.header-button .inner > span { font-size: 18px !important; } .header-button .inner i.fa { font-size: 40px !important; } .comment-form-message { background-color: #f4f4f4 !important; font-size: 14px !important; }

রক্ত অনুষঙ্গ │প্রবন্ধ│ সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ

বাংলা গল্পের আখ্যান জুড়ে নানা প্রকার অনুষঙ্গ; অনুষঙ্গের বিভিন্ন রূপ, রক্ত- রক্তাক্ততা—রক্তিমতা। গল্পে রক্ত অনুষঙ্গ পুরনো এবং বহুল ব্যবহৃত ও চর্চিত : প্রান্তর রক্তাক্ত হচ্ছে, হৃদয়ে রক্তারক্তি ঘটছে—রক্তক্ষরণের আমূল বর্ণনা গল্পে প্রকাশিত হচ্ছে; এসবের উর্ধ্বে উঠে কোন কোন গল্পে রক্তপাত তথা রক্ত অনুষঙ্গ বিশেষ মাত্রা –ভিন্ন এক সংযোজন সৃষ্টি করে, দ্রবীভূত করে ভিন্ন এক দ্যোতনায়।

অনেক গল্প রয়েছে, স্মরণ করতে পারি, দুইটা গল্প : আল মাহমুদ এর 'পানকৌড়ির রক্ত' এবং কমলকুমার মজুমদার এর 'নিম অন্নপূর্ণা'। এই গল্প দুইটাতে রক্ত অনুষঙ্গ বহুকৌণিকতা নিয়ে উপস্থিত হয়েছে; মৃত্যু বা হিংস্রতার ছবি নয়, জীবনের আনুষঙ্গিক হিসেবে রক্ত অনুষঙ্গ নির্মাণ করেছে তৃতীয় একটা অক্ষ।

আল মাহমুদ, কবিতা ও গদ্য এই দুই মাধ্যমে কাজ করেছেন। কবিতায় আল মাহমুদ 'লোক লোকান্তর', 'কালের কলস' ও 'সোনালী কাবিন' সৃষ্টি করেন। জেলখানায় কবিতা লিখতে লিখতে সহসা 'মায়াবী পর্দা দুলে ওঠো' হয়, তিনি 'অদৃষ্টবাদীদের রান্নাবান্না" করেন এবং 'বখতিয়ারের ঘোড়া' নিয়ে অগ্রসর হন। তিনি 'প্রহরান্তের পাশ ফেরা' শেষে 'এক চক্ষু হরিণ' এবং 'মিথ্যাবাদী রাখাল' হন—পরবর্তীতে দূরাগামী তিনি স্থির 'খনা' বিষয়ক সনেটগুচ্ছে। প্রথম পর্বের কবিতায় প্রাণিত হয়েছে প্রেম-কাম-যৌনতা; 'মায়াবী পর্দা দুলে ওঠো'তে রাজনৈতিক বক্তব্যধর্মীতার সঙ্গে মিশ্রিত হয় ধর্মীয় চেতনাজাত উপাদানসমূহের অনবরত ব্যবহার; প্রচলিত উপকথামালাকে নতুন দ্যোতনা ও অর্থ প্রদান করা হয়েছে 'মিথ্যাবাদী রাখাল' কাব্যগ্রন্থে; বাঙালী কৃষিভিত্তিক সমাজের অভ্যন্তরীণ প্রাকৃতিক উর্বরা শক্তি সম্পর্কিত জ্ঞান ও বিচিত্র তন্ত্রমন্ত্রে উদ্বুদ্ধ তাঁর সনেটগুচ্ছ এক কীর্তি। চর্যাপদের কবিরা তাঁদের রচনায় কবিতা বলতে যা বুঝেছিলেন, আধুনিককালের রবীন্দ্রনাথ, জসীমউদ্দিন ও জীবনানন্দ দাশ ঐ পরিধিকেই আন্তর্জাতিক ও সম্প্রসারিত করে তোলেন এবং আল মাহমুদ তাদেরই উত্তরাধিকার। লৌকিক বাংলার নদী-মাটি-অন্তরীক্ষ, জীববৈচিত্র্য সর্বোপরি কৃষিভিত্তিক গ্রাম সমাজে নারীর একাধিপত্য, প্রাকৃতিক মহিমা ও সৌন্দর্য, জনসমষ্টির ভাষা, অলঙ্কার ও শব্দ তিনি কবিতায় আবিষ্কার করেছেন। তিনি সার্বিকভাবে দেশজ ও স্বদেশী। কাব্য দৃষ্টিভঙ্গিতে জীবনানন্দের সঙ্গে যে পার্থক্য তিনি রচনা করেছেন, তা হলো : জীবনানন্দের ঋণাত্মক কাব্য দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিপক্ষে আল মাহমুদের আশাব্যঞ্জক মনোভাব; সাহিত্যে অব্যবহৃত কিন্তু লোক সমাজে ব্যাপক প্রচলিত আঞ্চলিক শব্দরাজি, উপমা ও উৎপ্রেক্ষা তিনি ভীষণভাবে কবিতায় ছড়িয়ে দিয়েছেন। তিনি ভেঙে পড়া গ্রাম ও সমাজের কবি অথচ জীবনানন্দ বাঙালী ঐতিহ্যের কবি—যে ঐতিহ্যে রয়েছে হিন্দু-বৌদ্ধ চেতনা, তিনি এই দুই সম্প্রদায়কেই বাঙালী ঐতিহ্য বলে শনাক্ত করতে পেরেছিলেন। আল মাহমুদ, বাঙালী সংস্কৃতির অংশীদার বৃহত্তর বাঙালী মুসলমানকে কবিতায় উপস্থাপন করেছেন। প্রসঙ্গত অনস্বীকার্য যে, আল মাহমুদ যখন বিশেষ ভাবধারায় স্বতঃস্ফূর্ততার পরিবর্তে আরোপিত হন তৎক্ষণাৎ হয়ে পড়েন অচেনা; ইসলামী নব উত্থিত সাম্প্রদায়িক। রাজনৈতিক দলবাজির, সাংস্কৃতিক রুচির অভাব তাঁর প্রতিভা ও সৃষ্টিশীলতা সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারছে না।

সমাজ-সময় –বোধের নানা প্রভাবে পুষ্ট তাঁর কাব্য চিন্তা ও কবিতার প্রভাব পরবর্তী প্রজন্মের বাংলা কবিতায় দুর্লক্ষণীয় নয়, তিনি প্রভাব বিস্তারকারী। বর্তমানে তাঁর কবিতায় নিজেকে উদ্ঘাটন ও অস্তিত্বরহস্য ভেদের প্রমত্ত আকাঙ্ক্ষা প্রকাশিত। আল মাহমুদ এর গদ্যে তাঁর সামগ্রিক চেতনার রেখাপাত লক্ষ করা যায়। বর্তমানে এই কবি
নিজেকে গদ্য রচনায় স্থির করেছেন। তবে তার গদ্য-পদ্য সকল লেখার গতিধারার মধ্যে কাব্যময় ঐক্য অনস্বীকার্য। তিনি পশ্চিমবঙ্গীয় সাহিত্য অনুকৃত এদেশীয় সাহিত্যিকগণের বানোয়াট গদ্য-পদ্য রচনার বিপরীতে বাংলাদেশের গ্রামীণ কৃষি সমাজের মানবিক আবেগ-অনুভূতি ও স্বপ্নের মূল উপজীব্য করার সাহিত্যকর্মে কমিটেড/সৃষ্টিশীলতায় মুখরিত।

আল মাহমুদের গল্পে ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চল এবং তিতাস নদী পটভূমির দিকে কোন সীমাবদ্ধতা সৃষ্টি করেনি ফলে ভাটি অঞ্চল নয় বরং তাঁর গল্পে খুঁজে পাওয়া যায় সারা বাংলা, যেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ উপেক্ষিত মানুষের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, প্রেম- অপ্রেম, হিংসা-ভালবাসা, স্বপ্ন-হতাশা এবং মৌনতা -যৌনতা; উর্বরা জমি কর্ষণ-ফলন এই সবকিছু অন্তর্দৃষ্টি ও প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতায় তাঁর কলমে বিপুলভাবে মূর্ত হয়ে উঠেছে। হাসান আজিজুল হকের গল্পে রাঢ় বাংলা, আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের গল্পে পুরাতন ঢাকা ও উত্তরাঞ্চল উজ্জ্বল হয়ে উঠলেও আল মাহমুদের গল্পে সারা বাংলার রক্ত সঞ্চালন অনুভূত হয়ে ওঠে।

