ঘূর্ণিঝড়ে উপকূলের বিপদ সংকেতের মেঘেরা এই খরার দেশে ঝড়বাদলের খবর নিয়ে এসেছে উঠোনে। তাই জৈষ্ঠ্যমাসের মধ্যভাগে দিনব্যাপী অবাক করা বৃষ্টি ও ব্যাঙের ডাক। আর এমন মধুর বাদলা দিনে খুলে বসেছি বিশ্বদেব মুখোপাধ্যায়ের কবিতাবই। ‘প্রিয় ২৫’ নামে দুফর্মার এই বইটি অনুপদার কাছ থেকে পেয়েছিলাম গত চৈত্রে। এখন এই জৈষ্ঠ্যের নাভির ভেতর এসে তা খোলা হলো। তবে বই হাতে নিয়ে প্রথমেই প্রচ্ছদে নয় বরং ব্যাক কাভারের লেখাতেই আটক হলো চোখ। সেখানে কবি বলছেন তার কবিতার যাপন ও যাত্রা—
কবি কবিতা লেখেন না; তাকে আবিষ্কার করেন। এডিসনের গ্রামোফোন আবিষ্কারের মত নয়, কলম্বাসের আমেরিকা আবিষ্কারের মত। আছে, তাকে খুঁজে পাওয়া।কবিতার খোঁজে এরকম অনেক ঘুরেছি আমি। এখনো ঘুরছি। খুব বড় মহাদেশ... সে তো ভাগ্যের কথা। কিছু-কিছু ছোট্ট দ্বীপের দেখা পেয়েছি। আমার আবিষ্কার।
এই কথা কটা পড়ে আর ভেতরের কবিতা পড়া শেষ করে আপনা আপনি উচ্চারিত হলো একটি শব্দ— আহা! সত্যিই অনেকদিন পর— বেশ আশ মিটিয়ে কিছু মন ভরে যাওয়ার মতো কবিতা পড়লাম।
প্রথম কবিতাটি পড়েই যেন বুকের ভেতরে সত্যিকারের ঢোল বাজতে লাগলো। আহা ঢোলের সাথে পুরো গ্রাম, গ্রামের বহমান প্রকৃতির নিবিড় যাত্রার অপূর্ব বর্ণনায় যেনো আমি একের পর এক সিনেমার দৃশ্যস্রোত আঁকছি মনের ভেতর আর ব্যাকগ্রাউন্ডে মিউজিক বাজছে বাভোম্...বাভোম্...
বিনোদ নট্টের ঢোলআর কোন শব্দ নেইঢোল বাজে বাভোম্...বাভোম্...দুপুরে গভীর হয়ে মেঘ জমে। চরাচরেস্তব্ধ বাতাস। কবেকারপুরোনো হুঁকোর গন্ধ। পাতার ঝুপড়ি-ঘরে নষ্ট গাবেরভিজে ভিজে আঁষ-গন্ধে ঠায় জেগে বিনোদ নট্টের বাঘ-চোখমাখায় টলছে গ্রাম... আন্ধারদুলে উঠছে গাছপালা,পেহ্লাদ বাগ্দীর জুম-কালো পাথল-শরীল আবছায়া মাঠের কিনারে দূর ঘুম ঘুম জনপদেবাঁশের ঝুড়ির গন্ধ, পুকুরের আবিল পানারমজে ওঠা ভাপ-গন্ধে পৃথিবীর নামহীন পাড়ায় পাড়ায় বহুকালশব্দ নেই...আর কোন শব্দ নেই, শুধু এক ঢোল বাজে বাভোম্... বাভোম্...অদ্ভুত ঢোল বাজে... দুর্বোধ্য ঢোল বেজে যায়....
আহা আর কিই বা বলতে পারি আমি, এখন কেবলই মনে হচ্ছে জনে জনের কানের পাশে গিয়ে আলতো পড়ে শোনাই, আর পড়া শেষে বলি— শোনো কবিতা এমন হয়।
আর কবিতা কিংবা বৃহৎ অর্থে শিল্পের যাপনে বর্তমানের এই খেয়োখেয়ি, লুটোপুটির জগতের বাইরে বিশ্বদেব বাবু একেবারে আলাদা, ঠিক এক বুড়ো বট গাছের মতো শান্ত, স্থীর, নীরবে দাঁড়িয়ে সবকিছু দেখে মৃদু হাসছেন। আর অবতারের মতো তাঁর কাব্যের ওপর এমন সূক্ষ্ম বিচার, প্রকৃতি যাপন ও অনুভূতির অক্সিজেনের মেলবন্ধন কবিতাকে এক চমৎকার তৃপ্তির দিকে নিয়ে যায়। জল তেষ্টায় বুক ফাটা পথিক যেন বেঁচে ওঠে বিরাট আনন্দ নিয়ে। আহা তাই তো তাঁর কবিতার শরীরে এমন মধুর চলন ও সুর, এভাবে স্তব্ধ করে আমাকে!
