গল্পের শরীরে গল্প না থাকলে কী হয়? গল্পকে গাঁথা থাকতেই হবে সে-শরীরে? কোনো মাপকাঠি নেই নিশ্চয়ই। কেন এত কথা গল্পের শরীরের গল্প নিয়ে? যে-সময়ের কথা বলছি, সে-সময়টা যে গত শতকের আট বা সর্বজনগ্রাহ্য আশি দশক। এ কোনো সোজা দশক নয় যে গল্পকাররা গল্পের মধ্যে শুধু গল্পই বলতে থাকবেন। বাংলাদেশের সাহিত্যে এ দশক একটা কারণে গুরুত্বপূর্ণ যে, এখানে গল্পকে প্রাধান্য না দিয়ে, এর শরীরকে প্রাধান্য না দিয়ে, এর মনকে দেয়া হয়েছে প্রাধান্য। ফলে গল্পরসের মাদকতা কিছুটা ক্ষুণ্ণ হয়েছে সত্য, কিন্তু পাওয়া গেছে অভূতপূর্ব এক স্বাদের নিশ্চিতি। চিরকালের প্রমিত রীতির গল্পভাষাকে এড়িয়ে গিয়ে, তার আখ্যানধর্মিতাকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে নতুন ভাষায় কথা বলার চেষ্টা, নতুন ভাষারীতি আবিষ্কারের চেষ্টা, নিজেকে অন্যদের কাছ থেকে ভিন্নধর্মী হিসেবে পরিচিতি পাবার চেষ্টায় এ দশক বিদ্রোহ করে বসে। পশ্চিমবঙ্গের বাংলাভাষার বিদ্রোহী লেখকদের নতুন ভাষারীতি আবিষ্কারে সূত্র ধরে বাংলাদেশেও তা প্রাণ পায়। এবং তা প্রাণ পায় আমাদের প্রথাবিরোধী, প্রতিষ্ঠানবিরোধী লিটলম্যাগ আন্দোলনের ফলে। ছোট ছোট দলে, ছোট ছোট পত্রিকাকে ঘিরে দাঁড়াতে থাকে এক-একটা সাহিত্যগোষ্ঠী। এ গোষ্ঠীগুলো নতুন নতুন রীতি গড়তে গিয়ে সাহিত্যশিল্পের অন্যান্য অনুষঙ্গের মতো ছোটগল্পকেও ভাঙতে চেয়েছে সহজাতভাবেই। শুধু গল্পের শরীর থেকে গল্পকে বিদায় দেয়া না, বিদায় দিয়েছে চিরকালীন ম্যাড়মেড়ে, দুমড়ানো, চর্বিতচর্বণ ভাষারীতিকেও। এর সাথে যোগ হয়েছে লেখ্যরীতির সব অনুষঙ্গকে এক মে নিয়ে এসে গল্প বলার চেষ্টা। প্রবন্ধ, কবিতা, গান, দিনলিপি, স্বগতোক্তি, প্রতিবেদন, ভ্রমরচনাসহ নানান অনুষঙ্গকে একই শরীরে কোলাজ করে অপেক্ষাকৃত জটিল, একই সঙ্গে মননশীল রচনা উপস্থাপনের মাধ্যমে এইসব লেখক তাঁদের নতুন প্রস্তাব পেশ করেন আমাদের সাহিত্যজগতে। ব্যাপারটা যে শুধু এরকম তা-ই নয়, এ-ধারার লেখকরা তাদের বাক্যবিন্যাসে আনেন জটিলতর পরীক্ষানিরীক্ষা। যেন ইচ্ছা করেই আবহমানকালের বাক্যরীতিকে নতুন আঙ্গিকে তাঁরা সাজাতে চান। এমনও হয়েছে যে, কোনো কোনো গল্পের শরীরে প্রধানতম বিরামচিহ্ন দাঁড়ি পর্যন্তও দেয়া হয়নি। লেখক হয়ত এর মাধ্যমে বোঝাতে চান যে, আমার গল্প তো ‘শেষ হইয়াও হইল না শেষ’-- কেন এখানে অযথা দাঁড়ি পড়বে! আবার এমনও দেখা গেছে, কোনো কোনো গল্পের শেষে একটিমাত্র দাঁড়ি কোনোরকমভাবে রাখা হয়েছে। দাঁড়ির কাজগুলো সেক্ষেত্রে হয়ত করেছে কমা-রা!
