.header-button .inner > span { font-size: 18px !important; } .header-button .inner i.fa { font-size: 40px !important; } .comment-form-message { background-color: #f4f4f4 !important; font-size: 14px !important; }

সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ-এর সঙ্গে দুই বৈঠক


প্র থ ম  বৈ ঠ ক
সাক্ষাৎকার গ্রহণ: হাবিব ওয়াহিদ (সম্পাদক- অনিন্দ্য)

প্রশ্নঃ আপনি লেখেন কেনো? লেখার মাধ্যম হিসেবে  গল্পকে বেছে নিলেন কেনো?

উত্তরঃ কেনো লেখালেখি, এই কথা প্রসঙ্গে অনেক, –যাকে বলে, ভুরি ভুরি চটকদার বানোয়াট কথাবার্তা কানে এসেছে। কেউ বলে নিজেকে আবিষ্কার করার জন্য নাকি লেখালেখি,-- নিজেকে অনেকে বলে লেখার মধ্য দিয়ে জন্ম দিচ্ছে! তাদের লেখা-ই নাকি তাদের হাতিয়ার!এই গুলো আজেবাজে কথা ছাড়া আর কিছু না, নিছক ভড়ং। এই যাবতীয় টাকমাথা, মোচঅলা, পক্ককেশী বিভিন্ন ধাপ্পাবাজদের লেখা পড়লেই লেখালেখির পেছনে তাদের কারণ দর্শানো কথামালা অন্তঃসারশূন্য বলে সাদা চোখেও ধরা পড়তে বাধ্য। আমি নতুন কথা ফেঁদে এই পথে পা বাড়াবো না। আমি তন্নতন্ন করে আত্মানুসন্ধান করে দেখেছি, লেখালেখির পেছনে নিজেকে আত্মপ্রকাশ করার অন্তর্গত তাগিদ প্রচন্ডভাবে প্রথম অবস্থায় খুবই কাজ করেছিল। আমার বাবা একজন বইপাগল লোক। বাসায় অনেক পত্র-পত্রিকাও ছিল। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধে অনেক বই নষ্ট হয়। পরে বন্যার সময় আরও অনেক বই পত্র ভেসে যায়। এই বাবার সুবাদে আমার পাঠাভ্যাস। এমন কোনো বই পত্র পত্রিকা নাই, যা আমি পড়ি নাই। কিন্তু হ'ল কি, এসব পড়ে টড়ে, তা যারই লেখা হোক না কেনো, সত্যি বলতে কি আমার ধারণা হয়েছিল লেখালেখি করা অনেক সহজ কাজ। শতকরা ১৪ পরিমাণ পঠিত লেখাই, এই বোধটিকে এখনও সমর্থন করে। তো, নটরডেম কলেজে পড়ার সময় হ'তেই টুকটাক লেখালেখির শুরু। অবশ্য ছোটদের জন্য অল্পবিস্তর লিখেছি আগেই। দেখেছি, কত সহজে, কত অকথ্য আজেবাজে লেখা ইচ্ছা করলেই ছাপানো যায়। এখন নাম ছাপানোর মোহ কেটে গেছে। এখন পরিকল্পনা করি যে, নিজের নাম ছাড়াই গল্প ছাপাবো! আমার বিশ্বাস তাতেও গল্প লেখককে লেখার চরিত্র বিচার করেই পাঠক সনাক্ত করতে সক্ষম হবে। নিজের নামের প্রতি মোহ দশা হ'তে এইযে নির্মোহত্ব, তা লিটল ম্যাগাজিনের জন্যই অর্জন। লেখালেখির কারণ হিসেবে আরেকটি বিষয়কেও উড়িয়ে নেয়া যায় না। এখন বাংলা সাহিত্যে তো-বড় সব তথাকথিত 'ক্লাসিক' হতে শুরু করে যত প্রকার সাহিত্য কর্ম হয়েছে এবং হচ্ছে আজও, তা অভিনিবেশ সহকারে পাঠ করে অতৃপ্তিই কাজ করে। কোথায় যেন একটা অপূর্ণতা টের পাই। সব লেখাই হতদরিদ্র-ক্লিশে-কুৎসিত, এক কথায়, আমার চিন্তাধারার পরিপন্থী মনে হয়। সব লেখাই অগভীর-অমৌলিক-তরল- আবোলতাবোল শব্দ বাহার। অল্প বয়সে মনে করতাম, এর চেয়ে ভালোভাবে আমি ঐসব প্রকাশ করতে পারবো। আর এখন মনে হয় এসব লেখা পুরোপুরিভাবে অনুচিত। সবই চর্বিতচর্বন। দেখুন, এই পৃথিবীতে সব কিছুই বড় পুরাতন। সব ঘটনা আগেও ঘটেছে– এখনও হচ্ছে। তাই উচিৎ যা-ই লিখি না কেনো তা যেন হয় স্বতন্ত্র কন্ঠস্বর এবং মৌলিক বীক্ষণ সম্পন্ন। এবং সমকালকে ছুঁয়ে লেখাটি অবশ্যই স্পর্শ করবে ভবিষ্যৎকে। একটি মর্মমূলে প্রবেশ করে স্বতন্ত্র কন্ঠস্বর নির্মাণ করার জন্য আমার লেখালেখি। এই জন্যই লিখি। লেখালেখির মাধ্যম হিসেবে গল্পকে সবচেয়ে শক্তিশালী ও কার্যকর মনে হয়। রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্প সংক্রান্ত বাণীকে অত্যন্ত অর্বাচীন ও স্থূল বলে মনে করি। ছোট গল্প শুধুমাত্র ছোট ছোট ব্যথা ইত্যাদি ইত্যাদির মধ্যেই আর সীমাবদ্ধ নয়। ছোট গল্পের ভূগোল ছোট নয়। ছোট গল্পের মধ্যে রয়েছে অনন্ত সম্ভাবনা। ঠিকমত কুশলী প্রতিভার হাতে ছোট গল্প, আমরা যা চাই, তা-ই পুরোপুরি হয়ে উঠতে পারে। ছোট গল্পের মধ্যেই এই যে অনন্ত সম্ভাবনা, তার বিস্ফোরণ ঘটাতে হবে। ছোট গল্প কোনো বালবেলা ব্যাপার নয়, অথচ পূর্বাপর যে কোনো লেখা পাঠ করলে এই রকমই মনে হয়। আসলে হয়েছে কি, অন্য কোথাও পাত্তা না পেয়ে লোকেরা, এই মাধ্যমটিকে ভুলবশতঃ মূর্খতার কারণে সহজ মনে করে, সুলভ ভেবে বালসুলভ চপলতায় মাঠে নেমেছে। গল্প লেখাকে সহজ ভেবেই আজকে ছোট গল্পের এই পতন হয়েছে। তাতে ছোট গল্প সম্পূর্ণ চেহারা ও চরিত্র অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে। ছোট গল্পের অমিত তেজকে কেউই চিনতে পারে নাই আজও। ছোট গল্প লেখা আসলে মোটেও সহজ বিষয় নয়। মূর্খরা যাই ভাবুক তাতে কিছুই যায় আসে না। (ছোট গল্প 'ইহাদের' ক্ষমা করুক। 'উহারা' মূর্খ, বিপথগামী তবু ছোট গল্প 'তাহারা' উদারতা ও মহত্ব দিয়া ক্ষমা সুন্দর হউক।) অনেকেই, ছোট গল্প লেখা যে সহজ 'লাড্ডু' বস্তু নয়, তা টের পাওয়াতে, অধিকাংশকেই দেখা যায় অচিরাৎ কলমে উপন্যাস লেখা ধরে। ছোট গল্প লেখা তরলবৎ নয় বলেই, ফেনিয়ে লেখার জন্যই উপন্যাস এত প্রচুর। আর গল্প মাত্র তাই হাতে গোনা। গল্পের ক্ষেত্রে পাত্তা না পেয়ে, এর মধ্যে থৈ না পেয়ে, হাবুডুবু খেয়ে লোকজন উপন্যাস লেখা শুরু করে। নইলে ছোট গল্প মাধ্যমটির নাড়ির স্পন্দন যে যথার্থ অনুভব করতে পারে, তার জন্য অন্য কোনো বিকল্প থাকার কথা নয়। ছোট গল্প মানেই যে অল্প পৃষ্ঠায় সীমাবদ্ধ শব্দপাত, তা নয়। অযুত অক্ষরে, পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা লেখাও গল্প-ই বটে। যারা গল্পকে চিনতে পারে নাই, শক্তিকে আবিষ্কার করে নাই এবং চেষ্টাও করে নাই, সেই সকল অপগন্ডরাই-উপন্যাস- নভলেট-উপন্যাসিকা ইত্যাদি  লিখে দম ফেলছে। উপন্যাস টুপন্যাস এই সব নামের পেছনে ব্যবসায়িক চাতুর্যও লক্ষণীয়। গল্প লিখতে গিয়ে যেসব ডিমাণ্ড দেখা দেয়, তারই শৈল্পিক প্রকাশ জরুরী। সেটা উপন্যাস, না অন্য কিছু হলো সেটা গৌণ---ইম্যাটেরিয়াল। ছোট গল্পে কোনো বাঁধাধরা ব্যাপার নাই। ছোট গল্পের ক্ষমতা অসীম, সর্বস্পশী। ছোট গল্পকে প্রিজমও বলা যেতে পারে। ছোট গল্পকে ‘ছোট—' চেতনা মনে করে দায়িত্ব ফুরায় না। ছোট গল্প মাল্টি মিনিং ফুল, প্রতিটি লাইনও একই কাঠামোতে থেকেও হতে পারে বিভিন্ন অর্থবহ আর তাৎপর্য খচিত। এমন কি প্রতিটি শব্দ সুনির্বাচনের ফলে শব্দ আর তার নির্দিষ্ট অর্থের মধ্যে, নির্ধারিত গন্ডির মধ্যে আটকা থাকে না। প্রতিটি শব্দই হয়ে উঠতে পারে একেকটি বাঙ্ময় যোদ্ধা, হয়ে উঠতে পারে একেকটি বিষয়বস্তু। প্রতিটি লাইনও একেকটি নতুন অর্থ প্রদায়ক বিষয় হতে পারে। শব্দ নির্বাচন, প্রতীক, অলংকার, ভাষা প্রভৃতিকে যথার্থ ব্যবহারে ছোট গল্প আর নামটির সঙ্গে যে ছোট মত অনুভূতি জড়িত, তার মধ্যে স্থির থাকে না। মানিক-ওয়ালিউল্লাহ -দীপেন-জগদীশ- কমলকুমার-অমিয়ভূষণ প্রমুখ যা দেখিয়েছে, সেটাও শেষ কথা নয়। গল্পে যে সকল উপাদান সম্পৃক্ত করা যেতে পারে, সবই যোগ করে, পরস্পর ক্রিয়া-বিক্রিয়ার মাধ্যমে তুলে আনা যায়। ঈশ্বরতুল্য কর্ম যা পাঠকের অভ্যন্তরে সৃষ্টি করে এক চরম বোধ, অনুভূতির সর্বশেষ প্রান্ত। যা হোক, আমি সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ একজন গল্পশিল্পে বিশ্বাসী মানুষ।

