ফুকো আসার আগে আমরা ভাবতেও পারিনি নি যে, যৌনতা একটি বয়ান— যা সৃষ্টির অন্যতম প্রেরণা। তিনি দেখালেন ভিক্টোরীয় আধিপত্যবাদ যৌনতাকে পরিবার, সমাজ, ধর্মীয় অনুশাসনের মধ্যে বন্দী করে রাখায় এক চিরন্তন বন্ধাদশার জন্ম হয়। এই আরোপিত পিউরিটানিজমের আধিপত্যের ফলেই মানুষের স্বাধীনতা বিসর্জিত হয়। তিনি এর কারণ অনুসন্ধান করেছেন এবং প্রশ্ন তুলেছেন— শরীর কি শুধুই যৌনতা নিবৃত্তির? ক্ষমতার কার্যকরী প্রকরণগুলো কি যৌনতা দমনে ব্যাপৃত? আসলে তিনি যৌনক্রিয়া ও যৌনতার মধ্যকার পার্থক্য নিরূপণ করতে চেয়েছেন। কথা সাহিত্যিক সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ তাঁর নবতম উপন্যাসের মধ্য দিয়ে ফুকোর জটিল চিন্তন বিশ্বে প্রবেশ করতে চেয়েছেন। তিনি দেখাতে চেয়েছেন যৌনতার দর্শনের মধ্যে নিহিত আধিপত্যবাদী রাজনীতি যা পুঁজিবাদী বিশ্বে আরও প্রকট— তা বিনির্মাণের মধ্য দিয়ে জ্ঞানতাত্ত্বিকতায় প্রবেশের দ্বার উন্মোচিত হতে পারে। এটাই তো প্রগতি। আমরা পাঠ করে চলি উপন্যাসের সেই অংশে— “প্রান্তরের রুক্ষতা ও নারীর সঙ্গে শেষ পর্যন্ত যৌনতার অবাধ যোগ রয়েছে। ভিক্টোরিয়ান যুগে যৌনতা পর্যবসিত হয়েছিল এক আনন্দহীন ক্রিয়াকলাপে। এই সময় যৌনতা সম্পর্কে এক পরিলক্ষিত হয় অসাধারণ নিস্তব্ধতা।” উপন্যাসের এখানে কবর থেকে যেন জেগে ওঠেন ফুকো। আর তিনি যেন বলতে চান— পৃথক বয়ান নির্মিতির দ্বারা তথাকথিত ঔচিত্য বোধের মূলে কুঠারাঘাত করা একজন ঔপন্যাসিকের সৃষ্টির প্রেরণা যেমন, দায়িত্বও তেমনই।
রশীদ সাহেবের উপন্যাস প্রবেশ করে ইতিহাস ও তত্ত্বের বিশ্বময় শাখা প্রশাখায়। আর সেখান থেকেই শুরু হয় ‘কুসুম কথা অমৃত’ উপন্যাসটির পাঠ— যা এক জটিল মনস্তাত্ত্বিক শিরা-উপশিরায় বিন্যস্ত। প্রতীকী এই উপন্যাসের সূচনা হয় তীব্র খরার প্রেক্ষিতে। যেখানে অনাবৃষ্টি ও দাবদাহে প্রকৃতি পুড়ছে। বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড পুড়ছে। ঠিক যেমনটা ভেবেছিলেন ঋত্বিক ঘটক। পৃথিবী যেন এসে দাঁড়িয়েছে এক অনিবার্য ধ্বংসের মুখে। মানুষের আকুল প্রার্থনা ঈশ্বরের কর্ণকুহরেও পৌঁছায় নি। এ যেন বৃষ্টিহীন ধূসর এক দেশের কথকতা। আজন্মা সর্বত্র— জমি থেকে যোনি পর্যন্ত। নিস্ফলা এক দেশ। যেখানে অনন্তকালের জন্য স্তব্ধ হয়ে আসে ঋতুস্রাব— “জরায়ুর মধ্যে শূন্যতা। শূন্যতার সঙ্গে খেলা করে বিষণ্ণতা।” যা নতুন প্রাণের ও সৃষ্টির সমস্ত সম্ভাবনাকেই বিনষ্ট করে। তবু পৃথিবী চলে আপন কক্ষপথে ও আপন গতিতে। সেখানে সবাই অপেক্ষায় থাকে বর্ষণ মুখরিত দিনের। বর্ষার জলে সিক্ত হয়ে ভ্রূণ জেগে উঠবে পুনর্বার। সৃষ্টির উন্মাদনায় প্লাবিত হবে জগৎ সংসার।
