সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ: সেন্টিমেন্ট, শ্লেষ ও জিজ্ঞাসার মিশেলে বিকল্প স্বরের নির্মাতা
প্রমিথ রায়হান
প্রমিথ রায়হান
দুই বাংলা মিলিয়ে বাংলা কথাসাহিত্যের যেই সুদীর্ঘ পরম্পরা ও তার ধারাবাহিকতা ধরে সমকালে উপনীত হওয়া- ভাসাভাসা জ্ঞান নিয়ে সেই বিষয়ে পন্ডিতি আলোচনা করাটা ধৃষ্টতার শামিল হবে। তার প্রয়োজনও নেই। নানা বিষয়ে বিবিধ উপলক্ষ বা একক ঘটনাকে বিশাল হিসেবে বানিয়ে মূল সত্যকে আড়াল করার যে প্রবণতা সমাজে আমরা দেখি, সময়-সুযোগ বুঝে সেই প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণও করি; অন্তত এই লেখাটিতে তা থেকে নিজেকে বিরত রাখি।
সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ- আশির দশকে পূর্ববাংলার কথাসাহিত্যে বিকল্প স্বরের সন্ধানে ব্যাপৃত একজন কমিটেড কথাসাহিত্যিক; পরিচয়টিকে বিজ্ঞাপন বানিয়ে নেননি- নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সংমিশ্রণে সাহিত্যকর্মে ক্রিয়েটিভিটি ও কমিটমেন্টের স্বাক্ষর আজও বহন করে চলেছেন।
অবাণিজ্যিক ভাষার অধিকারী পূর্বসূরী কথাশিল্পীদের ধারা থেকে বিচ্যুত না হয়েও প্রাতিস্বিক গদ্যভাষায় শ্লেষ, সেন্টিমেন্টের অব্যর্থ ব্যবহারে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেন- মনোযোগী পাঠক কিংবা আন্তরিকতার সাথে যারা লেখা পাঠ করতে সচেষ্ট; তাদের কাছে প্রশ্নগুলো অবধারিতভাবে পৌঁছায়।
মনে রাখা দরকার- নিবিষ্ট সাহিত্যপাঠ অতি অবশ্যই ক্লাসরুমে বসে পরীক্ষা দেওয়ার থেকে প্রক্রিয়াগতভাবে ভিন্ন। প্রশ্নের যথাযথ উত্তর পাওয়া নয়; প্রশ্নের উপস্থিতিকে ঠিকঠাক ধরতে পারাটা অন্তত কথাসাহিত্যের উপযুক্ত পাঠের জন্যে আবশ্যক।
সৈয়দ রিয়াজুর রশীদের কথাসাহিত্যে, যৌনতার বিষয়টি অসংখ্যবার এসেছে। যেই বিষয়টির দিকে লক্ষ রাখা জরুরী তা হলো- উপস্থাপনার ধরণ কিংবা ইন্টারপ্রিটেশনে পাঠককে সুড়সুড়ি দেওয়া কিংবা স্থূল ইন্দ্রিয়চেতনার মধ্যে তাকে আটকে ফেলার প্রলোভন থেকে সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ দারুণভাবে নিজেকে সচেতনভাবে দূরে রেখেছেন।
দুই বাংলা মিলিয়েই বাংলা কথাসাহিত্যের অনেক দিকপাল সম্পর্কেই এমনটা বলা যায়না।
সৈয়দ রিয়াজুর রশীদের ‘শাদা কাহিনী’ গল্পগ্রন্থের দ্বিতীয় গল্পের দিকে মনোযোগ দেই।
'সুপ্রভাত?’ গল্পটির নাম।
গল্পের প্রধান চরিত্র আব্দুল আলিম পাটোয়ারী। লোভী ও ভোগবাদী স্বভাবের। যৌনতার প্রশ্নে বাছবিচারহীন।
“নাহ এই শালা-শালীদের যন্ত্রণায় আব্দুল আলিমের ভালো সব কালো। মাথার খুপড়িতে উদাস হাওয়া ঢুকে পড়ে….. এমনকি এই শালা আব্দুল আলিমের জন্য মানুষ থাকতে পারছেনা আপদবিহীন, সেই জন্যই বুঝি পাশের ফ্ল্যাটের কুত্তার বাচ্চা আহমদ সাহেব বউ নিয়ে চম্পট মারলো!