এখন কথা হল, নতুনভাবে গল্প বলার এই কৌশল তা কি কালের ধারায় শেষ পর্যন্ত টিকবে? এতদিনের গল্প শোনার খায়েশ ছেড়ে নতুন এই রীতি কি পাঠক আত্মস্থ করতে পারবে, নাকি তারা তা ছুঁড়ে দেবে ডোবানালার আবর্জনায়? আশার কথা, নতুন রীতিকে পুরাতনরা আত্মস্থ করতে না পারলেও নতুনরা, নতুন প্রজন্মের পাঠকরা ঠিকই ধরতে পারে বা পারবে বলে অনুমান করা যায়। নইলে সাহিত্য তার গতিধারা কালে কালে পাল্টাত না; এত এত নতুন স্বাদের দিকনির্দেশনার খবর আসত না এ জগতে। এই গল্পের শরীরকে ভাঙার চেষ্টা, সেটা কি শুধু শুধু গল্প থেকে গল্পকে হাওয়া করে দেয়া, বাক্যবিন্যাসে নতুন ভঙ্গি আনা বা নতুন ভাষারীতি তৈরি করা, কিংবা সব সাহিত্যশিল্পকে এক মে আনার চেষ্টা করা, নাকি এর ভেতরের সত্যকে, ভিতরের বক্তব্যকেও প্রাণ দেয়া? এতক্ষণ যে ছোটগল্পের শরীর নিয়ে বলা হল, তা বাদ দিয়ে এবার আমরা চলুন ঢুকে পড়ি ছোটগল্পের মনের মধ্যে। এ কালজাত গল্পলেখকদের মনটা আমরা বুঝে নিতে চাইব কিছুটা বিশ্লেষণাত্মক ভঙ্গিতে। আর আশির দশকের অন্যতম প্রধান একজন লেখকের গল্প বিশ্লেষণ করেই আমরা এ-পথটা এগোব। গল্পকারের নাম সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ। তিনি গল্পকার। লিখেছেন প্রবন্ধ, উপন্যাস, ছোটদের জন্য আখ্যান। কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনি মূলত গল্পকার। টিপিক্যাল আশি দশকের গল্পকার।
সৈয়দ রিয়াজুর রশীদের গল্প পড়ত গেলে একটা কথা মনে রাখতে হবে, গল্পের ঘনঘটা না থাকলেও তাঁর গল্পে গল্প-শোনানোটা কেমন যেন শেষ পর্যন্ত হয়েই ওঠে। তবে সব গল্পে নয়, কয়েকটিতে। আবার এমনও হয় : স্বাভাবিক বোধবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষকে দিয়ে গল্পকার রাষ্ট্র-সমাজের আসল অবস্থাটা বোঝাতে পারছেন না, তাঁর লাগে এমন-সব চরিত্র, যারা কিনা নিজে বিকারগ্রস্ত, মাতাল, আত্মমগ্ন, আত্মপর, ভোগ ও সম্ভোগলীলায় মত্ত। সুস্থস্বাভাবিক চরিত্রের মাধ্যমে গল্পের বিবৃত হওয়া তো অনেক দেখেছে বাংলাসাহিত্য, আর কত! এইসব চরিত্রের চোখ দিয়ে ভোগসর্বস্ব সমাজকে দেখাতে গেলে একটা তরঙ্গক্ষুব্ধ অভিব্যক্তি হয়ত প্রকাশ পাবে, তবে তা হয়ত হবে উপরিতলভ্রমণসর্বস্ব। অন্তঃস্হল দেখাতে প্রয়োজন পড়বে মনোবিকারগস্ত চরিত্রের। এবং সেটাই ঘটেছে সৈয়দ রিয়াজুর রশীদের অন্যতম শ্রেষ্ঠ গল্প ‘মানবিক পাশবিক’-এ। একটু পরিচয় মিলুক উত্তমপুরুষে বিবৃত গল্পের প্রধান চরিত্রের দশার :
