৭৫ এর ১৫ আগস্টের বেদনাবহ ইতিহাস নিয়ে বেশ কয়েকটি উপন্যাস লেখা হয়েছে। খুব কম উপন্যাসেই মর্মন্তদ বেদনাবিধুর ঘটনার সঙ্গে আগস্ট ঘটনার যোগসূত্র ও পরবর্তী প্রতিক্রিয়াকে একই বিন্দুর বৃত্তে রেখে কার্যকারণ বিশ্লেষণ করা হয়েছে। অর্থাৎ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর পরিবার পরিজনের নৃশংস মৃত্যুর প্রেক্ষাপট, প্রতিক্রিয়াসমূহ শৈল্পিক ভাষায় চিহ্নিত করা সম্ভবপর হয়নি। লেখক রিয়াজুর রশীদ ভাষা, বাক্য গঠন, বাক্যের আঙ্গিক, চিন্তার বিস্তার যোগসূত্রের গোপন রহস্য উদ্ঘাটন ও বহুমাত্রিক সমীকরণকে উন্মুক্ত করেছেন। লেখক বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কিছু রূঢ় বাস্তব, অপ্রিয় সত্য ও সামগ্রিক অস্বস্তিকে এমনভাবে উন্মুক্ত করেছেন পাঠকের বিশ্বাস ভেঙে চৌচির হয়ে যায়। তিনি ভাষার আঙ্গিক ও উপস্থাপনে যে কৌশল ব্যবহার করেছেন তাতে ঘটনা কেবল ইতিহাস পাঠ না হয়ে ইতিহাস, সম্ভাবনা ও রহস্য উন্মোচনের তীব্র বিশ্লেষণ হয়ে ওঠে ।
‘ইতি তোমার মুজিব' বাক্যে যে দ্যোতনা ও বোধের আবহ সঞ্চার করে তা পাঠকের ষড়-তন্ত্রকে এক ধরনের নির্বাক অনুভূতির দিকে তাড়িত করে। সত্য হলো বাঙালিকে ট্র্যাজিক বাস্তবতা অর্থাৎ ১৫ আগস্টের ভয়াবহ অভিজ্ঞতার মুখোমুখি করে দেওয়া। উপন্যাসের মূল ফোকাস তাই। লেখক এ ক্ষেত্রে ঘটনার দীর্ঘ বিশদ বিবরণ দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করেননি। ১৫ আগস্টের অতীত ও ভবিষ্যৎ ঘটনাপ্রবাহের যোগসূত্রগুলো উল্লেখ করেন। আবার ১৫ আগস্টের যতটুকু বিবরণ দিয়েছেন তাতেই পাঠক অসাড় হয়ে পড়ে। মুজিবের মৃত্যু কেবল ব্যক্তি মুজিব, পরিবার কিংবা তাঁর রাজনৈতিক মতাদর্শের মানুষদের বিমূঢ় করে দেয়নি। সমগ্র বাঙালি জাতিকে চিরকালের জন্য দুটো শিবিরে বিভক্ত করে দেয়। লেখকের ভাষায়— “দুনিয়ার পাপ পুণ্য পাশাপাশি চলতে পারে না। পুণ্য চলে একদিকে, পাপ চলে আরেক দিকে।"
"এক্ষণে সদলবলে দুই ভাগ হয়ে গেল, সহসা সব- এমনকী পাথর, এমনকী সময়, এমনকী ক্রন্দন এমনকী জন্ম, এমনকী দুঃখ, এমনকী অশ্রু, এমনকী নারী, এমনকী জনগণমন-সব-ই বিভাজ্য। একই বৃন্তে দুটি ফুল ফোটে না, ফোটে না, কখনো ফোটে। নাই।” [পৃ. ৯, ইতি তোমার মুজিব: সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ, অনুভব, ফেব্রুয়ারি ২০২০, ঢাকা]
