.header-button .inner > span { font-size: 18px !important; } .header-button .inner i.fa { font-size: 40px !important; } .comment-form-message { background-color: #f4f4f4 !important; font-size: 14px !important; }

বিশ্বদেব মুখোপাধ্যায়ের কবিতার আলোচনা

ঘূর্ণিঝড়ে উপকূলের বিপদ সংকেতের মেঘেরা এই খরার দেশে ঝড়বাদলের খবর নিয়ে এসেছে উঠোনে। তাই জৈষ্ঠ্যমাসের মধ্যভাগে দিনব্যাপী অবাক করা বৃষ্টি ও ব্যাঙের ডাক। আর এমন মধুর বাদলা দিনে খুলে বসেছি বিশ্বদেব মুখোপাধ্যায়ের কবিতাবই। ‘প্রিয় ২৫’ নামে দুফর্মার এই বইটি অনুপদার কাছ থেকে পেয়েছিলাম গত চৈত্রে। এখন এই জৈষ্ঠ্যের নাভির ভেতর এসে তা খোলা হলো। তবে বই হাতে নিয়ে প্রথমেই প্রচ্ছদে নয় বরং ব্যাক কাভারের লেখাতেই আটক হলো চোখ। সেখানে কবি বলছেন তার কবিতার যাপন ও যাত্রা—
কবি কবিতা লেখেন না; তাকে আবিষ্কার করেন। এডিসনের গ্রামোফোন আবিষ্কারের মত নয়, কলম্বাসের আমেরিকা আবিষ্কারের মত। আছে, তাকে খুঁজে পাওয়া।
কবিতার খোঁজে এরকম অনেক ঘুরেছি আমি। এখনো ঘুরছি। খুব বড় মহাদেশ... সে তো ভাগ্যের কথা। কিছু-কিছু ছোট্ট দ্বীপের দেখা পেয়েছি। আমার আবিষ্কার।

এই কথা কটা পড়ে আর ভেতরের কবিতা পড়া শেষ করে আপনা আপনি উচ্চারিত হলো একটি শব্দ— আহা! সত্যিই অনেকদিন পর— বেশ আশ মিটিয়ে কিছু মন ভরে যাওয়ার মতো কবিতা পড়লাম। 

প্রথম কবিতাটি পড়েই যেন বুকের ভেতরে সত্যিকারের ঢোল বাজতে লাগলো। আহা ঢোলের সাথে পুরো গ্রাম, গ্রামের বহমান প্রকৃতির নিবিড় যাত্রার অপূর্ব বর্ণনায় যেনো আমি একের পর এক সিনেমার দৃশ্যস্রোত আঁকছি মনের ভেতর আর ব্যাকগ্রাউন্ডে মিউজিক বাজছে বাভোম্...বাভোম্... 

বিনোদ নট্টের ঢোল

আর কোন শব্দ নেই 
ঢোল বাজে বাভোম্...বাভোম্...

দুপুরে গভীর হয়ে মেঘ জমে। চরাচরে 
স্তব্ধ বাতাস। কবেকার 
পুরোনো হুঁকোর গন্ধ। পাতার ঝুপড়ি-ঘরে নষ্ট গাবের 
ভিজে ভিজে আঁষ-গন্ধে ঠায় জেগে বিনোদ নট্টের বাঘ-চোখ 
মাখায় টলছে গ্রাম... আন্ধার 
দুলে উঠছে গাছপালা,
পেহ্লাদ বাগ্দীর জুম-কালো পাথল-শরীল আবছায়া মাঠের কিনারে দূর ঘুম ঘুম জনপদে
বাঁশের ঝুড়ির গন্ধ, পুকুরের আবিল পানার 
মজে ওঠা ভাপ-গন্ধে পৃথিবীর নামহীন পাড়ায় পাড়ায় বহুকাল 
শব্দ নেই...
আর কোন শব্দ নেই, শুধু এক ঢোল বাজে বাভোম্... বাভোম্... 
অদ্ভুত ঢোল বাজে... দুর্বোধ্য ঢোল বেজে যায়....

