প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার সামাজিক নৃতাত্ত্বিক কেন্দ্র
সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ
সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ
সংস্কৃতির নাম প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা; এখন এই কারক-কে আখ্যায়িত করা গেল প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার সংস্কৃতি—এই শিরোনামে।
সংস্কৃতি হচ্ছে এক আপাদমস্তক মানুষ। এই মানুষের মধ্যে সক্রিয় থাকে প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা। আবার বীজতলা অথবা বৃক্ষ। বৃক্ষ যদি, তবে তোমার নাম কী?
প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা। ফলে প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার কুসুম ছড়িয়ে থাকে সবখানে।
সংস্কৃতির ভেতরে বাস করে অনেকের সংস্কৃতি, এমনই এক সংস্কৃতি ছড়িয়ে থাকে সবখানে। প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা করা থেকে হয়ে ওঠা সংস্কৃতি।
সংস্কৃতির একটি অঙ্গ হয়ে থাকে প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা অথচ নির্ণয় না-জানি আজ পর্যন্ত আমরা।
প্রাগুক্ত যে সংস্কৃতি আপাদমস্তক মানুষ হলে তাতে প্রতিষ্ঠান বিরোধিতাও একটি মানুষের মত জ্যান্তব।
মানুষ, জীবন ধারণের জন্য যা কিছু করে, উদযাপন ও মোকাবেলা; পরিবেশের সঙ্গেও বোঝাপড়া; সমাজের সঙ্গে ক্রিয়া-বিক্রিয়া; যোগ্যতমের উর্ধ্বতন, সময়ের সঙ্গে খাপ মানিয়ে চলা; আচার-বিচার, হাবভাব ইত্যাদি সব কিছু জুড়ে থাকে সংস্কৃতির ভেতর।–সংস্কৃতির সপ্রাণ উপস্থিতি।
সংস্কৃতি কোনও নিটোল বস্তু নয়। মানুষে-মানুষে জৈব এবং প্রকৃতি ও সমাজের মধ্যে অজৈব রসায়নে গড়ে উঠেছে সংস্কৃতির অবয়ব।
সময়ের সঙ্গে– কালের যাত্রায় সংস্কৃতি বিন্যস্ত হয়; বিবর্তিত হয়; কখনো যুক্ত হয় পরিবর্তনকামী চেতনা, তা গড়ে দেয় নতুন মাত্রিকতা–প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা আশ্লেষণ-সংশ্লেষণে অভিযোজিত হয় সংস্কৃতির রূপ ও আধারে– সংস্কৃতির তল-ব্যাস-ব্যাধ নয় আত্মায় গিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা।
আপনা মাঁসে হরিণা বৈরী– তাদের চেনা যায়, অস্বীকার করতে চায় তারা প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার যাপিত সত্য। আর তখন সত্য অস্বীকারক মনোভাবের মধ্যেও ঘোষিত হয় প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার আরেক চেহারা, যা এক্ষণে বিমূর্ত কিন্তু থাকে চাক্ষুষ হওয়ার উদ্দেশ্যে অপেক্ষমান।
সংসার ছাড়া জগৎ হয় না,--জগতের মধ্যেই সংসার থাকে। সংসার এক বড় শিক্ষালয়। সংস্কৃতি, অতএব সাংসারিক।
মানুষ সংসার সাজায়। এক সংসার ভেঙে আরেক সংসার তৈরি। এক রুচি এক ঘেঁয়ে হয়ে গেলে অন্য রুচিবোধ গড়ে ওঠে। রুচিতে রুচিতে ঘটে যায় পার্থক্য। আর সকলের সর্বরুচি নির্মাণ করে দেয় জনরুচি।
জনরুচি ক্ষমতার কাছে, রাষ্ট্রের মেজাজের বদৌলতে আরামদায়ক হয়ে উঠতে পারে।
কিন্তু, জনতা,--ভাঙাপাত্র হাতে রাষ্ট্রের তথাকথিত মালিক হিশেবে সর্বদা মাথা গুজে থাকবে বলে গ্যারান্টি নাই, তাই কেউ যদিবা উসখুস করে ওঠে তা রাষ্ট্রের কাছে স্বস্তিদায়ক হয়ে ওঠে না আর সমাজ ও সংসারেও অস্তিনাস্তি সব তলায় চলে যেতে শুরু হয়।
তাই তো স্বস্তিদায়ক আরামপ্রদ ব্যবস্থা প্রশ্নের সম্মুখিন হলে যেমন তা নিঃসন্দেহে প্রতিষ্ঠানের প্রতি বিরোধকাম তেমনি জগতের মধ্যে তস্য সমাজ ও সংসার জোড়া এই বিরোধিতার বিরোধিতা শুরু হয়, পার্থক্য : কোনওটা পরিবর্তনকামী, কোনইটা স্থিতিকামী।
স্থিতির জয় হলে সমাজ অমৌনভাবে অগ্রসর হত না, আলো ক্রমে প্রবেশ করত না, দক্ষিণ জানালা বন্ধ থাকতে থাকতে একদিক অন্ধ থেকে যেত,--অথচ সমাজকে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে, সময়ের সঙ্গে দাঙ্গা করে হোক বা না করে হোক ক্রমে উপযোগ ও পরিত্রান-সূত্র হতে বেদম ঝাঁকুনি–এক তীব্র অভিঘাত ছড়িয়ে দিয়ে এতদিনকার গেঁড়ে বসা সব বেমানান ও নিশ্চল, কখনো প্রতারক কিংবা বিষধর হিশেবে কাঁধে চেপে বসা যাবতীয় অসুখের চিকিৎসা আবিষ্কার এবং অস্ত্রোপচার করতে করতে সমাজদেহের দগদগে ঘা-পুঁজ-বিষ দূর করার মধ্যেই নিহিতার্থ চিহ্নিত হয়ে যায় প্রতিষ্ঠান বিরোধিতায়।
প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার নিয়ামক হচ্ছে It want change, এই সমাজে, সংসারে।
