লিটল ম্যাগাজিন প্রসঙ্গে যা বলা দরকার মনে করি
সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ
সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ
১. সাহিত্যের জায়গা-জমিতে চাষাবাদে এখনও নিয়োজিত সনাতন পদ্ধতি; হাড়জিরজিরে অর্ধমৃত গরু, পুষ্টিহীন-রুগ্ন- ধ্বজ কৃষক ও বহুব্যবহৃত ও লাঙলফলা সম্পূর্ণ অকার্যকর;উৎকৃষ্ট বীজ-সার-পরিচর্যা-দক্ষতা তীব্র অনুপস্থিত।
২. সাহিত্য ভূ-খণ্ডে অনেকদিন হয় দুর্ভিক্ষ চালু, চারদিকে এক জরুরি অবস্থা বিরাজমান।
৩. সাহিত্য জগতে উপর্যুপরি ক্ষরা :
বৃষ্টি হচ্ছে না দিন ..
…অথচ, প্রকৃতপক্ষে এই জমি বন্ধ্যা নয়, পতিতদশা চিরকালীন নয়, আদতে এই জমি হচ্ছে উর্বর, উপযুক্ত কর্ষণে হতে পারে ফলবান ও জীবন্ত। এখানে সাহিত্যের ক্ষেত্র প্রস্তুত, প্রয়োজন শুধু সক্ষম ও তেজী মেঠো পুরুষের।
দুঃখজনক যে, সকলে নিশ্চেষ্ট ও উৎকণ্ঠাহীন; কোন প্রকার প্রয়োজনীয় উদ্ভাবনা ও পরিকল্পনা, নতুন উদ্যম ও সংকল্প, সৃষ্টিশীলতা দুর্লক্ষ্যণীয়। ফলে সম্ভাবনা দূরবর্তী।
এই নৈরাজ্যকর দশা, পাথরের মতো ছবির ক্রমশ.....
এক.
সাহিত্য প্রাঙ্গণে, চারদিকে শুধু জঞ্জালের মতো অজস্র পত্রিকা, রাশি-রাশি স্তূপীকৃত কাগজের নিষ্ফলা সমাবেশ; পাতায় পাতায় লক্ষ-কোটি কালো অক্ষর কি অর্থহীন-মূর্খ-প্রগাঢ় কপট-মেধাহীন উল্লম্ফনে প্রকটিত, এইসব মূঢ়-স্পর্শ-অযোগ্য শব্দপাতে ব্যবহৃত কালি ক্রমাগত জড়ো হয়ে পরস্পর লিপ্ত নির্মাণ করেছে এক জোনাকিবিহীন অন্ধকারের মারণ রাজত্ব; এই দুর্বিষহ রাজত্বে ক্রমে তলিয়ে যেতে হয়, দম বন্ধ হয়ে আসে, চোখ আলো শনাক্ত করে না; নাক-মুখ দিয়ে গলগলিয়ে থকথকে গলিত-পচিত এই হতকুৎসিৎ অন্তঃসারশূন্য অন্ধকার প্যাচ-প্যাচ করে প্রবিষ্ট হয় মগজে; এই ভয়াবহ এবং ক্ষতিকর ।
এই দানবীয় অন্ধকারের দোর্দন্ড অস্তিত্বে উজ্জ্বল সম্পাত হতে পারে লিটল ম্যাগাজিন।
বাংলা সাহিত্যে প্রাণ প্রবাহ ও উদ্দীপনা সূত্র হচ্ছে লিটল ম্যাগাজিন। যুগে-যুগে সাহিত্য অঙ্গনে প্রকাশিত হয়ে বাঁচিয়ে রেখেছে ভাষা ও সাহিত্য। লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলন, আক্রমণ করেছে ভাষা ও সাহিত্য এবং দান করেছে সৃজনশীল সাহিত্যে অনন্ত আয়ু। সাহিত্য গতিষ্মান হয়েছে লিটল ম্যাগাজিনের জায়মান ক্রিয়ায়।
দুই.
লিটল ম্যাগাজিনের ক্ষুরধার ভূমিকা হচ্ছে : সৃষ্টি-সৃজনশীলতায়, নতুন সূত্র আবিষ্কার ও প্রয়োগে, মেধা-মনন-যুক্তির সমন্বয়ে, স্বতঃস্ফূর্ত উৎকর্ষতায়, সুনির্দিষ্ট দর্শন ও দ্বান্দ্বিকতা নিয়ে অগ্রগামিতা;
সনাতন বিধি, পুষ্টিহীন মেধাশূন্যতা, রুচির দুর্ভিক্ষদশা, পাথরবৎ স্থবিরতা, মূর্খতা, জ্ঞানপাপ, অন্তঃসারহীনতা, ক্লিশতা, অনাসৃষ্টি-কুসৃষ্টি, ভণ্ডামি, আপোসমূলক দৃষ্টিভঙ্গি, নিম্নগামিতা, নতজানুতা, আত্মবিক্রয়, সাহিত্য ব্যবসা, প্রচলিত ব্যবস্থা ও মনোভাব, ওপর ও ভেতর কাঠামো, চলতি বিশ্বাস ও সংস্কার এবং অপ-সংস্কৃতির বিরুদ্ধাচারণ এবং সক্রিয় ঋজু ভূমিকা গ্রহণ ও সম্প্রসারণ;রক্ষণশীলতা ও প্রতিক্রিয়াশীলতার শকুন দৃষ্টির বিপরীতে সুনির্দিষ্ট প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ নির্মাণ।
লিটল ম্যাগাজিন নান্দনিক প্রতিষ্ঠান অস্বীকারক আন্দোলন।
এবং নতুন সৃষ্টির উত্তাপে লক্ষ্য অর্জনে নিরঙ্কুশ।
…সুতীক্ষ্ণ ক্ষুরধার তরবারির ঝিলিকে হত্যা করতে পারঙ্গম ক্রমাগত প্রকট কালো দৈত্যটাকে ... অন্ধকারের নির্বাসন... নতুন আবাদ ও অর্জন।