বউটি ছিলো দারুণ মাল। গায়ের রঙ আবলুস হলে কী হবে, দেখতে দারুণ শিশ্ন পসন্দ! এমন মেয়ে মানুষকে বিছানায় নিয়ে পাঁচ মিনিট পরিমাণ গড়াগড়ি দিতে পারলে শরীরের সব গরম ঠাণ্ডা!” – সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ (সুপ্রভাত?)
শ্লেষ বা বিদ্রুপের উপযুক্ত ব্যবহারে সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ অব্যর্থ। পাঠককে স্থূল বিনোদন দিতে নয়, অন্তর্গত ক্রোধ ও তার অতলে প্রশ্ন ছুঁড়ে যাওয়া যার মুখ্য উদ্দেশ্য।
“হঠাৎ করে সে একটি ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললো- কর্মচ্যুত করতে হবে, পেপারঅলা এবং কাজের মাতারীকে কোনো নোটিশ না দিয়েই তাড়াবে।
এই ভাবতে ভাবতে মিস্টার আব্দুল আলিম পাটোয়ারী লুঙ্গি হাঁটুর ওপর তুলে ভেজা বগলের গন্ধ শুঁকতে শুঁকতে উদাস হয়ে গেলো। ঝুলন্ত বারান্দায় একটি কাক উড়ে এসে ক্ষণিক যাত্রা বিরতি করলো। মাথার ৪/৫ হাত ওপর হ’তে অব্যর্থ নিশানা পিচিৎ!” – সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ (সুপ্রভাত?)
আমার ব্যক্তিগত বিচারে, সৈয়দ রিয়াজুর রশীদের সবচেয়ে শক্তিশালী গল্পগুলোর একটি হলো ‘মানবিক পাশবিক’। গল্পটির পরতে পরতে self exploration এর উৎকৃষ্ট প্রমাণ রয়েছে।
গল্পের শুরুটা এরকমঃ
“আমার ভিতরে একটা পশু ঘাপটি মেরে বসবাস করে যাচ্ছে এই বিষয়টা আমি বয়স বাড়ার পর ঠিকঠাক মতো বুঝে উঠতে সক্ষম হই। আমার এই উপলব্ধিতে কোনোরকম ভুল নাই।”
গল্পটির ক্রমবিকাশে এই লাইনগুলোর দিকে মনোযোগ দেই-
“পালিত পশু আর বহাল মানুষ এই দুই নিয়ে আমার ঘর গেরস্থি। আলো- আঁধারির মতো খেলা করে চলে। একজন হচ্ছে আলো আর অন্যটা অন্ধকার। আলো ও অন্ধকারের এই যুগলবন্দি দীর্ঘকাল যাবৎ যাপন করে যাচ্ছে। ক্লান্তিহীন। বিরামহীন। সীমাহীন। দীর্ঘদিন। কেউ কাউকে কখনো পরাস্ত করতে পারেনা। একজনের জিৎ হলেও তা বিচার করে রায় দেওয়ার মতো কেউ নেই। বোবা একধরণের বিব্রতবোধ প্রকাশিত থাকে বলে বিচারের ফল জানা হয়না।”
গল্পটির প্রধান চরিত্র যে ‘আমি’; তার মদ্যপান, যৌনতা ও বান্ধবী ঐশীর চরিত্রায়নে এক ধরণের কমপ্লেক্স পরিস্থিতি আমরা গল্পটিতে লক্ষ করি। চিরাচরিত বাংলা গল্পগুলোর থেকে যা স্পষ্টভাবে পৃথক অবস্থানে দাঁড়িয়ে থাকে। নিচের লাইনগুলো পড়িঃ
“যে ফোন করেছে তার নাম দেখে কল-রিসিভ করতে ইচ্ছা করলোনা। ফোন করেছে ঐশী। ও হচ্ছে লেসবিয়ান। ওর সঙ্গে খামোখা কথা বলে কাজ নাই কারণ ওসব হবে টবে না। একটা কড়া সঙ্গমের সম্ভাবনা থাকলে না হয় ফোনটা ধরা যেতো তার চেয়ে বরং এখন নিজেকে মেরামত করে নেওয়া যেতে পারে। পরে কলব্যাক করা যাবে।”