এই জগতে সমাজ সংসার, রাষ্ট্র নিজের অনুকূলে মনে করে যা কিছু স্থিতিময় চেহারা তা যে কষ্মিনকালে কতিপয় মানুষের পকেটে রাখা শোষণ ও সুবিধাবাদ, লোভ ও বৈভবের তাড়নায় গঠিত হয়ে কবে অলক্ষে চেহারাকে মুখোশে পর্যবসিত করেছিল এবং সেই মুখোশকে যত্নে সোহাগে সাজিয়ে, পরিপাট্যে মোহজাল বিস্তারের পরিকল্পনায় সত্যকে ঢেকে মিথ্যাকে জাগিয়ে তোলার ব্যাপক আয়োজন করেছিল– কষ্টের ছাপ মানুষের চেহারায় বিভৎস হয়ে উঠছিল বলে মুখোশের আড়ালে ঢেকে রেখে নতুন পুজোবিধি চালু করেছিল যেন দংশিতের চেহারা অন্তরালে থাকায় দংশনের প্রকৃতি ও তীব্রতা প্রণিধানযোগ্য হবে না এমন বোধ, যাতে কুকুরের পায়ের কাছে মানুষ বসে থাকবে অথচ কোনও লজ্জা-সম্ভ্রম-সম্মান পেছন থেকে ডাকবে না।
সারমেয় সমাচার দৈনিক, পাতায়-পাতায়, কাগজ-কলম -তুলি -কাঁচিতে উজ্জ্বল হয়ে থাকে এবং তা পাঠ করে মানুষ আরো প্রাণহীন হয়ে ওঠে এবং যাবতীয় দুষ্কৃতবৃত্তে নিজেকে অসহায় প্রমাণিত করে।
সংবাদপত্রে প্রতিফলন ঘটে সমাজের কিন্তু বৃহৎ পুঁজির কাছে হাতকড়া পড়া সংবাদের কাগজ সমাজ বদলকে উৎসাহিত করে না; সামাজিক মানুষের দগদগে চেহারায় প্রলেপ দেয়ার জন্য বৃহৎ পুঁজির বদান্যতায় নাটুকেভাবে সজ্জিত এক ধরণের মুখোশকে, নাকের বদলে নড়ুন দিলাম, এইভাবে হাত পেতে নিতে উৎসাহ যোগায়, প্রচারণা চালায়, ডুবিয়ে রাখে।
মানুষের পরিচয় : হয় পাঠক, না হয় দর্শক; আদতে সে হচ্ছে,--অপর।
এই –অপর–অর্থগতভাবে বহুমাত্রিকতা প্রদর্শন করে; শব্দকোষ হতে যে অর্থগুলো জানা যায়, তা হলো,--অন্য, পৃথক, ভিন্ন, ইতর, অর্বাচীন, নিকৃষ্ট, অশ্রেষ্ঠ, বিজাতীয়, অন্য জাতীয়, প্রতিকূল, বিরোধী, শত্রু ইত্যাদি। মানুষের বিচিত্র মুখ,-- অপর, যে নয় পর,-- এই শব্দটির মধ্য দিয়ে আখ্যা দেয়া যায়, –মানুষের ক্ষেত্রেই যেন যথাযথ প্রযুক্ত হয়।
এক পক্ষ নিজ, অন্য পক্ষ হলো–অপর। এই নিজ যতই ব্যক্তির সত্তা হোক না কেন, তার মূলে আছে সমাজ। সমাজ প্রভাবিত করে মানুষকে। মানুষ আবার এই সমাজকে আকার দেয়, গড়ে পিটে নেয়, কায়েমী স্বার্থের সুবিধাযোগ হয় তেমন ভূমিকা পালন করতে সমাজ ও সম্প্রদায়ের সংস্কার, বিদ্বেষ, ভীতি, পছন্দ-অপছন্দ, ক্ষোভ, আশা-নিরাশা, ধর্মচেতনা, ঘৃণা-লালসা, বক্রতা, পশ্চাৎপদতা, রাজনীতি এই রকম যা কিছু আছে তাই নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
পরিবার, পরিবেশ, নানারকম মিডিয়া, অশ্লীল তবু সুশীল সমাজ কিংবা নাগরিক উদ্যোগ, সরকার, সভা-সমিতি, রাজনৈতিক দল, ধর্মীয় সংগঠন, শিক্ষা ব্যবস্থা, ধর্মীয় ও রাজনৈতিক মতবাদ, হুজুগ, ধর্মীয় উন্মাদনা– সকলের গতি-প্রকৃতির লক্ষ্য একযোগে কাজ করে এমনভাবে যে অবস্থায় ঘূণধরা সমাজটা দঁড়িতে ঝুলে থাকে, কিন্তু ঘূণপোকরা সর্বময় জারি থাকে অথচ ঘূণ পোকার আক্রমণ রুদ্ধ হয় না, বদল হয় না ঘূণ ধরা সমাজ; বজায় থাকে যে স্থিতাবস্থা তাতে দেশ মাতার জন্য উন্নয়নের টোপ বলবৎ রেখে বিশ্বায়নের ফাঁস দিয়ে থাবা মেরে লুটে নেয় অনায্য পুঁজি,-- মানুষের দ্বারা মানুষকে জপিয়ে অবিবেকতা ও বিবেকহীনতাকে ইয়োরোপীয় বিচ্ছিন্নতাবোধের মত বুদ্ধিবৃত্তিক চাতুর্যে নয়া তর্ক জুড়ে দিতে এমন এক প্রাঙ্গণ অবারিত করা হয় যে, প্রতিষ্ঠানকে সরাসরি ভবিতব্য হিসেবে গোণাগুণতি দেখিয়ে, সোচ্চার যে সব মানুষ যাবতীয় স্থিতিশক্তির বিশ্রাম ও ভোগবাদ, শোষণ-তোষণ-পোষণকে প্রশ্নবিদ্ধ করে যাচ্ছে তাদের প্রতি বিকট কামনায়, ভুল তর্জমায়, এক প্রকার জিগজ্যাগ নর্তন-কুর্দনসহ গোয়েবলেসীয় মুখপাত্র সুলভ প্রচারণায় আজাব গজবকে প্রলেপযুক্ত বটিকা গলধঃকরণ তরিকায় কবুল করিয়ে নিতে শুরু করে নানা তৎপরতা।
ছলে বলে কৌশলে, আতলামি কিংবা মাতলামি, অথবা দলবাজি, উদ্যোগ-প্রয়োগ-সংলাপ, সুলভে বৃহৎ চৌর্যবৃত্তি ও ভিটামাটি চাটি করার উপলক্ষ– ক্ষুদ্র ঋণ ইত্যাদি নানা তৎপরতায় লোচনভূষণের আড়ালে আপাত পরিবর্তনের ডাকাডাকি, হাকাহাকির দেখানেপনার মধ্য দিয়ে পরিস্থিতিতে স্তরান্তর ঘটলেও ঘষামাজা করা টুটাফাঁটা সমাজ ব্যবস্থার ক্ষয়িত রূপ থমকে থাকে, অবক্ষয়িত হতে থাকে, আবার থমকে থাকে বটে কিন্তু বিলুপ্তি ঘটে না, পরিবর্তন হয় না, নয়া ব্যবস্থা চালু হয় না যার ফলে সমাজজাত অভ্যাস টিকে থাকে অমরত্বের আশীর্বাদে।
সংস্কৃতি সংঘবদ্ধ মানুষের জীবনবোধ। সমাজ গঠনের মূল উপাদানসমূহের অন্যতম যে সংস্কৃতি তা তাবেদারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে নিম্নকোটির মানুষকে বিচ্ছিন্ন রেখে উচ্চবর্গীয় উর্ধ্বতনের এক ভোগবাদী সাংস্কৃতিক পরিচর্যা পুঁজির বিন্যাসের সঙ্গে আলাপ করে হাত মিলিয়ে চলে; এক প্রকার আরামবোধ ও সৌন্দর্যের আড়ালে কঙ্কাল এলিজি রচনা করে।
কারকের ক্রিয়ার বিপরীতে প্রতিকারের বিক্রিয়া থাকে বলেই জীবন প্রণালী বদলে ফেলার সংস্কৃতি উদ্ভব হওয়ার অনিবার্যতা দেখা যায়।
রাষ্ট্রের প্রাথমিক উপাদান যে পরিবার, সম্প্রসারিত পরিসরে সমাজ কাঠামো এবং সমুচয়কে সুরক্ষিত করার ছলনায় নিপীড়ন ও শোষণের ধারক রাষ্ট্রযন্ত্র–সর্বব্যাপী, এবং সর্বত্র মানুষের মৃত্যু সত্ত্বেও জাগরুক জীবনবোধ ধ্বংস ও নির্মাণ, বিনির্মাণের জন্য জীবনযাত্রা প্রণালীর বাঁক পরিবর্তন করার উদ্যম ও লক্ষণে দেখা যায়।
