গল্প পড়াটা নেশা।কিছু পড়া হয় তাগিদে,কিছু কৌতূহলে,কিছু পড়ার জন্য পড়া আর কিছু না পড়ে পারা যায় না।পড়তে আরম্ভ করলে থেমে থাকা যায় না আরকি।যাকে বলে সাহিত্যের অ্যাডভেঞ্চার।প্রতিনিয়ত লেখার মধ্যে কিছু খুঁজে চলা।যাকে বলে খিদা–কিছু খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে আবিষ্কার। কিছুটা দুর্গম সময় পেরিয়ে যাওয়া আর সেটাই অ্যাডভেঞ্চারের স্হিতি–অ্যাডভেঞ্চারের প্রাপ্তি।পড়ে ফেললাম শাদা কাহিনী। না পড়ে পারা গেল না।ওই যে পড়াটা আরম্ভ করে ফেলেছিলাম!শেষ অব্দি টেনে নিয়ে গেল হিড়হিড় করে।পুরো শাদা কাহিনীটাকে যদি আমি সাহিত্যের অ্যাডভেঞ্চার-ক্ষেত্র বলে মনে করি তাহলে তার একেকটা ভূ-খন্ডে তথা গল্পে একেকটা সৌন্দর্য অপেক্ষা করছিল।শুরুতেই তাক লাগিয়ে দিয়েছে আমাকে তার লেখার স্টাইল।প্রচলিত ও গতানুগতিক লেখার নির্মাণশৈলী থেকে এ যেন ভিন্ন রাস্তা!এ যেন স্রোতের বিপরীত অথচ চরম বাস্তব ছবি।বাক্য গঠন দেখে অবাক হয়েছি।প্রচলিত ধারার বাইরে ছুঁটে গেছেন লেখক সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ।যেন কামারের কাছে দুর্বোধ্য আর স্যাঁকরার কাছে স্বর্ণ।বাক্য গঠনে পেয়েছি আধুনিক কাব্যিকতার স্বাদ।পেয়েছি হাংরি জেনারেশনের স্পর্শ।কোথা হতে কোথা লেখক পরিভ্রমন করেছেন লেখক!প্রত্যেকটা গল্পে উপলব্ধ হয়েছে লেখকের পোড় খাওয়া অভিজ্ঞতার ছাপ।সবচেয়ে বড় কথা লেখক ভয় পান নি– পরোয়া করেনননি– কে কী বলবেন, তা নিয়ে।তাই তিনি সত্যটাকে সহজভাবে বলতে পারেন–"আলিম পাটোয়ারীর দীর্ঘ দিন পরে লুঙ্গির গায়ে মানচিত্র তৈরি হয় আবার শুকিয়ে খরখরে হয়ে যায়।"এ কথাটা যে কত বড় চরম সত্যি যা সব লেখকেরা তাদের সাহিত্য কর্মে জায়গা দিতে সাহস করবেন না।মনে পড়ে নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর কবিতার লাইন—-"রাজা তোর কাপড় কোথায়? "
শাদা কাহিনীতে লক্ষণীয় বিষয়ের মধ্যে উল্লেখযোগ্য আরেকটা দিক মনে হয়েছে শব্দ চয়ন–যাকে ইতর শব্দ বা স্ল্যাং বলে এড়িয়ে গা বাঁচিয়ে চলেন অনেক লেখক।সেখানে সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ দেখিয়ে দিয়েছেন কীভাবে বাস্তবতা ফুটিয়ে তুলতে হয়।চরিত্র চিত্রায়নে চরিত্রের চিন্তা চেতনা তার ভাষার মধ্যে লুকিয়ে থাকে। তাই সাহিত্যের চরিত্র যখন বাস্তবতার প্রতীক হয় তখন গল্পের চরিত্র ভাবতে বসে—"....বউটি ছিল দারুন মাল।গায়ের রং আবলুস হলে কী হবে,দেখতে দারুন,শিশ্নপছন্দ!এমন মেয়ে মানুষকে পাঁচ মিনিট পরিমান বিছানায় নিয়ে গড়াগড়ি দিতে পারলে শরীরের গরম সব ঠান্ডা। " এমন চরম বাস্তব ছবি আঁকা সবার কর্ম নয়।সাহিত্যের অ্যাডভেঞ্চারে এটা শাদা কাহিনীতে আবিষ্কার।
সৈয়দ রিয়াজুর রশীদের শাদা কাহিনীতে পেয়েছি কাব্যময়তার ব্যাঞ্জনা—-"একজনের বুকে পিশাচ বাজনা,অন্যজনের বুকে নদী।"তার পরের লাইনে উঠে আসে রাজনৈতিক সমীকরণ –"তবে কী আমি বামে টললে ও ডানে…"
শাদা কাহিনীর প্রতিটি গল্পকে ফুটিয়ে তুলতে লেখকের আছে মুন্সিয়ানার ছাপ;দক্ষ শিল্পীর চোখ যাতে আছে সমাজ পর্যবেক্ষণ।শাদা কাহিনীর প্রত্যেকটা গল্পের মধ্যে ঢুকে যাওয়া যায় আর আবিষ্কার করা যায় আমাদের চারপাশের চেনাজানা চরিত্রগুলোকে।এটা লেখক রিয়াজের এক ধরনের সমাজ গবেষণা তথা চরিত্র নিরীক্ষার ফল।
এই বইটিতে কোথাও অযথা ফেনিয়ে তোলা নেই,আর নেই লেখকের পাণ্ডিত্য জাহির করার প্রচেষ্টা।তবে অবশ্যই আছে সাহসিকতার পরিচয় আর সমাজের গভীরে ঢুকে যাবার মানসিকতা।
লেখাগুলিতে পরিমিত অলঙ্কার এবং যথাযথ যতি- চিহ্নের ব্যবহার বইটাকে সামগ্রিক সৌন্দর্যে উন্নীত করেছে।গল্পে ব্যবহৃত সংখ্যাবাচক শব্দগুলোকে বানান করে না লিখে সংখ্যায় উল্লেখ করায় প্রথমে কেমন লাগলেও পরে বেশ ইন্টারেস্টিং লেগেছে…."তোর ১এর পর ১চমকানো…"
প্রত্যেকটি গল্প একেকটা অভিজ্ঞতা যা নিজস্ব স্বাতন্ত্র্যে বিশিষ্ট। ভিন্ন স্বাদে রচিত প্লটগুলো প্রচলিত বুননশৈলীর বাইরে গিয়ে রচিত।
প্রতিটা গল্পে জুড়ে আছে সুন্দর চিত্রকলা।গল্পগুলোর নামকরণে আছে দারুন ব্যাঞ্জনা।গ্রন্থটি সুসজ্জিত হয়েছে গল্পের সঙ্গে চিত্রাকর্ষক চিত্রণে।চিত্রমালা যেন গল্পের ভাষাকেই উপসংহার হিসেবে তুলে ধরেছে।এজন্য অবশ্যই চিত্রশিল্পী উত্তম সেন প্রশংসার যোগ্য।
ছবি দিয়ে কথা বলার বাস্তব উদাহরণ এই বইয়ের চিত্রমালা।
সর্বোপরি সাহিত্যের অ্যাডভেঞ্চারে আবিস্কৃত হন সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ।
শাদা কাহিনী : সাহিত্যের অ্যাডভেঞ্চার
মহানন্দ ঢালী
মহানন্দ ঢালী
মন্তব্য