.header-button .inner > span { font-size: 18px !important; } .header-button .inner i.fa { font-size: 40px !important; } .comment-form-message { background-color: #f4f4f4 !important; font-size: 14px !important; }

সন্দীপ দত্ত সংখ্যা : বটু কৃষ্ণ হালদার

রৌদ্র ঝলমল নির্মল আকাশে বিষণ্নতার ছায়া,
টেমার লেনের উঁচু দুটি ধাপ পেরিয়ে,
লাইব্রেরির পত্রিকাগুলো হাতছানি দেয়
সব আজ অতীতের ইতিকথা
তুমি আজ নেই কাটছে কালবেলা
নবীন প্রজন্ম কাঁধে এখন লিটিল ম্যাগাজিন মেলা।

একেবারেই সঠিক অনুমান, নবীন প্রবীণ  সাহিত্যদের অন্যতম আশ্রয়দাতা এবং ছোট ছোট পত্রিকা গুলোকে বাঁচিয়ে রাখার অন্যতম পুরোধা যাঁর নাম সন্দীপ দত্ত মহাশয়। অর্থাৎ বাংলা ভাষায় সিংহভাগ লেখক লেখিকারা মূলত ছোট ছোট পত্র পত্রিকা গুলোতে লেখা লেখি করে সাহিত্যের রস আস্বাদন করেন। আর সাহিত্যিকদের স্বপ্ন পূরণের আঙিনা হল লিটিল ম্যাগাজিন। যাতে নানান ধরনের লেখা প্রকাশিত হয়। বলতে গেলে লেখকদের হৃদয়ে আকুতিগুলো জলরঙে ভেসে ওঠে পত্রিকার পাতায়। নিজেদের ভাবনা, কল্পনা, স্বপ্ন, মেধা প্রকাশের মাধ্যম। এককথায় বাংলা সাহিত্যের মূল স্তম্ভ হল লিটিল ম্যাগাজিন। অথচ লিটল ম্যাগাজিন বলতে আমরা বুঝতাম প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা। লিটল ম্যাগাজিন বলতে আমরা বুঝতাম সন্দীপ দত্তকেও, যিনি প্রাতিষ্ঠানিক সমর্থনের ধার না মাড়িয়ে রোদ-বৃষ্টি-ঝড়ে অণুপত্রিকাগুলির মাথায় ঋজু অশ্বত্থের ছায়ার মতো হয়ে উঠতে পেরেছিলেন।

পশ্চিমবাংলা বরাবরই সংস্কৃতি সাহিত্যের অন্যতম পীঠস্থান। সেই বাংলায় সাহিত্য সংস্কৃতির গুণগত মান বিশ্বের দরবারে পৌঁছানোর অন্যতম মাধ্যম হলো ছোট ছোট পত্রিকা। তবে কালের নিয়ম অনুসারে বর্তমানে এই বাংলায় অপসংস্কৃতির ঢেউ বিরাজমান। শিক্ষা, শিল্পর মত কমবেশি সর্বস্তরের সেই ঢেউ আঁছড়ে পড়েছে সাহিত্য, সংস্কৃতিতে। তাতে সব থেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ছোট ছোট পত্রিকাগুলো। যে সময় আমরা দাঁড়িয়ে আছি তার  পূর্ববর্তী সময়ে বহু ছোট ছোট জনপ্রিয় পত্রপত্রিকা কালের গর্ভে অবহেলায় যেমন তলিয়ে গেছে,তেমনি ব্যাঙের ছাতার মতো নতুন নতুন বহু পত্রিকা জন্ম ও  নিয়েছে। বহু সাহিত্যিক থেকে সমাজসেবী এসেছেন আর গিয়েছেন কিন্তু সন্দীপ দত্তের মতো করে ছোট ছোট পত্রিকা গুলোর ভবিষ্যত সংরক্ষণ বা অক্সিজেন ফিরিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা আর কেউ করেনি। বলতে গেলে অপসংস্কৃতির ধুলো ঝড়ে ছোট ছোট পত্রিকাগুলো চাপা পড়ে যাবার আগেই তিনি সেই তিনি নতুনভাবে রূপদান করে গেছেন।সেই সঙ্গে নবীন, প্রবীণ, সাহিত্যিকদের একটি সুতোয় গেঁথে ফেলার ঠিকানাকে মজবুত করার মত গুরু দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি হলেন লিটিল ম্যাগাজিনের অন্যতম প্রাণ পুরুষ। মাত্র ২১ বছর বয়সে পাকাপাকি ভাবে মনস্থির করেছিলেন যে লিটিল ম্যাগাজিন ছিল তাঁর জীবন। বাংলা ভাষায় যেখানে যত লিটিল ম্যাগাজিন প্রকাশিত হত তিনি ছিলেন তাঁর একমাত্র ধারাবাহিক সংরক্ষক। তিনি নিজের নিজের অর্থ দিয়ে কিনে নিয়ে পত্রিকা সংরক্ষণ করার মত গুরু দায়িত্ব পালন করতেন। আবার বহু সম্পাদক নিজেদের সন্তানসম পত্রিকা গুলো যাতে নিয়মের বেড়াজালে হারিয়ে না যায় সেই গরজে সবথেকে পছন্দের জায়গা সন্দীপ দত্তের লাইব্রেরিতে মহাআনন্দে দিয়ে আসতেন।সেই সঙ্গে ভবিষ্যতের জন্য সম্পূর্ন রূপে চিন্তা মুক্ত হতেন। এক্ষেত্রে সন্দীপ দত্ত ছিলেন লিটল ম্যাগাজিনের স্বার্থহীন আশ্রয়দাতা।