বহমান অবক্ষয়িত-শূন্যগামী-অচল- নষ্ট তথাকথিত সাহিত্য প্রথার মুখোমুখি সজীব- মুখর-বেগবান ত্রাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ পাল্টা এক সমান্তরাল সৎ-সত্য-জীবনমুখিন প্রকৃত প্রতিবাদী ও মৌলিক সাহিত্য প্রবাহ সৃষ্টি করার মধ্যেই নির্দিষ্ট রয়েছে লিটল ম্যাগাজিনের লক্ষ্য। এবং এরই মাধ্যমে নতুন মাত্রা যুক্ত করে সাহিত্যকে অগ্রসরতা প্রদান, প্রাণ প্রতিষ্ঠা, স্বতন্ত্র কন্ঠস্বর আবিষ্কার ও উপস্থাপন এবং ভাষার সমৃদ্ধিসহ মৌলিক বীক্ষণে পাঠকের গভীরে ভাবনার বিক্রিয়া সৃষ্টি ও সরাসরি অংশগ্রহণের জন্য পাঠককে সচেতন ও প্রস্তুতকরণ। ফলে সর্বোপরি গ্রহণ-বর্জনের মধ্য দিয়ে যৌথ কল্যাণ ও সর্বোময় উৎকর্ষতা।
সকল কিছু মুখ থুবড়ে শেষ যেখানে, লিটল ম্যাগাজিনের সূচনা হয় সেখানে । লিটল ম্যাগাজিন করতে পারে ব্যর্থতা ও পরাজয়ের গলিত শবের শরীরে আগুন জ্বালাবার অহংকার।
লিটল ম্যাগাজিন : নিরবচ্ছিন্ন জ্বলন্ত প্রতিবাদ; মুখাপেক্ষী নয়; স্বাধীন ও প্রচলিত চেতনাদ্রোহী; অনিবার্যরূপে লক্ষ্যভেদী।
লিটল ম্যাগাজিন,—অজর; যুগে-যুগে বেঁচে থাকবে.... হয়তো একেকটার অস্তিত্ব ক্ষণায়ুর এবং এই স্বল্পায়ুকালে কাগজটার প্রতি সংখ্যা প্রকাশিত হয় রক্ত-মেধা-শ্রমে দীর্ঘতর বিরতিসহ যদিও সিনথেসিস্ চলে নিয়ত –জীবদ্দশায় হয়তো এইভাবে হাতেগোনা মাত্র কতিপয় প্রকাশনা তবুও সপ্রাণ উপস্থিতি ও নিরঙ্কুশ শ্রেষ্ঠত্ব; বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের হৃৎপিণ্ড এখানেই।
আপস না করার জন্য লিটল ম্যাগাজিনসমূহের সমাপ্তি ঘটে তবে চেতনার বিনাশ হয় না; সময়ের অপরিহার্যতায় জন্মলাভ করে নতুন চিন্তা ও আরেকটা লিটল ম্যাগাজিন... এইভাবে একের পর এক এগিয়ে চলা এবং এই হচ্ছে নিরন্তর ধারাবাহিক প্রক্রিয়া; চেতনার অগ্নিমশাল হস্তান্তরিত হয়, গতি পায় আগুন ক্রমে উজ্জ্বলতর ও ব্যাপক......
প্রকৃত লিটল ম্যাগাজিনের সঙ্গে বৈজ্ঞানিক পরীক্ষাগারের তুলনা স্থাপন করা যায় যেখানে চালু থাকে অধ্যয়ন, গবেষণা, মূল্যায়ন, উদ্ভাবন, নিরীক্ষা ও প্রয়োগ; ফলে সম্ভাবনার দুয়ার উন্মোচন, প্রতিষ্ঠিত ঘুণে ধরা বিশাল পরিধিতে ব্যাপকতম ওলটপালট সঙ্ঘটন।
লিটল ম্যাগাজিনে ঈশ্বরপ্রতিম শিল্পীরা বৈজ্ঞানিকের মতো অতীতের যথার্থ সৃষ্টিশীল কর্ম অন্বেষণে, মেধার চর্চায়, সৃজনশক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহারে যাবতীয় প্রতিষ্ঠান ও প্রাতিষ্ঠানিক মানসিকতার শরীরে বজ্রাঘাত করে, পুনর্গঠন করে এক প্রকার মৌলিক -একক-
আক্রমণাত্মক-দ্বান্দ্বিক-সাহসী বহুমাত্রিক সৃষ্টি –পর্যায়ক্রমিক কেলাসিত হয়ে সর্ববিস্তৃত এবং বর্তমানের ফাঁপা অংশকে প্রদান করতে পারে এক প্রকার সম্পূর্ণতা এবং মানচিত্র উঠে আসতে পারে সম্মুখে তখন।
লিটল ম্যাগাজিন কোন 'লিটল' ব্যাপারকে বোঝায় না; লিটল ম্যাগাজিন কোন বায়বীয় বস্তু নয়,--লিটল ম্যাগাজিনে সমবেত হয় একেকজন ঈশ্বর,-- লিটল ম্যাগাজিনের লেখকরাই ঈশ্বর। ঈশ্বরের সৃজনশীলতায় সৃষ্টি হয় নতুন জগৎ; পুনরায় মহাকাল, বস্তুসমষ্টি এবং মানুষ ও তাদের ভেতরের ক্রিয়া-বিক্রিয়া।
অতএব যে কোন পত্রিকা মানেই লিটল ম্যাগাজিন নয়; অনুরূপ ভাবে তল-ব্যাস-বেধহীন, সংবেদন- বীক্ষণশুন্য,দুর্গন্ধ বমনকারী, অপরিণত গর্ভস্রাবকারী নামসর্বস্ব জঞ্জালের মতো নানাপ্রকার কাগজের লেখকমাত্রই ঈশ্বরপ্রতিম সেই লেখক নয়, ধ্বংস ও সৃষ্টিতে যিনি অপরিসীম। যদিও এই সকল লেখক সংখ্যায় ভারী এবং তাদের লেখাজোখা ওজনে জগদ্দল হলেও এই সব নষ্ট জননাঙ্গের প্রজনন ও বিকলাঙ্গ পৌনঃপুনিক উৎপাদন না ঘটলেও বাংলা সাহিত্যের ক্ষতি-বৃদ্ধি ছিল না। এসব লেখা মানুষের ভাবনা-চিন্তা উসকে দেয় না এবং তেমন উদ্দেশ্যে লেখাও হয় না, শুধু এক অন্ধমোহে অনবরত নাম প্রকাশের উৎকট চাহিদায়, বিকৃতিস্পৃষ্ট হয়ে আবোলতাবোল শব্দবাহার রচনা করার তাড়না থাকে তাদের মধ্যে।
তিন.
