সাল তারিখের হিসেব আমার একেবারেই স্মরণ থাকে না। তবে যতদূর সম্ভব মনে হয়, ১৯৯৫ — ৯৬ সাল হবে। আমি তখন পাকাপাকি ভাবে চুঁচুড়ায় চলে এসেছি। আমার জন্মগ্রাম ধনিয়াখালিতে কোনো একটা অনুষ্ঠানে সন্দীপদা গিয়েছিলেন। যদিও তার আগে কলকাতাতেই তাঁর সঙ্গে আমার আলাপ হয়ে যায়। অনুষ্ঠান চলাকালীন সময়েই আমায় জানিয়ে দিলেন, তিনি কয়েকটি তাঁতের শাড়ি কিনবেন। আমার কাজ হবে তাঁকে তাঁতিদের বাড়িতে নিয়ে যাওয়া। এটা আমার কাছে কোনো সমস্যাই নয়। তাঁতিবাড়ির অনেক ছেলেই আমার স্কুল জীবনের বন্ধু। অনুষ্ঠান শেষ হতে আমি তাঁকে আমার বেশ কয়েকজন বন্ধুর বাড়ি নিয়ে যাই। তিনি শুধু কাপড়ই কিনলেন না, তাঁতিদের কাছ কতকিছু খুঁটিনাটি বিষয় জেনে নিলেন। অতসব তাঁর না জানলেও চলত। কিন্তু তিনি যে সন্দীপ দত্ত। অসীম তাঁর কৌতুহল। একটি কাপড় তারা কতদিনে বোনে, প্রতি কাপড়ে কত মজুরি পাওয়া যায়, তারা যা উপায় করে তাতে তাদের সংসার চালাতে কোনো সমস্যা হয় না তো — এমন হাজারও জিজ্ঞাসা। রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে আমায় বলতে শুরু করলেন, তাঁত বিষয়ে কোথায় কোন পত্রিকা কি কি কাজ করেছে তাদের নাম ইত্যাদি ইত্যাদি।
১৯৯০ সাল নাগাদ চুঁঁচুড়ায় চলে আসি। এর কিছু সময় পরেই “মউনি” নামে একটি পত্রিকা সম্পাদনা করি। লিটল ম্যাগাজিন করব আর সন্দীপ দত্তর সঙ্গে পরিচয় হবে না — এটা তো হয় না। পত্রিকা নিয়ে একদিন তাঁর কাছে পৌঁছে যাই। “মউনি” বন্ধ হয়ে যাবার পর শুরু করি “বৃষ্টিকথা” পত্রিকা। এই পত্রিকাটিও কয়েকটি সংখ্যা প্রকাশিত হওয়ার পর বন্ধ হয়ে যায়। এর মাঝে চন্দননগর থেকে প্রকাশিত “অক্ষর” নামে একটি পত্রিকা সম্পাদনা করি। সেটিও বন্ধ হয়ে গেলে পাকাপাকি ভাবে “ছায়াবৃত্ত” চলে আসি। সন্দীপদার সঙ্গে যোগাযোগ একদিনের জন্যেও বন্ধ হয়নি। ওনার সঙ্গে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে দেখা হতো এবং উনি আমাকে পত্রিকা নিয়ে নানান কথা বলতেন যা আমার কাছে মূল্যবান সম্পদের মতো।
“ছায়াবৃত্ত” একেবারে প্রথম দিকে ফোল্ডার আকারে প্রকাশিত হতো। একবছর পরেই আর্থিক অসচ্ছলতার জন্যে ছায়াবৃত্ত অণুপত্রিকা রূপে আত্মপ্রকাশ করে। একটি A4 পাতাকে তিন ভাঁজ দেওয়ার পর যে আকারটি দাঁড়ায় — এমন আকৃতি দেখে সন্দীপদা খুব খুশি হয়েছিলেন। পরে তার অফিসে গিয়ে দেখি তিনি আমাদের সংখ্যাগুলিকে যত্ন করে সাজিয়ে রেখেছেন। কয়েকটি সংখ্যা প্রকাশিত হওয়ার পর ছায়াবৃত্ত বুকসাইজে ফিরে আসে। ২০১০ সালে জুলাই সংখ্যাটি “অরুণ মিত্র সংখ্যা” রূপে প্রকাশিত হয়। সন্দীপদা সেই সময় কলকাতা থেকে প্রকাশিত একটি দৈনিক পত্রিকায় প্রতি রবিবার লিটল ম্যাগাজিন নিয়ে আলোচনা করতেন। অরুণ মিত্র সংখ্যা তাঁর হাতে গিয়ে পড়লে তিনি লিখলেন, মফস্বল থেকে একটি পত্রিকা অরুণ মিত্রকে নিয়ে সংখ্যা করছে এটা দেখলে শুধু আনন্দ নয়, তাঁর সাহসকেও সাধুবাদ জানাতে হয়। ২০১২ সালে সেপ্টেম্বর মাসে ছায়াবৃত্ত “বনলতা সেন” সংখ্যা প্রকাশ করে। বনলতা সেন কবিতাটির পঁচাত্তর বছর উপলক্ষে এই সংখ্যাটি আমরা প্রকাশ করি। মনে আছে, উনি বলেছিলেন এই বিষয় নিয়ে সংখ্যাটি পশ্চিমবঙ্গে প্রথম তোমরাই করলে। এরপর আমরা “প্রিয় কবির প্রিয় কবিতা”, “কবির চিঠি” সংখ্যা প্রভৃতি নানান বিষয়ে সংখ্যা প্রকাশ করি। ২০১৬ সালের জানুয়ারি মাসে “ছায়াবৃত্ত” থেকে প্রকাশিত হয় “নবারুণ ভট্টাচার্য সংখ্যা”। নবারুণ ভট্টাচার্যের গদ্যের ওপর অনেক কাজ হয়েছে কিন্তু শুধু কবিতার ওপর কোনো সংখ্যা কোথাও হয়েছে কিনা আমার জানা নেই। অন্তত আমার চোখে পড়েনি। সন্দীপদাকে জিজ্ঞাসা করে জানতে পারি, আমাদের বক্তব্য পুরোপুরি ঠিক। কলকাতা টেমার লেন-এ একদিন তাঁর লাইব্রেরিতে গিয়ে তাঁকে জিজ্ঞাসা করি, “নবারুণ ভট্টাচার্য সংখ্যা” টি তাঁর লাইব্রেরিতে এসে পৌঁছেছে কিনা। আমার স্পষ্ট মনে আছে, তিনি আমাকে বলেছিলেন, “মানে! কত কত গবেষক এই সংখ্যাটি থেকে কতকিছু লিখে নিয়ে গেল।”