যার কারণে তিনি সমাজের প্রতিটি স্তরের না হোক, কিন্তু সাহিত্য সংস্কৃতি জগতের উদিত সূর্য হয়ে উঠেছিলেন। তিনি কিন্তু বিখ্যাত সঙ্গীতশিল্পী, বা অভিনেতা, রাজনীতিবিদ নন। তবে অবশ্যই তিনি একজন চিন্তাবিদ,দার্শনিক এবং মননে নিঃশব্দ বিপ্লবী বললে একেবারেই ভুল বলা হবে না। যাঁর জন্য তিনি সমাজের এক শ্রেণীর সাহিত্য সংস্কৃতি মনোভাবাপন্ন মানুষের হৃদয় চির বিরাজমান থাকবে।

সন্দীপ দত্তের প্রাথমিক শিক্ষা কলকাতার সেন্ট পলস স্কুলে। তারপর স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে বাংলায় স্নাতক হন তিনি। পরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা বিষয়ে স্নাতকোত্তর এবং বি এড করেন। কলেজ স্ট্রিট সংলগ্ন  মির্জাপুর সিটি স্কুলের শিক্ষক ছিলেন। তবে সমকাল এবং ভাবীকাল তাঁকে মনে রাখবে লিটল ম্যাগাজ়িন আন্দোলনের এক পরম হিতাকাঙ্ক্ষী হিসাবেই।

