উৎসর্গ
একাত্তরে শহীদ বিদুষী সৈয়দা ফেরদৌস মহল, অধ্যাপক ওয়াহিদুর রহমান চৌধুরী, নীলু, খোকন এবং জীবিত রইলে স্বাধীনতার সমান বয়সী যুদ্ধে দেড় মাসের নিখোঁজ শিশু; আমার স্বজন ফুপু-ফুপা- বোন- ভাই,— দিনাজপুর শহরে ঘৃণ্য পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও দোসরদের নৃশংস হত্যাযজ্ঞের শিকার।
লোকটা কি করে ওখানে কি করে ওখানে লোকটা ওখানে লোকটা করে কী?
মুখোমুখি হওয়া যাক —
ফোকাসটা…….
জায়গাটা হচ্ছে কিনা খলিফাপাড়া — না, সেই দিন আর নাই; হাওয়া পাল্টেছে।
গায়েব হয়ে গেছে খলিফারা সব; প্রথমে আস্তে আস্তে, পরে একদম।
এখন শুধু ওষুধঅলাদের দোকান –রোগবালাইয়ের দাওয়াই বেচে।হুশ হুশ গাড়ি আসে, ঢাউস গাড়ি ভর্তি ওষুধ– দোকানিরা লুফে নেয় আর কাতরাতে কাতরাতে লোকরা । লোকজনের সুখ নাই কেবলই। আগে তো অসুখ-বিসুখের চিকিৎসা, ফের কিনা কাপড়-চোপড়। গার্মেন্টসের গেঞ্জি আর এন্টাসিড বোতল তিরিশ টাকা, তার বাদে কে বানাবে পোশাক-আশাক। এখন আর বাবু নাই শুধু আছে ফিটিং ফাটিং।
কেমন সুন্দর ধোপদুরস্ত ঝকঝকে বাইক হাকিয়ে ওষুধ বানানেওয়ালাদের প্রতিনিধিরা আসে– ওরা জামা বানায় কোথায়— ওষুধের গুনগান করে। ওষুধ দোকানদারদের মুডের কমতি নাই। দুই পক্ষের মুডে মুডে চলে বেচাকেনা, আর সব শেষে বেচা তো রোগীদের কাছেই! সব মিলিয়ে শাদামাটা সেই খলিফাপাড়া ব্যাপী ওষুধঅলাদের জমাটি কৌলিন্য অধুনা।
এসবের মধ্যেই খাড়া হয়ে আছে— বলাটা বোধ হয় ভুল হবে, মনে হচ্ছে ল্যাঙ খেয়ে হুমড়ি মেরে কাত হয়ে একটা টিনচালা ঘর; সাইনবোর্ডে একদা লেখাজোখা ছিলো-- মুছে মুছে কেবল কাকের পুরিষই টাটকা ছিটকে ছিটকে দাগিয়ে আছে। ঘরটা এক দোকান –মুখে, কাঠের পাল্লা ভাঁজ হয়ে হয়ে দু'পাশে দড়ি দিয়ে আটকানো, খুলে যেন যায় না! ঘরে কি-ইবা আছে –সব দোকানে স্টিল শার্টার –কাঠের ভাঙ্গাচোরা পাল্লায় দশাসই তালা রাতে লটকানো থাকলেও ওটা বাদ দিয়েই না হাত লাগিয়েই ভাঙ্গতে কসুর হওয়া ছ্যাচড়া চোরদের জন্য অপরাধ হবে।
দোকান ঘরে সম্পত্তি.... হুঁ, ঝাপসা.... দেখা যাচ্ছে না, ভেতরটা অন্ধকার জ্বলে গেছে টিমটিমে যে ষাট ও চল্লিশ পাওয়ারের দু'টো বাতি ছিলো ১২'×১২' ঘরে তার মধ্যে একটি— দিন কতক হলো কেনা হয়ে ওঠেনি।
চল্লিশ পাওয়ারে মিটমিটে একেবারে আলো-- সঙ্গে ছায়ার জোরালো উপস্থিতি এখন রাতে, তবে কারেন্ট চার্জ বলে কথা, দিনে জ্বালানো হয় না বাতির আলো। পাল্লা খোলা থাকায় যা আলো আসে আল্লার পাঠানো তাই নিয়ে কাজবাজ।
আবিষ্কার করা গেল যে দোকানের ভেতরে সম্পত্তি এই রকম –
