এইযে মানুষ-জন্মাচ্ছে-কত কি করছে-সময় ফুরালে মরছে-দুনিয়ার সাড়ে তিন হাত লম্বা মানুষ, মাঝখানে ফাঁড়া, এই মানুষ কিসে তৈরি হয়? মাটি দিয়ে? হবে হয় তো!
নাকি, ঠিক 'কুন' বলতেই গড়ে ওঠে বস্তু জগৎ। তাতেও অতৃপ্তি, দরকার হলো অন্য কিছু একটা, সেটা তবে মানুষ! ব্যস, মাটি ছেনে ছেঁচে গড়ে-পিটে তৈরি করা হলো এই মানুষ, দেহ খাঁচার অন্তরে ঠাঁই পেল আত্মা, আর আলোর জীবদের হুকুম করা হলো স্বীকার করে নিতে হবে শ্রেষ্ঠত্ব; ঢিপ ঢিপ করে অমান্য করে সেজদা দিল না কেবল শয়তান, বড় তেজী'--
মাটির তৈরি মানুষ মরলেও মাটিতে ঠাঁই, সাড়ে তিন হাত জায়গা বরাদ্দ, শরীর হেজে মজে ঐ মাটিতে মিশে যায় তারপর। মরার পরেও মাটি, মরার আগেও মাটি। মাটির জিনিস ভঙ্গুর হয়, মানুষ ভাঙ্গে না কেন, কে জানে? তো, মন বলে বস্তুটি কখনো ভাঙ্গনে পড়ে কি– মানুষ তার শরীর বটে কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে তার মনও। জবেদালিরও মনের ভেতর ভাঙ্গন শুরুর এক বেসামাল গভীর সূত্রপাত। মনের দুর্বলতা ভয়ানক, চিমটি চিমটি ধ্বস নেমে অনিবার্য চূড়ান্ত পতন। একেকবার মনে হয় নিজেকে অটল রাখতে হলে অবশ্যঞ্জাবী সত্য এই বুড়ির শ্বাসনালি কঠিন হাতে পিষ্ট করে কথা চলাচল, সেই সঙ্গে বাতাস আসা-যাওয়া রুদ্ধ করতে হবে দৃঢ় হাতে।
মরতে বসেছে বুড়ি, প্রাচীন বটের মতো বয়স, শরীর নিশ্চল, অশক্ত, নিত্য অবলীলায় মলমূত্র ক্ষুৎ-পিপাসা তাড়না অনুপস্থিত প্রায়, তবে অসহ্য রকমে কণ্ঠনালি নিঃসৃত ধ্বনিস্রোত; এক প্রকার ঘ্যানঘ্যান বহাল তবিয়তে বিদ্যমান। শরীরটা ধনুকের মতো বক্রমান, হাত-পা জঠরে ক্রমে প্রোথিত প্রায়, দৃষ্টিহীন চোখ হতে পানির ধারায় মিষ্টি-মিষ্টি স্বাদ–তাতেই পিঁপড়া সমবেত হয়, কাজ বৃদ্ধি পায় শুধু– পিঁপড়া সাফ সুতরা করবার। ক'দিন আগে পরিধেয় কাপড় পরিবর্তনকালে দিব্যি ডান হাতটা উল্টাদিকে মটকে গেল, মটাৎ করে হাঁড় ভাঙ্গার ক্ষীণ শব্দ ভিন্ন কোন রকম আর্ত চিৎকার হয় না, বর্তমানে হাতটা ঢুল ঢুল করতে করতে দোল খেতে পারে শুধু। কবে দেখা যাবে, বাহ্য ত্যাগের সময় পশ্চাৎ দিয়ে গুয়ের সংগে যাবতীয় নাড়ি ভুরি সব কৃমির মত কিংবা দড়ির মত হড়হড়িয়ে বেরিয়ে একাকার করে ফেলবে অকস্মাৎ। বুড়ির
অঢেল চুল ছিল এককালে, –মায়ের কাছে শোনা, সেই মা-র মৃত্যুও অনেক দিন আগে, – বাপের মা ঐ কেশবর্তী বুড়ির চুলটুল সব ক'টা প্রায় খসে গিয়ে ন্যাড়া চেহারা তবে কিনা গলার ঘরঘরে আওয়াজটা শ্রুত হয়, অস্পষ্ট টানা স্বর, স্বর নিক্ষেপ, কান পাতলে বোধগম্য হতে পারে; তবে কিনা একই কথা পুনরাবৃত্তির কারণে বুড়ির ঠোঁটের নিকটবর্তী কান স্থাপন না করলেও ঐ ঘরঘরঘর শব্দে নিহিতার্থ পরিষ্কার, জবেদালি-ই হচ্ছে একমাত্র যেন উপজীব্য বিষয়। বুড়ির বুঝি মরার আগে পচনের গন্ধ শুরু হয়েছে, যত মাহি শরীরের ওপরে ভনভন করে চলছে, তেমনি বুড়ির অবিলুপ্ত স্বরধ্বনি একতরফা ভ্যানভ্যান করে বাজতে থাকে অনবরত।
বুড়ি যে, অবশিষ্ট শেষ বিন্দু শক্তি জবেদালির পেছনে অকাতরে ব্যয় করে, তাকে লক্ষ্য হেনে বাক্য ক্ষরণ ঘটাচ্ছে সেটি টের পেতে বিলম্ব হয়েছিল, বুড়ির চেচাঁতে চেচাঁতে ক্ষয়প্রাপ্ত গলনালি হ'তে নিক্ষিপ্ত বিক্ষিপ্ত কথামালা সরাসরি কানে পৌঁছার পূর্বে বউ-মাগীর কান ঘুরে ঠোঁট-জিহ্বা-দাঁতে ঘষা খেয়ে তবেই জবেদালির শ্রবণ পর্দায় ঢুকুস ঢুকুস করে গুতা মেরে ছিল ঠিকঠাক। সেদিনের ঘটনাটি এমন ছিল যে, জবেদালি তিনদিনের জন্য এক কাজে শহরে গিয়ে দ্বিতীয় দিন রাত নাগাদ ফিরে এলো, হাতে ছিল ঠাণ্ডা হওয়া বিহারীর দোকানের কাবাব, –হাড্ডি ছাড়া দুই শিক কাবাব, বউকে তোয়াজ করার জন্য –আর কারো জন্য নয়। যে জন্য শহরে যাওয়া, তা ব্যর্থ; উপরন্তু ক্যান্টনমেন্টের অডিটরিয়ামে ছবি দেখা, সে জানতো–ওখানে নাকি বইয়ের ফাঁকে হঠাৎ হঠাৎ সাহেব মেমদের বিভিন্ন ভঙ্গিমার সংগম দেখায়, বিনা পয়সায়। জবেদালি সন্ধ্যাতে ছবি তো যেমন-তেমন ঐ সব কান্ড কারখানা ফ্রি মেরে দেখে এসেছে আর খুব টাটাচ্ছে নুনু সেই থেকে; সাহেব-মেমরা কেমন সুন্দর পরস্পরের লজ্জাস্থানে চুমু খায়, মুখ ঘষে–কীসব করে-টরে আর কুকুরের সম্ভোগ করে, আজব নিয়মে কেমন বাইরে মেমদের মুখে-বুকে সর্দির মত বীর্যপাত করে, জবেদালির শরীর গরম হয়ে মাথায় আগুনের তাপ জমা হয়ে খলবল করে চলে বেশুমার। বউকে পটাবার জন্য রূপার তৈরি গলার চেইন নিয়ে এসেছিল সে; যেমন দেখা তেমন করার খায়েশ জেগেছে তার। পাকিস্তানী আমলে রূপার যে