…
পাতিহাড়ে পড়ে বৃষ্টির ফুল, চকিত হরিণ ভয় নেই তোমার
আদি বর্ষায় জল আর গহীন জঙ্গলে আমরা ছিলাম আদি ভাই বোন…
সর্বদা মানুষ থাকি না তাই
অর্ধেক চাতক, চাতকিনী…
প্রতিঅঙ্গে বৃষ্টির গজল মাখি আমি আর মৃত ঠাকুর মা (সঙ্গে তাঁর ধর্মান্তরিত প্রেমিক)
হায় বর্ষা! জীবিত আর মৃতের
অনন্ত মাতৃমঙ্গল…
২.
পৃথিবীর জানালায় ভর দিয়ে দেখছি
গাছের পাতাগুলো কাঁপছে, পাতার আড়ালে স্বর্গের ফল ঝুলে আছে
নদীতে নেমে-যাওয়া সেই রাস্তাটায় ঝিরঝির হাওয়ার মুখ ভেসে ভেসে ডুবে যায়…
অনেকটা ডুবন্ত মানুষের চোখে দ্রুত সরে যাচ্ছে জলের প্রবাহ
এভাবেই
রোকমচিন্তাহীন, ভাবেই এক জীবন…
আবছা গোধূলির আলো ঘরে ঢুকতে না ঢুকতেই কেউ প্রথম বাতিটি জ্বালিয়ে দিলো
সে আলো জ্বলজ্বল করছে আয়নায়
যেন মহারাত্রির অপেক্ষায় একটি জোনাকিপোকা।
৩.
এবার সত্যি সত্যি বিদ্যুত চমকায়
খাঁচা থেকে পাখিগুলো বেরিয়ে আসে
বিদ্যুতের ছিদ্রে পাখিগুলো ঘুমিয়ে পড়ে আবার জেগে ওঠে।
ক্রমে পালক ঝরছে, পাতা ঝরছে, শিশির ঝরছে…
কতিপয় মানুষ পাখির শরীরে প্লাস্টিকের পালক লাগিয়ে দিয়ে যায়
পৃথিবীতে আবার ঝড় আসে
আর প্রতিটি ঝড়ের শেষে ভোর বেলা দেখি
ধর্মবিদ্যালয়ের আলখাল্লা পরা সেই ছাত্রদের মত পাখিগুলো আমার উঠোনে দাঁড়িয়ে রয়েছে৷
৪.
ফ্লাক্সের মধ্যে তরল চা-বাগান লুকিয়ে রেখেছিলাম
এখন আফিমের গন্ধ পাচ্ছি; পান করছি পরমায়ু…
বারান্দার মাথায় রঙিন কাচের স্কাইলাইট
ছায়াচিত্রটি ক্রমে মুছে যায়
টবে-ঝোলানো বারান্দা স্থায়ী হয়ে যায় ধূসর দেয়ালে দেয়ালে
ঘরের মধ্যভাগ ছিদ্র করে এক বাটি আলো স্থির পড়ে থাকে মেঝেতে।
বেতের চেয়ারে তুমি বসে আছো, স্বর্গ পলাতক
বাদামি চুলে যেনো পুরনো এক ফটোগ্রাফের পূর্ণিমা, পরিষ্কার হাওয়ার কোলাহল…
আর আমি হতে চাই সেইজন
যে তোমার অভিনয় আর গলার স্বরের ওপারে যেতে পারে।
৫.
সবুজ-সন্ত্রাসের অধিকার অপন করেছো
নিজের মতো করে
নিজের ভেতরে…
রক্তের পাশে ঝলসানো হৃৎপিণ্ড
এলোমেলো চাঁদের মাংস আর
আগুন-লাগা রক্তজবার যৌবন বাড়িয়ে দিয়েছো বহুবর্ষ।
কে তুমি মহাকাল, ১৯১৭…
বঙ্গোপসাগর ছুঁয়ে চাওয়া নিম্মচাপ আজ বড়ই প্রবল…
কেনো এক বসন্তদিনে শুনেছিলাম, রাজপুত্র আসবে ঘোড়া-টানা-গাড়িতে করে…
সেই রাজপুত্র কোনোদিন আসেনি
প্রিয় রাক্ষস এসেছে, যার জন্ম হয়েছে আমার করোটী থেকে
৬.
স্বপ্নেরও হাত আছে, চোখ আছে, ঠোঁট আছে…
দু’বছর আগের সেই শিউলি-ফোটা ভোরেরও অবয়ব ছিল
আজ গোপন পাঁজর খুলে দেখলাম
আমার জীবনের সেই একটা মাত্র ভোরের মুখখানা কেমন শুকনো শুকনো লাগছে…
আমি সঙ্গপনে ঠাকুর মা’র পিতলের কৌটা থেকে শরৎকাল বের করে নিয়ে আসি
স্বর্গের শিশির দিয়ে ধুয়ে দেই ভোরের দুইচোখ, মথুরা বৃন্দাবনের ঘুমসমগ্র।
৭.
আজ এই পূর্ণিমার রাতে
পূর্বপুরুষের নিঃশ্বাস ফেটে যাচ্ছে গলিত কফিনের ভেতর
কাগজের পরতে নড়ে উঠছে জিরাফের মাথা, গোপন রক্তপ্রবাহ
প্রশ্ন নিয়ে দাঁড়িয়ে-থাকা সাদা কাগজের মুখ মিলিয়ে যাচ্ছে গহীন কুয়াশায়।
স্থির দাঁড়িয়ে থাকি
গ্রহণ করি কুয়াশার কামড়…
একসময় সূর্য উঠে
কষ্টিপাথরের গন্ধ ফেটে পড়ে গর্ভবতী মায়ের জঠরে
জবাই-হওয়া শব্দের গলা বেয়ে সাদা রক্ত ঝরছে তো ঝরছে…
অবশিষ্ট তারা ফাঁসির জন্য ছটফট করে।
শব্দের ফাঁসি দেবো বলে
কাগজ কলমের বদলে বিস্মৃতির মেহেকানন্দা নদী নিয়ে আসি
শব্দের বদলে ঝুলে পড়ে ঈশ্বরের গলা।
৮.