সংসার সীমান্তে জরুরি হয়ে উঠলে পরিবর্তন দেখা যায়; মুখ গুজে পড়ে থাকা সমাজকে গতিমান করতে ধাক্কা দিতে হয় বলে মুষ্ঠিবদ্ধ হাত পেছনে এসে সঞ্চয় করে শক্তি।
সমাজ ও সংসারে যে পরিবর্তন ক্রমে শুরু হয়, প্রারম্ভে তা হোঁচট খেতে বাধ্য।
স্থিতিশীলতা, বিদ্যমান স্থিতিশক্তিকে, সমাজ ও সংসারে স্থিতিস্থাপক হতে ক্রমে দুর্মর করে তুলতে কোনও নাটকীয়তা কোনও ঐন্দ্রজালিক প্রস্থান দরকার হয়না বরং কার্যকরী হয় স্থিতিশক্তি অর্থে প্রতিষ্ঠান ভাঙার ক্রমিক মোকাবেলা ও তৎপরতা। যে তৎপরতা ও ক্রিয়াশীলতা প্রতিষ্ঠান নামক হাঁকিয়ে চেপে বসা তন্ত্রমন্ত্রযন্ত্রকে অচল করে দিতে উদ্যত হয়, অবিরাম সংসার ও সমাজের শরীরে তা যে- প্রকার অভ্যাস ও প্রবণতা, সেই সূত্রে প্রকল্প গঠন ও ধারণ করে এক নয়া মোচড় সমাজ ও সংসার বাঁচাতে ও সাজাতে বিকল্প জীবন প্রণালী বিন্যস্ত হওয়ার মধ্যদিয়ে প্রথা ভাঙার, ক্ষয়িষ্ণু সমাজ কাঠামোকে দুমড়ানোর যে সকল মিলিত পদক্ষেপের উদ্দেশ্যে আলাদা আলাদা পাগুলো জড়ো হতে থাকবে–বেগবান ও নিহিত থাকে সেখানে যে চর্যা ও চর্চা তাকে প্রতিষ্ঠান বিরোধিতাকারী সংস্কৃতি হিসাবে মূল্যমান করা গেলে সর্বাঙ্গীন জ্বলে ওঠা জীবন্ত সংস্কৃতির উপলক্ষ করে ধীরে ধীরে সংস্কৃতির রূপান্তরের মধ্য দিয়ে সংস্কৃতি যে সঙ নয় তাই কেবল প্রমাণিত হয়ে সংস্কৃতিকে উচ্চাসীন করে।
কুশাসনের ফলে জীবন দুর্বিসহ হয়ে গেলে দেয়ালে পিঠলাগা মানুষ সশস্ত্র সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়, শাসক ও শাসন পদ্ধতি পরিবর্তন করতে। গোলাপ যে নামে ডাক, বিপ্লব অথবা অভ্যুত্থান কিংবা জনযুদ্ধ তা রাষ্ট্রের প্রত্যহে যতটা সম্ভব পরিবার কিংবা সমাজেও অন্যভাবে সম্ভব। এখানে পরিবর্তনের পালা সশস্ত্র পথে নয় বরং পরিবর্তনকামী সেইসব মানুষের সংঘবদ্ধ ষোড়শ উপাচারে উপাদানগত রদবদলের চেয়েও গুণগত পরিবর্তনকামী সংযোগ থেকে নয়া সাংস্কৃতিকযোগের উন্মেষ–প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা নামে খ্যাত হোক।
প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা, দুঃসহ ত্রুটিযুক্ত যে কোনও স্তরে প্রতিপালিত ব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ মানবিক সত্তার যেমন অমর উপাদান এবং এই নিয়ে জীবন ধারণের চেয়েও মূল্যবান জীবন যাপনের শর্ত উদযাপনের অনাবিষ্কৃত অথচ বহুল পরিমাণে পরিত্যাজ্য, ভীতি সঞ্চারী হুজুগপনা জ্ঞানে চিৎকৃত বেপথু অতি সংবেদনপ্রবণ জ্ঞান-অজ্ঞানী আস্ফালনের লক্ষ্য কিংবা নিশানা– অধোগতিকে নাকচ করার মনোভাব ও সংকল্প যে প্রকার আলোক সম্পাত করে বদলে দিতে উদ্যত–প্রতিহত করতে অপরূপ সম্মিলনে জাগরণ পর্বের ইঙ্গিত থেকে প্রয়োগে যেভাবে অমৃত কুম্ভের সন্ধান–উদ্ধত তর্জনির বিপরীতে তাচ্ছিল্য–যাবতীয় আপাত অসম্ভবকে নাকচ করার স্পর্ধা যুগান্তরের অমোঘ ঘোষণা ও স্মৃতি।
সংস্কৃতির কবে আরম্ভ তা জানা হয় না। বিভিন্ন স্থানে প্রাপ্ত প্রাচীন নিদর্শন, ইতিহাস, লেখাপড়া, নানা তথ্য-উপাত্ত আমাদের সংস্কৃতির নানা পরিবর্তনের অন্তর রূপান্তরের সাক্ষ্য দেয়। স্মৃতিশক্তি মানুষের স্বভাবজাত প্রবৃত্তি। এই স্মৃতি পালন করে সংক্রামক ভূমিকা, মানুষ ধারণ করে অতীতের স্মৃতি।
অতীতের মধ্যে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে আছে মানুষের দিন বদলের ইশতেহার থেকে ভারমুক্ত স্থিতিবস্থাকে নাকচ করার রোমাঞ্চকর প্রবণতা।
জাতিগতভাবে কখনো অস্ফুট আবার কখনো স্ফুরিত নাকচ করার মহান প্রবণতা যা ভাষায় ও মানচিত্রে শেষাব্দি সংগ্রামে ও রক্তপাতে শোষক-শাসক গোষ্ঠীকে বিতারণ, নতুন নতুন অভ্যুদয় ও বিজয়, উপনিবেশ থেকে উত্তর-উপনিবেশ, জাতিহত্যা থেকে স্বাধীনতা আনা সম্পন্ন করেছে বলে সমাজতত্ত্বে ও নৃতত্ত্বে যোগানো উপাদান, দুঃসহবাসকে নাকচ করে দেয়ার প্রবনতা ও প্রয়োগ, সাফল্যগাঁথা ও করতালি, উচ্ছ্বলতা ও উদ্দীপনা, আবেগ ও রূঢ়তা, জোড়াতালি দিয়েও অবশেষে নকশীকাঁথা বুনে ফেলা, এসবই মাথা না নত করার অহংকার বলেই চিরকালীন হতে সমকালীন প্রথা ভাঙতে ভাঙতে কাঠামো দুমড়াতে দুমড়াতে ব্যবস্থাকে হতদ্যম করতে করতে অতীত হতে ভেসে আসা ঐকতানের মতো সাংস্কৃতিক উপাদান হিসাবে প্রতিষ্ঠিত ও আমাদের বিগত দিনের প্রত্নচিহ্ন হয়ে আজও জ্বলজ্বল করে জীবনবোধে প্রতিফলিত হয়ে, জারিত হয়ে, পরম্পরায় প্রবাহিত হয়ে রক্তের এককের মতো আমাদের সংস্কৃতির ভেতর–অপর-এর সংস্কৃতি গড়ে ওঠার প্রতিভায় সংলগ্ন থাকে।
ইতিহাসের ধারা পরীক্ষা করে বাঙালির এই বৈশিষ্ট্য এই সেই সংস্কৃতি কী প্রকারে ঘটনার ঘনঘটায় নির্মিত হয়েছে তা অবগতি অর্থে লব্ধ জ্ঞান হয়।
