কুত্তার শরীর বাঘের ছালে মুড়িয়ে সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ আমাদেরকে একটা চেনা পথে নিয়ে যেতে চাইছেন। পথটা যদিও চেনা, ঢঙটা যেনো কোন নতুন প্রতিবেশী বালিকার সুতীব্র আকর্ষণ। প্রথম দেখাতেই যার পেছন পেছন বাড়ির মূল ফটক অব্দি গিয়ে হঠাৎ থমকে দাঁড়ানো। না পারছি ফটক ভেদ করে অন্দরে প্রবেশ করতে, না পারছি হৃদয়াকাশ থেকে মুখচ্ছবিটা মুছে ফেলতে। এমনি বেহাল দশা আমার। গতকালকেই সৈয়দ রিয়াজুর রশীদের ‘বিস্তারিত অথবা বিস্মৃতি’ নামক উপন্যাসিকাটি পড়েছি। এটাই আমার সৈয়দ রশীদের প্রথম পাঠ। অনেকদিন বাদ সমকালীন (বাংলা) সাহিত্য দরবারের কেউ একজন আমাকে খোশ করতে পারছেন। কোন বিচারে এর মূল্য নির্ধারিত হবে জানা নেই। যে বিচারেই হোক সৈয়দ রশীদকে বুজুর্গ হিসেবে মেনে নিতো আপত্তি নেই। আমি উনার ফটক ভেদ করে অন্দরে ঢোকার অপেক্ষায় থাকলাম। জনান্তিকে বলে রাখি, অর্থাভাবে অনেক বুজুর্গের সাথেই আমার সাক্ষাৎ ঘটে না। এজন্য মামলা মোকদ্দমা করা না গেলেও অভিযোগনামা পেশ করতে তো মানা নেই।
অগ্রজ কবি দিপংকর মারডুকের মারফতে রশীদের বারান্দা পরখলর সুযোগ হয়েছে। এজন্য উনার সদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করি। শহীদুল জহিরের ‘জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা’র মত ‘বিস্তারিত অথবা বিস্মৃতি’তে সৈয়দ রশীদ জাদুবাস্তব বর্ণনার মধ্য দিয়ে চমকে দিয়েছেন। জাদুবাস্তব বর্ণনার জগতে হাবুডুবু খেতে খেতে যখন দেখি পারভেজ রহমান ওরফে মিস্টার রশীদ চাকরি ছেড়ে মুক্ত হাওয়া খেয়ে বেড়াচ্ছেন তখন পাঠকসুলভ মাজেজায় ঘটনার গভীরে যাওয়ার কোশেশ করি। পারভেজের কুত্তা যখন বাঘের ছাল পরে বাঘসুলভ হয়ে উঠতে থাকে, তখন আমরা আমাদের ঔপনিবেশিক সুরত দেখতে পাই। সৈয়দ রশীদ তখন আমাদের মহাত্মা ফ্রানৎস ফানোঁর ‘ব্লাক স্কীন হোয়াইট মাস্কে’র দুয়ারে নিয়ে যান। আমরা তখন বুঝতে পারি সৈয়দ রশীদ আমাদেরকে বিস্মৃতির অতলে ডুবাতে চান। আমরা রবীন্দ্রনাথের উত্তরাধিকার হিসেবে ডুবতে তখনই রাজি হয়ে যাই। সদ্য চাকরি ছেড়ে দেওয়া একজন বুদ্ধিজীবী কীভাবে হত্যার শিকার হন। এমনি এক চেনা গল্পে ভর দিয়ে উপন্যাসিকাটি দাঁড়িয়েছে। আশ্চর্যের বিষয়, সৈয়দ রশীদের গল্প বলার তেমন তাগিদ নেই। উনি মূলত অন্য কোথাও যেতে চাইছেন। তবে কি রশীদ ফানোঁর মুখোমুখি দাঁড় করানোর জন্যই এত ব্যস্ত! কী তাঁর অভিপ্রায়?
সৈয়দ রিয়াজুর রশীদের ঢঙটা একদম আলাদা। উনার গল্পের কুশীলবদের যতটা না গল্পে দেখা যায়, তারো বেশি গল্পের অদূরে। বিস্তারিত অথবা বিস্মৃতির প্লটটা একাত্তরের। একাত্তর বলতে চিরায়ত যেই ফ্রেম দাঁড় করানো হয়েছে, এখানে সেটা অনুপস্থিত। এখানে গল্পের নায়ক চাকরি ছেড়ে, কুত্তা কেনে, আবাসিকে যায়, মদ খায়। কেন জানি মনে হয় সৈয়দ রশীদ শুরুয়াতটা যেভাবে করেছিলেন, তার ধারাবাহিকতা রাখতে পারেননি। কোথায় জানি খেই হারিয়ে ফেলেছেন। তারপরও বলবো উপন্যাসিকাটি বাংলা সাহিত্যের নতুন সংযোজন। উনি আমাকে আশাহত করেননি। পারভেজের দুয়ারে যখন দু’জন অপরিচিত ঢোকে, তখনই আমরা টের পেতে থাকি গল্পটা আমাদের চিরচেনা পথে বেঁকে যাচ্ছে। চাকরি ছাড়ার পর মিলিটারিদের মিস্টার রশীদের ওপর সন্দেহ যেন পাকাপোক্ত হয়। এখানে আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ‘রেইনকোটে’র হালকা আবহ পাওয়া যাবে। ধ্যানী পাঠকমাত্রই এর মর্মার্থ বুঝবেন। আমার মত অধমের কালি খরচের দরকার নেই। সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ বুদ্ধিজীবী হত্যার মধ্য দিয়ে আমাদেরকে কোথাও কি থিতু করতে চাইছেন? হয়তো চাইছেন, হয়তো চাইছেন না।
বিস্তারিত অথবা বিস্মৃতি ও আমাদের ঔপনিবেশিক সুরত
রিদওয়ান নোমানী
রিদওয়ান নোমানী
মন্তব্য