আমার ডায়রিতে একটুও জায়গা নেই
ব্লেড দিয়ে কাটা-রাত আর নার্ভ থেকে ঝরা-রক্ত চারদিকে।
কিছু রক্ত আবার পুড়ছে। কাটা-মাংস হতে শূকরের আর্তচিৎকার ভাসমান…
ছিলে-তোলা চাঁদের খোসা ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে রয়েছে…
ডায়রিতে আছে হরিণের মাথা, কাক ও পেন্সিল, আমার প্রেমিকের কলিজা ও পাতিহাড়
মৃত ঈশ্বরের কবর ও চিতা পাশাপাশি
আজ একপাল মৃত পাখি উড়ে এসেছে ব্যাবিলন থেকে, আরও একবার আত্মাহুতি দেবে বলে।
আমি ডায়রির ভেতর লুকিয়ে পড়েছি
ছায়া ও শব্দের ছাইদানীর ভেতর ছাই হচ্ছি, ছাই।
৯.
আমি জেগে থাকি
কাটা-হাতখানা অন্য-হাতে নিয়ে সারারাত জাগি
অনন্ত ভোরের দিকে হাতের গহীনে জ্বলে ওঠে হাতের চিতা
হাড়-গলা গরম ঘন হয়ে এলে কেবল শীত শীত লাগে… ঘুম লাগে
এইসব মুনিরা ঘুমের ঘোরে কোথাও কোনো জানালা নেই; সই সই নয় দরজার বাতাস…
১০.
ছায়া ছায়া, অন্ধকারে ডুবে হাওয়া, মুখ দেখা যাচ্ছে না কিছুতেই
ছায়ার ভেতর মিশে যাওয়া দু’টি আবছা ছায়ামূর্তি
একই রকম অথচ কত আলাদা
একটি শরীর নিষ্ক্রিয়, নির্দোষ, নিস্পৃহা আর চরম উদাসীনতা নিয়ে চলছে মাটির ওপর…
আর
অন্যটি সামান্য ঝুঁকে, আবর্জনা আর ঝোপঝাড়ের ওপর দিয়ে নিয়ে চলার চেষ্টায় হাঁপাচ্ছে…
মাঝে-মধ্যে থেমে থেমে নিঃশ্বাস নেয়ার চেষ্টা
তারপর আবার আরো ঝুঁকে টেনে টেনে চলে তার বোঝাখানি
হতচকিত হয়ে দেখতে পেলো কী সামান্য পথই না পের হয়েছে!
ছায়া ডুবে গেলে
ঘরের ভেতরে ঘর আর চোখের ভেতরে চোখ ঘুমিয়ে পড়ে
হয়তো জোনাকী পোকার ভেতর পৃথিবীর অবশিষ্ট আলো জেগে আছে!
১১.
পাতার পরত বেয়ে বেয়ে ঝরে-পড়া ঝর্ণার আওয়াজ
হাড় হতে হাড়ের ভেতরে…
গাছের বুক হতে পাখিদের বুক বেয়ে ধাবমান, বৃষ্টির বিলাপ।
বিক্ষুদ্ধ
বাতাসের গান…
বাতাসের হাত-পা-আঙুল আমাদের কাচের জানালায় ডুবে ডুবে যায়
গ্রীষ্মের এই গহীন সন্ধ্যায়
অগ্নিকালো আকাশের নিচে দীর্ঘ দাঁড়াই
আমি আর আমার ছোটবোন আত্মহত্যা
এখন কি পরিষ্কার হলো তোমাদের আয়নার কুয়াশার আবরণ!
১২.
চোখ জোড়া যেনো ঘুমের মধ্যে গলে যায়…
উঁচু উঁচু বিশাল ঢেউয়ের মধ্য দিয়ে নৌকা চালাই
নৌকায় আমার মৃত ঠাকুরমা আর মহাশূন্যের একটি পিঙ্কি বিড়াল
চোখবিহীন ঘুমের সর্বত্র শুধু ঘুম
কপালের দু’পাশে সাগরের ঢেউয়ের মতই নাড়ি টিপটিপ করে
মনে হয় দুই খন্ড ভাবনার সমুদ্র
এরপর কী হলো?
না, এর আগে কী হয়েছিলো?
অবশ্য আগে-পরে বলে কিছু নেই
যাত্রা সবসময়ই বর্তমানের
নৌকা, মৃত ঠাকুরমা আর পিঙ্কি সবকিছুই বর্তমান মুহূর্তের অস্তিত্বশীল
সবকিছুই স্থিরীকৃত
স্থির আবার চলমান
ঘুমের বিপুল ননীর মধ্যে সবকিছু দোলে…
মুখে চোখ নেই, চোখের তারা নেই
আছে কেবল সর্বব্যাপী ঘুম
দুই চোখের পাতা জুড়ে ঘুমের প্রপাত৷
হেমন্তে রচিত হেমলক
১.
মহাকালের ছবি দেয়ালে টাঙিয়ে ছিলাম সেই কবেকার ঘোরগ্রস্ত ভোরে, সেলাই করে করে... সেইসব ছায়া-চেহারাগুলো এখন ঝাপসা হয়ে গেছে... ছাদের উপর বৃষ্টির আঙুলগুলো ফেটে পড়ছে উচ্চাঙ্গসঙ্গীতে না কি কান্নায়- ঠিক বুঝতে পারি না... কৈশোরে কাগজের নৌকা ভাসিয়েছিলাম পুকুরে... ভেবেছিলাম- নৌকাগুলো বড় হবে একদিন, দেখা হবে মেহেকসমুদ্রে...
আমার পাখিরা আর উড়াল দিলো না... দূর অতীতে পাখিদের ডানা কেটে দিয়েছিলাম পাখিদের ডানা রেখে দিয়েছিলাম ছোটবেলার অ্যালবামে...
২.