প্রকৃত লিটল ম্যাগাজিনের জন্য অতিক্রমণের সড়ক অত্যন্ত সংকীর্ণ ও কণ্টকিত, তিরস্কার ও তাচ্ছিল্য জরিত। এই পথে প্রশংসা ও স্তূতি নিদারুণ অনুপস্থিত। নীচে ফাঁদ পাতা গড্ডলিকার খাদ। লোভ-মোহ, নগদপ্রাপ্তির অবিরাম হাতছানি প্রলোভন সৃষ্টিতে উদ্যত। এই অবস্থায় ভণ্ড ও কপট ব্যক্তিসহ অনেকের সত্তা বিক্রি হয়। আস্থাবান লেখক ও সম্পাদকে হতে হয় সংগ্রামশীল, যুযুধান—রক্তাক্ত হয় বক্ষদেশ, পৃষ্ঠদেশ নয়। গলায় রক্ত উঠে মৃত্যু তবু অস্তিত্ব বিক্রয় নয়।
সকল পত্রিকার ক্ষেত্রে লিটল ম্যাগাজিনের শিরোপা চূড়ান্ত বিচারে শিরোধার্য হতে পারে না । কোন-কোন কাগজই কেবল শেষ বিচারে হয়ে ওঠে লিটল ম্যাগাজিন এবং যেখানে অন্তর্নিহিত চেতনা সার্বিকভাবে অ-প্রাতিষ্ঠানিক; 'প্রতিষ্ঠিত শক্তি' 'প্রচলিত মূল্যবোধ' ও “স্থিতাবস্থা'র সম্পূর্ণ বিরোধী; বিদ্রোহাত্মক।
নতুন কিছুর প্রতি তীব্র আক্রমণ বা নতুনত্বকে প্রলোভনের মাধ্যমে প্রশমিত করার উদ্যোগ নতুন নয় । একদা 'পৃথিবী সূর্যের চারদিকে প্রদক্ষিণরত' ধারণাটাকে ধর্মীয় চার্চ সহ্য করতে পারে নাই; প্রতিষ্ঠান এমনই হতে বাধ্য। চিন্তার মুক্তি ও মৌলিক ভাবনা বা উদ্ভাবনা সর্বদাই অপরাধী এবং অস্পৃশ্য হিসেবে সাব্যস্ত হয় প্রাতিষ্ঠানিক মানসিকতার কাঠগড়ায়।
মৌলিক বিষয়ের উত্থাপন, সত্যনিষ্ঠ সৃজনশীলতা, প্রশ্নশীলতা, পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও যে কোন সৎ-উচ্চারণকে গ্রহণ করতে হয় প্রতিষ্ঠানের সংশ্রবহীন দৃঢ়-অবস্থান। সৎ লেখনীর মধ্যে কাজ করে অন্তর্নিহিত সত্য প্রকাশের নিরঙ্কুশ তাগিদ এবং আর্তনাদ ।
অনেক লেখা লিটল ম্যাগাজিনে উদ্দেশ্যমূলক হলেও প্রকৃত অর্থবোধক হয়ে থাকে এহেন প্রযোজনা। আত্মার অকৃত্রিম শুদ্ধ উপস্থাপনায়, গ্রহণযোগ্য অতীত সংশ্লিষ্টতায়, নতুন দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন ভূমিকায়, ইমাজিনেশনের প্রচণ্ডতায় সাহিত্যের চাকা সম্মুখবর্তী করা সৎ লেখনীর প্রথম দায়িত্ব; এইক্ষেত্রে সার্বিক প্রাতিষ্ঠানিকতার প্রতি অবজ্ঞা ও বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন নৈতিক কর্তব্য এবং অপরিহার্য বটে।
চার.
প্রকৃত লিটল ম্যাগাজিনের বিরুদ্ধে উন্মত্ত শত্রুসংখ্যা অগণিত, এদের চিহ্নিতকরণ আশু প্রয়োজন এবং সময়ের সুনিশ্চিত দাবী। লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে ক্রিয়াশীল তিনটা নষ্ট-ভ্রষ্ট গোষ্ঠিকে শনাক্ত করা যায় প্রাথমিকভাবে নিম্নরূপ :
[ক] প্রথমোক্ত শ্রেণী হচ্ছে অজাচারী প্রকাশ মাধ্যমের কল্যাণে প্রতিষ্ঠিত কাগজ ও বেদখলকৃত সিংহাসনে আসীন প্রচারের প্রকোপে প্রতিষ্ঠিত তথাকথিত সাহিত্যিক জীব যারা নতুন সাহিত্য সৃষ্টিকে গ্রহণ করতে অপারগ এবং আসনটা হতে বিচ্যুত হবে এই সম্ভাবনায় আতঙ্কিত; হীনমন্যতায় তারা অন্ধ সেজে দুর্বলতা গোপন করে রাখে বেশুমার। উপরন্তু, গালিগালাজে দ্বিধাহীন (এরা এমনই—গাছে ধরে অজস্র, ঝাঁকে-ঝাঁকে এবং যাবতীয় পুরিষ গায়ে মেখেও উজ্জ্বল ও আত্মগর্বী)। এইসব প্রচলিত কাঠামোভুক্ত পণ্যসর্বস্ব পুতুলরূপী ভৃত্য সম্প্রদায় অত্যন্ত নপুংসক ও কুৎসিত।
[খ] অন্যপদের লেখালেখির ভণ্ডদের সহজে চেনা দুরূহ; লিটল ম্যাগাজিনকে উদ্ধার করছে এমন একটা ভড়ং আছে কিন্তু মুখোশটাই প্রধান। এদের ভেতরে গোপন পশমের মতো দাদাদের পদসেবা করার আকাঙ্ক্ষা বিদ্যমান; আত্মসন্তুষ্টিজনক যুক্তি দেখিয়ে বহুগামী চরিত্রবিশিষ্ট হয় তারা।
অনেকে ক্লিব বৈশিষ্ট্যধারক : না লিটল ম্যাগাজিনের না অন্য কিছুর পক্ষে। দুই বিপরীত পাল্লার মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখার এক কিম্ভূত ফর্মুলা অনুসরণরত এহেন বিকৃত প্রবণতা সবচেয়ে বিষধর হিসেবে সর্বাগ্রে চিহ্নিত ও বর্জনযোগ্য। লিটল ম্যাগাজিনের দর্শনে আত্মসমর্পণের কোন স্থান নাই এবং সুযোগ অনুপস্থিত লিটল ম্যাগাজিন ও প্রচলিত ধারার মাঝামাঝি সুবিধাভোগী অবস্থানের।
