পাল্টা ধারার লেখক সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ প্রাতিষ্ঠানিক বড় বড়ে আবর্জনাময় সাহিত্য উপেক্ষা করে, সুনির্দিষ্ট পাহাড় কাটা শ্রমিক সাহসে, এক নিজস্ব সড়ক কেটে চলেছে। এ সড়কে সকল যশ-খ্যাতি পায়ে ঘষে সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ এক সৈয়দ রিয়াজুর রশীদই।
'লাশ নাই' রিয়াজের তৃতীয় গল্প গ্রন্থ। মুক্তিযুদ্ধের ৪টি গল্পে সমৃদ্ধ এ পুস্তক। গল্প গুলির চরিত্র সাধারণ ও অবহেলিত মুক্তিযোদ্ধার এবং যাদের আত্মা খুঁড়লে স্বাধীন মাতৃভূমিরই সুবাস মেলে। রিয়াজ এদেরই আত্মা খুঁড়েছে তার 'লাশ নাই' গ্রন্থে।
রিয়াজের ভাষা ও গল্প চিত্রণ দুইই তার একেবারে নিজস্ব ঘরানার। এ ছাড়া সে তার গল্প আঁকায় বাহুল্য বর্ণনা, অতি কথন শুধুই মেধা ও কলম খরচ মনে করে। তার গল্প চরিত্র যেমন টানটান, তেমনি সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম প্রেম, মানবিকতায় ভরপুর। ফলে, 'লাশ নাই' গ্রন্থে রিয়াজকে চেনা-জানার আরো পাতালে নিয়ে যায়।
এ পুস্তকের প্রথম গল্প "মারণ দাঁত" যার শুরু এক ভয়ঙ্কর আদিম আবহে, যেমন
“সর্পিলাকার, পিচ্ছিল, দীর্ঘ এক শ্বাপদ যথা, একটি অজগর যেন, জিহ্বা মৃত্যুবিস্তারী-
পাকস্থলী-ভয়ঙ্কর । মুখ গহ্বরের বিশাল হা। হা করে সে গলঃধকরণ প্রক্রিয়াতে এক একটি সুরুৎ করে টান দেয়, সঙ্গে সঙ্গে রাশি রাশি ত্রাসিত মানুষজন গ্রাসিত হয়ে চলেছে অনবরতঃ এই হল রাত্রি; অন্ধকার, নিকষ যা মৃত্যুগন্ধি।”
এই শুরু থেকে “দপ করে যাবতীয় সব কিছু বিলীন হয়ে ফুটে ওঠে জ্বলন্ত বাংলাদেশ। সবুজ পুড়ে হলুদ হয়ে যাচ্ছে। বসতি পুড়ে খাক হয়ে ছাই শুধু ওড়ে বাতাসে। রক্তের তাপে অগ্নি ইদানিং সঞ্জীবিত”, এভাবে শেষ হয়। এর গভীরে অগণিত হত্যা, ধ্বংস ক্ষয় মৃত্যুসহ ইঁদুর, সুঁচো, নেকড়ে স্বভাবে লুট ধর্ষণ ও ঘরে বাইরে, স্বজনে অজনে প্রত্যয় চাতুরতার দ্বন্দ্ব সংঘাতে ভরপুর।
এই '৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ যদিও আমাদের জনযুদ্ধ তথাপিও এ লড়াই ছিল পেটিবুর্জোয়া ও সাম্রাজ্যবাদিদের দেনা-পাওনার লড়াই। ফলে সাধারণের যা ঘটবার তাই ঘটেছে।রিয়াজের গল্পে দর্পণের মতো তা স্বচ্ছ। তাইতো বাজারের কশাই এ যুদ্ধ জয় করতে দা হাতে রুখে দাঁড়াতে গিয়ে শত্রু অস্ত্রে নিজে কোরবানীর পশুর মতো ফালাফালা হয়।বিভিন্ন গেরস্থবাড়ির রমণীরা মাংশ মনদরে রক্ত ভাসিয়ে হায়েনার দাঁতে তুলে দিয়েছিল;কচি কন্যাশিশু। মাতৃ- সমারাও তাদের অঙ্গ সংস্থানের অপরাধ থেকে রেহাই পায়নি।কিন্তু এই যুদ্ধ শেষে এরা যা পেয়েছে, তা হল, এই স্বাধীন রাষ্ট্র প্রভুদের ঘৃণা, অবজ্ঞা,থু-থু ও দানব দারিদ্র।
২য় গল্প
দীর্ঘজীবী হোক আবুল হুসেন
