.header-button .inner > span { font-size: 18px !important; } .header-button .inner i.fa { font-size: 40px !important; } .comment-form-message { background-color: #f4f4f4 !important; font-size: 14px !important; }

পাঠকের মুখোমুখি সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ

[এটি গতানুগতিক সাক্ষাৎকার ছিলো না। পাঠক কী ভাবছেন, তাদের মনের জিজ্ঞাসা- এসবকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট প্রশ্ন সংগ্রহ করে লেখকের অনুভূতি-ভাবনা, জবাব নেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। বিভিন্ন এলাকা থেকে সংগৃহীত এই সব প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ। যারা প্রশ্ন করেছেন তাদের নামগুলো শেষে সংযুক্ত করা হলো।]

লেখকের কথা...লেখকের বৈশিষ্ট্য...কী ঘটে লিখনে?
উত্তরঃ
কঠিন প্রশ্ন। আমার মতো করে উত্তর দেই। একজন লেখক ভেবে ভেবে নিজেকে অতিক্রম করে। একজন লেখককে একেকটা গল্পে নির্মাণ করতে হয় একেকটা জগৎ। সেই জগতের মধ্যে সে গল্পের চরিত্রদের স্থাপন করে। সেই চরিত্রদের সৃষ্টি করতে হয় তাকে।
বিষয় অনুযায়ী গল্পের আঙ্গিক, ভাষার আঙ্গিক তাকে নির্মাণ করতে হয়। তার সঙ্গে জড়িয়ে নিতে হয় বহু অনুষঙ্গ, প্রসঙ্গ। কখনো একটা আঙ্গিকই হয়ে ওঠে আবার তার বিষয়বস্তু। গল্পকারকে কখনো সৃষ্টি করতে হয় আয়না যেখানে অজস্র প্রতিফলন আর অজস্র বিকীরণ ঘটে থাকে।
আরেকটা গল্প সে রচনা করে যখন, তখন আবার সৃজন করে নতুন জগৎ, নতুন চরিত্র, নতুন সূত্র, নতুন প্রণালী।
সে নিজে থাকে এক বাস্তবতা ও দর্শনের মধ্যে কিন্তু গল্প তাকে নিয়ে যায় আরেকটা বাস্তবতায়, আরেকটা দর্শন আরেকটা নির্মাণের দিকে। হয়তো সেই ঘটনা সে দেখেনি, কিন্তু গল্প লিখতে লিখতে নিজেকেও সে দেখতে পাচ্ছে তাতে (সেই ঘটমান বাস্তবতায়) যা তার নিজের রচিত । কি করবে সে? ভারী দুরূহ তার কাজ।
আমার ‘জননীর জন্য গল্প ও লেখকের হত্যাকান্ডে’র অংশ বিশেষ (দশম অধ্যায়ের) পাঠ করি, আসলে চরিত্রের কন্ঠস্বরে প্রতিধ্বনিত হয় লেখক আরেকবার, চিৎকার করে লেখক, নম্র হয় লেখক, ভালোবাসা দেয় লেখক, জ্যোৎস্নার নিচে সাপ নিয়ে খেলা করে লেখক, হাভাতে মানুষের ভাঙাচোরা মুখের দিকে ফিরে ফিরে তাকায় লেখক, নিজের মধ্যে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে লেখক, মাতৃস্তনের দুগ্ধধারার মতো লেখকের ঝরণাধারা এঁকে বেঁকে  তৈরি করে মানুষ- মানচিত্র, রাষ্ট্র-স্বপ্ন, জাতি- স্বপ্ন। ব্যক্তির অস্তিত্বের অনেকাংশ রহস্যময়, লেখকের লেখা ভেদ করে রহস্য। লেখকই পারে প্রতিটা উচ্চারণ পুনরায় শোনাতে, পুনরাবৃত্তি করতে, না কোনো ইন্দ্রজাল নয়, লেখকই পারে আরেকবার ঘনঘোর তৈরি করতে, সম্মোহন করতে এবং রচনা করতে পারে আরেকটি সংহিতা।
লেখকই পারে আরেকবার দৃশ্যপট রচনা, যে দৃশ্য আদৌ দেখে নাই কোনোদিন তবুও কী রকম জ্যান্ত সম্মুখে; এখন অতঃপর লেখকেরই পাশে লোবানের গন্ধ ওড়ে, কর্পুরের গন্ধ লেখককে টান মারে অকস্মাৎ তীব্র।
লেখকই কেবল হতে পারে শেষ পর্যন্ত চিকিৎসক, মৃত্যুর ব্যাখ্যাকার, ভাষ্যকার, লেখককে আঘাত করতে পারে স্বপ্ন কিংবা প্রলয়, স্বপ্নকে বাস্তব দিয়ে গুণন করে লেখক, বাস্তব প্রলম্বিত হয়, সুদূর আর নির্জন আর একা লেখক ছাড়া কেউ হতে পারে না কেননা তার সমস্ত সুখ উপড়ে গিয়ে কঙ্কালের মুখ উঁকি দেয় যখন ভ্রমণ করে লেখক, চারিদিকে কেউ নাই শুধু মৃত আব্বাকে দেখতে পায় লেখক। 
লেখক হেঁটে যাবে রোদ্রে–কালো পিচের রাস্তা গলে যাবে, বৃষ্টিতে ভিজে যাবে, রুদ্র বাতাসে ইলেক্ট্রিকের তার ছিঁড়ে পড়ে থাকবে এবং লেখকই কেবল দীপ্রময় হেঁটে যাবে; শব্দহীন সড়কপথে লেখকের পর্যটন এইভাবে চলে...
শেষ পর্যন্ত একজন লেখক অস্তিত্বের সঙ্গে ভীষণ সংঘর্ষে লিপ্ত হয়; নিজের যে দুইটা চোখ সম্মুখে দেখার জন্য অদম্য কেবল, অথচ নিশানা করে নিজের বরাবর, ততক্ষণাৎ এবং অস্তিত্বমূলে প্রবেশের পর শ্রবণ করে সে, অস্তিত্বের এক তীব্র অপর কণ্ঠস্বর– আলো ও আঁধার সম্মুখে সঘন হয়; 
লেখকের অস্তিত্ব হয়ে ওঠে নিকষভাবে নিজের কাছে ততক্ষণে এক জ্যান্ত শ্রূতি-অবলোকন অভিঘাত.....
শরীরের মধ্যে অবিরাম এক বাজনা; অজস্র করতালি রক্তের মধ্যে, হৃদয়ে কান্না ও তৃষ্ণা, এইভাবে শুধু শব্দহীন শব্দ, দৃশ্যহীন অদৃশ্য...যখন নিমজ্জিত সে, ডুব সাঁতারে গ্রহণ করে যেটুকু প্রশ্বাস হয় তার জন্য একমাত্র প্রয়োজন–কেবলি বিন্যাস আর তবু নির্মাণ; শব্দের ভেতর সংগীতকে, শূন্যতার ভেতর উপস্থিতিকে, নিমজ্জনের ভেতর নিশানাটিকে আবিস্কারের অদম্য সংগ্রামে, আয়োজনে মাটি ও আকাশ অভিমুখে রিক্তের যাত্রায় জেগে ওঠে লেখক।
লেখককে হতে হয় মনস্তত্ববিদ। তার থাকা দরকার তৃতীয় নয়ন। সমাজ-রাজনীতি-অর্থনীতি-সত্তার শিকড়, দেখবার জন্য চোখ কোনো কিছু বাদ দিতে পারবে না সে। পর্যবেক্ষণ ও কল্পনা শক্তি, পশু শ্রম একটা ভালো গল্প লেখার জন্য কখনো জরুরি।
গল্পলেখক হওয়ার আরেকটা ফর্মূলা আছে। Networking সৃষ্টি। Nucleus-এর সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ, পরস্পর স্বার্থনির্ভরতা,......এই প্রকার Communication,Selective communicational   সার্টিফিকেট নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়া। চাতুর্যের সঙ্গে Nucleusকে দিয়ে নিজের কথা বলানো এবং অন্যদের লেখার সঙ্গে তাদের পরিচিত হতে না দিয়ে সাহিত্যিক হিসেবে নিজের আসনটা পাকা করা, পোক্ত করা।
এরা হচ্ছে যোগাযোগ কেন্দ্রিক। যোগাযোগ তাদের লেখার মূলসূত্র। তাদের আর কোনো গুণাবলী না থাকলেও চলবে। 