আমি আমার ভিতরে আবাসিক পশুটাকে ঘৃণা করি কিন্তু ঐ পশুটা আমাকে বহুৎ আদর করে। আমার সঙ্গে মাখামাখি করে বাস করে। পশুটাকে আমার মধ্য থেকে দূর করে ফেলতে চাই কিন্তু পশুটা নাছোড়বান্দা। একটা ভূতের মতো পশুটা আমার ঘাড়ে দিব্যি বসে। পশুটা আমার মধ্যে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে থাকে। পশুটা আমার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গি হয়ে গেছে। পশুটা আমার সঙ্গে প্রেমিকের মতো জড়িয়ে থাকে।
গল্পটির আরেকখানে–
মুখের মধ্যে স্পর্শ করে দেখলাম। দুইটা চোখ আছে তবে একটা উপরে আর একটা নিচে। নাকটা ডানদিকে হেলে গেছে। কানটা ঝুলে গেছে দুইরকম মাপ ও আকারে। ঠোঁট উলটে আছে। জিহ্বা ভেংচি কাটার মতো ভাব ধরে আছে। দাঁতগুলো সব ই-ই-ই করে আছে। দুইটা পা ছোট-বড়ো লাগছে। শিশ্ন ও পশ্চাৎদেশ আগে-পিছে হয়ে গেছে। দুইটা হাতের স্ক্রু আলগা হয়ে গেছে।
মায়ের মত্যুসংবাদপ্রত্যাশী তরুণটি নিজের দূর কি অদূরকালের সংঘবদ্ধ যৌনলালসা মেটাবার সংবাদটি একফাঁকে দিয়ে সে আমাদের জানিয়ে দেয় তার পাশবিকতাকে। মদের প্রতি মারাত্মক আসক্তি তাকে চিহ্নিত করে দেয়, সে মাতালদের মধ্যে মাতালতম। অথচ সে পৃথিবীচেতন মানবিক মানুষ। আত্মমগ্ন হলেও, যৌনগ্রস্হ হলেও সে মানবিক। রোগিবহনকারী অ্যাম্বুলেন্সে নিজেকে প্রতিস্থাপনকারী মানুষটি যে সূক্ষ্ণ অনুভূতিপ্রবণ, তা আমরা জেনে যাই। গল্পের প্রধান চরিত্রের ওপর একটা মায়াজ অমোঘ টান আমরা পেতে শুরু করি ক্রমে ক্রমে।
গল্পের মধ্যে বীভৎস রসের আলামত আছে। যৌনতার রস বয়ান আছে। নারীশরীরের জ্যামিতি আছে। সঙ্গমের সঘন চিত্রায়ণ আছে। সমকাম নিয়ে সরস বিবৃতি আছে। কিন্তু তাতে ধরা পড়ে মননশীলতার আলামত। উদাহরণ বিক্ষিপ্তভাবে–
প্রবল প্রতিরোধের মধ্য দিয়ে বীর্যপাতের একটি ধ্বনি কানে এসে পৌঁছায়।
....
পেনিট্রেশন। ইরেকশান। লাগানো– যেন একটা ভূখন্ড দরকার। যে ভূখন্ডের কোনো স্বাতন্ত্র্য নাই। যে ভূখন্ডকে দখল করা যায়–পেনিট্রেশন। স্তন, যোনি, নিতম্বসহ একটি শরীর নাকি একটা নির্দিষ্ট নৈর্ব্যক্তিক স্পেস। যে স্পেসের কোনো স্বাধিকার অনস্বীকার্য। যে শরীর নিজে স্বাধীনভাবে ক্রিয়াশীল নয়, যে শরীর অপরের যথেচ্ছ ক্রিয়াশীলতায় অর্থবহ হয়ে ওঠে।
....
