বিস্তারিত অথবা বিস্মৃতি: মুক্তিযুদ্ধের নারকীয় এলিটোসাইড ও ধর্ষকাম সমাজে চৈতন্যের চোরা স্রোতে কীটদগ্ধ মনন
মারিয়ম ফেরদৌসী
কথকের মগ্ন চৈতন্যের চোরাগলি বনাম আখ্যানের চেতনাপ্রবাহমূলকতা: “Consiousness flows- let us call it stream of thought, of consciousness, or of subjective life.” প্রখ্যাত দার্শনিক উইলিয়াম জেমসের ‘Principles of Psychology গ্রন্থমতে অর্ধচেতন স্তরের নানান ভাবনা-স্মৃতি-অনুভবসহ মানবমনের নিরন্তর প্রবাহকে নদীর জলধারার সঙ্গে তুলনীয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর সময়কালপর্বে ইউরোপের যুদ্ধদীর্ণ, রক্তাক্ত, ভঙ্গু্র, বিকৃত, ধর্ষকাম সমাজে বেড়ে ওঠা কলা-কুশলীগণ কাহিনী-নির্ভর বাস্তবতন্ত্রী উপন্যাসের ধারা থেকে সরে এসে পরীক্ষাধর্মী চেতনাপ্রবাহমূলক উপন্যাসে মনোনিবেশ করেন। যুক্তি-পরম্পরা, বাস্তবতার স্তরভেদ, শব্দ প্রয়োগ ও বাক্য গঠনের ব্যাকরণরীতি এসব ভেঙেচুরে ঔপন্যাসিক মানবমনের চিন্তার নিরবচ্ছিন্ন প্রবাহকে ভ্যানগগের চিত্রকলার মতোই পরিস্ফুট করেন। ওপার বাংলার ঔপন্যাসিক সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ আখ্যানের চিরাচরিত ফর্ম নিয়ে কাটাছেঁড়া করতে কেতাদুরস্ত। প্রকরণই শিল্প, যা শিল্পের বহিঃরঙ্গগত আয়োজনকে অনিবার্য করে তোলে। আলোচ্য বিষয়টি মাথায় রেখে পাঠককে ভিন্ন স্বাদের; বহিঃরঙ্গে তিক্ত অন্তরে জ্বালা ধরানো অনুভূতির উদ্রেক করে ঔপন্যাসিকের ‘বিস্তারিত অথবা বিস্মৃতি’ নভেলাটি। আখ্যানগত পরীক্ষা-নিরীক্ষায় সিদ্ধহস্ত ঔপন্যাসিক সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ স্বীয় ‘বিস্তারিত অথবা বিস্মৃতি’ মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাসে আখ্যান নির্মাণে চেতনাপ্রবাহ নীতির দ্বারস্থ হয়েছেন। চেতনা প্রবাহ বা Stream of consciousness রীতি মূলত উত্তরাধুনিকতাবাদের ফসল। কলা-কুশলীগণ বাহ্যিক পরিবর্তমান ঘনঘটার বিপ্রতীপে মনের কুঠরিতে আলো ফেলেছেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর ভয়াবহতা, রক্তস্নাত পৃথিবী, সমগ্র বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা ইত্যাদি দুর্বিষহ পরিস্থিতি সচেতন বুদ্ধিজীবী মাত্রই বৌদ্ধিক বিচ্ছিন্নতার জন্ম দেয়, যে বোধ স্বস্তি-শান্তি-স্থিতি দিতে অপরাগ।
আলো অন্ধকারে যাই-মাথার ভিতরেস্বপ্ন নয়, কোনো এক বোধ কাজ করে;স্বপ্ন নয়-শান্তি নয়-ভালোবাসা নয়,হৃদয়ের মাঝে এক বোধ জন্ম লয়;আমি তারে পারি না এড়াতে।