আগস্ট ভোরে রক্তের পিপাসায় উল্লসিত হয়ে উঠেছিল কিছু মানুষ –তার ক্রুর ভাষাও নির্মাণ করেন লেখক। ৭৪ সালে জুলফিকার আলী ভুট্টোর বাংলাদেশ সফরের মধ্য দিয়ে সেই আবহের একটি ইঙ্গিত ফুটে ওঠে। আবার উপন্যাসে কর্নেল জামিল ও ডি.এস.পির আত্মদানের মহত্ত্ব আছে। বঙ্গবন্ধু মুজিবের হত্যাকাণ্ডে মেজর জিয়াউর রহমান, খন্দকার মোশতাক, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত বোস্টার, কনস্যুলেটর জর্জ গ্রিফিন, সি.আই এর সংশ্লিষ্ট থাকা কিংবা সম্ভাব্য রক্ষী-বাহিনীর প্রতিরোধ মোকাবিলায় মার্কিন প্রস্তুতি এখন দিবালোকের মতো স্পষ্ট। একইভাবে তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল শফিউল্লাহ কিংবা তোফায়েল আহমেদের ব্যর্থতা ও অসহায়ত্বের কথাও সবাই কম বেশি জানে। লেখক জানার আরও কিছু তথ্য মনে পড়ল তার ১৯৭১ এর ১৭ ডিসেম্বর চৌএনলাই চীনের প্রধানমন্ত্রী যা বলেছিলেন- “ঢাকার পতন ভারতের বিজয়ের পথে অগ্রগতির স্বাক্ষর নয়, বরং এশীয় উপমহাদেশের এক অন্তহীন যুদ্ধের সূচনা মাত্র।"
জুলফিকার আলীও যেন সুর মেলায় কথা, “সমরশক্তির জোরে একটা অবাঞ্ছিত পরিস্থিতিকে চাপিয়ে দেওয়া যায়, কিন্তু তা চিরস্থায়ী হয় না। পূর্ব পাকিস্তান পাকিস্তানের অবিচ্ছেদ্য অংশ।” [পৃ. ২৬, পূর্বোক্ত] কাজেই মুজিব হত্যার সঙ্গে তাদের নিকট অন্তত দূরবর্তী যোগসূত্র থাকা অসম্ভব কিছু নয়। বিশেষত ১৫ আগস্টের পরে চীন ও পাকিস্তানের বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার মধ্য দিয়ে সন্দেহ আরও ঘনীভূত হয়। পাঠক হোঁচট খায় যখন DGFI এর মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার রউফের কাপুরুষোচিত ভূমিকা জানতে পারে। কার্যত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এক চোরাবালি ফাঁদ, এক বিশ্বাসহীনতার গোলকধাঁধায় বন্দি হয়ে পড়েছিলেন। লেখকের ভাষা- “ফারুক-রশীদ নেতাকে হত্যা করার মতো ঘটনা তৈরি করতে পারে, তা জানা ছিল জিয়া- খালেদ- শাফায়েত-রউফের। প্ল্যান সাফল্যের মুখ দেখলে তারা যেন পিছিয়ে না থাকেন,এই মতলবে তারা কোনো সংবাদ গোপন রাখে।” [পৃ. ৫৭ পূর্বোক্ত] অর্থাৎ ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশারফ ও কর্নেল শাফায়েত জামিলের ভূমিকা লেখক প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন। ১৫ আগস্টের আগে ও পরে তারা সত্যিকার অর্থে কোনো ভূমিকা পালন করেছিলেন তার ঘটনা নিরপেক্ষ তদন্ত ও বিচার-বিশ্লেষণ প্রয়োজন ।
বঙ্গবন্ধু মুজিব আর বাঙালির মুক্তিযুদ্ধ অবিচ্ছেদ্য। উপন্যাসে ছয় দফা, ৭০ এর নির্বাচন, অসহযোগ আন্দোলন, মুজিবের গ্রেফতার-তাঁর বিচার, মুক্তিযুদ্ধর মূল ঘটনাপ্রবাহ স্বল্প কথায় চিহ্নিত করেন। মুক্তিযুদ্ধের প্রবণতার ভিতর তাজউদ্দীনের নেতৃত্বে মুজিবনগর সরকার গঠন, মুজিব বাহিনী গঠন, আওয়ামী লীগের অন্তর্দ্বন্দ্ব, খন্দকার মোশতাকের উদ্যোগে পাকিস্তানের সঙ্গে কনফেডারেশন প্রচেষ্টা লেখক টেনে এনেছেন। একই প্রসঙ্গে লেখক পাকিস্তান বাহিনীর বর্বরতা, গণহত্যা, ধর্ষণ যেমন চিত্রায়িত করেছেন