মেদ ও ত্বকের নিচে থাকবে মাংস। নারীমাংস।
সালোয়ার কামিজ খুললে লাফিয়ে বেরিয়ে আসবে স্তন, নিতম্ব।
যোনি গভীর হয়ে থাকে। কেশ থাকবে যোনিতে।
তারপর ত্বক ও মদ ঢেকে রাখে এইসব স্তন, যোনি, নিতম্ব, কটিদেশ। ঢেকে রাখে হাড়গোড়, শিরা, ধমনী, ওদের শরীরের প্রবাহিত রক্ত।
....
আমাদের দেখলে ও শরীর থেকে একে একে সব বস্ত্র খুলে ঢিল দিয়ে ফেলে দিত।
নিরাভরণ শরীরে শুয়ে পরত।
কখনো চিৎ হয়ে। কখনো উপুড় হয়ে।
যখন চিৎ হয়ে থাকত আমরা কেউ ওর উরুসন্ধি অভিমুখে আসা মাত্র কোনো কথা বলতে হত না; কোনো চাপ প্রয়োগ করত না।
মেয়েটা উরু ফাঁক ও জংঘার উত্থান করত।
উপুড় হয়ে শুয়ে থাকলে কুকুরের মতো, হামাগুড়ি দেওয়ার মতো করে একটা আসন বানিয়ে দিত।
যোনি আমাদের বাড়িয়ে দিত।
গল্পের শরীরে যৌনতার উদ্গীরণ আছে ঘন ঘন– সে পাশবিকতার প্রকাশ। কিন্তু শেষের উদ্ধিৃতিতে যৌনতার যে অসহ তীব্রতা আছে, মানবিক বিপর্যয় আছে, যে রক্ত হিম-করা পরিস্থিতি তাতে তৈরি করা হয়েছে, তা মদাসক্ত, এলোমেলো, বিকারপূর্ণ অথচ অনুভূতিময় মানুষটির স্বীকারোক্তিমূলক এমন বয়ান সে নিজে ছাড়া আর কে দিতে পারে! পুরুষের পৃথিবীতে নারী কি শুধুই ভোগ্যপণ্য। এর থেকে তার কি মুক্তি নেই? ভোগরাজ্যে এরকম ঘাত-প্রতিঘাতী, পরস্পরবিরোধী মনোভাবের চরিত্রচিত্রণ তাঁর পক্ষেই সম্ভব, যিনি মাঝে মধ্যে জটিল বাক্যবিন্যাসে জর্জরিত করে, তীব্র উত্তেজনা থেকে বেদনা বের করে এনে বিরাট এক প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দিতে পারেন। এ-ই হচ্ছে আমাদের সৃষ্টিশীল লেখক সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ।
ঐ যে শুরুতে একটা কথা বলেছিলাম– তিনি ও তাঁর গোত্রের গল্পলেখকদের অন্যতম প্রধান একটা প্রবণতা হল : সাহিত্যমাধ্যমের সবগুলো শাখাকে কোলাজের মতো করে উপস্থাপন করা। এতে প্রথাগত গল্পের গল্পকে একপাশে রেখে তার শরীরকে ভেঙেচুরে দিয়ে নতুনভাবে বলার ভাষাটা পাঠকের ভিতরে ঢুকিয়ে দিতে চেয়েছেন তারা। একটু আগে যে গল্পটার কথা বলা হল তাতে কৌশলে মদ্যপান, অসমকাম, সমকাম, পুঁজির স্ফীতি, ফ্যাসিজম, রাষ্ট্রসন্ত্রাস, বিজ্ঞাপনি দৌরাত্ম্য, দেশপ্রেম, ধর্ম, সাহিত্য, রাজনীতি, দর্শন, সমাজ, নারী, পুরুষপ্রাধান্য, সংগীত, যুদ্ধ, ধর্ষণ, ধ্বসস্তূপ, বাংলাসাহিত্য, বিশ্বসাহিত্যসহ অসংখ্য বিষয়কে জড়ো করা হয়েছে গল্পের শরীর, একই সাথে গল্পের মন–বক্তব্যকে শক্তিশালী করার জন্য।