ঘুট ঘুট ঘুট ঘুট করে চালানো পায়ের জোড়ে চালানো সেলাই কল আছে একটা। কাজ হাতে জুটলে সচল নয়তো নিস্তব্ধতা সচরাচর– তবু এমনই যে কেউ দু'দণ্ড দাঁড়ালে, থম মারা সেলাই যন্ত্রটার দিকে তাকিয়ে থাকলেও কানে যেন বাজতেই থাকবে শব্দ ঘুট ঘুট ঘুট ঘুট ঘুট......, হ্যাঁ, আজও পুরনো দিনের লোকেরা লুপ্ত অথচ ডাকে চালু খলিফাপট্টি দিয়ে সারি সারি দু'পাশের সাজানো দোকানগুলোর পাশ মাড়িয়ে যেতে যেতে শুনতে পাবেই ভ্রমরের মতো শব্দ:খোঁচানো –ঘুট ঘুট ঘুট...... -।
সেলাই করতে গেলেই এটা হবে আর তখন উপড়ে সুতো বের করে এনে আবার একই কাজে সময় খাটানো। হাত কাঁপলেই ছ্যাড়াব্যাড়া আর তখন সেলাই ফোঁড়াই করা আকারটা হয়ে ওঠে ঠিক যে বাংলার বর্ডার।
বাংলাদেশের 'ম্যাপ যাহা মানচিত্র' অংকন করার ঘটনা প্রবাহে তার, আবুল হুসেনেরও এক ভূমিকা ছিলো:সেই কথায় পরে যাওয়া যাবে।
ফোকাসটা......
দোকানঘর ও ভেতরকার যাবতীয় সম্পত্তির মালিক বলতে আবুল হুসেন – অতএব সম্পত্তির মালিকের সঙ্গে পরিচয় ঘটে গেল তা'হলে।
ঠিক আছে!
চলবে .....
খলিফাপট্টি হ'তে একে একে আসল মানুষজন বিদায় এখনও তবু একলব্য বলতে আবুল হুসেন।তবে কিছু কিছু জিনিস ঐ দোকানঘরে ঢুকে গেছে– আশেপাশে দোকানপাট ওষুধের পশরা সাজিয়েছে না,তাই –যদিও এখানে পা মাড়ায় কমই লোক এই দোকানঘরে।
একটি রয়েছে দাবী করলে বলা যায় যে–স্টেথোস্কোপ! ভাঙা ও অকেজো– চাকতির মধ্যে শাদা যে পর্দাটা ঢ্যাপ করে বেজে সংকেত পাঠায় সেটা ফাঁটা ঠিক চোখের চশমার কাঁচের মতো ক্রুশের মতো কাগজে আঠা লাগিয়ে সেটে জোড়া লাগানো হয়েছে যেখানে যেভাবে।
স্টেথো ঝুলতে ঝুলতে গলায় আর চশমা নাকের গায়ে দাগ ফেলে দাগী করে দিয়েছে আবুল হুসেনকে।
একবার হয়েছে কি আবুল হুসেন অনেকক্ষণ ধরে হোঃ হোঃ হোঃ হোঃ করে হাসতে লাগলো। কোথায় মার ফায়ার হবে তা না, সকলে তো ভয়ে অস্থির যারা তাকে চেনে! কে যেন এক উদীয়মান ডাক্তার নাকি বলেছে আবুল হুসেনের স্টেথো নষ্ট, কাজ করে না, খারাপ জিনিস।
আবুল হুসেনের স্টেথোস্কোপ রাখার প্রয়োজন হয় না, নিছক সৌজন্য দেখিয়েই বাগিয়ে রাখা। এমনিতেই সে সব বলে দিতে পারে: কার হার্টবিট বেশি—কম, লাংস নরমাল ইনফেকশন এইসব। যে লোকটি খারাপ মানুষ স্টেথোস্কোপগুলো কি তথ্য সরবরাহ করে কখনো?--সে তো পারে নিজের স্টেথোতে বেশ। মিলিয়ে দেখতে চাইলে মিলেও যায়। এমন ঘটেছেও অনেক। কিছু লোক ভালো মানুষ ছাড়া অন্য কেউ না এমন তো আসে তার কাছে বইকি! অনেককাল ধরে বাঁচছে এই মানুষগুলো। ৭০/৮০র নিচে কেউ নাই। খলিফাপট্টির আজকালকার অদলবদল সকলেরই চাক্ষুস– হেঁটে হেঁটে যেতে যেতে ঐ যে ঘুট ঘুট ঘুট ঘুট বাজতে থাকা অশ্রুত শব্দ কানে তাদের ঠিকই যায় যেমন তাদের শরীরের কলকব্জার অবস্থা জেনে যায় ঠিকই আবুল হুসেন। আবুল হুসেনের স্টেথো কাজ করে কাটায় কাটায় মোক্ষম!
