বিপরীত অহংকার আর সৃষ্টিশীল চেতনার মুক্তবুদ্ধিবৃত্তির চর্চা ও বিকাশ বর্তমান সাহিত্যে এক শক্তিশালী বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। হাজার বছরের বাংলা সাহিত্যে বিভিন্ন বাঁক অতিক্রান্ত করে বাংলা সাহিত্য সমৃদ্ধ ও ঋদ্ধ হয়েছে বিভিন্ন আঙ্গিকে। এতে কোথাও ভাষার উচ্চ কঠিনত্ব রূপায়নে দ্বান্দ্বিক প্রশ্নের অবতারণা সূচিত হয়েছে। ‘এখন সময় পাল্টে দিতে হবে কাহিনীগদ্যে এই যাবতীয় ছক সমগ্র। সমস্ত কিছু, এইসব, ছোটগল্প- উপন্যাস-রম্যরচনা বড়গল্প-ব্যক্তিগত রচনা-নিবন্ধ ইত্যাদি সীমানা প্রাচীর ভেঙে করে এই নির্দিষ্ট নিয়মাবলি মেনে যে নির্ধারিত আকাঙ্খা তৈরি করতে অভ্যস্ত হয়েছি সেই অহেতুক শিরোধার্য শিরোপা ফেলে দিয়ে নতুন একটা সংঘর্ষ আরম্ভ করতে হবে। বিবর্তনের প্রক্রিয়ায় কাহিনীগদ্য একুশ শতকে বিপ্লবী উত্তরাধিকার গ্রহণ করবে অথবা সজোরে অস্বীকার করে অগ্রসর হবে। ঐতিহ্য ভাঙতে যেমন ঐতিহ্যের পুনঃনির্মাণেও তেমন সাহসের দরকার। এবং এখন বড় জরুরি: সাহস এবং সাহস। মধ্যবর্তী কোন পরিস্থিতি নাই বা থাকবেনা'। মোটাদাগে এরই উত্তর খুঁজেছেন" তামাদি পাতা ও ভাষার আঙ্গিক "প্রবন্ধ-গ্রন্থে বিকল্প ধারার লেখক সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ। প্রবন্ধকার প্রকৃত ভাষার স্বরূপ উম্মোচনে এক ভাষার শৈল্পিক কাহিনী রচনা করেছেন, ভাষার প্রতিষ্ঠিত রূপ, উৎস সন্ধান করতে প্রবন্ধকার বাংলা সাহিত্যের তিনটি প্রাচীন পর্ব (৯৫০-১২০০ খ্রিঃ), মধ্য (১৩৫০-১২০০ খ্রিঃ) এবং আধুনিক (১৮০০) যুগের বিবৃত পর্বের আলোচনা করতে ভাষার বিভিন্ন Form কীভাবে কতোটুকু বদল হয়েছে তার সাত কাহন বিবৃত করেছেন। অনেক ক্ষেত্রে Discourse পদ্ধতিকে ছুঁয়ে আবার আর্ট ফর্ম ভেঙ্গে স্টোরি টাইপের রচনাকে ইঙ্গিত করেছেন। অপ্রাতিষ্ঠানিক চেতনাবোধ অতঃপর প্রতিষ্ঠান- অপ্রতিষ্ঠান দ্বন্দ্বের বিনির্মাণ করতে সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ আপোষহীন ভূমিকা অনস্বীকার্যভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তাঁর শিল্প ভাবনা কোনো বাজারী ভিত্তিহীন লেখার যাবতীয় ধরণ নয়। বরং বিষয়বস্তুর ঐক্য নির্মাণে তিনি ভাষাকে খুঁজেছেন দুই আধেয় বর্গে। লেখক সুবিমল মিশ্র কিংবা কমল কুমার মজুমদার শিল্প ভাবনা ভেঙে অনেকটাই ভাষার গতিপ্রকৃতি ও পারস্পরিক সংস্কৃতি গড়ে তোলেন। প্রবন্ধকার মূলতঃ আলোচনা করতে চেয়েছেন আধুনিক যুগ (১৮০০ খ্রিঃ) কিন্তু প্রচীন ও