পয়সা ছিল তা-ই গলিয়ে তৈরি করা হয়েছে এইসব গলায় পরার চেইন, শহরের দোকানদার গ্যারান্টি দিয়েছে একদম খাঁটি জিনিস। তো, জবেদালি রাতের গভীরে, বাইরে বৃষ্টি আর শেয়ালের ডাক, তন্মধ্যে কুপির ম্লান আলোয় বউয়ের গলায় কাঁপা হাতে চেইন পরিয়ে মহা উৎসাহে শরীরের বস্ত্র উন্মোচন করলো, খানিক পূর্বে কাবাব সাটিয়েছে দু'জনাই। জবেদালি দাঁতের ফাঁক হ'তে মাংশের আঁশ খুঁচিয়ে বের করতে করতে অতঃপর বউয়ের গোপন অংগ বরাবর মুখ ও জিহ্বা ধাবিত করতেই অনাস্বাদিত অভিজ্ঞতায় সিক্ত হয়ে গেল। ঝটপটিয়ে সিটকে উঠলো বউ, একটা রামধাক্কা মারলো কিন্তু সে মোটেও নিরস্ত না হয়ে স্তনবোঁটায় লিঙ্গমুন্ডু স্পর্শ করে, আরেকটু ওপরে বিস্মিত মুখ গহবরে ব্যস্ত হ'তেই একটা হিসহিস শব্দ শুনে মহা তাজ্জব হয়ে গেল একদম। আমেনা চিবিয়ে খেয়ে ফেলবে তাকে যেন। বউয়ের শরীরে হাত রেখে উদাহরণস্বরূপ, উদ্বুদ্ধ করার মত্ত অভিপ্রায়ে আগে দেখা সাহেব - মেমদের যৌন ক্রীড়ার গল্প শোনায়, কিন্তু এহেন ফিরিস্তি মোটেও সৃষ্টি করলো না কোন উৎসাহ বরং তীব্র ঘৃণা যেন লকলকিয়ে ওঠে যেমন ইটের ভাটায় পেট্রোল মবিলে ভেজা কাঠের গায়ে আগুন দিলে দপ্ করে লেগে ওঠে প্রচন্ড আগুন এক লহমায়, ঠিক তেমনি; ঘরের জ্বলন্ত কুপির আগুনও ম্লানতর মনে হয় সম্পূর্ণ। আমেনা, শরীরটা বস্ত্র দিয়ে আচ্ছাদিত করতে-করতে ফোঁস ফোঁস শব্দে যা আছে সব উপড়ে ফেলতে সক্রিয় হয়, 'লজ্জা নাই শরম ভরম নাই, আটকুরা।' অতঃপর বোমার মত বিস্ফোরিত, 'তুমি মাটি পুড়াও, মাটিতে আগুন দাও। তোমার মরণের ভয় নাই? পাপের ভয় নাই? -- মরার পর কবর তোমাকে নিবে না। শরীর মরার পর দেইখো আপনা আপনি পুইড়া কেমন কালা অঙ্গার হইয়া যাবে, তোমার দাদীর কথা কানে নাও নাই, শোন নাই: তার উপর আবার এই সব পাপ জমা করতাছো। সাহেব মেমমাগীদের খোদার ভয় আছে নাকি? তুমি ওদেরটা দেইখা এই সব কুকাম করো, ছি!থুক:তোমার পোলাপান হয় না কেন? – তুমি মাটি পুড়াও বইলাই হয় না, তোমার বংশ বাড়বে না, পোলাপান জন্ম নিবে না, তুমি শেষ হইবা —'
জবেদালি সম্পূর্ণত স্তব্ধ। উত্থিত লিংগ ততক্ষণে ঘাড় গুটিয়ে মরিচের মত এতটুকু আকার হয়ে ঝুলন্ত মূত্রথলির গায়ে এক পাশে কাত মেরে অসহায়। মরা মাছের মত চোখের দৃষ্টি জবেদালির, অস্ফুটে বলে, 'কি বললি –তুই কি বলিস?' গলনালির সুড়ঙ্গের ভেতর পাথরের টুকরার মত কি যেন একটা আটকানো, বাকস্ফূর্তি বাঁধাগ্রস্ত; পদসঞ্চালনে আঘাত হানতে ব্যর্থ হয়, পা গতিশীল হয় শুধু তাতে কি বাতাসে মৃদু কম্পন ওঠে?-পাশে স্থাপিত কুপির আগুন নড়ে শুধু।
"আমার গায়ে পা তুইলা লাভ নাই, আল্লায় তোমার উপর পা তুলবে বইলা রাখলাম,",উচ্চারণকালীন আমেনার গলার শিরা-উপশিরা ফুলে সাপের শরীরের মত দৃশ্যমান হয়।
'চুপ মাগী, একদম চুপ। কাঁচা খাইয়া ফেলবো, বইলা দিলাম', ফাঁপা কণ্ঠে বলে বটে জবেদালি, কিন্তু দাঁত-নখ নাই; তাতে আমেনা ভীত নয়, পুনরায় যোগ করে, "আমারে থামায়া লাভ নাই, দেখ না কি হয়, পাক সাফ হইয়া তৈয়ার হও।”
অতঃপর জবেদালি নিকটবর্তী কুপিটা আক্রমণ করে উল্টে দিতেই আলো নিভে গিয়ে ঘর ঞঅন্ধকার। উপুড় হয়ে, কাতর কণ্ঠে বলেছিল সে, 'আমেনা থাম, আমার যেন কেমন লাগে।'
অন্ধকারের ভেতর ভূতগ্রস্ত আতংকজনক কণ্ঠের অনর্গল শব্দের পর শব্দের আঘাত পরাক্রমশীল, -- 'কেমন লাগলে আর কি হবে, দাদীর কাছে একবারও গেছো, কি কয় সে শুনছো, মরণের ওয়াক্ত আসছে তোমার দাদীর, সে তোমারে মউতের কালে সাবধান করতাছে।'
‘দাদী?--কি কয় আবার বুড়ি?' জবেদালিকে, তার দাদীর আঁচল ফাঁস পড়িয়ে যেন ভয়াবহ আকর্ষণ করে অকস্মাৎ।
'ঐ তো, যা বলে তাই তো কইলাম। তুমি এইসব মাটি পুড়ানোর কাজ কারবার ছাড়। দোহাই লাগে।' ভীষণ এক আহাজারি শকুনের মত ঘুরপাক খায় অনতিবিলম্বে। 'বুড়ির জবান বন্ধ হয় নাই এখনও?' বিস্ময়ে জবেদালি হতবিহ্বল উচ্চারণ করে, 'আর মরবার কালেও বুড়ি আমাকে নিয়া পড়ছে ক্যান, এতদিন কামাই করা পয়সায় ভাত খাওনের সময় এইসব মনে পড়ে নাই? তখন তো টু ফু শব্দ করে নাই, মরণ ঘনাইছে আর তার বাদে খাওয়ার পাট চুকবে, তাই যত মতলব বাজি। কোন দিন এই বুড়ি আমার ভালোটা দেখবার পারে নাই। কয়দিন বাদে মরবে তা-ও যত পেটে–পেটে শয়তানি।' পুনরায় শ্বাস গ্রহণ করে নতুন উদ্যমে প্রশ্ন করে আবার ‘ঐ বুড়ি মরবে কবে?--তা ঐ, মাগী ঐ বুড়ি যে এইসব বলে টলে, কই আমিতো আগে শুনি নাই, তুইও তো আগে কখনো বলিসও নাই। নাকি বানাইয়া বানাইয়া মিছা কথা বলতাছিস?'