একটা কথা কিন্তু না বললেই নয়। সৈয়দ রিয়াজুর রশীদের গল্পে একটা উৎপাত রয়েছে, সেটা হল ‘প্রাবন্ধিক উৎপাত’। গল্পের ছলে তিনি যেন কিছু একটাকে জোরগলায় বলতে চান। কিন্তু যেহেতু গল্পের ভান করছেন তাই গল্পকে গল্পের মতো করে ট্রিটমেন্ট যে দিতে হবে, তা তাঁর মাথায় আছে। সেজন্যই হয়ত গল্পের প্রথমভাগে গল্প থাকে, আর থাকে শেষভাগে। তাহলে প্রশ্ন করা যেতে পারে, মাঝামাঝি কি গল্প নেই? আছে। তবে তা গল্পের মধ্যে না থেকে অনেকটা বিশ্বভ্রমণের মতোই বিচিত্র বিষয় নিয়ে হাজির থাকে। সেখানে থাকতে পারে দিনলিপি-গড়নের লেখা, থাকতে পারে প্রতিবেদনের মতো ভাষা, থাকতে পারে প্রবন্ধঘনিষ্ঠ গাম্ভীর্য, আরো থাকতে পারে বিশ্রুম্ভালাপও। যেমন ‘Am I Being Paranoid'গল্পটির কিছু অংশে ব্যবহার করা হয়েছে প্রতিবেদনের কণ্ঠ, কিছু অংশে প্রবন্ধপ্রায় ভাষা, কিছু অংশে বাদ যায় না গানও। ভূতের গলিতে থাকা পুরনো ও বিচিত্র পেশাগুলো ক্রমশ যখন বিলীন হয়ে যাচ্ছে, তা দেখে গল্পকারের বয়ান :
পাড়ার আদি মুদি দোকানদার চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়েছে। যে বাড়ির সামনের আঙিনার মধ্যে রাস্তার গা ঘেঁষে টঙ ঘর করে মুদি ব্যবসা চালাত–লামসাম ভাড়া দিত–এখন সেই বাড়িটায় ডেভেলপারের সাইনবোর্ড শিরদাঁড়া করার ফলে তার এতদিনের পুরানা দোকান উচ্ছেদের মুখোমুখি। সাজানো বাগান তছনছ হয়ে যাচ্ছে। আর জৌলুস নাই। মরা মাছের মতো চোখ মেলে তাকিয়ে থাকা ছাড়া আর কোনো কিছু করার নাই তার। পেছন থেকে ভাঙতে ভাঙতে দোকানটাও গুঁড়া হতে সময় নাই।
....
এই বিষয়ে মালবিকা কাননের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি সংখ্যালঘুর ক্ষমতায়নকে উঁচুতে তুলে ধরে খোলা ছাদে শ্রাবণের পর আশ্বিনে হুদহুদ পাখির আক্রমণে আকাশ ভেঙে নামা ঝমঝম বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে ময়ূরের মতো নাচে, নাচতে থাকে, গাইতে থাকে গান What did you learn in school today? আমি কান পেতে রই... গোপনবাসীর কান্নাহাসির গোপন কথা শুনিবারে...