প্রশ্নঃ একসময়ে আপনার লেখা গল্প দেশের বিভিন্ন দৈনিকের সাহিত্য পাতায় দেখা যেত। হঠাৎ করে সেই সমস্ত দৈনিক কিংবা সাপ্তাহিকে লেখা বন্ধ করে দিলেন কেনো? আর কেনোইবা এখন প্রকৃত ছোটকাগজ ছাড়া অন্য কোথাও লিখছেন না!এটা কি আপনার একধরনের ফ্যাশন, না অন্য কিছু?

উত্তরঃ হ্যাঁ, শুরুর দিকে যখন রাইটিং ইজ এ গুড হবি জাতীয় ব্যাপার ছিল, নিজের নাম ফাটানোর তাগিদ ছিল, আগেই বলেছি, তখন অনেক অজায়গায় কুজায়গায় লেখা প্রকাশ করেছিলাম। এই জন্য প্রচন্ডভাবে আমি গ্লানিবিদ্ধ। এই আমার প্রথমাবস্থায় বড় ধরনের স্খলন বলে মনে করি। এই হচ্ছে আমার সবচেয়ে বড় পাপ। অপরাধ। তবে সে সমস্ত লেখা, বিশেষত শিশুতোষ লেখাগুলোকে ফেলনা জিনিস বলে মনে করতে পারছি না। তবে বেশি লিখি নাই, আকছার লেখার অভ্যাস ছিল না। সাহিত্যকে

