সাতচল্লিশে সাতসকালে
খোয়াবে মর্মে
কোলাহল করে চলছিল স্বপ্ন।সেই
স্বপ্নের ভেতর মানুষ গুজে দিয়েছিল নিজেদের।স্বপ্ন-পর্ব নিয়ে এসেছিল উত্তেজনা।
সেখানে, এই যে অপেক্ষমান স্বপ্নবাস —ওখানে,ঐ মুখে ধাপের পর ধাপ দিয়ে উঠে গেছে সিঁড়ি।
উর্ধ্বগামি সিঁড়ির নিচের দিকে অন্ধকার।
যতদূর চোখ যায় হু হু করা বাতাস ও শূন্যতা খুঁজে পেলেও আরো বিস্তৃত চোখ মেলে দেখা শোনা ধাঁতে সয় না— তাকায় না ওপরে ও নীলিমার বুকে পরিলক্ষিত হয় না যে কোনও প্রকার আনাগোনা –কীরূপ সঙ্কেত বহন করে চলেছে!
নীল আকাশের নিচে স্বপ্নতাড়িত মানুষের দল দৌঁড়াচ্ছে কেবল দৌঁড়াচ্ছে।সব চাই তাদের। আকাশের সমান– চাহিবা মাত্র আকাশ এসে নেমে পড়ে –নাগালে গা ঘেঁষে —হেলান দিতে পিঠ পেতে দেবে যেন!
সিঁড়িটায় একটি পাদানি টপকে পরের পাদানির পর আরেকটা পাদানি ছেড়ে অন্যটায় পা রেখে এই ভাবে অন্তহীন যেন এমন যে কতটা গমন সম্ভব –জানা নাই।
আকাশ ফুঁড়ে উঠে যাবার সিঁড়িটি অতিক্রম করতে দেখা মিলবে সেই আকাশ– বড় তাজ্জব,--সেখানে সবুজাকাশে চাঁদতারার পাশে শাদা বর্ডার!
দেশের ভেতর অপর এক দেশ জেগে উঠছিল তখন;
খাঁচার মত দেশটার ভেতর মানুষ ঢুকিয়ে নিয়ে তাদের জন্য স্বপ্নযাত্রার তখন কালাকাল।---মানুষের সিঁড়ি বেয়ে ওঠা ;স্বপ্লের ভেতর বিরচিত স্বপ্নের ঘোর লাগা উদযাপন তাদের।
অলক্ষ্যে কেউ হাসলো, –চোখে ধরা পড়ে না;বেশুমার উল্লাস শুধু চারদিকে–আলোড়ন দিশাহারা
মু মে বিড়ি
হাত মে পান
লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান।
পাখির পালকে রক্ত তবু পাখা ঝাঁপটানো উড়ান।
জাগরূক স্বপ্নটা কাঁচা ঘুম ভাঙলে যেমন মনে করলে কুড়িয়ে পাওয়া স্বপ্নের ভেতর যা ছিল নির্মিতব্য –অনেকটা দাগ গভীর আর বাকিটা আবছা–অথচ থেকে যায় ঐ বাকিটা মনে করার প্রাণপাত খোঁচাখুঁচি –তাড়না।
তাড়নাকারী নিজেই তখন সে –উদ্যাম;দেখাটা না-দেখা যাবার পর সেই দিকে পিছুপিছু অনুসরন।
ভারি মুসিবৎ।অস্মৃতিহীনতায় সমাধানকল্প কি সেই তরুবৃক্ষের মত:পত্রালি আছে অথচ বর্ণালি নাই; হা করে তাকিয়ে আছে গাছটি অথচ নাই শেঁকড়-বাকড় ;কোনো রকমের তুকতাক করলেই ফল দেবে গাছের ঝোপ; মন্ত্রপুত হলে দিতে পারে আবারও আরোগ্য ধর্ণা ব্যাপক চাহিদায়।
সাফ সাফ কোনও গন্তব্য পাওয়া যাচ্ছে না।
স্বপ্নটা তাহলে এরকম দাঁড়াচ্ছে যে , সামনে নতুন দিন তাক করে আছে কিন্তু সেই চোখ উল্টোদিক থেকে শিকারীর মত বন্দুকের নিশানায় খুঁজছে মানুষের তল-ব্যাস-বেধ।
হাটতে হাটতে কাদামাখা কালচে সবুজ কামানটা এসে দাঁড়ালো উঠানে।
দানব আর মানবের মধ্যে পার্থক্য ঘুচলো।
ঘটনা জান্তব।
