সিলেট যাবার জন্য মোটামুটি ২৫-৩০ জনের একটা দল তৈরি হয়ে গেল। আমিও আছি। সেকালে আন্তঃনগর এক্সপ্রেস তখনও চালু হয়নি। সিদ্ধান্ত হলো, আমাদের বন্ধুদের কয়েকজন ডিপো থেকে একটা বগি দখল করে ট্রেনের সাথে আসবে। আমরা অপেক্ষা করলাম বটতলার স্টেশনে। রাতের ট্রেন স্টেশনে আসার সাথে সাথে আমরা দল বেঁধে হৈ হৈ করতে করতে উঠে পড়লাম ট্রেনটিতে। মেইল ট্রেন ধীরগতিতে নানা স্টেশনে থেমে থেমে এগিয়ে চলেছে। আমরা ঘুমে ঢলে পড়ি এর-ওর গায়ে। ট্রেনের বগিতে আমরা ছাড়াও বেশ ক’জন বয়স্ক ভদ্রলোকের ছিলেন। আমাদের পরিচয় জেনে আমাদের নানা বিষয়ে জানতে আগ্রহ প্রকাশ করেন তাঁরা। আমরাও নীতিনৈতিকতা বিষয়ে নানারকম বক্তব্য রাখলাম। কিন্তু যখন টিটি এসে টিকেট চাইল, আমাদের কাঁচুমাচু অবস্থা হলো। আমি তো জানতামই না যে আমরা বিনাটিকিটের যাত্রী! আমি ভেবেছিলাম নেতৃত্বে যারা আছে, তাদের কেউ এ কর্তব্য পালন করেছে। আশেপাশের লোকজন তখন আমাদের দিকে শ্যেনদৃষ্টিতে তাকাচ্ছেন। আমি এবং অনেকেই মাথা নিচু করে বাকি পথটিকে পার করলাম। সিলেট মেডিকেল কলেজে, এমনকি সিলেটের, এটা আমার প্রথম পদার্পন। মেডিকেল কলেজের সুপরিসর ক্যাম্পাস দেখে মুগ্ধ হয়ে দেখছি। আমাদের সহপাঠী বন্ধুদের মধ্যে রাজিব, সোলায়মান, নাসিমসহ অনেকেই আমাদের অভ্যর্থনা জানালো। সে যুগে তো আর মোবাইল যোগাযোগ ছিল না, তাই আমাদের এই আগমন সংবাদ সম্ভবত ল্যান্ড ফোনে কোন একটা যোগাযোগ করে জানানো হয়েছিল। হতে পারে রাজিবের সাথে ধীমানের কোন উপায়ে যোগাযোগ হয়েছিল। আমাদের একজনের টিমকে কোথায় কিভাবে থাকতে দেবে সে একটা কঠিন ব্যাপার। আমার আশ্রয় হয়েছিল ছাত্র ইউনিয়ন কর্মী বাপ্পীর রুমে। যাই হোক, পরীক্ষা পেছাতে এসে দেখা গেল, এখানে অধিকাংশ ছাত্রই পরীক্ষা দেওয়ার পক্ষে। আমাদের বন্ধুরা এটাকে তাদের আত্মসম্মানে আঘাত বলে মনে করলো এবং জোর তদবির চালালো। আমরাও নানাজনের সাথে আলাপ করে বুঝাতে চেষ্টা করলাম। অনেক বেশি ছাত্রের বিরোধিতার কারণে এক পর্যায়ে সিদ্ধান্ত হলো নির্বাচনের। সম্পূর্ণ গণতান্ত্রিক উপায়ে ভোট ব্যবস্থা করা হলো। ভোট গণনা করে দেখা গেল দুপক্ষই সমান সমান। তখন কে যেন আবিষ্কার করলো একটা মেয়ে সহপাঠী অসুস্থ এবং সে হোস্টেলে আছে। আমাদের বন্ধুরা দৌড়ে গিয়ে তাকে নিয়ে এলো লেকচার হলে, যেখানে ভোটাভুটন চলছে। কিন্তু বিপক্ষের বন্ধুরা দাবী করলো, ভোটগ্রহণ শেষ হবার পরে আর ভোট দেওয়া চলবে না। তর্ক উত্তপ্ত হলে ভোটে জেতার জন্য আমাদের পক্ষে সিলেটের ২/১জন বন্ধু পটকা ফুটিয়ে বিপক্ষ ভোটারদের বিচলিত করে তুলেছিল। অবশ্য সেই একটি মাত্র ভোটে আমাদের বিজয় নিশ্চিত করে সবাই শেষ পর্যন্ত পরীক্ষা পেছাতে সম্মত হলো। এদিকে সিলেট মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষের কাছে ফোন করে অভিযোগ করেন, “আপনার ছাত্ররা অমার মেডিকেলে এসে বোমাবাজি করছে”। শুনেছি এর জবাবে, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ ণারি ওনাকেই প্রশ্ন করেছিলেন, “আমার কলেজের ছাত্র ওখানে গিয়ে এ কাজ করে কীভাবে? আপনি কি করছেন?” যাই হোক পরীক্ষা পেছানোর