.header-button .inner > span { font-size: 18px !important; } .header-button .inner i.fa { font-size: 40px !important; } .comment-form-message { background-color: #f4f4f4 !important; font-size: 14px !important; }

সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ সংখ্যা : সুশান্ত বর্মণ

সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ রচিত ‘ছায়া আবছায়া’ উপন্যাসে অবগাহনকেন্দ্রিক অভিজ্ঞতা সুশান্ত বর্মণ
বাংলা কথাসাহিত্যে যে কজন লেখক শুধুমাত্র আখ্যান লেখকের পরিচয়ে সীমাবদ্ধ নন, তাদের মধ্যে সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ অন্যতম। প্রতিষ্ঠাকামী লেখকগণের মত তিনি প্রচলিত পথরেখা অনুসরণ করেননি। আশির দশকে যখন সাহিত্যপথে পা রাখলেন, তখন থেকে শুরু করেছেন বিকল্প গদ্যের সন্ধান। সে সন্ধান এখনও বহমান। নিষ্ঠার সাথে এক নিজস্ব ভঙ্গিতে রচনা করে চলেছেন বাংলা গদ্য। গল্প, উপন্যাস ও প্রবন্ধের শরীর গঠনে তাঁর মৌলিকতা অভিনব, অভূতপূর্ব এবং নান্দনিক।

বাংলা সাহিত্যে ষাটের দশকে এক অভাবিত জোয়ারের আগমন ঘটেছিল। হাংরি সাহিত্য আন্দোলন, শ্রুতি আন্দোলন প্রভৃতি তাত্ত্বিক চিন্তার উদ্ভব হয়েছিল। সমাজে, মননে, রাষ্ট্রে, নৈতিকতায় যথাযথ অভিঘাত সৃষ্টি করে জয় করে নিয়েছিল বিদগ্ধ পাঠকের মন। পরবর্তী যুগের সৃষ্টিশীল লেখকদের প্রায় প্রত্যেকের চিন্তায় রেখেছিল গভীর প্রভাব। প্রচলিত সাহিত্যধারার সীমাবদ্ধতা বড় প্রকট হয়ে চক্ষুষ্মান পাঠককে সচকিত করে তুলেছিল। সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ তাঁর পাঠ অভিজ্ঞতার নিরীখে প্রথাগত সাহিত্যের দুর্বলতা বুঝতে পেরেছিলেন। তাই যখন হাতে কলম তুলে নিলেন, তখন ভবিষ্যত নিয়ে কোন সংশয়বোধ করেননি। বেশ সাবলীলভাবে জীবন খুঁড়ে তুলে আনলেন টুকরো ঘটনার ভিন্নরূপ।

শ্রীশচন্দ্র দাশ তাঁর 'সাহিত্য সন্দর্শন'বইতে উপন্যাসের যে গুণগুলিকে বিবেচ্য মনে করেছেন সেগুলো হল কাহিনী-বিন্যাস, গঠন-নৈপুণ্য, চরিত্র-সৃষ্টি এবং শক্তিশালী ভাষা। তিনি মনে করেন, উপন্যাসের চিৎ-শক্তি হলো ভাষা। ভাষার গুণে গল্পকার পাঠকের কল্পনা শক্তিকে উদ্বুদ্ধ করতে পারেন। 

উপন্যাসের প্রধানতম আলোচ্য বিষয় হল মানুষের জীবনপ্রবাহ। জীবনের বিবিধ রূপ লেখকের চেতনামূলে যে রূপ ধারণ করে, তার বহিঃপ্রকাশ ঘটে উপন্যাসে। মানবজীবনের কোন একটি বা একাধিক ঘটনা সাহিত্যরসে জারিত হয়ে চরিত্রবিকাশের সাথে সাথে উপস্থাপিত হয়। সহৃদয় পাঠক নিজ অভিজ্ঞতার আয়নায় লেখকের উপস্থাপনকে আত্মস্থ করে। লীন হয়ে যায়। ধারাবাহিক পদবিন্যাস উপন্যাসটিকে গন্তব্যে নিয়ে চলে। একজন প্রধান চরিত্র, তার জীবনের গল্পের সাথে সংযুক্ত অন্য ঘটনাগুলোকেও উল্লেখ্য করে তোলেন। জীবন তো একরৈখিক নয়; কালপ্রবাহ একরঙা নয়। একটি নির্দিষ্ট সময়কালের মানুষেরা নিজেদের মধ্যে এক অনিবার্য মিথস্ক্রিয়া তৈরি করে। পরস্পরের পথে বা বিপথে চলেও সময়ের স্রোত সকলকে স্পর্শ করে। সরাসরি সম্পর্কিত হয়ে বা না হয়েও তারা পরস্পরের জন্য অনিবার্য অনুষঙ্গ হয়ে ওঠেন।

বাংলা উপন্যাসের সূচনা ঘটে মধ্যযুগের শেষভাগে এসে। রেনেসাঁসের অভিঘাত মানুষের চিন্তাজগতের পাশাপাশি সমাজ জীবনেও ধাক্কা দেয়। প্রথাসিদ্ধ মূল্যবোধের অসারতা ব্যক্তিমানুষকে আরো বেশি আত্মকেন্দ্রিক করে তোলে। আত্মপ্রতিষ্ঠার বাসনা জীবনকে চালিকাশক্তি যোগায়। ব্যক্তির দার্শনিক অবস্থান সমাজচিত্রের প্রতিফলন। ফলে ব্যক্তির সংক্ষিপ্ত জীবন মহাকালের ব্যাপ্তিকে ধারণ করতে চায়। ব্যপ্ত হওয়ার প্রত্যাশা এর প্রধান কারণ। যার প্রভাবে গল্পের অবয়ব নির্দিষ্ট আকার পেরিয়ে যায়। জীবনের বহুবৈচিত্র্য প্রকাশ করতে লেখকের স্ফূর্তি উপন্যাসকে আশ্রয় করে।

‘আলালের ঘরের দুলাল'থেকে শুরু করলেও দেখা যায় সূচনা থেকে দেশভাগ পর্যন্ত বাংলা উপন্যাসের প্রধান প্রবণতা প্রায় একই। প্রায় সকল ঔপন্যাসিক কোন একটি অখণ্ড কাঠামোকে উপন্যাসের মেরুদণ্ড রচনায় ব্যবহার করেছেন। ডালপালা বিস্তার করেছে এই প্রধান শিরদাঁড়া থেকে। সূচনাকালের উপন্যাসগুলোতে মানবজীবনের বিস্তৃতিকে অবয়ব দেয়ার চেষ্টা শুরু হয়েছিল। জীবনের বিচিত্রমুখী অভিঘাত সন্ধিৎসু লেখকের দৃষ্টি এড়ায় না। ফলে উপন্যাসগুলো কোন একটি জীবনবিন্দুকে আশ্রয় করে সিন্ধুরূপ নিতে চেয়েছে। ব্যক্তি, ইতিহাস, সময়, সমাজ, দর্শন কতকিছুই না প্রধান চরিত্ররূপে এসেছে। মানুষ মননশীল প্রাণী, নিজেকে প্রকাশের বিচিত্ররূপ তার জানা আছে বলেই সে জন্ম দিয়েছে সভ্যতার।

নিবেদিতপ্রাণ গল্পকারের গভীর দর্শনবোধ মানুষের জীবনস্বপ্নকে প্রশ্রয় দেয়। বৈষয়িক মানুষতো লেখকগণের প্রিয় বিষয়। যাপিত জীবনের যন্ত্রণাদগ্ধ, ক্লিষ্ট, ক্লান্ত চরিত্র লেখকের কল্পনাশক্তিকে আশ্রয় করে নিজেকে মেলে ধরতে চায়। মানুষের দুঃখ নামক অনুভূতিকে সহমর্মীতার আলিঙ্গনে উপশম করা যায়। বাংলা সাহিত্যের কথাসাহিত্যিকগণের অধিকাংশ এই সহজ পথের বাইরে চোখ ফেরাননি। গল্পকে উপজীব্য করে ব্যক্তিচরিত্রকে যন্ত্রণাশূলে বিদ্ধ করে জন্ম হয়েছে উপন্যাসের অরণ্য। সহানুভূতির পেলব স্পর্শের বাইরে গল্পের অন্যরূপ অন্বেষণকে বাহুল্য মনে হয়েছিল। কিন্তু দেশভাগ পাল্টে দেয় সকল জল্পনা।

