জল কি মনের গন্ধ বোঝে? প্রাণের কথা ব্যাকুলতা শোনে? বোঝে? বোঝে অন্তর্দহনের কান্না? তবু কেন জলের কাছে মানুষ উপুড় করে দেয় মনের কলস? বীরের রক্তস্রোত আর বিরহের অশ্রুগাঁথা? কোন সে অতল ছলছল জল যে জল সকল কলুষতা তলিয়ে দিয়ে রুপোলী জ্যোৎস্নায় ঝিকমিকিয়ে ওঠে? কোন সে নদী? সন্ধ্যা না কীর্তিনাশা? সুরমা না শীতলক্ষ্যা? কুশিয়ারা না সুতিয়া? ধানসিঁড়ি না আড়িয়াল খাঁ?
সেই নদীর নামের হদিস আমাদেরকে দেন না সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ। শুধু সেই কালো নদীর জলে, যে জলে তখন জ্যোৎস্নার আলো খলবলিয়ে হাসছে সেই জলে ভাসিয়ে দেন এক প্রাচীন নৌকা, বেহুলার ভাসান দেন কিছু নিরব মানুষের, যে মানুষগুলোর অন্তরস্থ কান্না জ্যোৎস্নার হাসিকে ম্লান করে দিচ্ছে। কোথায় তাদের গন্তব্য? বেহুলা যেমন মৃত লখিন্দরের লাশ ভাসিয়ে নিয়ে দেবতার আরাধনা করে জীবন ফিরিয়ে এনেছিলো... এই প্রাচীন নৌকা, যে নৌকা মানুষের অনুভূতি বোঝে, যে নৌকায় অসৎ মানুষ চড়লে আচম্বিত ডুবে যায়, যে নৌকায় সাধু মানুষ চড়লে এগিয়ে চলে তরতর... সেই প্রাচীন নৌকা কি তবে এই নৌকারোহীদেরকে নিয়ে যাবে এমন কোনো এক অলৌকিক দরবারে যেখানে আরাধনা করলে মুছে যাবে কলঙ্ক- মালতীর আর তার মায়ের?
সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ আমাদেরকে সেই সুলুকেরও সন্ধান দেন না। শুধু ইঙ্গিতে দেখিয়ে দেন হোসেন মাস্টারকে, যার স্মৃতিতে রোমন্থন হয় পোল্যান্ড রাশিয়া যুদ্ধের সেই বন্দি সৈনিকের কথা, যার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো অসংখ্য ধর্ষিত নারী, যারা ছিঁড়ে খুঁড়ে নিয়েছিলো সেই ধর্ষক পুরুষের সব মাংস-দণ্ডকারণ্য।
বলছিলাম সৈয়দ রিয়াজুর রশীদের উপন্যাসিকা ‘জ্যোৎস্নায় এক প্রাচীন নৌকা’র কথা। জ্যোৎস্নাস্নাত নদীবক্ষে বয়ে চলা নৌকায় তিনি তুলে দেন যৌন-অক্ষম গ্রামের কৃষক ইমান আলীকে। স্ত্রী পাকিস্তানী সৈনিক কর্তৃক ধর্ষিতা হওয়ার কালে হাত পিছমোড়া করে বেঁধে রাখা হয়েছিলো যে স্বামী ইমান আলীকে আর সেই নিজের অক্ষম আর স্ত্রীর অসহায় অবস্থাতেও তিনি ঘৃণাভরে তাকিয়েছিলেন স্ত্রীর দিকে... ধর্ষণকাণ্ড সমাপনের পর যখন স্বর্গসুখ নিয়ে চলে গেলো পাকিস্তানী সৈনিকেরা, যখন দুই নারীর সম্ভ্রমের বিনিময়ে রক্ষা পেলো গ্রামের সমস্ত মানুষ, গবাদিপশু আর চাষবাস- তখন যে ইমান আলী ধর্ষিতা স্ত্রীর দিকে ফিরেও তাকায়নি! সেই স্ত্রীর পাশে তখন সহায় হয়েছিলো দত্ত কবিরাজ। ক্ষতস্থাতে হাতের পরশ বুলিয়ে দিয়েছিলো আর সেই পরশে নিস্তার পেয়েছিলো যাবতীয় কান্না, আর ঘুম পেয়েছিলো ইমান আলীর স্ত্রীর। কোনো এক অবারিত জ্যোৎস্নায় নদীবক্ষে অক্ষম অসহায় ইমান আলী আর তার ঘৃণিত স্ত্রী পাশাপাশি সওয়ার হয় সেই প্রাচীন নৌকায়। সঙ্গে তাদের