লাইব্রেরিটি শুরু হয়েছিল ১৯৭৮ সালের ২৩ জুন। এই শুরুর নেপথ্যে ছিল বিশেষ কিছু ঘটনা। ১৯৭২ সালে ছাত্র অবস্থায় একদিন ন্যাশানাল লাইব্রেরিতে গিয়ে তিনি দেখেন বহু পুরানো লিটল ম্যাগাজিন জোড়ো করা রয়েছে। দেখে উৎসাহিত হন কিন্তু, কর্তৃপক্ষ বলেন যে সেগুলো রাখা হবে না। তারপর, ১৯৭২-এ পার্ট টু পরীক্ষা দেওয়ার পর বাড়িতেই ৬৫০টি পত্রিকা নিয়ে একটি প্রদর্শনী করেন।সাধারণ গ্রন্থাগারের লিটল ম্যাগাজ়িনের প্রতি অশ্রদ্ধা এবং অবহেলা দেখে সন্দীপ নিজের বা়ড়িতেই তৈরি করেছিলেন গ্রন্থাগার। নাম দিয়েছিলেন ‘কলকাতা লিটল ম্যাগাজ়িন লাইব্রেরি অ্যান্ড রিসার্চ সেন্টার’। যার শুরুতে নাম ছিল ‘বাংলা সাময়িকপত্র পাঠাগার ও গবেষণা কেন্দ্র’, যা পরবর্তীসময়ে বর্তমান নামে নথিভুক্ত হয়।
১৯৭৮ খ্রিস্টাব্দের ২৩শে জুন সামান্য কয়েকটি পত্র-পত্রিকা নিয়ে কলকাতার টেমার লেনে যে গ্রন্থাগার চালু করেন সন্দীপ তা বর্তমানে ভারতের অন্যতম সমৃদ্ধ পত্রিকার সংগ্রহালয় হিসেবে গণ্য হয়ে থাকে। তাঁর তত্ত্বাবধানে বহু দুষ্প্রাপ্য ও দুর্লভ পত্রিকা সংরক্ষণ করা হয়। ১৯৭৯ সালের ৮ই মে গ্রন্থাগারটি জনগণের জন্য গবেষণার স্বার্থে উন্মুক্ত হয়। এই গবেষণা কেন্দ্রের নাম হয় কলিকাতা লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরি ও গবেষণা কেন্দ্র। 
কলকাতার একমাত্র ‘লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরি ও গবেষণা কেন্দ্র’টি তাঁর হাতেই তৈরি। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকার একেবারে শুরুর দিকের অরিজিনাল সংকলন থেকে শুরু করে দেশলাই বাক্সের আদলের লিটল ম্যাগাজিন, কী নেই তাঁর সংগ্রহে। এখনও পর্যন্ত প্রকাশিত যাবতীয় লিটল ম্যাগাজিনের সংকলন রয়েছে তাঁর পাঠাগারে। তাবড় তাবড় লেখক, গবেষক, ছাত্র, অধ্যাপক রা ছুটে যান সন্দীপ দত্তের এনসাইক্লোপিডিয়ার কাছে। কারণ টেমার লেনেই লুকিয়ে আছে হিরে, মুক্ত, জহররের থেকে ও অনেক বেশি অমূল্য সম্পদ। সবাই জানেন যে বাংলা সাহিত্যের এক দিকপাল যাঁর সংগ্রহে রয়েছে আট থেকে আশির অন্তরের চাহিদা।
যেকোনও বইমেলাতেই তাঁকে দেখা যায় লিটল ম্যাগাজিনের চারপাশে ঘুরছেন তিনি, পুরোনো-পরিচিত কাগজ সংগ্রহের পাশাপাশি খুঁজে নিচ্ছেন একেবারে আনকোরা, নতুন শব্দ-কাজ। এখনও পর্যন্ত প্রকাশিত যাবতীয় লিটল ম্যাগাজিনের সংকলন রয়েছে তাঁর পাঠাগারে।সন্দীপবাবু নিজে একটি কাগজ শুরু করেন ১৯৭০ সালে। তাঁর কথায়, “সব লিটল ম্যাগাজিন সেই সময় আমি কিনতে পারতাম না। সেই সময় মানে, স্টুডেন্ট লাইফে পয়সা বাঁচিয়ে যতটুকু পারতাম কিনতাম। এইভাবে কিনতে কিনতেই একটা ভালোবাসা জন্মে যায়। ন্যাশনাল লাইব্রেরির ঐ ঘটনাটা আমায় আরও এগিয়ে দেয়। ভাবলাম যে ন্যাশনাল লাইব্রেরির যদি এমন অবস্থা হয়, তার একটা কাউন্টার এসট্যাব্লিশম্যান্ট (Counter Establishment) আমি ছোট করে আমার বাড়িতেই করতে পারি। প্রদর্শনী করতে গিয়ে আমার কাছে কিছু পত্রিকা জমেছিল, এইভাবেই শুরু বলা যায়। এইসব চিন্তারই ফসল এই লাইব্রেরি।”