তৎক্ষণাৎ আমেনার পাল্টা বিধ্বংসী আঘাত- 'তুমি শুনবা কেমনে? তোমার শোনার সময় কই? তুমি আছো খালি সাহেব-মেমদের অংগ নিয়া, কি সব দেখ আর বাতাসে লাগাও।তোমার তো সময় নাই।' এবার জবেদালির ভরাডুবি ঘটলো।
কুপি নিঃসৃত তেলে যে অংশের মাটি সিক্ত, পা স্পর্শিত হয় সেখানে, কেরোসিনের গন্ধটি যেন কেমন। অনুরূপ পেট্রোল মবিলের এক প্রকার গন্ধ আছে নিজস্ব। এমন গন্ধ তীব্রভাবে নাকে লাগে ইটাখোলার ভাটায়, –অসংখ্য কাঠ খন্ড বিভিন্ন সারিতে তেলে ডুবিয়ে সজ্জিত করা হয়, ঐসব ভাটার মুখে অগ্নি প্রজ্জ্বলন মাত্রই ছড়ায় আগুন এবং প্রখর আঁচে খোপ খোপ ইটের পর ইট কাদার দলা হ'তে দুই-তিন দিন রোদের তাপে হালকা সিদ্ধ হওয়ার পরবর্তী এই দন্ডে দ্রুত কঠিন আকৃতি গ্রহণ করে, –আজিজার মহাজন বিগত বৎসরে নয় লাখ টাকা লাভবান হয়েছে বলে শোনা যায় লোকমুখে, অবশ্য সত্য-মিথ্যা অনির্ণেয়। তবে কিনা জবেদালির রেট নির্দিষ্ট, আগুন লাগিয়ে সে অর্জন করে কিছু টাকা মাত্র। নদীর কিনারাবর্তী যে সকল ইটাখোলা বিদ্যমান, সেই গুলিতে বৎসর ধরে স্রেফ আগুনের আয়োজন করেই তার যা উপার্জন। এমন ভূমিকার জন্য কেউ নাই, মূলতঃ সে একা, মাটি পুড়িয়ে পয়সা গ্রহণ করার জন্য লোকের বড় অভাব বিধায় শূন্য স্থান পূরণে উদ্যমী। এ কথা প্রচলিত যে, মাটি যে-ই আগুনে পোড়ায় বাঁচোয়া নাই তার, বড় কঠিন এই মাটির অভিশাপ; সন্তান জন্ম নেয় না, নতুবা জন্মের পর মরণ ঘটে, বিকলাঙ্গ জন্ম নিলেও নিতে পারে হয় তো –তবে সেই সন্তানও মরে যায়। গর্ভ শূন্য থাকে শুধু গর্ভ থলিতে বীজ ভেঙ্গে এক-আধা ইঞ্চি মাংশের কোয়া ক্রমঃ বর্ধমান নয় কদাচিৎ এই সংক্রান্ত তথ্য অজ্ঞাত নয়, তবে মনের প্রকোষ্ঠে প্রশ্রয় দিতে সম্পূর্ণ অ-রাজী সে।
পুরাতন কথা পুনরায় শ্রবণের পর বিষয়টিকে নিয়ে সেই মুহূর্তে –অন্ধকার ঘরে, জোরে দম নিতে নিতে, উলংগ শরীরে চক্রান্তমূলক কারবার হিসেবে দৃঢ়মূল ধারণাবদ্ধ হ'তে সুখবোধ প্রস্তুত করেছিলো বেশ।
প্রথমতঃ বউ মাগীটার গভীর চালাকির সম্ভাবনাটি ন্যস্ত হয় নির্বিধায়। উভয়ের দাম্পত্য আট-দশ বৎসর যাবৎ এবং বিবাহ পরবর্তী কালে বর্তমানের পেশাজীবী সে ছিল না, মাত্র দুই-চার বৎসর যাবৎ এই উপায়ে জীবিকা। বিয়ে পরবর্তী সন্তান জন্মদানের ব্যাপারে বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গির কারণে সংগমকালে সচেতন সাবধানতা গ্রহণ করে পরিবার পরিকল্পনা কর্মীদের নিকট হ'তে বড়ি-কনডম সংগ্রহের তৎপরতা বহাল ছিল। ফলে স্ত্রী সম্ভোগের সূত্রে সন্তান সম্ভাবনা ছিল অনুপস্থিত। নতুন বিবাহের উচ্ছ্বাস মিলিয়মান হ'লে সিকি-আধুলির ন্যায় কাচ্চা-বাচ্চার সম্ভাব্য অস্তিত্ব দুর্বিষহ অনুভূতি সৃষ্টি করলেও আমেনার গর্ভে সন্তান বীজ প্রদানে সচেষ্ট হয়; তৎকালে পেশা বদলও সম্পন্ন। কিন্তু, আমেনার গর্ভের বিশ্বাসঘাতকতা ক্ষমাহীন। আমেনা যেন ফলতঃ অক্ষমতার দায় জবেদালির ওপর আরোপ করতে ইচ্ছুক, তাই যত প্রকার চালাকি --- এই চিন্তাটি উৎসাহ সৃষ্টি করতে সক্ষম হয় বেশ, আসলে মাগী বন্ধ্যা।
বুড়ি দাদীর পক্ষে মৃত্যু দরোজায় পা রেখেও ভিন্ন ষড়যন্ত্রের আভাসও পরিলক্ষিত হয় তার। মৃত্যুকালেও কুচুটেপনা অসম্ভব নয়, বুড়ি বহুপূর্বে মা-কে জ্বালিয়েছে প্রচুর; মা-টা কবরে গেছে সেই কবে, বাপের কাশির রোগ স্থায়ী হয়েছে তৎপরবর্তী। বুড়ি তাকে, ছেলে ও বউকে সহ্য করতে অনিচ্ছুক ছিল যদিও ছেলের অন্ন ভিন্ন বিকল্প ছিল না কোন। পান হতে চুন খসলে পুরো পাড়া সুদ্ধো এক করে তবেই শান্তি পেত বুড়ি। মেয়ের ঘরের দিকে প্রাণের টান ছিল অকৃত্রিম; মেয়ের নাতিটা এলেই জবেদালির বরাদ্দ দুধ কর্তন হত, আরও ছিল ঈদে বকরিদে সালাম করার পর সেলামী হিসেবে নয়া পাঁচ টাকার নোট। জবেদালির জন্য এ সব প্রাপ্তি কচিৎ ঘটেছে কি না তা আজ বিস্মৃত। স্মৃতিতে উজ্জ্বল হয়ে আছে যে, মা যখন তাকে ভাত খাওয়াতো বুড়ি উজ্জ্বল চোখে তীব্রভাবে শুধু দৃষ্টিপাত করে যেত। জবেদালি স্বাস্থ্যময় ছিল শৈশবে অথচ বোবা নাতিটা ক্ষীণকায় বলে এটা যেন একটি অপরাধ ছিল বুড়ির দৃষ্টিতে। বুড়ির শুধু একই কথা, 'এতটুকু ছোড়া খায় এত, অরে বউ খাওয়া থামা, এত দুধ দিস না, হাগা হবে। খাওয়া থামা এবার। বাপকে ছোড়া দেখতেছি ফতুর বানাবে। কি পোলা জন্ম দিছিস তুই, খালি খায় আর হাগে।'
জবেদালির শৈশবে কাপড় নষ্ট করার অভ্যাসটা ছিল বেশ। একবার বুড়ি কি যেন কেন, তাকে কোলে নিতেই সচেষ্ট হয়ে গাদা খানেক মল স্ব-ইচ্ছায় নির্গত করতেই এক বিশ্রী অবস্থা, চিল চিৎকারে বাইরের লোক ঘরে এসে সমবেত প্রায়। ভাবতেই জবেদালির ভারী আরাম। সেই যে বুড়ি গভীর নিবিষ্টভাবে তার খাওয়া দেখে বাক্যবাণে জর্জরিত করতো মাকে, তো একদিন মা করলো কি, বুড়িকে এক চোট নিল, বানিয়ে বললো, 'আপনি যান তো, মা, জবেদ আমার খাইতে পারে না আপনি তাকাইয়া থাকলে, ও আপনাকে সরতে কয়, তাইলে সে খাইব।' অতঃপর বুড়ির চেহারা সুরত হয় দর্শনীয় বস্তু। ভয়াবহ আক্রোশে বিস্ফোরিত হয়ে বলেছিলো, 'কও, তোমার পোলা আমাকে দেইখা ঘেন্না করে। আমাকে দেইখা বমি আসে' -- নড়ে-চড়ে না বুড়ি, বরং তীব্র আকার ধারণ করে শাপ-শাপান্ত। জবেদালির তখন ভারী ফুর্তি, দিব্যি সে ছিপ্ ছিপ্ করে, বুড়ির দিকে তাক করে মুত্র ত্যাগ করলো; তাতে বুড়ি পশ্চাতে রাখা পিড়িটা হাতে নিয়ে মারতে উদ্যত হলেও নিরস্ত হয় মায়ের জন্য। বুড়ি সচরাচর সকল বিষয়ে জবেদালির কঠোর সমালোচক, অবশ্য প্রকাশ্যে ভালো মানুষির মুখোশটা উজ্জ্বল। জবেদালির মায়ের মৃত্যু, বিবাহ বিষয়ক সংবাদ, সন্তানহীনতা ইত্যাদি নানাবিধ প্রসঙ্গ জবেদালিকে কেন্দ্র করেই রঙ গন্ধরসসহ বিতরণ করার ব্যাপারে বুড়ির কুশলতা প্রশ্নাতীত। এমনতর, জবেদালির সিদ্ধান্তে, ডাইনী স্বভাবা বুড়ির পক্ষে মৃত্যুকালেও অহেতুক এক বিকট রকম বেড়াজাল বিস্তার করা অসম্ভব নয় বলে বদ্ধমূল ধারণাকে দোষ দেয়া যায় না। স্বাভাবিক নিয়মের অন্তর্গতই মনে হয় তার, মরণ ঘনালেও গুহ্য দ্বারে দণ্ড না পরিচালনা করলে শান্তি হবে কী ভাবে?-- বিষয়টি লঘু নয় মোটেও।