দুষ্ট বা ৭৮

বেসাতি করার প্রবণতা কখনোই ছিল না এবং নাই-ও। নিজের পেট চালানোর ভালো যোগ্যতা আমার আছে, সততা আছে, যেজন্য সাহ্যিতকে পণ্য করার বিন্দুমাত্র প্রয়োজন নাই। সাহিত্য আমার কাছে ছবি দেখে লেখার মত ব্যাপার নয়। সামান্য কোনো ব্যাপার নয়। আমি অভিজ্ঞতা দিয়ে অনুভব করেছি, বাজার চলতি প্রচল সাহিত্যব্যবস্থাগুলি ---নিছক পাবলিক টয়লেট ছাড়া কিছু নয়, যেখানে অনায়াসে ভারমুক্ত হচ্ছে মানুষজন। এইসব প্রচলিত সাহিত্যব্যবস্থায় সত্যিকার ক্রিয়েটিভিটির কোনো দাম নাই। মুখচেনাচেনি আর টেপাটেপি করাই হচ্ছে লেখা ছাপানোর কাঠি। দেখছো তো, এসব কাগজের গণ্ডায় গন্ডায় ইস্যু বের হচ্ছে, কিন্তু কোথায়ও হারিকেন দিয়ে তন্নতন্ন করে খুঁজলেও কোনো স্মরণযোগ্য লেখা------আবিষ্কার করতে পারবে না। বোধহীন - অপগন্ড-মূর্খ- চটকদার ভাসাভাসা কতিপয় কলমবাজের অত্যাচারে ভরপুর রাজত্ব চলছে এখানে। এইসব পাতার পর পাতা মূল্যহীন সাহিত্য কাগজের পরিণতি আমি নিজের চোখে দেখেছি। মানুষ পড়া হলে বিক্রী করে দেয়, সংরক্ষণ করার যোগ্য মনে করে না। তাতে কাগজের ঠোঙ্গা হয়, অনেকে দিব্যি বাচ্চার গু-মুত মোছে, আলমারীর তাকে কাগজ বিছানোর মত কান্ডও ঘটে। যথার্থ কাজই হয়। এসব দেখে তো এমনি ঘেন্না ধরে যাওয়ার কথা। নিজের ওপর আস্থাবান যিনি, বোধহীন নন, সাহিত্যকে সিরিয়াস ভাবেন, আত্মমর্যাদাসম্পন্ন হন, অবশ্যই তিনি নিজেকে এই অবস্থা হ'তে প্রত্যাহার করে নেবেন। এটাই স্বাভাবিক। আমিও এইসব দৈনিক বা যাবতীয় সাপ্তাহিকের সাহিত্য ব্যবস্থাকে নিজস্ব কোয়ালিটির জন্য অচিরেই যোগ্য মনে করি নাই। নিজের সম্মানকে অগ্রাধিকার দিয়ে নিঃশব্দে, ঐসবের পাছায় কষে লাথি মেরে নিজেকে পরিশীলিত করেছি। এখানে একটি ব্যাপার হয়েছে যে, প্রচলিতধারার অনুগত হোপলেসরা কখনই বলতে পারবে না যে, তথাকথিত বড়কাগজে লেখালেখি করার পায়তারা হিসেবে আজ আমার এই লিটল ম্যাগাজিন করা। লিটল ম্যাগাজিন আমার কাছে কোথাও পৌঁছে যাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় সিঁড়ি নয়। আমার সব কিছুই দেখা আছে, সব দৌড় জানা আছে। লিটল ম্যাগাজিনে আমি এসেছি নিজেকে শুদ্ধ করার জন্য। বিশুদ্ধ হয়ে সবকিছু বিশুদ্ধ করার জন্য। পরিশুদ্ধ কিছু দিতে। লিটল ম্যাগাজিন আমার কাছে প্রতিভার স্ফুরণ কেন্দ্র। নিজের কোয়ালিটির জন্য উপযুক্ত প্লাটফর্ম। লিটল ম্যাগাজিনবোধ আমার মধ্যে কোনো গজিয়ে ওঠা ভূঁইফোড় ব্যাপার নয়। আমি সত্তা দিয়ে অনুভব করেছি লিটল ম্যাগাজিনের অনিবার্য প্রয়োজন। প্রথমে যখন লিখতাম তখন লিটল ম্যাগাজিন তেমন চিনতাম না। 'সংবেদ' বেরুলো, লিখে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতাম, লিখতাম। সবচেয়ে বেশি লিখেছি-তোমার-হাবিব ওয়াহিদের 'অনিন্দ্য' তে, তবে এখানে বেশ কয়েক সংখ্যা পরে যুক্ত হই। 'সংবেদ' এর পারভেজ ও মিঠু, দুই বন্ধু, বই বের করার পর কাগজটি বন্ধ করে দিল। একদিন কারণ জানতে চাইলে বলেছিল, ওদের বই বেরিয়েছে বলে নাকি বড় কাগজে যাওয়া দরকার। জাতীয় মানের ব্যাপার স্যাপার আর কি। এইভাবে কেউ লাফ মারলো, পা ভাঙলো কিনা বলার দরকার নাই। কিন্তু 'অনিন্দ্য'র শিবলী রইল। 'গান্ডীব' বেরুবার পর আজও আছে। ভণ্ডামিপূর্ণ কাগজ হ'তে প্রত্যাহার করার পর প্রথমে লিখতাম, যেখানে লিখে স্বাচ্ছন্দ্য রয়েছে সেই কাগজে। এইসব কাগজগুলোর মধ্যে অনেকে ঝরে গেলেও বাকিরা ক্রমে হয়ে উঠছে লিটল ম্যাগাজিন। ফাইনাল করে ফেলেছে নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়া। আমিও নিজেকে পরখ করা শেষে আশ্রয় খুঁজে নিচ্ছি একমাত্র অনিবার্য লিটল ম্যাগাজিনে। লিটল ম্যাগাজিন চেতনা ক্রমিক কেলাসিত হওয়ার মত ব্যাপার, কোথাও হতে আমদানী করা নয়। লেখক হিসেবে আমি যেমন, তেমনি আমার প্রিয় এই কাগজগুলোও লিটল ম্যাগাজিন চেতনায় ক্রমে ক্রমে কেলাসিত হয়ে স্ফটিকের মত স্বচ্ছ রূপ গ্রহণ করে নিচ্ছে। আমার এবং এই কাগজগুলোর অভিযাত্রাকে সমান্তরাল হিসেবেই মনে করি। লেখক ও পত্রিকা, যাকে বলা যায়, হ্যাঁ উভয়েই পরিশ্রুত হচ্ছে। লিটল ম্যাগাজিনকে আমি আমার অস্তিত্বের জন্য জরুরী হিসেবেই দেখে থাকি। এখানে ফ্যাশন করার কোনো অবকাশ নাই। ফ্যাশন মারানোর অন্য অনেক জায়গা আছে। লিটল ম্যাগাজিনে চাতুর্যের কোনো স্থান নাই। তবে কেউ কেউ অনেকেই যে লিটল
ম্যাগাজিন করাকে ফ্যাশন করার মত নিচ্ছে, এই কথাটা মোটেও উড়িয়ে দিচ্ছি না। এই সকল কৃত্রিম লিটল ম্যাগাজিন আবেগ প্রকৃত লিটল ম্যাগাজিনের কাজকে বিভ্রান্ত করছে জনগণের সামনে। অবশ্য অচিরেই এদের মুখোশ খুলে যাবেই, প্রকৃত সত্যের উপর দাঁড়িয়ে এই বিশ্বাস আমার রয়েছে। নিজের লেখা আমার কাছে সন্তানতুল্য। সন্তানকে যেমন যে কোনো স্কুলে ভর্তি করিয়ে শিক্ষিত করে তুলতে চায় না সজাগ পিতা-মাতা, আমিও চাই না আমার গল্প প্রকাশিত হোক অসৎ সঙ্গে যেনতেন কাগজে। তাই লিটল ম্যাগাজিন। সাহিত্যকে বাণিজ্য বেসাতির জিনিস না মনে করলে লিটল ম্যাগাজিনের দুয়ার দিয়ে যেতেই হবে।

প্রশ্নঃ আপনার লেখার ফর্মকে আমি একধরনের আরোপিত স্টাইল বলে মনে করি। মনে হয় আপনি জোর করে আপনার
লেখা গল্পগুলোর ওপর অযথা রং চড়াতে চাইছেন, যে রংয়ের মূল্য নেই কোনো। এ ব্যাপারে আপনার কি মত?

উত্তর :আমার লেখা গল্পগুলোর প্রসঙ্গে এধরনের কথাবার্তা নানাভাবে আকারে-বিকারে বারবার উচ্চারিত। এই প্রশ্নের জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। বুঝতে পারছি, আমার লেখাগুলো কারো কারো কাছে প্রচণ্ডভাবে মিস আণ্ডারস্টুড হয়ে আছে। অনেকেই গল্পগুলোর অগ্রসরতা সঠিকভাবে স্পর্শ করতে অপারগ। এখানে আমার বলার কিছু নেই। শুধু বুঝি পাঠককে আরোও সাহিত্য সচেতন, বহুমাত্রিক এবং শুধু গল্প পাঠ করার জন্যই ক্রিয়েটিভ হয়ে উঠতে হবে। বর্তমান গল্পকারদের মনোজাগতিকতা আবিষ্কার করে, গল্পের ভেতর সরাসরিভাবে পাঠকের শ্রমযুক্ত অংশগ্রহণের মাধ্যমে বুঝে নিতে হবে সাম্প্রতিক সকল প্রকার ইন্টারপ্রিটেশন ;মনে রাখতে হবে, প্রাচীন আমলের রোমান্টিকধর্মী সাহিত্য, একরৈখিক সরল কাহিনীর যুগ পার হয়ে এসেছি আমরা। আগের আমল হতে বর্তমান সময় বিস্তর পাল্টে গেছে। অর্থনীতি-রাজনীতি-সমাজনীতি ইত্যাদি প্রচন্ড গতিতে বদলে যাচ্ছে। বিজ্ঞানের চূড়ান্ত অগ্রগতি মানুষের অনেক দরজা খুলে দিলেও মানুষকে অনেক সংকুচিতও করছে। জীবন ধারণে কুণ্ঠিত করছে। এইরকম এক প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে এখনকার গল্পের সৃষ্টি। শিল্পের কাছে শুধু নিবেদিত থাকার কথা এখন মূল্যহীন, ভ্রান্ত। গল্পলেখক এখন বর্তমানের ব্যাখ্যাকার, ধারাভাষ্যকার, চিকিৎসক–গল্প ও গল্পকার শুধুমাত্র বিষয়বস্তু বা বেধে দেয়া কোনো সীমারেখার মধ্যে নাই, থাকতে পারেন না। একজন লেখক তার দৃষ্টিকে একটি নির্দিষ্ট ছকের মধ্যে আটকে রাখতে পারছেন না। তার পর্যবেক্ষণ এখন বহুমাত্রিক ও সংঘর্ষপরায়ন। আসলে মানুষে-মানুষে, কারণে-কারণে, ইন্টারএকশন নিয়েই তো গল্প। তলিয়ে এখানে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে বিচিত্র সব উপাদান। ফলে বিশ্বস্ত উপস্থাপনার জন্য লেখকের ক্ষেত্রে অবধারিত হয়ে আসছে নতুন-নতুন ফর্মের সংযোজন। তাতেও সম্পূর্ণ প্রকাশ হয় না। গল্পকার সব কথা তুলে ধরার অক্ষমতায় মুখ থুবড়ে পড়ছেন। আবার লিখছেন, নতুন একটি করে ফর্ম পরীক্ষাগারে বিকাশ পাচ্ছে। গল্পকার, এখন ব্যাপকতার ধারক হিসেবেই প্রয়োজনীয় ফর্মটি বিন্যস্ত করছেন। বিষয়বস্তুও সম্পূর্ণভাবে উন্মোচিত করার অন্তর্গত আর্তনাদই ফর্ম নির্ধারণ করে। অযৌক্তিক প্রয়োগ অর্থে আরোপ করা স্টাইল হিসেবে আমার গল্পের ফর্ম কখনই মূর্ত হয়ে ওঠেনি। আমার নিজস্ব থটপ্রসেস অনুযায়ী গল্প লিখিত হয়েছে, আর তাতেই উঠে এসেছে অনিবার্যভাবে বিভিন্ন গল্পের বিভিন্ন ফর্ম। আমি কোনো গল্পই একই ধাঁচে–ভাষা বা ফর্মে লিখিনি। সূক্ষ্ণ হলেও পার্থক্য আছে। কোয়ালিটিসম্পন্ন পাঠক মাত্রই বুঝবেন। আর, আমি যে কোনো ক্ষেত্রেই অধিক মাত্রায় একসট্রেমিষ্ট। কি শব্দ নির্বাচনে, ভাষা নির্মাণে। কিন্তু অযথা গল্পে বেশি রং চড়ানোর পক্ষপাতী নই, যদি গল্পকে চিত্রকলার সঙ্গে তুলনা করি। বরং, আমি গল্পে, স্কেলিটনের ওপর মাংশযোগ করে, রক্তসঞ্চালনের মাধ্যমে, অনুভূতি দিয়ে তাকে জীবন্ত করে তুলি। আমার কাছে গল্পলেখক আর ঈশ্বরের মধ্যে কোনো পার্থক্য নাই। 