[গ] লিটল ম্যাগাজিন বলতেই অজ্ঞান হয় এমন লেবাসধারীও রয়েছে। মূল চেতনা বিন্দুমাত্র পোক্ত হয় নাই । লিটল ম্যাগাজিনের নামাবলী শরীরে বিধৃত করে ফ্যাশনবাজ মাত্র। কিছু একটা হয়ে ওঠার এমনতর মনোবিকলন-ই তাদের প্রধান। লিটল ম্যাগাজিনের প্রতি প্রেম বেশ্যার ভালবাসার মতো খণ্ডকালীন; কোন প্রকার লিঙ্গজ্ঞান তাদের নাই। বিশুদ্ধ লিটল ম্যাগাজিন চেতনা বহির্ভূত কৃত্রিম পোশাকধারী এরা, অচিরেই লোভের বশবর্তী হয়ে মুহূর্তে শরীরে ধারণকৃত পরিধেয় যাচিত হয়ে পায়ু উন্মোচনের মাধ্যমে মজা গ্রহণেই অবিমিশ্র মোক্ষ অর্জন করে। এই গুহ্যদ্বারের ক্ষতচাটা পরিতৃপ্ত দলভুক্তরা পায়ুরক্তে মনের ঝামিনকোণে রঙিন আলপনা রচনা করতে করতে তলিয়ে যায়। এরা মূলত চেতনাশূন্য বলে করুণা উদ্রেককারী। শুধুমাত্র অমর হওয়ার অসুস্থ কামনাবাসনায় প্রথমে লিটল ম্যাগাজিন এবং পরবর্তীতে নানা ঘাটে চলাচল ও আত্মবিসর্জন-সওদাপাতি ।
উপরোক্ত সকল প্রকার অপ-শক্তি প্রকৃত লিটল ম্যাগাজিনের চেতনা পরিপন্থী বিভিন্ন মাত্রার শত্রুজন।
এইভাবেই লিটল ম্যাগাজিনের চেতনা ও আন্দোলন স্তরে বিভ্রান্তির জট গাঢ় হয় ক্রমশ।
আরেকটা বিষয়। প্রকৃত লিটল ম্যাগাজিন চেতনার বিরুদ্ধবাদী যে অসুস্থ পরিপ্রেক্ষিত ভয়ঙ্করভাবে ক্রিয়াশীল তা উল্লেখযোগ্য। বিষক্রিয়মান পরিস্থিতি এরকম যে, ইদানীং লিটল ম্যাগাজিনের নামে একটা মারাত্মক বিকার প্রকটিত; মূল উদ্দেশ্য, এই সকল আওয়াজ সৃষ্টি করে তথাকথিত 'প্রতিষ্ঠা' অর্জনের উপযুক্ত 'সীল টা সপাটে পশ্চাতে স্থাপন করে জাতে' ওঠা। এইভাবে 'লিটল ম্যাগাজিন' ব্যবহৃত হচ্ছে এক প্রকার 'সিঁড়ি' হিসেবে; এই প্রবণতা পুরাতন, সেই ষাট দশক হতে অদ্যাবধি প্রবহমান; যতদিন জাতীয় পত্রিকা (?) গুলোয় স্থানালাভের সুযোগ না ঘটে তৎপর্যন্ত খুব বিপ্লবী ও জঙ্গিপনা বহাল থাকে এবং যেই মাত্র কৃপা বর্ষিত হয় যৎসামান্য অমনি পুরনো ধ্বজা প্রত্নবস্তুতে রূপান্তরিত করা চলে মহাসমারোহে –অতপর কি চেকনাই ও শানদার! গুহ্যপথ চৌচির তবু মুখভতি হাসি।
লিটল ম্যাগাজিন নামধেয় অধিকাংশ কাগজে লক্ষণীয় ক্ষত এই যে, 'ছাপমারা' লেখকদের বর্জ্য-পদার্থ কাতর ভাবে ধর্না দিয়ে এনে গদগদচিত্তে অকাতরে প্রকাশিত করা হচ্ছে; উদ্দেশ্য একইরকম, এই ফর্মুলাও অতি পুরাতন, তথাকথিত 'মাননীয় 'দের সংশ্রবে এসে মোক্ষলাভ করার কামতাড়না বিশেষ; প্রকাশিত পত্রিকার পাতা উল্টে 'বাহ্' বলে প্রশংসা করবে –তাতেই চরম প্রাপ্তি; এইভাবে তাদের গায়ের স্পর্শ সহযোগে নিজেদের শরীরের গন্ধ একই রকম মানসম্মত করার অপচেষ্টা আর কি! ঘাম ঝরবে একই চোলাই!
এই সকল কুপ্রবৃত্তি লিটল ম্যাগাজিন স্বভাবের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন ও চেতনা বহির্ভূত; এহেন সুযোগ সন্ধানী মোহগ্রস্ত কর্মকাণ্ড, বেজন্মা প্রচেষ্টা হিসেবে উত্তীর্ণমাত্র। এতদ্ব্যতীত, ঢাকার বাইরে হতেও কতিপয় বোধশূন্য অপগও 'লিটলম্যাগ' সাইনবোর্ড যুক্ত ক্ষুরধার সম্পাদকীয় কথনসহ কাগজ বের করে চলেছে অবিরাম; উপস্থিত করছে নবীন প্রবীণের সহাবস্থানের সূত্র বা ঢাকার লেখক ও স্থানীয় লেখকযোগে মান বহির্ভূত এক ধরনের 'সাসপেনশন' যা “সেবনের পূর্বে ঝাঁকিয়ে নিলেও'আবিষ্কার করা যাচ্ছে না তাতে একরত্তি মৌলিক কণা কিংবা সম্পাদক নামক সংকলকের একান্ত মৌলিকতা বা স্খলিত বীর্যের ঘন অংশ ।
এইসকল কাগজের অশ্বতর মগজের 'সম্পাদক' প্রকৃত অর্থে 'সংকলক’গণ যা পায় লিখিত আকারে সব-ই প্রকাশ করে নির্বোধের মতো; ঢাকার প্রচারসর্বস্ব কাগজের লেখক দেখলেই দ্রুত স্খলন ঘটে, নিম্নাঙ্গ ভেসে যায় ও এই দশাতেই তাদের লেখা আবর্জনার মতো সংগ্রহ করে ছেপে ঘোষণা দেয় 'লিটল ম্যাগাজিন' যেন 'সময়মত পৌরকর পরিশোধ করুন' এমন আহ্বান; এইসব নষ্টভাবধারার সংকলকদের গর্ভপতিত এইসব কাগজ হচ্ছে এক ধরনের চরিত্রহীন উপস্থাপনা। ফলে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে পাঠক সম্প্রদায়, লিটল ম্যাগাজিন নামে ভুল ঔষধ খেয়ে ব্যাধিময় তারা; পাঠক প্রস্তুত হচ্ছে না নতুন চিন্তাধারা ও নতুন ধরনের লেখার জন্য যদিও এসব কাগজে আবোলতাবোল অসঙগত রচনাকর্মকে নতুন ধারার লেখা হিসেবে প্রকাশের বিকার লক্ষণীয় : হয়ত দেখা গেল, কেউ আনুভূমিক হাঁচিদানকে শব্দে বর্ণনা করেছে এবং যথারীতি তা-ই হয়ে ওঠে 'নতুন ধরনের' লেখা বা 'পরম পূজনীয়' এক্সপেরিমেন্ট। টাইপ ছোট-বড় করে উল্টে- পাল্টে কেরামতির অন্তহীন প্রচেষ্টাও নাকি 'নতুনত্ব' নামক প্রপঞ্চ। এইসকল মারাত্মক কার্যকলাপের ফলে পাঠক সাহিত্য সচেতন ও প্রস্তুত হওয়ার বদলে নিরন্তর বিভ্রান্তির গহ্বরে নিক্ষিপ্ত হয়ে অর্জন করছে ভুল ওহী।
পাঁচ.