ডমেস্টিক ভায়োলেন্স ও ধর্ষণের মতো স্পর্শকাতর ইস্যুগুলোকেও সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ উল্লিখিত গল্পে দারুণভাবে একোমোডেট করেছেন। প্রসঙ্গানুসারে ভারতে ধর্ষণ মামলায় ন্যায়বিচার সুনিশ্চিত করতে ফৌজদারী বিধিতে সংশোধনী আনা হচ্ছে এই তথ্যটিও গল্পে উল্লেখ করেছেন। গল্পে কিছু লাইন এরকমঃ
“আমার এক বন্ধু আছে। কাজের মেয়েকে ধর্ষণ করার মধ্য দিয়ে ওর যৌনজীবন শুরু হয়েছে। ধর্ষণ করার উত্তেজনা অন্যরকম। এই উত্তেজনার কোনো তুলনা হয়না। ও আমাকে দেখা হলেই সুযোগমতো ধর্ষণ করার জন্য অনুপ্রাণিত করে। এই উত্তেজনার সঙ্গে পরিচিত হওয়া যে কোনো পুরুষের জীবনে একবার জরুরী। প্রথমে যৌনতার উত্তেজনায় যখন নারীদেহের উপর চড়াও হলে প্রাথমিক স্তরে যোনি অবাধ্য আচরণ করলেও একসময়ে তা বাধ্য হয়ে ওঠে এবং স্বয়ংক্রিয়ভাবে প্রবিষ্ট শিশ্নটিকে একধরণের ক্রমাগত আকর্ষণ ও অন্তর্মুখী চাপের মধ্যে দিয়ে শরীরের মধ্যভাগে যেই রহস্যময় গুহার ভেতর টেনে নেয়। বন্ধুটা এই রকমই একটা বয়ান দিয়েছিলো।”
পাঠক, লক্ষ করুন- উপস্থাপনার ভঙ্গিতে রিরংসা উসকে দেওয়ার প্রবণতা এখানে একেবারেই অনুপস্থিত। অন্তর্গত ক্রোধের প্রকাশটাই এখানে মুখ্য।
গল্পটিতে বিয়ে সম্পর্কে প্রধান চরিত্রের ভাবনাটা উঠে আসে এভাবেঃ
প্রচলিত সামাজিকতার মাপকাঠিতে দেখলে বিবাহমাত্রই বিষমকামী। একজন পুরুষ নারীর অংশগ্রহণ বাধ্যতামূলক। বিবাহ মানে সন্তান ধারণ, সন্তান ধারণ মানে যৌনতা। যৌনতায় অবতীর্ণ হওয়া এইভাবে, বিয়ের রাতে স্বামীর সঙ্গে বিছানায়, তারপর একই বিছানায় নিয়মিত দেহমিলন, কী নারীর সামাজিক ভূমিকা।”
রাজনৈতিক– অর্থনীতির একটি বিশেষ দিকও সৈয়দ রিয়াজুর রশীদের ‘AM I BEING PARANOID?’ গল্পে সুনিপুণভাবে উঠে এসেছে। এই গল্পের প্রধান চরিত্র কামরুজ্জামান ভূতের গলির নামকরণের বিষয়ে ৫ পর্বের তদন্ত প্রতিবেদনের এসাইনমেন্ট পায়। নর্থ রোডে ডেভেলপারদের আনাগোনায় পরিবর্তিত চেহারা দেখা গেলো। সেই এলাকার মানুষদের মধ্যে দ্রুত ধনী হবার বাসনা দেখা গেলো। ডেভেলপারদের আধিপত্যের সাথে সঙ্গতি রেখে ডিশের ব্যবসায়ীদের রমরমা দেখা গেলো। স্ফিত হতে শুরু করলো ডিশের ব্যবসায়ীরা। পাড়ার আদি মুদি দোকানগুলো টিকতে না পেরে ঝরে পড়তে আরম্ভ করলো। ডোবানালাগুলোও ভরাট হয়ে যায়। নতুন উঠতে থাকা দালানকোঠাগুলো এলাকাটির অবয়ব ও এলাকাবাসীর মনোজগতে সমূহ পরিবর্তন ঘটায়। গল্পের শেষে দেখা যায় যে নিজের দু-কামরার ফ্ল্যাটে কামরুজ্জামানের মৃত্যু ঘটে। জানাজানি না হওয়া পর্যন্ত মৃতদেহ অনেকটা সময় পঁচছিলো। ভূতের গলি নিয়ে এসাইনমেন্টটির কাজ আর তার শেষ করা হয়না।