মধ্যযুগের অবতারণা অনেকটাই লেখার শৈল্পিক রূপকে ব্যাহত করেছে এবং আলোচনার পূর্ণাঙ্গতা হয়ে ওঠেনি। সেক্ষেত্রে তিনি শুধুমাত্র আধুনিক (১৮০০ খ্রিঃ) যুগকেই আলোচনার দিক হিসেবে বিবৃত করতে পারতেন। কিংবা তিনটি প্রবন্ধের লেখা হতে পারতো। তামাদি পাতা ও ভাষার আঙ্গিক কোন শ্রেণীর পাঠকের জন্য তা নির্ধারণ করা কঠিন এবং ভাষার আঙ্গিক বা ফর্ম শুধুমাত্র গদ্যের উপরেই আলোকিত হয়েছে। কবিতার কোনো দিক-কে ইঙ্গিত করেনি।
ঊনিশ শতকের শেষের দিকে ন্যাচারালিজম, এক্সপ্রেসনিজম, ইউরোপিয়ান রিয়েলিজম ও ফরমালিজম এর বিষয়মুখীতা প্রবন্ধকার অনেকটাই বিমূর্ত করেছেন। Stylistics বা বাহিরাঙ্গন বিষয় রীতিবিন্যাস, অন্তরঙ্গ শৈলী-প্রতিভাস রীতিকে গতিশীল ধারায় কতোটাই জরুরি তা প্রবন্ধকার সক্ষমভাবে তুলে ধরেননি। ভাষা ও কথাশিল্পের অন্তর-বাহির প্রভাববিস্তারকারী ক্ষমতায় যুগপৎভাবে অনেক বেশি আদৃত ও চর্চিত হচ্ছে। সেক্ষেত্রে তামাদি পাতা ও ভাষার আঙ্গিক সামগ্রিকভাবে ভাষার স্বরূপ, প্রকৃতি ও অর্জন অনেকটাই প্রাবন্ধিকের মননধর্মী বিশ্লেষণের বৈশিষ্ট্য বিশেষভাবে লক্ষ্যযোগ্য। ভাষার নন্দনরূপ বা কৃতিত্ব প্রবন্ধকার চমৎকারিত্বের ও নতুনত্বের রূপ দিয়েছেন এবং উপস্থাপিত যুক্তির পক্ষাবলম্বনে জ্ঞাত বিষয়সমূহ নতুন বিষয়বোধের সূচনা করেছেন। আমাদের বোধে ও বিশ্বাসে আধুনিকতার মিশ্র সংশয়ের ভেতর বাংলা সাহিত্যের আবর্তন লক্ষণীয়ভাবে উল্লেখযোগ্য। ভাষার বাঁক বদল নিয়ে নানা কথা, চিন্তা প্রবন্ধকার অঙ্গুলীমেয় মেধাবীচিত্তের পরিচয় বহন করেন। বাংলা ভাষার নিজস্বতা ও মৌলিক বিন্যাসে সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ ভাষার নানাবিধ অনুষঙ্গ চিত্রিত করেছেন সুনিপুনভাবে "তামাদি পাতা ও ভাষার আঙ্গিক "প্রবন্ধ গ্রন্থে। অনেকক্ষেত্রে বিষয়বস্তুর প্রক্ষেপণ ও সমকালীন সমাজ বাস্তবতাকে নন্দনতত্ত্বের মাপকাঠিতে প্রবন্ধকার অনেক গাল্পিক হয়েছেন। প্রবন্ধকার প্রবন্ধের পরতে পরতে ভাষার বাঁক ও আদ্যোপান্ত স্বরূপ চিনিয়ে দেন শিল্পের সুনিপুন হাতে। ছোটগল্পের বিষয় বিন্যাস প্রকরণরীতি তথা বিকল্প ধারার লেখক হিশেবে সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ এক শক্তিশালী আসন নির্মাণে সক্ষম হয়েছেন। ভাষার মূলধারার আধুনিক শাসন রূপ-লাবণ্য, প্রান্তীয়, লোক-লোকায়িত প্রভৃতি অভিধায় ভাষা সমৃদ্ধ হচ্ছে তার নিজস্ব চরিত্রে। প্রজন্ম পরম্পরায় ভাষার আঙ্গিকের বদলে হয়ে উঠেছে আরোও