‘জ্যোৎস্নায় এক প্রাচীন নৌকা’ এই মায়াভরা উপন্যাসে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের নির্মম কাহিনী গাঁথা। গল্পকার সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ এ উপন্যাস রচনা করে বাংলা কথাসাহিত্যে যুগ যুগ বেঁচে থাকবেন । এটি একটি পাক সেনার পৈশাচিক নির্যাতনের উপন্যাস। বৃষ্টি থেকে জ্যোৎস্না, মানুষ, নদী পর্যন্ত, এবং ব্যক্তিবোধ সংসার থেকে মুক্তিযুদ্ধ আমল পর্যন্ত এ উপন্যাসের কাহিনি বিস্তৃত। জ্যোস্নায় এক প্রাচীন নৌকা উপন্যাস যেমন অনেক ঘটনা সংযুক্ত তেমনই অনেক চরিত্রও আছে। যেমন মালতী, ইমান আলি, দত্ত কবিরাজ, মৌলভী তমিজ উদ্দিন ইত্যাদি। এ সব চরিত্রের মধ্যে মালতী একটি অন্যতম কেন্দ্রীয় চরিত্র। চরিত্র নির্মাণে লেখক অসাধারণ দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। আমি তাঁর উজ্জ্বলতা অনুসন্ধান করি এভাবে-
“নদীর উপর ভাসতে ভাসতে চলতে চলতে নদী যেমন মানুষকে আপন করে নেয়, মানুষেরও তেমন আপন ভাবে সহযাত্রীদের।
পথের ক্লান্তি মুছে ফেলতে কিংবা নদীর কুলকুল শব্দের মুখরতায় তারাও চঞ্চল হয়ে পাশ্ববর্তী একই নৌকার যাত্রীদের সঙ্গে সঙ্গে টুকটাক করে কথা বলতে বলতে অজান্তে এই নদীবক্ষে ধরে গল্প বা বুনে দিতে থাকে গল্পবীজ।”
জ্যোৎস্নায় এক প্রাচীন নৌকা, উপন্যাসে কাহিনী এই বাংলা বারবার শৃঙ্খলিত হয়েছে বিদেশিদের অত্যাচার নিগড়ে। বিশেষ করে পাকিস্তানিদের বাংলার বৈভব বিনষ্ট করার চক্রান্ত হয়েছে। এর বিরুদ্ধে ঘটেছে জনবিক্ষোভ। উপন্যাসে মালতীর বাবা, মা এই বিক্ষোভ -বারুদের একটি কনার মতো কার্যকর ছিলেন। স্বাধীনতা- উত্তরকালে রচিত তাঁর এই উপন্যাস গ্রন্থে সেই বিক্ষুব্ধ সমকালে ধারণ করেছেন ঔপন্যাসিক সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ। এ ও দেশপ্রেমের আরেক মাত্রা, দেশের জন্য সবর্স্ব কলম প্রতিবাদ। পাক সেনাদের জোয়ারে যখন উঠেছিল উর্মি, সেই সফেন তরঙ্গ পর্যবেক্ষন করে তিনি লিখেছেন—
“জ্যোৎস্নার হাটে নদীবক্ষে জ্যোৎস্নার আবহে শকুনের কোন ডানা মাঝে মাঝে ঘাপটি মেরে থেকে আবার থাবা বসিয়ে অপসৃত হয় যেন মুহুর্মুহু। জ্যোৎস্নার গায়ে কি পঙ্কিলতার ছাপ দেখা মিলছে।
বীরের রক্তস্রোত আর মায়ের অশ্রুধারা মিশেছে নদীতে আর সেই জ্যোৎস্নার ঝিলমিল পানিতে জ্যোৎস্নার প্রলেপ মিলেমিশে গিয়ে অদ্ভুত এক এক তীব্রতা নদীর মাঝে, ঢেউয়ের দোলায়, সজল