দোকানঘরের কোণায় আছে, কোনো কাঁচ ভাঙ্গা নাই– এই নিয়ে আলমারিটা, চারটা পায়ার একখানা মচকানো বলে ন্যাংড়া। আলমারির তাকে থরে থরে সাজানো ওষুধ।
ফোকাস….
ওষুধ, কম্প্রোমাইজ! সেলাই মেশিনটা দোটানা....... ;আচ্ছা চলুক!
এই যে ওষুধ, কি যে ওষুধ, কে যে সাপ্লাই দিয়েছে জানে না কোন জন!
বড় বড় কোম্পানীর ওষুধের রিপ্রেজেন্টেটিভরা আসে না কেউ — এই দোকানঘরের দুয়ারে। ভটভটিয়ে চলে যায় এধার-ওধার।
ওষুধ কোম্পানীর লোকেরা তাকে পাগল ভাবলে কি হবে, আবুল হুসেন কখনোই ছেড়ে কথা বলে না।
যে লোকটা পিশাচ,
পৈশাচিকতার বিরুদ্ধে কার্যকর ওষুধ নাই কোনো।
যে লোকটা অসৎ
অসততার ক্ষেত্রে ক্রিয়াশীল ওষুধ নাই কোনো
যে লোকটা রাজাকার
খুনের বিপরীতে ওষুধ নাই কোনো।
যে লোকটা পাপী,
হেদায়েত করার জন্য ওষুধ নাই কোনো।
যে লোকটা ভালো
টিকে থাকবার ওষুধ নাই কোনো।
আবুল হুসেন মুগ্ধ চোখে আলমারিতে থরে থরে সাজিয়ে রাখা ওষুধের দিকে তাকিয়ে অপলক থাকে শুধু। নাই, কোন ক্রেতা নাই কোনো!পৈশাচিকতা, অসততা, গণহত্যার কৃতি, পাপ, নষ্টামি উপাধি লাভ করেছে আজ - - আবুল হুসেন চিবুকে হাত রেখে ভাবতে ভাবতে কাটায় সময়ের সমুদ্র......., পার করে চিন্তার জটাজালে ভ্রু কুঞ্চিত।
আবুল হুসেনের শরীরে রোগ মুসিবত নাই কোনো। সকাল দশটায় দোকান খুলে বন্ধ করে আটটা নাগাদ রাতে, কোনো দিন দেরীও ঘটে; বাদ যায় দুপুর সময়– ঘণ্টা দুই। এইতো রুটিন আর সংসারে আছে বলতে জমির। দোকানে যায় আর ফিরে যখন, হাতে দুই আঙ্গুলে কোনো মতে ঝুলিয়ে রাখে এক টুকরা বিস্কুট, যা দেখে পিছে পিছে অনুসরণ করে জমিরও চলে, থাকে সঙ্গে সঙ্গে আবার ফিরেও যায়। জমিরের অনুসরণপর্ব ও আবুল হুসেনের চলাচল অদ্ভুত দ্যোতনাময় ।
গাধার নাকের ডগায় ঝুলন্ত মুলার মতো– এই গল্পটা সকলেই করে যে, একদা স্বাধীনতার পর পর জনতার সঙ্গে মিশে যাওয়া রাজাকার নেতা জমিরকে চা-পানি আর কি বিস্কুট টোপ ঝুলিয়ে ঘরে এনে থুথু মারে আবুল হুসেন। পরে কুকুর পুষে নাম রাখে জমির।
আবুল হুসেন এখন আর ক্ষিপ্র নাই। সে শুধু হাসে আর দেখে যায় শুধু দেখে যায়।
একদা আবুল হুসেন ছিলো ক্ষিপ্র, তখন ১৯৭১। অথচ লোকমুখে এখনও কত কথা ঘুরে ফেরে।যেমন–
বেঁচে আছে শহীদ এখনও, সাক্ষী দিতে পারবে। গুলি এসে লেগেছিল তার হাতে, সেই জুলাই ৭১এ।
বন্দুকের নল গরম হয়ে যায়, গুলি নিক্ষিপ্ত হলে— অনেকে বলে যে, পাঁক খেতে খেতে সজোরে ছোটে জান কামড়াতে; হয়তো মেশিনগান-স্টেনগান এসএল আর-শর্টগান কি থ্রি নট থ্রি-র ডগা হ'তে ছুটন্ত ঐ বুলেট তাজা রক্ত ফিনকিয়ে দেয় যখন ঘাই মারে শহীদের শরীরে, পেশল বাহুতে।
আহত শহীদ চ্যাংদোলা হয়ে আনীত হয় আবুল হুসেনের নিকট। চারিদিকে পাক মিলিটারীর ঘেরাও –যোদ্ধারা পালায় পরে আরও বড় করে যুদ্ধ করার জন্য।
টুপ টুপ করে রক্ত ঝরছিল অচেতন শহীদের শরীর নিংড়িয়ে; আবুল হুসেনরা দিশেহারা: গুলির ঘায়ে শহীদের ফেঁড়ে যাওয়া চামড়া আটকানো দরকার– রক্ত বন্ধ করা গেলে বাঁচিয়ে রাখা যাবে হয়তো!