প্রকৃত লিটল ম্যাগাজিনের উৎপত্তিকে বিশ্লেষণ করে পাওয়া যায়: বাংলাদেশে লিটল ম্যাগাজিনের প্রকাশ অপরিহার্য হয়েছে অন্যতম একটা কারণে যে, দৈনিক পত্রিকার সাহিত্যপাতা ও অন্যান্য সাময়িকীগুলোর আশির দশকে সীমাহীন সীমাবদ্ধতার ল্যাবিরিন্থ দশার ঘূর্ণাবর্ত হতে মুক্তি অর্জনের ঐতিহাসিক প্রয়োজনে; দায়িত্বপ্রাপ্ত সম্পাদককুলের মেধার দারিদ্র্য ও অক্ষমতাও বিশেষ দ্রষ্টব্য।
এই সমস্ত সাহিত্যপাতা ও সাময়িকীগুলো অনিবার্যভাবেই তারল্য উদ্ভাসিত, সিরিয়াস বিষয়াদি এখানে নিষিদ্ধ ঘোষিত; কেবল স্থান দখল করে থাকে অসংগঠিত নানা রুচির পাঠক সন্তুষ্টির বিচিত্র মালমশলা; এইসব সাহিত্য-ব্যবস্থা অবসরকালীন ফুরফুরে মেজাজকে প্রশমিত করার তাগিদে মূল্যবান বিষয়াদি ও ভিন্নধারার লেখাকে উপেক্ষা ও অবহেলায় তৎপর ।
সাহিত্যে বিনোদন ধারা কখনই চূড়ান্ত নয়। এর বাইরেই রয়েছে সৃষ্টিময় সিরিয়াস সাহিত্য-মূলধারা। নতুন প্রজন্মের নবনিরীক্ষা, মৌলিক স্বতন্ত্র কণ্ঠস্বরে উচ্চারণ ও সৃজনীশক্তি এই প্রধান ধারাবাহিকতাকে করে তুলছে নিরন্তর সমৃদ্ধবান ও সুমহান গৌরবের অধিকারী।
কিন্তু এই মূলধারাটা চরমভাবে লাঞ্ছিত ও উপেক্ষিত হয় তথাকথিত সাহিত্যপাতা ও সাময়িকীগুলোর পৃষ্ঠায়। কদাচিৎ আধা-সিরিয়াস বিষয় সামান্য স্থান গ্রহণ করলেও যথেষ্ট মনোযোগ আকর্ষণ করতে ব্যর্থ। মূল্যবান বিষয়াদি গাণিতিক নিয়মেই অপঠিত ও অবহেলিত। হালকা বিষয়াবলীর চুম্বক আকর্ষণ প্রবল। পাঠকের তরল বিষয়ে নিরঙ্কুশ সমর্পণের ধারাপাত লক্ষণীয়।
গৎবাঁধা সাহিত্যপাতা ও সাময়িকীতে এক প্রকার স্ট্রাকচার গঠিত হয়ে বিকাশমান যেখানে রয়েছে স্থবিরতা ও বদ্ধতা; সব কাগজেই একটা নির্দিষ্ট বন্ধ্যা ফরমেট দ্রষ্টব্য। নতুন ধরনের চিন্তা করতে সম্পূর্ণ অসার। বালখিল্য গল্প, কাষ্ঠকাঠিন্য মার্কা অনুবাদ, পুনরাবৃত্তিক কবিতা, সাক্ষাৎকার নামক তলচুলকানি, আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক অগভীর রচনা, দায়সারা কলাম, ভুয়া জার্নাল, সীমিতাকার পুস্তক আলোচনা ইত্যাদি মৌলিক উৎসারণ বিমুখ; এইসব কাগজে প্রত্যেকটা জিনিসই নির্দিষ্ট গণ্ডিতে একই ছকে আবদ্ধ, মৌলিক চিন্তা-চেতনা, সাহিত্যের ঝাঁঝ এখানে অসহ্য ও অচল, সম্পাদনা ও উপস্থাপনায় যে প্রচলিত ফর্ম ও চিন্তা প্রতিষ্ঠিত তা ব্যতিরেকে সব কিছু অচ্ছুৎ।
এইসব সাহিত্য ব্যবস্থায় নতুন লেখক ও নতুন লেখা যেমন আপন হয় না — বিস্তার লাভও করে না স্বকীয় ভাবনা, তেমনি যাবতীয় সৎ সৃজনশীল সাহিত্যকর্মও অস্বীকৃত ও অযাচিত এখানে। তথাকথিত এইসব সাহিত্যমুখপত্রে তৈরি হওয়া (?!) পরনির্ভর লেখকদের আত্মপ্রকাশ করতে দেখা গেলেও কখনও নতুন লেখক বানাতে চোখে পড়ে না; নতুন প্রজন্মের কোন লেখক-কবি অদ্যাবধি এইসব পত্রিকার কল্যাণে প্রকাশিত হয় নাই।
বড় কাগজ অনেক ‘ক্ষুদ্রকাগজে লিখে পরিচিত' লেখকদের পায়ের তলায় শক্ত(!?) মাটি দিলেও তা চোৱাবালি; ছোট কাগজ হতে অনেক প্রতিশ্রুতিশীল লেখক মোহগ্রস্ত হয়ে তথাকথিত সাহিত্য কাগজের চক্করে পা রেখে অচিরেই হয়ে পড়ে প্রথাদাস, অমৌলিক এবং গৌণ; এইভাবে ঝাঁকে-ঝাঁকে আত্মহত্যা লক্ষণীয়; শুধুমাত্র কাগজের গায়ে কালো কালিতে অজস্র মুদ্রণে লেপ্টে গিয়ে তাদের সার্থকতা।
এমন অনেক দৃষ্টান্ত রয়েছে। কোন-কোন তথাকথিত প্রতিষ্ঠিত লেখক তাদের ভিন্নধর্মী রচনা বহুল প্রচারিত কাগজে প্রকাশ করতে অসমর্থ। সে-ই লেখাটা পুস্তাকারে মুদ্রণেও বিমুখ হয় প্রকাশক। এই দশা প্রচলিত সাহিত্য ব্যবস্থার সীমাবদ্ধ ফর্মেটের বিষাক্ততা প্রমাণ করে।
একইরকম অসহায়ত্ব, প্রচলিত বিধান ও স্ট্রাকচারের যাঁতাকলে আবদ্ধ কোন-কোন মেধাবী ও অকুণ্ঠ ইচ্ছুক সাহিত্যপাতা ও সাময়িকীর সম্পাদনায় দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিবর্গের ক্ষেত্রেও সমপ্রযোজ্য; সব ঘর রক্ষা করে চলতে হয় তাদের। একক মৌলিকত্ব বিসর্জনের মাধ্যমে ধারণ করতে বাধ্য হয় সর্বপ্রকার আগা-পাশ-তলা বিবেচনার দাসত্ব ।