জীবনের সাথে বাস্তবতার দ্বন্দ্ব, লেখক সত্তার সাথে তার গল্প বা থীম, ফর্ম সম্পর্কে?  
উত্তর :
জীবন ও বাস্তবতার সঙ্গে লেখক সত্তার দ্বন্দ্ব চিরকালীন। এই দ্বন্দ্ব না থাকলে হয়তো লেখা যায় না। একজন Perfect  মানুষ কখনো লেখক হতে পারে না। সে যে জীবনযাপন করে তা সে বিশ্বাস করে না। যে গল্প লেখে তার জীবন যাপন দেখার পর তার গল্পকে বানোয়াট মনে হতে পারে।
লেখক যা লেখে তা কখনো বানানো। এখানে লেখককে মিথ্যুক বলা যায়। কিন্তু তার লেখার বিষয় কতখানি মিথ্যা অথবা সত্য? সত্য নিয়ে গল্প হয় নাকি গল্পের মধ্য থেকে সত্য বেরিয়ে আসে?
লেখককে প্রতিনিয়ত নিজের সঙ্গে যুদ্ধে জড়াতে হয়। যার কোনো ক্রাইসিস নাই সে কোনো লেখক না। মানুষও না। টাকা না থাকলেই ক্রাইস বলা যাবে না। লেখকের মধ্যে নিরন্তর এক স্ট্রাগল থাকে।
সবাই টাকা দিয়ে বিচার করে। কেনা ফ্ল্যাট দিয়ে বিচার করে। গাড়ি আছে কিনা তাই দিয়ে বিচার করে। সে মদ্যপান করে কিনা তা বিচার করে। সে উপভোগ করছে কিনা তা বিচার করে না। সে এসব নিয়ে গর্ববোধ করে কিনা তা বিচার করে না। এগুলো তার একমাত্র পরিচয় কিনা তা বিচার করে না। তার ভিতরে কেন, কীভাবে রক্তক্ষরণ হচ্ছে, তা বিচার করে না। সে কেন মদ্যপান করে তা বিচার করে না।
বিভিন্ন প্রকার সংঘর্ষ ও মোকাবেলার মধ্য দিয়ে গল্প একটা তৈরি হতে পারে। তার গল্প তখন অন্যরকম হতে থাকে। থীম চেনা মনে হয় না। ফর্ম পাল্টে যায়। তারপর তার গল্পের বিষয়-বস্তু, ভাষা, ফর্ম একসূত্রে গাঁথা হয় যখন, তখন কারো কাছে পরীক্ষামূলক গল্প বলে প্রতিভাত হলেও দেখা যায় গল্পটা আসলে এরকমই। অন্যভাবে গল্পটা লেখা যেত না।
আপনি কোনো Network -এ জড়িত থাকতে না পারলে সবদিক ঘুটঘুটে।

আপনার লেখার মৌলিকত্ব ...শিল্পমান ...নতুন প্রজন্মের  লেখক . . .অনুপ্রেরণা ... ?
উত্তর :
একক ভূমিকার চেয়ে মুখ্য হলো লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনে সম্মিলিত মৌলিক ও শিল্পগুণ সম্পন্ন লেখার উচ্ছ্বাস এক ধরনের তরঙ্গ সৃষ্টি করেছে।
নিজের একক ভূমিকা সম্পর্কে বলা সমীচিন হবে না ।
লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনে যে গল্পকারদের অংশগ্রহণ ছিল, ... কোনো ইস্তেহার রচনা করে গল্প লিখি নাই–কিন্তু আমাদের লেখা পাঠ করলে আপনি অবশ্যই গল্প আন্দোলন, লিটল ম্যাগাজিন, একটা ইস্তেহার তৈরি করে ফেলতে পারবেন।

একক ভূমিকার কথা বাদ দিয়ে বলি আশির দশকে যারা গল্প লিখেছিলাম সেই সকল গল্পের শৈলী ও ঐক্য স্বাধীনতা -উত্তর বাংলা কথা সাহিত্যের ভিত্তি ...বুনিয়াদ রচনা করেছে। আশি-উত্তর গল্প পাঠ করলে তাদের লেখায় এই ভিত্তির আবহ পাবেন।
মনে রাখবেন সৃজনশীল মস্তিস্কের কাজই হলো কোনো কাজ, পরিস্থিতি বা পরিণতিকে নিবিড় বিশ্লেষণ করে দেখা।
অবশ্য আমাদের আলোচক -সমালোচক নামধারীরা তা থেকে অনেক দূরে। ২০০৬ সালে আমার ৪টি বই বের হলো। ‘জননীর জন্য গল্প ও লেখকের হত্যাকান্ড’, ‘গল্প অন্যান্য ও ছবি লেখা’, ‘রক্ত অনুষঙ্গ’ এবং ‘কুফা ভাইয়ের কুফাগিরি’। কোনো গ্রন্থের আর কোনো আলোচনা নাই। শুধু আলোচনা পাওয়া গেল ‘রক্ত অনুষঙ্গ’ নিয়ে। ঐ গ্রন্থের ‘লিটল ম্যাগাজিন প্রসঙ্গে যা বলা দরকার মনে করি’ প্রবন্ধটা এমনই কারো কারো গাত্রদাহ সৃষ্টি করল যে, ঐ বইটাকে একেবারে তুলোধুনো করা শুরু হলো। 
বুদ্ধদেব বসুর আলোচনা পড়ে আমরা শার্ল বদলেয়ারকে চিনেছিলাম। এখন তেমন সমালোচক–কোথায় পাব তারে? সবাই আছে  Charged   হয়ে।
সমালোচনা সাহিত্যের কোনো মূল্য আজকাল আর কেউ খুঁজে পাবেন না। ভুল ধারণা ছাড়া। ভুল বিশ্লেষণ ছাড়া কিছু পাবেন না। আর পাবেন গড্ডলিকা প্রবাহে পরস্পর আঁতাতের মধ্য দিয়ে স্ফূর্তিমান কিছু প্রশংসাধ্বনি, জয়গান। এর বাইরে যারা Network -এর মধ্যে নাই তাদের জন্য পরিকল্পিত নিন্দাধ্বনি পাবেন।
কখনো দেখা যায় একজনকে নিয়ে খুব মাতামাতি চলল। কিন্তু যারা Network- এর মধ্যে নাই তাদের জন্য পরিকল্পিত নিন্দাধ্বনি।Network-এর কাছে পান থেকে চুন খসলে শুরু হয়ে গেল তার বিরুদ্ধে শব্দ ধোলাই।
আমি যখন একটি প্রবন্ধ লিখি, একটি গল্প লিখি তখন আমার মাথার ভিতরে জমে থাকা বিভিন্ন প্রকার পূর্বপাঠ, বিভিন্ন লেখার অংশ বিশেষ, কাটিং, বিভিন্ন উৎসের তথ্য স্রোত, ভালোলাগা-মন্দলাগা, পছন্দের বাক্য, কোনো লেখকের উচ্ছ্বাস, বিভিন্ন কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ, অনুভূতির স্বরক্ষেপ হুড়মুড় করে ঢুকে যায়, মিশে যায়, মিথষ্ক্রিয়া ঘটায়–মিউজিকে যেমন East meets west হচ্ছে, Fusion হচ্ছে , Remake হচ্ছে, তেমনি কখনো আমার লেখায় আমি আবিস্কার করি Fusionধর্মীতা। আমি বলছি Fusion, কিন্তু মনে মনে বলি এসব আমার Confusion । আমার লেখায়, আমার মনের এই Confusion -ই হচ্ছে মৌলিকত্ব। 

আপনার লেখার স্ববিরোধিতা সম্পর্কে ... 
উত্তর :
লেখকের মধ্যে, লেখার মধ্যে স্ববিরোধিতা থাকবে কিন্তু তা যেন ঐ অজুহাতে আমাকে কোনো রকম ফায়দা ওঠাতে কাজ করে এমন যেন না হয়।
মানুষ আসলে একটা লেখাই লিখে হয়তো সারা জীবন। সে একটা লেখার ধারণা থেকে, তার বক্তব্য থেকে, তার উদ্দেশ্য থেকে, তার ভুল থেকে, তার নিজস্বতা থেকে, তার মৌলিকত্ব থেকে, তার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে, তার দর্শন থেকে—এভাবে হয়তো পরের লেখায় আবার সে নিজেকে নতুন করে নতুন ভাবে তুলে ধরে।
এটাকে তার উল্লম্ফন বলা যাবে না, বলা যাবে না স্ববিরোধীতা। সৃজন ক্রিয়ার সময় এরকম ঘটে থাকে।
সৃষ্টিশীলতার মধ্যে কতো স্ববিরোধিতা উৎপাত করে। লেখক যখন নৈর্ব্যাক্তিক, সে তো কোনো পক্ষ নিতে পারে না। একবার যা পক্ষের, পরে তা বিপক্ষের, আবার পক্ষের।
লেখকের লেখা তো আগুন দিয়ে পোড়ানো কোনো টেরাকোটা নয়, শত বৎসর একই রকম থাকবে বরং বলা যায় আগুন, যাকে পোড়াচ্ছে সে পুড়ে যাচ্ছে আবার পুড়িয়ে যাওয়ার জন্যও সে কাঁদছে। আর নিজে তো সে দগ্ধীভূত। আসলে প্রেমের প্যানপ্যানানি, ঈদ সংখ্যার অপন্যাস পড়লে আমার কথা বোঝা যাবে না।