আল মাহমুদ 'একটি চুম্বনের জন্য প্রার্থনা' করতে গিয়ে তলিয়ে যান। মীরবাড়ির কুর্সিনামা' ও 'গন্ধবণিক' তাঁকে জাগিয়ে রাখে। ইসলামী ভাবধারায় গল্প লিখতে গিয়ে একটা আত্মহত্যার আয়োজনে লিপ্ত তিনি হয়তো বিস্মৃত হন যে, মার্কসবাদী সাহিত্য- শোষক-শোষিতের দ্বন্দ্ব ও শোষিতের বিজয় নিশান ওড়ানোর গল্প কেবল সময়ের প্রয়োজন মিটায়ে ফুরিয়ে গেল কীভাবে –কোন সাহিত্যকৃতি হিসেবে স্থান লাভে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হল।

সব্যসাচী সৈয়দ শামসুল হক গল্প-কবিতা মাধ্যমে সিদ্ধহস্ত, নিরীক্ষায় ক্লান্তিহীন; তাঁর লেখায় পটভূমি স্থানান্তরিত হয় উত্তরবঙ্গ হতে ঢাকা এবং বিলাত পর্যন্ত, প্রধান উপজীব্য বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ – সংগ্রাম অথচ আল মাহমুদ একজন মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী হলেও মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে অনুচ্চ প্রকাশ—লেখালেখিতে মুক্তিযুদ্ধের অনুপস্থিতি এবং যে কোন প্রকার নিরীক্ষার ক্ষেত্রে অপারগতা দৃষ্টি আকর্ষণ করে।

কমলকুমার মজুমদারের সাহিত্যিক জীবন দীর্ঘ, রচনাবলী অতি অল্প কিন্তু তিনি সীমিত রচনার মাধ্যমে অনুভূতি ও অভিজ্ঞতার সম্প্রসারণ, ভাষার বহন ও ধারণক্ষমতা বৃদ্ধি এবং বিষয়ের পরিধি বিস্তৃত, প্রসারিত করেছেন; বাংলা কথাসাহিত্যের প্রধান নির্মাণকর্তাদের অন্যতম তিনি। কমলকুমার মজুমদারের ভাষা বাংলা গল্প-উপন্যাসের ক্ষেত্রে নতুন এক বৈপ্লবিক উপাদান জন্ম দিয়েছে—বাংলা গদ্যে চিত্র রচনা একটা নতুন পরিপ্রেক্ষিতের সঙ্গে যুক্ত ও নতুন উপকরণ সমন্বিত হয়ে বিশেষ পরিস্থিতি তৈরি করেছে ফলে তিনি গল্প-উপন্যাসের বলয়ে নতুন বিষয় সংযোজন করার মাধ্যমে এই নতুন বিষয়সমূহকে কবিতার বদলে গদ্যে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।

উপনিবেশিক শাসনের প্রক্রিয়াজাত আধুনিকতার সঙ্গে দেশজ ঐতিহ্যের সঙ্ঘাত কমলকুমারের গদ্য শৈলীর অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। তৃতীয় বিশ্বে আধুনিকতা এবং ঐতিহ্যের পারস্পরিক সঙ্ঘাত সামাজিক দ্বান্দ্বিকতার প্রতিক্রিয়ামাত্র। বাংলাদেশে এই প্রক্রিয়া আরম্ভ হয় ইংরেজ শাসনামলে; উপনিবেশিক শাসনের ফলে বাংলার মূল কাঠামোতে পরিবর্তন ঘটে; ইংরেজ গড়ে তোলে সুবিধাভোগী শ্রেণী এবং এই নব্য শ্রেণী নিজস্ব স্বার্থে গড়ে তোলে একটা উপনিবেশিক সংস্কৃতি –এই সংস্কৃতির আরেক ভিত্তি চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত। উপনিবেশিক শাসনের কল্যাণে প্রাপ্ত সংস্কৃতি ও আধুনিকতা তিনি গ্রহণ না করে উপনিবেশিক গদ্য ভাষাকে অস্বীকার করেছেন। ইংরেজ আগমনের ফলে সৃষ্ট গদ্য ভাষাকে কেবল অস্বীকার করেই ক্ষান্ত না হয়ে মার্শেল প্রুস্তের সূত্র অবলম্বনের মাধ্যমে ভাষার প্রতি চালিয়েছেন প্রচণ্ড আক্রমণ। ভাষার মূল কাঠামোকে আক্রমণ করে তিনি ভেঙে ফেলেন বাক্য বিন্যাসের কাঠামো, পদক্রম সাজালেন ইচ্ছানুযায়ী; কমলকুমার বাংলা গদ্য শৈলীতে নিজেকে প্রথাবিরোধী হিসেবে চিহ্নিত করেন; তাঁর গল্প-উপন্যাসের বিষয়বস্তুতে যেমন বিশিষ্টতা রয়েছে তেমনই আছে পৃথক স্বাদ।

গল্প লেখার আদি পর্বে কমলকুমারের গদ্য শৈলী ছিল মন্থর; 'লাল জুতো' গল্পে গদ্য বেশী গম্ভীর; চলিত ভাষায় গল্পটা রচিত হলেও স্বতঃস্ফূর্ততা ছিল অনুপস্থিত। চলিত ভাষা কমলকুমারের উপযুক্ত প্রকাশ মাধ্যম নয়। অতঃপর ক্রমশ সাধু ভাষা অবলম্বন করলেন তিনি। আত্ম-স্বাতন্ত্র্যের প্রয়োজনে কমলকুমার স্ব-সৃষ্ট গদ্য ভাষার অনুশীলন করেছেন অনবরত। এই অনুশীলনকে ইংরেজ আগমনপূর্ব গদ্য শৈলীর চর্চা হিসেবে গণ্য করা যেতে পারে। কমলকুমার মজুমদারের কতিপয় উচ্চারণ স্মরণ করা যেতে পারে, যথা : 'লেখা আমি দুর্বোধ্য করি না—এত সরল যে তাহা দুর্বোধ্য হইয়া যায়', 'প্রত্যেক লেখাই প্রতি লেখকের নিকট দুরূহ', 'আমরা পাঠককে ভোট-দাতা বা ইউনিয়ন করে বলিয়া ভাবি নাই' এবং 'লোকমান্য হইবার বাসনা আমার নাই'।

“শ্যাম নৌকো'র ভূমিকায় ভাষা সম্পর্কে মতামত জ্ঞাপন করেছেন কমলকুমার মজুমদার। তিনি মনে করেন প্রাত্যহিক জীবনে একই শব্দের বহুল ব্যবহারে বাংলা ভাষার অস্তিত্ব বিপন্ন ফলে বংশগত আভিজাত্যবোধ শব্দের যথাযথ মর্যাদাকে রক্ষা করতে সক্ষম হবে। এই প্রসঙ্গে আবশ্যিক বক্তব্য এই যে, বাংলা ভাষা রক্ষার দায়িত্ব বর্ণ হিন্দুর একার নয় বরং ভাষার বিকাশ দেশ ও জাতির আর্থ-সামাজিক অবস্থানের উপর নির্ভরশীল।

“শ্যাম নৌকো'তে ভাষা বিষয়ক প্রস্তাবনার পর কমলকুমার বাংলা সাহিত্যের ঐতিহ্যের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেছেন। 'রামপ্রসাদ, ঈশ্বরগুপ্ত, মাইকেল, বিদ্যাসাগর, বঙ্কিমবাবু, সঞ্জীববাবু, গিরিশ বাবু, রামেন্দ্রসুন্দর এবং শরৎ চাটুজ্জ্যে' কমলকুমারের ঐতিহ্যবোধের দিকনির্দেশনা। কিন্তু ব্রাহ্ম বলে রবীন্দ্রনাথ কিংবা বিষাদ সিন্ধু'র লেখক মীর মশাররফ হোসেন কমলকুমারের নিকট উপেক্ষিত রইলেন ।

অবশ্য রামকৃষ্ণের ভক্ত হয়েও কমলকুমার তার গল্পের চরিত্রদের ঠাকুরের কাছে নতজানু করান নাই, এখানেই কমলকুমারের জয়-জয়কার।

নিটোল গল্প রচনা কমলকুমারের লেখালেখিতে নাই; একই জায়গায় গল্পের শুরু ও শেষ হয়। জীবনের খণ্ডাংশকে নয়, একটা সম্পূর্ণ মানুষকে তিনি তাঁর গল্পে তুলে ধরেন। খণ্ড খণ্ড ঘটনা প্রবাহ এসে ভিড় জমায় আবার খণ্ড বিখণ্ড ঘটনা প্রবাহকে এড়িয়ে একই গল্পে মানুষের অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন করেন। সব প্রশ্নের জবাব মেলে না এইসব গল্পের চরিত্রদের জীবনে । অথচ ঠাকুরকে দিয়ে কৃপা ছড়াতেও আগ্রহী হন না কমলকুমার মজুমদার।