এখন নৈঃশব্দের শব্দরা ঘুমিয়ে পড়েছে... চিরদিনের জন্য ঘুমিয়ে পড়েছে... মরুভূমিতে একা একা টেনে টেনে নিয়ে যাচ্ছি বালির নৌকো
দূরতম জানালার পাশে দেখি- চিরচেনা কারো ছায়া ভেসে ভেসে ডুবে যায় আয়নাগুলো গলে গলে যায়...
চক্ষু খুলে দেখি- কোথাও চক্ষু নেই, ছায়া নেই, বিম্ব-প্রতিবিম্ব নেই শূন্য কুঠরিতে পড়ে আছে মৃত সব মুনিরামায়া আমার অগ্নিমায়া...
৩.
নরকের নীল আগুনের চারপাশে লেলিহান জিহ্বাগুলো উড়ছে উড়ন্ত জিহ্বায় গেঁথে যাচ্ছে আর্তনাদের ধ্বনি ও প্রতিধ্বনি আমি যাই নি কোথাও আমার পাণ্ডুলিপি থেকে সবগুলো লেখা চলে গেছে
হাতখানি যে রক্তে ডুবে আছে... কী করে লিখি কথা ও মুনিরাকথা, নদী ও মেহেকানন্দার জল তবু- স্ফটিকের পাখি প্রত্নকলম তুলে দিচ্ছে হাতে
আমায় ক্ষমা করো পাখি, পাখির পালক, আমায় ক্ষমা করো নদী, নদীর দুইপাড় আমায় ক্ষমা করো ক্ষমা করো ক্ষমা করো ক্ষমা করো ক্ষমা করো রক্তকরবী আমি যে পাথর কুচি...
৪.
ভেবে নাও তুমি- মঙ্গলরূপ কিছুটা পুড়ে গেছে পুড়ে-যাওয়া জলের ছোবলে ভোর বেলার আলোয় কোনো কমলা-রঙ নেই, ছাই-রঙা বালিকার গুড়া গুড়া শরীর ব্যতিরেকে ভাঙ্গা মন্দিরের পাশে আমাদের ভাঙ্গা-শঙ্খের আওয়াজ ভাঙছে তো ভাঙছে সখা হে, মমি হয়ে শুয়ে আছি অগ্নিঝর্ণার নিচে
আর জাগবো না আর জাগবো না
কেনো জাগাতে চাও তবে কেনো জাগাতে চাও ঘুমিয়ে-পড়া মৌমাছির ঝর্ণা
এই মমি আবার কি মানবী হবে মথুরা বৃন্দাবনে।
মেহেরকান্দার কবিতা
আয়নার দাগ
আয়না হতে পিছলে পড়েছে মুখগুলো
আজ তোমার মুখের গভীরে দেখি ভেঙে-যাওয়া সেই আয়নার দাগ।
বিবর্ণ থৈ থৈ
বিধবার শাদা চোখের মতো চারদিক…
হে দিন, হে রাত্রি, হে বসন্ত, হেমন্ত মৌসুম
হে প্রজাপতির ডানা, পাখির পালক, হে বৃন্দাবনের সিঁদুর
কোথাও কোনো রঙ নেই
আমাদের মেহদীবাগান কালো কুয়াশার নিচে ঢাকা পড়ে আছে।
শুনেছি পাথরে মেহদীপাতা ঘষলে রঙের হলাহল বের হয়ে আসে
আমি আজ হৃৎপিণ্ডকে পাথর বানিয়ে নিয়েছি।
মৃত্যু, মুনিরাহেনা…
আজ এই শুক্লা দ্বাদশীর চাঁদ ফেটে গিয়ে
নীল-বর্ণ আলো ঝরছে
নরক প্রদেশে।
নরকের নয় দরজা খুলে বসে আছি আমি আর একটা অন্ধ হরিণী…
দু’চোখ ছিদ্র করে
গলিত চোখের রঙে চন্দ্রের পিঠে এঁকে দিয়েছি গাছের ছবি
এই গাছ স্বর্গের গাছ
এক একটা শিশু মৃত্যুর পর সেই গাছে একটা করে ফুল ফোটে
ওহ ঈশ্বর
সময় হলে কি তুমি দেখে যাবে
সেই গাছে অনেক অনেক ফুল ফুটেছে
তুমি কি একবারও শুঁকে যাবে না হাসনাহেনা অথবা মুনিরাহেনার গন্ধ!
নয় দরজার নদী
১.
তোমার সঙ্গে দেখা হয়েছিল নয় বছর আগে
এই নয় বছরে নয়-দরজার-নদী তৈরি করেছি
তুমি কি একবার সময় করে আসবে
জলের জানালাগুলো লাগিয়ে দিয়ে যাবে!
২.
সময় পেরিয়ে যাচ্ছে ছিপছিপে এক মাতামুহুরী নদী
নদী পেরিয়ে যাচ্ছে সময়
হাতের নীলবর্ণ রেখায় এ-কার ছায়া দেখা যায়!
ছাদের উপর বৃষ্টির গুঞ্জন থামছে না কিছুতেই
তানপুরার হৃৎপিণ্ডে আঙুল ফেটে গেলে বুঝতে পারি না
এ-কান্না উচ্চাঙ্গসঙ্গীতের নাকি মাতামুহুরীর
ঘরের জানালা কিছুতেই বন্ধ হয় না
আমাদের জানালায় আটকে রয়েছে নদীর দরজা।
৩.
চাঁদের শরীর থেকে বের হচ্ছে ধূয়া ও শিশির
দুই হাজার বছর আগেকার রাত ছাই হবে দুই হাজার সতের সালে
দু’চোখের অন্ধ ছায়া উড়ে যাচ্ছে অন্ধকারে
পাখিরা নৌকা চালায় বাতাসের নদে
নিঃশ্বাস ফেটে যাচ্ছে ধীরে
গাছের
মানুষের…
ফাটা-নিঃশ্বাসে তুমি কি একবারও আত্নহত্যা করতে আসবে না!
৪.