আপনার লেখা রক্ত অনুষঙ্গ নিয়ে ব্যক্তিগত অনুভূতি...?
উত্তর:
তখন আমার তিনটি গল্পের বই প্রকাশিত হয়েছে। প্রকাশিত হয়ে গেছে ‘আগুনের বিপদ আপদ’ (১৯৯৪), ‘শাদা কাহিনী’ (১৯৯৬), মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক গল্প গ্রন্থ ‘লাশ নাই’ (১৯৯৯)। এছাড়াও আমাদের স্বাধীনতার ২৫ বৎসর পূর্তি উপলক্ষে প্রকাশিত হয়েছে একটি গল্পের বুলেটিন ‘দীর্ঘজীবী হোক আবুল হুসেন’।
লিটল ম্যাগাজিন ‘অনিন্দ্য’র সম্পাদক হাবিব ওয়াহিদ ১৯৮৮ সালে আখতারুজ্জামান ইলিয়াস স্যারের উপন্যাস ‘চিলেকোঠার সেপাই’এর উপর আলোচনা ‘চিলেকোঠার সেপাই পাঠের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া’ লিখিয়ে নেয়। সেটা ছিল তার প্রেরণায় আমার প্রথম প্রবন্ধ লেখার প্রচেষ্টা যা পরে আখাতারুজ্জামান ইলিয়াসের উপর একটি পত্রিকায় তাঁর জীবদ্দশায় নিবেদিত একটি সংখ্যা পুনরায় প্রকাশিত হয়।
পরে হাবিব ওয়াহিদের প্ররোচনায় আমি আরেকটি প্রবন্ধ লিখি ‘লিটল ম্যাগাজিন প্রসঙ্গে যা বলা দরকার মনে করি’ যা ‘অনিন্দ্য’-- মার্চ ১৯৯৩ সালে প্রকাশিত হয়। এর আগে বাংলাদেশ প্রেক্ষিতে লিটল ম্যাগাজিনের উপর আর কোনো লেখা আর কেউ চিন্তা করে নাই।  হাবিবের চাপে-তাপে আমি লিখি, তা নাহলে হয়তো আমিও লিখতাম না এবং অধরা থেকে যেত।
লিটল ম্যাগাজিন ‘গান্ডীব’--এর সম্পাদক  তপন বড়ুয়া আমাকে তার পত্রিকার জন্য ‘রক্ত অনুষঙ্গ’ নামের আমার তৃতীয় লেখা এই প্রবন্ধের উৎস বাৎলে দেয়। সেটা ১৯৯৯ এর শেষ দিক। তিনি আমাকে আল মাহমুদের ‘পানকৌড়ির রক্ত’ ও কমল কুমার মজুমদারের ‘নিম অন্নপুর্ণা’ যে প্রসঙ্গে ব্যবহৃত হয়েছে সে ব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষণ করে ঋতুমতী নারীর রক্তের প্রেক্ষাপটে, একটি অলিখিত খুন বিদ্ধ রক্তের রহস্যময় একটি প্রবন্ধ তৈরি করতে বলেন। আমি আল মাহমুদ ও কমল মজুমদারের গল্পের উন্মোচন করতে করতে অনেক তথ্য সহায়তা নিয়ে  তপন    বড়ুয়ার সঙ্গে দীর্ঘ-দীর্ঘ আলোচনা, তর্ক-বিতর্কের মধ্য দিয়ে এই প্রবন্ধটা লিখেছিলাম।
এই প্রবন্ধগুলো রচনার মধ্য দিয়ে গবেষণাধর্মী লেখার সূত্রপাত হয় আমার। আমি বিজ্ঞানের ছাত্র কিন্তু প্রবন্ধ লিখতে লিখতে আমি নিজের মধ্যে অন্য একটা উন্মোচন খুঁজে পাই।
রজঃপাত নারীর এক অনিবার্য শারীরবৃত্তিক ক্রিয়া। আমার মনে হয় তা যেন ঊর্বরা শস্যক্ষেতের পলিমাটির সঙ্গে তুলনীয়। লেখাটি, লিখতে লিখতে আমি আমার মাতৃদ্বার প্রত্যক্ষ করেছি।
‘ওমা তোমার পাছার কাছে রক্ত’ ‘কি অসভ্যতা কর এদের সামনে, জান না কিসের রক্ত’, আমি কমলের গল্পের ক্যারেক্টার প্রীতিলতা ও ব্রজর কথা কতোদিন নিজ কানে শুনেছি।

যুদ্ধকে আপনি কীভাবে দেখেন? আপনার ‘লাশ নাই’ গ্রন্থের মূল কাহিনীর সূত্রমুখটি লুকিয়ে আছে আপনার পারিবারিক যন্ত্রণাদগ্ধ একটি ঘটনার ভেতর। সংক্ষেপে বলবেন কী?
উত্তর :
যুদ্ধ হচ্ছে সভ্যতা বিরোধী এক বর্বরতা। যুদ্ধ কখনোই কল্যাণকর হয় না। যুদ্ধের মধ্যে অন্তঃশীল থাকে মানবিক বিপর্যয়। প্রথম ও দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ, ভিয়েতনাম, বাংলাদেশ, প্যালেস্টাইন- সর্বত্র একই রকম।
যুদ্ধ ও মানবিক বিপর্যয়ের অন্যতম হোতা মার্কিন যুক্তরাষ্ট। আমেরিকার ভাষায় বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠা করতে হলে গণহত্যা ও ধ্বংসলীলার কোনো তুলনা হয় না। 
কবরের শান্তির চেয়ে আর কোনো শান্তি হয় না যেন। বিজ্ঞানের আবিস্কার ছিল মানুষের জন্য। মানুষের দ্বারা সৃষ্ট। কিন্তু তাতে যোগ হলো মানুষ খুনের আদিম নেশা। একদিকে যখন মঙ্গলগ্রহে প্রাণ আবিস্কারের জন্য মানুষ কাজ করছে, বিজ্ঞান তৎপর, তখনই আবার এই গ্রহে জাতি -হত্যা, রাষ্ট্র -হত্যা করার উন্মত্ততায় নতুন নতুন অস্ত্র আবিস্কারের নেশায় উন্মত্ত সভ্য জগৎ। মানুষ মারার হাতিয়ার তৈরি বা ক্রয়ের জন্য বাৎসরিক বাজেটের সবচেয়ে বড়ো অংশটা ব্যয় করা হচ্ছে আরেকজনকে মেরে নিজেকে নিরাপদ রাখার জন্য। এর বিপরীতে জাতিসংঘ, মানবাধিকার, রেড ক্রিসেন্ট, পরিবেশবাদী আন্দোলন সব কিছু তামাশা হয়ে ওঠে।
যুদ্ধের মতো অসভ্যতা শিল্প হয়ে ওঠে কারো কারো কাছে। আমেরিকার কাছে। ইহুদিদের কাছে। একাত্তরে পাকিস্তানি সামরিক জান্তার কাছে।
জাঁ পল সার্ত্র বলেন, হাজার বছরেরও পরে মাটি খোঁড়া হলে নিঃসঙ্গ ফুলের ভেতর উঁইয়ে খাওয়া ক্লান্ত হাড়গোড়– পাপ রয়ে যেতে পারে–পাপ রয়ে যায়।
বাঙালি একাত্তরে যখন শ্লোগান দিল :বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর। টনক নড়লো পাকিস্তানের বাপ-মা আমেরিকা ও চীনের, একাত্তরে এই রাষ্ট্র ও জাতির বিরুদ্ধে ছিল তাদের ন্যাক্কারজনক ভূমিকা।
বাঙলি নেতা যখন বললেন, তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শক্রর মোকাবেলা করতে হবে। প্রত্যেক ঘরে ঘরে দূর্গ গড়ে তোল।
গেরিলা যুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু হলো এবং তার ইঙ্গিত পাওয়া মাত্র উনিশ শত একাত্তরের পঁচিশে মার্চে শুরু হয়ে গেল অপারেশন সার্চ লাইট। গণহত্যার অর্ডার দিয়ে একটি জনগোষ্ঠীর নারী-শিশু-বৃদ্ধ-নিরীহ জনগণের ওপর যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়ে ইয়াহিয়া খান ২০০০ হাজার মাইল দূরে উড়াল দিলেন হুইস্কি পান করতে করতে। তিনি তখন সংগীত শ্রবণ করছিলেন কোকিল কন্ঠি নূরজাহানের। রোম যখন জ্বলন্ত তখন নিরোর মতো।
উনিশশ'একাত্তরে আমাদের পরিবার পাকিস্তানের বর্বর সেনা বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসরদের নির্মম হত্যাযজ্ঞ, ধ্বংসলীলা আর নিষ্ঠুর অকথ্য অত্যাচারের শিকার হয়েছিল বাংলার আরো অনেক পরিবারের মতো।
যুদ্ধের সময় আমার ফুপু সৈয়দা ফেরদৌস মহল, ফুপা দিনাজপুর কলেজের ইংরেজির অধ্যাপক ওয়াহিদুর রহমান চৌধুরী, পুত্র আমার ডাকনামেই নাম ছিল খোকন ও কন্যা নীলু দিনাজপুরে পাকবাহিনী ও তাদের দোসরদের সহিংসতায় শহীদ হয়েছিলেন। সদ্য ভূমিষ্ট আমার এক ভাই তাদের সন্তান নিখোঁজ হয়েছিল। আমরা জানিনা, যুদ্ধের সময় সদ্য ভূমিষ্ট সেই নিহত জনক-জননীর সন্তান আজও বেঁচে আছে কীনা? অথবা মাতৃস্তন্যের অভাবে ধুঁকে ধুঁকে পৃথিবীতে আসার পর নিষ্ঠুর দাপটে মারা গিয়েছিল কিনা। যদি বেঁচে থাকে কোথায় জানা যায়নি, মাঝ মাঝে গা ছমছম করে হয়তো আমারই সামনে দিয়ে হেঁটে গেল, চিনি না তাই কথা হলো না, এমনও তো হতে পারে। বাবা বেঁচে থাকতে কোনো অপরিচিত যুবক দেখতে হয়তো ফুপার মতো আমার বাবা তখন ব্যাকুল হয়ে উঠতেন। যুদ্ধ একটা পরিবারকে কীভাবে নির্মুল করে দিল তার জন্য কোনো Text পড়তে হয় না আমার।