কমলকুমারের ভাষারীতির বৈশিষ্ট্যের একটা ব্যাকরণগত দিক রয়েছে। প্রধানত সাপেক্ষ সর্বনাম ও সংযোজক অব্যয়ের ব্যবহারে ও যৌগিক বাক্য গঠনে। লৌকিক ক্রিয়া বা পদ ব্যবহার করেছেন। কিন্তু বিশেষ্য বিশেষণের ব্যবহার বৈপরীত্যে শব্দের নতুন অনুষঙ্গ- সৃষ্টি, ক্রিয়ার কাল ও ভাবের প্রকাশে ক্রিয়ার নতুন ব্যবহার – এগুলো তাঁর রীতির এমন বৈশিষ্ট্য যে, বাংলা গদ্যের ধারণ ক্ষমতা ও প্রসারতা বেড়ে গেছে। যতিচিহ্ন ব্যবহারের ক্ষেত্রে কমলকুমার বাংলা যতিচিহ্নের নিয়মাবলী গ্রহণ করেন নাই, ব্যাকরণের নিয়ম ভেঙে নিজস্ব নিয়মে যতিচিহ্ন ব্যবহার করেছেন।

চল্লিশ দশকের লেখক হওয়া সত্ত্বেও রাজনৈতিক তত্ত্ব কিংবা সমাজ অভিজ্ঞানের আলোকে আলোকিত করেন নাই নিজস্ব সৃষ্ট গল্প-উপন্যাসের চরিত্রকে। কমলকুমার মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবীর দৃষ্টিতে মানুষকে গল্প-উপন্যাসে স্থাপিত করেন নাই। অন্ত্যজ মানুষের গ্লানিবোধ, বেদনার উৎসারণকে ধারণ করেছেন আপন রচনায় যদিও ব্যক্তিগত জীবনে অনুশীলন করেছিলেন উনিশ শতকের বাবুয়ানা।

ভাষার ক্ষেত্রে কমলকুমার যেমন ভিন্ন ধারার প্রবক্তা তেমনি গল্পের প্রসঙ্গে, কাহিনী নির্বাচনে এবং চরিত্র নির্মাণ করার ক্ষেত্রেও তিনি সম্পূর্ণ পৃথক। কমলকুমারের উপন্যাস ছোট গল্পের আদলে রচিত; চরিত্রসমূহের সংঘাত ও ব্যাপ্তি পর্যাপ্ত নয় বরং মসৃণ ও ঋজু ;উপন্যাসে স্থান কালের পরিধি সীমিত; বিষয়ে ডিটেইলসের প্রতি আগ্রহ বেশী ফলে পরিবেশ পটভূমি রমণীয় এবং বর্ণাঢ্য হয় ।

কমলকুমারের শিল্প-ভুবনে নেই নর-নারীর প্রেমের তীব্রতা; প্রেম নয় মানুষের বেঁচে থাকার সঙ্কটের গল্প লেখায় বিধৃত। নারীর গৌণ ভূমিকা কমলকুমারের কথা সাহিত্যের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। নারীর প্রেমকে অবলম্বন করে প্রেমের মহিমা জাগ্রত করেন নাই তাঁর যাবতীয় রচনায়। প্রেম নয়, কামনা কিংবা প্রেমহীনতার কারণে উদ্ভূত বিকৃতিকে কমলকুমার মনস্তাত্ত্বিকের মতো বিশ্লেষণ করেছেন। ফ্রয়েডের চেতনা কিংবা মার্কসীয় চেতনা কমলকুমারকে প্রভাবিত করে নাই; ইয়ুং এর লিবিডো চেতনা কমলকুমারের মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের মাধ্যম হিসেবে শনাক্ত করা যেতে পারে।
পরিবেশ পটভূমিতে সাঁওতাল পরগণা, গঙ্গার তীরবর্তী বাংলাদেশ এবং দক্ষিণের নোনাভূমি কমলকুমারের গল্প উপন্যাসের মূল পটভূমি। কলকাতা মহানগরীর প্রসঙ্গ তাঁর গল্প- উপন্যাসে তুলনামূলকভাবে কম উপস্থিত। তারাশঙ্কর, বিভূতি ও মানিক বন্দ্যোপাধায়ের মতো কমলকুমারের কাহিনী স্বতঃস্ফূর্তি লাভ করে, বাংলাদেশের গ্রামীণ জীবন, জন্মগ্লানির অভিশাপে পীড়িত কিশোর বালক, জৈবিক প্রবৃত্তির তাড়নায় কাতর নিম্নবর্গের হিন্দু, আদিবাসী, দেশীয় খ্রিস্টান ও চাষা তাঁর গল্প উপন্যাসের মূল চরিত্র হয়ে যায়।

কমলকুমারের গল্পের জগৎ গড়ে উঠেছে আবহমান বাংলা ও বাঙালীকে কেন্দ্র করে। মধ্যযুগের শ্রীচৈতন্যের প্রেমধর্মকে কমলকুমার গ্রহণ করেছেন বাঙালীর জীবন ধর্ম হিসেবে। বাঙালী সংস্কৃতি কমলকুমারের রচনায় অনার্য জীবনের স্বাভাবিক পরিণতি হিসেবে গৃহীত। কমলকুমারের হিন্দুত্বের ধারণা উপনিষদ নির্ভর নয়, রবীন্দ্রনাথের মতো এবং বঙ্কিমের আর্য সংস্কারের অনুরূপ নয়। কমলকুমার হিন্দু চেতনা লোকায়ত এবং শ্রীচৈতন্য ও রামকৃষ্ণের জীবন দর্শন দ্বারা প্রভাবিত। তাঁর গল্প-উপন্যাসের মানুষেরা কেউ আর্য হিন্দু নয় বরং অনার্য ব্রাত্য। কমলকুমারের গল্প উপন্যাসের জগৎ আবহমান বাংলা ও বাঙালীকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠলেও বাংলার বিশাল জনগোষ্ঠি মুসলমান চরিত্র বা আচার প্রথা তাঁর লেখায় উল্লিখিত হয় না। ফলে অনুপুঙখভাবে নয় খণ্ডাংশে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর বাংলাদেশ। গল্প-উপন্যাসের কাহিনী বিন্যাসে চরিত্রসমূহ একক ব্যক্তিত্ব নয় বরং পরিবেশ প্রকৃতির সঙ্গে একাত্ম হয়ে ওঠে, গল্প উপন্যাসের চরিত্রসমূহ জীবনবাদী ও বহির্মুখী; মানুষ বেঁচে থাকার জন্য ভেঙে ফেলে সামাজিক অনুশাসন।

কমলকুমার মজুমদার সমালোচকগণের সমর্থন লাভে ব্যর্থ হয়েছেন বলা যেতে পারে। মূলত ভাষার দুরূহতা এই ক্ষেত্রে প্রধান বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বলতে দ্বিধা নেই, সমালোচকগণের অশিক্ষার দায় লেখকের উপর ন্যস্ত হয়। এছাড়াও সাহিত্যের অধিকাংশ পাঠক-লেখক-সমালোচকগণ প্রকৃতপক্ষে কমলকুমারের
প্রকরণ-ভাষা-বিষয়ের জন্য সমর্থন করেন না কথাটা হয়তো অনেকাংশে ঠিক নয় বরং কমলকুমারের ক্লাসিকধর্মীতার বিরুদ্ধে যেন সকলের অবস্থান। অতএব চরিত্রের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম আখ্যান ক্লান্ত করে, ঘটনার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ বিরক্ত করে, বাক্যে অভ্যস্ত স্থান হতে একটা বিশেষণের বিচ্যুতিতে ভাষার সংযোগ হারিয়ে যায়, ক্রিয়াপদটাকে অভ্যস্ত স্থানে না পেয়ে ভাষা দুর্বোধ্য হয়ে ওঠে, বাক প্রতিমার বিমূর্ততা দুর্গম পথ রচনা করে। পাঠক-সমালোচক হিসেবে অক্ষমতা লেখকের কাঁধে ন্যস্ত করা হয়। বস্তুত কেউই এই বিশেষ লেখকের জন্য প্রস্তুত নন– শিক্ষিত নন । কমলকুমারকে অনেকে ফর্ম/আঙ্গিক সর্বস্ব লেখক মনে করেন। আসলে এই সব পাঠক-লেখক-সমালোচক হেগেলীয় অপরিবর্তনীয় ধারণা তত্ত্বের শিকার। মার্কসবাদ কোন ধারণার সর্বকালীন সত্যে বিশ্বাস করে না। ধারণার সর্বকালীনতা হেগেলীয়  ও তৎপূর্ব দর্শনের ভিত্তি। ভাষায় বিচ্ছিন্নতা কখনও কখনও ভাষা সাহিত্যের ক্ষেত্রে নতুন বৈপ্লবিক উপাদানের জন্ম দেয়।