বিষ পান করছি নাকি বিষের নিঃশ্বাস নিচ্ছি
পান করছি পরমায়ু
প্রজাপতির ডানা লাগিয়ে দিয়েছি
ধীরে চলো
ধীরে চলো
নিমাই সন্ন্যাসীর গ্রাম যে বহু দূর
ঐ দূরত্বে
নিভে যাচ্ছে অতলান্ত এক আত্মার ছায়া…
৫.
কে যেন আমার কন্ঠস্বর থেকে
নিদ্রাতুর কিছু শব্দ লুণ্ঠন করে নিয়ে যায় নিধুয়া পাথারে
অতঃপর কাচের করাত দিয়ে শব্দগুলো কুচি কুচি করে ভাসিয়ে দেয়
আড়িয়াল খাঁ’র বুকে
ভাসে গলাকাটা নদী
ভাসে নারী
ভাসে গলাকাটা নক্ষত্র
শকুনের ডানায় চিৎকার ভাসে জল ও স্থলভূমে…
মৃত্যুর গন্ধ চৌদিকে
দূরে যাই
দূরে যাই
পৃথিবীর কোনো এক রান্নাঘরে আলু-পটল কাটতে ভুলে যাই
আমি আমাকে কেটে ফেলতে ভুল করি না
ওহ পাখি, পরমাত্মা…
আট দরজার আগুন
সবুজ-সন্ত্রাসের অধিকার আপন করেছো
নিজের মতো করে
নিজের ভেতরে...
রক্তের পাশে ঝলসানো হৃৎপিণ্ড
এলোমেলো চাঁদের মাংস আর
আগুন-লাগা রক্তজবার যৌবন বাড়িয়ে দিয়েছো বহুবর্ষ।
কে তুমি মহাকাল, ২০১৭...
বঙ্গোপসাগর ছুঁয়ে-যাওয়া নিম্নচাপ আজ বড়োই প্রবল...
কেনো এক বসন্তদিনে শুনেছিলাম, রাজপুত্র আসবে ঘোড়া-টানা-গাড়িতে করে...
সেই রাজপুত্র কোনোদিন আসে নি
প্রিয় রাক্ষস এসেছে, যার জন্ম হয়েছে আমার করোটী থেকে
দিনান্তে
এ-যে কবিতা এক, চম্পাবতী নদীতীরে কেশর উড়িয়ে দেওয়া
বোবার না-বলা কথাগুলো টেনে হিঁচড়ে নিয়ে আসা, তারপর
পাখিদের ঠোঁটে তুলে দেওয়া…
হায়!
শব্দ বদল হতে হতে পাখির সঙ্গে পাখা বদল করে কবিতা…
নদীতীরে বটগাছের গর্তে কাঁচা-পাকা সময় বেড়ে উঠছে ধীরে
দুলছে শীর্ণ তরুলতা, সাপের বাচ্চা
দিনান্তে পাখি উড়ে যায়
নদীতীরে পড়ে থাকে মানুষের পালক। দিনান্তে
এ-যে কবিতা এক, চম্পাবতী নদীতীরে কেশর উড়িয়ে দেওয়া
বোবার না-বলা কথাগুলো টেনে হিঁচড়ে নিয়ে আসা, তারপর
পাখিদের ঠোঁটে তুলে দেওয়া…
হায়!
শব্দ বদল হতে হতে পাখির সঙ্গে পাখা বদল করে কবিতা…
নদীতীরে বটগাছের গর্তে কাঁচা-পাকা সময় বেড়ে উঠছে ধীরে
দুলছে শীর্ণ তরুলতা, সাপের বাচ্চা
দিনান্তে পাখি উড়ে যায়
নদীতীরে পড়ে থাকে মানুষের পালক।
মেহেকানন্দা নদীতীরে
এক.
আত্মহারা আমি— বেঁচে থাকবো নাকি মরে যাব
কে ডাকছে আমায়! তুমি না স্বয়ং ঈশ্বর!
পিয়ানোবাদক মঞ্চে এসে বসলেন। একটু কায়দা করে কাশলেন। এরপর একমুহূর্তের জন্য ধ্যানমগ্ন হলেন। ঘর আলো করা উজ্জ্বল ঝাড়বাতিটি একসময় ম্লান হয়ে একটা নরম আলোয় এসে থামে। আর স্তব্ধতার মধ্য থেকে জেগে ওঠে একটি সুরধ্বনি, ক্রমে যা সংযত ও পরিমিত বিস্তারের সঙ্গে ঘরময় ছড়িয়ে পড়ে।
‘মোৎসার্ট কী?’ ভাবি। যথারীতি প্রোগ্রামটা চাইতে ভুলে গেছি। ‘মোৎসার্ট বোধহয়, নাকি স্কারলাট্টি?" গানের ব্যাপার এত কম জানি! অবশ্য এমন নয় যে, গান বুঝি না বা ভালোবাসি না। শৈশবে পিয়ানো শেখার আবদার তো আমি-ই করেছিলাম। যে বছর শিখতে শুরু করেছিলাম সে বছরই ছেড়ে দিলাম। ছেড়ে দেবার কারণটি যেমন সোজা, তেমনি লজ্জারও।
কিছুতেই স্বরগ্রামের ‘মা’ ধ্বনিটি শিখে উঠতে পারিনি। কিছুতেই না। বুঝি না ‘মা’ এর পর কেন আর কিছুই মনে থাকে না। এই দেখে মা এর কী রাগ! না জানি কতটা কষ্ট পেয়েছেন! মেয়েটা অপদার্থ! তাই অপদার্থ হিসেবে দেখাই তার সহজ মনে হয়েছিল।
আমি আর কষ্ট করতে পারি না। কোনো লাভ নেই। থাকগে ও নিজের মতো পড়াশোনা না করলে নাই করুক। ওর যদি ভূতের গল্প শুনতেই ভালো লাগে, তাই সই। ষোলো বছরেও যদি পুতুল খেলতে চায়, খেলুক ও পুতুল নিয়ে।
না হলো পুতুল খেলা, না হলো পড়াশোনা। মূর্খ হওয়ার কী আনন্দ!