তেমনি দীর্ঘকাল পড়ে হলেও তাদের নির্বিকার আত্মপক্ষ সমর্থনের নির্লজ্জতাও ফুটে ওঠে। পাকিস্তানের সাংবাদিক জাফর আব্বাসের কাছে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বঙ্গবন্ধুর খুনিদলের সেই ভূমিকা স্পষ্ট হয়। আবার মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী রাজনৈতিক অস্থিরতা, প্রশাসনের অভ্যন্তরে অদক্ষতা ও ষড়যন্ত্রের স্বরূপ ফুটে ওঠে। ফিদেল কাস্ত্রো বঙ্গবন্ধুকে চিলির আলেন্দে ও চে গুয়েভারার উদাহরণ টেনে সতর্ক করেছিলেন। পরবর্তী ইতিহাস প্রমাণ করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত অধিকাংশ সদস্য ছিলেন পাকিস্তান প্রত্যাগত কিংবা সুযোগ সন্ধানী মুক্তিযোদ্ধা। কিন্তু লেখক যে ডালিমের চরিত্র অঙ্কন করেছেন তাঁর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতক ব্রুটাসও হেরে যায়। একই ভাবনা থেকে লেখক ১৫ আগস্ট ও কারবালার ইতিহাসকে এক সমরেখায় দাঁড় করিয়ে দেন।
১৫ আগস্টে পরিবার-পরিজনসহ বঙ্গবন্ধু মুজিবের হয়তো নির্মম মৃত্যু হয় কিন্তু তার বিনাশ হয় না। বাঙালির অবিনাশী চেতনা, শৃঙ্খল মুক্তির ইতিহাসের সঙ্গে মুজিব ছিলেন চির একাত্ম। মৃত্যু তাঁর নশ্বর দেহের বিনাশ ঘটালেও, তাঁর চেতনা, স্বপ্ন ও আদর্শের পুনর্জাগরণ ঘটে। পলাশিতে বাঙালির যে ঔপনিবেশিক দাসত্বে বন্দি হয়েছিল বঙ্গবন্ধু মুজিব তা ছিন্ন করেন। লেখক চিহ্নিত করেন- "সেই সাম্রাজ্যের মধ্যমণি ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বাংলার কর্মী থেকে দলপতি, রাষ্ট্রপিতা নেতাকে অভ্যর্থনা জানালের ১০নং ডাউনিং স্ট্রীটে। তারিখটা ৮ জানুয়ারি ৭২। প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হীথ সাহেব ছিলেন লন্ডনের বাইরে। খবর পেলেন বাংলার নেতা আসছেন। কর্মসূচি বাতিল করে ফিরলেন লন্ডনে। নেতাকে নিয়ে গাড়ি যখন এসে থামল ১০নং ডাউনিং স্ট্রীটের ফটক খোলা হলো তখন। এডওয়ার্ড হীথ সাহেব বেরিয়ে এসে গাড়ির দরজা খুলে দাঁড়িয়ে রইলেন যতক্ষণ পর্যন্ত নেতা বেরিয়ে না আসে গাড়ি থেকে। ঔপনিবেশিক দেশের প্রধানমন্ত্রী তারই অধঃস্তন একটি দেশের নেতার জন্য অপেক্ষা করেছেন এবং হয়েছেন সম্মানিত। দৃশ্যটি ইতিহাসের স্থির এক রঙিন চিত্রের মতো উদ্ভাসিত।” [পৃ. ৬৩ পূর্বোক্ত] অন্যত্র লেখক মুজিবকে চিহ্নিত করেন এভাবে- "আর সেই তর্জনী। একবার উত্তোলিত হয়, সঞ্চালিত হয়। যেন কোনো অর্কেস্ট্রা। পরিচালনা করেছিলেন তার বিশিষ্ট একক সেই তর্জনী আমোঘ জাদুকরী মুদ্রায় সম্মোহিত করে, আন্দোলিত করে সাড়ে সাত কোটি জনকে একদা এবং তারপর ফেটে পড়েছিল মানুষ, বিষ্ফোরণ ঘটেছিল তাদের, প্রতিবাদে-প্রতিরোধে লড়ে গিয়েছিল আমৃত্যু তাদের স্বাধীনতা পর্যন্ত ।