প্রায় একইরকম কাহিনীভিত্তিক, চরিত্র প্রধান উপন্যাস পড়তে পড়তে ক্লান্ত পাঠক ও লেখকগোষ্ঠী ঘোষণা করে 'শাস্ত্রবিরোধী আন্দোলন'। ষাটের দশকে বিকশিত হওয়া এই ধারার লেখকগোষ্ঠীর প্রধান বক্তব্য হল- ‘গল্পে এখন যারা কাহিনি খুঁজবে তাদের গুলি করা হবে'। সাহিত্য চিন্তারাজ্যে সুনামীর প্রাবল্য নিয়ে ধেয়ে আসা এই প্রতিবাদে অনেক সাহিত্যিকের আত্মগরিমা ভেসে গেছে। সন্ধিৎসু কথাসাহিত্যিকগণ নিজেদের সীমানা অতিক্রম করার প্রেরণা পেলেন। একই অবয়বের কাহিনী কাঠামোর গোলকধাঁধা শুভঙ্করের ফাঁকি হয়ে গেছে। প্রজন্মের অগ্রসর অংশ প্রচলিত পথে হাঁটতে চায় না। সমসাময়িক অন্যান্য সাহিত্য আন্দোলনগুলো বাংলা সাহিত্যের গতিতে নবপ্রাণের জোয়ার এনেছে। দেশভাগ পরবর্তী নতুন সাহিত্যিকদের সামনে নতুন জগৎ খুলে গেল। সাহিত্যধারায় নতুন গতির সঞ্চার হল। পঞ্চাশ ষাটের দশকের সমৃদ্ধ বাংলা সাহিত্য এর প্রমাণ। উভয় বাংলায় একের পর এক ধ্রুপদী উপন্যাস রচিত হতে থাকে। ৭১ এরমুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশ অঞ্চলের সাহিত্য বাতায়নে নতুন মাত্রা যোগ করে। যুদ্ধকালে রচিত 'রাইফেল রোটি আওরাত'বাংলা উপন্যাসের রূপ পরিবর্তনের আভাষ দেয়। অনাকাঙ্খিত রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ সাহিত্যপ্রাঙ্গনকে উর্বর করে। অভাবিত ঘটনার দরজা একের পর এক খুলে যেতে থাকে। তৈরি হতে থাকে নতুন নতুন দৃশ্যপট। এই সময়ের নিবেদিত লেখক সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ। তিনি সময়ের সন্তান। তাঁর রচনা অভিনব হবে সেটাই তো স্বাভাবিক। অবশ্য একালেও পশ্চাদমুখী মানুষের অভাব নেই। তবে রিয়াজুর রশীদ নিজেকে চিনতে পেরেছেন। চিন্তনীয় ও করণীয়র মধ্যে সম্পর্ক তৈরি করেছেন। সংস্কারাচ্ছন্নদের নৈকট্য তাই এড়িয়ে চলেছেন; জীবনের সবক্ষেত্রে, সবকালে।

সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ তাঁর 'ছায়া আবছায়া'উপন্যাস লিখতে গিয়ে নিজের সময়কালকে উপেক্ষা করেছেন। প্রচলিত গল্পকাঠামোর একঘেয়ে রঙে নিজেকে রাঙাতে চান নি। নিজের জন্য, বাংলা সাহিত্যের জন্য এক অন্য গল্পভাষার অন্বেষণ করেছেন। শুধু ভাষা নয়, আঙ্গিকে, তত্ত্বে, ব্যাখ্যায়, উপস্থাপনে একেবারে স্বতন্ত্র শৈলী রচনা করতে চেয়েছেন। তাঁর উপন্যাসদর্শন একপেশে নয়। চমকপ্রদ এবং রহস্যময় আবছায়ায় মোড়ানো।

'ছায়া আবছায়া'উপন্যাসের প্রধান চরিত্র হিসেবে কোন একক ব্যক্তিকে খুঁজে পাওয়া যায় না। উপস্থাপিত লেখক চতুষ্টয়ের জীবনের টুকরো চিত্র প্রধান প্রসঙ্গ। তাঁরা প্রত্যেকে নিজ নিজ চারিত্র্যবৈশিষ্ট্যে বাংলা সাহিত্যাকাশে সমুজ্জ্বল। এদের প্রত্যেকের জীবনধারা ও রচনাবলী সমাজের সংবেদনশীল তন্ত্রীগুলোকে উদ্বেলিত করেছে। উপন্যাসের মধ্যে তাঁদের প্রত্যেকে বিশেষরূপে উপস্থাপিত হয়েছে। তারপরেও তাঁরা কেউ এককভাবে উপন্যাসের প্রধান চরিত্র নয়। প্রধান চরিত্রের কথা লেখক সচেতনভাবে কোথাও বলেন নি। কোন ইঙ্গিত বা সংকেত নেই। তাই উপন্যাসের প্রধান চরিত্রের পরিচিতি সম্পর্কে পাঠকমনে একটা প্রশ্ন থেকে যায়। নিবিষ্ট পাঠক বুঝতে পারে যে, না কোন লেখক বা না কোন ব্যক্তি, এই উপন্যাসের প্রধান চরিত্র হল 'বাংলা সাহিত্য'।

বাংলা সাহিত্যের প্রখ্যাত লেখকগণ বাংলা ভাষায় বিভিন্ন সাহিত্যপ্রসঙ্গ রচনা করেছেন। নিজগুণে প্রাসঙ্গিক বিষয়ে সুখ্যাতি অর্জন করেছেন। এরা প্রত্যেকে তাঁদের স্বাতন্ত্র্যমণ্ডিত রচনার মাধ্যমে মূল সাহিত্যধারায় প্রাণসঞ্চার করেন। পরবর্তী প্রজন্মের হাত ধরে বাংলা সাহিত্য পা রাখে নতুন যুগে। সাহিত্য নামক বুদ্ধিবৃত্তিক এই কল্পনদীটি কল্লোলিত হয়, গতিস্রোত অর্জন করে। নতুন রূপ নিয়ে উপস্থিত হয় সময়ের নতুন বাঁকে। যুগ সন্ধিক্ষণের সময়গুলোতে বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ মানুষদের জীবন বাঙালির সংখ্যাগরিষ্টের জীবনচিত্রের প্রতিরূপ। রোগে, শোকে, দুর্ভোগে সকল সহৃদয় পাঠককে একসূত্রে গেঁথেছেন। বাংলা সাহিত্য উচ্ছসিত হয়ে আরও সমৃদ্ধ হয়েছে। তিরিশের দশক পার করে এগিয়ে চলেছে চল্লিশের দিকে। এই সময়কালে লেখকগণের জীবন ও মৃত্যু, সুখ ও যন্ত্রণা, প্রাপ্তি -অপ্রাপ্তি -নিরাশার হাতছানি দেয়। তাঁদের খুঁড়িয়ে চলা জীবন যেন আর শেষ হয় না। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরের, কালান্তরের কেউ হয়ত আন্দোলিত হয়। এর মানে এই না যে আলোচ্য উপন্যাস মানুষমুখী নয়। বরং যেহেতু মানুষের ছায়াচিত্র সাহিত্যকে ব্যঞ্জনা দেয়, সেহেতু সেখানে রিক্ত মানুষকে ধারণকারী সময়ের কথা তো থাকবেই।

সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ ঘটনার রন্ধ্রে প্রবাহিত রক্তকণিকাগুলোকেও স্পর্শ করতে চান। উন্মুখ হয়ে তাকিয়ে থাকেন লেখকগণের দিনযাপনের দিকে। অনেকগুলো টুকরো টুকরো ঘটনা নিয়ে যেহেতু সম্পূর্ণ জীবন, সেহেতু উপন্যাসেও জীবনের পরিধিকে আঁকতে অনেকগুলো ঘটনার বুনন ঘটে। কোন একক ব্যক্তি এখানে মুখ্য হয়ে ওঠেননি। প্রত্যেকের জীবনচিহ্ন মৌলিক, বৈচিত্র্যময়।  সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ স্বকীয় বিশেষত্ব নিয়ে ঘটনার পরম্পরা তৈরি করেছেন। শুরু করেন জীবনানন্দ দাশের জীবনাভিজ্ঞতা দিয়ে। ঐতিহাসিক উপন্যাস নয় 'ছায়া আবছায়া'। প্রচলিত রীতিমোতাবেক রাজা-বাদশা ও নায়ক-নায়িকার উচ্চক্রম ঘটনানিনাদ নেই। জলের মত, জীবনপ্রবাহের মত তাদের প্রতিটি দিন সাদামাটা। সাহিত্যলগ্ন চিন্তার পীড়ন, অর্থকষ্টের যাতনা, পারিবারিক সমস্যার জ্বালাতন, রাজনৈতিক উৎকণ্ঠা প্রভৃতি তাড়িত জীবন তাদের। বাংলা ভাষার লেখক তাঁরা। তাঁদের জীবন সেকালে যেমন, একালেও তেমন থাকবে- এই জনপদে যেন সেটাই স্বাভাবিক। নিজেদের জীবন সম্পর্কিত বলে লেখকগণের জীবনভিত্তিক রচনার সংখ্যা বাংলা সাহিত্যে কম। আবার ইতিহাসের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে লেখকদের অভিজ্ঞতা বিষয়ক কথাসাহিত্যের সংখ্যা তো আরও কম। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের 'সেই সময়', ‘প্রথম আলো', সমীরণ দাসের 'মধুময় তামরস', 'ফুলগুলো সরিয়ে নাও', 'নিঃসঙ্গ ঈশ্বর'এর পাশাপাশি'শাহাদুজ্জামানের 'একজন কমলালেবু'পাঠক হৃদয়ে স্থান পেয়েছে। ইতিহাসের সন্ধিক্ষণে চরিত্র হিসেবে লেখকগণের সামাজিক অবস্থান ও সক্রিয়তা এই রচনাগুলোর প্রাণ। বাংলা সাহিত্যের শরীরে জন্ম হয়েছে নতুন হৃদস্পন্দের। জীবনী বা আত্মজীবনীভিত্তিক এই রচনাগুলোতে ইতিহাস সশরীরে বিদ্যমান। একেবারে সাল-তারিখ নিয়ে সবৈশিষ্ট্যে উপস্থিত। ইতিহাসের এই উপাদানগুলোকে উপেক্ষা করলে নিছক ফিকশন ছাড়া আর কী থাকে?

'ছায়া আবছায়া'উপন্যাসে তিরিশের দশক লেখকের প্রধান বিবেচ্য। বাংলা সাহিত্যে এই সময়কালে ঘটে আধুনিক যুগের প্রথম বাঁকবদল। রবীন্দ্রপ্রভাবের বাইরে থাকা লেখকগণ এই সময়কালে সোৎসাহে নিজের উপস্থিতি ঘোষণা করেন। তৈরি হয় উদ্যমী সাবলীল বুদ্ধিবৃত্তিক চিন্তাশীল আধুনিক সাহিত্যধারা। বুদ্ধদেব বসু, জীবনানন্দ দাস, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, সুধীন্দ্রনাথ দে, অমিয় চক্রবর্তী এই সময়ের প্রধান নির্মাতা। তরুণ লেখকগণের সৃষ্টিবিলাসকে প্রশ্রয় দিয়েছিল মননশীল পত্রিকাগুলো। বুদ্ধদেব বসু'র 'কবিতা'পত্রিকার পাশাপাশি আরও যে সব পত্রিকা জনারণ্যে ঢেউ তুলেছিল তাদের মধ্যে 'পূর্বাশা'পত্রিকা অন্যতম। সঞ্জয় ভট্টাচার্যের সম্পাদনায় প্রকাশিত এই পত্রিকার সস্নেহ উদারতায় বাংলা সাহিত্য পেয়েছে ঔপন্যাসিক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়কে। পঞ্চপাণ্ডবদের পাশাপাশি রয়েছেন অনেক সৃষ্টিশীল লেখক। প্রত্যেকের অবস্থান ও ভূমিকার আলোকে বাংলা সাহিত্যে তাদের অবস্থান যথাযথ রয়েছে। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, কাজী নজরুল ইসলাম প্রমুখের অবদান বাংলা সাহিত্যে চির অমলিন রয়ে গেছে। এরা প্রত্যেকেই উপন্যাসের প্রধান চরিত্র হবার মত বিচিত্র রূপধারী। আরও অনেক লেখকের জীবনের স্থির ঘটনা 'ছায়া আবছায়া'উপন্যাসে উপস্থাপিত হতে পারত। সকলের সম্মিলিত জীবন যাপনে বাংলা সাহিত্যের সমৃদ্ধি কীভাবে ঘটেছে - তার বিস্তারিত বিবরণ উপন্যাসের উপজীব্য হতে পারত। সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ অত বিস্তৃত পরিসরে প্রবেশ করেন নি। জনারণ্য থেকে বেছে নিয়েছেন মাত্র চারজনকে। জীবনানন্দ দাস (১৮৯৯-১৯৫৪), মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় (১৯০৮- ১৯৫৬),  অদ্বৈত মল্লবর্মণ (১৯১৪-১৯৫১ এবং সঞ্জয় ভট্টাচার্য (১৯০৯-১০৬৯)।

এঁদের মধ্যে সঞ্জয় ভট্টাচার্য তুলনামূলক কম পরিচিত হলেও আবেগাশ্বৈর্যে তিনিও কোন অংশে কম নন। তিনি নিজের সম্পাদিত 'পূর্বাশা'পত্রিকার পরিচয়ে অধিক পরিচিত। পাশাপাশি কবিতারাজ্যে মননশীল পরিভ্রমণেও নিজের সক্ষমতা দেখিয়েছেন। তবে উপন্যাসে তার প্রকাশক সত্ত্বার বিকাশ দেখা যায়নি। সময়জালে আটকে যাওয়া কালের হরিণ যেন তিনি। কবিসত্ত্বা নয় বা প্রকাশক সত্ত্বাও নয় বরং এক ক্লিষ্ট মানুষ হিসেবে পরিপার্শ্বের সাথে প্রতিক্রিয়া করেন। স্বতঃপ্রণোদিতভাবে তার মধ্যে জন্ম হয় এক দুর্মর প্রতিক্রিয়া। ঘটনাক্রমের অভিঘাতকে প্রত্যাখ্যান করতে চান। অল্প কয়েক পৃষ্ঠায় তিনি উপস্থিত। কিন্তু অনুভূতির প্রগাঢ়তায় সংকীর্ণ নন।

ইতিহাস রচনা করতে বসেননি সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ। ইতিহাসের পাতায় কার ভূমিকা কতটুকু তাও বিচার করেননি। কিন্তু ইতিহাসের বিভিন্ন কোণে পুঞ্জীভূত শক্তিমান মেঘগুলোকে তিনি একসূত্রে গাঁথেন। উল্লিখিত সাহিত্যিকগণকে নিয়ে দাঁড়ান পাঠকের সামনে। প্রত্যেক লেখকের নির্মোহ, আত্মমগ্ন, অমোঘ অভিব্যক্তি ফুটিয়ে তোলেন। পাঠক একের পর এক ঘটনাপ্রবাহের মুখোমুখি হতে থাকে। বাংলা সাহিত্যের এক সার্বিক বিন্যস্ত সাহিত্যজীবনের একাংশ নিয়ে 'ছায়া আবছায়া'উপন্যাস রচিত। বাংলা সাহিত্যের জীবনগতিতে তিরিশ-চল্লিশ সালব্যাপী এক-দেড় দশকের যে অনুষঙ্গগুলো অনিবার্য ছিল, সেগুলোর প্রতিধ্বনি তুলেছেন। বাংলা সাহিত্যের জীবনযাত্রায় পুষ্টি, বঞ্চনা, প্রাপ্তির অন্তরালে যা দেখি, তা কোন একক জীবনের গল্প নয়, কোন একক সত্ত্বার প্রশংসাগাথা নয়। সকল সত্ত্বার মিথস্ক্রিয়ায় গড়ে ওঠে যে সম্মিলিত অভিযাত্রা, তার চরিত্র আঁকেন সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ। লেখকদের জীবনাভিজ্ঞতার প্রচ্ছায়ায় রচিত হয় বাংলা সাহিত্যের জীবনচিত্র। তাঁর উপস্থাপনাশৈলী পাঠক অভিজ্ঞতাকে এক বিশিষ্টতা দান করে। প্রচলিত সজ্জ্বাশৈলীর উপন্যাসের মত নয়। ফলে উপন্যাসের শরীর নির্মাণে শাস্ত্রবিরোধী আন্দোলনের প্রভাব রয়েছে বলে মনে করা যেতে পারে।