সংস্কৃতির মধ্যে মানবেতিহাসের নানা সংযোগ পাওয়া যায়। সংস্কার ও সংশোধন করেও দমিয়ে রাখা যায় না। সংস্কৃতি প্রাচীনকালের বহু আচার আচরণের প্রতীক ধারণ করে আছে। জন্ম হতে জননক্রিয়ায় যা কিছু সব মিলিয়ে মানুষের যে গল্প–তা-ই সংস্কৃতি।
এইসব প্রতীক থেকে আরো প্রতীক তৈরি হয় সাম্প্রতিক অতীতকালে এবং সমকালে; প্রতীকের হাত ধরে অজস্র প্রতীক বড়ো করে আঁকে একটি অমর শব্দ, না। না বলা। নাকচ করা। রুখে দেয়া। বাতিল করা। বিরোধিতা। প্রতিষ্ঠান বিরোধিতায় যুক্ত আছে না বলার সামর্থ্য, নাকচ করার দুঃসাহস, যেখানে আক্রমণ, তাৎক্ষণিক ব্যারিকেড সেখানে– হানা বাড়িতে পাল্টা আক্রমণ।
শিল্পের জগতে, সাহিত্যের দুনিয়ায় অস্ত্র হাতে লড়াই জমে না, কলম, কাঁচি, তুলি, কালিতে মিলে মিশে যেন অস্ত্র বাগিয়ে উদ্ধার, উজ্জ্বল।
সংস্কৃতি, উপরন্তু প্রতিষ্ঠান বিরোধী সংস্কৃতির আঁচড়, আগামি দিনের সংস্কৃতির রূপরেখা তৈরির ক্ষেত্র প্রস্তুত করছে বলেই কায়েমী স্বার্থবাদী মহল ক্ষিপ্ত ও বেপরোয়া হয়ে ওঠে প্রচল বিরোধিতার আহ্বানে ও কর্মে (কারক অর্থে)। পুঁজিতুষ্টির সংস্কৃতি ব্যতীত আর সব সংস্কৃতির লোকায়ত ও প্রতিবাদী রূপদর্শনে ঝাঁকি দর্শনের বেগ হয়।
সভিয়েট রাশিয়া ভেঙে যাওয়া, বার্লিন প্রাচীর পতন, দুই মেরুভিত্তিক ঠাণ্ডা লড়াইয়ের জমানা শেষে পৃথিবী ব্যাপী সরল এক মেরুতে বিলীন হয়ে যাওয়ার বাস্তবতা; ব্রিটিশরা উপনিবেশের পর উপনিবেশ স্থাপন করেও পৃথিবীব্যাপী যেখানে এক চেটিয়াত্ব প্রতিষ্ঠিত করতে পারে নাই বরং রাজ্য বিস্তার ভাগাভাগি করে নিতে হয়েছে অথচ কিনা বিশ্বায়নের এক ঝটকায় মার্কিনীরা সারা বিশ্বকে আপন মুঠোয় বন্দি করতে পেরেছে অনায়াসে স্রেফ কূটচালে, এই সেই সময়, যখন প্রারম্ভে বিভ্রম ছিল যেনবা বিশ্বাসের পতন মতবাদের ক্ষয়ের উপর দাঁড়িয়ে আছে। এক ধরনের হতাশাজনক সময় অতিবাহিত করতে বাধ্যবাধকতা ছিল। পুঁজির এক চেটিয়াতন্ত্র ঝলসে দিতে থাকল।
অনাহারী বিবেক সাঁয় দেয় না দুর্বৃত্ত পুঁজির স্থানীয় বিন্যাস থেকে একক কর্তৃত্ববাদী যুদ্ধবাজ পুঁজির গ্রাস ও হাহাকারকে।
প্রজন্মের অসহায় সন্তানরা বিকল্প সত্তা দিয়ে ধারণ করেছিল প্রতিষ্ঠান বিরোধিতাকে। মুক্তির পথ বাৎলে দিয়েছিল প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা–সংস্কৃতির প্রকার থেকে সজ্ঞান চর্চায়।
প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা ছিল সময়ের উচ্চারণ, তৎকালীন তারুণ্যের নতুন ধর্ম সেই প্রভাতে অপার হয়েছিল।
এতক্ষণে প্রণিধানযোগ্য যে, প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা, হঠাৎ লেতিয়ে ওঠা এমন কোনো বিষয় নয় যা দ্রুত মিলিয়ে যাবার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। সময়ের হাত ধরে উপস্থিত হয়েছে বরং। ইতিহাস ও সংস্কৃতির নান্দীপাঠ সাক্ষ্য দেয়, দোলাচালে ভাসমান প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা সব জমানায় ছিল,-- থাকবে।
পুঁজিবাদ শিঁখরে আরোহন করলেও–ক্রমিক পতন বিলম্বিত, পুঁজিবাদ আরেকটু প্রলম্বিত হয় খোল নলচে পাল্টে বেপরোয়াভাবে অহংকারী আত্মপ্রকাশে একচেটিয়া পুঁজির দাপটে হিতাহিত জ্ঞানশূন্য করে তুলেছে যখন মানুষের অস্তিনাস্তি, সেই সময়ে অতীতের দুনিয়া কাঁপানো দিন বদলের নিনাদ শুনতে শুনতে মহারণের জন্য প্রস্তুতি নিতে নিতে মীথ অব সিসিফাসের নিয়তি ভেঙে গুড়িয়ে দিতে দিতে, শোণিত প্রবাহিত হয়েছিল যে উপাদান–বিচ্ছুরিত হয়ে এসেছিল স্রোতের বিরুদ্ধে পাল্টা ঢেউ জাগানিয়া শপথে– সেই সত্তার সনদ আবার যেন পঠিত হয়,-- উচ্চারিত হতে থাকে– সংঘ ও একককে উদ্যত হয়েছে– এমনই জেনেটিক্যালি সেই উত্থান পর্বের নাম খ্যাত হয়ে আছে–প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা ক্রিয়া ও কারকে। প্রতিবাদে, প্রতিরোধে।
প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা কোনও মায়াবী ছক নয়, বরং নিষ্ঠুর প্রান্তরে তপ্ত দিবস-রাত্রিব্যাপী সর্বপ্রকার প্রথা-প্রতিষ্ঠা ইত্যাদিসহ দুঃসহবাসের বিরুদ্ধে সমবেত আর্তনাদ হতে বিচ্ছুরিত তরঙ্গ-কম্পিত ছুঁটে চলে ত্রস্ত করে তোলে প্রতিপক্ষের দানবকে।
প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা জেনেটিকসে প্রতিভাত হয়। মানুষের সহজাত প্রবণতার মধ্যে নিহিত থাকে। যখন কূলায় কালো স্রোত, চারিদিকে বাঁকাজল তখন ভয় দুমড়ে মাঠ ভেঙে নদী সাঁতরে পাড়ি দেবার শক্তিবীজ এবং শেষ পর্যন্ত বিজয়,-- পরাজয়ের বাইরেই নিশ্চয়।
প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা একাধারে বর্ম ও বর্শা : রুখে দিতে নব্য শক্তি সঞ্চয় ও বিদ্ধ করতে তোমার আমার হাতিয়ার।
প্রতিষ্ঠানকে বাঁকা চোখে দেখার মধ্য দিয়ে সোজাসুজি দেখবার গ্রাহ্য দৃষ্টির সীমায় থরে থরে সাজানো নানা বিকার ও আকার আড়ালে চলে যেতে থাকে।