“ছায়াবৃত্ত” তাঁর কাছ থেকে অনেক কিছু পেয়েছে। তাঁর মৃত্যুর পর যাঁরা তাঁকে নিয়ে লোক দেখিয়ে ভালোবাসা দেখাচ্ছেন, তাঁরা বেশিরভাগই অসার মালপত্র। কলকাতার অনেক পত্রপত্রিকাই তাঁকে তাঁর প্রাপ্য সম্মান দেয়নি। বরং গ্রাম বা মফস্বল থেকে তাঁর ডাক আসত অনেক বেশি। সেখানে তিনি অগণন মানুষের ভালোবাসা পেয়েছেন। সন্দীপদা প্রায় বিনা নিমন্ত্রণেই কলকাতার অনেক অনুষ্ঠানে হাজির হয়ে যেতেন। ভিড়ের মধ্যে থেকে লুকিয়ে দেখতেন, কোথায় কি লিটল ম্যাগাজিনের কাজ হচ্ছে। সন্দীপদার এমন অদ্ভুত মানসিকতা আমাকে খুবই অবাক করত। একটা মানুষ কত উদার আর লিটল ম্যাগাজিনে নিবেদিত প্রাণ হলে তবে এমন কাজ করতে পারে। কলকাতা শিয়ালদহ অঞ্চলের একটি সভাগৃহে একদিন তাঁকে এইভাবেই আবিস্কার করি। আমি খেয়ালই করিনি, হঠাৎ দেখি তিনি সকলের শেষে একটি চেয়ারে বসে আছেন। কাছে যাই এবং সেইদিনই তাঁর কাছ থেকে বিনা নিমন্ত্রণে এই হঠাৎ উপস্থিতির কথা জানতে পারি। সেদিন অবাক হয়ে আরও একটা বিষয় লক্ষ্য করি, মঞ্চের অনেক কবি সাহিত্যিকই তাঁকে দেখতে পাচ্ছেন কিন্তু তাঁদের বক্তব্যে একবারের জন্যেও তাঁর নাম উচ্চারিত হল না। এই যে তাঁকে চিনেও না চেনার ভান করে এড়িয়ে যাওয়া আমাকে খুবই পীড়া দিত। সেদিন আমি মনে করেছিলাম, আমার কবিতা পাঠের সময় এলে আমি মঞ্চ থেকে তাঁর কথা বলে আমাদের এই এড়িয়ে যাওয়ার ব্যাপারে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করব। কিন্তু সন্দীপদা আমাকে বারবার অনুরোধ করেন এমন কাজ না করতে। যার ফলে সেদিন মঞ্চ থেকে শুধু কবিতা পাঠ করেই নেমে আসি।
সন্দীপদা লিটল ম্যাগাজিনের পথ চলাকে একটা আন্দোলনের পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলেন তাঁর একক দক্ষতায়। কিন্তু এই বাংলার অনেক অনেক লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদক এটাকে একটা ব্যবসার ক্ষেত্র হিসেবে নেওয়াতে তিনি চরম দুঃখ পেয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, পত্রিকা সম্পাদকদের এহেন চরিত্রহীনতার কথা বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তিনি তাঁর বক্তব্যেও তুলেও ধরতেন। কিন্তু কে শোনে কার কথা! তিনি স্বীকারও করেছিলেন, লিটল ম্যাগাজিন আজ আর কোনো আন্দোলনের স্তরে দাঁড়িয়ে নেই।
ব্যস্ততার কারণে তাঁর লাইব্রেরিতে যেতে পারতাম না। তাই লিটল ম্যাগাজিনের এই অভিভাবক দেখা হলেই, লাইব্রেরিতে আসতে বলতেন। কেন জানি না, তিনি বোধহয় জানতে পেরেছিলেন তাঁর সময় হয়ে আসছে। কেবলই বলতেন, “তুমি তো আর আসো না। একদিন একটা ফোন করে চলে এসো। আমি তো এখন বিশেষ কোথাও বের হইনা। আড্ডা দেওয়া যাবে। কবে কোনদিন পালিয়ে যাব আর কোথাও খুঁজে পাবে না”। সত্যিই তিনি যে এত তাড়াতাড়ি চলে যাবেন আমরা কেউই ভাবতে পারিনি। আড্ডা আর দেওয়া হল না — এ দুঃখ আমার আমৃত্যু থেকে যাবে।
সন্দীপ দত্ত: লিটল ম্যাগাজিনের অভিভাবক
হরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়
হরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়
ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণের মধ্য দিয়ে উঠে এসেছে সন্দীপ দত্তের আন্দোলন প্রতিমা৷ সুন্দর লেখা৷ গ্রেট ওয়ার্ক বিন্দু
উত্তরমুছুন