আমাদের কমশিক্ষিত এই জনপদে, প্রচলিত সাহিত্য ব্যবস্থা প্রাতিষ্ঠানিক চারিত্র -অর্জনে নিরঙ্কুশ বিফল হলেও ক্ষতিকর হিসেবে মূল্যায়িত হয়ে এসেছে এইসব মেধাহীন প্রক্রিয়ার দাপট; প্রতিষ্ঠান পরিণত হতে পারেনি ঠিকই, তা সত্ত্বেও ক্ষতিকর প্রভাব সম- মাপের মারাত্মক ।
পক্ষান্তরে লিটল ম্যাগাজিন স্ট্রাকচারাল লিমিটেশন হতে মুক্ত ও প্রথা স্বাধীন, এখানে যে কোন মৌলিক চিন্তা 'ভিশন' অনুযায়ী হুবহু প্রতিফলিত। লেখকের 'থট প্রসেস' হচ্ছে মূল বিষয়।
লিটল ম্যাগাজিনে কখনওই জগাখিচুড়ি সমন্বয়ের মতো ক্ষতিকর প্রবণতা স্বীকৃত নয়, যা তথাকথিত সাহিত্য কাগজ বা সাময়িকীর কুলক্ষণ। তথাকথিত সাহিত্য কাগজে নানা পথের বিচিত্র সব লেখক ও তাদের লেখা এক প্রকার সমন্বয়ের ফর্মুলায় চরিত্রহীন সম্প্রদায় উপস্থাপিত হয় বেশুমার। লিটল ম্যাগাজিন একক লক্ষ্য ও সুনির্দিষ্ট চরিত্র ধারক। লিটল ম্যাগাজিনে নষ্টমান সমন্বয়ধর্মীতা অচল।
লিটল ম্যাগাজিন মুক্ত ও অবারিত; এখানে সম-মনস্ক লেখকরা পত্রিকাটাকে দাঁড় করায় । লিটল ম্যাগাজিনে, লেখকের সামনে কোন সম্পাদক অবস্থান করে না ।
লিটল ম্যাগাজিনের লেখা, সম্পাদক নামক কারও ব্যক্তিগত মন-মীমাংসা, সন্তুষ্টি ও পছন্দ-অপছন্দের 'ফেনোমেনা'র ওপর নির্ভরশীল নয় কখনই ।
লিটল ম্যাগাজিনের লেখক আবার নিজেই তার সবচেয়ে বড় সম্পাদক হিসেবে সুবিবেচিত। বিচারমূলক চিন্তার মাধ্যমে নিজেই স্বকীয় সৃষ্টিকে চূড়ান্ত করে প্রতিবার।
তথাকথিত বড় কাগজের বিদ্যমান সাহিত্যে যেসব ক্লিশতা ক্রিয়াশীল তা থেকে রেহাই হচেছ লিটল ম্যাগাজিন। লিটল ম্যাগাজিনে নতুন প্রথাবিরোধী-(যৌক্তিক) রাজনীতি সচেতন লেখক সৃষ্টি হয়, উৎক্ষিপ্ত হয় নতুন ভাবনা-চিন্তা এবং তাৎপর্যপূর্ণ পরীক্ষা- নিরীক্ষাসহ মৌলিক প্রবণতা।
ছয়.
একটা বিষয়ে পরিষ্কার স্বচ্ছ ও আলোকিত হওয়া আবশ্যক যে, প্রতিষ্ঠান বলতে শুধুমাত্র বহুল প্রচারিত পত্র-পত্রিকা, সাহিত্য পাতা ও সাময়িকীকে কখনই নির্দেশ করে না, এই বিতর্কটার অবসান হয়েছে পূর্ব বর্ণনায়। সাহিত্য পাতা দৈনিকে উপযুক্ত ফোরাম নয়। দৈনিকে সাহিত্য চর্চা কেন করা হয় বোধগম্য নয়।
এখানে প্রেক্ষাপট অন্যরকম; বাংলাদেশ প্রেক্ষিত বিবেচনায় স্পষ্ট যে, কমবেশি চার ধরনের বিকৃতি প্রাতিষ্ঠানিক চারিত্র্য অর্জন করেছে,
যথা :
(ক) ধর্ম (খ) আমলাতন্ত্র (গ) বিশেষ বাহিনী (ঘ) সুবিধাবাদের রাজনীতি ।
বর্তমানে আমাদের দেশীয় সমাজ ব্যবস্থা আধা-সামন্তবাদী, শিল্প-কারখানা ও পুঁজির বিন্যাস অবিকশিত স্তরভুক্ত: মন-মানসিকতা সনাতন রক্ষণশীল জরাগ্রস্ত অথবা কিঞ্চিৎ প্রগতিশীল কখনও; শিক্ষাব্যবস্থা সার্টিফিকেটসর্বস্ব, অনুপযোগী ও পঙ্গু;প্রযুক্তি কৌশল পশ্চাৎপদ ও অগঠিত; সংস্কৃতি খণ্ডিত ও খর্বিত, জাতীয়তা বিকৃত; অর্থনীতি দোদুল্যমান; মূল্যবোধ অনগ্রসর; সর্বোপরি দানবাকৃতি মূর্খতা প্রতিটা স্তরে ভয়াবহ; সভ্যতা অচল-স্তম্ভিত ও মুমূর্ষু;প্রেক্ষাপট যখন এই রকম, বাংলাদেশের শিল্প-সাহিত্য অঙ্গনেও ফলে ব্যতিক্রম নাই এখানেও পচনের গন্ধ এবং এই বিশেষ ক্ষেত্রে সদম্ভে বিচরণশীল তথাকথিত বুদ্ধিজীবী ও কপট জ্ঞান-গুণীদের পাতালস্পর্শী নিকৃষ্ট অযোগ্যতাও পুনরায় প্রামাণ্য হয়ে ওঠে; এক- একজন হচ্ছে ব্যর্থতার উৎকৃষ্ট দলিল-নমুনা ।
তীর্যকভাবে বিশ্লেষণ করলে এটাও প্রতীয়মান যে, সাহিত্য চারণক্ষেত্রে গর্দভদের সংখ্যা অত্যন্ত সুলভ এবং যে কোন প্রকার দুষ্কর্ম-ও তাই সুচারুরূপে সম্পন্ন হবার নয়; মন্দ ও ক্ষতিকারক কুকর্ম সাধন করার মতো প্রয়োজনীয় মেধাবী দক্ষতার পরিচালনা কৌশল ও পরিকল্পনার অভাবও প্রকটিত। যেমন : সংবাদপত্র প্রকাশনা প্রচার মাধ্যমে এ যাবৎ প্রাতিষ্ঠানিক চেতনা-মানসিকতা ভিত্তি পায় নাই। কলকাতায় যে রকমভাবে আনন্দবাজার-দেশ প্রভৃতি অসংখ্য প্রতিষ্ঠান জ্ঞানপাপী মসীজীবীদের বদৌলতে বিকশিত হয়, ছদ্মাবরণে অসুস্থতাকে পুঁজি বানিয়ে মধ্যবিত্তকে ভোক্তা হিসেবে শিকারে পরিণত করে প্রচণ্ড মুনাফা-অর্জনকারী, তেমন অবস্থা এখানে অনুপস্থিত। ব্যবসায়ী মানসিকতা একশত ভাগ বিদ্যমান, তা সত্ত্বেও পেশাদার মনোবৃত্তি স্ফীত হতে পারে নাই।