তারপর কানে বাজে ঝুমঝুমি। ঝুমঝুমিওয়ালীর ডাকে নেশা ধরে গেলে অবোধ ন্যাঙটো শিশুর মতো ওর পেছন পেছন দৌড়াতে থাকি, মনে এক অমোঘ আশা নিয়ে, ‘ও ঝুমঝুমি, জীবনে একবার হলেও তোমাকে বাজাবোই।’
হঠাৎ ঘুমের মধ্যেহঠাৎ ঘুমের মধ্যে বাজিকর রমণীর মতোকে যেন ভীষণ স্বরে ডেকে ওঠে,—‘এ খোকার মাঝুমঝুমি লিবি?’‘আকাশে ঘুটঘুটে মেঘভুতুড়ে অন্ধকারে গাছপালা ঝোপঝাড় আমাদের পাড়াগভীর ঘুমিয়ে আছে। গেরুয়া ডাঙায় কবেকারপড়ো ঘর।মাতালশালের পাশে মেটে হাঁড়িচোলাই মদের গন্ধ আরবেদেনীর আদিম শরীরী গন্ধে ঘুমের ভেতরেঝুমঝুম... কুমঝুম... ঝুমঝুমি বাজিয়ে কেউদুপুর বিদীর্ণ ক’রে ডেকে ওঠে,—‘এ খোকার মাঝুমঝুমি লিবি?’
উঁকি মেরে আরও দেখি ঘরের ইতিহাস কিংবা পরম্পরা বলে যে শব্দটা আমরা জানি সেও কিভাবে কবিকে ডাকনাম ধরে হাসিখুশি ভাবে ডাকে, আর সে ডাকে যেন একেবারে খোকা হয়ে যান কবি। যে খোকা সাড়া দেয় এভাবে, ‘হ্যাঁ। আমি রইলাম, তোমাদের আর চিন্তা নেই।’
পারিবারিকআমাদের দরদালানের মেঝেয়লোহার একটা পেরেক পোঁতা হয়েছিল কোনো এক সময়।তার আগে, ছেলেবেলা থেকেই দেখে এসেছি,বিছানায় শায়িত আমার দীর্ঘদেহী ঠাকুর্দা আর তাঁর পাশেকাঠের একটা হাতবাক্স।পেরেকের ব্যাপারটা যখন সবাই এক রকম ভুলেই গেছেএকদিন একটু একটু ক’রে খুলে গেলসেই হাতবাক্সের ডালা।ভেতরে এটা ওটা,ঝাপসা গোল পেতলের চশমা, মশলার কৌটো, খেরোখাতা, চিঠির বাণ্ডিল,এছাড়াওদেখা গেলরয়েছে একটা ফাউন্টেন পেন।ছোটকা পান খেতেন। তাঁর ভাগে মশলার ডিবে।পেতলের চশমা চোখে খেরোপাতা খুলে বসলেন জ্যাঠামশাই।বাকি রইল চিঠি আর কলম।কুলুঙ্গিতে একটা গোপন কোটর ছিল, ঠাকুমা জানতেন।চিঠির বাণ্ডিলটা সেখানে রেখেকলমটা তিনিই তুলে দিলেন বাবার হাতে।বৈষয়িক বিলিবন্দোবস্ত চুকল।দেখতে দেখতেসুখদুঃখে কাটল আরো পনেরটা বছর।তারপর আবার একদিন ধীরে ধীরে খুলে গেল আরেকটা কাঠের বাক্সআর তার মধ্যে থেকে বেরিয়ে এলএক পাটি বাঁধানো দাঁত, কিছু খুচরো পয়সা, ঝিনুকের বোতাম কয়েকটাআর সবুজ রঙের একটা ফাউন্টেন পেন।রহস্য থাক্। আসলেএই আমাদের জাতব্যবসা—লেখা।আমার বাপ-ঠাকুর্দা-দু’জনেই ছিলেন লেখক।তেমন ফলাও ক’রে কিছু ক’রে অবশ্য উঠতে পারেননি,তবুবাক্স থেকে শেষ পর্যন্ত আমাকেওএই কলমটাই তুলে নিতে হল।এই সেই কলম। আর পাশেহাতবাক্স।কলম লিখছে। বাক্স অপেক্ষা করছেকবিতার শেষেকখন একটু একটু ক’রে খুলে যাবেতার ছোট্ট কাঠের ঢাকনা।