স্তব্ধতায় মলিন মূর্তি। নয়নজলে সিক্ত জ্যোৎস্নার সঙ্গে মিলনমেলা।”
তাঁর ভাষা এইরকম- "অসংখ্যবার বাঁচবার কথা লেখা আছে মেয়েটির তালুর অক্ষরে" আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় হানাদার পাকিস্তানি সেনাদের আক্রমণে বিধ্বস্ত হয়েছিল রাজধানী ঢাকাসহ বাংলাদেশের প্রায় সকল নগর- শহর- গ্রাম। তখন, তখন নগর- শহরবাসীদের চলে যেতে হয়ে ছিল পাশের দেশে ভারত। সেই সময়ের একটি সার্থক চিত্র তুলে ধরেছেন নদী নৌকা উপমার মাধ্যমে উপন্যাসে। অথচ সময়কে ঘিরে বহমানতার কোথাও কোন বিরতি ঘটেনি। প্রতিকী ব্যাঞ্জনায় চলমানতার স্বাক্ষর লেখক রাখতে সমর্থ হয়েছেন তা উপন্যাস নির্মাণে দক্ষতার পরিচয় বহন করে। কিছু প্রতিছবি ফুটিয়ে তুলছেন এভাবে
"নদী অফুরান বয়ে চলে। নদীতে নৌকার একেক যাত্রা একেক ধরনের কথা উৎসারিত হয়। সেই কথা যাত্রীরা সঙ্গে করে নিয়ে চলে যেতে পারে। নদীর পানিতে কোনো কোনো কথা, কথার ভিতর কাহিনী, কাহিনীর ভিতর মানুষ, মানুষের ভিতর সুখদুঃখ, হাসিকান্না, ঠাট্টা মশকরা এবং এসবেরই যে প্রাণের স্ফূর্তি প্রকাশমান তা নদীর শরীরে জলছাপের মতো থেকে যায়।
নদী হয়তো সেই সব কথা কুলকুল করতে আওড়াতে থাকে অবিরাম।”
একটি নিখাত সত্য এমন স্পষ্টভাবে উচ্চারণ করেছেন, যে তা আমাদের মর্মমূলে আক্ষেপের শেল হয়ে প্রতীকারহীন প্রবল আঘাতে আছড়ে পড়ে নিরুপায় ঝংকার তোলে - যেন নিরব আকুতি
"কেউ কোনো কথা বলবেন না। শত্রু টের পেয়ে যাবে। শিশুরা কেঁদে উঠলে বুকের দুধ দিন। কান্না না থামলে শিশুদের গলা টিপে মেরে ফেলুন। নইলে কেউ বাঁচবে না শত্রু যদি জেনে যায় মানুষ বেঁচে আছে। মানুষ পালাচ্ছে।
কেউ কোনো কথা বলবেন না।
সবাই চুপ করে থাকুন। আল্লাহর নাম নিন। ভগবানের নাম নিন। হিন্দুদেরকে কেউ নাম জিজ্ঞাসা করলে বলবেন মমিন নইলে ছলিম নইলে কলিম নইলে মরিয়ম নইলে জয়তুন"।
যদিও উপন্যাসকে ওইভাবে সঙ্গায়িত করা যায় না, যে, যা দিয়ে নাকচ করা যায়। কিন্তু বোধের যে অপরিমিত জ্ঞান থাকে বা সুগঠনের মাত্রাজ্ঞান থাকে তার বিচার অনায়সে প্রকাশ পায় নিজস্ব উপলব্ধি থেকে। যা দিয়ে বোধকে কিউর করার বার্তা আমরা বিলক্ষণ পাই এবং টেনে ধরি আমাদের সমস্ত না হওয়াকে...
