সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ ইতোমধ্যেই ছোট কাগজের পাঠকের কাছে পরিচিত। তার গদ্য,লেখক সত্তার প্রবল উপস্থিতি নিয়ে, বিষয় ও কাঠামোতে শব্দের অনুকল্প স্থাপনের মাধ্যমে দৃশ্যের সচেতনতা, তরঙ্গায়িত বস্তু কাঠামো বিনির্মাণে–সাইকোলোজিক্যাল ট্রিটম্যান্ট নিয়ে স্থান-কালিক-মনোগত সংযোগ ঘটিয়ে বিষয়ী সত্তার অবশ্যম্ভাবী চেতনক্রিয়ার নিরীক্ষা কর্ম সম্পাদনে ক্রিয়াশীল থাকে।
যে কোন গল্পেই তিনি চমক দিতে চান। পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালান। তার শিল্পের বহুমাত্রিক অবয়বটি উন্মোচনে, তারই 'আগুনবাজ' গল্পটিকে বিশ্লেষিত করা হচ্ছে। গল্পটি তার গ্রন্থ 'আগুনের বিপদ আপদ' থেকে নেয়া হয়েছে।
এবার ‘আগুনবাজ' গল্পের গভীরতর পাঠে প্রবৃত্ত হওয়া যেতে পারে। গল্পটি আগুন সম্পর্কে লেখকের কমেন্ট আর বিশ্লেষণ দিয়ে শুরু। এ বিশ্লেষণে আগুনের ইতিহাস এসেছে, ব্যবহার এসেছে, রূপকধর্মে সময়, দেশ ও তার অস্থিরতা এসেছে অনেকটা কবিতার কাটা গদ্যে-
"কিন্তু আজ বড় দুঃসময়।
বড় অসময় ।
সম্পূর্ণ নষ্টকাল ।
পরাজয়ের দিনরাত্রি চলমান।
একালে আগুন নির্জীব আর নিস্তেজ। আগুন চরিত্রহীন।'
তারপর শুরু হয় মূল গল্প। নিশিগন্ধা গ্রাম। যে গ্রামে আগুনের প্রসঙ্গ এলেই হাসেন পাগলের আঁকাবাঁকা আগুনের মতো শরীরটার কথা মনে আসে। হাসেন পাগল আগুনের কারসাজি জানে। শহরের রমরমা হোটেলে নাকি হাসেন পাগলার আগুনের গুণেই এত সাফল্য। সে কাহিনী বর্ণনা দিয়েছেন রিয়াজ।
তারপর আবার নিশিগন্ধা গ্রাম –সেখানে কিভাবে যাওয়া যাবে–সে চিত্রের বর্ণনা দিয়েছেন। তার নিজস্ব বিশ্লেষণ এসেছে। সে গ্রামের দিক থেকে ডিস্ট্রিক্ট বোর্ড পর্যন্ত নানা খোঁজ-খবর, উন্নয়নের কথা, প্রত্ন-কথা এসেছে। এক পর্যায়ে জানা যাবে নিশিগন্ধা গ্রামে আরও সাতাশটা পাগল আছে। একেক পাগলের একেক রকম কারিশমা। তবে হাসেন পাগলার ব্যাপার-স্যাপার আলাদা, তার জুড়ি নেই। ওকে নিয়ে গ্রামের লোকজন যেমন- শহরের মানুষেরও ভাবনার কমতি নেই। হাসেন রোগে পড়লেই শহর থেকে এম্বুলেন্স আসে। হাসেন পাগলার একটা ডেরা আছে। সেটা তারই জ্ঞাতিগোষ্ঠীর বসতির শেষ প্রান্তে একটা উঁচু ঢিপির ওপর। হাসেন আগুন ছাড়া চুলোতে রান্না-বান্না করে। আফজালের খাবারের দোকান আছে একটা। সেখানে পাগলা হাসেন প্রতিদিনই আসে। আর সেজন্যেই হয়তোবা আফজালের আয়-উন্নতি বেশি। এরকম বহু ঘটনা আছে কিংবদন্তীর মতো হাসেন পাগলাকে নিয়ে। এভাবে হাসেন পাগলার বিভিন্ন ঘটনা তুলে ধরে, শেষে গল্পকার রিয়াজুর রশীদ -- সে গ্রামে প্রবেশ করান হতাশাগ্রস্থ যুবকদের।
