শিল্প ব্যক্তির আত্মিক প্রয়াস, অনুপুঙ্খ বিশ্লেষে সারমর্মের ধারাবিবরণী নির্ণীত বিনির্মাণ পর্ব গ্রন্থন এভাবেই এগিয়ে যায় সৈয়দ রিয়াজুর রশীদের 'লাশ নাই' গ্রন্থটি। আশির দশকের উল্লেখযোগ্য লেখক সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ তাঁর লেখায় বলন-শৈলীর অভিনবত্বে এবং আঙ্গিকের কুশলি ভঙ্গিমায় এক নান্দনিক আবহ সৃষ্টি করেন। ইতোমধ্যে সৈয়দ রিয়াজুর রশীদের তিনটি গল্পগ্রন্থ বেরিয়েছে। প্রতিটি গ্রন্থে রিয়াজ নিজেকে অতিক্রম করার চেষ্টা করেছেন। 'লাশ নাই' তাঁর তৃতীয় গল্পগ্রন্থ। বিগত বিশ বছরে যে ক'জন লেখক ছোটকাগজের আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছেন এবং প্রতিষ্ঠানবিরোধী অবস্থানে স্থির থেকে শিল্প – অনুসন্ধান করেছেন, সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ তাদের মধ্যে অন্যতম। রিয়াজের লেখার উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য বিষয় কিংবা বিষয়বস্তুর গতিপ্রকৃতি বৃত্ত থেকে অনন্ত বিন্দুর প্রতি যায় অর্থাৎ প্রত্যক্ষ ঘটনা সংগঠনের বিস্তারিত রূপ অনুভববিন্দুর দিকে অগ্রসর হয়। আখ্যান আছে অথচ আস্তরণও আছে আধুনিক গল্পধারার এই আলো-আঁধারি রিয়াজের প্রতিটি গল্পে প্রবল। ফলত কথাবস্তুর উপজীব্য উপাত্তগুলো নানামুখি মাত্রায় যে সংবেদনশীল পরিস্থিতি নির্মাণ করে অর্থাৎ সৃষ্টি এবং নির্মাণ এ দুটির সম্মিলন সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ তাঁর শিল্পে ঘটান। পাশাপাশি অন্তর্জগতের অনুসন্ধান বিশ্লেষণি ভঙ্গিমায় করলেও অভিব্যক্তিতে স্পন্দিত রূপ নেয় সমসাময়িক বীক্ষণ। ফলে রিয়াজের শিল্পরূপে ধ্রুপদী কিংবা আধুনিকতার চেয়েও গুরুত্ব পায় উদ্বেলতা অথচ চরিত্র এবং ঘটনার প্রতি লেখকের শিথিল তাচ্ছিল্য। এ ক্ষেত্রে তাঁকে রুশ সাহিত্যের ভিন্ন ধারার লেখক নিকোলাই গোগলের সাথে তুলনা করা যেতে পারে । গোগল এবং রিয়াজ এক এবং অভিন্ন কয়েকটি সূত্রে। এক: গন্তব্য অনুসন্ধানে—তীক্ষ্ণ ডিটেলে যত্নশীল। ন্যারেশনে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ এক সূক্ষ্ম কৌতুক-আবহ বিস্তৃত হয়। মানুষ এবং প্রেক্ষিতকে কখনই বুর্জোয়া মানবতায় তাঁরা দেখেন না। দুই: এ দু'জন লেখকই ভিন্ন ভিন্ন রাজনৈতিক এবং ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে জন্মালেও তাঁরা সমাজের ওপরে বুদ্ধিভিত্তিক আঘাত করেছেন খুব প্রকটিত অর্থে—সেই অর্থে রিয়াজ উচ্চণ্ড বাঙালির দ্রোহ চৈতন্যই মূলত একাত্তরের যুদ্ধ। এই যুদ্ধ-পরবর্তী ত্রিশ বছর পার হয়ে গেলেও এ যুদ্ধকেন্দ্রিক বস্তুনিষ্ঠ, উন্নত শিল্পমানসম্মত এবং ভিন্নধর্মী উল্লেখযোগ্য রচনা লেখা হয়নি। বলাবাহুল্য, সৈয়দ রিয়াজুর রশীদের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক গ্রন্থ 'লাশ নাই'-এ উপরে উল্লেখিত চারটে গুণেরই প্রোজ্জ্বল ছায়া আমরা দেখি। একাত্তরে যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে তিনি ধর্ষণ এবং হত্যার রগরগে সারময়-সারসংক্ষেপ অনুসন্ধানে কথাশিল্পের