১৯৭৬ সাল থেকে কলকাতা বইমেলায় সন্দীপ দত্ত তাঁর পত্র-পত্রিকার সংগ্রহ নিয়ে অংশগ্রহণ করতেন। লিটল ম্যাগাজিন সংগ্রহ ও গবেষণা ছাড়াও তিনি বহু পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন। তাঁর রচিত একাধিক গল্প, প্রবন্ধ এবং কবিতা সংকলন রয়েছে। সিনে সেন্ট্রাল কলকাতা ও বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের আজীবন সদস্য ছিলেন তিনি। সুভাষ মুখোপাধ্যায় জীবন ও সাহিত্য এবং বাংলা কবিতার কালপঞ্জি (১৯২৭-১৯৮৯) তাঁর রচিত অন্যতম গ্রন্থ।সন্দীপ দত্তকে নিয়ে লিখতে গেলে মহাভারত। কারণ তিনি শুধু মাত্র পত্র-পত্রিকার হাল-হকিকত খবর রাখতেন না, সেই সঙ্গে কবি সাহিত্যিকদের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। এমনকি দূর দূরান্ত কবি সাহিত্যিকদের সঙ্গে পত্র দ্বারা যোগাযোগ করতেন। লাইব্রেরীতে আমন্ত্রণ জানতেন। তাই তাদের কাছে সন্দীপ দত্ত ছিলেন আত্মার আত্মীয়।

সন্দীপ দত্ত সম্ভবত অনুভব করেছিলেন তথাকথিত প্রাতিষ্ঠানিক, মূলত বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে প্রকাশিত পত্রপত্রিকাগুলোর বিপ্রতীপে দাঁড়িয়ে শহর কলকাতা এবং মফস্বলে যে অসংখ্য পত্রপত্রিকা হচ্ছে এবং সেইসব কাগজকে কেন্দ্র করে সাহিত্যের থোড়-বড়ি-খাড়ার বাইরেও যে পরীক্ষামূলক সাহিত্য সৃষ্টি হচ্ছে, তার সংরক্ষণ জরুরি কারণ আগামীদিনে সাহিত্যের ইতিহাসের জন্য এই ডকুমেন্টেশন রয়ে যাবে। একজন স্বপ্নদ্রষ্টার কাজ স্বপ্ন দেখা এবং স্বপ্নপূরণের পথে এগিয়ে চলা। সন্দীপ দত্ত সেটা করে দেখালেন। আজ আর ট্যামার লেন কলেজস্ট্রিট অঞ্চলের এক অলিগলি পথ নয়, তাঁর সংগ্রহশালা আজ সারা পৃথিবীর গবেষকদের এক আকরস্থান, পবিত্রভূমি। তিনি প্রমাণ করে দিয়েছেন লিটল ম্যাগাজিন কোনো বিকল্প সাহিত্যধারা নয়। তথাকথিত ‘মূলস্রোত’কে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে চোখে চোখ রেখে সে জানিয়ে দিচ্ছে— আমাদের ছাড়া সাহিত্যের কোনো অঞ্চলই আর সম্পূর্ণ নয়। সন্দীপ দত্তের লাইব্রেরিতে গেলেই চোখে পড়ত দেশি-বিদেশী কত গবেষককে।একজন ব্যক্তি তাঁর কাজের মধ্যে দিয়ে নিজেই হয়ে উঠছেন এক প্রতিষ্ঠান – এমন খুব বেশি দেখা যায় না।আমাদের সৌভাগ্য আমাদের মধ্যে ছিলেন এরকমই একজন নিঃস্বার্থ মানুষ ছিলেন সন্দীপ দত্ত। 
সন্দীপ দত্তকে বাংলার সাংস্কৃতিক মহল একডাকে চেনে যে প্রতিষ্ঠানটির জন্য সেটা হল লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরী। লিটল ম্যাগাজিন দীর্ঘদিন ধরেই বাংলা সংস্কৃতির এক অনন্য ও বিশিষ্ট সম্পদ। কিন্তু দীর্ঘদিন অবধি তা ছিল ক্ষণিক আলো ছড়িয়ে চিরতরে হারিয়ে যাওয়ার এক আবেগদীপ্ত প্রয়াস। এই হারিয়ে যাওয়া আটকাতে যিনি এক প্রতিষ্ঠানের জন্ম দিলেন তিনিই সন্দীপ দত্ত।