একটি মাত্র তর্জনী নিশ্চল করে দিয়েছিল আস্ত দেশ। তার তর্জনী রচিত মুদ্রা ও তর্জনী খচিত নির্দেশ অমোঘ হয়ে উঠেছিল, বারবার আবার।” [পৃ. ১২, পূর্বোক্ত]
অন্যদিকে, তাজউদ্দীন আহমদের ভাবনায় বঙ্গবন্ধু মুজিব ফুটে ওঠেন এভাবে– হাজার বছর পর পাওয়া গিয়েছিল এমন নেতা, যিনি রঙে-বর্ণে, ভাষায় ও জাতি বিচারে প্রকৃত মানুষ। মাটি ও ইতিহাস থেকে সৃষ্টি অথচ ভূখণ্ডের স্রষ্টা। সুদর্শন ;প্রবল ব্যক্তিত্ব। অনলবর্ষী। অসাধারণ জাদুকর। শ্যমলা রঙের মানুষ, বাংলার শ্যামলিমা যেখানে মিশেছে। তিনি হঠাৎ হয়ে ওঠা নেতা ছিলেন না। কর্মী থেকে নেতা, নেতা থেকে জাতীয় নেতা, তারপর জাতির পিতা।” [পৃ. ২২ পূর্বোক্ত]
ইতিহাসের ট্র্যাজেডি হলো ষড়যন্ত্রকারিগণ তাঁর সম্পর্কে মুজিবকে সন্ধিগ্ধ করতে পেরেছিল। ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলীর মতো বিচক্ষণ মানুষও মানুষ চিনতে ভুল করছিল। কলকাতার মার্কিন কনস্যুলেটর জর্জ গ্রিফিন ও ডালিমের ষড়যন্ত্রে মোশতাককে অবিশ্বাস না করে বরং তাজউদ্দীন আহমেদকে সন্দেহ করেছেন। স্বভাবত প্রশ্ন ওঠে মনসুর আলী কেন মোশতাকের স্বরূপ চিনতে ভুল করলেন কিংবা তাজউদ্দীন আহমেদকে আস্থায় নিতে পারলেন না?
সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ নিজস্ব ভাষাভঙ্গি, বাক্যের আঙ্গিকের মধ্য দিয়ে ১৫ আগস্টের অনেক প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন। পাঠকের কাছে রহস্যের উন্মোচন-সূত্র রেখে নতুন প্রশ্ন ও জিজ্ঞাসা সৃষ্টি করেছেন। আর তা করতে যেয়ে তিনি গল্পের কোন ধারাবাহিকতা রক্ষা করেননি। ইতিহাস, বাস্তবতা ও উপলব্ধির অনেকগুলো বাঁকের সমন্বয় করেছেন মাত্র। ফলে গল্পের অনুভব ব্যক্ত করতে যেয়ে ঘটনার ভিতর ঘটনা প্রবেশ করিয়ে আবহ থেকে আবহে স্বচ্ছন্দে বিচরণ করেছেন। প্রথাগত অর্থে উপন্যাসে কোনো মুখ্য বা গৌণ চরিত্র নেই। অর্থাৎ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছাড়া অন্য কোনো চরিত্র গতিশীল ছিল না। গতিশীল ছিল সময়, রাজনীতি ও ষড়যন্ত্রের প্রেক্ষাপট। একই সমান্তরালে বঙ্গবন্ধু মুজিবের বেদনাবহ ইতিহাসের ময়নাতদন্ত ওঠে এসেছে। আর চরিত্রগুলো সত্য উন্মোচনের প্রয়োজনে গতিশীল হয়েছে, পরক্ষণেই স্থির। কিন্তু লেখক তার উদ্দেশ্য ঠিক অর্জন করেছেন, চরিত্রগুলোর ভিতরের সত্তা ও আপাত মুখোশ উন্মোচন করেছেন। ইতি তোমার মুজিব বলে তিনি কার্যত বঙ্গবন্ধু মুজিবের অনিবার্যতা ভাষায় আরও বেশি বাঙ্ময় করেন। উপন্যাসটি '৭৫ এর ১৫ই আগস্টের প্রেক্ষাপটে ভাষা, চিন্তা, দর্শন, কার্যকারণ বিশ্লেষণ ও আঙ্গিকে নিরীক্ষাধর্মী টেক্সট।
[‘বাংলাদেশের উপন্যাসে বঙ্গবন্ধু, শৈল্পিক নির্মিতি"গ্রন্থ হতে/ ২০২২]
মন্তব্য