নভেলার কথক বায়োজিদ রহমান ৭১এর বাংলাদেশে সমগ্র দেশজুড়ে জরুরী অবস্থার পরিস্থিতিতে বড়ো আমলার মোটা অঙ্কের স্যালারির বিলাস ছেড়ে এসে নিজেকে প্রকৃতির কোলে সমর্পণ করেছেন। “তিনতলা হতে সিঁড়ি বেয়ে দোতলা হয়ে নীচতলায় বিল্ডিংয়ের সামনে ফুটপাতে এসে দাঁড়িয়ে প্রাণ ভরে নিশ্বাস নিল যেন সুদূর দারুচিনির গন্ধ বুক ভরিয়ে দিল। নিজেকে মনে হল ভারমুক্ত; স্বাধীন; পাখির মতো উড়তে পারে।” অমিয় চক্রবর্তীর ‘বড়বাবুর কাছে নিবেদন’ কবিতায় অফিসের বড়বাবুর কাছে ক্ষুদ্র কেরানীর চাকুরী খুইয়ে ব্যক্তিটি প্রকৃতির বুকে আশ্রয় খুঁজেছে। – “হই না নির্বাসিত কেরানি।/ বাস্তুভিটে পৃথিবীটার সাধারণ অস্তিত্ব।/যার একখণ্ড এই ক্ষুদ্র চাকরের আমিত্ব।/ যতদিন বাঁচি, ভোরের আকাশে চোখ জাগানো / হাওয়া উঠলে হাওয়া মুখে লাগানো।/ গ্রীষ্মের দুপুরে বৃষ্টি /…. বুকে ঢাকলাম।” অমিয় চক্রবর্তীর কবিতার কেরানীবাবু পরিস্থিতির শিকার, যান্ত্রিক সভ্যতার ইঁদুর দৌড়ে চাকুরী হারানো এই মানুষটির শেষের খেয়া প্রকৃতি মায়ের সবুজ আঁচল। অন্যদিকে ঔপন্যাসিকার কথক রাষ্ট্রযন্ত্রের দশটা-পাঁচটার নিয়মতন্ত্রকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে নস্যাৎ করার দুর্লভ ক্ষমতার অধিকারী। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়কালে যে সমস্ত মুক্তিযুদ্ধপন্থী বাঙালি বুদ্ধিজীবী কার্যক্ষেত্রে অবস্থানরত অবস্থায় মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করেছিলেন, তাদের প্রতিনিধি বায়োজিদ রহমান। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘কে বাঁচায় কে বাঁচে’ গল্পের মৃত্যুঞ্জয় অফিস থেকে বাড়ি ফেরার পথে দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষদের দেখতে দেখতে একসময় নিজেই দুর্ভিক্ষকবলিত মানুষগুলির সুরে গলা মিলিয়ে বলতে থাকে “গাঁ থেকে এইচি। খেতে পাই না বাবা। আমায় খেতে দাও।” জরুরী অবস্থায় বাংলাদেশের অরাজক পরিস্থিতি, রাজাকার বাহিনীর বর্বরতা, জেনোসাইড, ঢাকা কেন্দ্রিক বুদ্ধিজীবী হত্যা কথককে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মৃত্যুঞ্জয়ের মতো সম্পূর্ণ বিকারগ্রস্ততার দিকে ঠেলে না দিলেও চূড়ান্ত বৌদ্ধিক বিচ্ছিন্নতাবোধের জন্ম দেয়। রাষ্ট্রযন্ত্রের নিয়মের জাঁতাকলে থুথু ছেটানো কথকের চোখে অফিসের নিয়মিত কর্মচারীরা সারমেয় বলে প্রতিপন্ন । আলোচ্য নভেলাটিতে পথে-ঘাটের খেঁকি কুত্তা, নেড়ি কুত্তা, ছাল ওঠা বাঘাদের মূর্তিমান উপস্থিতি আখ্যানটির বহুস্তরীয় অভিমুখ নির্দেশ করে। বাংলা সাহিত্যে সর্বপ্রথম প্রতিষ্ঠান বিরোধী সাহিত্যিক নবারুণ ভট্টাচার্যের কলমে কুকুর উপকথা ‘লুব্ধক’ উপন্যাসটি উঠে আসে। নবারুণের ভাষ্যে “প্রাণমন্ডলের অধিকার একা মানুষেরই নয়, সকলেরই। এই অধিকারের মধ্যেই নিহিত আছে প্রাণ ও মৃত্যুর নিয়ত ভারসাম্যের নিয়ত সমীকরণ যাকে বিঘ্নিত করলে মানুষের লাভের চেয়ে ক্ষতির সম্ভাবনাই বেশি।” কিন্তু ঔপন্যাসিক সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ ব্যাঙ্গের হাতিয়ার হিসেবে ‘ছাল ওঠা বাঘার’ প্রয়োগ করেন এবং সচেতন পাঠক মাত্রই এই শাণিত অস্ত্রের আঘাতে বিদ্ধ হয়েছেন। কথকের অফিসের কলিগদের কুত্তার সঙ্গে তুলনা এবং মানসভ্রমণে রাস্তার দু ধারে কুত্তার দোকান ও তার বীভৎস বর্ণনা পাঠক মাত্রই শিহরিত হয়ে ওঠে। বিশেষতঃ কুকুরদের রূপকধর্মী প্রয়োগ চেতনাপ্রবাহধর্মী উপন্যাসের লক্ষণগুলি পূরণে সক্ষম।
