আশির দশক থেকেই, প্রধানত বাংলাদেশের ছোটগল্পে, গল্পকারদের মধ্যে আত্মচিন্তা প্রকাশের উৎসাহ বেশি দেখা দেয়। গল্পকারগণ যেন আত্মদ্বন্দ্বে আকীর্ণ, এক ধরনের অন্তঃক্ষেপণে যেন ম্রিয়মাণ তাঁরা, যেন সব পেয়েছির দেশে পৌঁছেও অনেক কিছুই তাঁরা পাচ্ছেন না, ফলে অন্তর্মুখী চিন্তার কণ্টকাঘাতে ক্ষতবিক্ষত। তবে যেহেতু শিল্পী মাত্রই যুগের আবহাওয়ায় লালিত, সুতরাং স্বকাল-সংলগ্ন হয়ে আমাদের বর্তমান প্রজন্মের গল্পকারগণ তাঁদের বিষয়-ভাবনায় ও শিল্প-রূপায়ণে নতুনভাবে আত্মপ্রকাশ করার প্রবণতা দেখান। সেই সঙ্গে এই কথাটি বলা সমীচীন যে পাশ্চাত্যের শৈল্পিক বিবেচনাসমূহ বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ছোটগল্পের ধারায় কৌশলে অনুপ্রবেশ করে একথাই প্রমাণ করে যে এদেশের ছোটগল্পের বিচিত্র বিকাশের ধারাটিও এখন বিশ্বসাহিত্যের মানদণ্ডেই বিচার্য। তবু বাংলাদেশই প্রধানভাবে তাদের ছোটগল্পে ছায়াবিস্তার করে। বর্তমান প্রজন্মের একজন গল্পকার সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ। তাঁর ‘আক্রন্দন হাৎ-যাত্রা' শীর্ষক একটি গল্পে গল্পকারের জটিল রচনাশৈল্পীর মধ্য দিয়ে আহার-বিহার- মৈথুনের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে যে কাহিনীটি, সেখানে লেখকের শিল্পভাবনার নতুন বিন্যাসটি যেমন চমকপ্রদ, তেমনি শিল্পীর জটিল বাণীবিন্যাসের উচ্ছ্বল স্রোতস্বিনীতে যখন গা ভাসায় মাটির মানুষের জন্মভূমি আমাদের চিরায়ত বাংলাদেশ, তখন সেই চিত্রকল্প, কিছু দুৰ্জ্ঞেয়তা সত্ত্বেও, আমাদের মুগ্ধ মনে আবেশ সঞ্চার করে। এই প্রসঙ্গের খানিকটা অংশ,--
"মনের মধ্যে আকাশ পুনরায় নীল রৌদ্রের রঙ যায় বদলে, সেইখানে সোনালি স্নিগ্ধতা। কালে মেঘের দল সরে গিয়ে মনের আকাশ পটভূমিতে কাশবনের রূপ পুঞ্জ পুঞ্জ মেঘের আকৃতি ঘনত্ব। হাসিব, অতএব যেন চারদিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে রেখে চলে মনের এমত অপরূপ দৃশ্য : কোথায় দাঁত উন্মোচিত শীত-সকাল, এ যেন ম্রিয়মাণ মলিনতায় ঘটমান অভাবিত উত্তরণ এবং তদীয় উজ্জ্বল উদ্ধার। কানের নিকট বাদ্য –গগনঢাকির ঢাক, দৃশ্যমান শিশির বিন্দুতে স্মৃতি দৃশ্য কণা, জীবনের মধু। রৌদ্রের সুষম রশ্মিতে চাঁপা ফুলের রং, অনাঘ্রাতা শিউলি ফুলের অমিয় ঘ্রাণ,বৈশল্যকরণী নীলাকাশে কালের প্রতিমার সাজাগোজা।"
একজন আধুনিক গল্পকার হয়তো তাঁর অজান্তেই নিজের রচনায় আধুনিক শিল্পধারণার এমন দৃষ্টান্ত রাখেন, যা সাহিত্যের চমৎকার নিদর্শন হিসেবে বিবেচিত হয়।
সাহিত্যে বাস্তবতা গ্রন্থ থেকে, ১৯৮৯
সাহিত্যে বাস্তবতা
আজহার ইসলাম
আজহার ইসলাম
মন্তব্য