মনে আছে, পরদিনই ভাষ্য শ্রবণের অদম্য ইচ্ছাতে নিজেকে বুড়ির নিকটবর্তী টেনে নিয়ে যায় সে। তখন, সেই কালে বুড়ির হুশ ছিল টনটনে বেশ, খাওয়ার অনিয়ম হলেই তারস্বরে চিৎকার করায় পারঙ্গমতা ছিল অটুট। অকথ্য সব যুৎসই ভাবে সচল ছিল, ঘরে কেউ প্রবেশ করা মাত্র বুকের আঁচল সামলে নেয়ার প্রবণতা দেখা দিত, শুধু হাটা নড়া চড়ায় অচল অবস্থা বিদ্যমান, অবশ্য কন্ঠের তেজ তখনও অনস্বীকার্য। সকলেরই দৃঢ় ধারণা তখনই যে, বুড়ির মৃত্যু আসন্ন প্রায়। বুড়ির বয়স অগুণতি, ক্রমে মানুষ চিনতে ভুল হচ্ছে প্রায়ই; এই হয় তো জবেদালিকে চিনতে সক্ষম, তো ফের জবেদালির বাপ হিসেবে সনাক্ত করছে পরক্ষণেই। এবং শ্যামা গামা নামক দুইটি গরুর বিষয়ে হাল হকিকৎ জানতে উদগ্রীব হলো অকপটে। এরকম কোন গরু জবেদালি জন্মেও দেখে নাই, শুনেছে কেবল, দশ-বারো সের পরিমাণ হররোজ দুধ পাওয়া নিশ্চিত ছিল নাকি! বুড়ো বয়সে কোন আমলে যেন বেচে দেয়া হয়েছে সেই দুইটা গরু। রতন নামক এক মামার ব্যাপারেও সকলে লা জওয়াব। বাবার মুখে এই নামটি দ্রুত, জবেদারি জন্মের পূর্বে তো বটেই, তার বাপের বালক বয়সে এই বাড়িতে দাদাজানের তাগড়া বয়সকালে রতন নামে ব্যক্তিটির দুই/একবার আবির্ভাব ঘটে, সেই তিনি এখন কোথায় কে জানে? –মরে ভূত হওয়ারই সম্ভাবনা, কবরের নিশানাটা আবিষ্কারও হয়তোবা নিতান্ত দুষ্কর। সেই কবে, কোন সুদূর অতীতে দাদাজানের দ্বিতীয় স্ত্রী হিসেবে এই বাড়িতে আগমন, হয় তো দুই/একবার বাপের বাড়ি নাইওরে গিয়ে থাকতে পারে-ঐ পর্যন্তই, তারপর শুধুমাত্র সন্তান উৎপাদন-প্রতিপালন, সেবাশ্রম, রন্ধনে-- এইভাবে দিনরাত -উদযাপন, বহুদিন পর এমনই পরিস্থিতি যে, জন্ম ও কৈশোরের পিতৃ বাড়ির পরিচয়টুকু স্মৃতি হ'তে অপসৃত। তবুও যৎ- কিঞ্চিৎ স্মৃতিচ্ছবি স্পষ্ট করে বলেই একে-তাকে সওয়াল করে, বিভিন্ন গল্প রোমন্থন করে শোনায় যা আবোল তাবোল এক প্রকার উচ্চারণ বলেই বোধ হয় সকলের। দাদা দীর্ঘকাল আগে গতায়ু, জীবিত পিতার নিকট এই সকল মন্থিত ঘটনা অর্ধেক বোধগম্য হয় মাত্র। এই দশাগ্রস্ত বুড়ি নানা অভিব্যক্তির অন্তবর্তী ইনিয়ে বিনিয়ে কেঁদে কেটে চোখ ভাসিয়ে যা বিস্তারিত করতো সোজাসুজি জবেদালির ওপর তা বর্তায়, ভেতরে ঘষা লাগে, ক্ষত হয় তার।
জবেদালি, রাত পার করে পরদিন সকালে নিজ কানে শুনেছিল-- "মাটি পুড়াবি না রে মাটি পুড়াবি না, মাটিতে আগুন দিবি না –মরার পর মাটি কামড়াবে-- মরণ আসলে শরীর তোর পোড়া মাটির মত কয়লা হবে রে রে--' এই বলে খানিক গোঙ্গায়– চোখের পানি ফেলে, অতঃপর পারম্পর্যহীন স্বরধ্বনি: সব অতীতের কথা, কি যেন পুকুর টুকুর, মাছ-গাছ-টাছ-না, কি যেন, যত্তসব। জিহ্ববা জড়িয়ে খানিক ক্ষান্ত থেকে ফের শুরু, পুনরাবৃত্তি চলেই শুধু।
এই ধারাবাহিক নিত্য বুড়ির প্যাচাল শুনে শুনে জবেদালি ক্রমে তিতি বিরক্ত। বুড়ি নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছে অথচ গলা চালু, বিন বিন শব্দস্রোত শুনলে সে নিঃসন্দেহে বুঝতে পারে মমার্থ,মুখস্থ প্রায়, করোটিতে গেঁথে আছে একই কথা-' মাটি পুড়াবি না রে মাটি পুড়াবি না, মাটিতে আগুন দিবি না --- '
জবেদালি হররোজ নিদ্রা উত্থিত হয়ে শোনে, বাইরে গমন কি প্রত্যাবর্তনের পর শোনে, আহারের সময় শোনে, মল ও মূত্র ত্যাগকালীনও শোনে, বউকে মর্দন করতে করতেও শোনে; শোনার কোন বিরাম নাই –শুধু একমাত্র কথা, একই কথার ফুলঝুরি। অতিষ্ঠ প্রায় জবেদালি নিষ্কৃতি প্রত্যাশী। বুড়ির হাল সঙীন হ'তে হ'তে শুধু প্রাণের ধুক ধুকানিটা অবশিষ্ট, চোখ দৃষ্টিহীন, হাত-পা তো বটেই শরীরও প্রায় শুধুমাত্র কণ্ঠনালি ভুক্ত গুটলিটা ওঠা-পড়া করে –খাদ্য ও বাতাস চলাচলও বাধাাগ্রস্ত, মৃত্যু গন্ধে আগত মাছির বনবন শব্দের সমান্তরাল ক্রমাগত গোঙানিটা বলবৎ-যা জবেদালিকে অবিরাম বিদ্ধ করে চলে।
বুড়ির জান খুব শক্ত, মৃত্যুদূত শিয়রে দাঁড়িয়ে রয়েছে ঘর্মাক্ত কলেবর, তবু দম আদায় করতে ব্যর্থ; জাহিলা মরা বুঝি একেই বলা হয়!জবেদালি কায়মনোবাক্যে মরণ চায় বুড়ির। কিন্তু আশ্চর্য যে তার শত্রুর মুখে ছাই বিতরণ করে দিব্যি শ্বাস-প্রশ্বাস বহাল এবং হেগে মুতে সবকিছু সয়লাব করে রেখে চলেছে। মরণশয্যাতে এত রাশি রাশি খাদ্য উদরে প্রবেশ করছে কীভাবে? জবেদালি চমৎকৃত। না-কি, এমত যে মৃত্যু পূর্বে এই সময়ে পেটের অভ্যন্তরে যত গু স্তূপিকৃত ছিল, সেগুলো যেন আখেরীবারের মত গাদাগাদা নির্গত হচ্ছে, তাতেই যত গন্ধ মাদন।#
আমেনার-ও জান ওষ্ঠাগত, কাঁহাতক এক ঘাটের মরা বুড়ির জন্য আরাম বিসর্জন দিয়ে সেবা শুশ্রূষা করা সম্ভব! একদিন অতিষ্ঠ হয়ে বুড়ির মৃত্যু কামনায় সামিল হতেই জবেদালির রোষানলে কুপিত হয় সে। জবেদালিকে অনুসরণ করে স্ত্রীও মৃত্যু কামনায় সোচ্চার হবে তা কিছুতেই হতে পারে না বলে গ্রহণযোগ্য নয় যেন! আমেনার উদ্দেশ্যে সুতীব্র চিৎকারে সাবধান বাণী উচ্চারণ –অবিলম্বে করে সে; সেবা-যত্নে গাফিলতি বরদাস্ত করা হবে না,তেমন কিছু হলে আমেনার কপালে খারাবি লিখিত। আমেনাকে বুড়ির সেবা কর্মে নিয়োজিত
রেখেও মনের ভেতরে দ্রুত মৃত্যু কামনা প্রকটিত; এই বজ্জাত বুড়ির মৃত্যু আনন্দিত করবে জবেদালিকে।
দিন যায়, তবু বুড়ি মৃত্যুহীন; জবেদালির মনের ভেতর হাজারো তোলপাড়; মাটি পোড়ানোর কারণে হাজারো আপদ বিপদের কথা জানা শোনার পরেও যে মনোবল সুদৃঢ় ছিল, তাতে ক্রমান্বয়ে কেমন যেন শক্তির ঘাটতি দেখা দিতে শুরু করে, দুর্বলতা যেন মুখব্যদান করেই চলেছে ঘনঘন, সঘন মাত্রায়। এই বিষয়টির ঘনঘটা মুখ গহ্বরের সর্বোচ্চ বিস্তৃতি ঘটিয়ে গিলে ফেলে সেই সময়ে, যখন কি-না আতিয়ার মহাজনের নিকট হ'তে বায়নার টাকাসহ লোক আসলো বাড়িতে।
সকাল-সকাল জবেদালি এক সানকি পান্তা– কাঁচামরিচের ঝাল দিয়ে পেটে জমা করে বেদম গরমের মধ্যে ঘর্মাক্ত অবস্থায় উদোম শরীরে লুঙ্গির গিঁট আলগা রেখে হাওয়া সংগ্রহ করছে। তখনই চুলোর পাড় হতে আমেনার আগমন ও সংবাদ পরিবেশন যে, মহাজনের লোক এসে ডাকছে! শোনার সঙ্গেই বুকের ভেতর ঢাকের মত শব্দ, তবু নিজেকে স্থির রেখে বললো বটে, ‘আসতাছি তুই দাঁড়াইতে ক লোকটারে'...কিন্তু আমেনা চলে যাওয়ার পর নিশ্চল বসে রইলো সে। শরীর যেন নড়াচড়ায় গররাজি, তবু দাঁড়ায়, কষে লুঙ্গির গিট বাঁধে –শরীরে জড়িয়ে দেয় ডুরে গামছা, পা চালায়;দুই পা বেজায় ভারী মনে হয়, তবু গিয়ে মহাজনের লোকের সামনে দাঁড়ায় —-আর কেউ না লোকটি মহাজনের ছেলে। ঘরের ভেতর বসবার বন্দোবস্ত নাই, বাইরে গাছের নিচে দাঁড়িয়ে প্রচন্ড ঘর্মাক্ত, কপালে প্রগাঢ় বিরক্তির কুঞ্চন, কিন্তু জবেদালিকে দেখে নরম স্বর- 'এই নাও, ধরো টাকা, বাবা পাঠাইছে এইবার তোমার কথা মত দুইশ টাকা বেশিই দিলাম, খুশী তো!'