তার নিজস্ব ভাষাশৈলীতে নিম্নরূপ -
“শহরের যুবকদল শেষ পর্যন্ত এসে পৌঁছতে পারলো।
তারা ক্লান্ত।
ভীষণ ভারাক্রান্ত।
শরীর তাদের ধূলিময়।
অনেক দূর হতে পায়ে হেঁটে এসেছে; পুরোপথে পাকস্থলিতে
দানাপানি পড়ে নাই; পা চলতে গররাজী। শরীর যেন টানতে পারছে না শরীরই।
তবু, এতদসত্ত্বেও যুবকদলের প্রত্যেকটি চোখের তারা আগুনের সম্ভাবনায় ঝলকিত। যুবকরা আকুলভাবে আগুনের কথা বলে; আগুনবাজের খোঁজ চায়।"
শেষে একটা টাইপো-গ্রাফিক্যাল ফিগারের মাধ্যমে রিয়াজ ঐ যুবকদের হাসেন পাগলের শিষ্য করে ফেলেন – এ সেই সক্রেটিসের গল্পটিকে যেন স্মরণ করিয়ে দেয়। টাইপো -গ্রাফিক্যাল বাক্যটি হচ্ছে 'আগুনবাজ আমরা এসেছি।' একেই আবার বিন্যাস-সমাবেশ ঘটিয়ে বিভিন্ন বাক্য দিয়ে সরাসরি বিন্দুবাদী আন্দোলনের মতোই পাঠক-মস্তিষ্কে একটা ইমপ্রেশন তৈরি করে দেন –সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ। এখানেও তার একটা পরীক্ষা- নিরীক্ষার বিশিষ্টতা আমরা দেখতে পাই। আর এভাবেই গল্পটি শেষ হয়ে যায়। গল্পটি পাঠ করলে, এক ধরনের চিত্রময়তার ভেতর থেকে বিভিন্ন প্রতি ঘটনা কখনো এসে কাহিনীকে গতিশীল করে হারিয়ে যায়, আবার মূল কাহিনীর শুরু; আবার আসে প্রতি- ঘটনা। শেষ পর্যন্ত কাহিনী গিয়ে অমীমাংসিত থেকে যায়। এবং এক পর্যায়ে দ্বন্দ্ব ও বিকাশে কাহিনী এসে স্থির হয় টাইপো-গ্রাফে। একটা উল্লম্ফনের ঢেউ দেখতে পাওয়া যায় সমগ্র গল্পের শরীর জুড়ে। এবং মাঝে মাঝে গল্পটিকে চিত্রনাট্য মনে হতে পারে। একজন লেখকসত্তার চোখও অভিব্যক্তি, ক্যামেরার মতো পাঠককে বয়ে নিয়ে যাচ্ছে। রেখাচিত্রে বিষয়টি দেখানো যেতে পারে :
প্রবহমান ঘটনা —- কাহিনী শুরু
প্রবহমান ঘটনা —- প্রতি ঘটনা
প্রবহমান ঘটনা —- প্রতি ঘটনা
প্রবহমান ঘটনা —- প্রতি ঘটনা
|
প্রতি ঘটনা
রেখাচিত্রের 'প্রবহমাণ ঘটনা'কে যোগ করে দিলে যেমন একটি সরল রেখা পাওয়া যায়। তেমনি মূল গল্পটি মনোযোগ দিয়ে পাঠ করলেও দেখা যাবে সেখানে মূলতঃ কোন - কাহিনী নেই। আছে শুধু একটাই সরল রেখার মতো ঘটনা। তা হচ্ছে আমাদের কুসংস্কারের বিশ্বাস থেকে জন্ম নেয়া হাসেন পাগলের আগুনের কারুকাজ-এর অবৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি বিশ্বাস স্থাপনের মনোবিকলন। যা এ সমাজে হর-হামেশাই দেখা যায়। রিয়াজুর রশীদ তার অসামান্য শিল্প-নৈপুণ্যে আমাদের প্রচলিত বিশ্বাসের ভেতর তার কাহিনী-গাঁথুনির শক্তি প্রয়োগ করে বিপরীত-বিনির্মাণ ঘটিয়েছেন। আর এ জন্যেই গল্পটি খুব সহজেই পাঠকের মস্তিষ্কে প্রতিক্রিয়া তৈরি করে।