আহা আর কিই বা বলতে পারি আমি, এখন কেবলই মনে হচ্ছে জনে জনের কানের পাশে গিয়ে আলতো পড়ে শোনাই, আর পড়া শেষে বলি— শোনো কবিতা এমন হয়। 

আর কবিতা কিংবা বৃহৎ অর্থে শিল্পের যাপনে বর্তমানের এই খেয়োখেয়ি, লুটোপুটির জগতের বাইরে বিশ্বদেব বাবু একেবারে আলাদা, ঠিক এক বুড়ো বট গাছের মতো শান্ত, স্থীর, নীরবে দাঁড়িয়ে সবকিছু দেখে মৃদু হাসছেন। আর অবতারের মতো তাঁর কাব্যের ওপর এমন সূক্ষ্ম বিচার, প্রকৃতি যাপন ও অনুভূতির অক্সিজেনের মেলবন্ধন কবিতাকে এক চমৎকার তৃপ্তির দিকে নিয়ে যায়। জল তেষ্টায় বুক ফাটা পথিক যেন বেঁচে ওঠে বিরাট আনন্দ নিয়ে। আহা তাই তো তাঁর কবিতার শরীরে এমন মধুর চলন ও সুর, এভাবে স্তব্ধ করে আমাকে!

তারপর কানে বাজে ঝুমঝুমি। ঝুমঝুমিওয়ালীর ডাকে নেশা ধরে গেলে অবোধ ন্যাঙটো শিশুর মতো ওর পেছন পেছন দৌড়াতে থাকি, মনে এক অমোঘ আশা নিয়ে, ‘ও ঝুমঝুমি, জীবনে একবার হলেও তোমাকে বাজাবোই।’

হঠাৎ ঘুমের মধ্যে

হঠাৎ ঘুমের মধ্যে বাজিকর রমণীর মতো 
কে যেন ভীষণ স্বরে ডেকে ওঠে,—‘এ খোকার মা 
ঝুমঝুমি লিবি?’

‘আকাশে ঘুটঘুটে মেঘ 
ভুতুড়ে অন্ধকারে গাছপালা ঝোপঝাড় আমাদের পাড়া 
গভীর ঘুমিয়ে আছে। গেরুয়া ডাঙায় কবেকার 
পড়ো ঘর।
মাতালশালের পাশে মেটে হাঁড়ি
চোলাই মদের গন্ধ আর 
বেদেনীর আদিম শরীরী গন্ধে ঘুমের ভেতরে 
ঝুমঝুম... কুমঝুম... ঝুমঝুমি বাজিয়ে কেউ 
দুপুর বিদীর্ণ ক’রে ডেকে ওঠে,—‘এ খোকার মা 
ঝুমঝুমি লিবি?’

উঁকি মেরে আরও দেখি ঘরের ইতিহাস কিংবা পরম্পরা বলে যে শব্দটা আমরা জানি সেও কিভাবে কবিকে ডাকনাম ধরে হাসিখুশি ভাবে ডাকে, আর সে ডাকে যেন একেবারে খোকা হয়ে যান কবি। যে খোকা সাড়া দেয় এভাবে, ‘হ্যাঁ। আমি রইলাম, তোমাদের আর চিন্তা নেই।’

পারিবারিক

আমাদের দরদালানের মেঝেয় 
লোহার একটা পেরেক পোঁতা হয়েছিল কোনো এক সময়। 
তার আগে, ছেলেবেলা থেকেই দেখে এসেছি, 
বিছানায় শায়িত আমার দীর্ঘদেহী ঠাকুর্দা আর তাঁর পাশে 
কাঠের একটা হাতবাক্স।

পেরেকের ব্যাপারটা যখন সবাই এক রকম ভুলেই গেছে 
একদিন একটু একটু ক’রে খুলে গেল 
সেই হাতবাক্সের ডালা। 
ভেতরে এটা ওটা, 
ঝাপসা গোল পেতলের চশমা, মশলার কৌটো, খেরোখাতা, চিঠির বাণ্ডিল, 
এছাড়াও 
দেখা গেল 
রয়েছে একটা ফাউন্টেন পেন।

ছোটকা পান খেতেন। তাঁর ভাগে মশলার ডিবে। 
পেতলের চশমা চোখে খেরোপাতা খুলে বসলেন জ্যাঠামশাই। 
বাকি রইল চিঠি আর কলম। 
কুলুঙ্গিতে একটা গোপন কোটর ছিল, ঠাকুমা জানতেন। 
চিঠির বাণ্ডিলটা সেখানে রেখে 
কলমটা তিনিই তুলে দিলেন বাবার হাতে।