রমানাথ রায় তাঁর 'এই দশক'পত্রিকার সম্পাদকীয়তে (মার্চ ১৯৬৬) লিখেছিলেন "শিল্পের ক্ষেত্রে আমরা বাউল। আমরা শিল্পের শাস্ত্রবিধি মানি না।"সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ তাঁর 'ছায়া আবছায়া'উপন্যাস লেখার সময়েও কোন বিধি মানেন নি। কোন অনিবার্য রীতির সামনে নত হন নি। কোন এক পূর্বনির্ধারিত ধারণামতে কাহিনী, চরিত্র, সংলাপ, ঘটনা নিয়ে পাত্র পূর্ণ করে তোলেন নি। প্রচলিত সহজ কাঠামোকে এড়িয়ে তিনি গ্রহণ করেছেন নিরীক্ষাধর্মী কাঠামো। জীবনানন্দ দাসকে নিয়ে শুরু করেন,তিনি যখন মরণ সাগরপাড়ে দাঁড়িয়ে, অপার্থিব আলোকচ্ছটায় বিলীন হয়ে যাচ্ছেন,তখন প্রবেশ ঘটে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের, পরপর চলে আসেন অদ্বৈত মল্লবর্মণ এবং সঞ্জয় ভট্টাচার্য।

সঞ্জয় ভট্টাচার্যের উচ্চাশা ছিল বাংলা সাহিত্যের একটি স্বতন্ত্র গোষ্ঠী তৈরি বা বিন্যাসে ভূমিকা রাখার। কাঙ্ক্ষিত চরিত্র অর্জনে 'পূর্বাশা'পত্রিকা সফল হয়নি। তবে তার আকুলতা ছিল 'পূর্বাশা'ঘিরে। নিজেও গল্প, কবিতা, উপন্যাস, প্রবন্ধ রচনা করেছেন। ৪৭টিরও অধিক গ্রন্থ নিয়ে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসপটে তার অবস্থান অনুজ্জ্বল নয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর কবিতা পছন্দ করতেন। অনুবাদেও ছিলেন সিদ্ধহস্ত। তিনি এতবেশি লিখেছেন যে, অপ্রকাশিত, অমুদ্রিত রচনার সংখ্যাই অধিক। কিন্তু পাদপ্রদীপের আলোয় তিনি অনুপস্থিত। সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ মননশীল দৃষ্টি দিয়ে সঞ্জয় ভট্টাচার্যের অন্তর্গত আবেগকে আলোকজ্জ্বল করেছেন।

প্রচলিত সাহিত্যচিন্তা অনুযায়ী উপন্যাস সাহিত্য চরিত্রপ্রধান। চরিত্রকে আবর্তন করে এগিয়ে চলে উপন্যাসের ঘটনা। একটি প্রধান চরিত্র তার সহচরিত্রগুলোকে নিয়ে তৈরি করে উপন্যাসের কাঠামো। ব্যক্তিমানুষের তুলনায় সাহিত্যের নিজের চরিত্র কম বিশিষ্ট নয়। সাহিত্য নিজেও শক্তিশালী চারিত্র্যবৈশিষ্ট্যের অধিকারী। ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্র, অর্থনীতি, নৈতিকতা, সংস্কার প্রভৃতিকে সাথে নিয়ে সম্মুখপানে এগিয়ে চলে। জীবনের অগণন অনুধ্যান সাহিত্যের বিচিত্রতাকে অসীম করেছে। ফলে কোন নির্দিষ্ট কাঠামোতে 'ছায়া আবছায়া'খাপ খায় না। নিজস্ব শৈলীর ফ্রেমে নিজেই সমুজ্জ্বল।

জীবনানন্দ দাস উপস্থিত হন উপন্যাসের শুরুতেই। তখন তিনি মৃত্যুশয্যায়। তাঁর আর্ত শরীর নিয়ে আসা হয়েছে হাসপাতালে। মুহুর্তেই খবরটি ছড়িয়ে পড়ে। হাসপাতালের বিছানায় শায়িত জীবনানন্দ দাসের নিথর শরীর সাহিত্যপ্রেমী মানুষদের চিন্তারাজ্যে স্থান দখল করতে থাকে। এক আশ্চর্য মায়া হাসপাতালের সীমানা পেরিয়ে ছড়িয়ে পরে শহরব্যাপী। তাকে ঘিরে আবর্তিত হতে থাকে নানা দৃশ্যপট; ডালপালা মেলতে থাকে নানাবিধ ভাবনামালা। সময়ের ভাঁজে ভাঁজে জীবনের আঘ্রাণ ছড়িয়ে দিয়ে জীবনানন্দ দাস যেন ক্রমশ দৃশ্যমান হতে থাকেন। উপন্যাসের মধ্যে বিভিন্ন তারিখের ব্যবহার দিনলিপির আস্বাদ দেয়। এ যেন ঔপন্যাসিকের নিজের দিনলিপি। ভাষাভঙ্গির কারুকাজ করতে গিয়ে লেখক সহজ সরল শব্দ ব্যবহার করেন। শব্দের আড়ালে কোন গল্পকে ভাঁজ করে রেখে দেন না।

১৯২৬ সালে কল্লোল পত্রিকায় 'নীলিমা'নামের কবিতা দিয়ে শুরু হয় জীবনানন্দের কবিতাভ্রমণ। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় শুরু করেন 'দিবা রাত্রির কাব্য'র মাধ্যমে ১৯৩৫ সালে। 'নবশক্তি'পত্রিকার ডানায় ভেসে আসেন অদ্বৈত মল্লবর্মণ। কিছুকাল পরে 'মোহাম্মদী'পত্রিকায় যোগ দেন। এর পাতাতে শুরু হওয়া 'তিতাস একটি নদীর নাম'বই হিসেবে মুদ্রিত হয় ১৯৫৬ সালে, লেখকের মৃত্যুর পর। এক অনাবিষ্কৃত চিন্তাবলয় বাংলা সাহিত্যের শরীরে হিল্লোল তোলে। সমালোচক, পাঠক এমনকি নিন্দুকেরাও অদ্বৈতর শক্তিতে বিস্ময়াভিভূত হয়ে পড়েন।

সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ আসলে ঘটনা পরম্পরার আড়ালে থাকা অন্তঃসলীলা স্রোতস্বিনীকে চিত্তরূপ দেন। অগ্রজ অথবা যে বিবেচনাতেই হোক না কেন জীবনানন্দের অন্তিম সময় তাঁর প্রধান বিবেচ্য। এক অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনার অব্যাবহিত পরে জীবনানন্দের অচেতন শরীর যখন হাসপাতালে আনীত হল, তখনকার দৃশ্যপট 'ছায়া আবছায়া'র পরিমণ্ডলে ধীরে ধীরে অবয়ব ধারণ করে। টানহীন, নির্মোহ, নিস্প্রভ তবে সাবলীল, সুখপাঠ্য ভাষাপ্রবাহে পাঠক নিমজ্জিত হন। নিরন্তর ভাবাবেগে আপ্লুত হয়ে লেখক বিবরণ দেন। তিনি বলেন-

“শায়িত সে; যেন পৃথিবীর নিয়মে-শেষবার চলে যাওয়ার আগে বিপুল অন্ধকাের অপেক্ষা-যেতে হবে, যদি কখনো ফেরাতো, কেবলই অন্য কোনো বেশে; কতটা স্বপ্ন দেখলে শঙ্খচিল কিংবা শালিখের বেশবাস আচ্ছন্ন করে রাখে।"পৃষ্ঠা ১২

মৃত্যুচেতনার বিস্তৃত ডানা জীবনানন্দের মানসপটে বেশ বড় জায়গা দখল করে আছে। আজ তার কাব্যভ্রমণ সমাপ্তিতে পৌঁছেছে। তিনি নিজেই বেশ খারাপভাবে দুর্ঘটনার শিকার হয়ে মৃত্যুশয্যায় শায়িত। বিদীর্ণ ফুসফুস আর তুবড়ানো পা নিয়ে তিনি নিজেই আজ মুখোমুখি। মৃত্যুক্ষণের জন্য অপেক্ষমাণ সময়ের বিহ্বল প্রেক্ষাপটে সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ আনমনা হয়ে ওঠেন। নৈঃশব্দতাড়িত শূন্যস্থানগুলো ভরিয়ে তুলতে বিবৃতিরাশি মন্ত্রোচ্চারণের মত নিরন্তর উচ্চারণ করতে থাকেন। অনিবার্য বাক্যগুলি আমাদের প্রজ্ঞার পথ দেখায়, আস্বস্ত করে। প্রেক্ষিতের পাতায় ফুটে ওঠে হতাশ্বাস। ভেঙে যাওয়া সমাজখণ্ডের সারহীন বিনির্মাণ তাকে আকুল করে-