আমাদের দেশীয় প্রেক্ষিতে নানাবিধ দৈন্যতার সমষ্টিতে প্রতিষ্ঠানের চেহারায় একপ্রকার মারাত্মক বিকৃতি উচ্চণ্ড রয়েছে। এহেন পরিস্থিতিতে, সাহিত্য পরিমণ্ডলে ঋণাত্মক ধারার সুষ্ঠ পরিণতি অর্জনের অসমর্থতার কারণে যথার্থ শক্তিশালী প্রতিপক্ষের সঙ্গে অনিবার্য সংঘর্ষের মাধ্যমে গড়ে উঠতে পারে নাই সবল ধনাত্মক ধারাটি। তবে এমতাবস্থায় নিস্পৃহতার যুক্তি নাই, কেননা এই সমস্ত প্রতিষ্ঠানের আদলে গড়ে উঠা অশুভ বিকৃতি কেবল উদ্বেগজনক নয়, আতঙ্কজনক মারাত্মক পরিণতিবহ। এই ক্ষেত্রে বিকৃতি ও অশ্লীলতার বিপরীতে বিরুদ্ধস্রোত নির্মাণের নামে তৈরি হতে পারে পাল্টা আর এক মারাত্মক বিকৃতি ও চেতনা। এই প্রক্রিয়ার কুলক্ষণ হিসেবে অগঠিত প্রাতিষ্ঠানিকতার বিরুদ্ধে বিভ্রান্তিকর অসংহত চেতনার অজস্র তথাকথিত 'লিটলম্যাগ' এর প্রাদুর্ভাব দেখা যাচ্ছে যত্রতত্র। সুতরাং যাবতীয় বিদ্যমান অ-প্রতিষ্ঠানসমূহের ক্ষতিকরক মহাসমারোহ, বিপজ্জনক কৃষ্ণদানর বিশেষ।
সাত.
অদ্যাবধি, দৈশিক সামাজিক শক্তি ও ব্যবস্থা, অনেকগুলোই, কোনরকম প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পরিগ্রহ করতে সীমাহীন ব্যর্থ।
ফলে কোনরকম “ইন্টার-একশন' সঙ্ঘটিত হয় নাই ।
যে ভাবে সূত্রপাত হয় বিপ্লব।
আট.
প্রতীয়মান যে, এখনও বড়সড় কাগজ সাহিত্য সাময়িকী বা পাতাকে প্রতিষ্ঠান অর্থে নির্দেশ করে না, ফলে প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধতা নিছক ঐসব কাগজে সাহিত্য রচনা না করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; ঐসব সাহিত্য ব্যবস্থাকে বহিষ্কার করতে হয় শুধুমাত্র পূর্বে বর্ণিত কারণে নির্ধারিত দণ্ডাদেশে।
অ-প্রাতিষ্ঠানিকতা একটা ব্যাপকতম বিষয় এবং তথাকথিত সাহিত্য কাগজে রচনা প্রকাশ না করা বা বয়কট করা প্রকৃত লিটল ম্যাগাজিনবাদীদের প্রয়োগকৃত অন্যতম অস্ত্র মাত্র।
নয়.
লিটল ম্যাগাজিনের জন্য একটা গুরুত্বপূর্ণ একক হচ্ছে পাঠক, যে পাঠক সাহিত্য সচেতন প্রথাবিরোধী এবং প্রস্তুত বলেই বস্তাপচা সাহিত্যকে অস্বীকার করেছে।
পাঠককে সরাসরি লিটল ম্যাগাজিনের লেখক ও লেখার সঙ্গে অংশগ্রহণ করতে হয়, তাতে মিথষ্ক্রিয়ায় গঠিত হয় নতুন যৌগ।
আবার, লিটল ম্যাগাজিন সাহিত্য সচেতন প্রকৃত পাঠক সৃষ্টি করে; পাঠকের অনুসন্ধিৎসু মনকে উসকে দেয়।
প্রকৃত লিটল ম্যাগাজিনে পাঠক মর্যাদা পায়।
লিটল ম্যাগাজিনের প্রকৃত পাঠকমাত্রই মননশীল, লেখকদের জন্য বড় সহায়, একে অন্যের পরিপূরক। যদিও এই ধারার পাঠক অপ্রতুল, তবু সংখ্যাল্পতা সত্ত্বেও এই পাঠক লিটল ম্যাগাজিনের জন্য কার্যকর সহযোগী এবং সাহিত্যের প্রকৃত পৃষ্ঠপোষক।
লিটল ম্যাগাজিনের পাঠক হওয়া একটা বিশেষ যোগ্যতা। পক্ষান্তরে বিনোদন ধারায় সাহিত্য পাঠকর্ম নিছক অভ্যাসের নামান্তর; এই পাঠ মগজ-কোষকে মৃত্যুতে পর্যবসিত করে ও চিন্তার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা দেখা দেয়; করোটির ভেতর স্নায়ুতন্ত্রের সক্রিয়তার সংবহন বাধাগ্রস্ত হয় । লিটল ম্যাগাজিনের ভাবনা প্রসারতা মস্তিষ্ককে উদ্দীপ্ত রাখে, এক বুদ্ধিবৃত্তির প্রখরতা হয় সম্প্রসারিত। মানুষটা সজীব ও কার্যকর থাকে এইভাবে, লিটল ম্যাগাজিন পাঠে, নতুন মৌলিক ভাবনার সংযোজনে। তরলীভূত ভাবনার অনুশীলনে মস্তিষ্কের সচলতা অসম্ভব। সাহিত্যে বিনোদন, ভাবালুতা, পুনরাবৃত্তি ও বৃত্তাবদ্ধ ছক এক অর্থে ঘুমের ঔষধের নামান্তর মাত্র ।
দশ.