সৈয়দ রিয়াজুর রশীদের কথাসাহিত্যে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় হিসেবে বিভিন্ন লেখায় উঠে এসেছে। এক্ষেত্রে উল্লেখ্য যে, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে গল্প- উপন্যাস রচনার বেলাতে এমন লেখার সংখ্যাই আমরা অনেক বেশী দেখি যেখানে সেন্টিমেন্টের প্রাবল্যে ফেনায়িত বিবরণ এবং ভাবালুতার আধিক্যে দুর্বল। সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ তুলনামূলকভাবে বিষয়টি নিয়ে ডিল করার ক্ষেত্রে যথেষ্টই সংহত। সেন্টিমেন্টের যেই প্রাবল্য তার লেখায় টের পাওয়া যায় তা স্বাভাবিক বোধবুদ্ধিকে ভাসিয়ে নিয়ে যায়না। মুক্তিযুদ্ধ সৈয়দ রিয়াজুর রশীদের কথাসাহিত্যের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর একটি বলে অবধারিতভাবে সেখানে শেখ মুজিবুর রহমানও উঠে আসেন নানাভাবে। ‘তখন জলরাশি ছিলো নোনতা’ গল্পে আমরা ১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্টে শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি উঠে আসতে দেখি। হত্যাকাণ্ডটির বিষয়ে সৈয়দ রিয়াজুর রশীদের অন্তর্গত শোককে সংহত কিন্তু শক্তিশালী রূপে আমরা প্রকাশিত হতে দেখি।
প্রযুক্তির অভাবনীয় উল্লম্ফন এবং তার সাথে সমান্তরালে বেড়ে চলা ভোগবাদী মূল্যবোধ ও সাম্প্রদায়িক মূল্যবোধের পুনর্জাগরণের ইঙ্গিত পাওয়া যায় সৈয়দ রিয়াজুর রশীদের ‘জ্বলছে শহর ভীষণ এক নেগেটিভ তীব্রতায়’ গল্পে। প্রযুক্তি বিশেষত ইন্টারনেটের বদৌলতে গ্রামে গ্রামে মানুষের কাছে যে কোনো বিষয়ে তথ্যাবলী পৌঁছে যাচ্ছে। গল্পে লেখা হচ্ছে- “ইন্টারনেট Open করো, Google-এ সার্চ দাও, কামসূত্র হতে জীবন সূত্র হাজির জাঁহাপনা।” অন্যদিকে সংখ্যালঘুদের প্রতি বিদ্বেষ ও আধিপত্যের তাড়নার পুনর্জাগরণের আভাস আমরা দেখতে পাই গল্পের শেষে এসে-
“জিন পরির দেশ বাংলাদেশ। এখানে ঘোরাফেরা করে ইয়াহিয়ার প্রেতাত্মা। পেতনি এসে জিহ্বা ভেংচায়।”
সৈয়দ রিয়াজুর রশীদের ‘ছায়া আবছায়া’ উপন্যাসটি জীবনানন্দ দাশ, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, অদ্বৈত মল্লবর্মণ এবং সঞ্জয় ভট্টাচার্যকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়েছে। ১ম বিশ্বযুদ্ধ থেকে ২য় বিশ্বযুদ্ধ মধ্যবর্তীকালীন উপরিউক্ত ৪জনের দোদুল্যমান জীবন মরণের গল্পকে ঔপন্যাসিক লিখেছেন যেনো তাদের এক্সরে রিপোর্ট লিখছেন। উপন্যাসটির পরতে পরতে ঔপন্যাসিকের নিজস্ব বিশ্লেষণ মূর্ত হয়ে ওঠে, তার প্রাতিস্বিক গদ্যভাষায়। উপন্যাসটির শুরু হয় জীবনানন্দ দাশের মৃত্যুশয্যায় শায়িত অবস্থা থেকে।
“চোখের রয়েছে ভাষা, এবং ভাষাকে পড়বার জন্য আবার আরেক চোখ; চোখময় এই সমাজ সংসার কতো না দেখে যায়- ক্লান্তিহীন। পুষ্প ও কন্টক, নরক ও জোৎস্না, অমাবস্যা ও দীপ্তি, সাত আসমান কিংবা সমুদ্রের জন্য জলরাশি, শব্দময় কল্লোলিনী চোখেরই আবিষ্কার।” – সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ (ছায়া আবছায়া)