কীভাবে লিটল ম্যাগাজিনের সংরক্ষণ ও চর্চার অসামান্য প্রতিষ্ঠান লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরী গড়ে উঠেছিল সে কাহিনী বহু সংস্কৃতি মনস্ক ব্যাক্তিরা সন্দীপ বাবুর মুখ থেকে  শুনেছেন। একদিন ন্যাশানাল লাইব্রেরীতে গিয়ে তিনি দেখেন অনেক লিটল ম্যাগাজিন, যা লাইব্রেরীতে দান হিসেবে এসেছিল,তা স্থান সঙ্কুলানের জন্য ফেলে দেওয়া হচ্ছে। লিটল ম্যাগাজিনকে স্থান দিতে গেলে মহার্ঘ পুস্তকাবলীর নাকী জায়গা জুটবে না। সন্দীপ দত্ত সেই বইগুলি চেয়েচিন্তে নিয়ে এসে শুরু করলেন লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরী তৈরির কাজ। 
এমন নানা কাজ আমরা অনেকেই শুরু করি উৎসাহ নিয়ে। তারপর সেই কাজ থেমে যায়। আমরা আবার অন্য কাজে নেমে পড়ি। ফেলে আসা কাজটির খোঁজও রাখি না। সন্দীপ দত্ত এই নিরিখে ছিলেন এক ব্যতিক্রমী মানুষ। তিনি কাজটি শুরু করলেন এবং তারপর দশকের পর দশক ধরে সেই কাজটি নিয়ে লেগে রইলেন। ছোট্ট চারা থেকে ক্রমশ মহীরূহ হল লিটল ম্যগাজিন লাইব্রেরী।তাঁর লাইব্রেরিতে ঢুকলে সত্যিই বিস্মিত হয়ে যেতে হয় চারিদিকে শুধু পত্রিকা আর পত্রিকা সেগুলো সুষ্ঠুভাবে সাজানো জায়গার অভাব তবুও তিনি পত্রিকা সংগ্রহ করে চলতেন এ তাঁর জেদ, সাধনা, সেইসঙ্গে অবশ্যই জড়িয়ে ছিল আবেগ ও ভালোবাসা। নইলে এমন অসাধ্য সাধন কোনদিন সম্ভব নয়।এই লাইব্রেরীতে যা পাওয়া যায় তা ভূ ভারতে আর কোথাও পাওয়া যায় না।এমনকি ন্যাশনাল লাইব্রেরীতেও নয়।

শুধু লিটল ম্যাগাজিনের সংগ্রহশালা গড়ে তোলা নয়। একে কীভাবে পাঠকের জন্য, গবেষকদের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া যায় সেই নিয়েও তিনি নিরন্তর কাজ করে গিয়েছেন। সীমিত সাধ্য নিয়েই এই বিরাট লাইব্রেরীর ডিজিটাইজেশনের কাজ একটু একটু করে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন। কতটা সাহায্যই বা এই কাজে তিনি সরকার, বিখ্যাত সব প্রতিষ্ঠান বা গ্রন্থাগারগুলির থেকে পেয়েছেন। দু চারজন সাথীকে নিয়ে প্রায় একক সংগ্রাম করে যেতে হয়েছে তাঁকে।

সন্দীপদাকে সবাই জানেন একজন সংগ্রাহক হিসেবে। তুলনায় কম জানা তাঁর লেখক ও গবেষক সত্তাটি। বিভিন্ন ব্যক্তি বা বিষয়ের ওপর যখন বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করেছে পত্রিকা বা প্রতিষ্ঠান, সেখানে প্রায়শই স্থান পেয়েছে সন্দীপ দত্তের প্রবন্ধ। সন্দীপদা মূলত লিখতেন সেই ব্যক্তি বা বিষয়ের ওপর কোন লিটল ম্যাগাজিনে কে কী লিখেছেন তার এক ইতিবৃত্ত। এই কাজটি কতখানি পড়াশুনো থাকলে করা সম্ভব – তা অভিজ্ঞ যে কোনও ব্যক্তিই জানেন।