গল্পের পর গল্পে, উপন্যাসের পর উপন্যাসে ফর্মের চমককে চেনা হয়ে যেতে দিয়েছেন, বিষয়ের নতুন স্তরান্তরের মাধ্যমে ফর্মের নমনীয়তা পরীক্ষা করতে চেয়েছেন—এই ক্ষেত্রে সাফল্য ও ব্যর্থতা দুই-ই ঘটেছে।

সাহিত্য ইতিহাসের রচয়িতারা মহাকাল নন—ওরা সাধারণ, এদের রচনা করা ইতিহাসের তোয়াক্কা তিনি করেন না। এই বিশ্বাসে বাংলা গল্প-উপন্যাসের শিল্পী কমলকুমার মজুমদার শিল্পের ধারাল পথ নির্বাচন করে নিয়েছেন।

আল মাহমুদ এবং কমলকুমারের মধ্যে মিল ও পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। আল মাহমুদ
সম্পাদনা করেছেন দৈনিক সংবাদপত্র 'গণকণ্ঠ' যা বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরবর্তী
রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বিরোধী একটা চরম প্রভাব বিস্তারকারক ভূমিকা পালন করেছিল। বাংলা ভাষায় প্রথম গণিত বিষয়ক পত্রিকা 'অঙ্ক ভাবনা'র সম্পাদক ছিলেন কমলকুমার এবং তাঁরই সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়েছিল গোয়েন্দা পত্রিকা 'তদন্ত'।

আল মাহমুদ মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন অথচ তাঁর রচনায় মুক্তিযুদ্ধ প্রবলভাবে উপস্থিত হয় নাই। কমলকুমার রাজনৈতিক ছিলেন না তবে তাঁর লেখায় ভারতের স্বাধীনতা ও দেশভাগকে উপজীব্য করা 'তাহাদের কথা' বাংলায় আলোড়ন সৃষ্টিকারী দেশভাগের উপর প্রতিক্রিয়া ও ক্রিয়াকলাপ ভিত্তিক বড় মাপের কাজ। অবশ্য 'উপমহাদেশ' নামে আল মাহমুদের একটা উপন্যাসের সূত্র দ্বি-জাতিতত্ত্বের উপর রচিত প্রয়াস হিসেবে শনাক্ত করা যায়।

আল মাহমুদ গল্প-উপন্যাস এবং কবিতা মাধ্যমে কাজ করেছেন। এছাড়াও রচনা করেছেন ব্যক্তিগত রচনা 'জীবন যাপন', প্রবন্ধ – 'কবির আত্মবিশ্বাস', জীবনী 'ছোটদের হযরত মুহাম্মদ (সঃ)' এবং সম্পাদনা করেছেন কতিপয় গ্রন্থ যথা : 'আহত কোকিল', 'আব্বাসউদ্দিন' ইত্যাদি।

কমলকুমার মজুমদার গল্প-উপন্যাস-প্রবন্ধ রচনা করার সঙ্গে চিত্রণ, প্রচ্ছদ অঙ্কন, নাট্য প্রযোজনা, যথা : 'দানসা ফকির', 'লক্ষণের শক্তিশেল' এবং 'আলমগীর' এর মাধ্যমে বহুমুখী প্রতিভার পরিচয় দিয়েছেন।

আল মাহমুদ মন্দ্র কণ্ঠস্বরে নিজস্ব অনুভব ও কম্পমান প্রাগ্রসর জীবনের কথা বলেছেন সযত্নে রচিত পরিচ্ছন্ন ভাষার সাহায্যে। তাঁর কবিতা প্রচণ্ড কবিসুলভ এবং গদ্যে কাব্যবীজ প্রকাশিত। তিনি গদ্যে ও কবিতায় প্রাতিষ্ঠানিক, –নিরীক্ষা মনস্ক নন। তাঁর যাবতীয় রচনায় লোকজ, আঞ্চলিক এবং ভাষায় অব্যবহৃত শব্দ বিরল নয়; তিনি সম্পূর্ণ দেশজ মনস্ক একজন শিল্পী, তিনি যা লিখেছেন সবই প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতায় জারিত এবং তিনি যখন বর্ণনা করেন জল-কাদা, বাতাস -আকাশ, ফল বা গাছপালা কিংবা পত্রালি তথা মাটির কথা—এদেশের সমস্ত কিছুর বিশদ বিবরণ, আমরা তখন বাস্তবতার ঘ্রাণ পাই, সব হয়ে ওঠে জীবন্ত; মাটির কথা বললে সেই মাটির গন্ধ ইন্দ্রিয়ে ধরা পড়ে। আল মাহমুদের লেখায় মুসলমান মন কাজ করে।

কমলকুমার, রচনার ভাষা ও আঙ্গিকে নিরীক্ষাপ্রবণ। তিনি ভাষার প্রচলিত বিন্যাসে বিশ্বাসী নন। তাঁর ভাষায় কাব্যবীজ উপস্থিত। তিনি গদ্যের প্রচলিত প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোকে চ্যালেঞ্জ করেন। উপনিবেশিকতা সৃষ্ট গদ্যে আস্থা রাখেননি বরং তিনি উপনিবেশিকতা হতে মুক্ত হয়ে গদ্য রচনা করে গিয়েছেন। তিনি প্রাতিষ্ঠানিক মাধ্যমে সাহিত্য চর্চায় কুণ্ঠিত ছিলেন; দুই/একটা রচনা ব্যবসায়ী কাগজে প্রকাশিত হলেও মূলত লিটল ম্যাগাজিনে ছিলেন স্বাচ্ছন্দ। রবীন্দ্রনাথ সাধুভাষা পরিত্যাগ করে চলিত ভাষাকে প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করলেও কমলকুমার চলিত ভাষা বর্জন করে সাধু ভাষায় লিখে গেছেন গল্প-উপন্যাস-প্রবন্ধ। কমলকুমারের রচনায় সর্বপ্রাণবাদী পৌত্তলিক চেতনায় জারিত ব্যঞ্জনার লক্ষণ পাওয়া যায়। তিনি হিন্দুত্বের শাক্ত শাখায় অশেষ বিশ্বাসী। তাঁর মানসচেতনায় বিচরণ করেন শ্রীচৈতন্য এবং রামকৃষ্ণ। সর্বপ্রাণবাদী পৌত্তলিক ভাবধারা হচ্ছে জীবনের প্রতি আনুগত্য এবং জীবনমুখী এক ধরনের চেতনা। ধর্মের সঙ্গে সর্বপ্রাণবাদী পৌত্তলিক চেতনার দ্বন্দ্ব কমলকুমারের সাহিত্য, গল্প- উপন্যাসের বক্তব্যগত সঙ্ঘাতের মৌলসূত্র হিসেবে গ্রহণ করা যায়।

কমলকুমারের গল্প-উপন্যাসে নারী ও যৌনতার উপস্থিতি সীমিত। অবশ্য 'রুক্মিনীকুমার' গল্পের যৌনতা ব্যতিক্রম হিসেবে উপস্থিত। পক্ষান্তরে আল মাহমুদ এর গল্পে নারী ও যৌনতা তীব্রভাবে রেখাপাত করে । আল মাহমুদের গল্প-উপন্যাসে শিল্পিত যৌনতার রূপ অন্যরকম বিশিষ্টতা সৃষ্টি করেছে। বাংলা সাহিত্যে এ হচ্ছে নিঃসন্দেহে একটা বিরল অভিজ্ঞতা।

নদীয়া-শান্তিপুরের ভাষা এবং ফিচারধর্মী, সাংবাদিকসুলভ তরল গদ্যের বিপরীতে আল মাহমুদ এবং কমলকুমার মজুমদারের দৃঢ় অবস্থান রয়েছে। কমলকুমার মজুমদার হচ্ছেন রামমোহন রায় হতে ধারাবাহিকতার শেষ উচ্ছ্বাস। মীর মশাররফ হোসেন হতে শুরু করে সাহিত্যের যে ইতিহাস সেখানে আল মাহমুদকে শেষ প্রতিনিধি হিশাবে শনাক্ত করা যেতে পারে।
আল মাহমুদ এর 'পানকৌড়ির রক্ত' গল্পটা ১৯৭৩-৭৫ সময়কালে রচিত। এই গল্পটা উত্তম পুরুষে লেখা হয়েছে। গল্পে 'আমি' চরিত্রটার নাম আনোয়ার, আদিনা নামের একটা মেয়ের সঙ্গে বিয়ে হয়েছে সদ্য, সহজভাবেই শেষ হয়েছে শুভ কর্ম। কনের পিতার একটা শর্ত ছিল যে, বিয়েটা গ্রামের বাড়িতে হবে, বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা শেষ না হওয়া পর্যন্ত তাঁরা গ্রামে থাকবে। বিয়ের পর গল্পের 'আমি' চরিত্রটা অর্থাৎ আনোয়ার বিয়ে করা বউ নিয়ে ফিরযাত্রায় অর্থাৎ আদিনাকে নিয়ে কয়েকদিন থেকে সবাই মিলে কুমিল্লায় ফিরে যাবে।