প্রতিষ্ঠান যেমন থাকে মানুষের মধ্যে– তখন গলায় জোর বাড়ে, সবকিছু উদগ্র শিকারে পরিণত করে এক শিকল পরানো ছল সৃষ্টি করা হয়।–সবই মানুষের, মানুষকে।
বাস্তবতা : মানুষকে প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ঠোকাঠুকি করে, ধারণ করে বাঁচতে হয়।
মানুষ যেমন সকলের মুখ চেপে নিজেকে জাগিয়ে তোলে– ব্যবহার করে আমজনতাকে– নিজেকে মানুষের মুখোশে দানব হয়ে উঠতে, ক্ষমতা এবং ক্ষমতা, মুখ ঢেকে যায় ক্ষমতায়।
মানুষের জন্য, মানুষকে নিয়ে, মানুষের দ্বারা নানা কাঠামো দাঁড় হয়ে যায়, সেখানে প্রতিষ্ঠান বলতে এমনই বেড়াজাল-শিকল-ডান্ডাবেড়ি; এই সব কিছুকে চিনির প্রলেপযুক্ত দৃশ্যমান পরিস্থিতি হিসাবে মানুষকে আষ্ঠেপিষ্ঠে বেঁধে রাখে। তাই প্রতিষ্ঠান বিরোধিতায় ডান্ডাবেড়ি, গলার ফাঁস ছাড়া আর কিছু হারাবার থাকে না। এইভাবে চলেছে নানা তাপমাত্রায় নানা বিগলনে, স্ফূটনে।
সমাজের গঠন সম্পর্কে বিদ্যাটি আয়ত্ব করলে– জবরদস্তিমূলক আরেক প্রাতিষ্ঠানিক প্রক্রিয়ায় সমাজের শারীরবৃত্তটা আবিষ্কৃত হয়। তাতে সরাসরি দেখবার শক্তি ও ক্ষমতা প্রতিষ্ঠান নামক ফাঁদপাতা ভুবনে এই যে এখনও শেকল ছেঁড়া কিছু মানুষ উল্টো গতিতে জগদ্বল পাথরকে নাড়া দিচ্ছে হয়তো সিসিফাসের পরিণতি ও ভবিতব্যকে মেনে নিয়ে, তবু, নিশ্চিতকরণ এই যে,যেখানে প্রতিরোধ,-শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি,-এরকম আরো রাজনীতি-সমাজনীতি-অর্থনীতির উর্ধ্বে ওঠা, বলবৎ থাকে রাস্তায় মানুষের মিলিত পা-ফেলা, একযোগে স্পষ্ট প্রতিরোধ উচ্চারণ, মানুষে মানুষে হাত ধরে দাঁড়িয়ে থাকা ইত্যাদী যাবতীয় প্রতিষ্ঠানের রূপভেদে পাল্টা প্রত্যয় জারী রাখা নানা ধরনের, মননের, চেতনের; যথা প্রতিষ্ঠান, তথা বিরোধিতা।
পূর্বপুরুষের হারিয়ে যাওয়া কলমের ডগায়, বিলুপ্ত হওয়া সম্প্রদায়ের জবানে, জিহ্বার ডগায়, পরিণত কিংবা অপরিণত দ্রোহে, বিপ্লবে-কাস্তে-কুঠারের ঝকঝকানিতে, সামাজিক সম্পর্কের বিকাশ ও রূপান্তরে-অর্থনৈতিক, সামাজিক, নৈতিক ব্যবস্থায় উন্নয়ন ও উন্নতির ঘোলাজলে-উন্নয়নের অর্থনীতি থেকে সমাজতত্ত্বে-উপনিবেশ হতে তৃতীয় বিশ্ব আরোপে,-বানানো অনুন্নয়নে হতে অর্থনীতির বিকাশ-শিল্পায়ন;-মানব উন্নয়ন হতে লাগসই ও টেকসই উন্নয়ন ধাঁধায়-বিশ্বায়নের আচ্ছাদনে লুপ্ত সংস্কৃতির কান্নায়-অশ্রুপাতে ও সরব সমরে প্রতিষ্ঠানকে বিরোধিতা করা থাকে প্রচলকে অচল করার তাগিদের মধ্যে।
প্রবর্তিত কাঠামো ও যোগাযোগ প্রক্রিয়া শোষণ উৎসাহী বলে–রক্তচোষা যাবতীয় বলয় ও আলয় ভাঙার, এবং আবার নতুন গড়ার স্বপ্নসাধে নিহিত আছে প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা–সাধ্য না থাকলে প্রবাহিত এবং চলিষ্ণু এই বিরোধিতায় প্রতিষ্ঠানকে মোকাবেলা।
বাংলাদেশের ইতিহাস বিচারে আরো পরিষ্কার যে, জাতীয়তাবাদী ইতিহাসের প্রতিরোধও প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা ছিল।
প্রভুত্ব ও অধস্তনতা ক্রিয়াশীল থাকলেও দমিত মানুষের স্বাতন্ত্র্য ঘোষণাতেও থাকে প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার বীজতলা ও শক্তিকেন্দ্র।
জাতীয়তাবাদের মধ্যে সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদ, নব্য উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধ-অবস্থান যখন ক্রিয়াশীল থাকে রাজনীতির মধ্যে–তাতেও প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা নির্দিষ্ট অবস্থান গ্রহণ করে থাকছে।
সমতার মধ্যে বৈপরীত্যকে প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার নান্দীপাঠে পাওয়া যায়। আদিবাসীদের সংস্কৃতি ও অস্তিত্ব উপেক্ষা, জাতীয়তাবাদী আগ্রাসন সত্ত্বেও তাদের সংস্কৃতি ও সভ্যতার প্রতিরোধের তৎপরতায় লীন হয়ে আছে বিরোধিতা, প্রতিষ্ঠানের প্রতিপক্ষে। ইতিহাসের অধিকার থেকে যাদের বহির্ভূত করা হয়, মূলত বিযুক্তি ঘটে থাকে ক্ষমতা সম্পর্ক থেকে।
ক্ষমতা সম্পর্কে পুনবির্ন্যাস না হওয়া পর্যন্ত এই জনতার ইতিহাসের ওপর অধিকার প্রতিষ্ঠা অনিশ্চিত বলেই কেন্দ্র হতে দূরে প্রান্তিকতায় তাদের অবস্থান আবদ্ধ থাকে।
প্রান্তিক মানুষ নিজেকে প্রকাশ করতে পারে না–Can Subaltern Speak? এমত বিচারে এইসব মানুষদের নিয়ে গত শতাব্দীর আশির দশকে নিম্নবর্গের ইতিহাস চর্চার সূত্রপাত হয়েছিল।
নিম্নবর্গের ইতিহাস রচনার মধ্য দিয়ে নিম্নবর্গ মানুষের চোখে ইতিহাসকে দেখার এক সমান্তরাল পাঠকৃতি রচিত হলো; নিম্নকোটির মানুষের স্বর ইতিহাসের পাতায় উঠে আসতে লাগলো– সাব-অলটার্ন ঐতিহাসিকদের অধ্যয়নে, চর্চায়।
প্রান্তিক মানুষের ক্ষমতায়নের সঙ্গে জড়িত থাকল প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা। রুখে দেবার শক্তি অর্জন,-- অন্যায়ের বিরুদ্ধে– ক্ষমতায়নের চল।
আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থার ক্ষমতার কেন্দ্র–শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সংবাদপত্র, প্রকাশনা সংস্থা, চিকিৎসা ব্যবস্থা, সেবা প্রদ্ধতি, উৎপাদন ব্যবস্থা, নিবন্ধন ও ছাড়পত্র প্রদান, কর্পোরেট হাউজ, সংঘ, সংগঠন এমনকি গবেষণাগার কিংবা পাঠাগার– আপাত নিরীহ মনে হলেও ক্ষমতা, প্রভাব ও আধিপত্য বিস্তারে যথাযোগ্য মর্যাদায় ব্যবহার্য; উপরন্তু, আইন-বিচার-নির্বাহী বিভাগ সমেত রাষ্ট্র তো সর্বাত্মকভাবে বলবৎ থাকে। রাষ্ট্রকে অপরিবর্তনীয় রাখতে বুর্জোয়া কর্তৃত্বে চিরতরে স্বার্থহানি রোধকল্পে বুদ্ধিজীবী ও মিডিয়ার তৎপরতা জড়িত।
সাবঅল্টার্ন স্টাডিজের তৎপরতা ক্ষমতার কেন্দ্রগুলি আবিষ্কার ও তৎসহ ক্ষমতা কেন্দ্রীয় সমালোচনা থাকলেও এসবের বিরুদ্ধে বিকল্প কর্মসূচি হিশেবে–প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা– আশির দশকেই এক নতুন আদর্শ ও মতবাদ নিয়ে আরেকটি ডিসকোর্স রচনা করে ছিল।
এই ডিসকোর্সের প্রতিষ্ঠানের আদিকল্পকে কীভাবে নস্যাৎ করা যায় তা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষামূলক নানামুখী প্রয়োগ সূচিত হয়েছিল বাংলাদেশে। প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ক্ষমতা যুক্ত। এই ক্ষমতা যখন নিরঙ্কুশ হয়ে ওঠে জন্ম নেয় স্বৈরাচার।
আশির দশকে হঠাৎ তামাশায় অস্ত্রজ্ঞানে লড়াই করার কাস্তে যখন অস্তমিত চাঁদের মতো ক্রমে বিলীন হয়ে গেলে ঘোর অমাবশ্যা বোধিকে গ্রাস করে ফেলল এবং বিষ ফোঁড়ার মত দেশ-কাল-পাত্র যখন স্বৈরশক্তি তখন তার সঙ্গে সঙ্গে কারো সংগ্রাম কিংবা কারো সংগম চলতে লাগল, এসময়ে আপাত দুর্বলতা, কখনো সীমাবদ্ধতাকে ইতিবাচকভাবে দেখতে শক্তি হিশেবে বিবেচনা করার আকাঙ্খা প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার সূত্রে নতুন জ্যামিতিক বিন্যাস রচনা আরম্ভ করল।
শিল্প বিপ্লব, দুটো মহাযুদ্ধ, অর্থনৈতিক মন্দা, ঠাণ্ডা যুদ্ধ, মহাকাশ যুগ, তেল সংকট, উপনিবেশগুলির স্বাধীনতা,-- এশিয়া-আফ্রিকার মুক্তি, ভিয়েতনাম যুদ্ধ, বাংলাদেশের একাত্তর, ফ্রান্সের ছাএ আন্দোলন থেকে স্থানিক ও কালিক নানা আন্দোলন ও বিদ্রোহ থেকে প্রতিষ্ঠান বিরোধী চেতনা,-- ঘূণে কাটা কাঠামোকে ভাঙচুরের স্বপ্ন বুনতে -দেখাতে, শুরু করল।
প্রান্তিক মানুষ যখন বিদ্রোহ করে, গড়ে তোলে কেল্লা, নতুন নতুন পরিস্থিতিতে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের নানা বিচিত্র পথের জন্ম দিতে থাকে; নতুন সব প্রতিবাদ, আজ যে সব প্রতিবাদ জমি হতে উচ্ছেদ বিরোধী কিংবা অরণ্য-নদী-পাহাড় হস্তান্তর কিংবা ধ্বংসের তোড়জোড়– তার বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামে, বুক পেতে নেয় গুলির তপ্ত শীসা-কেননা আক্রমনটা থাকে সরাসরি তাদের বিরুদ্ধে। এইসব বিপরীত বিন্দুতে একজোট হওয়ার মধ্যেই জারিত হতে থাকে প্রতিষ্ঠান বিরোধী চেতনা।
জীবনের বাস্তব অভিজ্ঞতা অনুযায়ী প্রাতিষ্ঠানিক অনায্য চাপ প্রয়োজন অনুযায়ী কতটা স্বীকার করবে এবং বাকিটা প্রতিরোধ করবে, সেখানেই তো নিহিত প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা এবং তাই তো প্রতিষ্ঠান বিরোধিতাকে অবলম্বন করে কষ্মিনকাল থেকে প্রবাহিত চেতনা এসে আশির দশকে সূত্রপাত করে প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা।
সেই অপরূপ ও জ্বলন্ত, সেই রকম প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা নতুন সময় আসলো শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি-সমাজতত্ত্বে, এই জনপদে।
সীমাবদ্ধতা থেকে সম্ভাবনার দরোজা খুলে যাওয়ার পালা। হঠাৎ জানালা খুললে এলোমেলো বাতাসে ধূলোবালি যেমন ঢোকে তেমনি প্রতিষ্ঠান বিরোধী চেতনার জন্য এক নতুনদিগন্তে দাঁড়িয়েও নানা সমালোচনা ও প্রভু শ্রেণীর সেবকদের হাতে অনাচার সহ্য করতে হয়েছিল।
বিরোধীতা → প্রতিরোধ → বিদ্রোহ
প্রতিষ্ঠান = হেগিমনিক পাওয়ার
উৎপাদন পদ্ধতিতে কর্তৃত্ব,
ধর্মাশ্রয়ী রাজনৈতিক বিশ্বাস,
আধিপত্যবাদ;
একচেটিয়া পুঁজির দৌঁড়
নিয়ম-নীতি, নৈতিকতা–
আইন ও বিচার।
প্রকৃতপক্ষে মার্কসবাদী চর্চার সূত্র ধরেই প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার সূত্রপাত– ভাষা ও সাহিত্য দিয়ে প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা শুরু করা গেল, যেহেতু একটা সংরূপ দরকার হয়ে পড়েছিল।
ভাষার ক্ষমতাকে অস্বীকার করা যায় না। কেননা প্রতিবাদ ও বিদ্রোহকে ভাষার সাহায্যেই দাবিয়ে রাখা যায়। সাহিত্যের বাহনের ভূমিকা পালন করে ভাষা।