আগের গল্পের মতো এ গল্পটিতেও সেই একইরকম ট্রিটমেন্ট দিয়েছেন লেখক। শুরুতে গল্পের আভাস দিয়ে, গল্পের সুঁতা না কেটে, নানারকম প্রসঙ্গ হাজির করে শেষে গল্পের যবনিকা টানেন। গল্পটির নাম কেন এমন অদ্ভুতুড়ে দেয়া হল এবং কেনইবা তা ইংরেজিতে রাখা হল তা কিছুটা বোধগম্য। কেননা ভূতের গলির ভূতগুলো যে রাষ্ট্র নামক যন্ত্রের মধ্যে ঢুকে পড়েছে। যা দেখা যায় না, কিন্তু যার মাধ্যমে ভয় দেখানো যায়। আর ভয় দেখিয়েই তো দলের স্বার্থ, নিজের ক্ষমতার স্থিতি বজায় রাখা যায় ভালোভাবে। ভূতগ্রস্ত রাষ্ট্রের পকেটে তাই চলে যায় ভূতের গলির ভূতেরা। যেমন তারা চলে যায় মৌলভির জোব্বার ভেতরে ধর্মের আদলে, যেমন তারা আশ্রয় নেয় রাষ্ট্রনির্ধারিত কালো পোশাকের মধ্যে, সুকৌশলে। তাই গল্পের প্রধান-চরিত্র নামের অপ্রধান চরিত্রটি, যে তার সংবাদমাধ্যমের কাছ থেকে দায়িত্ব পেয়েছে ভূতের গলির নামকরণের ওপর ৫ পর্বের ধারাবাহিক প্রতিবেদন করার; গল্পশেষে আমরা দেখতে তাকে দেখতে পাই তার নিজের ফ্ল্যাটে মরে পড়ে থাকতে। লেখক ইংগিত দেন, কামরুজ্জামান নামধারী এ প্রতিবেদনকারী হল সাধারণ জনগণের লাশ। যেখানে ভূতের অনুসন্ধান, লাশ পড়া সেখানে অনিবার্য। এত সোজা নয়, রাষ্ট্রযন্ত্রের ভূতকে খুঁজে পাওয়া।
সৈয়দ রিয়াজুর রশীদের গল্প যৌনগন্ধী অনেকটাই, সেকথার ইঙ্গিত আগেই কিছুটা দেয়া হয়েছে। ইংরেজি নামের গল্পটি থেকে কিছু লক্ষণ নেয়া যাক এবার। ভূতের গলিতে অন্যান্য অনেক পেশার লোকের সাথে দীর্ঘদিন সহবাসী ছিল ইস্ত্রির দোকানদার স্বপন মিয়া। তার যৌনপ্রিয়তা :
সালোয়ার কিংবা ব্লাউজ হাতে নিয়ে নাকের কাছে এনে নারীদের শরীরে লুকানো সুবাস মনপ্রাণ ভরিয়ে দিত।
মাতাল হত গন্ধে গন্ধে। তারপর গরম ইস্ত্রি দিয়ে কাপড় পরিপাট্য করতে করতে কতদিন অনুভব করে আশ্চর্য সংগমের স্মৃতি। সংগম সে করে নাই, সংগম করতে পারত নারীদের, তাদের লুকানো উজ্জ্বলতায় ভাসিয়ে নিয়ে যেতে পারত নিজেকে কিন্তু কোনোটা নয় অথচ সংগমের পর তৃপ্তি ও সঘন নিঃশ্বাস শরীরময় এক কুয়াশার মতো ঘিরে রাখে তাকে।
গল্পের আরেক জায়গায় ভূতের গলির অধিবাসীদের কান্ড-
যে যুবক একটু আগে মাস্টারবেশন করেছে; সারারাত জুড়ে কানের কাছে পৌঁছে যাচ্ছিল নারীবন্ধুর ক্রমাগত শীৎকার, মদ্যপ স্বামীর শিশ্ন প্রহারের ঝংকার–ঘুম হয় নাই সারারাত–...