উপন্যাসটিতে আমরা দেখতে পাই, জীবনানন্দ দাশ, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ও অদ্বৈত মল্লবর্মণের জীবনের গল্প সমান্তরালে চলে। উপরিউক্ত ৩জনের জীবনের খুঁটিনাটি নানাদিক ঔপন্যাসিকের সবল গদ্যভাষায় এগোতে থাকে। আমাদের অনেকের জানা বিবিধ তথ্যাবলীর সমাহারে।
জীবানানন্দ দাশের বিপর্যস্ত ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনের বিভিন্ন দিক ঔপন্যাসিক তুলে ধরেন; অন্তর্লীন বেদনায়। জীবনানন্দ দাশের নিশ্চেতনার কিঞ্চিত প্রতিফলন আমরা দেখি এই লাইনগুলোতেঃ
“মৃত্যুর পরে মানুষের অনেক প্রিয়জনের সঙ্গ হয়। সেই জন্য মৃত্যুর খোঁজ পড়ে- কোথায় রয়েছে মৃত্যু? কোন দিকে? খুঁজি আমি তাকে? এমন কথা তো একবার নয়, অনেকবার ভেবেছিলো লোকটা। মৃত্যুর আগে, হাসপাতালের বিছানায়, ভাঙ্গাচোরা শরীরে গুনে- গুনে দশদিক দাপিয়ে অবশেষে নিঃশ্বাস নেওয়া থেকে প্রত্যাহার করেছিলো নিজেকে।”
বাবা, মা থেকে শুরু করে স্ত্রী লাবণ্য দাশের চরিত্রের বিভিন্ন দিক ঔপন্যাসিক তুলে ধরেন সুনিপুণ দক্ষতায়।
আমরা উপন্যাসটিতে সাহিত্যে মানিকের উত্থানের গল্পটি জানতে পারি- তথ্যগুলো চেনাজানা, কিন্তু ঔপন্যাসিকের বিকল্পধর্মী উপস্থাপনায় আমরা সেগুলোকে পাঠ করতে বাধ্য হই ভিন্নভাবে।
রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষায় হতাশা, ব্যক্তিগত জীবনের বিপর্যস্ততা, ক্রনিক মদ্যপানের সংকট- মানিকের অন্তর্লোকের হাহাকার ফুটে ওঠে এভাবেঃ
“তার খুব খারাপ লাগে, নিশ্চয়ই বাবা শেষ জীবনে আশা করেন নাই, এই তার পুত্র, লেখক বলে নামডাক পেলেও দারিদ্র্য ও ব্যাধির কাছে ক্রমাগত ধুঁকছে। সে, অপর পাশ থেকে বাবার দীর্ঘশ্বাস, আক্ষেপ ও কষ্ট, এবং মঙ্গল কামনায় আর্তি শুনতে পায় হামেশা।
সে কি খ্যাতিমান কোনো মানুষ? খ্যাতিমান লোকদের ঘর ও পরিবেশে কি এমন হয়?- অনেক ভাবনা চারদিকে গিজগিজ করছে।”
উপন্যাসটি ক্রমশ এগিয়ে যায় বিভিন্ন টার্ন এন্ড টুইস্টের মধ্য দিয়ে। আদি-মধ্য-অন্ত, গল্প বা উপন্যাসের প্রচলিত ফর্ম থেকে ভিন্নভাবে উপন্যাসটি এগিয়ে চলে। তৎকালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও সাহিত্যিক রাজনীতির বিভিন্ন দিক সম্পর্কে আমাদের স্পষ্ট ধারণা হয়।
উপন্যাসের শেষে এক আশাবহ সম্ভাবনার ইঙ্গিত দিয়ে ঔপন্যাসিক লেখেনঃ
“বিকালে কোনোদিন ঘুম ভেঙ্গে গেলে আবার লিখতে আরম্ভ করবো। আলো ছায়া অন্ধকার- এই তিন সত্তাকে বুঝে নিতে, অমৃত কুম্ভের সংবাদ নিতে, বই যখন সহস্র পাতায় অজস্র শব্দখচিত করলো এই হিজিবিজি মুখবন্ধ, পাশাপাশি, শেলফে তুলে রেখে দিলাম… অপেক্ষা, বিকেলে ঘুম ভেঙ্গে জেগে উঠবার…”