প্রশ্নঃ অনেকে বলে থাকেন আপনি কমলকুমার মজুমদারের গদ্যরীতিতে আক্রান্ত। এটা কি সত্যি?

উত্তরঃ কমলকুমারের গদ্যরীতিতে আমি কখনও আক্রান্ত নই। বরং বলা যেতে পারে আগেরকাল হতে শুরু করে হালনাগাদ অধিকাংশ বেড়ে ওঠা ও তথাকথিত প্রতিষ্ঠিত লেখকদের আলগা, কষহীন চটুল, পরগাছাসুলভ বালগদ্যরীতি জনিত কারণেই বর্তমানের এইগদ্যের পতনে মারাত্মক আতংকিত আমি। হয়ত, বাবু কমলকুমারও সেইটা একদা বুঝতে পেরেছিলেন। মনে পড়ে তিনি লিখেছেন: কত বিবিধ ইতরোমির মধ্যে বসিয়া এই লেখা লিখিতেছি তাহা ভগবান জানেন না। –কমলকুমারের সঙ্গে মিল হতে পারে একটাই, আমি একই পথ পরিক্রমণ করছি। তাঁকে যেমন প্রচলিত গদ্যের পতিতদশা ক্ষুব্ধ করতে পারে, একইভাবে আমি কেনো যে কোনো সচেতন গদ্যকারকে বহুল ব্যবহৃত সাহিত্যরীতির হতাশাজনক রূপ মারাত্মক আক্রমণাত্মক প্রতিবাদী বিদ্রোহী করে তুলতে অনিবার্যভাবে বাধ্য। প্রথাসিদ্ধ কোনো ব্যাপার আমার কাছে হারাম মনে হয়। তো, কমলকুমারকে বাক্যবানের নানা চাতুর্বে এ পর্যন্ত কম বিদ্ধ করা হয় নাই। বলা হয়েছে, ভাষায় তিনি এলিটিস্ট এবং বিষয়বস্তুতে নাকি পপুলিস্ট। বলা হয়েছে, হিন্দু ঐতিহ্যবাদী আর ব্রাহ্মণ্য বিলাসী হিসেবে তিনি অন্যতম। তিনি নাকি সিজোফ্রেনিক গল্প লিখিয়ে এবং তাঁর নাকি ভাষা বিষয়বস্তু অ-সামঞ্জস্যপূর্ণ। তাঁকে শুধু আঙ্গিক বিলাসী হিসেবেও চিহ্নিত করা হয়েছে। সামাজিক ভিত্তিহীনতা, জীবনবিমুখতা, উন্নাসিকতা, সাধারণ মানুষকে উপেক্ষা করার মত অভিযোগও বিদ্যমান। এমন আরও অজস্রকথা, খণ্ডিত বিচার তাঁর সম্পর্কে রয়েছে। ঠিক একইভাবে, এখানেও, বর্তমানে লব্ধ ধ্বস্ত, ধারহীন, পতিত, গতানুগতিক প্রাণহীন গদ্যরীতিকে নসাৎ করে নতুন কোনো স্বতন্ত্র ধারা নির্মাণে বাধ্য হওয়ামাত্রই আমার ও অপরাপর সহগামীদের ওপর প্রচলধারার অভ্যস্ত ও দাসানুদাসদের আক্রমণের খড়গ অনুরূপভাবে উচাটন। আমাদের এখানে প্রচলিত ভাষা গৎ এর মধ্যে আবিষ্ট যারা কমলকুমার সংক্রমণের ভিত্তিহীন অভিযোগ করছে, তাদের মেধা-মনন সম্পর্কে সন্দেহ রয়েছে আমার। এরা অত্যন্ত নিম্নমানের মেধাধারী, একের সঙ্গে অন্যকে ভ্রান্তভাবে জুড়ে দিয়েই ক্ষান্ত। কমলকুমার, তারল্য উদ্ভাসিত গদ্যের বিরুদ্ধে স্রোত নির্মাণ করতে গিয়ে, বাংলাগদ্যের আদ্যন্ত ধারাবাহিক অনুসরণ করে, নিজস্ব চিন্তা যুক্ত করে অগ্রসর হয়েছেন। বিদ্যাসাগরের ভাষার সুক্ষ্মতা তাঁর কাছে আকর্ষণীয় ছিল। মিশনারী যুগের গদ্যের আদি চর্চা হাতে উপাদানসমূহ গ্রহণ করেছিলেন, ভাষাচিন্তায় নিজের মধ্যে। বঙ্কিমের ভাষার কাব্য সম্ভাবনাও পছন্দনীয় ছিল। এক্ষেত্রে ফলে তাঁকে প্রাক্তনদের দ্বারা আক্রান্ত বলে অভিযোগটি করা সম্পূর্ণ অবান্তর বলে মনে করি। আশা করি, আমি যা বলতে চাচ্ছি, তা বুঝতে পেরেছেন নিশ্চয়ই। আমি আমাদের এখানের গদ্যরীতিকে এক ধরনের সাংবাদিক সুলত ফিচারধর্মী ভাষাব্যবস্থা হিসেবে সনাক্ত করি এবং নিজেকে বিচ্ছিন্ন করতে চাই। ট্রাডিশনকে তন্নতন্ন  করে অনুসন্ধান করছি। তাৎপর্যপূর্ণ মৌলিক উপাদান গুলি সৃজনশীল গদ্যরীতিতে যুক্ত করা প্রয়োজনীয় বলে বিবেচনা রাখি। সাধারণতঃ বিষয়বস্তু অনুযায়ী গদ্যরীতি নির্ধারিত হয় এবং সেজন্য তরল গদ্যও লেখা যেতে পারে। কিন্তু শুধুমাত্র তরলগদ্য আর তরল বিষয়বস্তুরই সাহিত্য হবে এটা মানা যায় না। অথচ এটা প্রধান প্রচলস্রোত ধারা হয়ে উঠেছে। এইভাবে দেখারও চেষ্টা চলছে, যা সত্যিই দূর্ভাগ্যজনক। আমি বাংলা সাহিত্যের গোড়ার বড় তাৎপর্যপূর্ণ প্রবণতাগুলি আবিষ্কারের চেষ্টা করছি।
অভিজ্ঞতা অর্জনের সঙ্গে ভাষা নিরীক্ষাও চলছে আমার। তবে এ পর্যায়ে এখনও নবীশ। কমলকুমার মজুমদার একজন অসমবয়সী, অন্তরঙ্গ প্রতিবেশী মাত্র, তার বেশি নয়। 

প্রশ্নঃ আপনার লেখায় আনে কোনো পাঠক আছে কি?