জবেদালির দৃষ্টি ফ্যালফ্যালে, মাথা শূন্য, কিছুই যেন বোধগম্য হয় না, কী নিয়ে এই আলাপ! মাথা ঝাঁকুনি দিয়ে ক্ষীণ কণ্ঠে– 'কি হইছে?'
মহাজনের ছেলে রকম সকম দেখে ভ্যাবাচ্যাকা; জিজ্ঞাসা– 'কি ব্যাপার? তোমার শরীর খারাপ….'
'না, এই মানে ---- যাকগে কি বলতেছেন', জবেদালি দ্রুত ধাতস্থ।
'এতক্ষণ যা বললাম, কানের ছ্যাদা দিয়া যায় নাই?' বিরক্তি প্রকাশ; মহাজনের ছেলের মেজাজ আছে বই কি!
জবেদালি ভ্যাল ভ্যাল করে হাসে তখন। কপালে ঘাম পাঞ্জাবীর তলা দিয়ে সাফ করে মহাজনের পোলার ফের উচ্চারণ- 'নাও টাকা রাখো, গুইনা দেখ, কবে কামে যাইবা বল এইবার, আমার তাড়া আছে।'
'আপনিই কন কবে কামে যামু --- তা আপনি এখনই যাইবেন কি, একটু জিরান দেন,
এতদূর থেইকা আসছেন, গরীবের সংগে চাট্টে খান, গুড়ের শরবত দিতে বলি?' জবেদালি অতিরিক্ত বাক বিস্তার করে অনাবশ্যক। 'না না এই সবের দরকার নাই, কবে আসতাছো তাই বল, আমার সময় কম', কব্জি উল্টে সময় দেখে ব্যস্ততা প্রকাশ।
জবেদালির মনের ভেতর ক্রমাগত উত্থাল পাথাল, বিকট অস্বস্তি বোধ, বধির যেন সে, –তবুও অনুভূত হয় বুড়ি দাদীটার ক্ষীণ কণ্ঠে ধারাবাহিক ঘরঘর শব্দ, এই আওয়াজের মধ্যে অনবরত সাবধানতার সংকেত প্রকাশ, যেন—' মাটি পুড়াবি না রে মাটি পুড়াবি না, মাটিতে আগুন দিবি না' বলে আকুতি; বাড়ির গাছের মগডালে যেন এক অমঙ্গলের কাক দাড়িয়ে, বিরামহীন কা-কা-কা করে অশুভ ও বিপদের আভাস দিচ্ছে; জবেদালি, মনের ভেতরে, দু'হাত নেড়ে হুশহুশ করে হারামী কাকটাকে ভাগাতে চায়, বুড়ির কণ্ঠনালি দুহাতে পিষে স্তব্ধ করতে সক্ষম হলে আত্মরক্ষা হত।
মহাজনের ব্যাটা মাস দুয়েক পূর্বে বিয়ে করেছে, বিয়েতে বিস্তর লোকের ভোজ-আলু-মাংশের ঘ্যাট দিয়ে ডালডা মাখা ভাত; বউটা, শোনা কথা,-- কাক কালো অসুন্দরী এবং এই বাবদ শ্বশুর বাড়ির তরফ হতে প্রাপ্তিযোগ নগদ ও জমকালো। সে, সোনা রং ঘড়ি পরা হাত দিয়ে টাকাগুলো জোর করে এবার গুজে দিল জবেদালির শূন্য হাতে এবং পুনরায় জিজ্ঞাসা- 'কবে আসবা তাতো বললা না, বল তাড়াতাড়ি, শুইনা যাই বাবাকে বলতে হইবো, আর যদি টাকা চাও, না হয় কিছু দেওন যাইব, তা তুমি আগে আইবা তার বাদে না হইব। বল, কবে যাইতাছো?'
বাড়ির কুকুরটা শ্রবণেন্দ্রীয় খাড়া করে উভয়ের কথোপকথনে মনোযোগী শ্রোতা ছিল এতক্ষণ এবং মাটিতে ক্রমাগত নাক ঘষা; হঠাৎ-ই অচিন লোকটার শরীরের ঘ্রাণ নিতে মুখ দিয়ে স্পর্শ করা মাত্র মহাজনের ছেলে পা তুলে লাথি বাগাতেই দূরে সরলো এবং দুঃখিত ও মর্মাহত দৃষ্টিতে দু'জনার প্রতি লক্ষ্য করতে করতে যেন উদাস।
জবেদালির পরাস্ত কন্ঠের ক্ষীণ স্বর আসে- 'দুই-তিন দিন পর দেখি যাবো--- মহাজনৱে বলবেন' এবং শোনার পর 'আচ্ছা যাই --- তুমি চইলা আইসো তাড়াতাড়ি --।' বলেই দ্রুত নিষ্ক্রান্ত হয় মহাজনের ছেলে; হনহন পা চলে আর পেছনে মধ্যে মধ্যে দেখে নেয় জবেদালিকে– একটা বিস্ময়ভাব বেশ। জবেদালি দেখে কুকুরটি সঙ্গী হয়েছে মহাজনের ছেলের, নাহ লাথি খেয়েই তবে ফিরবে--চুক চুক চুক ---
ঘরের মুখে আমেনার মুখোমুখি, ফের প্রশ্ন- 'কিছু হইছে নাকি তোমার, কেমন যেন লাগতাছে–শরীর খারাপ?' জবেদালিকে টালমাটাল দেখে তার ভারী সন্দেহ।
'শ-রী-র',দম ছেড়ে বলে, 'বুঝতে পারতেছি না' এবং দ্রুত আমেনার উৎকণ্ঠাকে পাশ কেটে নিজ ঘরে, চৌকির চ্যাপ্টা তক্তপোষে পশ্চাৎ স্থাপন করেও ইতঃস্ততা দূর হয় না; মুঠির মধ্যে ধরা টাকাগুলো দু'চোখে দেখে খানিকক্ষণ, নাকের সুড়ঙ্গ দিয়ে হড়হড় করে গন্ধ নেয়--কেমন একটা চিমসে গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে, মাথার কোষে, --মগজে---ফুসফুসে; গণনায় সচেষ্ট হয়– বারংবার ভুল হয এবং ফের আঙুল নেড়ে গণনা, বিফলতায় নানা রঙা কমলা-সবুজ-বেগুনী নোটগুলো ভাগ করে পৃথক ভাবে বিন্যস্ত করে, কেমন যেন মনে হয় যে একটি নোটের সঙ্গে অন্যটি ভয়ানক সংযুক্ত ফলে ঘষে ঘষে থুথুময় আঙুল প্রায় ক্ষয়িত-- অশেষ পরিশ্রমে যেন ক্লান্তি নামে। সব টাকা একত্রিত করে বালিশের তলায় রাখতে গিয়েও মত পাল্টায়, চৌকির নিচে রক্ষিত ফুল-লতা-পাতাখচিত, বহু পুরাতন, বিয়ের ট্রাংকখানা টেনে বের করে আনে, এই ট্রাংকেই মূলতঃ সংরক্ষণ করা হয় যৎসামান্য মূল্যবান সামগ্রী তাদের; ট্রাংক তালা আবদ্ধ, কিন্তু চাবি বেপাত্তা --- খানিক অনুসন্ধান চালায় তবু আমেনার শরণাপন্ন হ'তে অনিচ্ছুক ----ক্রমেঃ জবেদালি বিধ্বস্ত, মুখ গহবরের সর্বোচ্চ বিস্তৃতি ঘটিয়ে হাই ওঠে, কেমন একটা ঘুম ঘুম দোলা, –গতরাতে রাখা পানি ভাত সকালে গ্রহণের জের হিসেবে তন্দ্রালুভাব কিনা –কে জানে? দুই চোখের পাতা ক্রমশঃ ভারী —কাত হয়ে গেল শরীরটা, পুনরায় গভীর ও বড় মাপের হাই উৎসারিত করে নিদ্রার ঘোরে চেতনা হারালো সে।
অনেক বেলা করে ঘুম ভাঙার পরও জবেদালির আচ্ছন্ন ভাবটা তখনও প্রবল ;শরীর টিশ ঢিশ করে, ক্ষুধার জ্বালাও তীব্র, মুত জমা হয়ে তলপেটে প্রগাঢ় চাপ, – মূত্রপাতের জন্যও নড়তে অবাধ্য দেহ– লাট সাহেব বনে গেছে যেন।
আমেনার আর্বিভাব তখন, একটা গুতো মেরে জিজ্ঞাসা করে, 'কি ব্যাপার? তোমার হইছেটা কি শুনি? শরীর-টরীর খারাপ?'