কামানের তাক করা মুখ আর উদ্যত বন্দুকের নল , উভয়ই অগ্নিবর্ষী ও উত্তপ্ত–তাহাতে এক প্রকার আক্রোশ ও নির্গলন রহিয়াছে।
বারুদ কামানের ও বন্দুকের ,--গর্জন ও বর্ষণ করে খতম করে মানুষ।এখানে যথেষ্ট মৃত্যু রহিয়াছে।
আকার দিয়ে প্রকার বিচার করা যায়।
নারীটিকে ওলোট পালোট করা হল।
পুরুষটার নিহত চোখ তা দেখতে লাগল।
নারীটি রতি লেপ্টে পড়ে রইল ততক্ষণ।
কামান বহর চলে গেল উঠানে দাগ ও রক্ত রেখে।
পাশে যে নদী বয়ে যায় , লাশ ভেসে যায় কতবার , নানা সময়ে।
নারীটির হাতের শাঁখা গুড়িয়ে গেছে , তছনছ লাল শাড়ি এবং– আরও লাল , মুছে গেছে মাথার সিঁদুর।
সম্বিৎ ফিরে এলে সিঁদুরে মেঘের দিকে এক ঝলক তাকিয়ে তাড়ুয়ার মত হাত নেড়ে এবার নারীটি ভেলায় চেপে নদীতে ভাসতে লাগল।
মানুষের জান ফেরাতে
বন্দুকের দরকার পড়ে না
কোনও ;
নদীতে জলোচ্ছ্বাসের কীর্তন যথেষ্ট ; জলোচ্ছ্বাসে জাগে প্রাণোচ্ছ্বাস।।
জানবাজি
বন্দুকের
সামনে হাজির ক্যাপ্টেন –
কে তাকে ক্যাপ্টেন ব্যাজ দিয়েছে বলতে পারে না কেউ।
তবু সে হাজির হয় বন্দুকের নলের সামনে , গুলি ছুটে আসতো এতক্ষণ যদি সে ব্যর্থ হত ;
তার মুঠোতে ধরা কবুতর কম্পমান ।
কবুতরের পালক ছেঁড়া হয় ;কবুতর তবু ঠোক্কর মারে।রক্ত ঝরে।
তারপর
অমর যে বা যাহারা , কথামালা গাঁথবে।।
বারুদ ও আগ্নেয়াশ্রু
মিলিটারি টহল দিচ্ছে।দেদারসে চলছে গুলি।উড়ে দূরে গিয়ে পড়ছে কামানের গোলা।
জ্বলছে আগুন–পুড়ে খাক হয়ে যাবে নগরী;
মরণ ক্রন্দন ছায়াহীন।
অজস্র মৃত্যুধরা ট্যাঙ্কগুলি রক্ত-ভোজ করতে করতে ভরপুর উদরের ভারে চলে না যেন শরীর –আর কত মৃত্যুতে পাকস্থলী পূর্ণ করবে? –অজানা নিশানায় ঘর্ঘর ঘর্ঘর করে রাস্তা জড়িয়ে গড়িয়ে চলছে আতঙ্কের মুদ্রা ছড়িয়ে দিতে দিতে।
রক্ত উপুড় করে ঢেলে দিয়েছে রাস্তায়।
তাজা খুনের গন্ধ সৈন্যদের রুমালে।
লাল রঙের একটা রুমাল ক্রমে জমে রক্তাক্ত কালো কাক হয়ে গেল।
কাকের গলায় কোনও স্বর নাই।ভয় টুঁটি চেপে ধরেছে।
মাথার ওপর আকাশ বাবড়ি চুলের মত দুলছে।আগুন পাকানো ফিতা তার দীর্ঘ চুল খোলে ; আকাশ জুড়ে বুনে চলে স্ফুলিঙ্গের তসবিহ।–মন্থর হয়ে আসে আঙুল;কতদিনের চির অভ্যাস অথচ ভ্রান্ত শতকিয়া;তসবিহর দানা থমকে থাকে;আড়ষ্ট জিহ্বা।
শরীরের ভেতর থেকে জানটা ধ্বক করে ওঠে।লাফিয়ে বেরিয়ে এসে হাতের মুঠোয় কাঁপতে কাঁপতে জমে যাবে–
ওদিকে টলটলা জল ভরা নদীটার গায়ে আগুন জ্বলজ্বল করছে;আগুন রচিত হয়েছে রণ-সংকল্প নগরীতে;পুড়ছে বাঁশ ও মাচার সংসার;গোলা বর্ষণে দীর্ণ -বিদীর্ণ খোদিত হচ্ছে দালান ঘর।
মৃত্যু গ্রহণ করে মানুষ, পলাতক হচ্ছে মানুষ। মৃত্যু স্মরণ ছাড়া কোনও পলায়ন নাই।পলায়ন হরণ করেছে মৃত্যুনাম।
