সৈয়দ রিয়াজুর রশীদের কথাই যদি ধরি, এ দেশে ক'জন তার নাম জানেন। আমরাও কি জানতে পারতাম, যদি না হাতে আসত ঢাকার কামরুল হুদা পথিক-সম্পাদিত 'দ্রষ্টব্য' পত্রিকার মার্চ ১৯৯৪ সংখ্যাটি। তাতেই আছে রিয়াজকে নিয়ে ৪৮ পৃষ্ঠার এক ক্রোড়পত্র। রিয়াজ চান 'যাই লিখি না কেন তা যেন হয় স্বতন্ত্র কন্ঠস্বর'। রবীন্দ্রনাথ আদর্শ নন (রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্প সংক্রান্ত বাণীকে অত্যন্ত অর্বাচীন ও স্থুল বলে মনে করি)। পূর্বজদের মধ্যে একমাত্র কমলকুমার মজুমদারই তাঁর কাছে গ্রহণযোগ্য, কিন্তু তিনিও অন্তরঙ্গ প্রতিবেশী মাত্র, তার বেশি নয়। প্রথাসিদ্ধ কোনো ব্যাপারে তিনি 'হারাম' মনে করেন। তাঁর গল্প সম্পর্কে আমার অভিজ্ঞতা না হয় পরে বলছি। যাঁরা তাঁর সঙ্গে সমধিক পরিচিত আগে তাঁদের মত জেনে নেওয়া যাক।
শোয়েব শাহরিয়ার :
১. রিয়াজের গল্পে যৌনতা বেশ তপ্ত মত্ততা নিয়ে মুখিয়ে থাকে প্রায়শই ।
২. তৎসমবহুল ভাষার গাম্ভীর্যে আপাত-দুরূহ আবহ তৈরির ঝোঁক আছে বলে মনে হয়।
৩. বাক্য গঠনরীতিতে কাব্যিক দ্যোতনা সৃষ্টি অভিপ্রায়িত।
৪. রাজনৈতিক বিরাজমান অবস্থার প্রতি সৈয়দ রিয়াজুর রশীদের ঘৃণা তুঙ্গে উঠে ফেটে পড়ে।
৫. কেন্দ্রে একটি সূত্র থাকলেও 'গল্পের শরীরে বহুমাত্রিক খণ্ডাংশ যুক্ত করার প্রবণতা"রয়েছে।
মজনু শাহ :
১. কালো কামের উন্মোচন।
২. ভাষার কেরদানিতে ভরপুর অথচ মাথা ধরে যায় না।
৩. গল্পের মধ্যে ফ্যান্টাসি এবং স্যাটায়ার হাসতে হাসতে কাপড় তুলে যা দেখানো যাকে বলে।
রিয়াজের দু'টি গল্প আমি পড়েছি- 'আক্রন্দন কৎ-যাত্রা' ও 'আগুনবাজ'। বাংলাদেশের লেখকদের লেখায় সাধারণত যৌনতা কড়া মাত্রায় থাকে, ঠিকই। Salvador daliর - শিল্পসৃষ্টি সম্পর্কে J. G. Ballard-এর একটি মন্তব্য এ প্রসঙ্গে স্মরণ করা যেতে পারে–The great turn leitmotifs of the 20th century-sex and paranoia preside over his life, as over ours।
জীবনের প্রতি সৎ কোনো শিল্পীই এ ব্যাপারটা অস্বীকার করতে পারেন না। রিয়াজও তা-ই বলেন, 'আমার কাছে ক্ষুধা ব্যাপারটাই তীব্র। যৌনতা আর ক্ষুন্নিবৃত্তিতে কোনও ভেদাভেদ নাই; দু'ধরনের ক্ষুধাই বড় স্পষ্ট মানবজীবনে। একটি স্বীকার আর অন্যটিকে অস্বীকার সত্যবিরোধী'। কিন্তু আমার পঠিত ওই গল্প দু'টিতে 'যৌনতা' বা 'কালো-কাম' এর কোনো চিহ্ন আমি পাইনি । প্রথম গল্পটির শিরোনাম যেমন, গল্পের পুরো কাঠামোও তেমনি কাব্যিক। শুরুতেই আছে এক স্বপ্নদৃশ্য। একদিকে বহ্নিমান চিতা, আর এক দিকে কবরের ক্ষুধার্ত হাঁ – উভয়েই নির্লজ্জ লোভী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে লাশের দিকে, যেন কাড়াকাড়ি, কে পাবে তাকে? স্বপ্নে নিজের মৃত্যু নিজে প্রত্যক্ষ করে হাসিব ওরফে রঞ্জন। মুসলমান মেয়েকে বিয়ে করে ধর্মান্তরিত এক ব্রাহ্মণপুত্রের