লেখকের কখনও বাৎস্যায়নের যুগে, কখনওবা সুদূর প্রাক ইতিহাস পর্বে অভিনিবেশের লক্ষ্যই হল— সৃষ্টির রহস্য ভেদ করা। তিনি লিখে যান প্রাগৈতিহাসিক যুগের আখ্যান। মানুষের আবির্ভাব থেকে সভ্যতার উন্মেষ তক্— দীর্ঘ যাত্রাপথ শেখায় অনেক কিছুই। উঠে আসে পৃথিবীর জন্ম কথাও— “আদিতে সূর্য ছিল না, না ছিলো কোনো নক্ষত্রমালা। চারদিকে আঁধার, শুধু পানি আর পানি চারদিকে তখন। চারদিক আঁকাবাঁকা জলময়। তারপর হঠাৎ রাত আলোকিত হলো একদিন চাঁদের আলোয়। সবদিক আলোকিত হলো ক্রমে। সূর্যের তাপে জল শুকোতে আরম্ভ করল। ডাঙা জেগে উঠল। পৃথিবীতে এল প্রথম মানুষ। মানুষটা থাকত একাএকা। এখানে ওখানে ঘন বনভূমি, অল্প দূরে তিরতিরে বয়ে যাওয়া নদী, উঁচু পাহাড়, পাহাড়ে অনেক গুহা, চারপাশে জলাভূমি, এসবের মধ্যে সেই একজন দীর্ঘদেহী মানুষ, ঘন কেশ মাথায়, পাথরের মতো শরীরের গড়ন নিয়ে একা একা, তার কথা বলার লোক নাই, সে শুধু তাকিয়ে দেখে, আশে পাশে প্রকৃতি ছাড়া নাই কোনো কিছু। সে আগুন জ্বালাতে জানে না। সে কাঁচা ফলমূল খেয়ে বাঁচে। তার ভালো লাগে না। মাঝে মাঝে শীত নামে। তার উষ্ণতা দরকার মনে হয়। কিন্তু সে আগুন দেখে নাই। পৃথিবীতে আগুন সৃষ্টি হয় নাই তখন। এতসব কষ্ট নিয়ে তার রাতদিন কাটতে থাকে। তার দেহে কোনো পোশাক নাই। সে কাপড় বুনতে জানে না, বানাতে জানে না পোশাক। একা মানুষটা ক্রমে ক্লান্ত হয়ে পড়ল। সব কিছুতেই যখন একবার অরুচি ধরে যায় তখন একটা না একটা সে কিছু পেয়ে যায় আবার নতুন করে এই তার টিকে থাকার জন্য।” অতঃপর একদিন অকস্মাৎ এক পুরুষের সঙ্গে এক নারীর সাক্ষাৎ হল। দুজন দুজনকে আলিঙ্গন করল। পাথরে পাথরে ঘর্ষণে যেমন একদিন আগুনের আবিষ্কার হয়েছিল, তেমনই নারী পুরুষের মিলনেও সৃষ্টি হল এক অন্য আগুনের। যে আগুন জন্ম দিল সভ্যতার। এখান থেকেই উপন্যাসের পাঠ শুরু হয় নানা গতিমুখে। গোষ্ঠীবদ্ধ বৈবাহিক সম্পর্কের পরিবর্তে কায়েম হল পরিবারের। ক্ষমতা খর্ব করা হল নারীর। আর জন্মাল যৌনতাকে কেন্দ্র করে মানুষের মধ্যে পাপ বোধের। এ ভাবেই বয়ে চলে সময়। শুরু হয় প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের বয়ান। এই অনিঃশেষ ও নিরবধি কাল ধরে চলা সভ্যতা ও সভ্যতার সংঘাত সৃষ্টি করে নতুন নতুন বয়ান।