দামাল ছেলের দল ব্যারিকেড দিচ্ছিল যখন পারাবার দুস্তর,শত্রুর জন্য অভেদ্য ঢাল নির্মাণ করতে…. ততক্ষণে ঢেউয়ের মত ছুঁটে আসতে লাগল বারুদ ভর্তি সিসা।শীষ দিয়ে উঠেছিল ধাবমান বুলেট।অজস্র;লক্ষহীন অথচ ব্যর্থহীন।
ওদের কণ্ঠ এখন সীমিত, স্তিমিত।
অথচ সেই সময় যখন হাতে ঝান্ডা ছিল এবং অতর্কিতে যথেচ্ছ বুলেট হানা দিল তাদের ওপর তখন ওদের শরীর থেকে পাল্টা আগুন , চোখ থেকে ধারালো বিদ্যুতের ফলা , বুকের ভেতর পুষে রাখা ক্রোধের বল্লম জল্লাদের অভিমুখে বর্ষিত হয়েছিল।
প্রমিথিউসের দল শ্লোগান দিতে দিতে আগুন আনতে দাবানলের খোঁজে চলে গেল।
পৃথিবী ধ্বংসের আগে নূহের নৌকা দেখা গিয়েছিল।দেখা মেলে না।ধ্বংসের মুখে দাঁড়িয়ে স্বপ্ন ঝলক দিয়ে ওঠে।নিশ্চিত তবে ধ্বংস নাই।
পুনর্বার গর্জন আছে।প্রকৃতি ঘন হয়ে আসছে।জড়ো হচ্ছে এখানে ওখানে মিছিলের মুখগুলি।
আবার কান্না নয় আর।বরং হ্যামলেট।প্রতিরোধে , প্রতিশোধে।
শিশুটি তখন থেকে কাঁদছিল।এখন কোনও সাড়া নাই।মা তার কাঁদে।
ক্রন্দনে ছিল অনল।মা তখন অগ্নিস্পর্ধী।অগ্নিস্বরূপা–
তিনি আগুন খেকো।একটা আগুন-লাগা তার-জাল জড়িয়ে ছেলে ঘুমানো বর্গীর দেশে
তিনি মৃত বৎসকে নিয়ে ধীর পায়ে
কালো পীচের রাস্তা ভেঙে
তাণ্ডব ভেদ করে গোলা বর্ষণকারী কামানের কাছে গিয়ে
পাদদেশে সন্তানকে যত্ন করে বড় মমতার সঙ্গে শায়িত রাখল।
কোনও আজান হল না।সালাম ফেরাল না কেউ।
গোলার আঘাতে হুড়মুড় করে ভেঙে পড়েছে মসজিদের মিনার।
যে সেপাইটি বন্দুকের নল স্হির করতে পারল নারীটির দিকে , আঙুলে স্পর্শ করল ট্রিগার , তার কাছে কার্তুজের অভাব নাই ; একটানা বর্ষিত হল গুলি , চিকন ধূঁয়া নলের ডগায় , এবং নারীটির বক্ষ বিদীর্ণ করল গুলির ছোবল ;বিস্মিত চোখ আটকে গেল ; তখন কালরাত্রি ,
মানুষের মত দেখতে অথচ মানুষ না যেন নারীটি ;
ছুটন্ত এক অগ্নি মশাল নারীটির বক্ষ উপড়ে তার দিকে উড়ে আসছে , স্তম্ভিত সেপাইটি ; ক্রমে প্রস্তুরিভূত ;হাত হতে খসে পড়েছে বন্দুক ; মাটিতে চিৎ হয়ে অবলোকন করল : তার বুকের ওপর পা রেখে দাঁড়িয়ে আছে নারীটি এবং শাড়ির আঁচল করছে আগুনে ঝলমল।
কোথাওগোলার আঘাতে খসে পড়ছে জানালা ;
জানালার শিক ধরে দাঁড়ানো কোনও মানুষের চোখ সেখানে
নাই।
ধ্বসে পড়ছে দরজা ;
বাইরে বেরুবার - ভেতরে ঢুকবার কেউ নাই।
রাইফেলের রক্তমাখা নল ভস্মীভূত কোন এক দালান প্রাঙ্গনে গড়াচ্ছে।
কেউ বোধহয় শ্বাস-প্রশ্বাস নেয়ার জন্য অবশিষ্ট নাই বালকটি ছাড়া। ততক্ষণে সেই বালকটি মানচিত্র আঁকা লাল-সবুজ পতাকা পুড়ে যাবার আগে বুকের ভেতর গেঁথে ফেলেছে। এবার রাইফেলটি সে আত্মস্হ করে ফেলল।
এখন তারপর
শ্লোগানের ভাষা —
নৈঃশব্দ।
সূচিপত্র লিংক
মন্তব্য