মানুষ স্মৃতিজীবী। সময় আর স্মৃতির ব্যস্তানুপাতেই এগিয়ে চলা অজানা ভবিষ্যতের পথে। তবে একেক সময় স্মৃতির ভার এত দুঃসহ হয়ে ওঠে, যে তাকে বিস্মৃতির অতলে সমর্পিত করাই শ্রেয় মনে হয়। ভুলে যেতে ইচ্ছে করে, যে এমন কিছু হয়েছিল কোনও একদিন। এরকমই এক ঘটনার কথা অনিচ্ছার স্বরেই বলতে হচ্ছে। তবে এখন মনে হচ্ছে, থাক এই অসহনীয় চিহ্নটুকু; এই শাস্তি আজীবন বহন করে চলা আমার দরকার, আমার প্রাপ্য; যাতে নিছক কোনও আলস্যের বশে চেতনার গর্ভগৃহে সঙ্কট আর কখনোই না তৈরি হয়।
বছরদুয়েক আগের কথা। মাঝ-দুপুরে একটা ক’রে ফোন। পর-পর তিন-দিন। কোনও এক অজানা কারণে ধরতে পারিনি তিনদিনই। অচেনা নম্বরে ফিরতি কল করার অভ্যাসটিও রপ্ত হয়নি তখনও। চতুর্থ দিন আর অবশেষে সে ধরা দিল সহজেই।
ওপার থেকে নম্র, গভীর গলা, ‘আপনি কি মকটেল পত্রিকার সম্পাদক?’
এমন তো কত ফোনই আসে। পত্রিকা সংগ্রহ করতে চান অনেকে, কেউ-কেউ ডাকে পাঠানোর কথা বলেন।
আমি একটি ছোট্ট ‘হ্যাঁ’ সারতেই পরের ঝড়টা এল।
‘আমি সন্দীপ দত্ত বলছি।’
তত-দিনে এই নামটির সঙ্গে পরিচয় তাঁর নাম আর কাজেই। যে-কোনো লিটল ম্যাগাজিন কর্মীর কাছে তিনি স্বয়ং দেবদূত। ফোনটা কানে যেন এঁটে আছে, আর আমি স্বপ্নলোকে তখন। অপার বিস্ময়ে ভাবতে শুরু করেছি, লিটল ম্যাগাজিনের প্রতি কতখানি দরদ আর ভালোবাসা থাকলে একটা অপ্রাপ্তবয়স্ক ছোটপত্রিকার অকালপক্ক সম্পাদককে ঈশ্বরসম মহীরুহ দিনের পর দিন নিরবচ্ছিন্নভাবে খুঁজে যেতে পারেন অবলীলায়।
থম কাটার আগে তিনিই বললেন, ‘আপনাদের একটি সংখ্যা পড়েছি। নতুন সংখ্যা কি বেরিয়েছে?’
তখন আমাদের ‘অণুপ্রজন্ম’ সংখ্যা বেরোবে-বেরোবে করছে। জানালাম সে-কথা।
বললেন, ‘প্রকাশিত হলে নিয়ে আসবেন একদিন লাইব্রেরিতে। কথা হবে।’
এটুকুই কথা। তারপর নিস্পন্দ অন্ধকার।
এই ঘটনার ক'দিন আগেই চুঁচুড়া লিটল ম্যাগাজিন মেলায় কয়েক মিনিটের সাক্ষাৎ হয়েছিল এই মানুষটির সঙ্গে। নিজেদের পত্রিকার টেবিলে বসে পা নাচাতে নাচাতে দেখেছিলাম, বয়সভারে ন্যুব্জ হয়েও এক ঋজুদেহ কীভাবে অকাতরে অন্বেষণ চালিয়ে যাচ্ছেন বিভিন্ন পত্রিকার বিভিন্ন সংখ্যার। সম্পাদকদের অন্তরে হাসি আর বিস্ময় ফুটিয়ে কিনে চলেছেন একের পর এক স্বপ্ন। তখনই এক মহার্ঘ মুহূর্তে আমাকে, আর আমার বন্ধু আদিত্যকে (মকটেলেরই সহকর্মী, শিল্পী আদিত্য ভট্টাচার্য) নিয়ে তাঁর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিয়েছিলেন মানস স্যার, তথা, সাহিত্যিক মানস সরকার। পরম আশ্রয়ের ছায়ায় পেয়েছিলাম স্পর্শ – কী অসম্ভব প্রশ্রয় মিশেছিল সে তালুতে! সেদিনও বলেছিলেন, “একদিন এসো লাইব্রেরিতে। কথা হবে”।