বৈষয়িক বিলিবন্দোবস্ত চুকল। 
দেখতে দেখতে 
সুখদুঃখে কাটল আরো পনেরটা বছর। 
তারপর আবার একদিন ধীরে ধীরে খুলে গেল আরেকটা কাঠের বাক্স
আর তার মধ্যে থেকে বেরিয়ে এল 
এক পাটি বাঁধানো দাঁত, কিছু খুচরো পয়সা, ঝিনুকের বোতাম কয়েকটা 
আর সবুজ রঙের একটা ফাউন্টেন পেন।

রহস্য থাক্। আসলে
এই আমাদের জাতব্যবসা—
লেখা। 
আমার বাপ-ঠাকুর্দা-দু’জনেই ছিলেন লেখক। 
তেমন ফলাও ক’রে কিছু ক’রে অবশ্য উঠতে পারেননি, 
তবু
বাক্স থেকে শেষ পর্যন্ত আমাকেও 
এই কলমটাই তুলে নিতে হল।

এই সেই কলম। আর পাশে 
হাতবাক্স। 
কলম লিখছে। বাক্স অপেক্ষা করছে 
কবিতার শেষে 
কখন একটু একটু ক’রে খুলে যাবে
তার ছোট্ট কাঠের ঢাকনা।

যাক পরিবারটি চেনা গেল, পরম্পরা আর কিছুটা ইতিহাসও জানা গেল; তবে এবার সত্যিই এমন কবিতায় মজে যদি কারো ইচ্ছে করে একখানা চিঠি লেখার, তবে তো ঠিকানাটা জানা জরুরী। তাই কবি ঠিকানাটিও দিয়ে দিলেন বেশ ফুর্তিতে—

ঠিকানা

পিছনে তালের কুঞ্জ। নীচে বাড়িটির খড়ো চালে 
সম্বৎসর জ’মে থাকে মেঘ। পাশাপাশি 
শুয়েছে নধর দুটি চালকুমড়ো।

ওই দেখেই 
মজলেন।

পূবে দাওয়া। দাওয়ার ওপরে 
কাঞ্চননগরের বঁটি, পিঁড়ি পাতা... 
বেলা যায়। দূরে 
ব্যাঙের ছাতাটি ঘিরে অন্তহীন দুপুর নেমেছে।

সুখে আছেন। বিউলির ডাল সহযোগে 
প্রত্যহ আহার, নিদ্রা,
নাম—

বিশ্ব 
ব্রহ্মাণ্ড ডাকঘর 
জেলা বীরভূম

এবার যত ইচ্ছে চিঠি লিখে ভরিয়ে দেওয়া যাবে ডাকবাক্স। আর ডাকবাক্সের ভরা পেটও তখন আমার মতো এমন মন ভরে খেয়ে অবশেষে একটি লম্বা ঢেকুর উঠিয়ে দিতে যাবে দুপুরের ভাতঘুম।
তবুও এই ভাতঘুম কিংবা আদুরে নিদ্রায় যাবার আগে হয়তো ডাকবাক্সটিরো পড়তে ইচ্ছে হতে পারে একটি প্রশ্নকে। যদিও ইদানীং প্রশ্ন নাম শুনলেই কেমন যেন মনে হয় পরীক্ষার খাতায় বসতে হচ্ছে— হা হা!
তারপর কেউ পরিপাটি উত্তর লিখতে গিয়ে— বেঞ্চে বসে কাত হয়ে হেলেই অন্তত একবারও যদি চলে যায় কল্পনিদ্রায়, হয়তোবা তখন দেখা যাবে তার স্বপ্ননদীতে চলে এসেছে এমন এক প্রশ্নের ডিঙি আর গণিতের সমীকরণ ... 

প্রশ্ন

ও নদী, ও নদী। উপুড় শবদেহটি কার?
যাচ্ছে ভেসে স্রোতউদাসীন পার থেকে ওপার... 
মুখ দেখি না। গোত্রবিহীন শবদেহটি কার?

দেখছে কিছু? ঘোর ঘোলা জল। মুখটি নিচু আর 
চিৎসাঁতারে অনভ্যস্ত শবদেহটি কার?

মগ্ন রাখে অংশত বুক, ভগ্ন দেহভার 
বইছে নদী। কিন্তু কাকে? শেষ অবধি তার
প্রশ্ন থাকেই—শবদেহটি। শবদেহটি কার?

এবার প্রশ্ন পড়া ও ঘুম শেষে বাভোম্... বাভোম্... শব্দে জেগে উঠলে আমাদের পাড়ার সেলিম কাকার চায়ের দোকানে তোমাকে নিমন্ত্রণ, চা-সিগারেট খেতে খেতে জানিও তোমার উত্তর— আসলে শবদেহটি কার?