উত্তরঃ পাঠক প্রসঙ্গে আমার নিজস্ব একটি জোক আছে। বলি, যাদের কেবল পাঠক হওয়ার যোগ্যতা ছিল, তারা সকলেই লেখক হিসেবে সীল যোগ করেছে। কি অবস্থা!জাতির উদ্দেশ্যে সকলেই লেখক হতে চায় এখন। যাক, আমি পাঠকের পরিমাপ করতে পারি নাই। কারণ আছে। ধরুন, এই যে গতসংখ্যা 'অনিন্দ্য' সব বিক্রী হয়ে গেল, এখন খুঁজে পাচ্ছি না, তো পাঠকরাই তো কিনেছেন। কিন্তু এমন কি হয়েছে যে, পাঠকরা কাগজটি পড়ার পর ভালোমন্দ জানিয়ে চিঠি লিখেছেন। তারা গালিও দিতে পারতেন। আমাদের এখানে পাঠকরা এমনভাবে সক্রিয় হতে পারেন নি। ফলে পাঠকের কোনো অস্তিত্ব টের পাওয়া যাচ্ছে না। আপনি বলতে পারেন, লেখকরা ঔৎসুক্য সৃষ্টি করতে পারেন নি। কিন্তু এটা বলা ঠিক হবে না। দেখবেন, এমনিই, কোনো অনাচারের বিরুদ্ধেও দু'/চারজন ছাড়া কারুর চিৎকার শোনা যাবে না। সকলেই আদতে যেন নিরাসক্ত এবং নিস্তেজ। অবশ্যই, এই অবস্থায় চাবুকের আঘাত লাগতে সময় লাগবে বই কি। আমি পাঠককে তুচ্ছ জ্ঞান করি না। আমার পাঠকও ইকুইভ্যালেন্ট হবে আমার: এক্ষেত্রে অভাব থাকতে পারে। যথার্থ মিথষ্ক্রিয়ার জন্য, লেখক ও পাঠকের মধ্যে ইকুইভেলেন্সি থাকা প্রয়োজনীয়। 
প্রশ্নঃ নিজের লেখা সম্বন্ধে আপনি কতটুকু আস্থাবান?

উত্তরঃ আমি নিজের ওপর কনফিডেন্ট অবশ্যই। বাকিটা সক্ষমতা। নিজের মধ্যে সবসময় সিনথেসিস করি, পরিশ্রম করার চেষ্টা করি। নিজের প্রতি আমার সবসময় চ্যালেঞ্জ রয়েছে। ফেস করি, সলভ করি, আবার আরেক চ্যালেঞ্জ থ্রো করি। নিজের প্রতি আমি নিষ্ঠুর, ক্ষমাহীন, এবং কোনো ক্ষেত্রেই ছাড় দিতে প্রস্তুত নই কখনই।

প্রশ্নঃ গল্পের মধ্যে বিষয়বস্তু, গদ্যশৈলী, শব্দ নির্বাচন, যতি-চিহ্ন ইত্যাদি প্রয়োজনীয় উপাদানগুলির মধ্যে কোনটার ওপর আপনি বেশি জোর দেন? 

উত্তরঃ দেখুন: গল্পশিল্পের সঙ্গে জড়িত যে কোনো উপাদানকে জরুরী মনে করি। প্রতিটিই নিরবচ্ছিন্ন মনোযোগ দাবী করে। নিরীক্ষারও দরকার রয়েছে। একটির মুখ এঁটে অন্যটি নিয়ে শুধু বাগাড়ম্বর করা যায়। তবে বিষয়বস্তুকে সবসময় মুখ্য ব্যাপার বলে মনে করি না। কীভাবে উপস্থাপন করা যেতে পারে, শব্দের পর শব্দকে কেমনভাবে নাড়াচাড়া করা যায় সেটাও দেখার মত বিষয়। ঊনবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত বিষয়বস্তু– ভাব বিতরণ ও জ্ঞানের জন্য ছিল, এখনও কি সেটা আছে!গদ্যশৈলীর অন্তর্গত উপাদান নির্বাচন,-- বাক্যগঠন, অলংকার প্রয়োগে চূড়ান্ত প্রকাশও দরকার। যতিচিহ্নের ব্যবহারও আরও তাৎপর্যময় হয়ে উঠতে সক্ষম। হাতের কাছের অভিধান গুলো যতিচিহের প্রতিটি যতি সম্পর্কে যে সকল বিধান দেখাচ্ছে, তা খণ্ডিত ও সীমাবদ্ধ। যতিচিহ্নকে চলতিভাবনার বাইরে সুক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম যৌক্তিকভাবে আরও হাজারো ব্যবহারের জন্য নিরীক্ষাপ্রয়াসও অপরিহার্য। নামধাতুর আরও মৌলিক ব্যবহার সম্ভব বাংলাগদ্যে। গল্পশিল্পে সমাস, সন্ধি, ক্রিয়াপদ, পদ ইত্যাদিরও ব্যাপক স্ফূরণ সম্ভব। এছাড়াও অনেক কিছু রয়েছে, যা পুনর্বিবেচনা করা দরকার। ব্যাকরণও সরকারী, তবে তা কখনই গল্পশিল্পকে নিয়ন্ত্রণের অধিকারী হয় না, বরং তাৎপর্য থাকলে সেই অনুযায়ী সাহিত্য হতে ব্যাকরণযুক্তি ঘটতে পারে বলে মনে করি। অন্যান্য মাধ্যমের ব্যবহৃত উপাদান:ইমেজ, মন্তাজ,কম্পোজিশন,ফ্রেম ইত্যাদিও আরও সফল ভাবে গদ্যে আসতে পারার সম্ভাবনা রয়েছে। চিত্রকলায় ব্যবহৃত টোন ও কালারও ভাষার ক্ষেত্রে আসতে পারে, বাবু কমলকুমার এই ব্যাপারে অগ্রসর কিছুটা হয়েছিলেন। গল্পশিল্পের বিকাশে, অশেষ সম্ভাবনায়, কোনো কিছুকেই অপাংক্তেয় বলে মনে করি না। আর, কোনো গল্পে মাত্র একটিই বিষয়বস্তু থাকবে, এটিও সবসময় চূড়ান্ত হতে পারে না। গল্পকাঠামোর প্রতিটি নির্বাচিত শব্দ, কোনো কোনো গঠিত বাক্য, বা ইমেজ, প্রতীক অবশ্যই ভিন্ন -ভিন্ন বিক্ষিপ্ত বিষয়বস্তু হওয়ার যোগ্যতা রাখে তবে সেক্ষেত্রে সৃষ্টি করা বিষয়বস্তু সমূহের মধ্যে একধরনের অন্বয় থাকা দরকার। এসব মূলের সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ ও তাৎপর্যময় হতে হবে নিশ্চয়ই। 

প্রশ্নঃ এদেশে কি ভালো কাজের মূল্যায়ন হয়েছে কখনও কিংবা হচ্ছে কি এখন?