অতঃপর সজোরে শরীরের কড়া যেন নড়ে ওঠে, আধাআধি ঘুম ও জাগরণ ভাব টুকরো হয়ে যায়, বার কয়েক পিটপিট করে চোখের পাতা, চৈতন্যোদয়ের পর শ্লেষ্মাজড়িত উচ্চারণ- 'বেলা বুঝি এখন অনেক হইছে, না–কি, কও?'
আমেনার সাহস খুবই উঠতি, তেল হয়েছে মাগীর বেজায় রকম, জবেদালিকে পুনরায় ধাক্কা ঝাড়ে, আর বলে-'কি হইছে তোমার কও না ক্যান? মহাজনের লোক কী বইলা গেল?টাকা-টুকা দিয়া গেল বুঝি?'
প্রত্যুত্তরে জবেদালি—'খানকি মাগী, তোর অত কথার কাম কি-? 'এই কথা ক'টি সরোষে কষে বলতে গিয়ে নিজেকে মুচড়ে নেয় এবং অন্য কথা—'কাজে যাইতে হইব বইলা গেল' তথ্যটা অবগতির জন্য পেশ করে মাত্র।
আমেনা চোখ সরু করে আপাদমস্তক স্বামীটিকে জরিপের পর মিহিস্বরে বলে 'শরীরটা খারাপ লাগলে, হাতে তো পয়সা আছে না-কি? যাও না একবার ডাক্তারের কাছে, দেখাও --- ওষুধ নিয়া আসো--- আর আমারো লাইগা লাল বোতল বড় দেইখা নিয়া আসো। শরীরটা কাহিল লাগতাছে। আজকা হাটবার, শরীফ ডাক্তারকে পাইবা। যাও একটুক্ ঘুইরা আসো, ওঠো?'
ডাক্তারের প্রসঙ্গ উচ্চারণ মাত্রই যেন সহনীয় মূত্রবেগ অকস্মাৎ প্রবল, নাক-মুখ-কান দিয়ে প্রচন্ড গতিতে নিষ্ক্রান্ত হওয়ার উপক্রম যেন! দ্রুত ধাবিত হলো বাঁশ ঝাড়ের উত্তরে, লুঙ্গি উঁচিয়ে শিশ্ন কম্পিত করে সড়সড় বেগে যত মুত এ যাবৎ থলির ভেতর জমাকৃত ছিল নিংড়ে ভার লাঘব করলো, সশব্দে পতনের পর মাটিতে মুতের ফ্যানা, ক্রমে মাটি শুষে নেয় মুতের তরল; বেশ আরাম এবার, শিশ্ন ঝেড়ে শেষ বিন্দুটিও ত্যাগ করলো সময় নিয়ে, বিচির থলিতে বিক্ষিপ্ত রোমরাজির একটি উপড়ে তীক্ষ্ণ ব্যথার তীর্যক স্বাদ অনুভব করতে করতে কখন যেন দাঁতে কাটা শুরু করেছে নিজেরই খয়েরি সরু চুল---
হাঁটে পৌঁছুতে সন্ধ্যা প্রায়। অধিকাংশ হাট ফিরতি লোকের মধ্যে সে ও গুটিকয়েক কেবল সদ্য আগত। সমস্ত দোকান এখনও গোটানো হয় নি, তবে দোকানিরা শেষ খদ্দের বিদায়ে শশব্যস্ত। জবেদালি, লোকজনের ভিড়ের ভেতর দিয়ে যেন সন্তরণশীল। তেড়ে একে বেঁকে উত্তরের চালাঘর গুলোর নিকট শরীর খাড়া করে, এখানকার একটি ঘরে শরীফ ডাক্তারের ডিসপেনসারি। আরে বাপ, শালার ডাক্তার নির্ঘাৎ টাকার কুমির হবে অচিরেই। লোকজনের কমতি নেই দেখা যায়। ডাক্তার রোগী পরীক্ষার সঙ্গে-সঙ্গে ঔষধও বিক্রয় করছে দেদার, রোগ বালাইয়ের প্রসার বলেই ডাক্তারের পোয়াবারো। ডাক্তারের ঘরের চাতালের ভেতর অজস্র লোকের সমাবেশ, –নিজের শরীরখানা গুজে দেয় জবেদালি। দাঁড়িয়ে থাকে। শোনা কথা:এই ডাক্তার নাকি পশুর ঔষধ ব্যবহার করে দিব্যি চিকিৎসা চালায় মানুষের, –ব্যাটা ঘোড়ার ডাক্তার!দোকানের গায়ে হাত খানেক লম্বা-চওড়া ঘষা সাইনবোর্ড চটা লেখাসহ লাট খেয়ে ঝুলন্ত–জবেদালি মনোনিবেশ করে সেটায়, সময় তো ক্ষেপণ করা জরুরী, কি সব যেন এম বি বি এস আর সি এম আর ডি ছাই মাথা আগডুম বাগডুম লেখা রয়েছে। এইভাবে দাঁড়িয়ে জবেদালির পা টনটন। অগত্যা উবু হয়ে পকেট ঘেটে বিড়ি মুখে ঝুলিয়ে অগ্নি সংযোগ এবং অপেক্ষা,-- কতক্ষণে হ্রাস পায় লোক সংখ্যা!-- নতুন একটি খেলায় নিজেকে মগ্ন করলো ততক্ষণ; লোক পিছু দশ টাকা হিসেবে ডাক্তারের রোজগার সম্পর্কে লোক সংখ্যা টাকার পরিমাণ নির্ণয়ে সে সচেষ্ট, যে লোকের হাতে ধরা বড় ফাইল ঔষধ তার সোজাসুজি পাছায় বাঁশ নিঃসন্দেহে, সেক্ষেত্রে ডাক্তারের পকেটে গোটা পঞ্চাশেক টাকা প্রাপ্তিও সন্দেহাতীত।
সময় যায় এবং অনুপাতে মানুষও হ্রাস পায়। আগে আসিলে আগে ভিত্তিতে রোগী দেখা হয়। এবং সে হচ্ছে শেষ ব্যক্তি; ঘাড় ঘুরিয়ে চারদিক তদন্ত করে দেখে, যে-না, নেই কেউ; আর কত? অতঃপর ডাক্তারের মুখোমুখি। পরনে সাদা হাতাঅলা গেঞ্জি-তলায় লুঙ্গি- ও গলায় ঝুলন্ত নল, ডাক্তার ষাড়স্বরে প্রশ্ন ছুড়ে দেয় –'কি, প্যাটে ব্যথা? 'এবং জবেদালির পেটে রামগুতো মারতেই দ্রুত মাথা দু'দিকে নাড়িয়ে কালবিলম্ব না করে উত্তর পায়-'জ্বী না।'
অতঃপর বিপুল উৎসাহে জবেদালিকে পরীক্ষা করে নেড়ে দেখে শুরু করলো ডাক্তার; 'আ--- আ" ---"উচ্চারণ করে দেখিয়ে দিয়ে জবেদালির বিঘৎ জিহ্বা পর্যবেক্ষণ শেষে, চোখের মণি টেনে বের করে এনে দেখে আর কি, –টর্চের জোরালো আলোয় ধাঁধিয়ে যায় সবকিছু;অতপর কালো কাপড়ে আচ্ছাসে ব্যান্ডেজ বাঁধার মত বাহুতে প্যাচ দেয় নলের গোড়ার ঠাণ্ডা-ঠাণ্ডা গোলাকার চাকতিটাকে ‘ডান বুকে' স্থাপন করে, এবং রবারের একটি গোলাকৃতি বলে পাম্প করতে করতে নিস্পলক চোখে আয়নায় মুখ দর্শনের ভঙ্গিতে লম্বাটে বাক্সের দিকে তাকিয়ে রইলো ডাক্তার; কনুইয়ের ওপর বাহুতে চাপ পড়ে বার কয়েক খামচে ধরছে গোছা মাংশ। ব্যাপারটিকে প্রেসার মাপা বলা হয়ে থাকে, জবেদালির সেটা অবগত হাটবারের দুই দিন ভিন্ন অন্যান্য দিনে ঘুরে ফিরে চড়ে-চষে নাকি লোকজনের প্রেসার মেপে বেড়ায় শরীফ ডাক্তার: প্রেসার দেখে জনপ্রতি একটাকা করে দাবী করে এবং অন্য সময় বিশ টাকা প্রেসার মাপার চার্জ এই কথাটাও সগৌরবে ঘোষণা দিতেও সে দ্বিধাহীন। ব্যাটা হচ্ছে একটা ঘোড়ার