যাঁরা ১৮ নম্বর টোমার লেন, কলেজ স্ট্রিটের গা ঘেঁষা এই ঠিকানায় গেছেন, তারাই জানেন লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরীর সংগ্রহ কী বিশাল। নিজের বাড়ির একটি বিরাট অংশই এই লাইব্রেরীর জন্য ছেড়ে দিয়েছিলেন তিনি, যার বার্ষিক ভাড়াই ঐ অঞ্চলে হত বেশ কয়েক লক্ষ টাকা। সন্দীপদা অবশ্য একে আর্থিক কৃচ্ছসাধন হিসেবে কোনওদিন ভাবেন নি। বাংলা ভাষা সাহিত্য পড়াতেন মিত্র ইনস্টিটিউশন স্কুলে। ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতির প্রতি ভালোবাসার টানেই নিজের সবটুকু তিনি উজাড় করে দিয়েছিলেন এই লাইব্রেরীর জন্য। 

শুধু তাই নয়, সাতের শেষের দিকে যখন দেশে জরুরি অবস্থা লাগু হয়, স্বাধীন মত প্রকাশের বিরুদ্ধে নেমে এসেছিল শাসকের নিষেধাজ্ঞার খাঁড়া ঠিক তখন সন্দীপ দত্তের মত নিঃস্বার্থ মানুষগুলো চেষ্টা করে গেছেন স্বাধীন চিন্তাভাবনার জীবন্ত দলিল গুলিকে সংরক্ষণ করতে যে কাজ মোটেই সহজ ছিল না। সন্দ্বীপ দত্তের মত কিছু মানুষ তো ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে কাজ করে গেছেন, কিন্তু প্রশ্ন আগামী ভবিষ্যতে যখন এই একই রকম ভয় তাড়া করে বেড়াবে, কিংবা স্বাধীন মত প্রকাশ ও শিল্পকলায় স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করবে, তখন সন্দ্বীপ দত্তের মত বিচক্ষণ মানুষদের ইতিহাস রক্ষা করার দায়িত্ব কে কাজে নেবে?

সন্দীপদার কী কোনও আক্ষেপ ছিল না? ছিল। কিন্তু সে আর্থিক নয়। একটা দুর্ভাবনা তাঁকে কুড়ে কুঁড়ে খেত। অনেকবার মুখোমুখি আলাপে তিনি দুর্ভাবনা ব্যক্ত করে বলেছেন – তিনি চলে গেলে এই লাইব্রেরীর কী হবে? এত অমূল্য সম্পদ কী এমন যত্নে রক্ষিত হবে? এই বিরাট সম্পদ ডিজিটাইজেশনো অন্যান্য প্রক্রিয়ায় কী সঠিকভাবে পাঠক গবেষকদের জন্য উন্মুক্ত হবে? ছড়িয়ে পড়বে?

আজ সন্দীপদার প্রয়াণের পর এই প্রশ্নটা আমাদের সকলেরই। যে লিটিল ম্যাগাজিনের ভবিষ্যত কি হবে? নিশ্চিত ভাবে বলা ভালো গভীর অনিশ্চয়তায় কালো আঁধারে ঢাকবে ম্যাগাজিন গুলোর ভবিষ্যত।গতিশীল সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আরো পত্রিকা বের হবে কিন্তু অন্তর দিয়ে সেই পত্রিকা গুলো রক্ষণা বেক্ষণ করার মত দায়িত্বকে নেবেন? আগামী দশ কুড়ি বছর পর সেগুলো আদৌ পাওয়া যাবে কিনা সেই গ্যারান্টি দেওয়ার মত কেউ রইলো না।সাহিত্যের মত একটা গোটা ইন্ডাস্ট্রির দায়িত্ব একজন মানুষের কাঁধে ছিল, আর তিনি চলে যাওয়াতে বাংলা ভাষা সাহিত্যের এত পত্র পত্রিকা ঠিকানা হীন হয়ে গেলো। এক্ষেত্রে অনুমান করা যায় তিনি পাঠক এবং সাহিত্যিকদের কাছে কতটা আশ্রয়দাতা ছিলেন তা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। তারও অন্যতম বিশেষ কারণ হল স্বার্থবিহীন কাজকে ভালোবেসে বুকে আঁকড়ে ধরার মানুষ এখন হাতে গোনা, আর তাঁর এই কাজকে দায়িত্ব নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে তো?