দুই.
আজ আমার কোনো কর্ম নেই
মেহেকানন্দা নদীতীরে কেবলই রোপণ করছি বৃষ্টি ও কৃষ্ণদাগ...
হঠাৎ শরীরটা কোনো একটা বিন্দুতে আটকে গেলে সে পেছন ফিরে তার পা দুটো ধরে দাঁত কামড়ে শক্ত মাটির ওপর দিয়ে টেনে নিয়ে ঢালু জমিন ধরে চলতে লাগলো। টেনে নেয়া শরীরের মাথাখানি এদিক-ওদিক দুলছিল, যেন সে অবস্থান পাল্টানোর জন্য আনন্দ প্রকাশ করছে। হঠাৎ বাঁক নেয়া একখানা গাড়ির আলোর ঝলক আবর্জনা, ঝোপ আর আসমান ভূমির ওপর পড়ে চারপাশ উজালা করে তুললো। লোকটি তখন চট করে শুয়ে পড়ে অপরজনের পাশে। এক মুহূর্তের জন্য দুটো মুখের বৈশিষ্ট্য যেন আঁকা হয়ে রইলো, একটি ভয়ে নীলবর্ণ, অপরটি ধুলোয় ভরা, অনুভূতিহীন। আবার অন্ধকার গ্রাস করে নেয় দুজনকে। লোকটি উঠে দাঁড়িয়ে আরও কিছুদূর টেনে নিয়ে গেল বোঝা, পথ রোধ করে দাঁড়ানো উঁচু ঝোপগুলো পর্যন্ত। তারপর আবর্জনা আর শুকনো ডালপাতা দিয়ে ঢেকে দিলো। যেন সে ভাগাড়ের দুর্গন্ধ আর আসন্ন বৃষ্টির হাত থেকে রক্ষা করতে চাইছে। অতঃপর একটু থেমে কপালের ঘাম মুছে ক্রুদ্ধ ভঙ্গিতে শব্দ করে থুথু ফেলে। এমন সময় শিশুর কান্নার শব্দে সে চমকে ওঠে। আবর্জনার মধ্য থেকে উঠে আসা ক্ষীণ চাপা কান্না, যেন তার নিচে চাপা পড়া মানুষটিই শিশুর রূপ ধরে কেঁদে উঠে অভিযোগ জানাচ্ছে।
সে পালাতে গিয়েও থেমে যায়। বিজলি চমকানোর আলোয় অন্ধকারে উদ্ভাসিত হয়ে উঠলো পুলের লোহার মাস্তুল; আর সে হতচকিত হয়ে দেখতে পেল, কী সামান্য পথই না পার হয়েছে। পরাজয়ের গ্লানিতে তার মাথা নত হয়ে আসে। সে হাঁটু গেড়ে বসে গন্ধ শুঁকে শুঁকে সেই একঘেয়ে ক্ষীণ কান্নার উৎসের দিকে এগিয়ে চলে। হঠাৎ তার চোখে পড়ে এক দলা শাদা বস্তু। হতবুদ্ধির মতো দাঁড়িয়ে থাকে সেখানে সে কিছুক্ষণ। তারপর চলে যাবার জন্য ইতস্তত কয়েক পা এগিয়েও বেশিদূর যেতে পারলো না। কান্নার শব্দ তাকে পেছনে টেনে ধরে রাখলো। সে একটু একটু করে আবার ফিরে এলো, ঘন ঘন শ্বাস পড়তে থাকলো তার। আরেকবার হাঁটু গেড়ে বসলো সে, তখনো দ্বিধান্বিত। তারপর দু`হাত বাড়িয়ে দিলো। সেই শাদা পিণ্ডের মোড়কটি নড়েচড়ে ওঠে। সেখানে ছোট্ট এক মানবশিশু কতগুলো খবরের কাগজের পাতার মধ্যে যুদ্ধ করছে। লোকটি তাকে কোলে তুলে নেয়। তার ভাবভঙ্গি অনিশ্চিত, অনেকটা যেন প্রবৃত্তি তাড়িতের মতো, যেন সে কী করছে নিজেই জানে না, অথচ না করেও পারছে না। সে ধীরে ধীরে সোজা হয়ে দাঁড়ায়। যেন তার এই আচমকা অপ্রত্যাশিত কোমল ভাবাবেগের জন্য নিজের ওপর বিরক্ত সে; তারপর নিজের অজ্ঞাতেই গায়ের জ্যাকেট খুলে সেই জলে ভেজা কান্নারত শিশুটির গায়ে জড়িয়ে দেয় এবং হঠাৎ গতি বাড়িয়ে দিয়ে অনেকটা দৌড়োনোর ভঙ্গিতে সে ওই কান্নাকে সঙ্গে নিয়ে ভাগাড় থেকে বেরিয়ে অন্ধকারে মিলিয়ে যায়।
অস্তিত্ব বিলীন হলো
অন্য কোনো সঙ্গ বা অনুষঙ্গে নয়
আমরা এক সঙ্গেই মারা যাব...
তিন.
কৃষ্ণদাগ ঘন হচ্ছে
খা খা করছে অন্ধকারে ডুবে যাওয়া দুটি আবছা ছায়ামূর্তি
মুখ দেখা যাচ্ছিল তো দেখা যাচ্ছিল না...
একই রকম অথচ কত আলাদা
একটি শরীর নিষ্ক্রিয়, নির্দোষ, নিস্পৃহা আর চরম উদাসীনতা নিয়ে চলছে মাটির ওপর দিয়ে...
