দু'টি রচনা, 'জননীর জন্য গল্প এবং লেখকের হত্যাকান্ড', আর 'সোমেন যদি বেঁচে থাকত';প্রথমটি প্রবন্ধ এবং শেষেরটি গল্প। গ্রন্থের গ্রন্থনেই অভিনবত্ব। দু'টি রচনা নিয়েই একটি গ্রন্থ এবং সেটি দুই শ্রেণীর দু'টি রচনা নিয়ে।
গ্রন্থের প্রথমেই রয়েছে প্রবন্ধ –' জননীর জন্য গল্প এবং লেখকের হত্যাকান্ড', যা দিয়ে গ্রন্থের নামকরণও করা হয়েছে। দীর্ঘ প্রবন্ধ এবং এর মধ্যে উঠে এসেছে সাম্প্রতিক পৃথিবী, তার চালচিত্র, গল্পের জন্য এর বর্তমান অবস্থা ও অবস্থান, শিকড়হীন 'আঁতেল' গাল্পিক ও সমালোচকদের পশ্চিমমুখী দরদী চিন্তা (যা তাদের দেউলিয়াত্বেরই প্রকাশ মাত্র), সাহিত্যে টেকনোলজির প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া আর সেই সাথে উল্টো স্রোতের কিছু মানুষের অবিরাম সাহসী যাত্রা, গল্পের শৈশব, কৈশোর অতিক্রান্তের পর ভগ্নস্বাস্থ্য যৌবনে পদাপর্ণ, নন্দনতত্ত্ব প্রভৃতি বিষয় উঠে এসেছে আলোচ্য প্রবন্ধটিতে। সাহিত্য পাঠ আনন্দের ব্যাপার, পাঠক মাত্রই সাহিত্য পাঠে আনন্দ পেতে চান, পাঠক বলতে যাকে বুঝানো হয়–তিনি সাহিত্য পাঠ করে মনোরঞ্জন লাভ করতে চান না, কিন্তু বর্তমানে ছোটগল্প বা উপন্যাস অনেক ক্ষেত্রেই মনোরঞ্জনের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ফরমায়েসী লেখক এবং ব্যবসায়ী প্রকাশকের আবির্ভাব হয়েছে। এই ফরমায়েসী লেখকের ভীড়ে সৃজনশীল নবীন লেখকের চলার পথ পিচ্ছিল হয়ে পড়ছে।
গত শতকের তিরিশের দশকের কল্লোল গোষ্ঠীর লেখকেরা বাংলা সাহিত্যে একটি নতুন যুগের সৃষ্টি করেছিল। যাদের মাধ্যমে হয়েছিল একটি পালাবদল। সেই পালাবদলের প্রয়োজন অবশ্যম্ভাবী ছিল কিনা তা নিয়ে বিতর্ক এখনো রয়ে গেছে, তবে সেই কল্লোল গোষ্ঠীর মধ্যে যারা বিশেষ করে পঞ্চপান্ডব নামে পরিচিত, তারাই প্রথম সাড়ম্বরে পশ্চিমী বিভিন্ন ‘ইজম' সাহিত্যে অনুপ্রবেশ ঘটান এবং বলা যেতে পারে তারা সফলও হয়েছেন। পরবর্তীকালেও অনেকে এ ব্যাপারে সফল হয়েছেন। কিন্তু ঐ শুরু, তার পর প্রয়োজনে, অপ্রয়োজনে পশ্চিমমুখী ভাবনার অতলে ডুবে যেতে যেতে আমরা খেই হারিয়ে অনেক ক্ষেত্রেই সঙ সেজে বসে আছি আর অস্তিত্বহীন অবস্থায় আত্মতৃপ্তি লাভ করছি। 'হীরা ফেলে কাঁচ তুলে' নেয়াকেই আমরা সৌভাগ্যবান বলে মনে করছি। লেখকের সাথে সাথে পাঠক হিসেবে আমরাও বেদনাবোধ করি আমাদের সাম্প্রতিক এই অবস্থা দর্শনে। একটি কথা অবশ্যই মনে রাখা দরকার- ওস্তাদ জাকির হোসাইন যখন তবলা বাজান তখন তা হয়ে উঠে একটি মহৎ শিল্প, আর সেই একই তবলা যখন কোন বাঁদর বাজায় তখন তা শুধু কর্ণপীড়াদায়ক যন্ত্রণাই সৃষ্টি করবে। নিজেকে জাহির করার জন্য নয়, নিজেদের ঐশ্বর্য্য নিয়েই নিজেকে প্রকাশ করতে হবে। তা না হলে লেখক যেমন বলেন- “ইউরোপকে নকল করতে গিয়ে আমরা আটকা পড়েছি এক ভয়ঙ্কর ফাঁদে"। আমাদের আত্মসম্মানবোধের অভাবের কারণেই আমাদের এই অবস্থা। কথাগুলা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই।