কাউকে কিছু না জানিয়ে রেজিগনেশান লেটার টাইপ করে বিলাসবহুল সরকারি চাকুরিতে ইস্তফা দিয়ে মুক্তির অনাস্বাদিত স্বাদে আহ্লাদিত কথক প্রকৃতির বুকে নিজেকে শপে দিয়েছেন। বস্তুতপক্ষে ঔপন্যাসিক রিয়াজুর রশীদ কথক বায়োজিদ রহমানের মধ্য দিয়ে এক জটিল চরিত্র নির্মাণে ব্যস্ত থেকেছেন এবং চেষ্টা করেছেন সেই চরিত্রের বিস্তৃত, বিপুল মানসভুবনের অবগাহনে ডুব দিতে। সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহের ‘চাঁদের অমাবস্যা’ উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র আরেফ আলীর বিভ্রান্তি, মানস-চাঞ্চল্য, অস্থিরতা কথকের মানস যাপনের সঙ্গে তুলনীয়। প্রকৃতপক্ষে কথকের চিত্তবিক্ষেপের অভিযাত্রায় মিলেমিশে একাকার অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎবোধ। যার চেতনে অতীতের স্নিগ্ধ-মধুর সুখস্মৃতি বিলুপ্ত। “স্মৃতি থেকে বিদায় নিয়েছে উল্লাস। বেঁচে থাকার যারপরনাই স্বর্গচ্যুত সেই সব আনন্দ জাগরণ।” বাস্তব পৃথিবী তার অনুভবের বিষয় নয়, হ্যালুসিনেশানের জগতে নিমজ্জিত কথকের বুকে পাহাড় প্রমাণ বন্ধ্যা মাতৃভূমির যন্ত্রণা। তার ভাবনার চোরাস্রোতে পাঠক উপনীত হয় গলা-পঁচা-ধ্বসা মূল্যবোধহীন, দূর্গন্ধময় ঢাকার নাগরিক সমাজের অলিতে-গলিতে। নতুন কসাইয়ের দোকান চালু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পাড়ার কুকুরদের সংখ্যা হ্রাস, নারী-খাসির মাংসের এক দাম ইত্যাদি বিচ্ছিন্ন-খন্ডিত ঘটনাসমূহ জরুরী অবস্থার প্রেক্ষিতে বাংলাদেশের বিভীষিকাময় পরিস্থিতির দ্যোতনার বাহক মাত্র।
জাতির মেরুদন্ড স্বরূপ মস্তিষ্কচর্চাকারী বুদ্ধিজীবীগণ : বাঙালি বোধি বিলোপের চক্রান্ত এলিটোসাইড
পারিভাষিক অর্থে ‘intellecctual’ শব্দটি প্রসঙ্গে ১৮১৩ সালে ইংরেজ কবি বায়রান জানিয়েছেন ‘I wish I may be well enough to listen to these intellectuals.’ উনিশ শতক জুড়ে ইংল্যান্ড-ফ্রান্সের সাহিত্যিক পরিমন্ডলে ‘intellectual’ শব্দবন্ধটির গোড়াপত্তন এবং পাকাপাকি অবস্থান। উনিশ শতকের উষালগ্নে ইংরেজ কবি-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবী কোলরিজের তীক্ষ্ণ অভিজ্ঞানে “An intellectual class in Europe was socially important, especially to self-styled intellectuals, whose participation in society’s arts, politics, journalism and education – of either nationalist, internationalist, or ethnic