উত্তরঃ এদেশে মানুষের জন্ম হয় শুধু অপমানিত হওয়ার জন্য। এখানে ভাল কাজ, খারাপের সঙ্গে দ্বন্দ্বে ও সংঘর্ষে পরাজিত বারবার। আর, মূল্যায়ন করার ক্ষেত্রে, স্বীকৃতি দেয়ার ব্যাপারে কৃপণতা বরাবর লক্ষণীয় আমাদের চারিদিকে। তবে হ্যাঁ, হুজুগ আছে। কোনো ব্যাপারে কাউকে নিয়ে সাড়া পড়লো তো হৈ হৈ রৈ রৈ কাণ্ড, একেবারে মাতম শুরু হয়ে যায়। ধোপদুরস্ত ব্যাপারেই এসব বেশি জোটে। কিন্তু যাঁরা সত্যিকারের ডেডিকেটেড, কমিটেড, ত্যাগী ব্যক্তিত্ব তাঁদের ক্ষেত্রে অবহেলা, উপেক্ষা সীমাহীন। আসলে তখন আয়নার মধ্যে আমাদের স্বার্থপরতা দেখে কুণ্ঠিত হই, তাই উন্মাসিকও হই। আমাদের সকলের চোখ স্বার্থপরতায়, আত্মসিদ্ধিতে এতটাই অন্ধ থাকে যে, কাউকে মূল্যায়ন করতেও চাই না, এমনকি সমর্থনও জানাই না। আমার বন্ধু সত্যজিৎ দে সরকারের বাবা ছিলেন শ্রী সাধন সরকার। একজন নিভৃত সঙ্গীতজ্ঞ –এই ব্যক্তিত্বের কথাই ধরা যাক, তিনি প্রয়াত হয়েছেন। জীবদ্দশায় তাঁর জন্য শুধু বরাদ্দ ছিল উপেক্ষা। তিনি শিল্প প্রেমিক হিসেবে সকলের মত পত্রিকার পাতায়, কি প্রচার মাধ্যমে সোচ্চার ছিলেন না। আমাকে দেখুন -আমাকে দেখুন বলে ধান্ধাবাজ ছিলেন না। তিনি ছিলেন একজন নিরব যোদ্ধা। মৃত্যুর পর শুধু তাঁকে নিয়ে কিছু মিছু লেখা হল, কিন্তু গভীর মূল্যায়ন কোনো পাওয়া গেল না। ধীরে তিনি বন্ধুদের উচ্চারণ হতেও হারিয়ে মুছে যাবেন, কোনো রাষ্ট্রীয় সম্মাননাও হয় তো থাকবে না। কায়েস আহমেদ, সাহিত্য বিক্রী করতে পারলেন না। অর্থকষ্টে বিধ্বস্ত হলেন। আত্মহত্যা করলেন। তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের চিত্র শুধু কাগজের পাতায় সেন্টিমেন্টাল নিউজ হিসেবে এলো, প্রবন্ধ নিবন্ধ ফাঁদা হল। লেখককে করুণার পাল্লায় তোলা হল। কিন্তু তাঁর রচিত বই, তাঁর সৃষ্টি, পাঠক সমক্ষে অবহেলিত। মাথাচাড়া দিয়ে লোক দেখানো ভাবে তাঁর উদ্দেশ্যে নিবেদিত সংখ্যা বের করার কৃতিত্ব নিতে শুরু করলো পেটেন্ট মতলববাজরা। অসৎ ব্যক্তিদের হাতে সংব্যক্তিত্ব চরিত্র হারাচ্ছে এইভাবে বাংলাদেশে আধুনিক সৎ চলচ্চিত্র দেখানো শেখালেন মুহাম্মদ খসরু। কিন্তু পেলেন শুধুমাত্র গলাধাক্কাএবং চূড়ান্ত অস্বীকৃতি। কামাল বিন মাহতাব, ষাট দশকের গল্পকারদের বিকাশে সাহায্য করলেন। 'ছোটগল্প' নামের কাগজের মাধ্যমে। অথচ তিনি আজ অদ্ভুতভাবে লোকচক্ষুর অন্তরালে। তিনি নিঃশব্দ যোদ্ধা হলেও তাঁকে নিয়ে কোনো মূল্যায়ন অনুপস্থিত। সকলেই আখের গুছিয়ে, ঘাড়ে কাঠাল ভেঙ্গে 'কিছু একটা' হয়ে গেছে আজ। কমরেড রতন সেনকে নিয়ে ছোট শহরই কেবল দুঃখিত ও আলোড়িত। অথচ সফিস্টিকেটেড কমরেডকে নিয়ে সারাদেশ কি রকম হামলে পড়েছিল। কি অবস্থা। ঘেন্না ধরে গেল। বর্তমান প্রজন্মের বা আগামী প্রজন্মের চোখ খোলা দরকার। দৃষ্টিভঙ্গির স্বচ্ছতা আসা দরকার। অবশ্য 'অনিন্দ্য' কাউকে কাউকে অকৃত্রিম শ্রদ্ধা নিবেদন করেছে এটা ঠিক। একের প্রতি অপরের পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ থাকা দরকার। নির্দিষ্ট, স্বচ্ছ, পরিষ্কার মূল্যায়ন থাকা প্রয়োজন। এই সুস্থ ব্যাপারে একটি ঐতিহ্য গড়ে ওঠা দরকার। তবে বিষাক্ত ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে এই কথা বলি না। আমার ভাবতে খুব খারাপ লাগে যে, এই দেশে, কোনো বীর নাই। যাঁরা বীর ছিলেন আমরা তাঁদের হত্যা করেছি। অপমান করেছি। জাতি তাই ছোট হয়েই থাকে। জাতির জীবন হ'তে শ্রদ্ধাজ্ঞাপনপর্ব যেন আত্মসাৎ হয়ে গেছে বলে মনে করি। 

প্রশ্ন: নারী সম্পর্কে আপনার ব্যক্তগত ধারনা কী?ব্যক্তিগতভাবে আমি একজন সাহিত্যিকের জীবনে নারীসঙ্গকে বিপজ্জনক বলে মনে করি।আপনি কী বলেন?

উত্তরঃ নারী সম্পর্কে ব্যক্তিগত ভাবে আমি নেতিবাদী নই। এই প্রসঙ্গে নিজের কথা বলি। নারী সুযোগ আমার বেশি হয় নাই। শৈশবে, শুরুর যৌবনে এ ব্যাপারে কিছু আলোড়ন থাকলেও সব যেন বুদবুদের মত। তারপর অনেকটা সময় পর্যন্ত স্বভাবত অনুৎসাহ ছিল। রাফ আর উদাসীন ছিলাম এ সম্পর্কে। বহুদিন নীরবতার পর ফরিদা হাফিজের সঙ্গে দেখা। তাকে নিয়ে আলোড়ন আমার। ফরিদার সঙ্গে আকস্মিকভাবে যৌথজীবন যাপনের অঙ্গীকারে আবদ্ধ হই। সালটা ছিল ১৯৮৮, সেই থেকে আমরা একত্র। তার কাছ থেকে আমি ব্যক্তিত্বময় সাহচর্য, সহৃদয় সর্বময় বোঝাপড়া, মমতাময় বন্ধুর হাত, সহিষ্ণুতা, কড়া সমালোচনা পেয়েছি। তবে তার জন্য আমি কতটা ভূমিকা রাখতে পেরেছি সেটা অবশ্য বড় প্রশ্নবোধক। মাঝে মাঝে সংসারের নিয়মে সম্পর্ক বৈরী হয়ে ওঠে। তখন নিজেদেরপরিষ্কার করে নেই। নমনীয় হই। আবার সব কিছু ঝাঁলিয়ে নেই আমরা। শেষ পর্যন্ত নারী কেনো কেউ আমার কাছে বিপর্যয়ের কারণ হয়ে ওঠে নাই। আমি মনে করি, শুধু কোনো ব্যক্তিই নয়, একজন লেখকের জন্য তাঁর পেশা বা কর্মক্ষেত্র ও তার পরিবেশ বিপদজনক ও দ্বন্দ্ব মুখর হয়ে উঠতে পারে। লেখককে ধীরে অচল করে নিতে পারে। আমি এটাকে বেশি অনুভব করি।।

প্রশ্নঃ সেক্স সম্পর্কে আপনার অভিমত কি?