সৈয়দ রিয়াজুর রশীদের উল্লেখযোগ্য একটি উপন্যাস ‘অমীমাংসিত আলো- আঁধারি’। উপন্যাসটির কেন্দ্রীয় চরিত্র রাশেদ। রাশেদের জীবনকে কেন্দ্র করে ঔপন্যাসিক উপন্যাসটিতে দক্ষতার সাথে বিবিধ বিষয় ডিল করেছেন। যৌনতাবোধ, পুরুষতান্ত্রিক মূল্যবোধের অনুগামী যেই অবরুদ্ধ যৌনতা; অবদমন উৎসারিত সেই শারীরিক ক্রিয়ায় মনোজগত নির্মিত ও চালিত হয় এবসার্ডিটির দ্বারা।
যান্ত্রিক সভ্যতার আধিপত্যে যৌনতা যান্ত্রিকতায় পর্যবসিত হয়। আমরা পড়ি-
“মধ্যরাতে, চোখে ঘুম নাই, নির্জনতা, ক্রমে, রাস্তার কোলাহল মিলীয়মান- জেগে থাকা পুরুষ আর যে নারী থাকে আবিষ্কার করে কখন যন্ত্রগুলো সব যেনো ধীরে ধীরে হয়ে ওঠে অযান্ত্রিক। প্রেম-যৌনতা-ভালোবাসা সব কিছু হয়ে ওঠে যন্ত্র। কম্পিউটার, মোবাইল ফোন এই সব যন্ত্র আবেগশূন্য তবু প্রেম-যৌনতা-ভালোবাসা সঞ্চালন করে।”
“এই মধ্যরাতে একাকী হাহাকার করে ওঠে রাশেদ। শরীর, শরীর। তোমার মন নাই সেলুলার, তোমার মন নাই কম্পিউটার। যৌনতার মাধ্যমের জন্য এখন আর কোনো প্রাকৃতিক আবহের দরকার হয়না। মোবাইল, টেলিফোন, চ্যাট মেইল-ই এখন মাধ্যম। টেলিফোন সেক্সের যুগে যদি শিৎকারে কম্পিত হতে হয় তা আর প্রেমিকার বুকে মাথা রেখে নয়, যন্ত্রকে তীব্রভাবে জড়িয়ে ধরে রেতঃপাত করতে হবে। আজ যৌনতাও এক যন্ত্র।”
উল্লিখিত উপন্যাসটিতে সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ একটি স্পর্শকাতর সামাজিক-রাজনৈতিক ইস্যুকে সামনে এনেছেন। প্রধান চরিত্র রাশেদের জীবনের গল্প বলার মাধ্যমে। সেটা হলো- মাদ্রাসায় শিশু ছাত্রদের ওপরে সংঘটিত হওয়া যৌন নিপীড়ন। রাশেদের শৈশবের একটা বড়ো অংশ অতিবাহিত হয় খলিফা হুজুর দ্বারা ধারাবাহিকভাবে যৌন নিপীড়নের শিকার হয়ে। আমাদের দেশের সামাজিক-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বিচারে উপন্যাসে এমন বিষয়কে উপস্থাপন করাটা শুধুমাত্র দুঃসাহসিক তাই নয়; উপস্থাপনা দুর্বল বা নড়বড়ে হলে তা উপন্যাসের সামগ্রিকতাকে রুগ্ন করে তুলতে পারে। আমাদের সৌভাগ্য, এই উপন্যাসটিতে তেমন দেখা যায়নি। অত্যন্ত স্পর্শকাতর একটি বিষয়কে ঔপন্যাসিক যেই সবলতায় উপস্থাপন করেছেন; তাতে উপন্যাসটির গুরুত্ব নিশ্চিতভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।
উল্লিখিত উপন্যাসটিতে ভারত উপমহাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর একটি উঠে এসেছে। তা হলো দেশভাগ। ভারত, পাকিস্তান এবং পরবর্তীতে বাংলাদেশ- এই ৩টি রাষ্ট্রের জন্ম বা উত্থানে দেশভাগ একটি অনুপেক্ষনীয় প্রপঞ্চ। এই ডিসকোর্স নিয়ে রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক-সামাজিক প্রতিটি পরিসরেই বিপুল