গল্পের মধ্যে গেঁথে থাকা প্রবন্ধপ্রতিম কিছু অংশের পরিচয় :
আর, মালবিকা কানন বাবুল মিয়া বাবুলকে প্রেমের ছ্যাকা জারি করার পর বঙ্গে হিন্দু বিজয় করল। ভূতের গলিতে ধর্মনিরপেক্ষতার আওতায় মুসলমান সমাজে দারুণ ক্রাইসিস।
হিন্দু কিংবা বৌদ্ধ নিপীড়নে সোচ্চার হলে তাদের চলে যায় কিন্তু কোনো সময় পতিত ও জর্জরিত মুসলমানের কান্নায় ভারাক্রান্ত হলে ধর্ম নিয়ে নিরপেক্ষ অ লে মন-শরীরের অবস্থান বেদম রকম টলে যায়।
সৈয়দ রিয়াজুর রশীদের প্রথম দিককার ও তাঁর শ্রেষ্ঠ গল্পের একটি ‘আক্রন্দন হৃৎ-যাত্রা’। হিন্দু থেকে মুসলিম বনে যাওয়া সাবেক ভাস্করের মনে যে তোলপাড়দশা, তা খুবই আকর্ষণীয় রসগদ্যে মেলে ধরেছেন গল্পকার। বলে নেয়া ভালো, গল্পটি গল্পাচ্ছন্ন বটে, তবে তার শরীর গল্পাকীর্ণ নয়। গল্পটি শুরু হয় মৃত্যুদৃশ্য রচনার মধ্য দিয়ে। কিছুক্ষণ পর ট্রমা কেটে গেলে গল্পের নায়ক বুঝতে পারে সে জীবিত রয়েছে। নামাজে অংশ নেয়ার পথে সংসারক্লান্ত, রমণক্লান্ত এবং পূর্বস্মৃতিক্লান্ত তরুণটি তার পূর্বধর্মীয় আচারনিষ্ঠতা, নিজের শিল্পপটুত্ব সম্পর্কে ভাবতে থাকে ক্রমাগত। একসময় বাস্তবে কি অবাস্তবে সে প্রতিমা তৈরি করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। নিখুঁত দেবীপ্রতিমা তৈরির পর নিজের সৃষ্টি নিয়ে সে আহ্লাদিত হয়ে সিদ্ধান্ত নেয় ঠাকুর ডোবানোর। বিসর্জনের সময় বিসর্জন দিয়ে ফেলে সে নিজেকেই। গল্পকারের ভাষায় ‘এবং এই প্রকারে সে যুগপৎ নিজের বিলয় প্রাপ্তি ও পুনরুত্থান প্রত্যক্ষ করে।’
গল্পটা যে ইঙ্গিতবাহী, প্রতীকী, তা আর বলে দিতে হয় না। শেষের স্তবককে যদি আমরা এই ফাঁকে তুলে ধরতে পারি তাহলে লেখকের ইঙ্গিতটাকে কিছুটা বোঝা যাবে হয়ত :
দিবসের এমন বিশুদ্ধ সূচনায় পাপবিদ্ধতার আশঙ্কায় আদি স্রষ্টা তার প্রতিদ্বন্দ্বির সীমাহীন স্পর্ধায় ক্রোধান্বিত হয়ে অভিশাপের শর নিক্ষেপ করতেই অকস্মাৎ প্রস্তরীভূত সে। মর্মর দেহ উল্টে পড়ে গড়িয়ে গড়িয়ে নদীর কিনারা হতে জলের অধিকারে এবং প্রাণ প্রতিমা আয়ত্তমুক্ত হয়ে নদীতীরের কাদায়–জলের অদূরে স্থির। পাথরের দেহ তার, নদীর তলদেশের দিকে তড়িৎ রওনা দেয়। তখনো চেতনা ও হৃদয় ছিল অর্ধবিশ্লিষ্ট এবং অক্ষিগোলকে প্রতিফলিত আপন সৃষ্টি ঐ সপ্রাণ দেবীর স্মিত হাসি শেষ পর্যন্ত তাকে গৌরব এবং স্রষ্টার শিরোপা দেয়। এবং এই প্রকারে, সে যুগপৎ নিজের বিলয় প্রাপ্তি ও পুনরুত্থান প্রত্যক্ষ করে।