রিয়াজুর রশীদ গুরুত্বপূর্ণ কোন অর্থে। আমাদের পরিচিতকালে দুর্বার সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিবর্তনের পরেও আমাদের বিশ্বাসের বদ্ধভূমির কোন পরিবর্তন আসেনি –তাই তিনি দেখিয়েছেন তাঁর 'আগুনবাজ' গল্পে।
'আগুনবাজ' নিটোল কাহিনী নয়, ঘটনা পরম্পরাযুক্ত, শৃঙ্খলাবদ্ধ কাহিনী নয়, এর গঠনভঙ্গি রৈখিক, (Linear), যদিও ঘটনাটি সরল। এর শেষ দৃশ্যায়ন বিশিষ্ট, তবে এতে ক্রমবিস্তার পাওয়া যায়। যা গল্পে গতিশীলতা নিয়ে আসে এবং শেষ পর্যন্ত পাঠক-মস্তিষ্কে সঞ্চারিত হয়। তবে গল্পটি মূলচরিত্র হাসেন পাগলাকে কেন্দ্র করে একটি বৃত্ত নির্মাণ করেছে। যেখানে জন্ম-মৃত্যুর স্রোত বেয়ে চলা, শেষ পর্যন্ত জীবন যে অপরাজিত, এমন একটি উপলব্ধি তৈরি হয়।
'আগুনবাজ' কাকতালীয় কার্যকারণ-উদ্ভূত কাহিনী, এখানে আছে নৈরাশ্য, আছে মৃত্যু-বেদনা, আছে জীবনের গভীর অনুভূতি, আছে বিষাদ, আছে নিম্ন ও মধ্যবিত্তের আশ্রয়হীনতা, অস্থিরতা, ক্রোধ, পাপবোধ।
এ গল্পের মূল বক্তব্য-'আগুনবাজ' চরিত্রে হাসেন পাগলের নিঃসঙ্গতা। এই চরিত্রের শিকড় বাংলাদেশের গ্রাম জীবনের গভীরে প্রোথিত। যা শহরে, মধ্যবিত্তশ্রেণী, হতাশাগ্রস্ত যুবকদের নিঃসঙ্গতার মর্মমূলে সাংকেতিক বিন্যাসের মাধ্যণে রিয়াজুর রশীদ অনুপ্রবেশের চিত্রটি এঁকে দেখিয়েছেন। অন্যদিকে রিয়াজ 'আগুনবাজ' শব্দটিকে পারসনিফিকেশন (Personification) করে ফেলেছেন হাসেন পাগলের ব্যক্তি-সত্তা আরোপ করে। এ এক সাংকেতিক চরিত্র হয়ে দাঁড়ায়।
চিত্রকল্প গল্পের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ। চিত্রকল্পকে অনেকে বলেন ভাবমূর্তি। বস্তুজগৎ, মানুষের মন ও মস্তিষ্ক, এই তিনের সমন্বয়ে শব্দের প্রয়োগে চিত্রকল্প গড়ে উঠে। অর্থাৎ প্রতিটি লেখক তাদের নিজস্ব মানসিকতা, সময়, কাল ও শ্রেণী অবস্থান থেকে চিত্রকল্প প্রয়োগ করে থাকেন। আর তা দিয়ে শিল্পগুণ বিচার করা যেতে পারে। রিয়াজুর রশীদের গল্পের শিল্পগুণের আরেক দিক হচ্ছে চিত্রকল্প। যেমন–তার ‘আগুনবাজ' থেকে দেখা যাক-