অন্যটি সামান্য ঝুঁকে তাকে আবর্জনা আর ঝোপঝাড়ের ওপর দিয়ে টেনে নিয়ে চলার কষ্টে হাঁপাচ্ছে। মাঝে-মধ্যে থেমে দম নেবার চেষ্টা
তারপর আরো ঝুঁকে টেনে চলে বোঝাখানি।
হাজামজা নালার পচা জলের গন্ধে চারদিক ক্রমে আরো দুর্গন্ধময় হয়ে ওঠে ভাগাড়ের মরচে ধরা জঞ্জাল আর মৃত প্রাণীর গলিত মাংসের বদবুতে, বাজে আবহাওয়ার দিনের মতো এই পচা থিকথিকে গন্ধই যেন ঝেড়ে ফেলতে চাইছে থেকে থেকে মুখ মোছার ভঙ্গি করে। ঘন ঝোপের গায়ে জড়াজড়ি করে পড়ে থাকা রুপালি ইস্পাত কিংবা কাঁচের টুকরোর ঘষা লেগে উদ্ভুত একঘেয়ে ভুতুড়ে সংগীত দুজনের কারোরই কানে যাবার কথা নয়। মাটির নিচ থেকে ভেসে ওঠা নগরের চাপা গুঞ্জনের শব্দও নয়। এমনকি যাকে টেনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে সেই নরম শরীরের সঙ্গে মাটি, ঝরাপাতা, কাগজের টুকরো, ছেঁড়া জুতো, দোমড়ানো টিনের প্যাটরা ও নুড়ি পাথরের ঘষটানোর শব্দও নয়। মাঝে মাঝে কোনো উঁচু পাথর কিংবা গাছের ডালে তার কাঁধ ঠেকে যাচ্ছিল। সে এখন গা ঝটকা দিয়ে নিজেকে ছাড়িয়ে নিচ্ছিলো, মুখ থেকে বেরিয়ে আসছিল ক্রুদ্ধ আওয়াজ, অনেকটা বিশাল বোঝা বয়ে নিয়ে যাওয়া মুটেদের মুখ নিঃসৃত বায়বীয় ‘হাঁ’ ধ্বনির মতো। বোঝাখানি নির্ঘাৎ ভারি উঠছিল ক্রমশ। তবে শুধু নীরব প্রতিরোধই নয়, যতশীঘ্রি সম্ভৱ কার্যোদ্ধারের তাড়াতে সমস্ত শক্তি যে ক্ষয়ে যাচ্ছে সেটাও ভীত করে তুলছিল।
প্রথমে সে তার হাত ধরে টেনে নিয়ে চলছিল। রাত্রি এতটা মেঘে ঢাকা না থাকলে কারোও চোখে পড়তো কোনো উদ্ধারকার্যের ওল্টানো নেগেটিভের মতো দু`জোড়া হাতের যুগল বন্দি। কৃষ্ণদাগ ঘন হচ্ছে করুণ কান্না ও কীর্তনের সুর...
আজ কোনো কর্ম নেই
মেহেকানন্দা নদীতীরে কেবলই রোপণ করছি বৃষ্টি ও কৃষ্ণদাগ…
ছায়াচিত্র
১.
দূর শৈশবে স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পথে
কাচের টুকরো কুড়িয়ে পেয়েছিলাম
কাচের ভেতরে নিজের চেহারা লুকিয়ে রেখেছিলাম।
নিজের চেহারা লুকিয়ে রেখেছিলাম বাবা-মা, ঠাকুর মা, চন্দ্র-সূর্য্য হতে বহুদূর
দূরতম কোনো গ্রহের গভীরে...
তিরিশটি বছর ঘুমঘোরে ছিলাম
ঘুম-ভেঙ্গে দেখি-
আমি সেই কাচের টুকরো হারিয়ে ফেলেছি
আমি আপন চেহারা হারিয়ে ফেলেছি।
২.
ফ্লাক্সের মধ্যে তরল চা-বাগান লুকিয়ে রেখেছিলাম
এখন আফিমের গন্ধ পাচ্ছি; পান করছি পরমায়ু...
বারান্দার মাথায় রঙিন কাচের স্কাইলাইট
ছায়াচিত্রটি ক্রমে মুছে যায়
টবে-ঝোলানো বারান্দা স্থায়ী হয়ে যায় ধূসর দেয়ালে দেয়ালে
ঘরের মধ্যভাগ ছিদ্র করে এক বাটি আলো স্থির পড়ে থাকে মেঝেতে।
বেতের চেয়ারে তুমি বসে আছো, স্বর্গ পলাতক
বাদামি চুলে যেনো পুরনো এক ফটোগ্রাফের পূর্ণিমা, পরিষ্কার হাওয়ার কোলাহল...
আর আমি হতে চাই সেইজন
যে তোমার অভিনয় আর গলার স্বরের ওপারে যেতে পারে।
কীর্তন
১.
মুনিরায়ানা কীর্তনীয়া সুরে
বাজে বাঁশি, করুণ বাঁশের বাঁশি, বাজে হাড়ের বাঁশি...
আয় তবে হাড় ভেঙ্গে ফেলি, নদীর দুই পাড় ভেঙ্গে ভেঙ্গে যায়।
বাঁশির রসে এমন পূর্নিমাসুন্দরী ভাসে
ঘৃতকুমারীর বনে
সখা হে
আয়, মাঝ দরিয়ায় ভাঙ্গা তক্তা ও আমাদের কলিজার নৌকা ডুবিয়ে ফেলি
চিরতরে
চিরতরে।
অহ সুর!
মুনিরায়ানা কীর্তনীয়া সুরে
মৃত্যু ও প্রেম একাকী দাঁড়িয়ে রয়
পৃথিবীর অনন্ত ভোরে।
২.
নয়নে আনন্দ-বিষাদ, মরা নদীর জল...
ওহে মধুমূর্তি
নয়নের গভীরে বসো একবার
বসো কাঙ্গালের সভায়
আসিবে, আশায় হৃদি-পদ্মাসন পাতিয়া রাখিয়াছি
ধোয়াবো চরণ নয়নের জলে...এমন তো নয়
মুনিরাকথা
ঈশ্বর হও
তুমি কবি হও
পৃথিবীর যত গান, এইসব কবিতাবলী
গীত হোক, গীত হোক মৃতের সন্মানে…
মুনিরাকথা
বৃষ্টির সাথে কোনো এক নাইওরি এসেছিলো মেঘে-ঢাকা গ্রামের ঐপার থেকে
ভেজা চুলের বন্ধন খুলে বসেছিলো
আমার বারান্দায়...