উচ্চতর। সৈয়দ রিয়াজুর রশীদের গল্পে চিত্রধর্মী ভাষার ব্যবহার কখনোই প্রাধান্য লাভ করেনি বরং চিত্রধর্মী কাব্যের গল্প-পরিবেশকে দৃশ্যমান করার চেয়ে চরিত্রের মনোজগতের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার বিশদ বিবরণ প্রদানে আগ্রহী হন। ভাষার শ্লেষ বা মান বাংলা পটভূমি চিত্রণে তিনি সচেতনতা অব্যাহত রেখেছেন। মূলতঃ প্রাবন্ধিক প্রতিশ্রুতিশীল জীবন জিজ্ঞাসার বিকল্প মূর্তমানস্বরূপ রচনা করেছেন। ‘বাংলাভাষায় গল্পের ফর্ম যে স্বকীয় আধুনিকতা স্পর্শ করতে পারলো না সেই সংকট জনপ্রিয় ও প্রথাবিরুদ্ধ সকল ধারায় সংকট হিসাবে বলতে দ্বিধা নেই। বাংলাভাষায় গল্প- কাহিনীর ইতিহাসে এমন কয়েকজন অংশগ্রহণ করেছেন যারা সকলে যে কোন ভাষার সাহিত্যের পক্ষেই গৌরবের কিন্তু তবু ঐতিহ্য নির্মিত হয় নাই কেবল ঐতিহ্য হওয়ার সম্ভাবনাপূর্ণ স্মারক দৃশ্যমান পাওয়া যায়। বাংলা গল্পে-কাহিনীতে সঞ্চারিত করা জরুরি লোকায়তের পৌরুষ, পুরাণ বা মিথভাষার লোকায়িত পেশী। আমাদের বাংলার প্রতি ক্রোশে ক্রোশে আলাদা খর চলিষ্ণুতা এবং ব্যাঙ্গশ্লেষ-রসিকতার শানে ধারালো করে তুলতে তৎপর গল্প কাহিনীর শরীর। সারা পৃথিবীর মধ্যে বাংলা একমাত্র ব-দ্বীপ--নদী যেখানে অভ্যন্তরে পাড় ঘেঁষে নদীর কিনারে অসংখ্য মানুষ বসবাস করে অথচ কিনা গল্পে কাহিনীতে নতুন আঙ্গিকে সৃজন হলো না সেই রচনা যেখানে বিবৃত হতে পারত কত নদীর জল কত রঙের মাটির ভাঙাগড়ায় মত্ত রয়েছে।' ছোটগল্পের পর্যায়ক্রমিক উত্তরণ ও বিকাশের ইতিহাস ইঙ্গিতময় এবং প্রাবন্ধিকের মননধর্মী বিশ্লেষণ-বৈশিষ্ট্য বিশেষভাবে লক্ষ্যযোগ্য। প্রাবন্ধিকের এই বিস্ময়কর প্রজ্ঞা, প্রতিজ্ঞা, প্রতিশ্রুতি কিংবা দায়বদ্ধতা তাঁর ভাষাচর্চার আদি ইতিহাস পাঠক মাত্রই তা গভীরভাবে উপলব্ধি করেন। ভাষার সঞ্চারিত রূপ এবং ভাষার আদি পাঠক এর উৎস সন্ধান করতে তাঁর প্রবন্ধ নতুন আঙ্গিকের অবতারণা করে। সমগ্রতা বিচারে সৈয়দ রিয়াজুর রশীদের ভাষার জন্ম ও বিকাশ প্রতিষ্ঠিত করার বা প্রতিষ্ঠিত করণের প্রচেষ্টার শৈল্পিক রূপায়নে এবং ভাষার ঐতিহ্য পুনঃনির্মাণে তামাদি পাতা ও ভাষার আঙ্গিক নিঃসন্দেহে বর্তমান সাহিত্যে অনবদ্য ভূমিকা রাখবে বলে সন্দেহ নেই।
[চালচিত্র, ২০০৯]
বর্তমান কালপর্ব বাংলা সাহিত্যের পুরাণ বা মিথভাষার লোকায়িত সন্ধানে
তামাদিপাতা ও ভাষার আঙ্গিক পাঠের সরল অনুভূতি
মাসুদ মুস্তাফিজ
তামাদিপাতা ও ভাষার আঙ্গিক পাঠের সরল অনুভূতি
মাসুদ মুস্তাফিজ
মন্তব্য