উত্তরঃ সেক্স একটি অত্যন্ত প্রয়োজনীয় অংশ। সেক্সও শিল্প হতে পারে। অপরিমিত সেক্সের ব্যবহার আনন্দকে ম্লান করে তোলে এবং ব্যাপারটা অভ্যাসে পর্যবসিত হয় মাত্র। সেক্স তখন সৌন্দর্য ও আকর্ষণ হারায়। সেক্সকে পানসে করা চলবে না। মানসিক সমন্বয় সেক্সের সময় অতিরিক্ত আনন্দ নিতে পারে। সেক্সের সময় যতটা সম্ভব ফ্রি হওয়া দরকার। সেক্স গভীরভাবে উপলব্ধি করার বিষয়। এটা আমি মানি- সেক্স সম্পর্কের ক্ষেত্রে একধরনের শুশ্রূষাও বটে।

[দ্রষ্টব্য, ১৯৯৫]

দ্বি তী য়  বৈ ঠ ক
সাক্ষাৎকার গ্রহণ: কামরুল হুদা পথিক (সম্পাদক, দ্রষ্টব্য)

প্রশ্নঃ আপনার জ্যোৎস্নাচারী, অলৌকিক সংবাদ, অবনত ধারাপাত, কিংবা সুপ্রভাত গল্পগুলোকে কিভাবে মূল্যায়ন করেন? এ লেখাগুলো আগের বলে কি এগুলো অপেক্ষাকৃত সাধারণ মনে হয়?

উত্তরঃ আমার কোনো লেখাকেই সামান্য মনে করি না। অন্তত নিজের প্রতিটি লেখা সম্পর্কে এরকমই আমার ধারণা। জ্যোৎস্নাচারী এবং অলৌকিক সংবাদ '৮৫-৮৬ সালে লেখা আর অবনত ধারাপাত, সুপ্রভাত- এ দুটো লিখেছিলাম '৯০-৯১ এর দিকে। আমি প্রতিটি গল্প লিখতে গিয়ে কিছু কিছু শিখি, যা অন্য পরবর্তী গল্পে উঠে আসে। প্রথম দিককার গল্প হিসেবে অলৌকিক সংবাদ এবং জ্যোৎস্নাচারী-দু'টাই প্রিয়। সুপ্রভাত একটি পুনলিখিত গল্প- দ্বিতীয় বার লেখার সময় স্যাটায়ারের যথেচ্ছ সুযোগ নিয়েছি। অবনত ধারাপাত গল্পেও একটি চাপা স্যাটায়ার আছে। এ গল্পগুলো লিখতে আমার খারাপ লাগেনি। আসলে লেখকের পক্ষে তার নিজের গল্প মূল্যায়ন করা একটু দুরূহ হয়ে যায়। প্রতিটি লেখাই তার সন্তানের মতো, কাউকে এখানে ছোট-বড় করা যায় না।
প্রশ্নঃ শেষ দিবস উদ্‌যাপন ও একটি রিপোর্ট, অন্ধকারে মোম গলে, আক্ৰন্দন হৃৎ যাত্রা, কিংবা অথবা ইন্দ্রজাল গল্পগুলো কি কমলকুমারীয় ঢং এ লিখেছেন বলে আপনি মনে করেন?

উত্তরঃ খুচরা মন্তব্য প্রায়ই শুনি। তাই বলছি আসলে এ রকম মন্তব্য করার আগে সকলের উচিত আবার কমলকুমার শুদ্ধ করে পাঠ আর আমার গল্পের ক্ষেত্রে ন্যূনতম মর্যাদা হিসেবে দ্বিতীয়বার পড়া। ভাষার উপরে একটু ধারাবাহিক ইতিহাস পড়ার দরকার আছে। যারা Details-এ যাবেন লক্ষ্য করতে বাধ্য হবেন আমাদের ভাষার প্রবণতা কোনদিকে হওয়া উচিত। তাছাড়া বিষয়বস্তু ভাষাকে নির্ধারণ করে ফেলে- এটা ভুলে গেলে চলবে না।

প্রশ্নঃ সুবিমল মিত্রের লেখা আপনার কেমন লাগে? তার লেখা আপনার গল্পকে কি প্রভাবিত করেছে বলে আপনি মনে করেন ?

উত্তরঃ সুবিমল বাংলা সাহিত্যে ফেলে নেয়ার মতো কোনো লেখক নন। তার লেখার উত্তাপ অকৃত্রিম। তার একটা নিজস্ব ভঙ্গী আছে যা তিনি অর্জন করেছেন। প্রতিটি লেখক একটি নিজস্ব পথ নিয়ে অগ্রসর হন– সে পথটাকে না চিনলে এবং লিখে গেলে আরোপিত প্রচেষ্টা হিসেবে লক্ষণাক্রান্ত হতে হয়। আবার কোনো গল্পের বিষয়বস্তুকে যদি সুবিমলের চোখ নিয়ে দেখা শুরু করলেই একই রকম হওয়ার সম্ভাবনা আছে। সেটাও আরেকটা অর্জনের মত ব্যাপার। আমি আমার নিজের পথকে যথেষ্ট মনে করি। তারপর গ্রহণ বর্জন করা যেতে পারে।

প্রশ্নঃ অলৌকিক সংবাদ গল্পে আপনি পেটের ক্ষুধা থেকে যৌনক্ষুধাকে প্রাধান্য দিয়েছেন। আপনি বিষয়টি কোন দৃষ্টিতে দেখছেন? 

উত্তর: আমার কাছে ক্ষুধা ব্যাপারটাই তীব্র। যৌনতা আর ক্ষুন্নিবৃত্তি কোনো ভেদাভেদ নাই; দুধরনের ক্ষুধাই বড়ো স্পষ্ট মানব জীবনে। একটি স্বীকার আর অন্যটাকে অস্বীকার সত্যবিরোধী।

প্রশ্নঃ আপনি কি কল্পগল্প অথবা টাল হয়ে ফাংফুং ও বস্ত্রহীন প্রতিবিম্ব–এদুটো ছাড়া অন্য কোনো স্যাটায়ারমূলক গল্প লিখেছেন?
এগুলোকে আপনি স্যাটায়ার না ফ্যান্টাসী বলবেন?

উত্তরঃ এদু'টো গল্প ছাড়াও স্যাটায়ারমূলক গল্প লিখেছি আমি। বলা যেতে পারে নুরুল এসলামের ইন্তেকাল ক্ষুন্নিবৃত্তি; সুপ্রভাত এ রকম গল্পের কথা। হ্যাঁ গল্প গুলোতে স্যাটায়ারের পাশাপাশি গল্পের বাস্তবতার ভূমিতে ফ্যান্টাসীর হাত পড়েছে। ফ্যান্টাসী বাস্তবতাকে কেন্দ্র করেই দেখা দিয়েছে। এ রকম গল্প লিখে আমার আনন্দ থাকে।

প্রশ্নঃ চোখ বিষয়ে গল্পে আপনি কি করতে চেয়েছেন? এটা কি একটি ব্যক্তিজীবনের দৈনদ্দিন অভিজ্ঞতা?

উত্তর: চোখ বিষয়ে গল্পটিতে কোনো প্রধান চরিত্র নামক তথাকথিত বস্তু ছিলো ন। একজোড়া চোখ
ছিলো শুধু। সে চোখ দেখে গেছে। আর তা অক্ষরে সাজানোটাই ছিল কেবল কাজ। এটা একটা অন্য
ধরনের নিরীক্ষা ছিল। একজন লোক হেটে যাচ্ছে, নানা কিছু দেখছে, কিন্তু চোখের অভিজ্ঞতা কেবল লেখা হয়েছে। এই চোখ যেন ক্যামেরার। 

প্রশ্নঃ আগুনের বিপদ আপদ কিংবা আগুনৰাজ গল্পগুলোতে আপনি কোনো প্রচলিত তথ্যকে কেন্দ্র করে আবর্তন করেছেন?আপনি কি এ প্রচলিত তথ্যসমূহ আসাকে অনিবার্য মনে করেন?