sentiment – constitute “vocation of the intellectual.” পাশাপাশি ‘সংসদ বাংলা অভিধান’ বুদ্ধিবলে বা বুদ্ধির কাজ করে জীবিকা অর্জন করে এমন; লেখাপড়া, বিদ্যাচর্চা বা বিদ্যাদান করা বৃত্তিধারীদের ‘বুদ্ধিজীবী’ তকমায় ভূষিত করেছে। কিন্তু ‘intellectual’ পরিভাষার বাংলা সমার্থবোধক ‘বুদ্ধিজীবী’ শব্দবন্ধটি নিয়ে বাঙালি পণ্ডিতমহলে তর্কের ঝড় বয়ে গেছে। পরিভাষাগত তর্কের ঝড় বয়ে গেলেও শতাব্দী-দেশ-কাল নিরপেক্ষভাবে কেতাদুরস্ত মস্তিষ্কচর্চাকারীগণ পৃথিবীর দিন বদলের গান গেয়েছেন। ‘বাঙালি বুদ্ধিজীবী ও বিচ্ছিন্নতাবাদ’ নামাঙ্কিত দুই মলাটে ঐতিহাসিক অমলেন্দু দে উনিশ শতক থেকে উত্তর স্বাধীনতা পর্বে বঙ্গদেশের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক জীবনের উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে বাঙালি বুদ্ধিজীবীর ভূমিকা ও হিন্দু-মুসলমান সম্পর্কের উপর আলো ফেলেছেন। মস্তিষ্কচর্চাকারীদের প্রতিবাদের টুঁটি টিপতে সতত পরাঙ্মুখ গজমিনারে বসবাসকারী রাষ্ট্রীয় শাসক শ্রেণি। ষোড়শ শতকে ইতালির দূরবিন যন্ত্র আবিষ্কারের পুরোধা দেদীপ্যমান বিজ্ঞানী গ্যালিলিওর যুগান্তকারী আবিষ্কারের ফল স্বরূপ তাঁর ক্যাথলিক ধর্মাবাদী কর্তৃক বিভীষিকাময় পরিণতি। অন্যদিকে সুদূর বাংলাদেশে উনিশ শতকীয় কলকাতা কেন্দ্রিক বাঙালি নবজাগরণের প্রাণপুরুষ রাজা রামমোহন রায় সনাতনী মনুবাদী সংস্কৃতির বুকে লাথি মেরে কালাপাণি পেরিয়ে সমুদ্রযাত্রা করলে, স্মার্ত্য-ব্রাহ্মণ্যবাদী সংস্কৃতির ধারক-বাহকগণ তাঁকে সমাজে পতিত করার হুমকি দেন। শতাব্দীর পর শতাব্দী যাবৎ সমাজের জগদ্দল পাথরে আঘাত হেনে সংস্কারের অচলায়তনে থুৎকার ছিটিয়ে সমাজের এই মস্তিষ্কচর্চাকারীদের আবির্ভাব, যাঁদের একেকটি অক্ষর ক্ষুরাধার তরবারি স্বরূপ শাসকযন্ত্রের পাপের ইমারতকে ধ্বসিয়ে দিতে সক্ষম। ৭০-এর দশকে নকশালদের উৎশৃঙ্খলতার চালচিত্র সর্বকালের সত্যদ্রষ্টা সাংবাদিক গৌরকিশোর ঘোষ জনগণের সামনে হাজির করলে, চরমপন্থী নকশাল কর্মীবৃন্দ প্রচারকার্য চালায় “গৌরকিশোরের মুন্ডু চাই”। জার্মানীর নাৎসি বাহিনীর ইহুদি বুদ্ধিজীবী নিধনযজ্ঞে বিশ্ববরেণ্য বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের পর্যন্ত ছাড়পত্র মেলেনি। মস্তিষ্কচর্চাকারী বুদ্ধিজীবীগণ সমাজ-রাষ্ট্রের খনিজসম্পদ স্বরূপ, ভারত-বাংলাদেশের মত উন্নয়নশীল দেশের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সরস্বতীর বরপুত্রগণ উচ্চতর গবেষণা ও বিলাসবহুল যাপনের উদ্দেশ্যে প্রবাস গমন করলে, সেই উন্নয়নশীল রাষ্ট্র ‘ব্রেন ড্রেইন’এর মত জাতীয় সমস্যার সম্মুখিন হয়। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসের শেষপাদে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর পতন অনিবার্য হয়ে উঠলে, নাৎসি বাহিনীর মত রাও ফরমান আলীর নেতৃত্বে আল বদর, আল সামস, রাজাকার বাহিনী বাঙালি বুদ্ধিজীবী নিধন যজ্ঞের ‘নীল নকশা’ প্রস্তুত করে। কিছু দিনের মধ্যেই ‘জেনোসাইড’এর বিভীষিকা ‘এলিটোসাইডে’ রুপান্তরিত হয়। হুমায়ূন আহমেদের ‘জোছনা ও জননীর গল্প’ নামাঙ্কিত কালজয়ী উপন্যাসের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ধীরেন্দ্রনাথ রায়চৌধুরী ও রাজাকার বাহিনীর প্রতিনিধি কলিমুল্লাহের উত্তেজনাময় কথোপকথন সচেতন পাঠক মাত্রই বিস্মৃত হবার কথা নয়। “ধীরেন্দ্রনাথ রায় চৌধুরী গাড়িতে উঠে দেখলেন … গাড়ি ভর্তি মানুষ। তারা সবাই চিন্তায় অস্থির। ধীরেন্দ্রনাথ রায় চৌধুরি আন্তরিক ভঙ্গিতে হাসলেন। ভুলে তিনি চশমা ফেলে এসেছেন বলে কাউকে চিনতে পারলেন না। চোখে চশমা থাকলে তিনি এদের অনেককেই চিনতে পারতেন। বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানরা রয়েছে সেই গাড়িতে, তাদের নিয়ে যাওয়া হবে বধ্যভূমিতে।” সাহেদ মন্তাজ তাঁর ‘মুক্তিযুদ্ধে বুদ্ধিজীবী হত্যা ও অন্যান্য প্রসঙ্গ’ গ্রন্থে মুক্তিযুদ্ধের আলোকে বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী সমাজকে দুইটি শ্রেণিতে দেখিয়েছেন – পাকিস্তানপন্থী বুদ্ধিজীবী এবং মুক্তিযুদ্ধপন্থী বুদ্ধিজীবী। পাকিস্তানপন্থী সুবিধাবাদী বুদ্ধিজীবীরা একাত্তরে সক্রিয়ভাবেই পাকিস্তানিদের সাহায্য করেছে তার আভাস আনোয়ার পাশার ‘রাইফেল রোটি আওরাত’ উপন্যাসে প্রতিফলিত। পাকিস্তানী রাও ফরমান আলী মুক্তিযুদ্ধপন্থী বুদ্ধিজীবী হত্যার উদ্দেশ্যে পাকিস্থানীপন্থী বুদ্ধিজীবীদের পরামর্শে ‘নীল নকশা’ প্রস্তুত করে।
মানসিক চিন্তার ঘূর্ণাবর্তে রাস্তার ধারে কুকুর কেনা, পতিতালয়ে একাধিক পতিতার ঘৃণ্য সাহচর্যে রাত্রি যাপন, পাড়ার কসাইখানার কসাইয়ের সঙ্গে কিম্ভুত কথোপকথন ইত্যাদি বিচ্ছিন্ন খন্ডিত ঘটনাসমূহে পাঠকের মন বাস্তব ও কল্পনার দ্বন্দ্বে সন্দীহান হয়ে ওঠে। রহস্যময়তার পারদ চড়ে। অবশেষে কথক কল্পনা-হ্যালুসিনেশান-চিন্তার জাল ছিন্ন করে পরদিন সকাল বেলা সশরীরে বাস্তবের মাটিতে প্রত্যাবর্তন করে। এরপরের ঘটনাসমূহ মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষিতে জরুরী অবস্থার দিনকালে এলিটোসাইডের জাজ্বল্যমান দৃষ্টান্ত। অফিসে রেজিগনেশান লেটার দিয়ে আসার পর পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর দুইজন স্পাই তার কর্মকান্ডের উপর নজরদারী রাখে এবং শেষমেশ তার বাড়িতে এসে হাজির হয় জিজ্ঞাসাবাদের উদ্দেশ্যে। “আপনাকে আমাদের সঙ্গে যেতে হবে। সামনে দাঁড়িয়ে যেন মৃত্যুদূত, হাতে মৃত্যুর পরোয়ানা।” কথককে আলবদর বাহিনীর দুই লোক ঢাকার বুদ্ধিজীবীদের বাসে করে বধ্যভূমিতে ধরে নিয়ে যায়। কথককে ‘আলবদর’ বাহিনীর দুইজনের জিজ্ঞাসাবাদের সমান্তরালে