গার্সিয়া মার্কেসের শৈশবে, ঘরভর্তি ভাই-বোন ও অভাব-অনটনের মধ্যে বড়ো এক কার্টুন বই এসে হাজির; যার প্রাপক তারা নন, আবার প্রেরককেও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। মার্কেস তার আত্মজীবনীতে লিখেছেন তিনি এই বইয়ের কেমন পাঁড় পাঠক হয়ে উঠেছিলেন! তখন তার শরীর ভেঙে পড়ে, কোনো খাবারই হজম হতো না; ডাক্তার আবিষ্কার করলেন, দিনরাত বই নিয়ে অনড় বসে থাকার কারণে পাকস্থলি খাদ্য হজম করতে কোনো সাড়া পাচ্ছে না।
ভুল ঠিকানায় আসা বইগুলো সারাজীবন তার পেছনে ভূতের মতো লেগে ছিল, বই তাকে কখনও নিস্তার দেয়নি। প্রায় সবার জীবনেই দেখি বইয়ের ভূত তাদের তাড়িয়ে বেড়ায়; ওরহান পামুকের মতো পৈতৃকসূত্রে পাওয়া বা যেকোনোভাবেই হোক বড়ো বড়ো লেখকরা একেকজন বইয়ের ভূতগ্রস্ত পাঠক। বোর্হেসের ক্ষীণতনু আত্মস্মৃতিতে দেখি, তিনি পড়ালেখা ছাড়া প্রায় কিছুই করেননি; লাইব্রেরিতে চাকরি নিয়েছেন কেবল পড়ার জন্যই। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় হাতের কাছে কিছু না পেলে ছেলের গণিতের বইয়েই মগ্ন হয়ে পড়তেন। বই নিয়ে গসিপও আছে বিস্তর। পাঠকের ধরনও আছে নানা প্রকারের। এমন পাঠক আছে যারা রাস্তায় একটা বাদামের ঠোঙা পেলেও না-পড়ে তাদের স্বস্তি নেই, তাদের কাছে পড়াটাই মুখ্য, বিষয় বা শৈলী কিছু নয়; কেউ কেউ চেয়ারের বদলে কমোড ব্যবহার করেন, তারা কোনো মুহূর্ত বই ছাড়া থাকতে চান না; কেউ পড়ুন বা না-পড়ুন সঙ্গে বই বহন করেন। এদের নানা নামেও ডাকা হয়।
আবার যারা পড়াকে অগ্রাহ্য করেন, তারা বলেন, পড়ুয়ারা জীবনে কী করতে পারে? তাদের কাছে পড়ুয়ারা উদ্যোগহীন ও অবৈষয়িক; এরা পান্ডিত্য অর্জন করতে পারলেও তারা অশিক্ষিত শাসকের বাহন (জুতা) ছাড়া কিছু নন; আমরা আমাদের রাষ্ট্রীয় জীবনে ‘বুদ্ধিজীবী’ নামে চিহ্নিত শিক্ষিত ও সৃজনশীল ব্যক্তিদের এই কাজই করতে দেখি। তখন হয়ত উত্তর পাই এভাবে, বই আপোসহীনের অন্তর্দাহ বাড়ায়, আর আপোসকামীর খ্যাতি ও পয়সা বাড়ায়। এখন পাঠক কী বাড়াতে চান, তা থাকলো পাঠকেরই ইচ্ছাধীন।
তবে, পড়ার ক্ষুধা কেবল পড়ার ক্ষুধাকে বাড়িয়েই তোলে, নিবৃত করে না কখনও; একটা বই আরেকটা বইকে ঘরে টেনে আনে। বই ব্যক্তির, সমাজের, রাষ্ট্রের কী করে তা নিয়ে মতামতের শেষ নেই। বই কিছু একটা করে বলেই কোনো কোনো রাজনৈতিক শক্তি বই ছড়িয়ে দেয়, কোনো কোনো শক্তি পুড়িয়ে দেয়। যারা পুড়িয়ে দেয় তাদেরও বই আছে, যা তাদের কাছে একক ও অনন্য; যারা বই ছড়িয়ে দেয় তাদেরও শত্রু বই, তারা বইয়ের একত্ব ভেঙে ফেলতে চান, বা ভিন্ন মতের বইয়ের টুঁটি চেপে ধরতে চান।
বই নিয়ে এত কথা পাড়ছি সৈয়দ রিয়াজুর রশীদের ‘সমগ্র রচনা-১’ এর পরিশিষ্টে দুটো অধ্যায়ের একটি ‘বইপড়া সারাবেলা’ পড়ে। ১৪ পৃষ্ঠার ছোট্ট এই লেখাটিকে আশা করেছিলাম লেখকের নীরহ পাঠ-ক্ষুধার প্রামাণ্য হিসেবে; যাতে আমরা জানতে পারতাম কী কী বই কোন বয়সে তাকে কীভাবে গড়ে তুলেছে। কিন্তু তিনি রচনাটিকে একটি সার্বিক দিকে নিয়ে গেছেন; তিনি একইসঙ্গে আলো ফেলেছেন বাংলাদেশের (পূর্ববঙ্গ বা পূর্ব পাকিস্তান অর্থেও) মধ্যবিত্তের ‘শিক্ষিত’ হওয়ার দিকে।