আমার বড় মামা আজিজুর রহমান। পুরো যুদ্ধের সময় আমরা ছিলাম ফকিরাপুল নানা বাড়িতে। ঢাকা যদি হয় বাংলাদেশের কেন্দ্রস্থল তবে মতিঝিল-ফকিরাপুল ছিল ঢাকারও আবার প্রাণ কেন্দ্র। ওখানেই আমার শৈশব-কৈশোর এবং যৌবনের সূত্রপাত। একাত্তরে ফকিরাপুলে আমাদের বাসা থেকে গভর্ণর হাউজ, আজকের বঙ্গভবন দেখা যেত। তিনি ছিলেন ছোট বেলা থেকেই প্রকৃতির নিয়মের সঙ্গে বেমানান। একদিন ভোরে তাঁকে বাসার সামনে ঐ গভর্ণর হাউজের ওখান থেকে ধরে নিয়ে গেল মিলিটারিরা। মুক্তি সন্দেহে তাকে এতটা শারীরিক নির্যাতন করা হয় যে তিনি পুরোপুরি ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন মানসিকভাবে। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি এরকম ছিলেন। 
যুদ্ধে অবোধ এই মানুষটা নির্মম অত্যাচারে সম্পূর্ণ উম্মাদ হয়ে গিয়ে ৩৭টা বছর এভাবে থেকে গত বছর(২০০৬সাল) মারা যান। তিনি ঘুমে ও জাগরণে মিলিটারিরা যে ভাষায় তাকে গালিগালাজ ও যে কায়দায় তাকে প্রহার ও অত্যাচার করেছিল অনুরূপভাবে তিনি রিএ্যাকশন ও ঘটে যাওয়া ঘটনার পুনরাবৃত্তি করতেন প্রায়। তিনি লাঠি দিয়ে হাতের কাছে যা পেতেন তা-ই পেটাতেন আর ভাংচুর করতেন, উর্দুতে মিলিটারিদের উচ্চারিত খিস্তিগুলো করতেন, ফলে আর্মিদের বাঙালি নির্যাতনের সেই সব কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প সব সময় আমাদের চোখের সামনে ভেসে থাকত।
যুদ্ধের সময় আমার দাদা বাড়ি সম্পূর্ণ লুঠ করা হয়। বৃদ্ধ দাদা-দাদিকে উন্মুল-উদ্বাস্তু করা হয়। পুড়িয়ে দেয়া হয় অনন্তপুরের জায়গা জমি, গোলা ভরা ধান, সব কিছু। সব কিছু হারিয়ে দাদা-দাদি আমাদের ফকিরাপুলের বাসায় চলে আসেন। তাঁদের অপরাধ ছিল, আমার তিন কাকা :আলম কাকা, জাহাঙ্গীর কাকা ও শাহ্ আলম কাকা যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করতে ভারতে চলে গিয়েছিলেন।
আমার জাহাঙ্গীর কাকা ময়মনসিংহে একটা অস্ত্রাগার লুন্ঠন করে আপামর জনতাকে সঙ্গে নিয়ে শহরে পাকিস্তান আর্মি প্রবেশের সময় সম্মুখ সমরে নেমে পড়েছিলেন। গড়ে তুলেছিলেন প্রতিরোধ। পরে বোম্বিং শুরু হলে ময়মনসিংহ শহরে ২৫ মার্চের পরে কয়েকদিন স্বাধীন বাংলার পতাকা ওড়ানো রেখে শেষ পর্যন্ত বর্ডার পার হয়ে ওপারে চলে যান। যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেন।
এসব খবর আমাদের কাছে এসে যাচ্ছিল আর আমরা আন্দোলিত হচ্ছিলাম। ফুপুর মৃত্যুর সংবাদ পেয়ে আমাদের ফকিরাপুল বাসায় গৃহহীন হয়ে আসা আমার দাদি বুক চাপড়ে যখন কাঁদতেন, মনে আছে, বাবা তার মা-কে বলতেন, মা তুই চুপ কর। মিলিটারিরা আমাদের সবাইকে মেরে ফেলবে শুনতে পেলে। তা সেই কী দমবন্ধ করা পরিবেশ! আমার মনে পড়ে।
আমাদের বাসার অদূরে রাজাকারদের ক্যাম্প ছিল। কুখ্যাত ফেরু মেম্বার ওরফে ফিরোজ মিয়া ছিল রাজাকারদের নেতা। রাত হলে সেখান থেকে তাদের অত্যাচারিত নারী-পুরুষদের কান্না ও আর্তচিৎকার ভেসে আসত। সেই আর্তনাদ এখনো আমাদের কানে ভেসে আসে।
একাত্তরে দুইবার আমাদের বাসা পাক বাহিনী তল্লাশী করে। মুক্তি বাহিনীর খোঁজে, অস্ত্রের খোঁজে পুরো বাড়ি তছনছ করে। মনে আছে আমার মা-খালাম্মারা ভয়ে ঠক্ ঠক্ করে কাঁপত তখন।
আমার অনেক খেলনা, আব্বার কিনে দেয়া পোশাক, বাড়ির মহিলাদের দামি শাড়ি ও গহনাপত্র তারা তল্লাশী করতে এসে কোনো কিছু না পেয়ে তাই নিয়ে দুই-দুইবার চলে গিয়েছিল। আমাদের বাসাটা তাদের সন্দেহের তালিকায় ছিল। আমার মামা, আম্মার মামাতো ভাই, আমরা তাকে ডাকতাম চাঁন মামা তিনি ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা একজন গেরিলা। তার কাছ থেকে আমি প্রথম গ্রেনেড স্পর্শ করেছিলাম। গ্রেনেড কীভাবে ছুঁড়তে হয়, কোন অস্ত্রের কী নাম তা তিনি আমাকে ও আমার ছোটো মামা মিঠুকে বলতেন। তিনি হঠাৎ হঠাৎ আসতেন, আব্বা, নানীরা টাকা পয়সা সংগ্রহ করতেন, তিনি তা নিয়ে আবার চলে যেতেন। রাতের আঁধারে তার ছিল চলাচল, আগমন ও অবস্থান। আমাদের বাসার সেইফটি ট্যাঙ্কের এক পাশে–এখন অতটা মনে নাই, তিনি অস্ত্র-শস্ত্র, গ্রেনেড বুলেট রাখতেন বলে আমি এখন ধারনা করতে পারি। সেই মামার ভালো নাম রফিক-উদ্দ-দৌলা, এখন ডিমলায়। তিনি মুজিব বাহিনীর সদস্য। নটরডেম কলেজ সংলগ্ন কালভার্টের কাছে আর্মি টহল চৌকিতে একক গ্রেনেড হামলার গল্প তিনি আমাদের শুনিয়েছিলেন। আমার বাবার ছোট চাচা সৈয়দ ইদ্রিস হুসেন, আমরা বলি ছোটো দাদা, তাঁর ছেলে শহীদ আনোয়ার রংপুরে সম্মুখ সমরে পাকবাহিনীর হাতে নিহত হয়েছিলেন। তিনি ছিলেন শহীদ একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা।
পুরো যুদ্ধের সময় আমরা ঐ ফকিরাপুলে ছিলাম। কেউ বাড়ি ছেড়ে চলে যাইনি বরং বিভিন্ন জায়গা থেকে এসে আত্মীয়রা আশ্রয় নিয়ে ছিলেন। একজন গোয়ালা আমাদের বাসায় দুধ দিয়ে যেত। তিনি ছিলেন মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষের। তিনি চাঁন মামাদের কাছে নানা তথ্য আদান প্রদান করতেন। যুদ্ধ শেষে তা জানতে পেরেছিলাম।
চাঁনমামারা কমলাপুরের ওদিকে সম্ভবত এখনকার মাদারটেক অঞ্চল হয়ে যেখানে ছিল ঘোর গ্রাম ওখান থেকে তারা এসে মতিঝিল ও আশে পাশে গেরিলা কায়দায় হামলা চালাতেন। প্রতিদিন একটি হামলা পরিচালনাকালে মুক্তিবাহিনীর গ্রেনেড হামলা না শুনলে বাড়ির কারো স্বস্তি হতো না। অবরুদ্ধ ঢাকা শহরে আমাদের মতো সকলের কাছে একই ছিল অনুভূতি । মুক্তিবাহিনী চারিদিকে আছে, তারা ঢাকায় আছে, এই রকম একটা মনোভাব মুরুব্বিদের মধ্যে কাজ করত। তারা গোল হয়ে নিচু স্বরে আলোচনা করতেন, সকালে-সন্ধ্যায় স্বাধীন বাংলা বেতারের অনুষ্ঠান শুনতেন। আমি ও আমার ছোট মিঠু মামাও তাদের পাশে থাকতাম। পরে নকল করে জল্লাদের দরবার, চরমপত্র ইত্যাদি সব নিজেরা নিজেদের মধ্যে পুনরাবৃত্তি করতাম।
যুদ্ধের শেষে যখন জয়বাংলার প্লেন ঢাকায় বোম্বিং করত, তখন বাড়ির সকলের সঙ্গে আমরাও উল্লসিত হয়ে বিমান হামলা দেখতাম। ডগফাইট দেখতাম। প্লেন দেখে মনে হতো গোলার আঘাতে ভূপতিত কিন্তু হঠাৎ কাছাকাছি এসে ভয়াবহ বোমা হামলা চালিয়ে আবার তীর বেগে চলে যেত। আব্বারা বলতেন ক্যামোফ্ল্যাজ। যুদ্ধ আমাদের কতো কিছু শেখালো। যেদিন গভর্ণর হাউজে বোমা মারল, সচক্ষে দেখলাম, আব্বা বললেন ঠ্যাটা মালিক্কা নাকি লেজ গুটিয়ে পালিয়েছে। জয়বাংলার প্লেন একবার পাকিস্তানি গোলার আঘাতে ভূ-পতিত হলে বৈমানিকরা ধরা পড়লে তাদের ছবি ইংরেজি মর্নিং নিউজে দেখে আমাদের সেকি মন খারাপ।
পাক সেনারা আত্মসমর্পণের পরদিন আমাদের ফকিরাপুলে যুদ্ধ হয়। কিছু খাঁনসেনা এসে ফকিরাপুলের মুখে হোটেল ডি-বাদশাহ্ আছে, --সেখানে খাবারের সন্ধানে গিয়ে আশ্রয় নিলে মুক্তিবাহিনীরা খবর পেয়ে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে­ রীতিমত যুদ্ধ শুরু;  উচুঁ ভবন গুলোর একটা ছিল নানাবাড়ি আমার। মেশিন গান নিয়ে মুক্তিবাহিনীরা সেখানে এবং অন্যান্য উচুঁ ভবনের ওপর থেকে হামলা চালিয়ে ওদের পরাস্ত করে পাশে যে খাল ছিল, ফকিরাপুলের কাঠের পুলের পাশের খালের কাছে সবাইকে ব্রাশফায়ার করে মেরে ফেলে। আমরা সবাই গিয়ে তা দল বেঁধে দেখে আসি। আমাদের বাড়ির গায়ে বুলেটের চিহ্ন ছিল। আমরা বুলেটের সঙ্গে রিং লাগিয়ে তখন বুলেটের আংটি বানিয়ে পড়তাম।
এরকম আরো অজস্র স্মৃতি আছে।  মুক্তিযুদ্ধকালীন এবং যুদ্ধের  পরের নানা অভিজ্ঞতা, বড়দের কথাবার্তা কান পেতে শুনতে শুনতে মুক্তিযুদ্ধ যেন কখন আমার রক্তের ভেতর প্রবেশাধিকার নিয়ে নেয়- তাই হয়তো যখনই কালি ও কলম নিয়ে গল্প লেখার আয়োজন করি তখন অনিবার্য হয়ে যায় এইসব নানা উত্তাপ। সেই উত্তাপ থেকে জ্বলন্ত রূপ নেয় বিভিন্ন গল্প। মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক গল্প লেখা অনিবার্য হয়ে যায় যেমন মেঘ জমে বজ্রসহ বৃষ্টিপাত হয়। ‘লাশ নাই’ আমার মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক গল্প-এলবাম। অসাধারণ চিত্রাঙ্কন করেছেন রনি আহম্মেদ। বাংলার স্বাধীনতা আনল যাঁরা-তাঁদের উৎসর্গ করা হয় ঐ বইটি। যুবকাল, লিটল ম্যাগাজিন ‘অনিন্দ্য’র হাবিব ওয়াহিদের প্রকাশনা ছিল ওটা। সুতরাং মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লেখা গল্প আমার জন্য কোনো বিচ্ছিন্নতা নয় বরং সংলগ্নতা। ঐ সময়টা আমাকে ম্যাচিওর করেছে।
আমরা মিস্ লিংকেজ প্রজন্ম। সরাসরি অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করতে পারি নাই। এখন কলম যুদ্ধ করছি।