সন্তান মালতী। যে মালতী মুসলমান পরিবারের পরিচয়েও হিন্দু নাম নিয়ে কৈশোর উত্তীর্ণ হয়। যে মালতীর জন্মদাতা ইমান আলী নাকি দত্ত কবিরাজ তা নিয়ে সংশয়ে পুরো গ্রাম। সেই মালতী যার শরীর বেড়ে উঠলেও মনে প্রাণে থেকে যায় বালিকাসম। যে তখনো জুঁই পারুলদের সঙ্গে খেলে আর ছড়া কাটে ‘আকাশ থেইক্যা নাইম্যা আসল প্লেন, সেই প্লেন থেকে নামল সুন্দর একটা মেম, নাম বলল সুচিত্রা সেন’। কোনোদিন মিলিটারি না দেখা যে মালতী মিলিটারি দেখার কৌতুহলে আক্রমনকারী সৈনিকদের লুকিয়ে দেখে খড়ের গাদার আড়াল থেকে, যে মালতী জানেই না মিলিটারি হাসে না কান্দে- সেই মালতীকে খুব ভালো করে সবকিছু দেখিয়ে দিলো মিলিটারিরা। মায়ের উন্মুক্ত বুকের ওপর শুইয়ে শুধুমাত্র জিপার খুলে ধর্ষণদণ্ড বের করে রজঃস্বলাহারা মা আর তার সদ্য যৌবনবতী কুমারী কন্যাকে একই মাটির পঙক্তিতে শুইয়ে বুনে দেয় পাকিস্তানী বীর্য! যে মালতী এখন আর মানুষ হয়ে রইতে চায় না, ‘বৃক্ষ বৃক্ষ করো! মা আমি বৃক্ষ হতে চাই!’ বলে বিলাপ করে নদীর কাছে। একই পরিস্থিতির শিকার যে মালতীর দিকে কথিত পিতা ইমান আলী তাকায় স্নেহমায়াভরা চোখে। আর সেই একই নৌকায় সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ দণ্ডায়মান করেন মৌলভী তমিজউদ্দিনকে। যে মৌলভী তমিজউদ্দিন হিন্দুনামধারী মালতীকে কোরআনের আয়াত পড়িয়েছে আর ঘৃণাভরে তাকিয়েছে বেলেহাজ এই মা মেয়ের দিকে। এখনো যার মনে হয় এই হায়া-লাজহীন নারী দুটোর উপযুক্ত শাস্তিই বুঝি হলো। আর মা মেয়ের এই পরিণতি যার মনে লুকিয়ে থাকা বিপ্লবের বীজে অঙ্কুরোদ্গম ঘটায় সেই হোসেন মাস্টার... যে মাস্টার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছে, যে হোসেন মাস্টার এখন গ্রামের প্রাইমারি স্কুলে বাংলা পড়ালেও উত্তাল মার্চে যে শহরে গিয়ে শরিক হয়েছে গণ-আন্দোলনে, সেই ভাষণ আর সেই পতাকা উত্তোলণের হয়েছে প্রত্যক্ষদর্শী, যে হোসেন মাস্টার গ্রামে ফেরার পথে কিনে এনেছে সবুজ জমিনে লাল সূর্য পটে সোনালী রঙে আঁকা বাংলাদেশ নামক একটা স্বাধীন রাষ্ট্রের মানচিত্র, যে হোসেন মাস্টার সেই গর্বিত পতাকা বুক পকেটে আগলে রাখে ভাঁজ করে, যে হোসেন মাস্টার যোগ দিতে চলে মুক্তিযুদ্ধে, যে যুদ্ধ একদিন বিজয় আনবে আর আকাশের সীমানা ছাড়িয়ে উড়বে এই পতাকা আর খুনে লুটেরা ধর্ষক পাকিস্তানী সামরিক বাহিনী এবং তাদের দোসর দালালদের শাস্তি হবে বলে স্বপ্ন দেখে আর সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নে নদী পারি দিয়ে চলে যুদ্ধের দেবালয়ে। আর সেই বৃদ্ধ মাঝি এই মানুষগুলোকে বয়ে নিয়ে চলেন নিজের নৌকায়, যে নৌকা কাঠের পয়দা হলেও মানুষের মতো যেন... কোন বৃক্ষের সেই কাঠ? যে বৃক্ষ হওয়ার আকুল বাসনা হৃদয়ে ধারণ করে মালতীর মতো সর্বহারারা?
সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ কিছু বলেন না, তিনি শুধু ভাসিয়ে নিয়ে চলেন পাঠককে। পাঠক ভাসতে ভাসতে শোনে একই ঘটনার হরেক বয়ান। ইমান আলীর বয়ানে আমরা শুনি একটি ধর্ষণের বিবরণ, একই ঘটনা ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি পায় ভুক্তভোগী মালতীর বয়ানে, ভিন্নতা পায় মায়ের বয়ানেও। একই ঘটনার ভিন্ন ভিন্ন বয়ানের এই তরিকা আমাদেরকে নিয়ে যায় জাপানী চলচ্চিত্রকার আকিরা কুরোশাওয়ার যুগান্তকারী চলচ্চিত্র ‘রাশোমন’ দেখার স্মৃতিতে। সেখানেও কাহিনীর মূলাংশে ছিলো এক ধর্ষণের ঘটনা। যে ঘটনা বিচারালয়ে বিচারকের সামনে চারজন সাক্ষী সাক্ষ্য দেন ভিন্ন ভিন্ন বয়ানে। সৈয়দ রিয়াজুর রশীদের গল্পের চরিত্রেরা কাউকে সাক্ষী দেন না, সরব হন না, একটি শব্দ বাক্যও উচ্চারিত হয় না কণ্ঠে, বিমূর নিমগ্ন নিরবতায় তিনি পাঠকের দরবারে হাজির করেন বয়ানগুলো। পাঠকই এখানে বিচারক। বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে বাংলার অজস্র মানুষ কি সত্যিই একদিন গাঢ় সবুজ হয়ে যেতে পারবে?
বাজারে এখন মুক্তিযুদ্ধের গল্প উপন্যাসের উপচে পড়া ভীড়। সে ভীড়ের দায় মেটাতে পোড়াকপালি যুদ্ধটাকে কখনো রূপকথা হয়ে উঠতে হয়েছে, কখনো আদার ন্যারেটিভের জোয়াল কাঁধে নিয়ে হতে হয়েছে ধর্ষণ বান্ধব। মুক্তিযুদ্ধই এখন চলচ্চিত্র, সাহিত্য প্রভৃতি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরষ্কার বাগানোর প্রধানতম মাধ্যম; জাতে ওঠার ক্রমাগত সিঁড়ি। সেই দুর্গম সিঁড়ি কান্তার মরু দুস্তর পারাপার হওয়ার জন্য তাই মুক্তিযুদ্ধটাকে যাচ্ছেতাইভাবে তাই বেচে দিতে হচ্ছে বিক্রয়ডটকমে। দিচ্ছেও হরদম। তাতে প্রবল যুদ্ধ আছে, ধর্ষণের মোচ্ছব আছে, যতোটা কদর্যতা সম্ভব নিঙড়ে ঢেলে দেওয়া আছে- শুধু যুদ্ধ আর তার ফলে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষগুলোর অন্তর্গত বেদনা আর তার উপলব্ধির কোনো হদিস নেই!