নিশ্চয়তা নিয়ে ফিরে আসি চট্টগ্রাম। অবশ্য তার কিছুদিন পরেই আমার ছোট-বোন লীনা সিলেট মেডিকেল কলেজে ভর্তির সুযোগ পাওয়ায় পুরো পরিবার একসাথে সিলেট যাই। সেযাত্রা আমরা খোকা মামার বাসায় উঠি। উনি তখন আইসিআই-এর সিলেট জোনের প্রধান। এবার আমরা জাফলং ভ্রমণ করি। শাহজালাল ও শাহপরানের মাজার জিয়ারতও করা হয়। চট্টগ্রামে শত শত মাজারকে ছাদের নীচে দেখে অভ্যস্ত চোখে হঠাৎ এমন খেলা আকাশের নীচে পীর ফকিরের মাজার দেখে বিস্মিত হলাম। জালালী কবুতরের ঝাঁক বেঁধে উড়ে যাওয়া, ঝাঁক বেধে বসা - সবই এক অন্যরকম মায়াবী পরিবেশ বলে মনে হলো। দেখতে গিয়েছি সুরমা নদীর পড়ে দাঁড়িয়ে থাকা প্রাচীন ঘড়িটি। সবচেয়ে অবাক করেছিল সারা সিলেট শহর জুড়ে ছড়িয়ে থাকা প্রাচীন বৃটিশ গথিকের টিনশেড বাড়ির ডিজাইন। আর, মোড়ে মোড়ে লালসালুর ছায়ায় শুয়ে থাকা বিচিত্র সব নামের মাজার। সিলেট থেকে ফিরে এসে মনঃসংযোগ করি পড়ায়। প্রথম প্রফেশনাল পরীক্ষার প্রস্তুতি ছিল মারাত্মক। তবে, আমি তেমন রাত জাগতে পারতাম না। পাঠসঙ্গী ধীমানের সাথে একবার পড়ে আমি শুয়ে পড়তাম, আর সে রাত তিনটা চারটা পর্যন্ত জেগে সে পড়া মুখস্থ ঠোঁটস্থ করে তারপর ঘুমাতো। নাসিরাবাদ দুই নম্বর হোস্টেলে আমাদের রুমের সাথে একটি ছোট্ট রুম লাগানো ছিল। এতে থাকতো আমাদের পরের ব্যাচের বাহার। একটু আলাভোলা টাইপের ভারী চশমার ছেলেটি খুব ভাল নজরুলের গান গাইতো। বাহার চুপচাপ থাকলেও আমাদের পড়ালেখা সে অনতিদূর থেকে বেশ লক্ষ করতো, কিন্তু আমাদের সাথে তেমন কথাবার্তা বলতো না। একদিন কলেজে গিয়ে টের পাই আপাত নীরব বাহার ক্যাম্পাসে আমাদের লেখাপড়া বিষয়ে বেশ ভালই প্রচার করেছে। তাদের ভাষ্য অনুযায়ী বাহার খুবই বিস্মিত হয়ে বর্ণনা করেছে “ওরা গ্রে’স এনাটমি থেকে ইংরেজিতে একেকটা লাইন পড়ে আর তা বাংলা না করেই সরাসরি চাটগাঁইয়াতে ট্রান্সলেট করে ফেলে!” কেউ কেউ ইংরেজি বাক্য বলে তার চাটগাঁইয়া ভাষান্তরও জানতে চাইল।
এদিকে ফাঁকে ফাঁকে সাহিত্যের পাঠও চলমান। সম্ভবত এই সময়টায় আমি শরৎচন্দ্রের প্রতি আকৃষ্ট হই। রবীন্দ্রনাথ তো আছেই। সুকান্তের কবিতাও আমার এই সময়কালেই পড়া হয়। এর পর একদিন আবিষ্কার করি একটি বই, যার নাম “রাজা যায় রাজা আসে”, কবি আবুল হাসানের লেখা। এই বইটি আমার জীবনে দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব বিস্তার করেছিল। এই একই সময়ে আমি অনেক বেশি থ্রিলারের দিকে ঝুঁকেছিলাম। জুলভার্নের গল্পগুলো বিশেষ করে আশি দিনে বিশ্বভ্রমণ এবং রহস্যময় দ্বীপ আমাকে দারুণ নাড়িয়ে দিয়েছিল। ফাঁকে ফাঁকে দস্যু বনহুর, কুয়াশা, মাসুদ রানাও বাদ যায়নি। তবে সবচেয়ে যে বিষয়টা হোস্টেল জীবনের কারণে আমার ভেতরে ঢুকে গেল তা হচ্ছে তাস খেলা। আমি ব্রিজ এবং টোয়েন্টি নাইন খেলাত বেশ মনোযোগী হয়ে উঠলাম। মাঝে মাঝে পড়ালেখা শেষ করে গভীর রাত পর্যন্ত এই খেলাত মগ্ন থেকেছি। হাতে তাস সাজিয়ে বসার ভঙ্গির জন্য বন্ধুরা এই খেলাকে বলতো মোনাজাত করা।
২৭-২-২০২৪, সকাল ৯:৪২ চট্টগ্রাম
কোরাকাগজের খেরেখাতা
জিললুর রহমান
জিললুর রহমান
মন্তব্য