তো, সেই ফিরযাত্রায় বিয়ের ছয়/সাত দিন পর এক সন্ধ্যায় আসার পর একদিন 'আমি' চরিত্রটা বন্দুক হাতে শিকারের উদ্দেশ্যে বের হলো। বন্দুক হাতে রওনা হওয়ার সময় স্ত্রী আদিনা রসিকতা করে বলে একটা ধনেশ পাখির ঠোঁট না নিয়ে ফেরা পর্যন্ত সে গাছতলায় অপেক্ষা করে যাবে। 'আমি' চরিত্রটা শুধু ধনেশ পাখির ঠোঁট নয়, বাতাসের পালক তুলে আনবে বলে রওনা দিয়ে শ্বশুর বাড়ির গ্রাম হতে প্রায় পোয়া মাইল এগিয়ে যায়।

'আমি' চরিত্র অর্থাৎ আনোয়ারের শিকার পর্বের মধ্য দিয়ে পুরো গল্পটা আবর্তিত হয়। শিকারে নেমে প্রথমে সে একটা সাদা 'বগা'কে সই করে ফেলে দেয় কিন্তু এতে তার কোন ভাবান্তর হয় না । ঘটনা ঘটে যখন একটা কালো পানকৌড়ি চোখের সামনে একটা শুকনো বাঁশের ডগায় উড়ে এসে বসে এবং মাত্র পঁচিশ গজ দূরের এই পাখিটাকে নিরীক্ষণ করতে করতে এর সৌন্দর্য মন কেড়ে নেয় তার। আদিনার সঙ্গে একটা মিল খুঁজে পায়; পাখিটা যত পালক ঝাড়ছে, গ্রীবা দুলিয়ে এপাশ-ওপাশ দেখছে ততই মনে হতে থাকে আদিনার এমন ভাবভঙ্গি রয়েছে। আদিনা ও পানকৌড়ির মধ্যে রয়েছে সতেজ ভাব, গায়ের রং মায়ামমতাময় ময়লা—এমনই অনাবিল সৌন্দর্য দুজনার। পানকৌড়িটা দেখতে-দেখতে আদিনার কথা মনে পড়ে যায়। পাশের বাড়ির আকিল সাহেবের মেয়ে আদিনা মায়ের কুটাকাটায় সাহায্য করতে আসত, শুকনা আচার চুষতো মায়ের চুলে বিলি কেটে দিতে দিতে; শরীর সম্পর্কে সচেতন ছিল না; বাহু-বক্ষবিতান সুডৌল হয়ে উঠেছিল; একদিন সে আদিনার কমলা রঙের ফ্রকের ফাঁক দিয়ে উরু দেখে ফেলেছিল। কারুকার্যময় খিলানের দুইটা থামের মতো মনে হয়েছিল উরুযুগল। আদিনা ফ্রকের সামনের দিকটা দিয়ে ঘামে ভেজা মুখটা মুছতে গেলে সে নাভি দেখে ফেলেছিল—জেগে ওঠা তলপেটের পেশীতে ভারসাম্য আনার জন্য এ ধরনের জবা ফুলের মতো নাভিমণ্ডলকে বড় প্রয়োজনীয় মনে হয়েছিল তার।

আদিনার সঙ্গে কালো সিক্ত ডানার পানকৌড়ির ভাবভঙ্গিতে মিল খুঁজে পাওয়ায় চোখ ফেরাতে পারে না। তবু গুলি করতে হলে অতি সাবধানে এগিয়ে যেতে হবে। সোজা খালপাড়ে উঠে যাওয়ার পর সে সন্তর্পণে এগিয়ে দেখে পানকৌড়িটা উড়াল দেয়ার মতো করে বসে আছে। 'আমি' চরিত্রটার মনে পড়ে যায় দুই বাহু মেলে দিয়ে এভাবেই একবার ছয়দিন আগে গলা জড়িয়ে ধরে বলেছিল... এই আমার প্রথম রক্ত । তুমি নোংরা হয়ে যেতে, তোমার গা ঘিন ঘিন করত। বাসর রাত শেষে এই কথা হয় এবং তারপর আদিনার হাত ধরে পেছন ফিরে দুইটা হাত উঁচু করে ধরলে যেমন লেগেছিল, বন্দুকের নলের সামনে পানকৌড়ির ডানা ছড়ান শরীরটাকে তেমন মনে হয়।

হঠাৎ সে আবিষ্কার করে পাখির পেছন দিক হতে সে লক্ষ্য স্থির করেছিল। অথচ বীর্যবর্ষণকারীগণ যেমন রমণলিপ্তা নারীর মুখমণ্ডল, বাহুমূল, স্তনযুগলের প্রত্যক্ষতা অবলোকন ও প্রেষণের প্রয়োজন অবধারিতভাবে অনুভব করে তেমনি শিকারের মুখোমুখি না হলে বারুদবর্ষণকারীরা কোন আনন্দ পায় না।

অবশেষে বন্দুক তুলে কোন রকমে ব্যারেল সই করে গুলি করতেই লক্ষ্য ভ্রষ্ট হলো। দ্বিতীয় প্রচেষ্টায় শিকারীর সহজাত চাতুরীগুণে ডুব সাঁতার দেয়া পাখিটা যেখানে ভেসে উঠতে পারে, তা আন্দাজ করে বুদবুদসহ পাখিটা ভাসামাত্রই ট্রিগার চেপে সফল হলো সে। পাখিটা যেখানে গুলি খেয়ে তড়পাচ্ছে সেখানে কেউ যেন এক বালতি রক্ত ঢেলে দিয়েছে, খালের পানি টাটকা রক্তে রঙিন হয়ে গেল। এবং তৎক্ষণাৎ 'আমি' চরিত্রটাকে তীব্র পুরাতন মাইগ্রেনের ব্যথা প্রবলভাবে আক্রমণ করল। শিকার বাদ দিয়ে ফিরে যায় সে, এই তীব্র ব্যথা মাথাটাকে শূন্য করে দেয়, এই মাথাব্যথা সে মায়ের কাছ হতে পেয়েছে। সে শ্বশুরবাড়িতে শিকার শেষে ফিরলে উদ্বিগ্ন হয় সকলে, আদিনা তার এই মাথাব্যথার কথা জানে। ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে উদ্বিগ্ন স্ত্রীকে না করে এবং শ্বশুর- শাশুড়িকে জানায় যে, চব্বিশ ঘণ্টা পরে ঘুম দিয়ে উঠলে মাথাব্যথা সেরে যাবে।

শ্বশুর-শাশুড়ি দরজা ভিজিয়ে চলে গেলে আদিনা খিল এঁটে দিয়ে কপালে জলপট্টি চেপে ধরে কানের কাছে মুখ এনে জানাল : আজ হবে। ব্যাপারটা বন্ধ হয়েছে। বিছানায় উঠে হাসতে হাসতে বলল : তুমি এখনি চাও?