উত্তরঃ আসলে কোনো তথ্য পরিবেশন করা গল্পগুলোর প্রধান উদ্দেশ্য ছিল না। বীজ থেকে বৃক্ষের সৃষ্টি হলে বৃক্ষটাই বিবেচ্য, বীজ হচ্ছে স্মৃতি। আর বৃক্ষটা নিয়েই কেবল আমরা আলোচনা করতে পারি।
আমার কাছে কিছু তথ্য ছিলো ঠিকই। ছিলো পর্যবেক্ষণ আর পর্যটন। এ থেকে যা আত্মস্থ করি সেটাকে নিজের মতো করে ব্যবহারে অকপট থাকা উচিত। আসলে একটি শিকারের গল্পের কথা যদি ভাবি তবে তীরধনুক এবং সিংহের ব্যাপারে ধারণা ও অভিজ্ঞতা জরুরী। কিন্তু এ দু'টোকে সমন্বয় করে শিকারের কাহিনী রচনা শিল্প কল্পনাপ্রসূত।

প্রশ্নঃ আপনি কি মনে করেন বাংলাদেশে এসময়ের অন্য গল্পকারদের থেকে আপনার অবস্থান আলাদা?

উত্তরঃ আমার পাঠক যাদেরকে আমি মেধায় আমার সমকক্ষ মনে করি তারা এ প্রশ্নের ভালো জবাব দিতে পারবেন। এই ক্ষেত্রে একটু বিনয় করে নিজের ঢোল নিজে আর নাই বা বাজালাম। গল্প সম্পর্কে অপগন্ড সাহিত্যবাজদের বক্তব্য রাখার কোনো এখতিয়ার নাই। 

আপনার গল্প পড়ে মনে হচ্ছে, এখন আপনার লেখায় আবার একটা বাঁক নিতে যাচ্ছে। এ বিষয়ে আপনার মন্তব্য?

উত্তরঃ এ যাবত লিখিত গল্পে সবমিলিয়ে দু'বার বাঁক নেয়ার ব্যাপারটা ঘটেছে। আমি বর্তমানে লক্ষ্য করছি যে গল্পগুলোতে আরেকটা বাঁক নেয়ার প্রক্রিয়া নিজের অজান্তেই ঘটে যাচ্ছে। অবশ্য এক শ্রেণীর গো পাঠক যারা কমলকমল করে আবিষ্কারের আনন্দে আত্মতৃপ্তির Masterbation করছেন তারা এসেব কতোখানি লক্ষ্য করবেন তা নিয়ে আমার প্রশ্ন আছে। আমাদের সমালোচনা কাঠামো এক শ্রেণীর অশিক্ষিত ও অমেধাবী মনুষ্যজীবের করতলগত –তারা যা কিছু করতে পারেন, বলতে পারেন। এসব বলা- টলায় তারা বীর্যপাতের মতই আনন্দ পান। আমাদের পত্রিকাঅলারা সেগুলো ছাপেন আর ততোধিক মস্তিষ্কহীন পাঠকরা সেগুলো পড়ে। ফলে মূর্খদের বাজারে এক ধরনের ধোঁয়া উড়ে। ঐ ধোঁয়া শুকে আসল সাহিত্য, তার লক্ষণ, প্রবণতা, বিষয়-আশয় অনুধাবন করা যাবে না। হ্যাঁ আমি রিয়াজ যা বলছি, আমি গল্প লিখে রক্তাক্ত হয়েছি, ক্ষত-বিক্ষত হয়েছি। আমি গল্প লিখতে লিখতে অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে পথ পরিক্রম করেছি। গল্প সম্পর্কে বলার অধিকার কেবল আমারই আছে। আমাদের এখানে মিডল ক্লাশ সাহিত্যবাজরা সমালোচনার কুকর্মটি করে। এ অবস্থার পাছায় লাথি মারা দরকার। গল্পের উপরে কথা বলার জন্য গদ্যকারদের দায়িত্বের কথা আমি জোর দিয়ে স্বীকার করি। এ রকম না হলে আমাদের গল্পে যত বাঁক ঘটে যাক না কেনো তা নিভৃতেই থেকে যাবে। গল্পকারদের উচিত নিজেদের ঢাক নিজেরদের ফাটানো; দরকার এই মূর্খ, অসুস্থ পরিবেশের জন্য, নিজেদের প্রয়োজনে। তাহলে সৎ পাঠক খোলাসা হতে পারবে বলে মনে করি।

[দ্রষ্টব্য, ১৯৯৫]

মন্তব্য

নাম

অনুবাদ,32,আত্মজীবনী,26,আর্ট-গ্যালারী,1,আলোকচিত্র,1,ই-বুক,7,উৎপলকুমার বসু,23,কবিতা,319,কবিতায় কুড়িগ্রাম,7,কর্মকাণ্ড,15,কার্ল মার্ক্স,1,গল্প,56,ছড়া,1,ছোটগল্প,12,জার্নাল,4,জীবনী,6,দশকথা,24,পাণ্ডুলিপি,10,পুনঃপ্রকাশ,15,পোয়েটিক ফিকশন,1,প্রতিবাদ,1,প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা,4,প্রবন্ধ,153,প্রিন্ট সংখ্যা,4,বর্ষা সংখ্যা,1,বসন্ত,15,বিক্রয়বিভাগ,21,বিবিধ,2,বিবৃতি,1,বিশেষ,23,বুলেটিন,4,বৈশাখ,1,ভাষা-সিরিজ,5,ভিডিও,1,মাসুমুল আলম,35,মুক্তগদ্য,37,মে দিবস,1,যুগপূর্তি,6,রিভিউ,5,লকডাউন,2,শাহেদ শাফায়েত,25,শিশুতোষ,1,সন্দীপ দত্ত,8,সম্পাদকীয়,16,সাক্ষাৎকার,21,সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ,18,সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ,55,সৈয়দ সাখাওয়াৎ,33,স্মৃতিকথা,14,হেমন্ত,1,
ltr
item
বিন্দু | লিটল ম্যাগাজিন: সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ-এর সঙ্গে দুই বৈঠক
সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ-এর সঙ্গে দুই বৈঠক
https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEiQ_SLPx8jtMMnOq8PGfHW9iOovZF4A35RxxmruUDS1YvWU-fBE9lMqJlVDUSqY-D2IQwblF4u8XiVziPfmbnW0jTqYviYVFbaqZWxpjaxh0axe4S0PuzuS6xH7aJZq-fz7dnqBsxpFJv2QsJTOogzvPKsv9KZ1mc94KA-V4sx2HeKvvQ7FrjGAbYY7M7Y/s16000/Syer%20Riazur%20Rashid%20bindumag.png
https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEiQ_SLPx8jtMMnOq8PGfHW9iOovZF4A35RxxmruUDS1YvWU-fBE9lMqJlVDUSqY-D2IQwblF4u8XiVziPfmbnW0jTqYviYVFbaqZWxpjaxh0axe4S0PuzuS6xH7aJZq-fz7dnqBsxpFJv2QsJTOogzvPKsv9KZ1mc94KA-V4sx2HeKvvQ7FrjGAbYY7M7Y/s72-c/Syer%20Riazur%20Rashid%20bindumag.png
বিন্দু | লিটল ম্যাগাজিন
https://www.bindumag.com/2023/11/syed-riazur-rashid-interview-by-habib-wahid--kamrul-huda-pathik.html
https://www.bindumag.com/
https://www.bindumag.com/
https://www.bindumag.com/2023/11/syed-riazur-rashid-interview-by-habib-wahid--kamrul-huda-pathik.html
true
121332834233322352
UTF-8
Loaded All Posts Not found any posts আরো Readmore উত্তর Cancel reply মুছুন By নী PAGES POSTS আরো এই লেখাগুলিও পড়ুন... বিষয় ARCHIVE SEARCH সব লেখা কোন রচনায় খুঁজে পাওয়া গেল না নীড় Sunday Monday Tuesday Wednesday Thursday Friday Saturday Sun Mon Tue Wed Thu Fri Sat January February March April May June July August September October November December Jan Feb Mar Apr May Jun Jul Aug Sep Oct Nov Dec just now 1 minute ago $$1$$ minutes ago 1 hour ago $$1$$ hours ago Yesterday $$1$$ days ago $$1$$ weeks ago more than 5 weeks ago Followers Follow THIS PREMIUM CONTENT IS LOCKED STEP 1: Share to a social network STEP 2: Click the link on your social network Copy All Code Select All Code All codes were copied to your clipboard Can not copy the codes / texts, please press [CTRL]+[C] (or CMD+C with Mac) to copy