তিনি জানাচ্ছেন, ‘বাঙালি মুসলমানের ঘরে প্রথম জেনারেশনের আম মানুষের ঘরে আউট বইয়ের তালিকায় মাকসুদুল মোমিন বড়োজোর লজ্জাতুন্নেছা গোপনে কিংবা প্রকাশ্যে স্থান পেলেও সময়ের সঙ্গে এগিয়ে এখন জীবনানন্দ, সেয়দ ওয়ালীউল্লাহ জায়গা করে নিয়েছেন।’ পরের প্যারায় তিনি বাংলাদেশের পঞ্চাশ-ষাটের লেখকদের নামও অন্তর্ভুক্ত করেছেন। এই অভিজ্ঞতা তিনি নিশ্চয়ই নিজের পরিবারের দিকে তাকিয়ে করেছেন। তার শৈশবে ‘আউট বই’ পাঠের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে তিনি বলেছেন, ‘পিতৃ সুবাদে বই পড়াক্রান্ত আমি।’ যিনি বই পড়েন, ‘...হয় বই পড়ি বেঁচে থাকার জন্য, বেঁচে থাকি তাই বই পড়ি।’ মানে জীবনের আর সব জৈবিক বিষয়ের মতোই বই একটি। কিন্তু লেখকের কাছে বই কেমন? ‘দুই মলাটের ভেতরে আপাত নিরীহ অক্ষরবিদ্ধ পাতা–একেকটা পাতা বিস্ফোরক হয়ে ওঠে।’ আর লেখকের কলম? ‘অন্যদিকে শোষক ও শাসকের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠা লেখনী আমাদের কলমকে রাইফেল হিসাবে–বিদ্বানের কলমের কালি শহিদের রক্তের চেয়েও দামি বলে ঘোষণা করে।’
সৈয়দ রিয়াজুর রশীদের কাছে বই দুপুরের ভাতঘুমের নিরীহ পাঠ্য বিষয় নয়, লেখক তো ননই; তিনি নিজেও তেমন লেখক যারা নিজের রক্ত পুড়িয়ে লেখাকে শোধন করেন। বই যার বাঁচার অবলম্বন তাকেও দেখি একাত্তরের কালোকালে, নিজের কৈশোরে প্রিয়তা হারানোর ব্যথায় কাতর; তখন গুজব ছিলো বাড়িতে হিন্দু লেখকের বই পাওয়া গেলেও নিস্তার নাই। ‘বাঁচার তাগিদে মানুষ বই পুড়িয়ে ছাই করে ফেলল। বাসায় ছিল রবীন্দ্রনাথ-শরৎচন্দ্রের বই। হয়তো থাকতে পারে নীহাররঞ্জন, ফাল্গুনী কিংবা তারাশঙ্কর-বিভূতিভূষণ। মনে পড়বে, এক রাতে বইগুলো বাজারের থলিতে ভরা হলো, আরেক রাতে কিংবা দিনে কখন যেন বইগুলো উধাও হয়ে গেল।’ আরেকবার ৮৮ সালের বন্যায় বই কাদায়-পানিতে নষ্ট হয়ে গেল।
সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ পৈতৃকসূত্রে বই পেলেও সবসময় বই পড়া তার জন্যও খুব সহজ ছিল না। মধ্যবিত্তের পড়াশোনার লক্ষ্যে থাকে ভালো একাডেমিক ক্যারিয়ার এবং চাকরি অর্জন; তাই কিশোর বয়সে ‘আউট বই’ আক্রান্ত হয়ে পড়লে অভিভাবকরা একটু ঝুকিতে তো পড়েনই। আবার ‘আউট বই’ আক্রান্ত পাঠকরা তাদের চোখ ফাঁকি দেয়ার কৌশলও ভালো করে জানেন। তার কৌশল কেমন ছিল? জানাচ্ছেন এভাবে “আমার পড়ার টেবিলে ড্রয়ারের ভেতরে সমুচার প্যাকেট, টেবিলের ওপর ছোটোদের-বড়োদের নানা ধরনের বই রেখে তা ঢেকে রাখতাম পড়ার বই–টেকস্টবুক দিয়ে।...ড্রয়ার থেকে সমুচা ভেঙে মুখে দিতাম, তলায় রাখা দারুণ সব বাছ-বিচারহীন বই কয়েক পাতা গোগ্রাসে গিলে আবার ‘সবার ওপরে পাঠ্যবই-ই সত্য’...”
সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ বই পড়া মানুষকে চিহ্নিত করেছেন, ‘রক্তের স্বাদ পাওয়া বাঘের মতো–রক্তের স্বাদ নিতে বই শিকার করা ছাড়া গত্যন্তর নাই।’
শুধুমাত্র পাঠকের কাছে বইয়ের স্বাদ এক রকম, আর যার লেখক ও পাঠক যুগপৎ সত্তা তার কাছে নিশ্চয়ই তা অনন্য।
সৈয়দ রিয়াজুর রশীদের ‘বইপড়া সারাবেলা’ পড়ে
জাহিদ সোহাগ
জাহিদ সোহাগ
মন্তব্য