প্রতিষ্ঠান বিরোধী চিন্তকরা রাজনীতিক ছিলেন। হাতে অস্ত্র তুলে নিয়ে সরাসরি রণক্ষেত্রে অবতীর্ণ হওয়ায় দুর্মর তাগিদ কাম্য ছিল না– সেই সময়ে রাজনীতির বিকল্প প্রণয়ন করার তাগিদ ছিল– স্বৈরশাসকদের রাজনৈতিক মাতব্বরি অশ্লীল ছিল সে সময়ে।– ছিল জন-বিরুদ্ধ।
সময়টাকে বলা যেতে পারে Age of Fragmentation. চারদিকে ভাঙনের শব্দ। সভিয়েট ইউনিয়নের পতন। বার্লিন প্রাচীর ভেঙে পড়া। পূর্ব ইউরোপে সমাজতান্ত্রিক কাঠামোয় ব্যাপক ভাঙন। –একটা অক্ষশক্তি ব্যাপক ভাঙনের মধ্য দিয়ে পৃথিবীর ভারসাম্য ভণ্ডুল করে দিল।
সেই সময়ে চেতনার বিচ্ছিন্নতা ঘটে গেল, চিত্রশিল্পে, সাহিত্যশিল্পে। আঙ্গিক বা রূপ সৃষ্টির ক্ষেত্রেও একটা আশ্চর্য ব্যাপার লক্ষণীয় হয়ে উঠল।
সেই সময়ে আশির লেখকদের হাত ধরে নতুন প্রজন্মের গল্প বেরিয়ে আসতে লাগলো। আশির দশকে সাহিত্যের জন্ম হয় ছোটগল্পে যা কিনা ছিল ভঙ্গুর সময়ের ইশতেহার।
সমসাময়িক কালে যারা গল্প লিখলেন, বিক্ষিপ্ততার গল্প,--প্রবাহ মধ্যে বিচ্ছিন্ন খন্ডতার রূপ ধরে ছোটগল্প লেখা হল–চেতনার বিচ্ছিন্নতার মধ্যে লেখা গল্পের মালিকেরা হয়তো উপন্যাসিকই ছিলেন।
তারপরও অথচ ছোট গল্প।
ভাষাকে আক্রমণ, গল্পের কাঠামোয় ভাঙচুর, ভাব ও ধারণার ব্যাপক উল্টোপাল্টা দিগ্বিদিক গতি, অস্থির সময়ের যেমন সাক্ষী তেমনি প্রাণ জাগানিয়া প্রকাশ।
মানুষের প্রতিবেদনে দেখা যায়, তাদের জীবনধারণ ধর্মাশ্রয় ও রাজনৈতিক দহনে সমাসন্ন। বিষয়বস্তু বর্ণিত সাহিত্য সর্বাপেক্ষা বলে দাবী করা যায়। বিষয়বস্তু বাদ দিয়ে সাহিত্য না হলে রাজনীতিকে বাদ দিয়েও সাহিত্য অসম্ভব। তা না হলে সাহিত্য অবাস্তব। গল্পকারদের সময়বোধের প্রেক্ষিতে ছোটগল্প ক্রমবিকশিত হয়েছে; গল্পকারদের কলমে জীবনের নানা বিপ্রতীপতা লক্ষ্য করা যায়। এই কালজ্ঞানই প্রকৃতপক্ষে সময় চিহ্নিত পরিসর যেখানে পাশ্চাত্য ভাবধারায় স্নাত হওয়া যেমনভাবে রয়েছে সমসাময়িক দৈশিক সাংস্কৃতিক ভাবধারা ও সাহিত্যের প্রতি বিস্ময় ও তা থেকে বিপন্নতার মধ্য দিয়ে পূর্ব-পশ্চিমের দোটানায় নিজস্ব স্বর খুঁজে পাওয়ার মুখ্যতে– নেপথ্যে গদ্যের চিরাচরিত স্বাচ্ছন্দ্যের বিদেশে অনায়াস গমনের বিপরীতে– তর্ক-বিতর্ক মুখর ডিসকোর্স, গদ্যের প্রচলভাঙার মুশলধারায় সোচ্চার থাকে।
ডায়ালিকটিকস্→প্রতিরোধ → বিদ্রোহ → প্রচলধারার ভাঙন কাহন।
রাজনীতি ও সমাজে নানামুখী যে প্রতিস্রোত তা গল্পে প্রভাব ফেলে বলেই প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা শনাক্ত হয় যাবতীয় প্রতিস্রোতে; গহীনে, অন্তিমে তা প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার নান্দী পাঠ।
আশি হতে ধারাবাহিক ছোটগল্পের, আরও ব্যাপকার্থে গদ্যের কথন বিশ্বে যেমন থাকে নতুনের অনুসন্ধানে সদর্পে এগিয়ে চলার সাহস– তেমনি গদ্যের মাধ্যমে আমাদের ভালোবাসার শিল্পমাধ্যম, আবার এই শিল্প মাধ্যমই হয়ে ওঠে যুদ্ধের মাধ্যম। বোকা লোকদের মতো বোমা ফাটিয়ে যুদ্ধ করা নয়, বরং ডিসকোর্স যেখানে সংঘর্ষ।
এই পরিপ্রেক্ষিতে লিটল ম্যাগাজিনের অবশ্যম্ভাবী চাহিদা, তাগিদ থেকে প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা গ্রহণ নতুন মতবাদ উপস্থাপন চেয়েছে।
এখানে জাল লিটলম্যাগাজিনের প্রসঙ্গ এসে দাঁড়ায় যেহেতু প্রকৃত লিটলম্যাগাজিন ধারণা সম্পৃক্ত করে নিয়েছিল প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার মন্ত্র। তাই শুনতে পাওয়া গিয়েছিল সেইসব প্রস্তাব যেখানে বলা ছিল :
লিটল ম্যাগাজিনের নিজস্ব একটা চারিত্রিক দর্শন থাকার কথা, এক কথায় যা তার ধর্ম। (সুখরঞ্জন দাস)
কোদালকে কোদাল এবং উলঙ্গ রাজাকে উলঙ্গ বলার প্রমিথিউসিয় চেতনা যে ধর্মের জন্ম দেয় তা হলো স্থিত স্বার্থ ও ব্যবস্থার বিরোধিতা, অস্বীকৃতি ও বিদ্রোহ।
বিষ্ফোরক, বিতর্কমূলক, শাসক শক্তি ও ক্ষমতাসীনদের সমালোচক হওয়ার মত সাহসী চরিত্র, ইশ্বরদ্রোহী হওয়ার মত মেরুদন্ডী হওয়াই প্রকৃত লিটল ম্যাগাজিনের ধর্ম পরিচয়- (সুখরঞ্জন দাস) মানুষের বেঁচে থাকার চেয়ে বড় কোনও রাজনীতি হয় না।
লিটল ম্যাগাজিনও উপেক্ষা করতে পারে বাস্তবতার দাঁত ও করাত, ফলে অভিযোজিত হয় রাজনীতিক বাস্তবতা–তা হলো ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ইতিহাসের উপাদান থেকে পাওয়া দ্রোহ-বিদ্রোহ-ভালোবাসা-বিপ্লবের আধারে বিভাজিত–প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার উন্মেষ যা বিধৃত হয়েছিল আশির দশকে, এই বাংলায়, অবলম্বনে ও সংকল্পে।
মনে করার নিশ্চিত কারণ এই যে, যে সব প্রেক্ষিত থেকে লিটলম্যাগাজিন জন্ম নেয় তার মধ্যে প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা থাকতে বাধ্য।– স্বরলিপি ও সুর থাকে।