"গ্রামের লোকেরা আইস্যা বলল, তোমার বউ আর মাইয়ারে মিলিটারিরা আইস্যা ছিলছাপ্পর মাইরা গেল। তোমাদের আর এই গ্রামে থাকা ঠিক হইবো না। মিলিটারি লাগা মা আর মাইয়ারে নিয়া গেরাম ছাইড়্যা ভাগো। মিলিটারির চইল্যা আবার পর দত্তপাড়ার সেই কবিরাজরে খবর পাঠায় মালতীর দাদা।"
যুদ্ধের ভয়াবহতা শেষে এইসব দুঃখতাড়িত ব্যর্থ ম্লান দিনগুলো বাঙালির সামনে প্রশ্নের মতো মুখ থুবড়ে পড়েছিল। কথাকার সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ হৃদয়ের অসম্ভব- মালতী, মালতীর মা -বাবার না ঘুমানো –পাকসেনাদের দ্বারা অত্যাচারিতের কান্না বেরিয়ে এসেছিল শব্দের প্লাবনে। হৃদয় ছিল রীতিমতো হাত বন্দি। মালতীর বাবার সামনে তার স্ত্রী -কে বেয়নেটের খোঁচা– মাটিকে আঁকড়ে ধরে –মাটি দিতে যুদ্ধের সংঘাত আর অভিজ্ঞতা গুলো। কিছু যায়নি প্রাণ থেকে গ্রীস্ময়তা। এ যেন নোনাধরা সময়ের ভিতরে নিজেকে কষ্ট করে বলে দেয়া কিছু কথা –
"মাইয়া আমার কিছু না। হিন্দু হইলে একটা কথা ছিল। তবু কেন পাকসেনারা আমার এতটুকু মাইয়াটারে জোরজবরদস্তি করল। পাকসেনারাও তো মুসলমান। আমার মাইয়া তো কাফের না যে এই কাম করবে।
আমার কী হেই বয়স হইছে। মাইয়ার মায়ের কাছে শুনছি—মাস ছয়েক হইল মাসিক হইছে। সেই মাইয়ারে কি না ওরা জোর কইর্যা এতটুকু মাইয়ার সতীত্ব কাইড়্যা লইল। মাইয়ার সারা শরীর দিয়া কত রক্ত। ওরা যখন আমার মাইয়ারে ধরতে যায় আমি ঠিক ঠিকভাবে কলেমা পাঠ করতে করতে ওদের পায়ে চাইপ্যা ধরি। আমরা মুসলমান। মুসলমান হইয়া মুসলমানের ক্ষতি কইরেন না"।
ক্রমশ জটিল হয়ে উঠেছিল স্বদেশ চিত্র। যুদ্ধবাজ একাত্তর নয়, সবুজস্রোতের এই ধরণীর বিপক্ষেই যেন আগ্নেয়াস্ত্র মালতীর মা, বাবার মাথাগুলোকে সাপের ফনার মতো করে হিস্ হিস্ শব্দে ধ্বংসলীলায় অবতীর্ণ হয়েছিল। বাংলার সমষ্টিমানুষের তখন ক্ষিদে মেটেনি, কান্না মেটেনি এবং মেটেনি শোকাবহতা। সেই যুদ্ধমত্ত জীবনযাপন, হাহকার অভিজ্ঞতা কাটতে না কাটতে আবারও দেখা দিল গ্রামের মানুষের মুখ:ঘৃনা দ্বি-বিভক্ত সমাজের বসবাসের অস্তিত্ব সংকট। তাই লেখক বন্দি করেছেন একই সাথে ইতিহাস চেতনাময় প্রকৃতি প্রবণ নিজস্ব সত্তার নির্জনতা প্রকাশ…
"নারী হইতাছে শয়তানের ফাঁদ। এই জন্যই মেলেটারিরা আর মাইয়া পাইল না এইখানে আইস্যা বনি মুস্তালিক যুদ্ধের বন্দি মাইয়াগো যেমন অনেক দিন মাইয়া মানুষ ছাড়া থাকার পর সৈন্যরা ‘আজল’ কইর্যা জেনা করছিল এই রকম এইখানেও কাম সারলো।
মাইয়া মানুষের শরীর ঢাকার ব্যাপারে দুইটা নির্দেশ আছে। প্রথমটা হইল ‘ছতর’ আর একটা হইল হেজার। মাইয়াদের ‘ছতর’ হইল : দুই ঊরু, উভয় পায়ের গোছা, গিঁঠ, পাছা, যোনি পথ, পায়ুপথ, পেট আর পিঠ, বুক, মাথা, চুল, কান, ঘাড়, কাঁধ, কনুই, হাতের কব্জি এইসব কোনোটাই মা আর মেয়ে ঢাকা রাখতো না বইল্যাই কী অই গজব ইয়া মাবুদ'।