যদি ধরে নেয়া হয় যে, লিটল ম্যাগাজিন চারিত্র্য অর্জন ও অ-প্রাতিষ্ঠানিক মানসিকতা চূড়ান্তরূপে আত্মস্থ করা কোন অকস্মাৎ বিষয় যেমন নয়, একইভাবে সদ্য ভূমিষ্ঠ সন্তানের মতো কোন পরিণতি বিশেষত্ব নয় কখনই। সেক্ষেত্রে এ হচ্ছে, একটা ক্রমাগত উত্তরণ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে অগ্রসর।
লিটল ম্যাগাজিন চারিত্র্য ও অপ্রাতিষ্ঠানিকতা ক্রমে কেলাসিত হয়ে বহুমাত্রিক স্ফটিকের মতো দ্যুতিময় ধারালো কৌণিক চেহারা অর্জন করে থাকে। তবে এই কখটা সত্য যে, বাস্তবে বর্তমানকালীন ও পূর্ববর্তী তথাকথিত অধিকাংশ লিটল ম্যাগাজিন নামধেয় কাগজের ক্ষেত্রে কেলাসিত হয়ে সঠিকমান অর্জনের জন্য প্রয়োজনীয় গ্রহণযোগ্য উপাদান, লক্ষণ ও বৈশিষ্ট্য, আবহাওয়া প্রভৃতি সম্পূর্ণ দুর্লক্ষণীয়। লিটল ম্যাগাজিন হিসেবে এইসব কাগজের উচ্চকিত দাবী যথেষ্ট সঙ্গতিপূর্ণ নয় বরং লঙ্ঘনীয় অপরাধ ও সীমাহীন স্পর্ধা। অধিকাংশ আবির্ভূত, ভূঁইফোড় দাবীকৃত লিটল ম্যাগাজিনের মূল প্রবণতা স্পষ্টরূপে নির্দেশ করে গতানুগতিক সাহিত্য ব্যবস্থার পরিণতির দিকেই স্ফূর্তিমান লক্ষ্যমাত্রা; এদের ভেতরে লিটল ম্যাগাজিনের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ কোন রকম প্রচেষ্টার অভাব নিদারুণ এবং প্রাথমিক শর্তপূরণের যোগ্যতাও অনুপস্থিত।
কতিপয় উজ্জ্বল ব্যতিক্রম রয়েছে, যে কারণে বর্তমান প্রবন্ধের উপস্থাপনা; যেমন : কোন-কোন সংখ্যা তপন বড়ুয়া সম্পাদিত 'গাণ্ডীব', হাবিব ওয়াহিদ সম্পাদিত 'অনিন্দ্য' বা একদা প্রকাশিত বর্তমানে যুগপৎ মৃত ও কবরস্থ সঙবেদ'।
এছাড়াও কিছু প্রকাশনা একই বিচারে গ্রহণীয় ও বরণীয়; এদের কর্মদ্যোম ও স্পৃহাকে স্বাগত ।
ঐতিহাসিকভাবে পুঁজির সঙ্গে সৃজনশীলতার সীমাহীন দ্বন্দ্ব ও সঙ্ঘর্ষের মধ্যেই নিহিত রয়েছে লিটল ম্যাগাজিনের জন্মবীজ; সৃজনের পেছনে কাজ করে মেধা ও শ্রম, পুঁজি কখনই শ্রম-মেধা-মননের জন্য বন্ধুসুলভ নয়; পুঁজি চায় মুনাফা এবং ক্ষমতার স্বাদ, শিল্প-সাহিত্যের ক্ষেত্রেও তা-ই মুখ্য বিষয়; পুঁজির উচ্চন্ডবিন্যাসও অনিবার্যভাবে একটা প্রতিষ্ঠান, একটা স্থিতিশক্তি। শিল্প-সাহিত্যের যে কোন শাখা-প্রশাখার মধ্যে পুঁজি বিনিয়োগ হলে অনিবার্যভাবে সেই সকল কর্মই দ্রুত পৃষ্ঠপোষকতা পায় যা মুনাফাকারী এবং কখনই সৃজনশীলতার উপাদান-যুক্ত রচনা নয়; এই ঘটনা অত্যন্ত বিরল যে, কোন রচনা একাধারে সৃজনশীল ও বাণিজ্যসফল। ব্যবসায়ে সাফল্য ও শিল্পোত্তীর্ণতা এক বস্তু নয়, জনরুচি শিল্পগুণ বিচারের চাবিকাঠি নয় বরং সৃজনশীলতার জন্য প্রতিকূল। প্রচারের উগ্রতায়, সমালোচনা কাঠামোর ধূর্ততায় 'কালো'কে 'সাদা' চেহারা প্রদানের হীন প্রচেষ্টা নিরন্তর বিভ্রান্তি ছড়ায়; পুঁজি জনরুচিকে 'এক্সপ্লয়টেশনে'র মাধ্যমে বাধ্য করে নিম্নগামী ধারায় নিরঙ্কুশ প্রবাহিত করতে। ফলে পণ্যসর্বস্ব রচনাকর্ম যথেচ্ছ গ্রহণীয় হয়। পুঁজি মূলত মুনাফার জনকমাত্র। এইসব অর্থকরী উদ্যমের বিপরীতস্রোত হিসেবে লিটল ম্যাগাজিনের অবস্থান ও সক্রিয় তৎপরতা; লিটল ম্যাগাজিনে একক বিষয় হচ্ছে বাণিজ্যিক ধারার বিপরীতে সমান্তরাল, আক্রমণাত্মক, সৎ, সৃজনধর্মী, অর্থ-অনীহ সাহিত্য ধারার নিরঙ্কুশ চর্চা। তাইতো জনপ্রিয় ধারায় লিপ্ত ও ব্যবহৃত, অসৎ-খর্বিত মসীজীবীদের প্রবেশাধিকারও প্রকৃত লিটল ম্যাগাজিনে নিষিদ্ধ হতে বাধ্য, কেবল মাত্র আপসকামী লোভাতুর ভেকসত্তার লিটল ম্যাগাজিনধারীরাই ঐসকল লেখককুলকে স্থান দেয় তাদের চিৎকৃত লিটল ম্যাগাজিনের শরীরে; এগুলো হচ্ছে গর্জমান লিটল ম্যাগাজিন। কিন্তু কর্মবান মৌলিক নতুন দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন রাজনীতিমনস্ক আপসহীন লেখক সৃজনশীল, চিন্তাশীল এবং অন্যকে তাৎপর্যময় চিন্তার মধ্যে নিক্ষেপ করতে সক্ষম হয় ফলে পাঠক সচেতন হয়, ঋদ্ধ হয়; এভাবেই অব্যাহত যুদ্ধ...
মার্চ ১৯৯৩
মন্তব্য