“সে যখন মরেছিল তবু আরেকটা দেশে নাড়ি-ছেঁড়া অপর হয়ে যাওয়া সূর্যমগ্ন চন্দ্রাহত দেশটা-চাণক্য কারসাজিতে হয়ে যেতে থাকবে শ্মশান। শ্মশানযাত্রার প্রস্তুতি থাকবে না-নিজেই একান্ত শ্মশান, যেখানে থাকবে কেবল পোড়া কাঠ, ছাইভস্ম আর অস্থি।"পৃষ্ঠা- ১৫

জীব্নানন্দ তখন হাসপাতালে, বিছানায় সমর্পিত। ফুসফুস ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেছে। শরীরে বিভিন্ন স্থানের হাড়গোড় ভেঙে চুরমার। শ্বাসকষ্ট ও রক্তক্ষরণ তাঁকে অন্দরে একটু একটু করে ক্ষয়ে ফেলছে। নিমীলিত চোখে অচেতন জীবনানন্দ কী কোন স্বপ্নের ভেতরে ডুবে গিয়েছিলেন? জীবনের অতীত কি টুকরো টুকরো ছবি হয়ে তাঁর চিন্তারাজ্যকে আচ্ছন্ন করে তুলেছিল? এক তুরীয় জগতে তার সন্তরণ কি দৃশ্যরূপ ধারণ করেছিল? সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ যেন জীবনানন্দের অবচেতন সত্ত্বার মুখোমুখি হয়েছেন। কবির সঙ্গে এক আত্মগত কথোপকথনে মগ্ন হয়ে ওঠেন। নিজের তাড়না যেন নিজেকে প্রগলভ করে তোলে। জীবনানন্দের মুমূর্ষু অবস্থা একজন শিল্পসত্ত্বার মনোজগতে আলোড়ন তোলে। না বলা, ভেসে যাওয়া কথামালা মূর্ত হয়ে ওঠে। অমোঘ আহ্বানে মগ্নচৈতন্য পরিপার্শ্বকে আবীল করে। জীবনানন্দের চেতনাজগত মগজের সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে মহাপ্রতিবেশে ছড়িয়ে পড়ে। চিন্তাজগতের থরে থরে রূপ পায় বস্তুনিষ্ঠতায়।

উপন্যাসের প্রথমাংশ গঠনে জীবনানন্দের জীবনচিত্র প্রধান। তিনি সশরীরে উপস্থিত কিন্তু নির্জীব, নিস্তেজ। মৃত্যু দরজায় প্রস্থানের জন্য অপেক্ষমান। ব্যক্তি জীবনানন্দ এই অংশের প্রধান চরিত্র; কিন্তু নিস্ক্রিয় তিনি নিজে কোন ঘটনার জন্ম দিচ্ছেন না, ঘটনাপ্রবাহে ভাসমান রয়েছেন মাত্র। তাঁকে আবর্তিত করে উপন্যাস এগিয়ে চলছে। তিনি স্বমূর্তিতে না হলেও ভাবমূর্তিতে লেখক পাঠক উভয়কেই আচ্ছন্ন করে রেখেছেন। তাঁর নিষ্ক্রিয় উপস্থিতি সৈয়দ রিয়াজুর রশীদের জাদুকরী শব্দ যোজনায় এক ধ্যানমগ্ন একাত্মতার সৃষ্টি করে। আত্মগত কথোপকথনের পথ বেয়ে জীবনানন্দের জীবন সীমানায় বাংলা সাহিত্যের জলোচ্ছ্বাস উছলে ওঠে। সময়গুলো অস্থির হলেও লেখকচিত্ত চঞ্চল নয়। শয্যায় শায়িত কবি নিষ্পলক আলোকবিন্দু হয়ে অবচেতনে নিখিলবিশ্বের প্রতিধ্বনি ছড়িয়ে দেন। বিবৃতিকারী লেখক নিজেও জীবনের যাবতীয় পাকচক্রকে স্থবির করে অপলক তাকিয়ে থাকেন নিষ্কম্প আলোকছটা সদৃশ জীবনান্দের দিকে।

প্রায় একই রকম অভিব্যক্তি নিয়ে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় প্রবেশ করেন বাংলা সাহিত্যের গতিপথে। জীবনের ভার দুর্বহ হয়ে উঠলেও মননশিখা উত্থিত রয়েছে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ব্যর্থতা, বৈষয়িক দুর্বলতা, পারিবারিক বিদ্বেষ, শারীরিক অসুস্থতা, অমানুষিক পরিশ্রম করে মনন ঘষে আগুন জ্বালানো গল্প-উপন্যাসের রচনা, সৃষ্টি ব্যাকুল নিরন্তর তাড়না তাকেও মরনোন্মুখ করে তোলে। মৃগীরোগের ঘনঘন আক্রমণে মুর্ছা যাওয়া তাঁর মানসিক সহ্যশক্তিকে তিলে তিলে শেষ করে দিয়েছে। অজ্ঞান হওয়া তো মৃত্যুরই নামান্তর। জীবনানন্দের মৃত্যুতাড়িত সময়কালের শরীরে, মৃত্যুভীজ্ঞা নিয়ে মাণিকের একীভূত হয়ে যাওয়া, সময়ের সাহিত্যপ্রবাহে লীন হয়ে যাওয়া কালেরই এক করাল চিত্র মাত্র। 'ছায়া আবছায়া'র ঘটনাপ্রবাহের মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের অবস্থান বেশ প্রকটরূপেই স্বাভাবিক, অনিবার্য। ঔপন্যাসিকের ভাষ্যে বিষয়টির সংবেদনশীলতা সহজে অনুমেয়-

“জীবনানন্দ যখন অগোছালোভাবে ট্রাম দুর্ঘটনায় পতিত ও অনিবার্যভাবে মৃত্যুগ্রাসিত, সেই সময়ে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় মৃত্যুর প্রকল্প হাতে নিয়ে শুঁড়িখানা থেকে হাসপাতাল, বাড়ির মধ্যে ঘর বানিয়ে তাতে বসবাস করে।"পৃষ্ঠা- ৪৪

'পদ্মানদীর মাঝি'উপন্যাসে তিনি নিজেই লিখেছেন -

“জীবনের অভ্যর্থনা এখান গম্ভীর, নিরুৎসব, বিষণ্ণ। জীবনের স্বাদ এখানে ক্ষুধা ও পিপাসায়, কাম ও মমতায়, স্বার্থ ও সংকীর্ণতায়।"পৃষ্ঠা- ৪৫

এ যেন আত্মপোলব্ধির এক অনিবার্য নির্যাস- এই বাক্য তাঁর নিজের জীবনের প্রতিধ্বনি যেন। কোন অমূলক কষ্টকল্পনার বাস্তবায়ন নয়। পাশাপাশি জীবনানন্দের জীবনচিত্রও এর ব্যতিক্রম নয়। জীবনের আনন্দ, স্বস্তি, তৃপ্তি কখনই এঁদের কাছে নির্ভার হয়নি। আজন্ম লালিত সুখস্বপ্নের জোয়াল আমৃত্যু টেনে নিয়ে গেছেন। ক্ষুধা ও পিপাসায়, কাম ও মমতায়, স্বার্থ ও সংকীর্ণতায় মানিক, জীবনানন্দ উভয়ই বিষমভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছেন। এক মানবিক ও বাস্তবিক জীবনের প্রত্যাশা আজীবন কল্পনাতেই থেকে গেছে। যার প্রতিফলন 'পদ্মা নদীর মাঝি'উপন্যাসেও দেখা যায়।

এ প্রসঙ্গে সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ বলেন-

“কবিতা লেখার ইচ্ছা থেকে গদ্য প্রকাশ-বিস্তৃতি, অস্তিনাস্তি আর হোসেন মিয়ার কবিত্ব পরিত্যাগের মধ্য দিয়ে ময়না দ্বীপকে নিজস্ব সার্বভৌম জগৎ হিসেবে নতুন জনবসতি স্থাপনের স্বপ্ন-আহ্লাদ মানিকের আত্মবিসর্জন ও পুনরুত্থানের সংলগ্নী"। পৃষ্ঠা - ৪৬

বাংলা সাহিত্যের শক্তিমান দুই লেখকের এমন বিদীর্ণ জীবন নিয়ে 'বাংলা সাহিত্য'নিজেই কি সুখে আছে? একদিকে জীবনানন্দের শারীরিক যন্ত্রণা প্রভাবিত কাতরতা আর অন্যদিকে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের অতিরিক্ত অ্যালকোহল পানজনিত অচেতনতা এবং মূর্ছারোগজনিত অজ্ঞানতায় তৈরি হচ্ছে মৃত্যুরূপ আচ্ছনতা। আত্মগত অবগাহনে যেন পরিভ্রমণ ঘটে জীবন চরাচরে।