আদিনাকে 'আমি' চরিত্রটা বুকে টেনে নিল; আদিনা বুক দিয়ে মুখমণ্ডল ঢেকে দিল তার। পানকৌড়ির পালকের মতো গাঢ় কালো রঙের মধ্যে চোখ ডুবিয়ে স্বস্তি এল। খালবিলে উড়ন্ত পাখপাখালির গায়ের গন্ধ নাকে এসে হানা দিল। সে আবার একনলা বন্দুক হাতে ত্রিকোণাকৃতি চারণভূমিতে বিচরণ করতে লাগল। গুলি ছুঁড়ল। দেখল একটা শ্যামবর্ণ নারীশরীর নদীর নীলিমায় আপন রক্তের মধ্যে তোলপাড় করছে। মনে হলো আলোড়িত এই মুখ-বাহু-স্তন-উরু সব চেনা। পানকৌড়ির মতো। সে আদিনার নাম ধরে ডাকতে গেলে টের পেল অঙ্গশোভা ঢেউয়ের ছলছলানি তুলে ডুবে যাচ্ছে। সে বন্দুকের গরম নল গালে চেপে বারুদের গন্ধে ডুবে যেতে থাকে ।

এই গল্পে পানকৌড়ির রক্ত একটা প্রতীকী ব্যঞ্জনা নিয়ে উপস্থিত হয়ে সৃষ্টি করেছে অদ্ভুত এক বহুকৌণিকতা।

বাসর রাতে নারীর হাইমেন ছিঁড়ে রক্তপাত হতে পারে, তবে ঐ রক্তপাত কি দীর্ঘ হয় যে সাতদিন পর্যন্ত ব্যাপিত থাকবে!নাকি প্রথম রাতে জৈব উত্তেজনায় সৃষ্টি হয়েছিল এক রজঃপাত –এই রক্তপাত অনিবার্য এক শারীরবৃত্তিক ক্রিয়া যা কয়েকদিন স্থায়ী হয়ে থাকে এবং সদ্য বিয়ের রাতে এই রক্তের অসুবিধা নিরস্ত করে স্বামী-স্ত্রী এই দুই নারী-
পুরুষকে অথচ জৈবিক উত্তেজনা তখন সঙ্কোচে আত্মহত্যা করে। গল্পের চরিত্রটা এহেন বাধাগ্রস্ত হয়ে পানকৌড়ি শিকারের সমতুল্য এক উত্তেজনা অনুভব করে। প্রথম গুলিটা লক্ষ্যভেদে ব্যর্থ হলেও দ্বিতীয়বার পানকৌড়ির পড়ন্ত দেহে রক্তপাত ঘটাতে পারে। স্ত্রীর প্রথম রক্ত এবং এই বাধা পেরিয়ে সেখানে এক নতুন রক্তের সাগরের সম্ভাবনা দেখা দেয়। পানকৌড়ি যেমন মরে গেল তেমনি স্ত্রীরও কুমারীত্ব ঘুচল যা এই সঙ্গে একজন নারীর পুরনো সত্তার মৃত্যু ও নতুন জীবনের সূত্রপাত । ফলে গল্পের শেষাংশে দেখা যায়, নায়ক একনলা বন্দুক হাতে যোনির মতো ত্রিকোণাকৃতি এলাকায় গুল্মলতায় পা মাড়িয়ে নদীটা যেখানে বাঁক নিয়েছে সেখানে এসে বন্দুক বাগিয়ে কালো বেলুনের মতো ভেসে ওঠা পানকৌড়ি বরাবর গুলি নিক্ষেপ করে। রক্তের তোলপাড় হচ্ছে নারীশরীরে–হাইমেন ছিঁড়ে যায়; নারীর চক্রমিত রক্তপাতের অতিরিক্ত এক রক্তপাতের মধ্যে ডুবে যেতে দেখা যায় গল্পের নারীটাকে। প্রকৃতির নিয়মে নারীর মধ্যে রয়েছে রজঃচক্র –নারীর জন্য যা কোনক্রমেই বিরুদ্ধ বিষয় নয় বরং স্বাভাবিক এবং প্রথম যৌনতায় ছিড়ে যেতে পারে হাইমেন তাতে রক্তাক্ত ক্ষরণ এক জীবনমুখী ক্রিয়া বলে স্বীকৃত। এই বিষয়ের সঙ্গে অর্থাৎ নারীর সহজাত রক্তপাত বনাম শিকার করা পানকৌড়ির রক্ত কথাসাহিত্যের প্রতীকের জগতে উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত এবং এই রক্ত অনুষঙ্গ তুলনারহিত ভিন্ন মাত্রিকতা সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে।

কমলকুমার মজুমদার রচিত 'নিম অন্নপূর্ণা' গল্পে রক্ত অনুষঙ্গ শেষাংশে এসে আকস্মিক
উপস্থিত হয়— 
গরম ভাতের সামনে বসে ব্রজর নিজেকে মানুষের মতো মনে হলো এবং প্রীতিলতাকে
তারিফ করবার জন্য বলেছিল, 'হ্যাঁ কোথায় পেলে....'

এ-কথার উত্তর প্রীতিলতা প্রস্তুত করবার জন্য ডালভাতের ন্যাকড়াটার গিট খুলবার জন্য একটু ঘুরে বসতেই ব্রজ তৎক্ষণাৎ প্রশ্ন করল, 'ওমা তোমার পাছার কাছে রক্ত...'

একথার সঙ্গে সঙ্গে প্রীতিলতা ঘুরে বসেই শুনল, লতি বলছে, জানো বাবা বুড়াটা মরে
গেছে....

প্রীতিলতা যুগপৎ বলেছিল, 'কি যে অসভ্যতা কর এদের সামনে, জানো না কিসের রক্ত—নোংরা' বলেই থেমে গিয়ে জিব কাটল।

ব্রজ দুবার ‘ও ও' বলেই কেমন যেন থ হয়েছিল।

“নে নে খা তোরা', প্রীতিলতা দমকা আওয়াজ করে বলেছিল। অনন্তর গরম ভাত পাওয়ার জন্যই হোক অথবা অন্য কোন কারণেই হোক, একটু সোহাগ-খোরাকী গলায় বলেছিল, 'বুড়ার জন্য মন খারাপ করছে... খেতে ইচ্ছে হচ্ছে না...'

'নিম অন্নপূর্ণা' গল্পটা কমলকুমার রচনা করেন ১৯৫৮-৬০ ইংরেজি সময়কালে। গল্পটাতে যুদ্ধকাল প্রতীয়মান বলে মনে হয়; এক ঝাঁক জঙ্গি বিমান উড়ে যায়, মেঘমন্দ্র
প্লেনের শব্দ, ক্বচিৎ মোটরের হর্ণ অথবা কখনও সাইরেন আছেই - তা ছাড়াও রাত্রে হরিধ্বনি থেকেও বীভৎস হয়ে ওঠে মানুষের কণ্ঠস্বরের নামে উত্তাল উদ্দাম পোড়ার আওয়াজ, মনে হয় এক আপনাকেই কামড়ায় ।

এই অসম্ভব অবস্থায় গল্পের ব্রজ চরিত্র অসহায়, তার প্রতি রাগ করার কিছু নাই কারণ সে প্লুরিসি নামক এক রোগে ভুগেছিল, অক্ষমতা বলেই নিজস্ব সকল স্বপ্ন বানচাল হয়ে গেছে। এখন এই সময় একটা টিউশনি পর্যন্ত নাই, শহরের অনেকেই চলে গেছে এবং অবশিষ্ট প্রত্যেক মানুষ যেন বোরখা পরিহিত আলোয় ভৌতিক। এখন সে পরমায়ুকে সব কিছু বলে মান্য করেছে।

প্রীতিলতার কণ্ঠস্বর ফাঁকা হাঁড়িতে প্রতিধ্বনিত হয় । প্রীতিলতা দেওয়ালে একটা পা ঠেস দিয়ে দণ্ডায়মান অবস্থায় হাতের আলগা মুঠায় একগাদা চুল নিয়ে খেলা করতে করতে মনে তার ভাল লাগে—অবহেলায় অনিয়মে মেহেদীপিঙ্গল চুলে রয়েছে অন্ধকার, সে জননী এবং অজস্র চুলে চুলে রয়েছে পাচনতুল্য গন্ধ, এই গন্ধে নিজেকে তার পুরনো বোধ হয়, গায়ে ন্যাপথলিন আর তোরঙ্গের মরীচিকার গন্ধে- মিলেমিশে —দিনগুলোকে যেমন বা সুদীর্ঘ করে, আর সে, তাকে, প্রীতিলতাকে, অযথাই, মন্দভাগ্যক্রমে, নিশ্চিহ্ন করেছে; বস্তুত সে নিজেকে খুঁজে না পেলেও শ্বাস নেয়, দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে—পুরাতন দিনগুলোর কথা ভেবে তন্ময় থাকে। সে সর্বদা ভাবে ছায়া তার সুখী। সে চোখ ছোট করে দিনমান অন্ধকার দেখে।

একটা কাশির আওয়াজ, যে আওয়াজে বটগাছের শিকড় পর্যন্ত অস্থায়ী হয়ে যায় তাতে প্রীতিলতার প্রাণপুরুষ কেঁপে উঠবেই, নিয়মিত হয়। তাদের সূক্ষ্মগলিতে এবং রকে- জানালার পিছনে ধপ্ করে গাঠরি রাখার আওয়াজ হবে, এইভাবে সবকিছু মিলে পাতাহীন পৃথিবীর রুক্ষতার উদয় হবে।

দীর্ঘ পথশ্রমে ক্লান্ত-দ্রুত নিঃশ্বাসে ব্যস্ত হাড়ের খেলা নিয়ে ছোট ছোট কাশি নিয়ে অশীতিপর এক বৃদ্ধ ভগ্নস্বরে গান করলে টহলদারী এই গানখানায় ... নিজস্ব বেদনা মূর্ত থাকে। গানটা শুনে শুনে তার ভাল লাগে, সে আপন মনে অনেক সময় গায়। যখন সহসা বুঝতে পারে অতি ধীরে বৃদ্ধের সঙ্গে গলা মিলিয়ে গানটা গাইছে ত্বরিতে লজ্জায় মাথায় কাপড় তুলে দিয়ে বুঝতে পারে হাতে কাপড়ের পাড় উঠে এসেছে মাত্র।

বুড়ার প্রগলভ ভয়ঙ্কর কাশির আওয়াজ শুনতে পেলে বলে, যূথি আর লতিকে উদ্দেশ্য করে, 'ওঠ না তোরা, বুড়া কি মরবে?'