গল্পের পাশাপাশি আপনার অনেক গদ্য-প্রবন্ধ . . .পাঠকদের কেউ কেউ বলেন  ‘গদ্যের চেয়ে গল্পই অনেক শ্রেয়’. . . কী পার্থক্য অনুভব ?
উত্তর :
আমার কাছে অন্তিম মতামত জানতে চাইলে বিনয়ের সঙ্গে বলি, আমি প্রবন্ধ-গদ্য-গল্প লিখে কম আনন্দ পাই নাই। আমি যখন প্রবন্ধ লিখি তা শুধু প্রবন্ধ হয়ে ওঠেনা। ওখানে, প্রবন্ধের মধ্যে কবিতা চলে আসে। অনেক সময় প্রবন্ধ লিখতে লিখতে আমি এক জায়গায় গল্প বিন্যস্ত করে আবার প্রবন্ধ লেখা শুরু করেছি।
প্রবন্ধে, উদ্ধৃতি/উদারণ হিসেবে কোনো গল্প বা কবিতার উল্লেখ নয় তা আবার। 
একটা প্রবন্ধ লেখা শুরু করেছি এক সময় দেখি তা গল্প হয়ে গেছে আবার গল্প থেকে প্রবন্ধের মধ্যে ফিরে এসেছি। দাওয়াত না দিলেও কবিতা প্রবন্ধের অংশ বা Textহয়েছে। বাবার লেখা চিঠি--পোস্ট কার্ডের ফটোকপি, প্রেসক্রিপশন, ইলাস্ট্রেশন, আমার উপর কোনো সমালোচনা, বাবাকে নিয়ে স্মৃতিকথা, পারিবারিক ঘটনা সব কিছু, এমন কী লাইনের পর জীবনানন্দ ঢুকে পড়েছে আমার প্রবন্ধে।
আমার পাঠককে আমার পূর্ণাঙ্গ প্রবন্ধের প্রথম গ্রন্থ ‘জননীর জন্য গল্প ও লেখকের হত্যাকান্ড’ পাঠ করার জন্য সাদরে আমন্ত্রণ জানাবো।
আর সর্বশেষ প্রবন্ধ গ্রন্থ ‘তামাদিপাতা ও ভাষার আঙ্গিক’। প্রবন্ধের বইয়ের একটা Cover থাকবে। সেখানে মূর্ত-বিমূর্ত কোনো দৃশ্য বা ক্যালিগ্রাফি থাকবে।
আমি ঠিক করলাম। Cover-এর প্রথাগত কিছু থাকবে না। থাকবে প্রচ্ছদ লেখা। যা Cover-এ ঐ প্রবন্ধ গন্থের যে রকম প্রচ্ছদ হতে পারত, তাকে Representকরবে। বন্ধু মাতিয়ার রাফায়েল প্রচ্ছদ -লেখা রচনা করে দেয় আর তা খুব চমৎকার প্রচ্ছদে প্রথাগত যা হতে পারতো তাকে Replace করে।
প্রচ্ছদ -লেখ আইডিয়া একেবারে নতুন। বইটার Innerকোন ছিল না।  শুধু শেষ পাতায় ঐ এক পৃষ্ঠার Inner না বলে বলা যেতে পারে Outer।
পাঠক আপনি ইচ্ছা করলে বইটি পড়ে দেখতে পারেন। প্রবন্ধ লিখতে গিয়ে আমি যে কোনো কিছু তলিয়ে দেখার একটা অভ্যাস পেয়ে গেছি। আমার গল্পের মধ্যেও প্রবন্ধের চালচলন ঢুকে গেছে। গোয়েন্দা হয়ে গেছি।