উপরের দিকে তাকিয়ে বললো
সিন্দু মা, আকাশের গর্তগুলো ঝরে পড়ছে কেনো, খসে পড়ছে কেন নরম নাভীগুলো
আমি তবে কোথায় গিয়ে থাকবো!
তারপর সে নিমিষে নাই হয়ে যায়
দিন যায়
বছর যায়
নাইওরি আর আসে না...
আর আমার বুকের বারান্দায়
চিরদিনের জন্য লেগে থাকে নাইওরির গন্ধ, মৃত্যুর মতো...
২.
আয়না হতে পিছলে পড়েছে মুখগুলো
আজ তোমার মুখের গভীরে দেখি ভেঙে যাওয়া সেই আয়নার দাগ।
বিবর্ণ থৈ থৈ
বিধবার শাদা থানের মতো চারদিক...
হে দিন, হে রাত্রি, হে বসন্ত, হেমন্ত মৌসুম
হে প্রজাপতির ডানা, পাখির পালক, হে বৃন্দাবনের সিঁদুর
কোথাও কোনো রঙ নেই
আমাদের মেহদীবাগান কালো কুয়াশার নীচে ঢাকা পড়ে আছে-
শুনেছি পাথরে মেহদীপাতা ঘষলে রঙের হলাহল বের হয়ে আসে
আমি আজ হৃৎপিণ্ডকে পাথর বানিয়ে নিয়েছি।
৩.
কালো জ্বরে মৃত্যু হবে না হে পুত্র!
আমার মৃত্যু হবে বেঁচে থাকাতে…
নাইওরি
বৃষ্টির সাথে কোনো এক নাইওরি এসেছিল মেঘে-ঢাকা গ্রামের ঐ পাড় থেকে
ভেজাচুলের বন্ধন খুলে বসেছিল
আমার বারান্দায়…
উপরের দিকে তাকিয়ে বললো
সিন্ধু মা, আকাশের গর্তগুলো ঝরে পরছে কেন, খসে পড়ছে কেন নরম নাভীগুলো
আমি তবে কোথায় গিয়ে থাকবো!
তারপর সে নিমিষে নাই হয়ে যায়
দিন যায়
বছর যায়
নাইওরি আর আসে না…
আর আমার বুকের বারান্দায়
চিরদিনের জন্য লেগে থাকে নাইওরির গন্ধ, মৃত্যুর মতো…
পাখি-পল্লী
এবার সত্যি সত্যি বিদ্যুৎ চমকায়
খাঁচা থেকে পাখিগুলো বেরিয়ে আসে
বিদ্যুতের ছিদ্রে পাখিগুলো ঘুমিয়ে পড়ে আবার জেগে ওঠে।
ক্রমে পালক ঝরছে, পাতা ঝরছে, শিশির ঝরছে…
কতিপয় মানুষ পাখিদের শরীরে প্লাস্টিকের পালক লাগিয়ে দিয়ে যায়
পৃথিবীতে আবার ঝড় আসে
আর প্রতিটি ঝড়ের শেষে ভোর বেলা দেখি
ধর্ম বিদ্যালয়ের আলখাল্লা পরা সেই ছাত্রদের মতো
পাখিগুলো আমার উঠোনে দাঁড়িয়ে রয়েছে।
ভবানীপুরের কবিতা
রক্তের ভেতর একটা নদী থেকে আরও একটা নদী
বিস্মৃতির ভবানীপুরে বৃষ্টি দিচ্ছে…
বৃষ্টি দিচ্ছে
বৃষ্টি দিচ্ছে
চোখ-ফাটা বৃষ্টির কান্না কোলে নিয়ে বসে আছি
আমার সিতানের বালিশের টুকরোগুলো এলোমেলো
ঘুম আসে…
ঘুম দাঁড়াতে পারে না কোথাও
ঘুম দৌড়াতে পারে না কোথাও
ঘুম বসতে পারে না কোথাও
ঘুম ঘুমুতে পারে না কোথাও
অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকে এলোমেলো আয়নার মুখ
মেহেকানন্দা কাব্য
১.
পুরনো বইয়ের পাতা উল্টে চোখে পড়লো
মমি হয়ে আছে কয়েকটা মাছি ও অচিন বৃক্ষের পাতা...
মমি হয়ে আছে পাতার স্পন্দন আর মাছির উড়াল
সাঁতার কাটি
নয়'শ বছরের পুরনো সমুদ্রে একা...
এ-কোন বিস্মৃতির জল কেবল ফেটে ফেটে যায়
এ-কোন কাহিনী গাঁথা- শবযাত্রী, সানাই আর ঘোড়ার ক্ষুরের শব্দ
স্বর্গের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে
চুম্বন শেষে কেন তারা ঠোঁটগুলো ছুঁড়ে দিলো নরকের দিকে!
দু'চোখ ঝাপসা হয়ে আসে
দু'চোখে জন্ম নেয় অজস্র রক্তের ডালপালা...
মেহেকানন্দা নদীতীরে অহ ঈশ্বর
কোনো এক কুয়াশাভোরে তুমি কি রক্তডুমুরের ডালগুলো কেটে দেবে!
২.
কে যেন রাস্তার পাশে মলিন চাঁদটাকে রেখে গেছে
চাঁদের গায়ে হোচট খেলাম
শুধু পা নয়, সমস্থ ‘আমি’ ভেঙ্গে গেলে চাঁদের শরীর থেকে চাঁদনী ও আগুন বের হয়...
জন্ম হয় দাউ দাউ চিতার...
মহাআনন্দে পুড়তে থাকি পৃথিবীর প্রথম মানুষ
ওহে শ্রীমতি. ঠাকুর মা আমার
আমিও চিতা জ্বালানোর কৌশল শিখে গেছি।
৩.
