দেশভাগ এবং মুক্তিযুদ্ধ এই উপমহাদেশে ও রাষ্ট্রীয় জীবনে দুটি গুরুত্ববহ ও সুদূর প্রসারী অধ্যায়। দেশভাগের অভিঘাত সময়ের পরিক্রমায় ৭৫ বছর পেরিয়ে এখনো অমলিন, অর্ধশতাব্দী অতিক্রান্ত হয়েছে ৭১-এর সেইসব রক্তঝরা দিনরাত্রির অথচ সেই রক্ত উল্লেখ আজও স্পষ্ট । ৪৭-এর দেশভাগ সকলের মান্যতা ও সমর্থন না পেলেও তাদের সোচ্চারিত কণ্ঠ ছিল দূর্বল ষড়যন্ত্রের ছোবলে ছিল নীলকণ্ঠ ফলে বিভাজনের রাজনীতি সিদ্ধ করে নেয় দেশভাগ-দেশ ত্যাগ। দেশভাগের লাভ-ক্ষতির হিসাব আজও অমীমাংসিত। দেশভাগের পথ পরিক্রমায় বাংলার স্বাধিকার অর্জনের আন্দোলন হতে ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ। এই দুইয়ের মধ্যে সূক্ষ্ণ সুঁতোর টান বিদ্যমান। বহুজাতিক ভারতবর্ষের মধ্যে ছিল শ্রেণিবৈষম্য ও জাতপাতের উৎপাত ফলে দেশভাগ তরান্বিত হয়েছে, ধর্মের ভিত্তিতে সৃষ্টি হয়েছে দুটি রাষ্ট্র ভারত ও পাকিস্তান। পাকিস্তানের পশ্চিমাংশ দ্বারাই পূর্ববঙ্গের তথা বর্তমান বাংলাদেশের ভাগ্য নিয়ন্ত্রিত হতো –যেখানে নিহিত ছিল শোষণ– মুক্তিযুদ্ধ অতএব হয়ে উঠেছিল অনিবার্য; মুক্তিযুদ্ধ সূচিত হয়েছিল ২৫ শে মার্চের ভয়াল কালোরাতের রক্তস্নানে এবং অস্ত্র হাতে ১৬ই ডিসেম্বরে বিজয় পতাকাতলে শোভিত হয়েছিল একটি জাতির মুক্তি।
৪৭ কিংবা ৭১ এর পক্ষে-বিপক্ষে শ্রুত হয় অযুত —অজস্র,অসংখ্য বয়ান ;আমাদের করে তোলে ভ্রান্তি-বিভ্রান্তির দ্বন্দ্বে মুখর। দেশভাগ যেমন ট্রমাটিক –আমাদের জাতীয় জীবনে একাত্তরও তেমনি অভিঘাত;রক্তাক্ত-ক্ষতার্ত করে চলে। ঐতিহাসিকগণ ক্ষত-বিক্ষত, রক্ত-চিহ্নিত অধ্যায়ের বয়ান রচনা করেছেন;একইভাবে সাহিত্যের পাতায় পরিদৃষ্ট হয়েছে সেইসব কথকতা।
কথাশিল্পী সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ দেশভাগ ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কলম ধরতে–অক্ষরপাত করতে পেছনে পা ফেলেন নি; সেই সব সময়ের চিত্র তিনি অংকিত করেছেন –ভাষাচিত্রে উঠে এসেছে ক্রান্তিকালের বিবরণ ও পরিনাম। তিনি ইতিহাসকে ধারণ করেন – ইতিহাসের উপাদান স্পর্শ রচনা করেছেন মানবিক ইতিহাস এবং যুক্ত হয়েছে সাম্প্রদায়িকতা, দেশভাগ সৃষ্ট দেশহারা মানুষের দেশ খোঁজার কাহিনী–মনুষ্য জীবনের নানা অধঃপতন -উত্তরণের বিবরণ। গল্পে তাঁর রচিত বৃত্তান্ত প্রকৃত তথ্য জারিত ও জায়মান।