আপনার লেখায় নতুন এক আঙ্গিক লক্ষ্যে করা যায়। বাংলা সাহিত্যের প্রচলিত ধারার বাইরে এই আঙ্গিক তৈরির পেছনে আপনার কী ধরনের মনোভাব কাজ করছিল? যদি বলা যায়, প্রচলিত ধারার বাইরে গল্প লেখাটা এক ধরনের স্ট্যান্টবাজি আপনি কী মন্তব্য করবেন?
উত্তর :
কেবল আমার নয়, যারা আশির দশকে লেখালেখি আরম্ভ করি তাদের প্রত্যেকের লেখায় আপনি বাংলা গল্পের প্রচলিত ধারার বাইরে একটি নতুন আঙ্গিক খুঁজে পাবেন।
কোনো বিষয়বস্তু নতুন নয়। সবই পুরাতন। শুধু পৃথক হয়ে ওঠে বলনকেতার জন্য। আমরা যখন দেখি একটা আখ্যান বলতে পারছি ভিন্ন প্রকৃতিতে –তখনই তো লিখি। নতুবা তো সবই চর্বিত চর্বন হতে বাধ্য।
আজকে যে গল্পের মধ্যে নতুন আঙ্গিক কিংবা প্রচলিত ধারার বাইরে কোনো উপাদান দেখছি পরবর্তী তা সবকিছুই প্রজন্মান্তরে প্রচলন হয়ে যায়। একটি নতুন স্বর, ভঙ্গি সকলকে খুঁজে নিতে হয়।
আপনি কীভাবে কথাবস্তু নিয়ে চিন্তা করছেন তার ওপরও অনেক কিছু নির্ভর করে। গল্পটা যেভাবে আসে, আপনি সেভাবে চিন্তা করে সেভাবে লিখবেন আর তা থট-প্রসেসের সঙ্গে যুক্ত বলে সেভাবেই গল্পটা লেখা হয়ে ওঠে। পাঠকের মনোভঙ্গির সঙ্গে একাত্ম বোধ করলে কোনো বিরোধ সৃষ্টি না করলে তাতে একরকম অনুভূতি আর যদি একটা দূরত্ব হয়ে যায় দু’জনার চিন্তাগত পদ্ধতির তখন স্ট্যান্টবাজি হিসেবে দাগ কাটলে লেখকের মধ্যে তাইতো খুঁজে পাওয়া যায়। লেখক, সময়ের প্রতিনিধি। তার রিয়েলিটি একেক রকম। লেখার সময় তা কাজ করে। 
লেখক কী ইচ্ছে করে প্রচলিত ধারার বাইরে গল্প লেখে? না সে তা করতে পারে না। থট প্রসেস অনুযায়ী লেখাটা এক রকম বেরিয়ে যায়। একটা ঈঁৎাব বা একটা ঈঁৎাব এর মধ্যে অনেক ঈঁৎাব রচনা করে। কখনো সে কলমকে পরিচালনা করে না, কলম তাকে চালিয়ে নিয়ে চলে, মস্তিষ্কে একটা ছবি আঁকা যা হয় তাই গল্পে  রূপ নেয়। লেখকও অবাক বিস্ময়ে দেখে তার লেখা, তার সৃষ্টি; তার লেখাজোখা। সব গল্প স্বার্থক নাও হতে পারে কিন্তু প্রতিটা গল্পের জন্য একটা সত্য থাকে। লেখক তাকে কতটা অস্বীকার করতে পারবে?
গল্প লেখা একটা অভিযানের মতো। লিখতে লিখতে তার সম্মুখে নানা প্রকার নীরবতা, উচ্চকন্ঠ হয় বিভিন্ন বিষয়- আশয়। সে ধারণ করে, পরিত্যাগ করে, জার্নি করে। এই জার্নি তাকে নিয়ে যায় এমন কোথাও যা সে নিজে দেখে নাই এবং পাঠককেও তার মতো হতে হয়। নতুন একটা ভুবনের বাসিন্দা তখন উভয়ই। গল্পে স্ট্যান্টবাজির কোনো স্থান নাই। যে করে শেষ পর্যন্ত সে চমকের মতোই অপসৃত হয়। 

সুবিমল মিশ্র দ্বারা আক্রান্ত বলে অনেকে মনে করেন ... 
উত্তর :
যারা এ কথা বলেন তারা সুবিমল মিশ্রকে অপমান করছেন বলে আমি মনে করি। তারা সুবিমল বাবুর লেখা ভালো করে পড়েন নাই। আমার লেখাও না।
আমার একটা গল্প ছিল। শেষ দিবস উদযাপন ও একটি রিপোর্টাজ। ‘অনিন্দ্য’-এ প্রকাশ হয়েছিল। আশির দশকে। এই গল্পটা ছাপা হওয়ার পর আমার বিরুদ্ধে তখন বলা হয়েছিল আমি নাকি কমল কুমার মজুমদার দ্বারা আক্রান্ত; আমার লেখা জটিল, দূর্গম।
আমি বলি লেখা হচ্ছে থট প্রসেসের সঙ্গে জড়িত। থট প্রসেস অনুযায়ী গল্প লেখা হয়।
একেক গল্পে তা একেক রকম। থট প্রসেস অনুযায়ী কখনো জটিল আবার কখনো সরল হতে পারে। থট প্রসেস অনুযায়ী তা পাল্টে যায়। কেউ চাইলেও জটিল গল্প লিখতে পারে না। গল্পের বিষয় বস্তু কী রকম হবে তা দেখা দরকার।
সরল বিষয় জটিলভাবে বলা যায় না আবার জটিল বিষয় সরলভাবে না।
লেখকের মধ্যে অন্য লেখকের প্রভাব আমি খারাপ ভাবে দেখি না। এটা হতে পারে। নকল করলে সেটা অন্য ব্যাপার। আরোপ করলে অন্য ব্যাপার। দেখতে হবে সেটা স্বতঃস্ফূর্ত ছিল কী না। গল্প কোনো ভূঁইফোড় রচনা হতে পারে না। গল্প লেখার সময় রক্তক্ষরণ হয়। সেই চিহ্ন থাকে লেখায়। ভালো গল্প মানুষকে ভালো গল্প লিখতে উৎসাহী করে। ভালো গল্পকে ব্যবচ্ছেদ করে করে তো শেখেও গল্প লেখা মানুষ।
গল্প তো ওহী নাজেলের মতো কোনো ব্যাপার নয়। গল্প কোনো চিন্তা/অনুভূতির বিদ্যুৎ মালা নয়। হঠাৎ একটা চিন্তা আসতে পারে। গল্পকার কলম হাতে নেয়। চিন্তা বেশি অগ্রসর হয়, কলম তুলনায় কম।
গল্প কবিতার মতো নয়। গল্পের মধ্যে Logicalপরম্পরা থাকতে হয়, যৌক্তিকতা থাকতে হয়। জাদুবাস্তবতা, আধাবাস্তবতা থাকলে জাদু নিয়ে কথা না বললেও বাস্তবতাটা যখন হানা দেয় তখন কোনো সাংঘর্ষিক পরিস্থিতি না হয় যা খটকা দেবে। জাদু ছুটে গিয়ে   বাস্তবতার মেঝেতে পপাতধরণীতল হবে। বাস্তবতার মধ্যে জাদু ঢুকে গেলে তা জাদু হবে না; কবিতা ঢুকে যেতে পারে গল্পে কিন্তু কবিতার মতো হবে না। নাটকীয়তা থাকতে পারে কিন্তু তা নাটক হবে না; চলচ্চিত্রের নানা অনুষঙ্গ ব্যাপ্তি থাকতে পারে কিন্তু তা চলচ্চিত্র বানিয়ে ফেলবে না। গল্পে ঢুকে যেতে পারে কবিতার মতো কখনো প্রবন্ধ কিন্তু তা এসব শুধু Fusion। আমি নিজেকে বলেছি Confusion
কিন্তু Confusion হলো আরেকটা Phenomenonযা Struggleআর Crisisএর মতো বাদ দিলে গল্প কোথায় যেন কেমন হয়ে যায়।
ভালো কোনো প্রভাবকে Welcome  করা যেতে পারে কিন্তু মন্দ প্রভাব: Nucleus, Network কে  Welcome দেয়া যাবে না।