১। "বৃষ্টিতে নেমে পড়ে হাসেন। সে কি বৃষ্টিতে ভিজবে নাকি! তাই বিড় বিড় করে কি যে উচ্চারণ করে তাতেই বৃষ্টির ধারাপাত স্তব্ধ! দু/একজন লোক অবাক হয়ে, দেখল, আশ্চর্য হল, আকবর মিয়াও ব্যাপারটি মনোযোগ দিয়ে দেখে নিল– তার ছিল এক পানের দোকান।"
২। "আফজালের দোকনে এখন টুইনওয়ানে, 'চোলি কা পিছে কেয়া হ্যায়' গানটি তারস্বরে বেজে চলে; সে চা দুই টাকা কাপ করে বেচে; বাকি বিক্রী বন্ধ; এক টাকা দামের বিস্কুট ডাটের সঙ্গে বিক্রি করে বেশুমার; দোকানের মাথায় ঝকমক করে নতুন সাইনবোর্ড –হোটেল নিউ সোনারগাঁও, প্রোপ্রাইটর: শেখ আফজাল।
সৈয়দ রিয়াজুর রশীদের গল্পের ভাঁজে, গদ্যের শরীরে কাব্যবীজ আঁট-সাঁট হয়ে থাকে।
‘আগুনবাজ' গল্প থেকে দেখা যাক–"রক্তের ভেতর করতালি বেজে ওঠে চনমনিয়ে ওঠে পরিশ্রমে নিস্তেজিত শরীর চাঙ্গা হয় ধ্বস্ত / মনোবল মস্তিষ্কের কোষে বেদম গর্জন করে ওঠে আগুনময় বয়লার অগ্ন্যুৎপাত শরীরে/প্রতিটি রন্ধ্রে রন্ধ্রে যেন মিনারে মিনারে আজানের মতো একটি আওয়াজ/আগুনবাজ আগুনবাজ আগুনবাজ আগুনবাজ আগুনবাজ আগুনবাজ আগুনবাজ আগুনবাজ আমরা এসেছি আমরা এসেছি আমরা এসেছি আমরা এসেছি আমরা এসেছি/আমরা এসেছি আমরা এসেছি আমরা এসেছি।"
'আগুনবাজ' গল্প নানা দিক থেকে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে । প্রধানতম বৈশিষ্ট্য--তার প্রকৃতি ও উপস্থাপন পদ্ধতি। এ গল্পের ঘটনা, চরিত্রগুলো যেন একটি অভিজ্ঞানহীন পর্দায় ছায়াবাজির মতো আসছে আর সরে যাচ্ছে। স্মৃতিবাহিত কিংবা লোকশ্রুত ঘটনাই বেশি, কিন্তু যদিও নিশিগন্ধা গ্রাম ঘিরে বর্তমান কিছু ঘটনা ঘটছে, স্থান কালের প্রেক্ষাপটে চরিত্র উপস্থাপিত হচ্ছে, তথাপি চরিত্রগুলো যেন, More acted upon want acting তাহলে দাঁড়াচ্ছে এই 'আগুনবাজ'-এর প্লট ও চরিত্র-নির্মাণ এক নতুন রীতির অনুযায়ী। এখানে ঘটনার সঙ্গে চরিত্রের যোগসূত্র স্থাপিত হচ্ছে অত্যন্ত শিথিলভাবে। স্মৃতিচারণা, আত্মমগ্ন চৈতন্যের মৃদু সক্রিয়তায়, অনুষঙ্গসূত্রে। যা একান্তই সৈয়দ রিয়াজুর রশীদের নিরীক্ষাকর্ম। আর এক কর্মই তাকে পৃথক করে তুলে। তিনি হয়ে উঠেন 'আগুনবাজ’, তার বিশ্লেষণী পর্যবেক্ষণশীল দৃষ্টিভঙ্গির কারনেই। এখানেই তার নিজস্বতা, শিল্প- নির্মাণের স্বার্থকতা ।
সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ: আগুনবাজ
মাসুদুল হক
মাসুদুল হক
পড়লাম ভালো লাগলো
উত্তরমুছুন