লিটিল ম্যাগাজিন হল সাহিত্যিকদের জীবন্ত ভাবনা, স্বপ্ন দেখা মানুষগুলোর রক্ত, মাংস, পরিশ্রম, ঘাম মিশে থাকে। সন্দীপ দত্তের প্রয়াণে আদর করে কে বুকে টেনে নেবে?

তবে সময় গতিশীল,তাকে আটকানোর চেষ্টা নির্বুদ্ধিতার কাজ। তবে যতদিন বাংলায় সাহিত্য নিয়ে চর্চা গবেষণা হবে ততদিন তিনি সাহিত্য জগতে পাঠক এবং কবি-সাহিত্যিকদের হৃদয়ে থেকে যাবেন। সন্দীপ দত্তের মত নিঃস্বার্থ মানুষদের কখনই মৃত্যু হয় না। তাঁর নশ্বর দেহটা হার মানল জন্ম এবং মৃত্যু নামক চিরাচরিত প্রথার কাছে। কারণ মৃত্যু চিরন্তন সত্য।যে নিয়মের কাছে একদিন সবাই পরাজিত হয়।

বাংলা সংস্কৃতি কাছে একটা সামগ্রিক চ্যালেঞ্জও এটা। এই চ্যালেঞ্জটা নেওয়া ও আন্তরিকতার সঙ্গে তা সম্পন্ন করার দায়িত্ব আমাদের সকলের। যে পথ তিনি আমাদের দেখিয়ে গেছেন তাঁকে বাঁচিয়ে রাখার গুরু দায়িত্ব এখন প্রবীণ ও নবীন সাহিত্যিক দের নিতে হবে। লাইব্রেরী টাকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে এই সংকল্প আমাদের কাঁধে।

এই কাজটা করতে পারলে সেটাই হবে এই আশ্চর্য মানুষটির প্রতি আমাদের যথার্থ শ্রদ্ধার্ঘ্য।     সাহিত্যের আঙিনায় এক অবিস্মরণীয় এবং অনিবার্য নাম আপনি। ভাবুক সাহিত্য প্রেমীদের কাছে বড় গর্ব ও অহংকার। তাঁর কথা মনে পড়লে যেন হামিংওয়ের কোন গল্প ও উপন্যাসের কথা মনে পড়ে। যাঁর সম্বন্ধে একটি বাড়তি শব্দ বা কোথাও কোনো বাড়তি আবেগকে বোঝায় না। মার্জিত পরিমিত সংযত একজন মানুষ সম্পূর্ণ নিরাপদ ভঙ্গিতে শুধুমাত্র অন্তরের প্রেরণায় সারাজীবন ধরে এমন একটি অমরত্বের আয়োজন করে গেলেন। তাঁর পর্বত প্রমাণ কাজের উত্তর অধিকারের দায়িত্ব আমাদের কাঁধে চাপিয়ে দিলেন। সেই দায়িত্ব পালন করার যোগ্য কিনা তা প্রমাণ করার দায় সম্পূর্ণভাবে আমাদের উপর। তবে সাহিত্য, ইতিহাসের পাতায় এবং মানুষের হৃদয়ে রয়ে যাবে সন্দীপ দত্ত তা কোন সন্দেহের অবকাশ থাকে না।