ঔপন্যাসিক চিত্রায়িত করেন এক নতুন সম্ভাবনার। কৃষিপ্রধান বঙ্গদেশে বৃষ্টির প্রার্থনা— লোকায়ত জীবনের অঙ্গ। কৃষক অসীম আকাশের দিকে তাকিয়ে গেয়ে ওঠে—‘আল্লাহ মেঘ দে পানি দে ছায়া দে রে তুই আল্লাহ মেঘ দে/ আসমান হইল টুটা টুটা জমিন হইল ফাটা/ মেঘ রাজা ঘুমাইয়া রইছে মেঘ দিব তোর কেডা…’ উপন্যাসটির ছত্রে ছত্রে মনে পড়ে যায় এই গানের কলিগুলি। অতঃপর আমাদের প্রবেশ ঘটে প্রান্তীয় উত্তরবঙ্গে। যার সঙ্গে জড়িয়ে আছে আদিম প্রকৃতি ও মাটির ভাবনা। যে মাটিকে নিয়েই তো বেঁচে থাকা দস্তুর। অথচ সেই আদ্র মাটি শুষ্ক হয়ে এলে জীব জগৎ বিপন্ন হয়্যে পড়ে। বৃষ্টির জন্য ও সৃষ্টির জন্য মানুষ উপায়ান্তর না দেখে শুরু করে প্রকৃতির আরাধনা। কৃষি প্রধান এ’ অঞ্চলে প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের এই নির্ভরতা জন্মজন্মান্তরের। কাঁটাতারের এক পারে যা ‘হুদমদাও’, অন্য পারেই তা-ই ‘হুদুমা’। বৃষ্টির জন্য, সৃষ্টির জন্য উত্তরের নারীদের আকুল প্রার্থনা— “এই বাংলায় এক উত্তরের জনপদ। তথায় অমাবশ্যার রাত। বৃষ্টির দেবতা হুদুমাকে তুষ্ট করতে গান গেয়ে চলেছে একদল নারী। খরার সময় এখন। আজ অমাবস্যার এই রাতে কোনো পুরুষ ঘরের বাইরে নাই।” এভাবেই চলে বন্ধা কাটানোর লড়াই। এই তপস্যায় পুরুষের কোনও স্থান নেই। যদি তারা উপস্থিত থাকে ও প্রত্যক্ষ করে এই আরাধনা— তবে আর বৃষ্টি হবে না। এই লোক বিশ্বাস যেন প্রকৃতির সঙ্গে প্রাগৈতিহাসিক যুগে স্বাক্ষরিত কোনও এক চুক্তির শর্তাবলী। লেখক দেখাতে চাইলেন, বৃষ্টির সঙ্গে শুধু ফসল উৎপাদনের সম্পর্কই জড়িয়ে নেই, আছে মানব সৃষ্টির চিরন্তন সূত্রও। উত্তরের নারীদের সেই আকুল প্রার্থনা বৃথা যায় না। তুষ্ট হয় বৃষ্টির দেবতা। নেমে আসে অঝোরে বৃষ্টি। মানুষ পুনর্বার সমবেত হয় সৃষ্টির আদিম খেলায়।