দুই বোন জল নিয়ে বুড়ার কাছে গেলে প্রীতিলতা বলতে ভুল করে না 'দেখিস, ছুঁস নি যেন!'

বুড়াটা কাশতে কাশতে ওদের দিকে টিনের পাত্র এগিয়ে দেয়। বৃদ্ধ অদ্ভুতভাবে দুই হাতে টিনটা মুখের কাছে আনতেই লোলদেহে বিদ্যুৎ খেলে যায়, দুই-একটা কাশি সহযোগে জল খায়....


যূথি আর লতির কথোপকথন হয় :

"কি বোকা জল গিলে গিলে খাচ্ছে'
 'চিবিয়ে খাবে বুঝি'
'আমি ত করি, ওতে পেট ভরে যায়'

বুড়াটা দুই হাতে বোচকা আগলে ওদের বলে 'ঘরকে যাওনা! ঘরকে যাওনা।'
 বুড়াটা এবং যে গাঠরি বোচকাটা আগলে রাখে সব সময়, এই নিয়ে জল্পনা কল্পনা আছে। বুড়া হলে কি হয়, টনটনে জ্ঞান। বোধ হয় বোচকায় অনেক টাকা আছে। কিন্তু লড়াইয়ের বাজারে টাকা দেবে কে?বোচকায় মানে বস্তায় চাল আছে...

দুই বোন, যূথি এবং লতি খাওয়া খাওয়া খেলে। যূথি ও লতির ন্যাকা, কদর্য, অস্বাভাবিক, পৈশাচিক চর্বনের চাকুম চুকুম শব্দের কারণে প্রীতিলতা স্বামীকে রেগে গিয়ে বলে 'বসে আছ মারতে পারছ না।' অতপর দুইবোন অফুরন্ত কিলঘুষি চড়ে ধরাশায়ী হতে বাধ্য।

লতি ও যূথি দুই বোনের খাদ্য ও আহার সম্পর্কিত নানারকম কল্পনা আছে। যূথির ধারণা হচ্ছে, মেঘ হয় হাজার হাজার বাড়ির রান্নার ধোঁয়া হতে। সে আরও বলে দিতে পারে, ওটা না রুই মাছের ঝোলের মেঘ, ওটা না সোনা মুগের ডালের মেঘ।

লতি বলে, আমরা যদি পিঁপড়া হতাম। পিঁপড়া লাইনে লাইনে চলে যায় বিরাট বিরাট বাড়িঘরে যেখানে পাঁচফোড়নের গন্ধ আসে, মাছের কাটা নিয়ে বিড়ালের ঝগড়া হয়।
লতিরা তাই পিঁপড়াকে অনুসরণ করে হামাগুড়ি দিয়ে।

যূথি লোভী হয়, খেতুর মা'দের সবুজ পাখিটার আহার্য খাঁচা হতে চুরি করে নিয়ে মুখে ছোলাদানা গিলতে গিয়ে পারে না; পাখিটা সংগ্রাম করে, যূথি ছোলার দুই তিনটা দানা মুখে ভরতে পারলেও পাখিটা কামড় দিতে ছাড়ে না। রক্ত বের হয়; চিৎকার করে যূথি পাখির কামড়ে; পাখিটা লাল ঠোঁট দিয়ে কামড় মেরেছে। যূথি পালাবার পথ পায় না, খেতুর মায়ের সামনে মুখে সযত্নে রক্ষিত ছোলাগুলো যা চিবালে শেষ হবে বলে চিবায়নি সেই ছোলাগুলো পড়ে গেলে কম্পমান হয় । ছোলা পড়তেই খেতুর মা সরে রাগে রোষে শুরু করে আক্রমণ: এক চড়ে দাঁত কপাটি ভেঙে দেব, ভিকিরীর অধম ছোলা চুরি করতে গিয়ে কি কাণ্ড বাঁধালে, সৎ শাসনে না রাখলে ছেনতাল হবে, ঝরঝরে হবে পরকাল । প্রীতিলতা বেড়ালের মতো ফোঁস করে বলেছিল : নিজে যে সাবান দাও বগলে বিধবা হয়ে তা-বেলা কিছুই হয় না-না ।

একদিন যূথি-লতি এসে খবর দিল: বুড়াটা মোড়ে কাশছে আর রক্ত পড়ছে। এরূপ সমাচার প্রীতিলতার মধ্যে ধূমায়িত হয়ে এক অদ্ভুত বিদ্যুৎ-সম্ভূত রোশনাইয়ের সৃষ্টি করে, এমনকি তার হাত দুইটা তালি দেয়ার জন্য উদগ্রীব হয়েছিল। কোথায় বুড়াটা মরবে বলে উঠতে গিয়ে সংশোধিত প্রশ্ন করে কোথায় বুড়াটা রয়েছে!এই খবর শুনে।

‘বুড়া মিনসের মুখ দিয়ে..... ',খবরটা ব্রজকে জানালে জবাব পায় : দূর...। তখন উত্তরে প্রীতিলতা বলে : 'দাঁত দিয়ে পড়ে থাকবে হয়তো, ভেবেছিলাম তোমাকে বলব ওকে এখান হতে চলে যেতে, পরে ভাবলুম কিছু ত দিতে পারি না অন্তত একটু জায়গা.... প্রীতিলতা গান গাইত, প্রীতিলতার কণ্ঠস্বরে লালিত্য ছিল—একদা প্রীতিলতার কণ্ঠস্বরে
ক্রমাগত বালি ঝরার ভয়াবহতা।

দুইদিন অন্নসংস্থান ব্যর্থতার পর তৃতীয় দিনের মতো ব্রজ একটা উপায়ের সন্ধানে বালিগঞ্জে যাওয়ার উদ্দেশ্যে অদৃশ্য হয়ে গেলে অন্ধকার কক্ষ মধ্যে একাকিনী আপন আত্মরক্ষায় যত্নবান হয়েছিল।

তীর্যক গ্যাসের আলোয় বৃদ্ধ বসে খানিক শ্রান্তি দূর করে শূন্যতার সঙ্ঘাতহেতু কম্পিত হাত দ্বারা আপন কপাল মুছছিল, মাধাজড়িত কণ্ঠে গান গাইছিল :হরিবোল ;বৃদ্ধটা গাইতে গাইতে সরে গেল, শুধুমাত্র বস্তাটা সেখানে এবং ঝটিতি প্রীতিলতা রাস্তায় নেমে বস্তাটায় হাত দিতে বৃদ্ধ ছুটে আসে এবং প্রীতিলতার দেহের উপর ঝুঁকে পড়ল; বোতল হতে তরল পদার্থ যেরূপে নির্গত হয় তেমনি সশব্দে রক্ত পড়ল।

হঠাৎ লতি ও যুথিদের বাড়িতে উনুন জ্বলল, এসব দেখে তারা পরীর রাজ্যে চলে গেল। তারা হাসল, তারা স্বাভাবিকভাবে চলতে গিয়ে সর্পগতিতে এগিয়েছিল। বুড়াটা মরে যাওয়ার পর ক্লাবের ছেলেরা সৎকারের সময় মরদেহ নিয়ে যাওয়ার সময় ওরা একটু আগে অবাক হয়ে দাঁড়িয়েছিল, একবারও বুড়ার বস্তা বা লাঠি বা মগের কথা মনে করে নাই; মায়ের কন্ঠস্বর শুনে ঘরের ভেতর চলে এসেছে তারপর।

সেদিন ব্রজর বরাত খুব ভাল, সে চাল পেয়েছে এবং পাঁচটা টাকা, তদুপরি ঘরে ফিরে দেখে হঠাৎ উনুনে হাঁড়ি চড়েছে, তলায় আগুন ও মেয়ে দুইটা বাবু হয়ে বসে বাপের জন্যও একটা জায়গা করেছে এমতাবস্থায় সব মিলিয়ে গরম ভাতের গন্ধ শুঁকতে শুঁকতে মানুষ মনে হতে লাগল নিজেকে।