সাম্প্রতিক শিল্প-সাহিত্যে প্রাতিষ্ঠানিক বা অপ্রাতিষ্ঠানিক কাগজের ভূমিকা...
উত্তর : 
প্রাতিষ্ঠানিক কাগজের ভূমিকা এ বাহ্য। প্রাতিষ্ঠানিক কাগজ করে এক ধরনের রুটিন ওয়ার্ক। আসলে প্রাতিষ্ঠানিক কোনো কাগজে সাহিত্য, শিল্পকলা থাকতে পারে না। সৃষ্টিশীল কোনো কিছু থাকতে পারে না।
তার ভূমিকা অনেকটা প্রচারকের। কিন্তু সে ভূমিকা পালন করে প্রতারকের। প্রতারকের মতো ভূমিকা এই জন্য যে, নোয়াম চমস্কির ভাষায় নির্বোধ পশুদের মধ্যে সে স্পন্সর আর মালিকের অনুকূলে, Network  বিস্তারে বিভিন্ন অপপ্রচার চালায়, সত্য গোপন করে, পাঠকদের একটা গড় মানে নামিয়ে আনে। নির্বোধ পশুদের কোনো Purpose serve করে না বরং প্রাতিষ্ঠানিক কাগজের বিভিন্ন পদক্ষেপের উদ্দেশ্যে সম্মতি উৎপাদনে ব্যবহৃত করে।
অপ্রাতিষ্ঠানিক কাগজের ভূমিকা সম্পূর্ণ বিপরীত। পাঠক তার কাছে নির্বোধ নয়, সঙ্গে সঙ্গে সে নিজেও অগ্রসর হয়, ঋদ্ধ হয়। পাঠকের সঙ্গে লেখার একটা মিথষ্ক্রিয়া কখন যেন ঘটে যায়। অপ্রাতিষ্ঠানিক কাগজের পাঠক বরাবরই শিক্ষিত, সে পড়ে, পঠিত জিনিস নিয়ে ভাবে, লেখাগুলো তাদের ভাবনার খোরাক হয় তখন দুয়ে -দুয়ে চার হয়।
অপ্রাতিষ্ঠানিক কাগজে লিখলে নগদ অর্থ পাওয়া যায় না কিন্তু লেখা যদি সেই তার পাঠককে নাড়া দিতে না পারে তবে নগদ যা লাভ করে তা হচ্ছে গঠনমূলক সমালোচনা। এখানে দুই পক্ষ সেয়ানে সেয়ানে।
প্রাতিষ্ঠানিক কাগজে লেখে এক ধরনের বিশেষ গোষ্ঠী। পাঠক নির্বোধ একদল পশুর মতো দু’পেয়ে জীব। এইসব অন্ধ মাঝে মধ্যে অপ্রাতিষ্ঠানিক কাগজ পড়ে গালাগাল দেয়ার জন্য। একবার যদি ঐ সিলছাপ্পর মারা লেখক-পাঠক এই অপ্রাতিষ্ঠানিক কাগজ পড়ে তখন তারা কী যে হিংস্র হয়ে, এমন জ্ঞানের মূর্তির মতো চেহারা ধারণ করে–দাঁত কিড়মিড় করতে করতে প্রাতিষ্ঠানিক কাগজে গিয়ে আয়নায় নিজের চেহারা– সেই কদর্য চেহারা ভুলতে না পেরে অপ্রাতিষ্ঠানিক কাগজ ও তাদের লেখা সম্পর্কে বোধহীন পশুর মত– চিরাচরিত বদহজমে হলেও যা হয়–সব কিছু এমন করে ফেলে যে নাকে রুমাল দিতে হয় দুর্গন্ধে। আমি বলতে চাই–তাদের ক্ষেত্রে ওদের নিঃশ্বাস যেন বিষ না ছড়ায়। আসলে প্রাতিষ্ঠানিক কাগজ পড়তে পড়তে মগজ এতটা গড়মান হয় এবং গড়মানের লেখা উৎপাদন করতে করতে এমনই দশা হয় যে রজ্জুতে সর্প ভ্রম হয়।
অপ্রাতিষ্ঠানিক কাগজে যারা লেখেন, যারা পড়েন, তাদের সাতখুন মাফ–এই কথাও আমি বলবো না।
এখানেও অনেক ছদ্মবেশী নির্বোধ আছে। এখানেও প্রাতিষ্ঠানিক কাগজের মতো কারো সঙ্গে কারো গলাগলি, দলাদলি আছে। কেউ আবার পাত্রে চুমুক দিয়ে দিব্যি মুখোশ পরে বসে থাকে। এদের কারণেও প্রাতিষ্ঠানিক কাগজ অনেক সময় অনেক কথা বলার সুযোগ নেয়।
তবে, আমি চাই দুই পক্ষ যার যার মতো থাক। কেউ যেন পিঠে, পিছন থেকে ছুরিকাঘাত না করে। কুৎসা ও মিথ্যা যেন উৎপাদন না করে। ব্যক্তিগত আক্রমণ না করে।
প্রাতিষ্ঠানিক কাগজের মতো কোনো কোনো অপ্রাতিষ্ঠানিক কাগজকেও ভূমিকা পালন করতে দেখি। ওরা আরেকজনের বিরুদ্ধে কুৎসা রটনা করে, মিথ্যা অপপ্রচার চালায় আবার  প্রাতিষ্ঠানিক কাগজ ও তার লেখকদের ইন্ধন যোগায় আরেক সতীর্থের বিরুদ্ধে।
কখনো কখনো দুই পক্ষের কেউ কেউ একজন সম্পর্কে বিধ্বংসীকর কথাবার্তা বলে।
লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনকারী অনেকের মধ্যে পরশ্রীকাতরতা তৈরি হয়েছে। নিজেকে সব চেয়ে বিশুদ্ধ মনে করার প্রবণতা তৈরি হয়েছে। বড়ো ভাবার পায়তারা শুরু হচ্ছে।
সত্য কথা বলতে এখন এমন কোনো লেখক দেখি না যে, সরল, শিশুর মতো, প্রকৃত শিল্পী; Networkবাজি বা ল্যাং মারার প্রবণতা নাই।
আরো অনেক কথা বলা যায়। নিজের গায়ে লাগে তাতে। আর আমিও এসবের উর্ধে নই কারণ আমার বিরুদ্ধে সহযোদ্ধা কেউ প্রাতিষ্ঠানিকদের নিয়ে আমার বিরুদ্ধে বলে একই কথা তখন কী ভাবে আমি আলাদা হই।
 
লিটল ম্যাগাজিন...কমিটমেন্ট... এই বিষয়ে আপনার অভিমত . . .?
উত্তর:
লিটল ম্যাগাজিন কোন পত্রিকা নয়, ম্যাগাজিন নয় বরং লিটল ম্যাগাজিন বলতে একটা আন্দোলন বোঝায়। সম্পূর্ণ প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা করার এই আন্দোলন। সেটা গদ্যের চিরাচরিত প্রতিষ্ঠান হতে পারে, কবিতা বা প্রবন্ধের প্রাতিষ্ঠানিক চেহারার বিরুদ্ধে হতে পারে। আমাদের এই ক্ষয়ে যাওয়া সমাজ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে হতে পারে। মূল্যবোধের বিরুদ্ধে হতে পারে। কলম, বন্দুক আর ক্যামেরার মধ্যে কোনো তফাৎ থাকে না এই আন্দোলনে।
আশির দশকে গড়ে উঠেছিল আন্দোলন লিটল ম্যাগাজিন। তখনকার অনিন্দ্য, গান্ডীব, সংবেদ, অর্ক–এগুলো ছিল আন্দোলনের বহিঃপ্রকাশ। এখনও তাই। তারই ধারাবাহিকতায় পরে আমরা পাই আরও কাগজ। তারা আন্দোলনের প্রতিচ্ছবি ধারণ করেছিল।
এখন বাজারে লিটল ম্যাগাজিনকে ব্র্যান্ড নামের মতো ব্যবহার করে গুচ্ছের কাগজ বের হচ্ছে। তাদের সামনে লিটল ম্যাগাজিন একটি ফ্যাশন মনে হয়। তারা ফ্যাশন করছে। তাদের সঙ্গে কোনো যোগযোগ নেই আন্দোলনের। একধরনের সুবিধাবাদও আছে। আবার তাই তাদের কাজ কর্মে দেখা যাচ্ছে...বিভিন্ন আমলা  কামলা গামলা কবিদেরও নিয়ে মাতামাতি। কবির চেয়ে উচ্চ পদস্থ আমলা হিসেবে কিছু অকবি বেশি দাম পাচ্ছে।
আমলা একজন হতে পারে। কিন্তু আমলাতন্ত্র যেন প্রধান না হয়। আমলা পরিচয় যেন গুরুত্বপূর্ণ না হয়, বিজ্ঞাপনের উৎস না হয় তা ভাবা দরকার।
আমিও সরকারি চাকরি করেছি। কিন্তু সেটাকে মূল পরিচয় করি নাই। করতে পারি নাই। একটা দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়ে শেষ পর্যন্ত চাকরি ছাড়ি।  বিজ্ঞাপন যোগাড় করে দিয়ে বা আমাকে দিয়ে বিজ্ঞাপন হাতিয়ে নিয়ে কেউ কিছু করে নাই। তারা সেটা ভাবেও নাই। আমিও না।
জিন্সের ট্রাউজারে ভালো ব্র্যান্ড যেমন আছে তেমনি  ব্র্যান্ড হিসেবে লিটল ম্যাগাজিন বলে দাবী করে অজস্র পত্রিকা বের করতে করতে, –পয়সার অভাব নাই যেহেতু, তাই এইসব পত্রিকার কোলাহলে, তাদের সম্মেলন, সেমিনার, স্পন্সরের চাপে-তাপে লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনের সৃষ্ট-মূল স্রোতের কাগজগুলোর মুখ ঢেকে যায় বলে আন্দোলন বিযুক্ত যতো প্রকার কাগজ পাঠকেরা পড়ে আর যাই হোক তাতে কমিটমেন্ট খুঁজে না পেয়ে  বিভ্রান্তির মধ্যে  পড়ে। থাকতে হয় অন্ধকারে।
কমিটমেন্ট যদি কিছু থাকে তবে তা লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলন কেন্দ্রিক কাগজে খুঁজে পাওয়া যাবে।