এই খেলা সমাজের সব ট্যাবু বা রাষ্ট্রীয় ও ধর্মীয় নীতি নৈতিকতার উর্ধ্বে। যেখানে বয়স, সম্পর্ক সবই হয়ে যায় গৌণ। উপন্যাসের চরিত্রগুলোর প্রবেশ ঘটে ফ্রয়েডীয় মনোবিকলন জগতে। যেখানে মধ্যবয়সী নারীদেরও যৌন আসক্তি যে কত প্রকট হতে পারে, তা ফুটে ওঠে। ইডিপাস কমপ্লেক্সের মতোই যেন বিপরীত অবস্থানটিও। রক্তের সম্পর্কের জটিল আখ্যান উপন্যাসের অলি গলি দিয়ে প্রসারিত। যুবক পুত্র রবিন সম্পর্কে কুসুমের বান্ধবী মধ্যবয়সী পরীর অপকপট স্বীকারোক্তি, “তোর ছেলেটোর দিকে আমি মাঝে মাঝে একটা যুবতী নারীর চোখ দিয়ে দেখি। আমি বুঝতে পারি, আমারও একসক্রিশন হয়ে যাবে।” জন্মদাত্রীকে দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করতে হয় কত কিছু। হবে নাই বা কেন— রবিনের দিকে একরাশ মুগ্ধতায় যে কোনও নারীই তাকাতে বাধ্য। এমনকি— “কোনো কোনো দিন ক্লাশ থেকে ফিরে এসে মা-কে জড়িয়ে ধরে। পুরুষালি ছেলের শরীরটা তখন মায়ের কাছে অচেনা মনে হলেও এখন হঠাৎ করে সেই অনুভূতিটা তার শরীরের রোমকূপে ফিরে আসে আবার।” তবে কি সবই শরীরী খেলা? যৌনতায় আচ্ছাদিত? পড়ন্ত বেলায় কুসুমের শরীরে যেন অন্য স্রোত বয়ে চলে। সে-ও যেন হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়ে। “সিগ্রেট ঠোঁটে ছেলেকে তার বেশ ম্যানলি মনে হয়। একবারও মনে পড়ে না যে, এই ছেলের মা সে। বরং অন্য কোনো পুরুষ মনে হয়। সে দরোজার সামনে ছেলের পৌরুষদীপ্ত রূপ চোখের সামনে ভেসে উঠতে দেখে আরেকবার মুগ্ধ হয়, আকুল হয়; নিজের ছেলে বলে তার কাছে বিশ্বাস হয় না। তার যদি বয়স কম হতো, নিজের যদি ছেলে না হতো এই রবিন তবে সে নির্ঘাৎ এমন এক যুবকের ভালোবাসায় জড়িয়ে পড়ত এই অনুভব তার হয় জীবনের ৪৭টা বৎসর কেটে যাওয়ার পর, এই রাত্রিতে যখন চারিদিক নিস্তব্ধ, কোথাও কেউ নাই, বিকট কোনো শব্দ নাই এবং আছে শুধু এক পেলব মৃসণতা। নিজের ভেতরের শিহরণ এই মধ্যরাতে সে লুকাতে পারে না।” এভাবেই উপন্যাসের প্রবেশ ঘটে মনোবিকলনের জটিল জগতে। যেখানে ধ্বনিত হয়— “কুসুম তোমার মন নাই। কুসুমের মনটা যেন এক শরীর। সে নিজের শরীরটাকে বহুদিন পর আবিষ্কার করে। শরীর, মন, ইচ্ছা আর বাসনার যে জগৎ সেটা যে একেবারেই ব্য্যক্তিকেন্দ্রিক, তা ভাবতে ভাবতে সে স্বীকার করে নিতে বাধ্য যে, কামনা, অভিলাষ আর মিথুন ভাবনার প্রকাশও স্বাধীন হওয়া উচিৎ। যেখানে কাজ করে প্রবৃত্তি তাতে মন একেবারে পাশবিক। সৃষ্টির আগে থেকে মানুষের মনে কামনার আগুন জ্বলছে দাউ দাউ করে।” কোথাও যেন সময়ের পাকদন্ডী বেয়ে পৌঁছে