হাফ ডাক্তার মতো ছিলো একজন; এলাহী ভরসা! মানুষের শরীরে ছুরি-কাঁচি ধরেনি – সে-ই তখন সার্জন।
ঘরে হাজির সকলে আরেক যুদ্ধে ব্যস্ত; হারিকেনের আলোতে তাদের ছায়া ছায়া নড়াচড়া –অবিরত দোয়া-দরূদ পড়া হচ্ছে, শহীদ বেঁচে উঠুক। যুদ্ধতো সকলেরই।
শেষ পর্যন্ত সুঁই-সুতো নিয়ে বসে আবুল হুসেন; তার রয়েছে গজের পর গজ, হিসাব নাই, কাপড় সেলাই করার জ্ঞান। এবার এই মানুষের চামড়ায় প্রথম সেলাই-- আল্লাহর মাপ নিয়ে বানানো শরীর জুড়ে মুড়ে থাকা চামড়ার গায়ে, সুইয়ে সুতো পরিয়ে ফোঁড়াই কর্ম: আবুল হুসেন, কেউ শুনতে না পেলেও, নিজ কানে কচ কচ কচ কচ চামড়া ফোঁড়াইয়ের অশ্রুত আওয়াজ চিনেছিল। শরীর বেয়ে আবুল হুসেনের যত ঘাম এক জন্মে যা হয়নি ঝরেছিল শুধু। শেষ, কুট করে দাঁত দিয়ে সুতোটা ছিঁড়তে পেরেছিল, হাত কাঁপেনি। টলে যায়নি সে!
শহীদ বাঁচে তারপর, যুদ্ধও করে।
কিছুই না কোনো ওষুধ নয়, আবুল হুসেন সুই-সুতোর সেলাইয়ে বাচিয়েছিল মানুষ। জীবন চলকে উঠেছিল আবুল হুসেনের হাতে!
পরে, আবুল হুসেন জামা বানাতে কখনো মগ্নতাকে তীব্র করতেই স্মৃতি... হাত কাঁপে বৃদ্ধ শরীরের আর বাংলার বর্ডারের মতো হয়ে যায় সুতোর দাগের সেলাই: আবুল হুসেন বাংলাদেশের মানচিত্র আঁকতে পেরেছিল বইকি। এইভাবে.....
আবুল হুসেনের মানচিত্রটা আঁকতে রঙ-পেন্সিল বারুদ লাগেনি, যথেষ্ট ছিলো সুতো সুই।
………….
আবুল হুসেন, ঘুমে কিংবা ঝিমুনি আচ্ছন্ন নিয়মিত এক সুশৃঙ্খল স্বপ্ন দেখে:
এই যে চারপাশে সব কিছু ভেঙ্গেচুড়ে যাচ্ছে ধ্বসে যাচ্ছে পড়ে যাচ্ছে টুটে যাচ্ছে ফাটল ধরছে ক্ষয় হচ্ছে– তাই সে যেন সুই-সুতো মেশিন চালিয়ে সচল; এই টুটা ফাঁটা সব,--বিভক্ত বাংলা মিলাতে, জোড়া লাগাতে প্রাণপণ সচেষ্ট! সব যেন হয় ঐক্য!
আর তাতেই, রাত বা ভর দুপুরে খলিফাপাড়ায় কান পাতলে প্রাচীন মানুষজন শোনে নিরন্তর সেলাই মেশিন নিঃসৃত ঘুট ঘুট ঘুট ঘুট আজব ধ্বনি ন্যাস।
না..... এবার আর ফোকাস স্থির করা যাচ্ছে না কোন কিছুতে….
দীর্ঘজীবী হোক আবুল হুসেন
সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ
সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ
মন্তব্য