লিটল ম্যাগাজিনের চরিত্রে বৈচিত্র্য থাকা, . . এর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য কতটা নিজস্ব- ?
উত্তর :
চরিত্রে বৈচিত্র্য থাকা দরকার তবে তা যেন চিত্রবিচিত্র না হয়ে যায় সেদিকটা একই সঙ্গে ভাবা জরুরি। লিটল ম্যাগাজিনে বৈচিত্র্য এনেছে  হাবিব ওয়াহিদ।
থাক সে কথা। ভাবা যায়, কুইজ, শব্দজট-মার্কা জিনিস বৈচিত্র্যের উদ্দেশ্যে চালু করা হলো তখন কেমন হবে ! আমি যে কোনো বারো ভাজা জিনিসের বিপক্ষে তবে বৈচিত্র্যের পক্ষে।
সেটা হবে চিন্তা-ভাবনায়-দৃষ্টি-ভঙ্গিতে। শিল্প-সংস্কৃতির প্রতি মনোভাবে।
লেখককে লিখতে হবে বিচিত্র বিষয়ে, লেখায় থাকবে বৈচিত্র্য। যে কোনো গৎ বাঁধা ফর্মূলা, মানদন্ড, তুল্যমূল্য, দৃষ্টিভঙ্গি–সব কিছু লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনের পক্ষে অনুকূল হবে না।
একটি পত্রিকা নিজেই যে একটা নতুন শিল্প হয়ে উঠতে পারে আবার শিল্প ভেঙে বেরিয়ে আসতে পারে সবই সম্ভব যখন নেপথ্যে সেই কাগজের পেছনে চির-তারুণ্য ভরপুর একটি গোষ্ঠী কাজ করে। কোনো মতলব কাজ করে না।
পত্রিকা জ্বলে ওঠে তখন যখন লেখক জ্বলে ওঠে। পত্রিকা একটা জড়বস্তু কিন্তু লেখক যদি প্রাণবান হন, লেখা যদি হয় জীবন্ত,উত্তাপময়, সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে ভরপুর তখন পত্রিকার মধ্যে প্রাণবন্ত বৈচিত্র্য প্রকাশ পায়। পত্রিকা তখনই কথা বিনিময় করে পাঠকের সঙ্গে।
লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনের ফসল পত্রিকা আর বারোভাজা কাগজ দেখলে নিজ গুণে যার যার বৈশিষ্ট্য আবিস্কার করা যায়।
বারোভাজা কাগজে গল্পের একটা আকার আছে তার বাইরে যায় না। কবিতার সংখ্যাও মাপা থাকে তার বাইরে যায় না। বিষয়বস্তু কী হবে চোখ বন্ধ করে বলে দেয়া যায়। আর প্রবন্ধ, আলোচনা নৈব নৈব চ।
অন্তঃসার শূন্যতা খেলা করে। পাঠ করার পর ভাবতে বাধ্য হবেন আপনি, -কী হলো?
লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনপ্রসূত কাগজে কোনো আকালের সন্ধান পাবেন না। তার মৌলিকত্ব, বেনোজলে না ভেসে পাওয়া তারুণ্য, কোনো কাঠামোর মধ্যে বন্দি না হওয়া একান্তই তার নিজস্ব। ক্রটি বললে তাই, উজ্জ্বলতা বললেও তাই।

বর্তমান প্রেক্ষপটে লিটল ম্যাগাজিনের মুভমেন্ট . . .?
উত্তর :
* মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করা
* মুক্তিযুদ্ধের চেতনার জন্য সোচ্চার হওয়া/চেতনার সপক্ষে লেখা
* দেশের শিল্পকলা–সাহিত্য-সংস্কৃতির বিরুদ্ধে যে অপশক্তি ক্রিয়াশীল, তা রুখে দেওয়া 
* প্রচলিত মূল্যবোধকে চ্যালেঞ্জ করা
* সমাজের অবক্ষয় চিহ্নিত করা
* সুস্থ শিল্প-সাহিত্যের বিকাশ, সংস্কৃতিকে উজ্জীবন, শেকড় সন্ধান
* ভালোলেখা-মন্দলেখা সম্পর্কে মানুষকে জানিয়ে দেয়া
* জনগণের শিল্প ও সাহিত্যের রুচির পরিবর্তন করা
* সময়ের সঙ্গে নিজেকে প্রস্তুত করা
* সাহিত্য-সংস্কৃতি-শিল্প নিয়ে বাণিজ্যের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা
* সৃজনশীল, সৃষ্টির্শীল সাহিত্য আন্দোলন
* সমাজ ব্যবস্থাকে পরিবর্তন করার জন্য লিখে যাওয়া
* প্রাতিষ্ঠানিকতা পরিহার করা
* কলম যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া নিরন্তর—
বর্তমানে লিটল ম্যাগাজিন যা করতে পারে তা শুধু বললাম। এছাড়াও সাহিত্যের দুর্বৃত্তায়ন, বেসাতিপনা, নগ্ন-কদর্য Networking প্রতিহত করা আশু কর্তব্য।

যাদের প্রশ্ন দিয়ে সাজানো হয়েছে–
  • রাজা সহিদুল আসলাম 
  • মৌমিস্বা
  • মতিয়ার রহমান
  • মুসফেরা তাসনিম
  • মাসুদ মুস্তাফিজ

[চালচিত্র, ২০০৮]

মন্তব্য

নাম

অনুবাদ,32,আত্মজীবনী,26,আর্ট-গ্যালারী,1,আলোকচিত্র,1,ই-বুক,7,উৎপলকুমার বসু,23,কবিতা,303,কবিতায় কুড়িগ্রাম,7,কর্মকাণ্ড,14,কার্ল মার্ক্স,1,গল্প,54,ছড়া,1,ছোটগল্প,12,জার্নাল,4,জীবনী,6,দশকথা,24,পাণ্ডুলিপি,10,পুনঃপ্রকাশ,14,পোয়েটিক ফিকশন,1,প্রতিবাদ,1,প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা,4,প্রবন্ধ,152,প্রিন্ট সংখ্যা,4,বর্ষা সংখ্যা,1,বসন্ত,15,বিক্রয়বিভাগ,21,বিবিধ,2,বিবৃতি,1,বিশেষ,23,বুলেটিন,4,বৈশাখ,1,ভাষা-সিরিজ,5,ভিডিও,1,মাসুমুল আলম,35,মুক্তগদ্য,36,মে দিবস,1,যুগপূর্তি,6,রিভিউ,5,লকডাউন,2,শাহেদ শাফায়েত,25,শিশুতোষ,1,সন্দীপ দত্ত,8,সম্পাদকীয়,16,সাক্ষাৎকার,21,সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ,18,সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ,55,সৈয়দ সাখাওয়াৎ,33,স্মৃতিকথা,14,হেমন্ত,1,
ltr
item
বিন্দু | লিটল ম্যাগাজিন: পাঠকের মুখোমুখি সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ
পাঠকের মুখোমুখি সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ
https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEiQ_SLPx8jtMMnOq8PGfHW9iOovZF4A35RxxmruUDS1YvWU-fBE9lMqJlVDUSqY-D2IQwblF4u8XiVziPfmbnW0jTqYviYVFbaqZWxpjaxh0axe4S0PuzuS6xH7aJZq-fz7dnqBsxpFJv2QsJTOogzvPKsv9KZ1mc94KA-V4sx2HeKvvQ7FrjGAbYY7M7Y/s16000/Syer%20Riazur%20Rashid%20bindumag.png
https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEiQ_SLPx8jtMMnOq8PGfHW9iOovZF4A35RxxmruUDS1YvWU-fBE9lMqJlVDUSqY-D2IQwblF4u8XiVziPfmbnW0jTqYviYVFbaqZWxpjaxh0axe4S0PuzuS6xH7aJZq-fz7dnqBsxpFJv2QsJTOogzvPKsv9KZ1mc94KA-V4sx2HeKvvQ7FrjGAbYY7M7Y/s72-c/Syer%20Riazur%20Rashid%20bindumag.png
বিন্দু | লিটল ম্যাগাজিন
https://www.bindumag.com/2023/11/syed-riazur-rashid-interview-by-reader.html
https://www.bindumag.com/
https://www.bindumag.com/
https://www.bindumag.com/2023/11/syed-riazur-rashid-interview-by-reader.html
true
121332834233322352
UTF-8
Loaded All Posts Not found any posts আরো Readmore উত্তর Cancel reply মুছুন By নী PAGES POSTS আরো এই লেখাগুলিও পড়ুন... বিষয় ARCHIVE SEARCH সব লেখা কোন রচনায় খুঁজে পাওয়া গেল না নীড় Sunday Monday Tuesday Wednesday Thursday Friday Saturday Sun Mon Tue Wed Thu Fri Sat January February March April May June July August September October November December Jan Feb Mar Apr May Jun Jul Aug Sep Oct Nov Dec just now 1 minute ago $$1$$ minutes ago 1 hour ago $$1$$ hours ago Yesterday $$1$$ days ago $$1$$ weeks ago more than 5 weeks ago Followers Follow THIS PREMIUM CONTENT IS LOCKED STEP 1: Share to a social network STEP 2: Click the link on your social network Copy All Code Select All Code All codes were copied to your clipboard Can not copy the codes / texts, please press [CTRL]+[C] (or CMD+C with Mac) to copy