ডাক্তার, ভাবতেই জবেদালির খিকখিকিয়ে হাসির উদ্রেক হয়। এবার ডাক্তার ফটাফট জবেদালির বুকের বোতাম খুলে বগলের নিচে কাঁচের সরু নল সই করে, অপর হাতটি পাকড়ে কব্জিতে আঙ্গুল স্থাপনের পর ঘড়ির দিকে দৃষ্টি তাক রেখে শতকিয়া পাঠ করার মতো কি যেন শুধু বিড়বিড়িয়ে চলে; নিজেকে সঁপে দিয়েছে সে এমন পরিস্থিতিতে, খালি হাসি শুধু পাচ্ছে তার, –বগলের নিচে কাতুকুতু। নানা কায়দায় আগা-পাছা-তলা পরীক্ষা শেষে খানিকক্ষণ মহা-ভাবনায় নিমজ্জিত রইল ডাক্তার। জবেদালির ভেতর হ'তে উগড়ে উড়ন্ত হাসির দমক বহু কষ্টে গিলে ফেলা মাত্রই চেহারাটি কাচুমাচু রূপ ধারণ করে তখন। একটু পর ডাক্তারের চোখমুখ উজ্জ্বল, হাত বাড়িয়ে পায়া ভাঙ্গা আলমারীর ভাঙ্গা কাঁচের মধ্য দিয়ে ভেতর হ'তে ময়লা ঝুলঅলা কৌটা বের করে এনে চাবির চ্যাপ্টা অংশ দিয়ে চাড়া মেরে খোলার পর গুণে গুণে দশটা ট্যাবলেট ঠোঙ্গায় ভরে জবেদালিকে প্রদান করে এবং চাওয়া মাত্র বড় বড় এক লাল রঙের বোতলও; সব মিলিয়ে দাম হয় প্রায় ঊনত্রিশ টাকা হ্রাস করার পরও প্রায় তিরাশি টাকা। টাকা খরচের সময় জবেদালি তার বউ মাগীকে কষে উদ্ধার করে নিল চৌদ্দগুষ্ঠিসহ গালি দিয়ে। তবে কিনা, জবেদালির সংগে পর্বটি শেষ হয়না, ডাক্তারের জন্য অপেক্ষা করছিলো মহা এক মুসিবৎ; জবেদালির ঘাবড়ে ফেলার মত আৎকা প্রশ্নবাণ - "বলেন তো ডাক্তার ভাই আমরা মানে মানুষ কি দিয়া তৈরি? মাটি দিয়া নাকি মানুষ তৈরি হইছে? আমি মানি না। আপনার কি মনে হয়? আমাদের এই শরীরে কি মাটি আছে?'
জবেদালির প্রশ্নের ভাব ও চালচলনে বেমক্কা হোচট খায় ডাক্তার; জড়ানো স্বরে বলে শুধু- "মানে?" সে যেন ঠাহর করতে অপারগ, কোন রোগ বালাইয়ের কথা হচ্ছে, না-কি? কথা সমষ্টি কোন অসুখ সংক্রান্ত, না-কি কোন রোগের লক্ষণ সম্বন্ধে আলোকপাত– তা পরিষ্কার হয় না তার নিকট; এমন ধারা কথা শোনেও নাই, ভাবনার মধ্যেও নাই। এ আবার কোন লক্ষণ অসুখের?--কি নাম এই অসুখের? রোগী দেখলেও তার মাথার কোটরে পাক মারে অসুখ বিসুখ টাইফয়েড- জণ্ডিস -আমাশা - জ্বর- ধাতুদৌর্বল্য এবং প্যারাসিটামল-ভিটামিন-সালফা যাবতীয় ঔষধের নাম হড়হড়িয়ে আসে; জবেদালির এ কোন রোগ দেখা দিল তাই ভেবে আকুল হয়েও কুল-কিনারা পায় নাই, চটজলদি কিছুই খেলে না মগজে, রোগের নাম কিংবা ঔষধের নাম একদম হজম।
নিশ্চুপ থাকলে ডাক্তারের অজ্ঞানতা, তাই উপায়ন্তরহীন বকে মাথা মুণ্ডুহীন; সারাদিন ধরে বক বক করায় জিহ্বা ধারহীন তার। মনে মনে দ্রুত সিদ্ধান্ত যে, ঔষধ কোম্পানীর লোককে পাওয়া মাত্র অবশ্যই জিজ্ঞাস্য, ঔষধ কোম্পানীর লোকেরা প্রায়শঃই ঔষধ সরবরাহের পাশাপাশি নানা বিষয়ে ঔষধ সংক্রান্ত জ্ঞান বিতরণে অবারিত। এই লক্ষণের কথা বলে আলাপ-সালাপে অবশ্যই সুরাহা হবে নিশ্চিত। কিন্তু, হায় অচিরেই গোলোক ধাধাঁয় পতিত হয় সে, সবই বিকৃত যেন; তখন কি যেন--কিযেন, এমত ভাবনার অরণ্যে পথ হারিয়ে দাঁড়িয়ে বাহ্। যাহ, ফাঁকা হয়ে গেছে মাথাটা একদম। --
ফিরতি পথে, ঘরমুখো চলতে-চলতে সাত এবং পাঁচ প্রকার বিভিন্ন ভাবনায় আক্রান্ত জবেদালি বিভোর হয়ে হাঁটে। মানুষ, তার বিবেচনায় একটি অদ্ভুত জীব; মাটি দিয়েই যদি নির্মিত হয়ে থাকে, তবে মানুষের দেহের মত, কোথাও মাটিতে দাগ কাটলে তো রক্তধারা অনুপস্থিত। মানুষের শরীর কেটে গেলে দেখা যায় কেমন সব রক্তে ভাসে; অতএব এমন নয় কেন যে মানুষের শরীর মাটি দিয়ে সৃষ্টি নয়; এই অংকটি তার নিকট অস্পষ্ট, সব কেমন তালগোল পাকিয়ে ওঠে। তবে কি কোথাও বড় ধরনের মিথ্যা কথা বিদ্যমান? জবেদালির মগজে জট; কেউ যেন এক উত্তাল মাঝ নদীতে নিক্ষেপ করেছে তাকে এবং মজা দেখছে সোৎসাহে, প্রথম নদীতে সাঁতার শিক্ষাগ্রহণকালীন জোর করে অপ্রস্তুত তাকে ফেলে দেয়া হয়েছিল নদীর পানিতে, তখন হাত পা ইতঃস্তত ঝাপ্টাতে ঝাপ্টাতেই আয়ত্ত্ব করা সম্ভব হয় পানিতে ভাসার সূত্র ও পদ্ধতি, জবেদালি এমত পরিস্থিতিতে এমন জোর সাঁতার দেয়, ডুবতে নারাজ সে, মৃত্যুকে দু'হাতে প্রতিরোধ করে প্রাণপণ লড়াই তার। এবং জয়ী হতা জন্য দু'হাত শূন্যে তুলে নিজেকে অভয় দিল।—-