সৈয়দ রিয়াজৃুর রশীদের একটি ছোটোগল্প ‘জলপ্রপাতের উপাখ্যান’ যেখানে ১৯৪৭-এর দেশভাগের একটি খন্ডচিত্র প্রকাশিত হয়েছে; মা-মেয়ের নির্যাতিত হওয়ার ধারাবাহিকতা ও স্তরান্তর পাঠককে স্তব্ধ করে দেয়। এমন একটি বর্ণনা, “আমিনার মাকে, ১৯৪৭ এর দাঙ্গায় উদ্দাম ধর্ষণ করেছিল হিন্দু গুন্ডারা; ১৯৭১ সালে পাকিস্তানে মাকে আবার উন্মত্ত বলাৎকার করেছিল মুসলমান পাক সৈন্যরা; হিন্দু গুন্ডাদের শিশ্ন দাঁড়ায়, মুসলমান হওয়ার অপরাধে–আবার হিন্দুদের হাত থেকে বাঁচতে ভিটামাটি উপড়ে ফেলে মুসলমান রাজ্য পাকিস্তানে আসার পর হিন্দু আর বাঙালি নাকি একই রকম কথা, বাঙালিরা খাঁটি মুসলমান হতে পারে না, তারা সোনার পাকিস্তানের জন্য অশুভ আত্মা-এই অপরাধে ১৯৭১ সালে বাঙালির শুদ্ধি অভিযানে খাঁটি মুসলমান পয়দা করার জন্য পাকিস্তানি মুসলমান সৈন্যরা খাকি পোশাকের ভিতর থেকে শিশ্ন উত্তোলিত করে মায়ের যোনিতে বীর্যের প্লাবনে এক খাঁটি মুসলমানের জন্ম আদায় করে নেয়।” এভাবে মায়ের গল্প শেষ হলে শুরু হয় মানব জন্মে অপমানিত সেই মুসলমান মেয়ে আমেনার রক্ত-স্নাতা গল্প;আর নারী মাত্র স্বদেশে-বিদেশে একই পরিণাম বাহিত বলে লেখকের ক্যানভাসে স্হান করে নেয় বাংলাদেশ ছাড়িয়ে গুজরাত, বসনিয়া, কোরিয়া, ভিয়েতনামের মতো দেশের নারীর অনুরূপ পরিণতি –শরীরে শরীর লাগিয়ে গল্প করে।
দুনিয়াজোড়া যেন একই কথকতা, ;রক্তল্লেখ আর রতিল্লেখ–“আবহমানকাল প্রবাহিত ভাটির দেশের পানির ধারায় কুয়াতলায় দাঁড়িয়ে জলপ্রপাতের ভেতরে সে যেন জলের আদরের মধ্যে-সারা রাত্রি-যুগ যুগ ধরে বীর্যে সিক্ত আমিনারা আশ্রয় নেয় আর দিকে দিকে রটে যায় নারীর কোনো স্বদেশ নাই, নারী মাতৃভূমিহীন।” লেখকের প্রশ্ন –ক্ষুরধার এবং পাঠক হয়েছে তড়িতাহিত। বলেছেন, কাঁটাতারের সীমানা দিয়ে কি জল-বায়ু থেকে পন্যের প্রবাহ রুদ্ধ করা যায়? আবহমানকাল হতে ভেসে আসা ঐকতান আন্দোলিত করে, মানুষ সৃষ্টি করে আবার বর্ডারের সংস্কৃতি। ‘শরীরের বাজার’ গল্পে লেখকের বিশদ বিবরণ হতে এক ঝলক–, “পাঁচিল দুই শরিকের নৈকট্য-মধ্যিখানে দূরত্ব রচনা করলেও অন্তর্জগতে মানুষের মধ্যে পাঁচিলের চুন সুড়কির গাঁথুনি শক্তপোক্ত হয়নি একেবারে কখনো।” তবে এই যে অযুত মানুষের হাহাকার ও আর্তচিৎকার, রক্তের দাগ মুছে নতুন করে জীবনখাতায় দাগকাটা — বিন্দু মাসি, শরাফত মিয়ার বউ বকুল বিবি কিংবা ওপারের তরফদার গিন্নি কাকলীদের মতো কত রমণীকে যে মাংস বিক্রির সামিল ও লালসার শিকার –মনুষ্য জীবনের অবনমন সংঘটিত হয়েছে দেশভাগের থাবায় পড়ে বর্ডারের এপার-ওপারে তা সংখ্যাহীন ও অলিখিত।‘শরীরের বাজার’ গল্পে উঠে এসেছে জীবনের আয়োজন ও নারী মাংসের বিকিকিনি।
