সন্দীপের সঙ্গে আমার প্রথম প্রত্যক্ষ পরিচয়ের আগে তার কথা দু-চার জনের মুখে শুনেছিলাম। কিন্ত প্রত্যক্ষ পরিচয় ঘটেছে তার কিছু পরে। যতদূর মনে পড়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ক্লাসঘরে একটা অনুষ্ঠান হয়েছিল লিটল ম্যাগাজিনকে কেন্দ্র করে। মূলত সেই আলোচনাচক্র ছিল সন্দীপের লিটল ম্যাগাজিন সংগ্রহ নিয়ে ৮০-র দশকের গোড়ায়। সেই সভায় সন্দীপের কথাবার্তা শুনে আমার একটা প্রচ্ছন্ন গর্ববোধ ধূলিসাৎ হয়ে গেল। কেননা ১৯৮২ সালে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের ছাত্রছাত্রীদের লিটল ম্যাগাজিন নিয়ে একদিনের এক বড়ো প্রদর্শনী হয়েছিল। তার আগে এইরকম লিটল ম্যাগাজিন কেন্দ্রিক কোনও বড়ো রকমের চর্চা আমাদের অনেকেরই চোখে পড়েনি। নিদর্শক হিসাবে মনে হয়েছিল আমিই প্রথম লিটল ম্যাগাজিন নিয়ে কাজ করলাম। কিন্তু সেই ধারণা যে মিথ্যা ছিল সেটা। জানতে পেরেছিলাম কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আলোচনাচক্রে গিয়ে। কেননা সেখানে সন্দীপ দত্তকে দেখলাম, পরিচয় হল তার সঙ্গে, আর জানলাম একেবারে একক চেষ্টায় ওরকম একটি পত্রিকা সংগ্রহের স্বপ্ন নিয়ে এই ছেলেটি ছোটো মাপের একটি লাইব্রেরি গড়ে তুলেছে একেবারে ব্যক্তিগত উদ্যোগে। এই লাইব্রেরি ছিল তার নিজস্ব ছোটো একটি ঘরে। একদিন দেখতে গিয়েছিলাম। শুনলাম ওই ছোটো ঘরের মধ্যে অনেকেই অদৃষ্টপূর্ব কোন কোন ম্যাগাজিন দেখে নিতে পারেন। ঘরটি ছোটো, কিন্তু একেবারেই কলকাতার বই জগৎ যেটাকে বলা যায় সেই কলেজ স্ট্রিটেরই সংলগ্ন বলে বই সংগ্রহ করার আর উৎসুক পাঠককে ব্যবহার করতে দিতে পারার পক্ষে অত্যন্ত উপযুক্ত। তখন থেকে আজ পর্যন্ত এমন একটি পরোপকারী কাজ করে চলেছেন তিনি যে ক্রমবর্ধমান এই লাইব্রেরি আর তাকে ব্যবহার করবার এমন অঢেল সুযোগ তৈরি হওয়া নিশ্চিতভাবেই একটা ঐতিহাসিক ঘটনা। মনে হল সেখানে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কোনও রকম সাহায্য করা আমাদের দায়িত্ব। এই প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব ও বিকাশের ভার যেন তার একার ওপর শুধু সীমাবদ্ধ না থাকে। সমবেত অনেকের সাহায্যে এটার বিরাট মাপের চিন্তাকেন্দ্র হয়ে দাঁড়াতে পারে।
অনেকদিন কেটে গেছে তারপর। ব্যক্তিগত স্তরে আমারও একটা সংগ্রহ আপনাআপনি গড়ে উঠেছিল সন্দীপ-নিরপেক্ষভাবেই। বাড়ি পাল্টানোর সময় এগুলি সব গুছিয়ে তুলে স্থানান্তরিত করার আয়োজনে সাজিয়ে রেখেছিলাম একটা জায়গায় দরজার ঠিক পাশেই। পরদিন সকালবেলায় উঠে দেখি একটি পত্রিকারও চিহ্ন নেই সেখানে। তার মানে ১৯৮০ সালের আগের আমার সংগ্রহের সমস্ত পত্রিকাই উধাও হয়ে গেছে। তারপর থেকে ৯০-৯১ পর্যন্ত অন্য সব পত্রিকা আমার এক পুরনো ছাত্রের নবনির্মিত বাড়িতে দিয়ে এসেছিলাম। কেননা সে বলেছিল এইসব বইগুলোর কথা ভেবেই দোতলায় একখানি ঘর করেছে। কিন্তু তার পক্ষে আমার এইসব পত্রিকা সংরক্ষণ সম্ভব ছিল না, কারণ স্বভাবতই তার পরেও পরবর্তী আরও কিছু জমে উঠেছে যেসব পত্রিকা তারও ভার তো কম নয়। সেই কারণেই একদিন সন্দীপকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, আমার কাছে রক্ষিত পত্রিকাগুলি সে নিয়ে যেতে পারে কি না। সন্দীপ খুবই খুশি হয়েছিল শুনে, কিন্তু ওর দিক থেকে এ নিয়ে আর কোনও কথা আসেনি।
বুঝতে পারলাম আমার প্রস্তাবটিই ছিল অসঙ্গত কেননা ওর বাড়িতেই বা জায়গা কোথায়? ফলে সন্দীপের গ্রন্থাগারটি আরও একটু সমৃদ্ধ করবার যে কথাটি ভেবেছিলাম তা সম্ভব হল না। কিন্তু যাঁরা লেখাপড়ার কাজ করেন, যাঁরা গবেষণার কাজ করেন কিংবা কোন বিষয়ে নিছক কোনও কৌতূহল মেটানোর জন্য লিটল ম্যাগাজিনের সন্ধানে ঘুরে বেড়ান এদিক সেদিক, তাঁদের সামনে সম্পূর্ণ একটা লিটল ম্যাগাজিনের সংগ্রহ হিসাবে গড়ে উঠছে না। এখনকার পাঠক-পাঠিকার সাহায্যের জন্য যতটা কাজে লাগতে পারত সন্দীপের এই লাইব্রেরি ততটা পেরে উঠছে না। সেটা আমাদের সংস্কৃতির লজ্জা। তবু এই দৈন্য মোচন করবার জন্য আকুল আগ্রহ নিয়ে নিজেদের ছোট্ট বাড়িতে যতটুকু আয়োজন গড়ে তুলতে পেরেছে সন্দীপ তার জন্য ভবিষ্যৎ কাল নিশ্চয়ই গর্ববোধ করবে।
অনুলিখন : হরিসাধন চন্দ্ৰ
সূত্র: ‘অথ পথ’ পত্রিকার নবম বর্ষ প্রথম সংখ্যা
তার জন্য ভবিষ্যৎ কাল নিশ্চয়ই গর্ববোধ করবে
শঙ্খ ঘোষ
শঙ্খ ঘোষ
মন্তব্য