যাক পরিবারটি চেনা গেল, পরম্পরা আর কিছুটা ইতিহাসও জানা গেল; তবে এবার সত্যিই এমন কবিতায় মজে যদি কারো ইচ্ছে করে একখানা চিঠি লেখার, তবে তো ঠিকানাটা জানা জরুরী। তাই কবি ঠিকানাটিও দিয়ে দিলেন বেশ ফুর্তিতে—
ঠিকানাপিছনে তালের কুঞ্জ। নীচে বাড়িটির খড়ো চালেসম্বৎসর জ’মে থাকে মেঘ। পাশাপাশিশুয়েছে নধর দুটি চালকুমড়ো।ওই দেখেইমজলেন।পূবে দাওয়া। দাওয়ার ওপরেকাঞ্চননগরের বঁটি, পিঁড়ি পাতা...বেলা যায়। দূরেব্যাঙের ছাতাটি ঘিরে অন্তহীন দুপুর নেমেছে।সুখে আছেন। বিউলির ডাল সহযোগেপ্রত্যহ আহার, নিদ্রা,নাম—বিশ্বব্রহ্মাণ্ড ডাকঘরজেলা বীরভূম
এবার যত ইচ্ছে চিঠি লিখে ভরিয়ে দেওয়া যাবে ডাকবাক্স। আর ডাকবাক্সের ভরা পেটও তখন আমার মতো এমন মন ভরে খেয়ে অবশেষে একটি লম্বা ঢেকুর উঠিয়ে দিতে যাবে দুপুরের ভাতঘুম।
তবুও এই ভাতঘুম কিংবা আদুরে নিদ্রায় যাবার আগে হয়তো ডাকবাক্সটিরো পড়তে ইচ্ছে হতে পারে একটি প্রশ্নকে। যদিও ইদানীং প্রশ্ন নাম শুনলেই কেমন যেন মনে হয় পরীক্ষার খাতায় বসতে হচ্ছে— হা হা!
তারপর কেউ পরিপাটি উত্তর লিখতে গিয়ে— বেঞ্চে বসে কাত হয়ে হেলেই অন্তত একবারও যদি চলে যায় কল্পনিদ্রায়, হয়তোবা তখন দেখা যাবে তার স্বপ্ননদীতে চলে এসেছে এমন এক প্রশ্নের ডিঙি আর গণিতের সমীকরণ ...
প্রশ্নও নদী, ও নদী। উপুড় শবদেহটি কার?যাচ্ছে ভেসে স্রোতউদাসীন পার থেকে ওপার...মুখ দেখি না। গোত্রবিহীন শবদেহটি কার?দেখছে কিছু? ঘোর ঘোলা জল। মুখটি নিচু আরচিৎসাঁতারে অনভ্যস্ত শবদেহটি কার?মগ্ন রাখে অংশত বুক, ভগ্ন দেহভারবইছে নদী। কিন্তু কাকে? শেষ অবধি তারপ্রশ্ন থাকেই—শবদেহটি। শবদেহটি কার?
এবার প্রশ্ন পড়া ও ঘুম শেষে বাভোম্... বাভোম্... শব্দে জেগে উঠলে আমাদের পাড়ার সেলিম কাকার চায়ের দোকানে তোমাকে নিমন্ত্রণ, চা-সিগারেট খেতে খেতে জানিও তোমার উত্তর— আসলে শবদেহটি কার?
বিশ্বদেব মুখোপাধ্যায়ের কবিতা
বাভোম্... বাভোম্... শব্দে মনে এলো শবদেহটি কার
হিম ঋতব্রত
বাভোম্... বাভোম্... শব্দে মনে এলো শবদেহটি কার
হিম ঋতব্রত
মন্তব্য