মুক্তিযুদ্ধের বিশালত্ব ধারণ করার দক্ষ কলম
সৈয়দ রিয়াজুর রশীদকে দিয়ে লিখিয়ে নিয়েছে সেই অসম্ভব ভয়ঙ্কর ও সুন্দর সময় ও পরবর্তী জাতীয় জীবনের চালচিত্র– মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে তিনি লিখেছেন সিদ্ধহস্তে। একাত্তরের সেই ঘাতক সময় ও যুদ্ধজয় নিয়ে বাঙালির জীবনে রয়েছে এক মহাকাব্যিক শিহরণ।
মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক একটি গল্প‘খবরের কাগজে যা থাকে না’ এমনই একটি আখ্যান নিয়ে রচিত ; মুক্তিযুদ্ধ খবরের কাগজে প্রতিফলিত হলেও আরো অনেক কথামালা অন্তরালে চলে গিয়েছে---সেই সব কাহিনী অধরা থেকে যায়। বাংলার যে চিরসবুজ রং ও শ্যামলী নারী হানাদার বর্বরতায় বিপর্যস্ত হলে যুদ্ধের ঘটনাপ্রবাহ লেখকের মনে সৃষ্টি করেছে দারুন ক্ষত –একেকটি অভিঘাত যেন একেকটি কাহিনীর বিস্তার---কী পরম মমতায় ও প্রার্থনায়। তিনি সেই সময়ের কলস্বর ও আর্তনাদ কখনও বেগম হোসনে আরা কখনও রুমানা রহমানের জবানীতে বিধৃত করেছেন। কাহিনীর আবর্তনে একদা একাত্তরের স্মৃতিবিষাদগ্রস্ত রুমানা রহমানের আর্তনাদ বেজে ওঠে, ‘আমি স্বপ্নে খুব অশান্তিতে থাকি। আমার ঠিকমতো ঘুম হয় না। প্রত্যেক সপ্তাহে ২-৩ দিন স্বপ্নে রক্ত, মৃতদেহ কিংবা ক্ষত-বিক্ষত শরীর দেখি। বেশিরভাগই যুদ্ধ দেখি...।” এই বক্তব্যের মধ্যে অরুদ্ধ হয়েছে একাত্তরের ভয়াবহতা । দুঃখদ দগ্ধ লেখক জানাচ্ছেন, ‘বাংলায় এখন রাত্রি বলতেই স্মরণ করতে পারব অন্ধকারবিদ্ধ চিৎকার ও অস্ত্রগর্জন, অগ্নি ফুলকি ও দাহ; মরণের আয়োজনের সঙ্গে হাত ধরাধরি করে প্রাণবন্যাও থাকবে। এই তা রচিত প্রণীত জাগৃতি হবে আরেকটি দিবসের আর পিছু হাঁটবে রাত্রির থাবা। থোকা থোকা রক্তছোবল লতা রাত্রিবেলায় ফোঁটে।” এভাবে গল্পের শরীর ক্ষতবিক্ষত করে উপসংহার রচনা করলেও মনের গভীরে, হৃদয়ের অভ্যন্তরে গভীর এক গাঢ় দাগ কেটে রেখে গেছেন।