দেশভাগ পরবর্তী দাঙ্গা-হাঙ্গামায় মানুষ নিয়ত মৃত্যুচিন্তায় তাড়িত, সামাজিক -রাজনৈতিক প্রভাবে মানুষের সামনে মৃত্যু পথরোধ করে। একবিন্দু প্রাণস্পন্দনের অন্বেষণ যখন ভূ-ভারতে প্রকট হয়ে ওঠে তখন এক সার্বিক বিভ্রান্তি সমাজচেতনায় ভর করে। বিমূঢ় এই সময়ে 'ছায়া আবছায়া'উপন্যাসের দৃশ্যপটে অদ্বৈত মল্লবর্মণের আগমন ঘটে।

মানিক চরিত্র জীবনানন্দের চরিত্রকে ছাপিয়ে যায় নি। বরং সমান্তরালভাবে পাশাপাশি এগিয়ে গেছে। কেউ কারও জীবনের ভারে ভাগী হয় নি। বহমান বাস্তবতার নিরীখে জীবনানন্দ ও মানিকের জীবনভূমিতে অদ্বৈত মল্লবর্মণ আরেক সহগামী মাত্র। তারও শরীর ক্লিষ্ট, রোগদংশনে বিপর্যস্ত। যক্ষারোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে থাকতে হয় অনিশ্চিত বৎসরাধিককাল। বাড়ি ফিরেও ঘটে না রোগমুক্তি। বরং ঘটে যায় মহানির্বাণ। অকৃতদার মল্লবর্মণ সাহিত্যের দায় মেটাতে নিজের শুশ্রুষা করার সুযোগ পান নি। রাজনৈতিক ও শারীরিক মৃত্যুতাড়না প্রতিনিয়ত আঘাত করেছে। তার এসব দৈব অনুভূতি হয়ে উঠেছে উপন্যাসের বাঞ্ছিত অনুষঙ্গে।

রাশিয়ার সাহিত্যিক দস্তয়েভস্কিরও মৃগী রোগ ছিল বলে জানা যায়। তার পরিবারে কারও মৃগী রোগ থাকার পূর্বইতিহাস ছিল না। মানিকেরও নেই। তার পরিবারে এই রোগ থাকার নিদর্শন নেই। প্রতিদিনের যন্ত্রণা তাকে সুস্থ জীবনের স্বস্তি দেয় নি। সমাজ জ্বালায় জর্জরিত হতে হতে তিনি মদ্যপানে আসক্ত হয়ে পড়েছিলেন। সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ মদ্যপান বিষয়ে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের আসক্তি নিয়ে অকপট থেকেছেন। প্রচলিত সাহিত্য রচনার পদ্ধতি অনুযায়ী মানিকের মদ্যপ্রেমকে নীতিবাগিশ উন্নাসিকতা দিয়ে ঢেকে রাখার চেষ্টা করেন নি। কোন ছুৎমার্গের দাসত্ব তিনি করেননা।বরং খোলাখুলি বিবরণ দেন। লিখেছেন-

"বঙ্গশ্রীতে চাকুরিকালীন মদ্যপান নিয়মিত ছিল না। সে সময়ে মদ্যপান এক ধরনের ফ্যাশান, তবুও মদ্যপানে আকৃষ্ট হতে শুরু করল মানিক। জননী যখন গ্রন্থাকারে প্রকাশ হলো সেই থেকে অন্য জলের প্রতি পিপাসা। শান্তি দিচ্ছে, জ্বালাও মেটাচ্ছে।"পৃষ্ঠা - ৬৮

শারীরিক শ্রম, বিষাদ, মানসিক ক্লান্তি দিনে দিনে তাকে বিপর্যস্ত করে তুলেছিল। তিনি মনে করতেন 'এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণের জন্য অ্যালকোহলের তুলনা নেই' (পৃষ্ঠা- ৬৮)

জীবনানন্দের জীবনে এমন কোন পলায়নপথ নেই। তারমদ্যপান বিষয়ক কোন অভিজ্ঞতার কথা কোথাও পাওয়া যায় না। কৃত্রিম অনুপানের চাইতে প্রকৃতির সান্নিধ্য এবং অপারনৈঃশব্দ তাকে আত্মমগ্ন করে তুলত। এক শৈল্পিক ভাবালুতায় নিজেকে পরিপার্শ্বের সাথে একাত্ম করে তুলতেন। জীবনের যন্ত্রণা যেমন প্রকৃতির দিকে তাকিয়ে ভুলে যেতেন, তেমনি অনুভব করতেন যাপিত জীবনের আনন্দ। বাংলার নদী মাঠ ঘাট, শ্যামার নরম গান, সোনালী ধান, ঘাস, অশ্বথ, শিরীষ,পেঁচা, শালিক, হরিণ প্রভৃতির সাহচর্যে আনমনা হয়ে উঠতেন। সময়, সমাজ, সংসারের পিছুটান পিছনে পড়ে থাকে; সামনে ভেসে থাকে শুধু অবারিত স্বপ্নপ্রান্তর।

সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ উপন্যাসের ঘটনাপ্রবাহে এতটা অংশীভূত হয়ে গিয়েছিলেন যে কখনও কখনও আবেগের ঢেউয়ে মোচড় দিয়ে উঠেছেন। জীবনানন্দের স্ত্রী লাবণ্যকে বর্ণনা করতে গিয়ে কাব্যের আশ্রয় নিয়েছেন। কবির জীবনে তার ভূমিকা ও অবস্থান, সেই সাথে ব্যক্তিগত উচ্চাশা লাবণ্য'র জীবনকে বহুমাত্রিক করে তুলেছে। লেখক যেন নিরাসক্তভাবে বর্ণনা করছেন, এভাবে উপস্থাপিত হয়ে কয়েকটি বাক্য হয়ে ওঠে কাব্যময়। -

“মনে হতো হেঁটে যাচ্ছে সাপের পা।
মাকড়শার পা… লাবণ্য… কৃমির মতো… কুয়াশার পেত্নীর মতো…
সব মিলিয়ে মাংসের ক্লান্তি। উৎপলাকে লিখতে গিয়ে অদলবদল হয়ে লাবণ্য, কেবলই এক পাথুরে গন্ধ… শিকারীর ক্যাম্পে প্রেতযোনীও তো বিস্মরণ আনতে পারে নাই। "পৃষ্ঠা- ৩১

লাবণ্য'র প্রত্যাশা অপার্থিব ছিল না। অন্য সকলের মত একটি সাবলীল জীবনের স্বপ্ন ছিল তার। দৈনন্দিন জীবনের নানা প্রসঙ্গে তার ইচ্ছা ছিল একেবারে সাদামাটা। কিন্তু জীবনানন্দ ছিলেন বিপরীত প্রকৃতির মানুষ। এই বিষয়গুলোর বিবরণে লেখকের নির্মোহ থাকার আন্তরিকতা কখনও কখনও ক্ষুণ্ণ হয়েছে বৈকী। -

“একজনের কাছে প্রধানত ছিল জৈবতা, যেখানে জৈবিক নিয়ম ও আর্থিক নিয়ম কৌলিন্য ছড়াবে।
অন্যজন, প্রতিপক্ষে তৃষ্ণায় স্থান দিয়েছিল জৈবতা- সেখানে কেবল জৈবিক নিয়ম, এবং স্বপ্নচারিতা- মেশামেশি করবে; স্বপ্নের নারী জৈব জগতে নেমে এসে আবার স্বপ্নের ভেতর আলোর প্রতিমা হয়ে থাকবে।"পৃষ্ঠা- ৩৩

অদ্বৈত মল্লবর্মণের জীবন হেটে চলে পাশাপাশি। যক্ষা রোগে মারাত্মকভাবে আক্রান্ত হয়েও রাজনৈতিক ঘটনাক্রমের মুখোমুখি হয়েছেন। ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতাকামীদের জীবনের সাথে নিজের জীবনের তাল মিলিয়ে নিয়েছিলেন। পত্রিকা প্রকাশের স্বর্ণযুগে জড়িয়েছিলেন একাধিক মননশীল সম্পাদকের সাথে। জীবনের যন্ত্রণার ভার বয়ে বয়ে সয়ে যাচ্ছিলেন স্বাধীনতার মরণকামড়। কিন্তু শরীরেরও তো সহ্যের একটি সীমা আছে। দেশভাগ, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, ছিন্নমূল মানুষের কলকাতামুখী অশেষ স্রোত সবকিছু মিলিয়ে এক অস্থির সময়ের পৃষ্ঠদেশে তিনি ছিলেন দাঁড়িয়ে। আঁকতে চেয়েছিলেন মানবতার অপমান ও প্রত্যাখ্যানের বাস্তব চিত্র। কিন্তু সময় সে সুযোগ তাকে দিল না। কিন্তু যা লিখেছিলেন, তার কিরণ ছড়িয়েছে চারদিক।