ফ্ল্যাশব্যাকে বুদ্ধিজীবী নিধনযজ্ঞের একেকটি খন্ডচিত্র সেলুলয়েডের মত পাঠকের সামনে ভেসে উঠেছে। বুদ্ধিজীবীদের জিজ্ঞাসাবাদ শুরু হয়েছে, কে ডাক্তার, কে সাংবাদিক, কে অধ্যাপক… “শালারা সব ইন্ডিয়ান স্পাই। সরকারের টাকা খেয়েছ আর গাদ্দারী করেছ। এবার টের পাবে।” সকলের চোখ, নখ, নারীর স্তন খুবলে এমন অবস্থা করা হয় যেন চিল-শকুন-শিয়াল ব্যতীত যে কোনো সুস্থ মানুষের ত্রাসের শিকার হয় জীবন্ত-বিকৃত লাশগুলি। এরপর জীবন্মৃত বুদ্ধিজীবী ভর্তি বাস চলেছে বধ্যভূমির দিকে। বাসের জানালা বন্ধ। বাসটা খোলা প্রান্তরে এসে পৌঁছালো, পাশে বটগাছ, সম্মুখে বিল। বধ্যভূমিটি ধীরে ধীরে মৃত্যু উপত্যকায় রুপান্তরিত হয়, যেখানে পাকিস্তানী জহ্লাদদের ১৫০ জন শিকার বসে আছে। অমানুষিক হত্যালীলা। আর্ত-চিৎকারের সঙ্গে পৈশাচিক হাসি আর উল্লাস। রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহের ‘চুয়াত্তরের প্রসব যন্ত্রণা এবং’ কবিতার –
বাহান্নর অবৈধ প্রসব তার স্বপুরুষএকাত্তরের সন্তান তার যক্ষাক্রান্ত হলো।যে যক্ষা একাত্তরের নয়- সে যক্ষা আমারসে কঠিন যক্ষা আমাদের সমস্ত শরীরে।
বেদনা-বিধুর রোম্যান্টিকতায় নভেলার সমাপতন:
কথকও চলেছেন গন্তব্যহীন পথে মৃত্যুর নিরুদ্দেশ যাত্রায়। “তার মস্তিষ্ক এতটা নিশ্চিত বোধ করে যে, একবারও প্রশ্ন করে না কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে তাকে ?” কথকের মস্তিষ্ক আসন্ন মৃত্যুর স্পর্শে শান্তি অনুভব করে। ১৪ই ডিসেম্বরের মতো ভয়ঙ্কর রাত্রি পৃথিবীর বুকে নেমে আসে। চারিদিকে কঙ্কালের মত ঝুলে থাকে শূন্যতা। পূর্ণিমা রাত্রির রোমান্টিকতা কথকের অনুভূতির কাছে খেই হারিয়ে ফেলে। ধর্ষিত-লাঞ্ছিত বাংলা মায়ের চোরা কান্না যেন শুনতে পায় কথক। স্বপ্ন নয়, শান্তি নয় সমগ্র প্রকৃতি যেন বাসর ঘরের লাঞ্ছিত বধূ –যে বিষাদের গহনা পরে দাঁড়িয়ে আছে। প্রকৃতি যেন নিরুত্তর-নিষ্ঠুর। গাছের পাতার কোনো সাড়া নেই। চারিদিকে যেন বন্ধ্যা-অন্ধত্ব। “মনে হয় পূর্ণিমার শাদা তরল এসেছে কাফনের উপর। রুখে গিয়েছে ঘূর্ণিপাক, স্বস্তি ও প্রাণভরা নিশ্বাস।” অনুভূতির শূন্যতায় দাঁড়িয়ে সচেতন মানুষ সমস্ত সুখ স্মৃতি বেমালুম ভুলে গেছে। কথকের অনুভূতিতে বেদনা-বিধুর আড়ম্বরে সজ্জিত প্রকৃতি। চারিদিকে গুমোট বাতাসে বারুদের গন্ধ। আকাশ থেকে ঝরে ঝরে পড়ছে অন্ধকার। “হঠাৎ চাঁদ উঠল। বুলেটের দাগ নিয়ে চাঁদ উঠল মেঘ ঠেলে।” পুনরায় মনে ভাসে রুদ্র মুহম্মাদ শহীদুল্লাহের ‘বাতাসে লাশের গন্ধ’ কবিতার লাইনগুলি–
বাতাসে লাশের গন্ধ ভাসে,মাটিতে লেগে আছে রক্তের দাগ।এই রক্তমাখা মাটির ললাট ছুঁয়ে একদিন যারা বুক বেঁধেছিলো।জীর্ণ জীবনের পুঁজে তারা খুঁজে নেয় নিষিদ্ধ আঁধার।আজ তারা আলোহীন খাঁচা ভালোবেসে জেগে থাকে রাত্রির গুহায়।
মন্তব্য