স্মৃতি-দীর্ণ জীবন এবং তদঘটিত মনোবিকার, যার পরিণতি আত্মহননে গল্পকারের ভাষায় 'বিলয়প্রাপ্তি ও পুনরুত্থান', এই গল্পের উপজীব্য। বাংলাদেশের এক সৈয়দ বংশোদ্ভূত কথাসাহিত্যিক নিজের অন্তরে এক ধর্মত্যাগী হিন্দু যুবকের মর্মবেদনা অনুভব করে যে ভাবে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে গল্পটি পরিবেশন করেছেন তার ফল হয়েছে গল্পে কথিত “উভয় পক্ষের বলপ্রয়োগের সমতা হেতু এক প্রকার শূন্য শক্তি নিরপেক্ষতার' মতোই। লেখক তাঁর চরিত্রের পাশে থেকেও যেন অন্তরালবর্তী। বুঝতে পারা যায় রিয়াজ কেন বলেন, 'আমার কাছে গল্পলেখক আর ঈশ্বরের মধ্যে কোনও পার্থক্য নাই'। গল্পটির পূর্ণ উপলব্ধি গ্রহণ করার জন্য আমাকে দ্বিতীয়বার পাঠ করতে হয়েছে। রিয়াজ সেটাই চান, 'আমার গল্পের ক্ষেত্রে নূন্যতম মর্যাদা হিসেবে দ্বিতীয়বার পড়া'।
পরের গল্প 'আগুনবাজ' পড়তে বেশি ধৈর্যের দরকার হয়। দু'পৃষ্ঠার প্রলম্বিত ভূমিকা পেরিয়ে তবেই মূল গল্পে প্রবেশ মেলে। গল্পটাও বেশ জটিল। রূপকধর্মী। একজন পাগল। নাম হাসেন পাগলা। তার অলৌকিক ক্ষমতা। আগুন তার বশে। সে বিমুখ হলে আগুন নিভে যায়। তার বাতির আগুন সে নিজে ছাড়া আর কেউ নেভাতে পারে না। শতাব্দী-প্রাচীন এক জনশ্রুতির সঙ্গে জড়িয়ে আছে তার নাম। 'তা হলে হাসেনের আয়ু কি এত লম্বা? নাকি হাসেনের বেটা আর এক হাসেন! ' কত বিচিত্র কাহিনী তাকে নিয়ে । কিন্তু সে সাধারণ মানুষের মতোই, খায়-দায়-ঘুমোয়। বেঁচে থাকার জন্য যেটুকু জরুরি, তার বেশি দাবি নেই। মুখে কথাও নেই--যেন এক বায়বীয় চরিত্র। একে সামনে রেখে লেখক কী এক অদ্ভুত খেলায় মেতেছেন। শেষে কার্যতঃ অক্ষরে আগুন ধরিয়ে দিয়েছেন। 'আগুনবাজ আমরা এসেছি', 'আগুনবাজ আমরা এসেছি', এই কথাগুলো নানা মাপের হরফ মিশিয়ে ঠিক আগুনের আকারে গোটা পৃষ্ঠায় ছড়ানো। যে ভাবে শ্রুতি গোষ্ঠীর কবিরা লিখতেন কংক্রিট কবিতা। এই গল্পের এক মায়াবী গুণ আছে যা গোড়ার দিকে 'ভাষার কেরদানি' দেখে ঘাবড়ে না গেলে, পাঠককে ক্রমে আবিষ্ট করে দেয়। কিন্তু লেখকের আসল বক্তব্য তো আছে ওই দীর্ঘ ভূমিকার মধ্যেই। 'এখন আগুন মাত্রই হচ্ছে বড় ঠান্ডা, নিরুত্তেজ।' তাই যুবকেরা বার হয়েছে সেই পরাক্রান্ত আগুনবাজের খোঁজে 'যে ধারণ করে আছে কোনও এক অজানায় বসে কাঙ্ক্ষিত এক জাদুর আগুন'। সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ লিটল ম্যাগাজিন বাদে অন্য কোথাও লেখেন না। তাঁর গল্পগ্রন্থ 'আগুনের বিপদ আপদ'-এর প্রকাশকও 'দ্রষ্টব্য' ঢাকা। বাংলা একাডেমী থেকে ‘আশির দশকের গল্প' নামে যে সংকলনটি প্রকাশিত হয়েছে তাতে রিয়াজের গল্প আছে। কিন্তু 'বাংলা একাডেমী লেখক অভিধান'-এ নাম নেই তাঁর।
প্রসঙ্গ: সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ
জাকিরুল হাসান
জাকিরুল হাসান
মন্তব্য