সৈয়দ রিয়াজুর রশীদের সুবিধে হলো এই বেচাবিক্রির দায়টা তাঁর কোনোকালেই ছিলো না। সোনার হরিণসম উচ্চপদস্থ সরকারি চাকুরিকে স্বেচ্ছায় নির্বাসনে পাঠিয়ে যিনি শুধু লেখাকে আশ্রয় করে বেঁচে থাকতে চান, সে লেখাও আবার কোনো কস্মিন কালেও প্রতিষ্ঠিত কোনো বাণিজ্যিক পত্রিকায় ছাপতে দিতেই রাজী হন না, জনপ্রিয় হওয়ার সবরকম সম্ভাবনা যিনি আঁতুরঘরে গলাটিপে হত্যা করে নিষ্পৃহভাবে বেঁচে থাকতে পারেন- সেই সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ যখন ‘জ্যোৎস্নায় এক প্রাচীন নৌকা’য় তুলে দেন ধর্ষিতা মালতী আর তার সহ-ধর্ষিতা মাকে... বেহুলার ভাসান দেন সর্বসহা নদীর জলে... নিরব কণ্ঠে তুলে ধরেন যার যার দৃষ্টিকোণ থেকে ধর্ষণের ইতিবৃত্ত... তখন তা এমন এক আখ্যান হয়ে ওঠে যা আমরা আগে কোনোকালে পাঠের সুযোগ পাইনি।
সমগ্রটা স্বাধীনতা আন্দোলন, উত্তাল মার্চ, অগ্নিঝরা ভাষণ আর রক্তঝরা ৭১ যিনি প্রত্যক্ষ করেন খোদ ঢাকা শহরে বসে অবাধ কৈশোরে... যাঁর পড়ালেখার একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ‘জেনোসাইড স্টাডিজ’... ৭৫ এর পর এই নিষিদ্ধ ভূমিখণ্ডে যে কিশোর প্রবল সাহসে প্রকাশ করেন জয় বাংলা স্লোগান সম্বলিত মুক্তিযুদ্ধের গল্প আর ধারাবাহিক জীবনী প্রকাশ করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের... (যেটুকু কীর্তি এখন একটুখানি প্রচার করলেই জীবনের অনেকটুকু স্বাচ্ছন্দ্য মুঠোয় পুড়ে নেওয়া যায় স্বপ্নের মতো, অথচ তিনি তা হেলায় অবহেলা করে ধন্য হন) সেই সৈয়দ রিয়াজুর রশীদের গল্পে যখন উঠে আসে মুক্তিযুদ্ধের আখ্যান- সেখানে কোনো কল্পনার আশ্রয়ের প্রয়োজন হয় না, প্রয়োজন হয় না কোনো ভনিতার! এগুলো ছাড়াই ‘জ্যোৎস্নায় এক প্রাচীন নৌকা’ হয়ে ওঠে মুক্তিযুদ্ধের এক মহান আখ্যান।
২০১৩ সালে প্রকাশিত যে আখ্যানে দুজন ধর্ষিতা নারী আর তা প্রত্যক্ষদর্শী পিতা কিংবা স্বামী আর যুদ্ধের দুই পক্ষের দুই সক্রিয়ের দৃষ্টিভঙ্গিতে আমরা সমস্ত যুদ্ধটা যেন পাই চোখের সামনে। দুজন নারী হয়ে ওঠেন ৯ মাসব্যাপী চলা পৃথিবীর অমানবিকতম এক যুদ্ধে সম্ভ্রম হারানো লাখ লাখ নারীর প্রতিনিধি। হাজার সাতেক শব্দের গভীরে সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ ফুটিয়ে তোলেন এক অমোঘ যুদ্ধের চিত্র। কারন তিনি জানেন- “লেখকের ঋণ রয়েছে স্বদেশের প্রতি-এখানকার অন্ন, জল, হাওয়া, মৃত্তিকা, সবুজের পোষকতায় সে লেখক হয়েছে; রয়েছে তার রক্তঋণ। রণ-রক্ত সফলতায় তাকে জেগে থাকতে হয়।” লেখক যে ঈশ্বরের প্রতিদ্বন্দ্বী! সত্যটাকে তো তাঁর নির্মাণ করতে হয়!
মালতী কিংবা তার মা কিংবা তার অক্ষম বাবা কিংবা একটা প্রাচীন নৌকা অথবা তার বৃদ্ধ মাঝি এবং এক মৌলভী আর প্রতিশোধোন্মুখ হোসেন মাস্টার যখন জ্যোৎস্নায় ভাসে নদীতে, তখন যদি সেটা মুক্তিযুদ্ধের আখ্যান হয়ে ওঠে
নজরুল সৈয়দ
নজরুল সৈয়দ
“লেখকের ঋণ রয়েছে স্বদেশের প্রতি-এখানকার অন্ন, জল, হাওয়া, মৃত্তিকা, সবুজের পোষকতায় সে লেখক হয়েছে; রয়েছে তার রক্তঋণ। রণ-রক্ত সফলতায় তাকে জেগে থাকতে হয়।” লেখক যে ঈশ্বরের প্রতিদ্বন্দ্বী! সত্যটাকে তো তাঁর নির্মাণ করতে হয়!
উত্তরমুছুনচমৎকার পর্যবেক্ষণ। লেখককে সাধুবাদ জানাই