তথাপি কেবল মুক্তিযুদ্ধ নিয়েই নয়, চেতনার জায়গায় উপন্যাসের কাহিনি মূলতঃ এক ছিল। সেখানে কেবল যুদ্ধের ঘটনা ঘোরপাক খায়নি, আমাদের সমাজের মানসিক দুঃশ্চিন্তা যেমন তমিজউদদীন মাষ্টার, দত্ত কবিরাজের ইতিহাসও এসেছে ক্ষিপ্র দ্রোহের লাল আয়োজনে। কথার ভেতর, তুমুল বক্তব্যের ভেতর কিংবা আচরণের ভেতর ইতিহাস ছোঁয়া ছিল জ্যোৎস্না এক প্রাচীন নৌকার গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এ যেন আপন সত্তার তাগিদে নিজেকেই গল্পকার সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ পেছনে ফিরে দেখানো, যেন - দেখো - এই আমার উজ্জ্বল প্রবাহ, এই আমার সোনালি মুক্তি যুদ্ধের সংস্কৃতি। তাই ইতিহাস আছে এই উপন্যাস দর্শনের তক্কে তক্কে। সেই ইতিহাস বহনকারী এবং যুদ্ধপরবর্তী সময়ের নতুন প্রজন্ম যারা মুক্তির আগুনে নিজের সত্তাকে পুড়ে পুড়ে সজীবতা লালন করে ইতিহাস তুলে ধরে নদীর জ্যোৎস্না ঢেউয়ের মতো আনন্দবিলাপ। দেশে যখন সেনা অত্যাচারে মানুষ কুপোকাত তখন লেখক চলে গেছেন নিজস্ব কাহিনী পুরাণে - পাঠ করছি
“...মায়ের সামনে বাবার সামনে
কিশোরী মেয়ের ঊরযুগল ফাঁক করে
ধরলো ওরা।
মাঝখানে ওরা পুরুষাঙ্গ বিদ্ধ করে
একজনের পর একজন
ওয়াতানামের পবিত্র সৈন্যরা
তাদের বীর্য উপহার দিল।
পুরুষাঙ্গ নাচাতে নাচাতে গান গাইল
পাক সার জমিন সাদ বাদ”
উপর্যুক্ত বিষয়ের আলোচনা-পর্যালোচনার মাধ্যমে দেখা যায় যে, এ উপন্যাসের অন্যতম নারী চরিত্র হলো মালতী ও তার মা। এই চরিত্রে সব ধরনের ইতিবাচক ও মানবিক হেনস্তা, পাক সেনাদের কাছে আমরা দেখেছি। তবে একটি গুরুত্বপূর্ণ ইতিবাচক দিক হলো এ চরিত্রের সংগ্রামশীলতা ও নিরব প্রতিবাদী চেতনা। মালতী মিলিটারি কুটকৌশলে হেরে গেলেও নিজের আদর্শ ও নীতিবোধ থেকে সরে আসে নি। গ্রামে সবশেষে মানবতার কল্যাণে মালতী নিজেকে নিয়োজিত করে। সে অবশিষ্ট জীবনটুকু মানবকল্যাণে উৎসর্গ করে। এ রকম চরিত্র শুধু খ্যাতিমান সাহিত্যে নয়, সমগ্র বাংলা কথাসাহিত্যেই বিরল। উপন্যাসের প্রথম দিকে চরিত্র গুলো নিষ্প্রভ মনে হলেও শেষে এ চরিত্র চাঁদের মতো মিষ্টি আলো ছড়িয়েছে। সৈয়দ রিয়াজুর রশীদের অসাধারণ সৃষ্টি হলো "জ্যোৎস্নায় এক প্রাচীন নৌকা"। বইটি ২০১৫ সালে বেহুলা বাংলা প্রকাশ করেছে। তবুও বলা যায় ব্যক্তিগত বেদনার- সংবেদনশীলতার, সংগ্রামের প্রগাঢ়তম উপলদ্ধি "জ্যোৎস্না এক প্রাচীন নৌকা' প্রকৃতি মানুষ মাটি ঘেঁষা একটি উপন্যাস। যেখানে ব্যক্তি হৃদয়ের স্পর্শকাতর অনুভূতি ততোধিক আলোলায়িত হয়ে পাঠককে স্পর্শ করে। মুগ্ধ করে, ব্যথিত করে। টেনে নেয় মুক্তিযুদ্ধের আবহে প্রকৃতির কোলে।
সৈয়দ রিয়াজুর রশীদের “জ্যোৎস্নায় এক প্রাচীন নৌকা”: কথাসাহিত্যে ধ্রুব তপোনিধি
ওসমান গণি
ওসমান গণি
নতুন লেখক সম্পর্কে জানতে পেরে ভালো লাগছে। ধন্যবাদ বিন্দু
উত্তরমুছুন