সন্দীপ দত্ত বিহীন টেমারলেনে বিষণ্নতার ছায়া
বটু কৃষ্ণ হালদার


মন্তব্য

BLOGGER: 2
  1. সন্দীপ দত্ত বিহীন টেমারলেন যেন বিষণ্নতার অপর নাম৷ সুন্দর সংখ্যা

    উত্তরমুছুন
  2. তথ্যবহুল পোস্ট। অনেককিছু জানলাম।

    উত্তরমুছুন
মন্তব্য করার পূর্বে মন্তব্যর নীতিমালা পাঠ করুন।

নাম

অনুবাদ,32,আত্মজীবনী,26,আর্ট-গ্যালারী,1,আলোকচিত্র,1,ই-বুক,7,উৎপলকুমার বসু,23,কবিতা,303,কবিতায় কুড়িগ্রাম,7,কর্মকাণ্ড,14,কার্ল মার্ক্স,1,গল্প,54,ছড়া,1,ছোটগল্প,12,জার্নাল,4,জীবনী,6,দশকথা,24,পাণ্ডুলিপি,10,পুনঃপ্রকাশ,14,পোয়েটিক ফিকশন,1,প্রতিবাদ,1,প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা,4,প্রবন্ধ,152,প্রিন্ট সংখ্যা,4,বর্ষা সংখ্যা,1,বসন্ত,15,বিক্রয়বিভাগ,21,বিবিধ,2,বিবৃতি,1,বিশেষ,23,বুলেটিন,4,বৈশাখ,1,ভাষা-সিরিজ,5,ভিডিও,1,মাসুমুল আলম,35,মুক্তগদ্য,36,মে দিবস,1,যুগপূর্তি,6,রিভিউ,5,লকডাউন,2,শাহেদ শাফায়েত,25,শিশুতোষ,1,সন্দীপ দত্ত,8,সম্পাদকীয়,16,সাক্ষাৎকার,21,সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ,18,সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ,55,সৈয়দ সাখাওয়াৎ,33,স্মৃতিকথা,14,হেমন্ত,1,
ltr
item
বিন্দু | লিটল ম্যাগাজিন: সন্দীপ দত্ত সংখ্যা : বটু কৃষ্ণ হালদার
সন্দীপ দত্ত সংখ্যা : বটু কৃষ্ণ হালদার
https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEiC26jaOwMNAlrswb78eFb4wNEFLHDi8qOvHgv4ps45R4sB7t0QqwCYXgc_gtH1g_AMDw8gdysC2YH-OeIRnAvHl86HYHktwU498Eb6I2Uacf4VKIO_HSTTIIpdBrYbetrmrPJtvmtdg_vYLv8H0Nsr-FfrRGg2WSXdBOcB4TjFoJVzYNtaMjxQVEEtnQw/s16000/sandip-datta-bindu-littlemag-cover.png
https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEiC26jaOwMNAlrswb78eFb4wNEFLHDi8qOvHgv4ps45R4sB7t0QqwCYXgc_gtH1g_AMDw8gdysC2YH-OeIRnAvHl86HYHktwU498Eb6I2Uacf4VKIO_HSTTIIpdBrYbetrmrPJtvmtdg_vYLv8H0Nsr-FfrRGg2WSXdBOcB4TjFoJVzYNtaMjxQVEEtnQw/s72-c/sandip-datta-bindu-littlemag-cover.png
বিন্দু | লিটল ম্যাগাজিন
https://www.bindumag.com/2023/12/botu-krishna-haldar-article-on-sandip-datta.html
https://www.bindumag.com/
https://www.bindumag.com/
https://www.bindumag.com/2023/12/botu-krishna-haldar-article-on-sandip-datta.html
true
121332834233322352
UTF-8
Loaded All Posts Not found any posts আরো Readmore উত্তর Cancel reply মুছুন By নী PAGES POSTS আরো এই লেখাগুলিও পড়ুন... বিষয় ARCHIVE SEARCH সব লেখা কোন রচনায় খুঁজে পাওয়া গেল না নীড় Sunday Monday Tuesday Wednesday Thursday Friday Saturday Sun Mon Tue Wed Thu Fri Sat January February March April May June July August September October November December Jan Feb Mar Apr May Jun Jul Aug Sep Oct Nov Dec just now 1 minute ago $$1$$ minutes ago 1 hour ago $$1$$ hours ago Yesterday $$1$$ days ago $$1$$ weeks ago more than 5 weeks ago Followers Follow THIS PREMIUM CONTENT IS LOCKED STEP 1: Share to a social network STEP 2: Click the link on your social network Copy All Code Select All Code All codes were copied to your clipboard Can not copy the codes / texts, please press [CTRL]+[C] (or CMD+C with Mac) to copy