সাহিত্যের মুনাফা শক্তিকে কাজে লাগাতে লুটেরা পুঁজি মনোযোগী থাকে বলেই সাধারণভাবে লিটল ম্যাগাজিনের ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার কথা বলা হয় তখন আবলুশ চিন্তা হিশাবে প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার প্রেক্ষিত হিসাবে বাণিজ্যিক মুনাফাখোর পত্রিকা গোষ্ঠীর দ্বারা সাহিত্যক্ষেত্রকে দখল করে নেয়ার ভাবনাটা দানা পাকিয়ে বড় করে তোলা হয়।
এই প্রসঙ্গে, উন্নয়ন ভাবনায় এনজিও প্রলেপের বিষয়টা সচকিত করা যায়।
এনজিও প্রলেপ হচ্ছে তেমনটা, জুতা পরিহিত পায়ের দুর্গন্ধ চাপা দেয়ার জন্য মোজার ভেতরে বরিক পাউডার ঠুসে দেয়া– তাতে লক্ষণ দূর হয় না অথচ চাপা দেয়া থাকে ফুঁসে ওঠা গন্ধমাদন।
পত্রিকা গোষ্ঠীর সাহিত্য ব্যবসাকে, প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার মূল উপজীব্য ধরে নিলে আরো বড় পরিসরে প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার– ত্রাহি মধুসূদন, বানাবার যে শক্তি প্রমত্তরূপে বহাল আছে– সেই শক্তিমত্তা সম্পন্ন দাঁড়াবার জায়গাটা কানাগলিতে ঢুকিয়ে দিয়ে এক ধরনের গৃহপালিত আকার-বিকার বানানো চলে। ক্ষতটা থাকবে, বিতর্কটা উসকে ওঠে এমন এক এনজিও প্রলেপ দিয়ে প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার মূল চেতনাকে জব্দ করা হয়ে থাকে।
আমাদের দেশে সাহিত্য জমিনে কোন পত্রিকা গোষ্ঠী কিংবা প্রকাশনা সংস্থার প্রতিষ্ঠান হয়ে ওঠার প্রতিভা নাই তবে যে সাহিত্যকৃতি লুটেরা পুঁজিকে তোয়াজ করে –তাদের গায়ে ঠুনকো মননশীলতার আস্তরণ বুলায় তা দিয়ে অপ-প্রতিষ্ঠানের বেড়াজাল সৃষ্টি দেখা যেতে থাকে।
সিদ্ধান্তটা লেখকের। লুটেরা পুঁজির কাছে ঘায়েল হবে কিনা,--ভাবনা লেখককে যে মানদন্ড দেয় সেখানেই রয়েছে প্রতিষ্ঠান বিরোধী চেতনা বিকাশ।
বৈশ্বিক বাণিজ্যনির্ভর কর্পোরেট চাণক্য এবং দেশীয় সামাজিক ব্যবস্থার নানা ত্রুটি-বিচ্যুতির মধ্যে মাথা তুলে দাঁড়ানোর মধ্যে বিদ্যমান বিরোধিতার বীজকে আমলে নিতে হবে।
সাহিত্যের মাধ্যমে সমাজ ও সংস্কৃতির প্রতিফলন নিয়ে লিটল ম্যাগাজিন দাঁড়ায়। মধ্যবিত্ত মনন এখানে প্রকাশিত। বাণিজ্যপ্রবণ মিডিয়া সর্বস্ব চালবাজির বিপরীতে সঠিক কথা উপযুক্তভাবে প্রকাশের যাবতীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা নির্ভর তৎপরতা পাঠকের রুচি পাল্টে দেবার জন্য সাহসী উপায় বলেই প্রতিষ্ঠান বিরোধী আন্দোলনের সূত্রমুখ লিটল ম্যাগাজিন–সেই রকম হয়ে থাকে।
পূর্ব ইয়োরোপ এবং রাশিয়ার সমাজতন্ত্রের পশ্চাদপসারণ, দুই জার্মানির মিলন, শক্তির ভারসাম্য এক বিশেষ মেরুর দিকে ঢলে পড়া– এসব যা ঘটেছে এবং বিশ্বায়নের পণ্য যোগাযোগে আরো যা কিছু ঘটে চলে, তা গভীর ও স্থায়ী প্রভাব বিস্তার করে চলেছে; সুতরাং সাহিত্য ও সংস্কৃতির মঞ্চেও প্রতিরোধের প্রত্যয়।
বাণিজ্য ও অর্থনীতি নির্ভর কাগজ ও প্রকাশনা হতাশাজনক এবং পত্রিকা গোষ্ঠী বাণিজ্য ও শিল্প ভিত্তিক আসর বসালেও সেখানে অর্থনীতি ও শিল্প-বাণিজ্যের গতিবিধি ও সহায়সম্বল তুলে না ধরে নানা ছলচাতুরী ও দুর্নীতি বহাল তবিয়তে একটা গেটাপ কিংবা মেকাপ বজায় রাখে।
নায়িকাদের মনোরঞ্জক চিত্র, রঙিন মোহজাল যেমন তেমনি সাহিত্যের নির্দিষ্ট প্রথা মাফিক প্রকাশে, কাগজওয়ালার কাছে সের দরে বিক্রির পূর্বে, প্রথম দফায় সাহিত্যের পণ্যোজীবীতার অনুকুলে বাই প্রোডাক্ট হিসেবে গছিয়ে দেয়া লেখা জোখা কালি ও কাগজের শ্রাদ্ধ। দৈনিক পত্রিকার ক্ষমতা আশ্রয়ী নীতি কিংবা তার জন্য পীড়াদায় স্বার্থবিরোধকে মাথায় রেখে সাহিত্য লেখক এককভাবে নয়, লিটল ম্যাগাজিনও তাই, সকলের মিলিত প্রবাহে বিভিন্ন সময়ে কালের কণ্ঠস্বরকে বহুস্বরিত করে আঙ্গিকে ও ভিন্নতর বিষয়ের সংযোজনে শুরু থেকে শুরুর ভূত-ভবিষ্যত-বর্তমানের যাত্রা। (জ্যোতির্ময় সেনগুপ্ত)
সংস্কৃতির একটি দৃশ্যমান উপাদান সাহিত্য। অন্তঃশীল উপাদানসমূহের অন্যতম হচ্ছে চেতনাগত প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা। সংস্কৃতির মধ্যে এই দুই পৃথক উপাদানের সংশ্লেষ হতে পারে আবার বিযুক্ত হয়ে অন্তঃশীলার মতো উদ্দীপক ও প্রভাবকের মতো গড়ে পিটে বের করে আনতে পারে প্রাচীন ও অর্বাচীন বিবেচনাবোধ চুরমার করে Total Involvement দূর করে Total denial শেষ পর্যন্ত Point of no-return ।
বর্তমানে Well-known & Powerfull man-এর Support & Recommendation ব্যতিত সমাজ-সংসারে প্রতিষ্ঠা,-- দানাপানি কুড়ানো ভিক্ষার থলি পূর্ণ করতে ঘরের বিবিকে ঘষে মেজে সমর্থ ভক্ষকের পাতে তুলে দেয়া,-- ফল লাভ, প্রাপ্তিযোগ; সাহিত্য ও শিল্পকলা পুরষ্কার কিংবা খেতাব, সিসিফাসের মতো পাথর নিয়ে টানাটানি করা এই সব ভরপুর পাথর সময়কে ধূলায় মেশাতে চাই প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার সংস্কৃতি, আজ থেকে জারী হোক তবে হতে চাও যদি মানুষ তবে বৃষ্টি হোক, রৌদ্র হোক : পাললিক সময়ের চাপ রুখে দিক।
মন্তব্য