বিশ্বদেব মুখোপাধ্যায়ের কবিতা
বাভোম্... বাভোম্... শব্দে মনে এলো শবদেহটি কার
হিম ঋতব্রত 

মন্তব্য

নাম

অনুবাদ,32,আত্মজীবনী,26,আর্ট-গ্যালারী,1,আলোকচিত্র,1,ই-বুক,7,উৎপলকুমার বসু,23,কবিতা,319,কবিতায় কুড়িগ্রাম,7,কর্মকাণ্ড,15,কার্ল মার্ক্স,1,গল্প,56,ছড়া,1,ছোটগল্প,12,জার্নাল,4,জীবনী,6,দশকথা,24,পাণ্ডুলিপি,10,পুনঃপ্রকাশ,15,পোয়েটিক ফিকশন,1,প্রতিবাদ,1,প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা,4,প্রবন্ধ,152,প্রিন্ট সংখ্যা,4,বর্ষা সংখ্যা,1,বসন্ত,15,বিক্রয়বিভাগ,21,বিবিধ,2,বিবৃতি,1,বিশেষ,23,বুলেটিন,4,বৈশাখ,1,ভাষা-সিরিজ,5,ভিডিও,1,মাসুমুল আলম,35,মুক্তগদ্য,37,মে দিবস,1,যুগপূর্তি,6,রিভিউ,5,লকডাউন,2,শাহেদ শাফায়েত,25,শিশুতোষ,1,সন্দীপ দত্ত,8,সম্পাদকীয়,16,সাক্ষাৎকার,21,সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ,18,সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ,55,সৈয়দ সাখাওয়াৎ,33,স্মৃতিকথা,14,হেমন্ত,1,
ltr
item
বিন্দু | লিটল ম্যাগাজিন: বিশ্বদেব মুখোপাধ্যায়ের কবিতার আলোচনা
বিশ্বদেব মুখোপাধ্যায়ের কবিতার আলোচনা
বিশ্বদেব মুখোপাধ্যায়ের কবিতা ও তার আলোচনা
https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEiUYkm0TPPjL9Zgmyzk0la7c5VaMWu7_GIQobGsl7msepMyQOgBqH5Vf21HOUBTcW1UwhL4kCAbhZ20AoYnU1FKwukbVu0I5goG99yJ-Of0aCUfSkFTzOrTWpOtZJx1IpBgLSnsgrMc9BkLV8t1fuCCifkoitCU1fNVtjm95HyE1TREaPJdtmxAqwbLSkI/s16000/Bishwadeb-Mukhopadhay-bindumag.png
https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEiUYkm0TPPjL9Zgmyzk0la7c5VaMWu7_GIQobGsl7msepMyQOgBqH5Vf21HOUBTcW1UwhL4kCAbhZ20AoYnU1FKwukbVu0I5goG99yJ-Of0aCUfSkFTzOrTWpOtZJx1IpBgLSnsgrMc9BkLV8t1fuCCifkoitCU1fNVtjm95HyE1TREaPJdtmxAqwbLSkI/s72-c/Bishwadeb-Mukhopadhay-bindumag.png
বিন্দু | লিটল ম্যাগাজিন
https://www.bindumag.com/2024/06/article-about-bishwadeb-mukhopadhay.html
https://www.bindumag.com/
https://www.bindumag.com/
https://www.bindumag.com/2024/06/article-about-bishwadeb-mukhopadhay.html
true
121332834233322352
UTF-8
Loaded All Posts Not found any posts আরো Readmore উত্তর Cancel reply মুছুন By নী PAGES POSTS আরো এই লেখাগুলিও পড়ুন... বিষয় ARCHIVE SEARCH সব লেখা কোন রচনায় খুঁজে পাওয়া গেল না নীড় Sunday Monday Tuesday Wednesday Thursday Friday Saturday Sun Mon Tue Wed Thu Fri Sat January February March April May June July August September October November December Jan Feb Mar Apr May Jun Jul Aug Sep Oct Nov Dec just now 1 minute ago $$1$$ minutes ago 1 hour ago $$1$$ hours ago Yesterday $$1$$ days ago $$1$$ weeks ago more than 5 weeks ago Followers Follow THIS PREMIUM CONTENT IS LOCKED STEP 1: Share to a social network STEP 2: Click the link on your social network Copy All Code Select All Code All codes were copied to your clipboard Can not copy the codes / texts, please press [CTRL]+[C] (or CMD+C with Mac) to copy