বেহুলা লখিন্দরের দেশ বাংলাদেশ, এখানকার প্রকৃতি শাপলা শালুক পদ্মফুলের রূপসজ্জায় সজ্জিত হয়। এখানে বনে- বনে ফোটে ফুল, পাখি গান গায়, নদীতে ভাসে মুজিবরের নৌকা। বাংলাদেশের সৌন্দর্যকথা এক গল্পে যেমন সংগীতের মত অনুরণন প্রবন তেমনি আতঙ্ক, আগুন, মর্টার, কঙ্কাল, হাড়, রক্ত শুকিয়ে বিভৎস রংও পরিলক্ষিত । লেখক এখানে নিরাশার ভেতর আশার আলো প্রক্ষেপনে জ্বালিয়ে দেন নতুন আগুন ও এসব দৃশ্যপটে আনেন আশাজাগানিয়া রং, বলেন- “নৌকা চালায় ফরিদপুরের প্রাকৃত পুরুষ, মাঝির নাম মুজিবর, হাল ধরেছে মুজিবর, ঝড় তুফানে আর কী ডর।”
মুক্তিযুদ্ধ কেন্দ্র করে এমন নান্দনিক রচনায় সেই যুদ্ধদিনে অগ্নিবৃষ্টির মধ্যে রহস্যমানব সাচ্চু মামার ‘সেই রূপালি আগুন ভরা রাতে নিঃশব্দে প্রস্থান’ সূচিত হলে সহসা আবিষ্কৃত হয়, একটি ঝাঁকুনি অনিবার্য হয়ে ওঠে,যেহেতু" বড়ো অসহায় সাচ্চু মামা অতলান্ত ভেদ করে আবার তলদেশে জলের বাগানে গিয়ে মওলাদের কাছে তদ্বির করে…..";অতএব গল্পের শিরোনাম হয় "চতুর্থ দুনিয়ার মালিক"। এও কী সম্ভব মুক্তিযুদ্ধের কথকতায়?
সৈয়দ রিয়াজুর রশীদের গল্পের উপস্থাপনভঙ্গীতে বৈচিত্র্য থাকায় কখনও একঘেয়েমিতে পেয়ে বসেনি। অনেক সময় অসাধারণ উপমার চমৎকারিত্বে পাঠক গল্প পড়তে বাধ্য হবে। ‘তখন জলরাশি ছিল নোনতা’ গল্পটি মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে নয় কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের মূল প্রাণ বঙ্গবন্ধু ও ’৭৫-এর ১৫ই আগস্ট ঘিরে আবর্তিত হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ আর বঙ্গবন্ধু যে এক সুতোয় গাঁথা লেখক তা রেখাপাত করেছেন গল্পবর্ণনায়। আড়াআড়িভাবে তুলে এনেছেন খলনায়কের প্রতিচ্ছবি। গল্প তো নয় যেন পটে আঁকা চিত্র। লেখকের ভাষায়, “বজ্রকণ্ঠ নিস্তব্ধ হওয়ার আগে নেতা বলেছিলেন, তোরা কী চাস? এক ঝাঁক বুলেট এসে ঝাঁঝরা করে দিল তাঁর বক্ষ। গুলির আঘাতে ছিন্ন হলো তর্জনী–সেই তর্জনী: এবারের সংগ্রামে ছিল মুক্তির ঘোষণা--উত্তোলিত আঙুলে যেখানে নির্দেশ ও প্রত্যয়।”
পরিশেষে বলতে হয়, ৪৭ এবং একাত্তর এখন আমাদের থেকে অনেক দূরে তবু সম্মুখে উপস্হিত সুখ- দুঃখের চিহ্ন সাজানো। ঘোরলাগা মানুষকে জাগাবার জন্য তিনি গল্পের মাধ্যমে শুধু বার্তা ও সঙ্কেত, প্রতীক ও আকার প্রকাশ করেন নি বরং আয়নায় দেখিয়েছেন মানুষের মুখ।
সৈয়দ রিয়াজুুর রশীদের সাহিত্যে দেশভাগ ও মুক্তিযুদ্ধ
তুষার প্রসূন
তুষার প্রসূন
মন্তব্য