যেতে হয় প্রস্তর যুগে। যখন সহস্র বছর ধরে পাথরে পাথরে ক্রমাগত ঘর্ষণ করে চলে মানুষ— আগুন জ্বালানোর জন্য। পাথরই হোক বা শরীর— সবেরই উদ্দেশ্য অগ্নি প্রজ্জ্বলন। এটাই হল সভ্যতা। অথবা সভ্যতার চালিকা শক্তি। কিন্তু সেখানেই থেমে থাকে না সবকিছু। এই জগৎ সংসার বড়ই বিচিত্র! অনেকটা বহমান নদীর বিচিত্র গতিধারার মতো। কোন দিক দিয়ে বয়ে যাবে কেউ নির্দিষ্ট করে বলতে পারে না। জন্মদাত্রীর যেমন পুত্রের প্রতি মুগ্ধতা জাগে, তেমনই পুত্রেরও। মায়ের কোলে মাথা রেখে এক পরম তৃপ্তি বোধ কাজ করে। উপন্যাসে চিত্রিত হয়— “রবিনের ভেতরটা একবারের জন্য হলেও কাঁপতে থাকল। কুসুম অনুভব করতে পারল যেন সেই কম্পনের মাত্রা। মা ও ছেলে কিছুক্ষণ উদাস হয়ে থাকল যেন। কুসুমের শাড়ির আঁচল বুক থেকে হালকা সরে গেছে। রবিন মায়ের খাঁজ কাটা কাঁধ মরাল গ্রীবা ও স্তনজ আভাষ চোখের সামনে দ্যুতিময় দেখতে পেল। তার মা অনিন্দ্য সুন্দরী। ওর এত সব সুন্দরী মেয়ে বন্ধুরাও মায়ের সামনে তুচ্ছ বলে মনে হলো তার। সে মাকে খুব খুব আদর করে দিল। নিজেকে তার একদম অচেনা মনে হলো। নিজেকে সে এইভাবে আবিষ্কার করে নাই কখনো।” এ-ও তো সেই ইডিপাস কমপ্লেক্সের চিরন্তন প্রকরণ!
লেখক এনেছেন দেশভাগ প্রসঙ্গও। সেই উত্তাল দিনগুলিতে সবকিছুই ওলটপালট হয়ে যায়। বঙ্গদেশের অনেকেই চাকরি সূত্রে বা অন্যান্য কাজে চলে যান পশ্চিম পাকিস্তানের লাহোর বা অন্যত্র। কুসুমের মা এখানে থাকলেও, বাবাকে চলে গিয়েছিলেন সুদূর লাহোরে। কুসুমের মা ও বাবার মধ্যে যেন চাপিয়ে দেওয়া হয় ‘র্যাডক্লিফ লাইন’। বিবাহ নারী-পুরুষকে কাছাকাছি নিয়ে আসে। দেশভাগের ফলে এ’ রকম বহু স্ত্রী থেকে গেল পূর্ব পাকিস্তানে, আর স্বামীরা জীবিকার স্বার্থে চলে গেল পশ্চিম পাকিস্তানে। এই ব্যবধান হয়ত স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে দূরত্ব তৈরিও করেছিল। যদিও কুসুমের মা-বাবার মধ্যে তা হয় নি। সে’ সময় যোগাযোগ রক্ষার একমাত্র মাধ্যম ছিল চিঠি। দেশভাগ ভালোবাসার সম্পর্কর মধ্যে ‘বার্লিন ওয়াল’ তুলতে চেয়েও পারে নি। উপন্যাসে এই আখ্যানের নতুনত্ব আছে। উঠে এসেছে লাহোর শহরের চালচিত্র। জনবিনিময়ের পর ভারত থেকে উদ্বাস্তুদের আগমনের ফলে সেখানেও দেখা দেয় তীব্র স্থানাভাব। বাসস্থানের অভাবও ছিল অত্যন্ত প্রকট। পড়তে