আয়না হতে পিছলে পড়েছে মুখগুলো
আজ তোমার মুখের গভীরে দেখি ভেঙ্গে-যাওয়া সেই আয়নার দাগ।
বিবর্ণ থৈ থৈ
বিধবার শাদা থানের মতো চারদিক...
হে দিন, হে রাত্রি, হে বসন্ত, হেমন্ত মৌসুম
হে প্রজাপতির ডানা, পাখির পালক, হে বৃন্দাবনের সিঁদুর
কোথাও কোনো রঙ নেই
আমাদের মেহদীবাগান কালো কুয়াশার নীচে ঢাকা পড়ে আছে।
শুনেছি পাথরে মেহেদীপাতা ঘষলে রঙের হলাহল বের হয়ে আসে
আমি আজ হৃৎপিণ্ডকে পাথর বানিয়ে নিয়েছি।
৪.
আজ এই শুক্লা দ্বাদশীর চাঁদ ফেটে গিয়ে
নীল-বর্ণ আলো ঝরছে
নরক প্রদেশে।
নরকের নয় দরজা খুলে বসে আছি আমি আর একটা অন্ধ হরিণী...
দু’চোখ ছিদ্র করে
গলিত চোখের রঙে চন্দ্রের পিঠে এঁকে দিয়েছি গাছের ছবি
এই গাছ স্বর্গের গাছ
এক একটা শিশু মৃত্যুর পর সেই গাছে একটা করে ফুল ফোটে
ওহ ইশ্বর
সময় হলে কি তুমি দেখে যাবে
সেই গাছে অনেক অনেক ফুল ফুটেছে
তুমি কি একবারও শুঁকে যাবে না হাস্নাহেনা অথবা মুনিরাহেনার গন্ধ!
৫.
চাঁদের শরীর থেকে বের হচ্ছে ধূয়া ও শিশির
দুই হাজার বছর আগেকার রাত ছাই হবে দুই হাজার পনেরো সালে
দু’চোখের অন্ধ ছায়া উড়ে যাচ্ছে অন্ধকারে
পাখিরা নৌকা চালায় বাতাসের নদে
নিঃশ্বাস ফেটে যাচ্ছে ধীরে গাছের, মানুষের
ফাটা-নিঃশ্বাসে তুমি কি একবারও আত্মহত্যা করতে আসবে না!
৬.
সময় পেরিয়ে যাচ্ছে ছিপছিপে এক মাতামুহুরী নদী
নদী পেরিয়ে যাচ্ছে সময়
হাতের নীলবর্ণ রেখায় এ-কার ছায়া দেখা যায়!
ছাদের উপর বৃষ্টির গুঞ্জণ থামছে না কিছুতেই
তানপুরার হৃৎপিণ্ডে আঙুল ফেটে গেলে বুজতে পারি না
এ-কান্না উচ্চাঙ্গসঙ্গীতে নাকি মাতামুহুরীর
ঘরের জানালা কিছুতেই বন্ধ হয় না
আমাদের জানালায় আটকে রয়েছে নদীর দরজা।
ময়ূরাক্ষী দাগ
কেন তুমি শঙ্খ কেটে শাখা বানিয়েছো
হাতের মুঠো তো খুলবো না
হাতের মধ্যে লুকিয়ে রেখেছি নদীনালা
মরে-যাওয়া ময়ূরাক্ষী দাগ
কেন শাখা নিয়ে এসেছো?
যদি পারো
চাকু দিয়ে হস্তরেখা কেটে যেও
বদলে যেও জন্মের দাগ।
মৃতের মাতৃমঙ্গল…
দু’চোখের পাথর ছিদ্র করে গড়িয়ে পড়ে জল
পৃথিবীর প্রাচীন কবরে
হায়! এ আনন্দধারায় আমিও জেনে যাই—বর্ষা এসেছে, তাজা জলে ডুব দেবে কঠিন কাছিম…
পাতিহাড়ে পড়ে বৃষ্টির ফুল, চকিত হরিণ ভয় নেই তোমার
আদি বর্ষার জল আর গহীন জঙ্গলে আমরা ছিলাম আদি ভাই বোন...
সর্বদা মানুষ থাকি না তাই
অধেক চাতক, চাতকিনী...
প্রতিঅঙ্গে বৃষ্টির গজল মাখি আমি আর মৃত ঠাকুরমা (সঙ্গে তাঁর ধর্মান্তরিত প্রেমিক)
হায় বর্ষা! জীবিত আর মৃতের
অনন্ত মাতৃমঙ্গল...
(প্রথম পর্ব)
ছোটবোন আত্মহত্যা
পাতার পরত বেয়ে বেয়ে ঝরে-পড়া ঝর্ণার আওয়াজ
হাড় হতে হাড়ে ভেতরে...
গাছের বুক হতে পাখিদের বুক বেয়ে ধাববান, বৃষ্টির বিলাপ।
বিক্ষুব্ধ
বাতাসের গান...
বাতাসের হাত-পা আঙুল আমাদের কাচের জানালায়
ডুবে ডুবে যায়
গ্রীষ্মের এই গহীন সন্ধ্যায়
অগ্নিকালো আকাশের নিচে দীর্ঘ দাঁড়াই
আমি আর আমার ছোটবোন আত্মহত্যা
এখন কি পরিষ্কার হলো তোমাদের আয়নার কুয়াশার আবরণ!
নির্বাচিত কবিতা
মুনীরা চৌধুরী
মুনীরা চৌধুরী
আহা মুনীরা চৌধুরী!
উত্তরমুছুনবেশ ভালো তো কবিতাগুলো!
উত্তরমুছুনঅসাধারণ কিছু কবিতা
উত্তরমুছুনগভীরতা
উত্তরমুছুনমাত্র
উত্তরমুছুনএত কম কেন? আরো পড়তে চাই। বেশ ভালো
উত্তরমুছুনভালো থাকুন আনন্দলোকে কবি মুনিরা চৌধুরী
উত্তরমুছুনদারুণ
উত্তরমুছুন