গল্পশুরুর মৃত্যুকে লেখক ধোঁয়াশাচ্ছন্ন করে রাখলেও শেষমেশ মৃত্যুর মধ্য দিয়ে গল্প শেষ করায় আমাদের মনে হতে পারে, কেন্দ্রীয় চরিত্রটি কি আসলে গল্পের শেষেই মরেছে, নাকি শুরুতেই মরে গিয়েছিল সে? মরে যাবার পরপরই তাহলে গল্পটা শুরু হয়েছে? গল্পপাঠের এরকম অনিশ্চিতি পাঠককে ধাঁধায় ফেলে দিতে পারে বিষমভাবে। আসলে আমাদের গভীরভাবে মনোযোগ দিতে হয় বাক্যের চলনবলনের দিকটাতে। খুব কষ্ট করে বারবার পড়ে বুঝে নিতে হয় এর বৈষয়িকতাকে। তাঁর গল্পভাষায় যে জটিলতা রয়েছে, এ-গল্পটি যেন তারই স্মারক। নমুনায় সরাসরি যাওয়া ভালো। এ গল্পটিতেই আছে :
বিগত দিনরাত্রি তো এমত বিসংগতি ছিল অনুপস্থিত। গত রাতও ছিল অদ্যকার মৌলভী শুক্রবারপূর্ব দীর্ঘ সময়ব্যাপী নিদ্রার স্বপক্ষে এক দাপ্তরিক উৎকণ্ঠাহীন গাড়ি ধরার দ্রুততামুক্ত রঙিন প্রিয় রাত্রি। ...বিচলিত হাসির মনোভূমিস্থ যারপরনাই বিশৃঙ্খলতার কোনো প্রকৃত সংকেত ও ইশারা গত রাতের চিত্রমালা তন্ন তন্ন অনুসন্ধানেও ব্যর্থ হয় অবশেষে। এই পর্যায়ে সিগারেটের প্যাকেট নিঃশেষ।
....
বিষাদের সঙ্গে হাসিব অনুভব করল ধাপের পর ধাপ এই সকল ঘটনা একদিন তার বিশ্বাসের অন্তর্গত ছিল, এক ব্যতিক্রম শুধু জীবন্ত আরেক প্রতিমার মোহগ্রস্ত বন্ধ্যা সন্তানহীন শুকনা বিগত দুইটি বর্ষ যখন ঈশ্বরিত মৃৎশিল্পীর কারুকার্য ফ্যাকাশে ও রক্ত, লাবণ্যশূন্যতাসহ রানির মধ্যে ধরা পড়ে না ইদানীংকার স্বরূপে।
....
সে কী যেন ভুলের ক্ষমা ভিক্ষায় আপ্লুত হয়ে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেছে পুনরায় অপর ভুল পথে রেখে বহমান মতিচ্ছন্নতায় নাকি!
গল্পের এরকম শারীরিক যন্ত্রণার সাথে এর মনকে বুঝতে গিয়ে পাঠকের কষ্ট হলেও নতুন বয়ানকৌশলের স্বাদ তো আর ফেলে দিতে পারে না অভিজ্ঞ পাঠক। গল্প বলতে গিয়ে গল্পের শরীর থেকে যখন গল্প ভেঙে পড়ে, খুব কষ্ট করে যখন গল্পকে হৃদয়ঙ্গম করতে হয়, গল্প ধরা দিতে দিতে যখন হারিয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়, পরীক্ষানিরীক্ষার ছুরিকাঁচি যখন প্রবল হয়ে ওঠে অথচ গল্পের মন, গল্পের বক্তব্য যেখানে সটান দাঁড়িয়ে থাকে, সেখানেই অটল সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ; সেখানেই তিনি অনন্য। কে যেন এক সাহিত্যসভায় একসময় তাঁর গল্প সম্পর্কে বলেছিলেন : তিনি শুধু পাঠকদের নয়, তিনি লেখকদের লেখকও।
সৈয়দ রিয়াজুর রশীদের গল্পের শরীর ও মন
মোহাম্মদ আলি
মোহাম্মদ আলি
মন্তব্য