পড়তে এখানে বড্ড বেশি করে সাদাত হোসেন মান্টোর অবিশ্বাস্য গল্পগুলোর কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল। লেখক তাকিয়েছেন ফেলে আসা ইতিহাসের দিকেও। সেখান থেকে দেশে প্রত্যাবর্তন। তারপর পেশাগত কারণে এক জেলা থেকে অন্য জেলায় বদলি। কুসুমের হাতে একদিন পড়ে যায় বাবা-মায়ের ভালোবাসার সেই পুরোনো মলিন চিঠিগুলো। সেগুলোকে সে আঁকড়ে ধরে। কুসুম খুঁজে চলে জীবনের সবুজতা। সে স্পষ্ট টের পায় বাবা মায়ের সেদিনের ভালোবাসার উষ্ণতা। পৃথিবীতে শুরু হয় আবার কৃষি কাজ। যেন সেই আপ্তবাক্য— “এমন মানব জমিন রইল পতিত আবাদ করলে ফলত সোনা।” অতঃপর আবাদও হয়। অঙ্কুরোগমের পর ভরে ওঠে সোনার ফসল। জগৎ যেন হয়ে ওঠে সৃষ্টির আনন্দে উদ্ভাসিত। আর বর্ষা শেষে আসে শরৎকালের অনিন্দ্য সৌন্দর্য্য। আকাশে পেজা তুলোর মতো ঘুরে বেড়ায় মেঘের দল। নদীর পাশে আপন আনন্দে দোল খায় কাশ ফুল। কুসুমের মধ্যে জেগে ওঠে দেবী সত্তা। সে-ও হয়ে ওঠে এক চিরন্তন নারী মূর্তি। যেন ধারণ করে এই পৃথিবী ও বিশ্ব সংসারকে।
সৈয়দ রিয়াজুর রশীদের ‘কুসুম কথা অমৃত’ উপন্যাসটি সভ্যতার নিগুঢ়ো সত্যের উদ্ভাসন। নৃতত্ত্ব, ইতিহাস, মনস্তত্ত্ব, ধর্ম, লোকায়ত জীবন, সঙ্গীত, যৌনতা— সবই মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে অন্তরঙ্গস্থে। ধ্বংসের মধ্য দিয়ে সৃষ্টির এই দীর্ঘ বহমানতায় দেহাশ্রয়ী বাস্তবতা প্রকটিত হয়েছে। লেখক সচেতন ভাবেই সভ্যতার জটিল অলিগলিতে প্রবেশের সৎ সাহস দেখিয়েছেন— যা হয়ত বিতর্কের জন্ম দিলেও দিতে পারে। তবু একজন সাহিত্যিককে তো প্রখর বাস্তবতার সামনে কখনও না কখনও এসে দাঁড়াতেই হয়। এতে হয়ত স্রষ্টা বা তাঁর সৃষ্টিকে মগ্ন হতে হয় সত্যানুসন্ধানের কঠিন স্তর ভেদ করতে। সেখানে অনিবার্য ভাবে জন্ম হতে পারে এক নিজস্ব বয়ান ও মতাদর্শের। এই আখ্যানের যাত্রাপথ এমনই— যেখানে মূল চরিত্র যেন নিজের সামনেই নিরাবরণ হয়ে দাঁড়ায় এবং বিনির্মাণের মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলে। তাই এই উপন্যাস হয়ে ওঠে সেই আদিম ধ্বংস ও সৃষ্টির দ্যোতক।
পাঠ প্রতিক্রিয়া: সৈয়দ রিয়াজুর রশীদের উপন্যাস ‘কুসুম কথা অমৃত’
ড. রাজর্ষি বিশ্বাস
ড. রাজর্ষি বিশ্বাস
চমৎকার পর্যবেক্ষণ। লেখককে সাধুবাদ জানাই
উত্তরমুছুনঅজস্র ধন্যবাদ
মুছুন