এই পর্যন্ত এসে গল্পটা সমাপ্তির দিকে অগ্রসর হয়। গল্পটার শেষ পর্ব, এতক্ষণ মূল গল্পের যে ছায়া বর্ণনার প্রচেষ্টা ছিল, তা শীর্ষে হুবহু উল্লেখ করা হয়েছে।

গল্পটার উপসংহারে আকস্মিক রক্ত অনুষঙ্গ উপস্থিত হয়, চমকিত করে এবং গল্পটার একটা স্তরান্তর লক্ষ করা যায়। 'নিম অন্নপূর্ণা' গল্পটার উপসংহারে বোঝা যায় : ১) অনড় বাস্তবতার অপরিবর্তনীয়তা ও মানুষের নিয়তির অপ্রতিরোধ্যতা, স্বাধীনতা এবং ২) মানুষই বাস্তবতা বদলে দিতে পারে, মানুষই মানুষের নিয়তি ও নিয়ন্তা; এই দুই প্রকার মনোভাবের প্রতি কমলকুমার মজুমদার দোদুল্যমান। এই দোদুল্যমানতা যে কোন বাস্তবতাবাধ্য লেখকের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য এবং কমলকুমার ব্যতিক্রম নন। চরম দারিদ্র্যের যে পরিপ্রেক্ষিতে পোষা পাখির ছোলা চুরি করে ক্ষুধার্ত বাচ্চাকে খেতে হয় এবং গল্পের শেষে বুড়াকে হত্যা করা হয়—দারিদ্র্য ও অনাহারের এই প্রেক্ষিতেই হত্যাকাণ্ডের নীতিহীনতা অনেকখানি অবান্তর হয়ে যায় ।

গল্পের শেষটুকু গরমভাতের ধোঁয়া-গন্ধে প্রায় মানবিক হয়ে ওঠে যেন; গল্পটাতে দারিদ্র্য এত সরল অমানবিক হয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে, বেঁচে থাকার অধিকারের মৌলিকবোধে সক্রিয় হয়ে একজন উপবাসী ভিক্ষুককে হত্যা করে যে কোন মূল্যেই মানুষের বাঁচাটা সমর্থনযোগ্য মনে হয়।

যখন ব্রজ-প্রীতিলতা-যূথি-লতি বেঁচে থাকার সুযোগ পেয়ে যায়, সেই মুহূর্তে লেখক হিসেবে কমলকুমার মজুমদার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন : ওমা তোমার পাছার কাছে রক্ত। কি অসভ্যতা কর এদের সামনে, জান না কিসের রক্ত – নোংরা। ব্রজর প্রশ্ন, প্রীতিলতার উত্তর–এই কথোপকথনের ফলে বুড়ার জন্য মন খারাপ না করলেও রক্ত অনুষঙ্গ এই স্তরে এসে অন্যরকম একটা ব্যঞ্জনা সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়। নিম অন্নপূর্ণা'-য় প্রীতিলতার সংসার এবং রকের বুড়ার আপাত অসম্পর্কের ভিতর একটা নতুন অক্ষ নির্মিত হয়, এই অক্ষটা ক্ষুধার, যে ক্ষুন্নিবৃত্তি মানবিক অস্তিত্বের প্রাথমিক শর্ত। যেভাবে অক্ষটা তৈরি—গল্পের কৌশল সেই প্রক্রিয়াতেই রূপায়িত; রক্তের উপমা, মৃত্যু ও জন্মের আনুষঙ্গিক হয়ে নতুন অক্ষটা সৃষ্টি হয়েছে ।

তথ্যসূত্র:
১. নিম অন্নপূর্ণা, কমলকুমার মজুমদার
২. পানকৌড়ির রক্ত; আল মাহমুদ
৩. আল মাহমুদের গল্প: আবু রুশদ
৪. তেইশ বছর আগে-পরে; দেবেশ রায়
৫. অভিনব ব্রতকথা; দেবেশ রায় 
৬. কমল পুরাণ; রফিক কায়সার
৭. চিঠি-পত্রে দ্বিরালাপ; কমলকুমার মজুমদার, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় 
৮. আল মাহমুদকে নিয়ে বিভিন্ন সাক্ষাৎকার
৯. তপন বড়ুয়া

ফেব্রুয়ারি ২০০০

রক্ত অনুষঙ্গ
সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ 

মন্তব্য

নাম

অনুবাদ,32,আত্মজীবনী,26,আর্ট-গ্যালারী,1,আলোকচিত্র,1,ই-বুক,7,উৎপলকুমার বসু,23,কবিতা,319,কবিতায় কুড়িগ্রাম,7,কর্মকাণ্ড,15,কার্ল মার্ক্স,1,গল্প,56,ছড়া,1,ছোটগল্প,12,জার্নাল,4,জীবনী,6,দশকথা,24,পাণ্ডুলিপি,10,পুনঃপ্রকাশ,15,পোয়েটিক ফিকশন,1,প্রতিবাদ,1,প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা,4,প্রবন্ধ,152,প্রিন্ট সংখ্যা,4,বর্ষা সংখ্যা,1,বসন্ত,15,বিক্রয়বিভাগ,21,বিবিধ,2,বিবৃতি,1,বিশেষ,23,বুলেটিন,4,বৈশাখ,1,ভাষা-সিরিজ,5,ভিডিও,1,মাসুমুল আলম,35,মুক্তগদ্য,37,মে দিবস,1,যুগপূর্তি,6,রিভিউ,5,লকডাউন,2,শাহেদ শাফায়েত,25,শিশুতোষ,1,সন্দীপ দত্ত,8,সম্পাদকীয়,16,সাক্ষাৎকার,21,সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ,18,সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ,55,সৈয়দ সাখাওয়াৎ,33,স্মৃতিকথা,14,হেমন্ত,1,
ltr
item
বিন্দু | লিটল ম্যাগাজিন: রক্ত অনুষঙ্গ │প্রবন্ধ│ সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ
রক্ত অনুষঙ্গ │প্রবন্ধ│ সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ
https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEiQ_SLPx8jtMMnOq8PGfHW9iOovZF4A35RxxmruUDS1YvWU-fBE9lMqJlVDUSqY-D2IQwblF4u8XiVziPfmbnW0jTqYviYVFbaqZWxpjaxh0axe4S0PuzuS6xH7aJZq-fz7dnqBsxpFJv2QsJTOogzvPKsv9KZ1mc94KA-V4sx2HeKvvQ7FrjGAbYY7M7Y/s16000/Syer%20Riazur%20Rashid%20bindumag.png
https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEiQ_SLPx8jtMMnOq8PGfHW9iOovZF4A35RxxmruUDS1YvWU-fBE9lMqJlVDUSqY-D2IQwblF4u8XiVziPfmbnW0jTqYviYVFbaqZWxpjaxh0axe4S0PuzuS6xH7aJZq-fz7dnqBsxpFJv2QsJTOogzvPKsv9KZ1mc94KA-V4sx2HeKvvQ7FrjGAbYY7M7Y/s72-c/Syer%20Riazur%20Rashid%20bindumag.png
বিন্দু | লিটল ম্যাগাজিন
https://www.bindumag.com/2023/11/syed-riazur-rashid-article-on-blood-in-bengali-literature.html
https://www.bindumag.com/
https://www.bindumag.com/
https://www.bindumag.com/2023/11/syed-riazur-rashid-article-on-blood-in-bengali-literature.html
true
121332834233322352
UTF-8
Loaded All Posts Not found any posts আরো Readmore উত্তর Cancel reply মুছুন By নী PAGES POSTS আরো এই লেখাগুলিও পড়ুন... বিষয় ARCHIVE SEARCH সব লেখা কোন রচনায় খুঁজে পাওয়া গেল না নীড় Sunday Monday Tuesday Wednesday Thursday Friday Saturday Sun Mon Tue Wed Thu Fri Sat January February March April May June July August September October November December Jan Feb Mar Apr May Jun Jul Aug Sep Oct Nov Dec just now 1 minute ago $$1$$ minutes ago 1 hour ago $$1$$ hours ago Yesterday $$1$$ days ago $$1$$ weeks ago more than 5 weeks ago Followers Follow THIS PREMIUM CONTENT IS LOCKED STEP 1: Share to a social network STEP 2: Click the link on your social network Copy All Code Select All Code All codes were copied to your clipboard Can not copy the codes / texts, please press [CTRL]+[C] (or CMD+C with Mac) to copy