এটি একটি প্রথাবিরোধী বই।
প্রথম লেখা রক্ত অনুষঙ্গ। আল মাহমুদের পানকৌড়ির রক্ত এবং কমলকুমার মজুমদারের নিম অন্নপূর্ণা এই দুটি গল্পের নারীর শরীরী-রক্তের দ্বিমুখী দিকের সমান্তরাল ঐক্য এবং সঙ্গতিটুকু লেখকের স্পর্শ করার চেষ্টা। এক রমনী রজস্বলা-দুই, তাজারক্ত বিদ্ধ হবার ক্ষেত্রে দ্বিতীয় প্রমাণ।
যখন মানুষ প্রাকৃতিক তখন সে বন্য-সুন্দর। রক্তও তাই। সাংসারিক যখন, রক্ত তখন নোংরা, ঘটানুক্রমিক, বিপর্যস্ত আর অলজ্জ্ব। নানা অনুষঙ্গে নৈকট্য এবং বিচ্ছেদ কতটা রক্তের দাবী রাখে, সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ তার এই লেখায়, এইসব সূক্ষতায়, তার মেধার পরিচয় দিয়েছেন।
আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের চিলেকোঠার সেপাই উপন্যাসের পাঠ প্রতিক্রিয়ায় জানানো হয়েছে, ইলিয়াসের শক্তিশালী রচনাশৈলীর দক্ষতা, সঙ্গে গণজাগরণকেন্দ্রিক বিবিধ বিষয়বস্তুর ঐক্য। জানিয়েছেন, উপন্যাসের জন্মলগ্ন, এর প্রেক্ষিত আর এই নামে বাজারী ভিত্তিহীন লেখার যাবতীয় ধরন।
ব্যক্তি সুবিমল মিশ্র লেখকের তৃতীয় লেখা। সুবিমল মিশ্র, তার বিশ্বাস, তার শিল্পভাবনা নিয়ে বলা হয়েছে। প্রতিষ্ঠানবিরোধী এই মানুষটির লেখার উদ্বৃত্তি দিয়ে রিয়াজ তাকে বিশ্লেষণ করেছেন কয়েকটি দিক থেকে। প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা নিয়ে লেখকের নিজস্ব দুয়েকটা ভাবনাও তুলে ধরেছেন।
লিটল ম্যাগাজিন প্রসঙ্গে যা বলা দরকার মনে করি– এটা এই বইয়ের আগুনজ্বালা লেখা। লিটল ম্যাগাজিন, এর প্রেক্ষাপট, প্রস্তুতি, পরিস্থিতি অতিক্রম করার ধরন, পণ্যসর্বস্ব মিডিয়ার আগ্রাসন, বাজারী লেখক, বিভ্রান্ত হওয়া পাঠককূল-এইগুলো নিয়ে গবেষণাধর্মী লেখা। সংবাদপত্রের সাহিত্য সাময়িকী পাতার জন্মান্ধ জানোয়ারীবৃত্তের বিরুদ্ধে বিরামহীন খড়গ চালিয়েছেন। প্রতিষ্ঠানবিমুখ লেখক সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ এই লেখাটা লিখতে পেরেছেন এই জন্যে যে, আশির দশকে বাংলাদেশের ঐতিহাসিক লিটল ম্যাগাজিন মুভমেন্ট যে কয়েকজন
কবি-লেখক-সম্পাদকের হাত দিয়ে হয়েছে রিয়াজ তাদের একজন। লিটল ম্যাগাজিন বিকশিত হবার ক্ষেত্রে তার ব্যক্তিগত কার্যক্রম এবং মৌলিক লেখাগুলো বড়ো ভূমিকা রেখেছে। দুর্বিনীত এই লেখাটি এদেশে লিটল ম্যাগাজিনে প্রকাশিত প্রথম লিটল ম্যাগাজিনের ওপর লেখা। হাবিব ওয়াহিদ সম্পাদিত অনিন্দ্যে ছাপা হয়। পশ্চিম বাংলার লিটল ম্যাগাজিন মুভমেন্টের জন্যেও লেখাটা জরুরী।
একদা এক শহরে-লেখকের আপন শহরের প্রতি মমতা ফুটে উঠেছে। লেখক ও তার শহর, তাদের বেড়ে ওঠা, পারস্পরিক স্মৃতি, গতিপ্রকৃতি আর এর সংস্কৃতি নিয়ে এটা।
শেষ দুটোয় সৈয়দ রিয়াজুর রশীদের ব্যক্তিগত জীবনের সঙ্গে সমাজ বাস্তবতার যে দ্বন্দ্ব, যে রক্তপাত সঙ্গে তার লেখকসত্তা সঙ্গে তার গল্প, সঙ্গে তার থিম, ফর্ম—এগুলো নিয়ে আলোচনা করেছেন মাতিয়ার রাফায়েল। ভালো লিখেছেন।
একটা ব্যবস্থাপত্র। ব্যবস্থাপত্র দিয়েছেন ডাক্তার সৈয়দ সাকিব নাজির।
বিপ্লব-বিদ্রোহ, রক্ত-হত্যা-আর? প্রকৃতিই নিয়তি। দেখাটা খুব মৌলিক। সৈয়দ রিয়াজ দেখতে চেয়েছেন এইসব। এই পর্যবেক্ষণে গতি আছে, উচ্ছ্বাস নেই। ভালোবাসা আছে, লোভ নেই। শিল্পমন আছে, লিপ্সা নেই। প্রতিরোধ আছে, প্রবঞ্চনা নেই। এতগুলো যখন নেই তো তার ব্যবস্থাপত্র ছাপতেই হয়। কিছুটা সিস্টেমের ভেতরে তো থাকি!দেখো আমার যৌনক্ষমতা কীভাবে হ্রাস পাচ্ছে! এস্টাবলিশমেন্ট এখন বিবেক-যাত্রার প্যান্ডেলে। সেরা প্রবীণ এবং মেধাবী তরুণ এরা খোঁজে, তৈরী করে। ভীষণ অরাজনৈতিক যারা আর যাদের ভেতর ইউরোপ বাস করে। ভোক্তা মাঝামাঝি শ্রেণীর সুশীল সমাজ। এখন এই বিবেকের সামনে নিজেকে ভাঁড় করে দেয়া ছাড়া আর কী আছে? দেখো এই আমি। তোমরা খোঁজো আমার স্ববিরোধিতা, এই আমার বাস্তবতা।
প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা দীর্ঘজীবী হোক।
প্রসঙ্গ: রক্ত অনুষঙ্গ
সেলিম মোরশেদ
সেলিম মোরশেদ
মন্তব্য