গল্পের উপাদান, বিষয় ভাবনা, গল্পের বাক্প্রতিমা প্রভৃতির সাথে গল্পের ধারাবাহিক ইতিহাস সাবলিল অথচ সংযত ভঙ্গিতে চমৎকার ভাবে তুলে ধরা হয়েছে আলোচ্য প্রবন্ধটিতে। এক অর্থে বলা যায় 'জননীর জন্য গল্প এবং লেখকের হত্যাকান্ড 'প্রবন্ধটি একজন নবীন লেখকের পথ খুঁজে পাওয়ার নির্দেশনা।
গ্রন্থের দ্বিতীয় রচনা 'সোমেন যদি বেঁচে থাকত'। পূর্বোক্ত প্রবন্ধে গল্পের যে মেকানিজমের কথা বলা হয়েছে, এই মেকানিজমের আবহে লেখা আলোচ্য গল্পটি। ১৯৪২ সাল ৮ মার্চ প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীর হাতে নিহত তরুণ মানবতা কর্মী, সুজনশীল লেখক সোমেন চন্দ জীবনের তথাকথিত আলোকোজ্জ্বল পথকে অবহেলায় পাশ কাটিয়ে স্বেচ্ছায় তিনি বেছে নিয়েছিলেন অনিশ্চিত অথচ গৌরবময় এক জীবন ।
যিনি ছিলেন– না হিন্দু, না মুসলমান ;ছিলেন একজন মানুষ। এই সোমেন চন্দের ডায়রী এবং চিঠি পড়তে গিয়ে গল্পে গতিশীল চরিত্র খোকনের বারবার মনে হয় সোমেন যদি বেঁচে থাকত! আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে সোমেন চন্দও রালফ ফক্সের জীবনী পড়ে তার ডায়রীতে লিখেছিলেন- 'ফক্স সবচেয়ে গৌরবজনকভাবে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছে। কিন্তু যদি আরও কিছুকাল বেঁচে থাকত।'
খোকনের ভাবনায়, সোমেন বেঁচে থাকলে কি হত? গণমুখী সাহিত্যের কর্মী সোমেন, মানবমুক্তি যার অন্তর এবং বাহির সর্বাবস্থায় এবং সর্বক্ষেত্রে ছিল স্বপ্ন, তার স্বপ্নের সাথে মিলিয়ে নিতে পারত খোকন। খোকন যেন বাংলার প্রতিটি মুক্তি সংগ্রামে সোমেনের অস্তিত্ব অনুভব করে, কারণ সোমেন মানবমুক্তির এক সেনানী। লেখক যেমন বলেন- ' 'সোমেনের মৃত্যু নাই, আছে মানুষের মৃত্যু কেবল'।
পূর্বোক্ত প্রবন্ধ এবং সোমেন যদি বেঁচে থাকত গল্পে লেখকের আঙ্গিক গঠন বেশ অভিনব। প্রবন্ধটির মধ্যে রয়েছে একধরনের ছন্দময় গতিশীলতা এবং প্রচুর উদ্ধৃতি, তবে সেই উদ্ধৃতিজ্ঞানের গুরুভারে মাথা ভারী হয়ে যাওয়া উদ্ধৃতি নয়, বরং বিভিন্ন কবিতার সাবলিল উদ্ধৃতির চমৎকার সংযোজন, যা আমাদের চমৎকৃত করে। গল্পটিতেও রয়েছে একই রকম উদ্ধৃতি, সাথে সিনেমাটিক শিল্পিত ও আকর্ষণীয় কারুকাজ, গ্রন্থটি পড়তে গিয়ে নতুন একটি ব্যাপার মনে হয়েছে।
[চালচিত্র, ২০০৮]
সংযত বাণীভঙ্গি: স্পর্ধিত প্রকাশ
মতিয়ার রহমান
মতিয়ার রহমান
মন্তব্য