উপজীব্য করেননি বরং তিনি এ যুদ্ধের ভেতরে যে অন্তর্গত যুদ্ধ চলে ব্যক্তিমানুষের — সে বিষয়গুলোকেই তিনি তাঁর লেখায় গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করেছেন। এমনি একটি কাহিনীই আমরা দেখতে পাই 'মারণ দাঁত' গল্পে। কেন্দ্রীয় চরিত্র একদিকে অক্ষম আস্ফালনরত, অন্যদিকে যুদ্ধে সংযুক্তি হওয়ার কাঙ্ক্ষা—অথচ মধ্যবিত্ত মানুষের ব্যর্থতা তার এই বিরামহীন বাগ্মিতায় আপনকার দুর্বলতাকে উন্মোচিত হতে দেয় না। এ চরিত্র সামষ্টিক, রিয়াজ এক্ষেত্রে একটি প্রতিনিধিমূলক চরিত্র তৈরি করতে সফল হয়েছেন।
দ্বিতীয় গল্প 'দীর্ঘজীবী হোক আবুল হুসেন'-এ যে বিষয়টি লক্ষণীয় – আবুল হুসেন বিরামহীন এক শ্রমের সঙ্গে যুক্ত। সে দর্জি। নতুন কিছু নির্মাণ করা এবং সমস্ত কিছুর ঐক্যই তো সেলাই-র কাজ। সে ঐক্য তার ভেতর কাজ করে। আবুল হুসেনের কর্ম এবং প্রবণতার যে সমন্বয় চিত্রিত হয় তা ব্যক্তিমানুষের শারীরিক ক্ষত নিরসনের প্রশ্ন থেকে মানচিত্র অংকনেও। তার পরিপার্শ্ব আর তার ব্যক্তিজীবনে চৈতন্য সমন্বয় এবং সমন্বয়হীনতার যে দ্বন্দ্ব—তার পেশা এই সেলাইকর্মের ভেতর প্রতীকী অর্থে চমৎকারভাবে ফুটে উঠেছে। পাশাপাশি তার কর্মবৈচিত্র্য তাকে ব্যক্তিমানুষের আত্মকেন্দ্রিক জায়গা থেকে যূথবদ্ধতার দিকে নিয়ে যায়। বোধ হয় সেজন্যই লেখক লেখাটির নামকরণ করেছেন 'দীর্ঘজীবী হোক আবুল হুসেন'। 'গল্পটি ভূতের নয়'—লেখাটিতে যুদ্ধের আতঙ্ক মানুষকে যে বিকৃত এবং বিকারগ্রস্ত চেতনায় ধাবিত করে এ গল্পটিই তার প্রমাণ। পাশাপাশি এই গল্পটিতে আরো প্রমাণিত হয় যুদ্ধের আকাঙ্ক্ষাটি সত্য হলেও কোথায় যেন এই প্রেক্ষিতটা চাপিয়ে দেওয়া। যে কারণেই গল্পে চরিত্রদ্বয় ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও দানা বেঁধে-ওঠা পরিস্থিতি না হওয়ায় স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে কোনো ভূমিকা রাখতে পারেনি যা মারাত্মকভাবে সত্য। যা রিয়াজের মতন একজন লেখকের কলম থেকেই আসা স্বাভাবিক। নামগল্প 'লাশ নাই'-এ একটি মৌলিক প্রশ্ন তুলেছেন সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ। হানাদার বাহিনীর কার্যক্রম সম্পর্কে ধার্মিক তালেব আলীর মনে নানাবিধ প্রশ্ন আসে। ধর্মের আবরণ নিয়ে পাক হানাদার বাহিনী এবং তাদের দোসররা নিরীহ শান্তিকামী মানুষের ওপর যে অত্যাচার করেছিল তা ধর্মপ্রাণ তালেব আলীর মনে প্রশ্ন এবং প্রশ্ন-পরবর্তী শংকায় রূপ নেয় এবং অবশেষে ধার্মিক তালেব আলী নিজেও মৃত লাশ হয়ে অজস্র লাশহীন লাশের অস্তিত্বকে শনাক্ত করে। 'লাশ নাই' গ্রন্থের চারটি গল্পের অভিব্যক্তির অভিনবত্ব আমাদেরকে মুগ্ধ করে ।
সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ। লাশ নাই (মুক্তিযুদ্ধের গল্প এ্যালবাম)। যুবকাল (লিটল ম্যাগাজিন অনিন্দ্য'র প্রকাশন)। প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি ১৯৯৯। গ্রহণদায় : ৭৫ টাকা। 'প্রতিশিল্প' ৫ম সংখ্যায় প্রকাশিত।
‘লাশ নাই’: রিয়াজুর রশীদের চারটি গল্প
সঞ্চয় প্রথম
সঞ্চয় প্রথম
মন্তব্য