পরিমাণে আলোচনা, তর্ক-বিতর্ক চলে; বিষয়টির অনতিক্রম্য অনিবার্যতায়। ঔপন্যাসিক উপন্যাসটিতে প্রেক্ষিতের প্রয়োজনে বিষয়টি ডিল করেছেন নিজস্ব বিশ্লেষণে। ইতিহাস, মিথ, হিন্দু-মুসলমানের মধ্যকার দ্বন্দ্ব, দেশভাগের আগেপরের বিভিন্ন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও হামলার বিষয়গুলো উপন্যাসটিতে এসেছে; উপন্যাসটির সামগ্রিকতায় নতুন মাত্রা যুক্ত হয়েছে। এক্ষেত্রে যা বিশেষ মনোযোগের দাবি রাখে তা হলোঃ আদি-মধ্য-অন্ত এই ফর্মে উপন্যাসটির অন্যান্য বিষয়গুলোর মতো এই বিষয়টিও সেভাবে এগোয়নি। ফলে পাঠের ক্ষেত্রে বাড়তি মনোযোগ তো বটেই, উপন্যাসের অন্যান্য আনুষাঙ্গিক বিষয়গুলো কীভাবে এই বিষয়ের সাপেক্ষে নির্মিত ও বিশ্লেষিত হয়েছে তার দিকে লক্ষ করাটাও জরুরী হয়ে দাঁড়ায়।
বিশ্লেষণই চূড়ান্ত কথা নয়- বিশ্লেষণের মাধ্যমে ক্রমশ সত্যের সম্ভাবনার দিকে পৌঁছানো এবং তার সাহায্যে জীবনের সৃষ্টিশীল ও সম্ভাবনাময় নির্মাণের জন্যে প্রয়োজন আশা বা সম্ভাবনার জায়গাগুলোকে শনাক্ত করে তাতে আস্থা রাখা। ধর্মীয় অর্থে না হলেও, দার্শনিক অর্থে আস্তিকতার যেই শক্তি; তার এক ধরণের স্বীকৃতি পাওয়া যায় নিচের লাইনগুলোতেঃ
“আমি সত্যের মধ্যে মিথ্যার বীজ, বীজের মধ্যে স্বপ্নের মৃত্যু, মৃত্যুর মধ্যে বিলাস, দেখার মধ্যে না-সত্য এবং হ্যাঁ-মিথ্যার একটা জালিকাবিন্যাস দেখতে দেখতে কোথায় যে উবে গেলো চরিত্রটা- সেদিকে খেয়াল করিনা। ভাবি, মিথ্যা হোক। স্বপ্নের মধ্যে হাবিজাবি শাদা-কালোর মধ্যে হাতড়ে বেড়াই মিথ্যার সুরতহাল প্রতিবেদন।”
‘অমীমাংসিত আলো-আঁধারি’র যেই কমপ্লেক্স বা জটিল বিস্তার; তার অতলে থাকা দার্শনিক অনুসন্ধান, তার ভেতর থেকে ব্যক্তিমানুষের চেতনার উন্মেষ, জীবনের সম্ভাবনার জায়গাগুলোকে শনাক্ত করে তার সৃষ্টিশীল নির্মাণের তীব্র আকাঙ্ক্ষা- সৈয়দ রিয়াজুর রশীদের উপন্যাসে আমরা তার প্রতিফলন দেখি। শ্লেষ, হাহাকার, প্রতিটি স্তরে সূক্ষাতিসূক্ষ বিশ্লেষণ- এসবের যোগফলে সমগ্র লেখাটি যেভাবে দাঁড়ায় তা শুধুমাত্র চিন্তাশীল পাঠ দাবি করে তাই নয়, বিবিধ জরুরী বিষয়ে আমাদের পুনরায় ভাবতে বাধ্য করে। খেয়াল করা দরকার, এই চিন্তাশীলতার প্রক্রিয়াটি অলস অবসরের আরামপ্রিয়তাকে অনুমোদন করেনা। তাই, পাঠপরবর্তীকালেও ভাবনাগুলো উপন্যাসের বিষয়গুলোকে দেখার ক্ষেত্রে সৃষ্টিশীল মননের দাবি করে।
একজন বিকল্পধারার কণ্ঠস্বর হিসেবে সৈয়দ রিয়াজুর রশীদের সামগ্রিক সাহিত্যকর্মের মাঝে আমরা পাঠকদের কাছে তার এই আকাঙ্ক্ষাটুকুই বিভিন্নভাবে হাজির হতে দেখি। জানার স্তর থেকে বোঝার স্তরে উপনীত হবার জন্যে তার সামগ্রিক সাহিত্যকর্মের দিকে মনোযোগ দেওয়াটা সে কারণে আবশ্যক।
মন্তব্য