সৈয়দ রিয়াজুর রশীদের ভাষ্যে আমরা জানতে পারি-

“তিতাস তীরে জল মজুর মালো আর খেত মজুর মুসলমান সমাজের অপূর্ব জীবনের সমন্বয়ে জীবনের এক রূপায়ন ঘটল তার লেখায়।"পৃষ্ঠা- ৯৩

বই পড়তেন খুব। সারাক্ষণ বইয়ের মধ্যে ডুবে থাকতে ভালবাসতেন। ঘরভর্তি বই থাকায় শোবার জায়গা নেই। বইয়ের সংখ্যা কেউ জিজ্ঞাসা করলে জানাতেন যা আয় করেছেন, তার সবটুকুই ব্যয় করেছেন বইয়ের পেছনে। বই কেনার পর যা থাকতো তা ভাগ করে নিতেন পথচলতি নিরন্ন মানুষদের সাথে, বাংলাদেশ থেকে যাওয়া নিরাশ্রয় মানুষের সাথে। জীবনভোগের আনন্দ একা একা ভোগ করতে পারতেন না। সকলের সাথে ভাগাভাগি করে তৈরি, সকলকে নিয়ে তার সংসার। গতানুগতিক দায়িত্ব নয়, জটিল এক ব্রত নিয়ে যেন জন্মেছেন এই দেশে। তাঁর প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে দেশ (১৯৫২) পত্রিকায় লেখা হল-

“কাহাকেও বিন্দুমাত্র ক্ষুণ্ণ না করিয়া জীবন যাপনের এক দুরূহ ব্রতে তিনি সফলতা অর্জন করিয়াছিলেন তাহা আমাদের যুগে বিরল। জীবনের দেবতা দুরূহের বেশেই তারা সম্মুখে আসিয়াছিলেন। সেই দুরূহকে শান্ত চিত্তে ও কুণ্ঠাহীন নিষ্ঠার সহিত পূজা করিয়া গিয়াছেন। জীবন এমন মানুষের ইতিহাসকে সবার অলক্ষ্যে পবিত্র করিয়া গিয়াছে।"পৃষ্ঠা- ৯৩

‘তিতাস একটি নদীর নাম'পত্রিকার মূল পাণ্ডুলিপি হারিয়ে গেলে বিভীষিকা বোধ করেছিলেন। কিন্তু বন্ধু-পাঠক সকলের তাড়নায়, উৎসাহে উপন্যাসটি সম্পূর্ণরূপ দেয়া শুরু করেন। পত্রিকায় যখন প্রকাশ হচ্ছিল, তখন রচনা করেছিলেন স্বতঃস্ফূর্ত আবেগে। গল্পের স্বাদে ও আকারে প্রকাশিত হয়েছিল দুই ধাপে। প্রথম অংশের শিরোনাম ছিল 'দুই নদী'আর পরের অংশের 'রামধনু'। পরে যখন সম্পূর্ণ উপন্যাস রচনার কাজে হাত দেন, তখন রাজনৈতিক, সামাজিক সকল গ্লানি মুছে ফেলে নতুনভাবে চিন্তা শুরু করেন। দেশভাগ তখন হয়ে গেছে। প্রতিটি দিন মানুষ খুনের খবরে শুরু হয়। পূর্ব বাংলা থেকে দলে দলে মানুষ চলে আসছে পশ্চিম বাংলায়। পত্রিকার পাতা ঠাসা থাকত তাদের অবর্ণনীয় দুর্দশায়। অদ্বৈত তখন হাসপাতালে, যক্ষা রোগের সাথে লড়াইরত। বন্ধুবান্ধবদের শরণার্থী জীবনের কথা জেনে করাঘাত করতেন। উত্তেজিত হয়ে উঠতেন। বিভিন্ন ক্যাম্পে আশ্রিত বন্ধুদের চিঠি লিখতেন। আর হাসপাতাল থেকে পালিয়ে বাড়িতে এসে লিখতেন 'তিতাস একটি নদীর নাম'। 'নিঃসঙ্গতার অন্তর্মহল'ছাড়া যেন তার মুক্তি ঘটত না। রোগের তীব্র আক্রমণে উপন্যাস লিখে শেষ করতে পারলেও তার মুদ্রিত রূপ দেখতে পারেন নি। 

লেখকগণের জীবন যাতনার টুকরো টুকরো দৃশ্যগুলো ক্যানভাসের বিভিন্ন অংশে বাঁকা হয়ে ঝুলে থাকে। ঔপন্যাসিক রিয়াজুর রশীদ দক্ষ শিল্পীর মতো সবগুলো জীবনছেঁড়া দৃশ্যগুলোকে এক আধুনিক কোলাজকাঠামোয় বিন্যস্ত করেন। পরপর জীবননানন্দ, মানিক, অদ্বৈত, সঞ্জয় এক মহাকালিক ঘুর্ণাবতের যাত্রী হয়ে পরিপার্শ্ব আলোড়িত করতে থাকেন। প্রত্যেকে উপস্থিত হন নিজ নিজ চৈতন্য নিয়ে। স্বাস্থ্য সম্পদে তাঁদের দারিদ্র সকলকে একই সুতোয় গেঁথে রেখেছে। ফরাসী ঔপন্যাসিক মার্সেল প্রুস্তেরও স্বাস্থ্য ভঙ্গুর ছিল। কিন্তু তাঁর মত মৃত্যুভীতি বাংলা সাহিত্যের লেখকগণের মধ্যে পাওয়া যায় নি। না জীবনযাপনে, না স্বাস্থ্য সম্পর্কিত আলোচনায়, না ভবিষ্যত ভাবনায়। মৃত্যু যত সন্নিকটে এসেছে, তাঁরা তত বেশি সৃষ্টিশীল, শক্তিশালী এবং কল্পনাসম্পদে ধনী হয়েছেন। বাংলা সাহিত্যের এ বোধ হয় এক অনাবিল চঞ্চল প্রাণ। অন্যদের মত যখন তাঁদের মৃত্যুভয়ে কাতর হয়ে পরার কথা, সে সময়ে তাঁরা নতুন শিল্প নির্মাণ করেছেন, লিখেছেন পাতার পর পাতা, সচল ছিলেন রাজনৈতিক সক্রিয়তায়। শক্ত পায়ে মৃত্যুর মুখোমুখি দাড়িয়েছেন। মৃত্যুগহ্বরে পতনের আগে আরও বেশি সৃষ্টিশীলতায় মগ্ন ছিলেন। মার্সেল প্রুস্তের মধ্যে দেখি মৃত্যুর আগে আগে জীবনীশক্তির প্রাবল্য। উপন্যাস শেষ করবার আকাঙ্ক্ষা দুর্মর হয়ে উঠেছিল। মৃত্যুর সাথে রীতিমতো লড়াইয়ে নেমে পড়েছিলেন। অদম্য তাড়নায় বেঁচে ছিলেন নিজের মত করে। তুমুলভাবে বেঁচে উঠেছিলেন মৃত্যুর আগেই। মৃত্যুর আশংকা লেখকগণের চিন্তাজগতে যেন কোনভাবেই আঁচড় কাটতে পারে নি। যেন তাঁরা প্রত্যেকেমৃত্যুকে এক অনির্বচনীয় জীবনবাক্যের সমাপ্তি মনে করেন শুধু।