আগুনের কেমন যেন একটা নেশা আছে, যখন দাউদাউ করে জ্বলতে থাকে, লেলিহান। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে নেশা ধরায়, ঝিমঝিম করে শরীর ও স্নায়ু, গভীর আচ্ছন্নতায় ফুলে ফেঁপে ঘোর সৃষ্টি হয়; আগুনের আঁচ তেতে রুক্ষ হয়ে যে তাপ বিতরণ করে সুতীব্র, তা অনুভূতির সীমানার বাইরেই অবস্থিত; অদ্ভুত এক নেশার ছন্দে আগুনের লকলকে শিখা তখন নৃত্য পরায়ন, কাঁপতে কাঁপতে ঢেউয়ের মত নিকটবর্তী হয় এবং ফের পালায়; আগুনের রং কমলা অথবা নীলচে অথবা বেগুনী অথবা লালচে কেবলই পোশাক পাল্টায়, আগুন শুধু দেয়--টান মারে–শরীর বিছিয়ে দেয়; খুব আদর করতে ইচ্ছা জাগে তখন। --- নেশার ঘোরে আত্মবুদ হয়ে জবেদালি সিনেমার মত দেখে –তাল তাল কাদা মাটির দলা দগ্ধিভূত হয়ে জমাটবদ্ধ কঠিন ইটে পরিণত, সারি সারি গণনা দুরূহ এত সুপ্রচুর ইট;ইটের পর ইট সংযুক্তিতে নির্মিত দালান কোঠা মাটি ভেদ করে যেন আকাশ স্পর্শক, একেকটি দালানে আশ্চর্য সব ঘর, মানুষ ঠাঁই নিচ্ছে ছাদের নিচে, ইঁট দিয়ে সৃষ্টি প্রতিটি গৃহে মানুষের অফুরন্ত স্বপ্ন তৈরি হচ্ছে, বিচিত্র সকল স্বপ্ন, একেকটা রঙ রয়েছে স্বপ্নের;মানুষ স্বপ্ন বুনছে–সন্তানকে স্নেহ দিচ্ছে, ভালোবাসা বিনিময় হচ্ছে, জন্ম নিচ্ছে মানুষ, হাসছে মানুষ, কাঁদছে মানুষ, সুখ ভাগাভাগি করছে মানুষ, বড় যত্ন সহকারে মানুষ সুসজ্জিত করছে তার ঘর–ঘর ভেঙ্গে গেলে আবার ঘরের জন্য লড়ছে মানুষ, গড়েপিটে নতুন আঙ্গিকে রূপায়িত করছে সেই ঘর। মানুষের ঘর---ইটের নির্মিত ঘর--- মাটির ইটে তৈরি ইটের সেই ঘর,জবেদালি চোখের সামনে রঙিন-- উজ্জ্বল ঘর-বাড়ি - দুয়ার -জানালা দেখতে-দেখতে ডুকরে ওঠে, সেখানে মানুষ বড় উন্নত। অকস্মাৎ নিজেকে অপরিচিত বলে অনুভূত হয় যেন,অন্তঃস্থলে অচেনা- পৃথক একটি মানুষ জাগরূক, সম্পূর্ণ অজানা; তার বোধ-বুদ্ধি- চিন্তা দূরবর্তী হ'তে হ'তে অনেক দূরে আসমান সমান উঁচুতে একটা বিন্দুতে স্থিরিকৃত যেন সে, ভীষণ--একটা অহংবোধে পায়ের তলার জমিতে পা থাকে না, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যে ফুৎকারে সব তুলার মত উড়িয়ে দিতে জোর ইচ্ছুক। –মাটি ছেনে ছেচে-ই যদি মানুষ সৃষ্টি, তো ছেনে-ছেচে-ই কাদার দলাতে আগুন জ্বালিয়ে শেঁকে শেঁকে নির্মাণ করে অজস্র ইট, সেই ইট যথাযথ একত্রিত হয়ে গড়ে ওঠে অপরূপ বাড়ি-ঘর যেখানে মানুষের বসবাস, তিলতিল আকৃতি পায় স্বপ্ন--ভালোবাসা-এইরূপে ক্ষমতাময় নিজেকে জবেদালির আরেক বড় কারিগর হিসেবে ধারণা হয়, এবং তখন-ই সব কিছু অবজ্ঞা করে, প্রচন্ড চিৎকারে কাঁপিয়ে দিতে সাধ জাগে এই আকাশ-জমিন, ভেঙ্গে-চুড়ে সব তছনছ চুরমার হলে নতুন বিন্যাসে ইটের পর ইটের সাহায্যে গড়ে উঠতে পারে সম্ভাবনাময় অন্য জগৎ জবেদালির নিজস্ব এক দুনিয়া।
–-এবং টাল বজায় রাখা অসম্ভব হয়ে ওঠে জবেদালির, শরীরে খিঁচুনি প্রবল হয়ে এক
পর্যায়ে চেতনা লুপ্ত হয়ে জমি ধ'রে শুয়ে পড়ে।
ইটের ভাটায় অগ্নি প্রোজ্জ্বলনের পর, মাত্র কয়েকদিনের ভেতরেই, দেখতে-দেখতে কোথা হ'তে কি যেন ঘটে গেল দ্রুত, নিমেষেই জবেদালির কেবল চল্লিশ বৎসর অতিক্রান্ত জীবনে পরবর্তী তিনটা ঘটনা যেন ফন্দি করেই সংঘটিত হয়।
এক। দাদী বুড়িটার অবশেষে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ, কিন্তু ক্রন্দন কিংবা আহাজারি বেমালুম অনুপস্থিত;বুড়ি যে মরছে—- মরবে এক মৃত্যুযাত্রী তা কারুরই তা অজানা ছিল না, শুধু দম ছাড়ার এমত কর্মটি ছিল অসম্পন্ন –সেটাই খতম হ'লে, মৃত্যুর মাধ্যমে সকলকে উদ্ধার করলেন তিনি।
দুই। আশ্চর্যজনক সংবাদ উড়ে উড়ে আগত; জবেদালি শোনে যে, কোথা হ'তে কি হয়েছে যেন, কয়েকদিন পূর্বে অগ্নি সংযোগ করা ইটের ভাটার আগুন, কর্ম নিষ্পন্ন হওয়ার পূর্বেই, তেলেসমাতির মত, বিনা কারণে নির্বাপিত, ফলতঃ মহাজনের অনিবার্যভাবে অনেক টাকা লোকসান। মহাজনের দুর্দশা স্মরণে মন বিষাদগ্রস্ত হয় বটে, তবে নিজস্ব স্বার্থ অনুযায়ী ঘটিত বিষয়টি মঙ্গলকারক, একই কাজ পুনরায় সংঘটনের উদ্দেশ্যে জবেদালিকে ফের টাকাসহ বায়না করতে হবে মহাজনের; টাকার চিমসে গন্ধটা জবেদালির নাকে ফিরে এলো নতুন স্বাদে।
তিন। হতে পারতো আনন্দদায়ক সুখকর আমেনা সংবাদ, যা এই যে, স্ত্রীর গর্ভধারণের মধ্যে দিয়ে পিতৃত্বের গৌরব অর্জন করতে যাচ্ছে সে, জবেদালি; এমত পরিস্থিতিতে ধাঁই ধাঁই করে উল্লম্ফন অতিশয় কর্মধারা হিসেবে মোটেও চিহ্নিত হওয়ার সম্ভাবনা ছিল না, কিন্তু তা হবার নয়, জবেদালির শীতল অভিব্যক্তি ক্রিয়াশীল বরং; স্ত্রী আমেনাকে প্রচন্ডভাবে অবিশ্বাস করলো সে, নিশ্চয়ই অন্য কোন পুরুষকে শরীর দান করে গর্ভবতী হয়েছে ছিনালটা; এখন একমাত্র করণীয় মাগীর পেটে দানাপানি সরবরাহ স্থগিতকরণ, পরপুরুষ তো মনের আনন্দে পূর্ণ–করে দিয়েছে আগামী মাসের জন্য আমেনার উদরটা। মাগীকে কুকুর সংগম করার সুতীব্র কামনা ধিকি ধিকি ছিল বহুদিন যাবৎ জবেদালির মনের কোটরে, কিন্তু সেটা আর মোটেও মেটানো সম্ভব নয় এখন; নিজের মনে খুকখুক হাসে সে বারবার।
বাতাসে আগুনের পোড়া-পোড়া গন্ধ কি?
যা কিছু ঘটে বা ঘটবে, সবই আগুনের বিপদ- আপদ বলেই বদ্ধমূল ধারণা জন্মে তার। নাকি,ভুল ?-কে জানে?
অতঃপর-
জবেদালি যাবতীয় এইসব ভাবতে ভাবতেই আগুনের ধোঁয়ার মত শূন্যে উড়ে যায়।…
আগুনের বিপদ-আপদ
সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ
সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ
মন্তব্য