এই-যে এক সাংঘাতিক অনুরোধ (তথা, আদেশ) তিনি করে রেখেছিলেন, এর থেকে মুক্তি পাওয়া হবে না আর কোনোদিনই। নাহ্! সে-যাওয়া হয়নি আমাদের আর। কেটে গেছে টানা দু’টি বছর। অথচ, কোনও এক দুর্বোধ্য কারণে আজও সে-ডাকে সাড়া দেওয়া হল না। নানা কারণেই যাব-যাব করে যাওয়া আর হয়নি। কলেজস্ট্রীট গিয়েছি বহু-বহুবার, কিন্তু মন্দিরের পথে একবারও যাওয়া হয়নি। কিছুদিন আগেও বন্ধু, কবি অর্কপ্রভ ভট্টাচার্যকে বলছিলাম, একদিন যেতে হবে ভাই। অর্ক এর আগে অনেকবারই তাগাদা দিয়েছিল, আমিই হয়ত গুরুত্ব দিইনি তখনও অতটা। জানতাম, আছেনই তো তিনি। থেকেই তো যাবেন। একদিন গেলেই হল।
আলস্যকে অজান্তে এতখানি মর্যাদা দিয়ে ফেলেছিলাম, জানতেই পারিনি। আর এই ভয়াবহ, দুঃসহ ভার আজীবন এভাবে বয়ে বেড়াতে হবে, কল্পনাতীত ছিল। হয়ত, ঈশ্বর চাননি, এই অপরাধী নাগালে পাক প্রবাদপ্রতিম মানুষটিকে। হয়ত, এভাবেই সেই মুকুটহীন রাজাকে যত্নশকটে সজ্জিত করে মুক্ত রাখলেন নগণ্য, ও তুচ্ছ এক সম্পাদকের বেষ্টনী থেকে। কিছু কিছু দূরত্ব এভাবেই থেকে যায়, যা শত চেষ্টাতেও পার করা যায় না সারা জীবনেও। সন্দীপ দত্ত থেকে যাবেন তেমনই এক নিশ্ছিদ্র বলয়ে, লিটল ম্যাগাজিনের সংগ্রামী প্রতিভূ হয়ে। আদর্শ আর সম্মানকে চূড়োয় রেখে, পা মাটিতে, শিরদাঁড়া দৃঢ় রেখে, যুগের আলোয় স্নাত হয়ে। তাঁকে দরকার হবে আমাদের অনেকবার, ছায়াহীন পথে হাঁটতে হাঁটতে পথ হারালে টেনে তোলার কেউ থাকবেন না আর। কিন্তু একথা বিস্মৃত হব না, যে সঠিক পথের খোঁজ সঠিকভাবে হাঁটলে ঠিকই পাওয়া যাবে কোনও একদিন।
শেষে যেটুকু বলার থাকে: হুগলী জেলার মানকুণ্ডু লিটল ম্যাগাজিন মেলা থেকে তিনি নিজ-তাগিদেই কিনে নিয়েছিলেন আমাদের পত্রিকার একটি সংখ্যা। সেও পরম যত্নে হয়ত ঠাঁই পেয়েছিল গ্রন্থাগারের আদিম দেওয়ালের কোনও একটি খাঁজে। সেই আদরের আর্দ্র ওমেই পরশপাথরের সন্ধান করতে থাকব বারবার।
শূন্যের অতল থেকে ভেসে আসে সেই অন্তহীন ডাক
রক্তিম ভট্টাচার্য
রক্তিম ভট্টাচার্য
বাঃ ওস্তাদ
উত্তরমুছুন