সৈয়দ রিয়াজুর রশীদের উপস্থাপনাভঙ্গী বহুমাত্রিক। সাহিত্যিকগণের বৈচিত্র্যময় ও ঘটনাবহুল জীবনযাত্রা নয়, জীবনকথা তার বিষয়। বিষয় নির্বাচনের এই অভিনবত্বের কারণে তার উপন্যাসকে ষাটের দশকের 'শাস্ত্রবিরোধী আন্দোলন'প্রভাবিত বলে মনে করা যেতে পারে। পুরোনো সাহিত্যশাস্ত্র সাহিত্যগত প্রসঙ্গগুলিকে যেভাবে কাঠামোবদ্ধ করে, তার বিরোধীতাকারীরা 'শাস্ত্রবিরোধী'বলে স্বীকৃত। 'ছায়া আবছায়া'উপন্যাসে প্রচলিত অন্যদের মত ঘটনাপ্রবাহ নয়, ঘটনাচিত্র প্রাসঙ্গিক বিষয়। সাহিত্যিকগণ পলে পলে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন। তারা নির্ভয়ে সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের মত শরীরের বেদনাকে উপেক্ষা করে প্রবলভাবে জীবন যাপন করছেন। সামাজিক, রাজনৈতিক, বৈষয়িক কোন কাজে শ্রান্তি নেই। প্রতিনিয়ত ঘটমান হচ্ছে নানাবিধ ঘটনা। ঘটনাগুলো কখনও কখনও পরস্পরবিচ্ছিন্ন, সম্পর্কহীন। জীবনানন্দের কোন এক জীবনচিত্রের পরে ধারাবাহিকভাবে চলে আসে মানিকের কোন এক জীবনচিত্র। কোন সম্পর্কিত ঘটনার সূত্র পরস্পরকে একফোঁড়ে গাঁথে না। শুধু ঘটনার প্রকাশযোগ্যতার কারণে দেয়ালে জায়গা করে নেয়। পাশ কাটানো যায় না, মুখ ফেরানোও যায় না। নিয়মিত সাংসারিক জীবন যাপনের পাশাপাশি রাজনৈতিক, সামাজিক বিরল ঘটনাগুলোও অকথিত থাকে না। টুকরো টুকরো কাগজের মত করে সুনিপূণ বিন্যাসে পরস্পরের পাশে স্থান করে নেয়।

সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ আনমনা হয়ে অনবরত বলে যান। ঘটনার বিবরণের সাথে আত্মমগ্ন হয়ে যান। একনাগাড়ে বলে যেতে থাকেন পরম্পরা ঘটনাবলী। আপাতদৃষ্টিতে পাতার পর পাতায় সম্পর্কহীন ঘটনাবলীর অভূতপূর্ণ বিন্যাস চোখে পড়তে পারে। কাহিনীহীন, তুঙ্গ মুহূর্তহীন ঘটনাটুকরোর স্থানিক অবস্থান অপরিচিত মনে হয়। কিন্তু ঔপন্যাসিকের আধুনিক মনোভঙ্গী পশ্চাতপদ দায় থেকে মুক্ত। আলোচ্য লেখকগণ প্রত্যেকে ঘটনাবহুল, উত্তেজনাপূর্ণ জীবন কাটিয়েছেন। তাদের জীবন থেকে পাওয়া টুকরোগুলো উপন্যাসের উপাদান, কাহিনী নয়। লেখকদের জীবন থেকে চুইয়ে পড়া উপাদানগুলোই মহার্ঘ। একাধিক জীবনের রহস্যকণা যেন একজীবনের বার্তাবহ। লেখকগণের জীবনটুকরো দিয়ে তৈরি হতে থাকে বাংলা সাহিত্যের জীবনসূত্র। এক ভাষাময় দক্ষতা দিয়ে তিনি উতরে যান সমকাল। তার অনবদ্য ভাষা এক  নৈর্ব্যক্তিক তানপুরা হয়ে মোহনীয় ধ্বনিরেখা হয়ে চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে। ধ্যানরত নির্মোহ ভাষার আবেশে লেখকগণের জীবনচিত্র জীবন্ত হয়ে ওঠে। অভিভূত পাঠকের চেতনাপ্রবাহে ঢেউ জাগে, নিমজ্জিত হয় এক মৌলিক স্রোতধারায়।ব্যক্তিক সীমাবদ্ধতা ছাড়িয়ে গিয়ে নৈব্যর্ক্তিক জীবনবোধ সর্বজনীন হয়ে ওঠে।সাহিত্যশৈলীর এক অনন্য নিদর্শন হয়ে ওঠার পথে 'ছায়া আবছায়া'উপন্যাসের প্রাসঙ্গিকতা বেড়ে যায়।

পৃষ্ঠাসূত্র: সমগ্র রচনা ১, সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ, ২০২২, অনুভব প্রকাশনী, ঢাকা।

সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ রচিত ‘ছায়া আবছায়া’ উপন্যাসে অবগাহনকেন্দ্রিক অভিজ্ঞতা
সুশান্ত বর্মণ 

মন্তব্য

নাম

অনুবাদ,32,আত্মজীবনী,26,আর্ট-গ্যালারী,1,আলোকচিত্র,1,ই-বুক,7,উৎপলকুমার বসু,23,কবিতা,319,কবিতায় কুড়িগ্রাম,7,কর্মকাণ্ড,15,কার্ল মার্ক্স,1,গল্প,56,ছড়া,1,ছোটগল্প,12,জার্নাল,4,জীবনী,6,দশকথা,24,পাণ্ডুলিপি,10,পুনঃপ্রকাশ,15,পোয়েটিক ফিকশন,1,প্রতিবাদ,1,প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা,4,প্রবন্ধ,152,প্রিন্ট সংখ্যা,4,বর্ষা সংখ্যা,1,বসন্ত,15,বিক্রয়বিভাগ,21,বিবিধ,2,বিবৃতি,1,বিশেষ,23,বুলেটিন,4,বৈশাখ,1,ভাষা-সিরিজ,5,ভিডিও,1,মাসুমুল আলম,35,মুক্তগদ্য,37,মে দিবস,1,যুগপূর্তি,6,রিভিউ,5,লকডাউন,2,শাহেদ শাফায়েত,25,শিশুতোষ,1,সন্দীপ দত্ত,8,সম্পাদকীয়,16,সাক্ষাৎকার,21,সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ,18,সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ,55,সৈয়দ সাখাওয়াৎ,33,স্মৃতিকথা,14,হেমন্ত,1,
ltr
item
বিন্দু | লিটল ম্যাগাজিন: সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ সংখ্যা : সুশান্ত বর্মণ
সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ সংখ্যা : সুশান্ত বর্মণ
সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ রচিত ‘ছায়া আবছায়া’ উপন্যাসে অবগাহনকেন্দ্রিক অভিজ্ঞতা : সুশান্ত বর্মণ
https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEiQ_SLPx8jtMMnOq8PGfHW9iOovZF4A35RxxmruUDS1YvWU-fBE9lMqJlVDUSqY-D2IQwblF4u8XiVziPfmbnW0jTqYviYVFbaqZWxpjaxh0axe4S0PuzuS6xH7aJZq-fz7dnqBsxpFJv2QsJTOogzvPKsv9KZ1mc94KA-V4sx2HeKvvQ7FrjGAbYY7M7Y/s16000/Syer%20Riazur%20Rashid%20bindumag.png
https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEiQ_SLPx8jtMMnOq8PGfHW9iOovZF4A35RxxmruUDS1YvWU-fBE9lMqJlVDUSqY-D2IQwblF4u8XiVziPfmbnW0jTqYviYVFbaqZWxpjaxh0axe4S0PuzuS6xH7aJZq-fz7dnqBsxpFJv2QsJTOogzvPKsv9KZ1mc94KA-V4sx2HeKvvQ7FrjGAbYY7M7Y/s72-c/Syer%20Riazur%20Rashid%20bindumag.png
বিন্দু | লিটল ম্যাগাজিন
https://www.bindumag.com/2023/11/susanta-barmans-article-on-syed-riazur-rashid.html
https://www.bindumag.com/
https://www.bindumag.com/
https://www.bindumag.com/2023/11/susanta-barmans-article-on-syed-riazur-rashid.html
true
121332834233322352
UTF-8
Loaded All Posts Not found any posts আরো Readmore উত্তর Cancel reply মুছুন By নী PAGES POSTS আরো এই লেখাগুলিও পড়ুন... বিষয় ARCHIVE SEARCH সব লেখা কোন রচনায় খুঁজে পাওয়া গেল না নীড় Sunday Monday Tuesday Wednesday Thursday Friday Saturday Sun Mon Tue Wed Thu Fri Sat January February March April May June July August September October November December Jan Feb Mar Apr May Jun Jul Aug Sep Oct Nov Dec just now 1 minute ago $$1$$ minutes ago 1 hour ago $$1$$ hours ago Yesterday $$1$$ days ago $$1$$ weeks ago more than 5 weeks ago Followers Follow THIS PREMIUM CONTENT IS LOCKED STEP 1: Share to a social network STEP 2: Click the link on your social network Copy All Code Select All Code All codes were copied to your clipboard Can not copy the codes / texts, please press [CTRL]+[C] (or CMD+C with Mac) to copy