এ গল্পটি রিয়াজের যেন আলাদা কলমে আঁকা। স্বাধীনতা প্রত্যাশি জনজীবনের এক দুঃসাহসী গল্প। খলিফা আবুল হুসেন তারই প্রতিনিধি। যে ৭১ যুদ্ধের বর্বর খুন পিপাসু দানব বেষ্টিত ছোট ঘরে, হারিকেন আলোয়, বুলেট খাওয়া মুক্তিযোদ্ধার জীবন বাঁচাতে অজয় সাহস ও প্রত্যয়ে অদক্ষ হাতে তুলে নিয়েছিল সুঁই-সুতো। অতঃপর সেই আহত শহীদের জীবন পুনঃযুদ্ধ জয়ে ঝলকে ওঠে। সুঁই সুতোয় আবুল হোসেন সেদিন যেন শুধু এক মুক্তিযোদ্ধার জীবন নয়, স্বাধীন মাতৃভূমির মানচিত্র এঁকেছিল। শুধু কি তাই? আবুল হুসেন এই যুদ্ধ বিরোধী দেশীয় ঘরশত্রুদের চরিত্র চিহ্নিত করতে এদের নামে যুদ্ধপর কুকুর পোষে। নাম রাখে (রাজাকারের নামে) জমির।
'৭১ এর যুদ্ধ অনেক অতীতে শেষ। আবুল হুসেন আজ বৃদ্ধ, তার সেই ক্ষিপ্রতাও নিঃশেষ।
এখন সে এই মানচিত্রের সবকিছু দেখে আর হাসে। কিন্তু তার সেই যুদ্ধ আজও অবিরত। এর দৃষ্টান্ত তার সারমেয় জমির..............।
বুড়ো আবুল হুসেনকে আজ সব পাগল ঠাওরায়। বড় বড় ঔষধ কোঃ এর রিপ্রেজেন্টেটিভরা তাকে ঘৃণা করে এবং তার পট্টি মারা স্টেথো নিয়ে অনেক হাসি তামাশার কথা কয়। কিন্তু আবুল হুসেন এখনো বলে দিতে পারে কার হার্টবিট বেশিকম, লাংস নরমাল ইনফেকশন। এ সবই। আজও আবুল হুসেনের স্টেথো কাজ করে কাঁটায় কাঁটায় মোক্ষম। সব শেষে আবুল হুসেন এখনো বৃদ্ধ কাঁপা হাতে জামা বানাতে বসে। ঘুমে কিংবা ঝিমুনি আচ্ছন্ন নিয়মিত এক সুশৃঙ্খল স্বপ্ন দেখে; এই যে তার চারপাশে সব ভেঙেচুরে যাচ্ছে, ধ্বসে যাচ্ছে, পুড়ে যাচ্ছে, টুটে যাচ্ছে, ফাটল ধরছে, ক্ষয় হচ্ছে।
তৃতীয় গল্প
গল্পটি ভূতের নয়
১৯৭১ ডিসেম্বর। মরণপণ যুদ্ধ। দিনে রাতে মুক্তিপক্ষের হিংস্র বোমাভিযান। বোমা বিস্ফোরণে গোটা শহর থরথরে। বোমা শব্দে শত্রুকুল বেসামাল ।
রাজাকার কমান্ডার মিয়া মন্টুর মুখনিসৃত খিস্তির তুবড়িতে তা স্পষ্ট–
এক একটি বোমা শব্দ-দ্রিম।
মিয়া মন্টু মাদার চোদ!
দ্রিম!!
খানকির বাচ্চা!
দ্রিম!!
জাউরা শালা!
এভাবে শত্রুকণ্ঠ এক মুহূর্তে একেবারে ক্ষীণতরো যেমন,
দ্রিম..... চোদ
দ্রিম..... বাচ্চা
দ্রিম ...... শালা
শেষ শেষ নিজের অজান্তে রাজাকার কমান্ডার নিজের বাল ছিঁড়ে দাঁতে কুটকুট করে কাটতে থাকে। সেই সঙ্গে রাজাকার পাহলোয়ান মিয়ার গভীরে মোচড়ে খেতে থাকে- এখন হাতে হারিকেন পোন্দে বাঁশ। তাও আবার গিঁটওয়ালা ।
যুদ্ধারম্ভ থেকে রাজাকার কমান্ডার মিয়া মন্টুর হম্বিতম্বির হুংকার ছিল। বাঘের ন্যায়। এবং সে-মতো ম্যান, ওম্যান ইটিং করত। যদিও কোনো বোমাবাজির গন্ধ পেলেই তার তলা ফাঁক হয়ে যেত। ফলে, বোমাভিযানে এই বাঘ এখন ইঁদুর, এবং ফুরুৎ ফুরুৎ করে ভয়ে একবার গর্তে ঢোকে, একবার ন্যাতানো লিঙ্গের মতো বাইরে আসে। অথচ সামান্য পূর্বেও নরহত্যা, নারী ধষর্ণে সে ছিল হিংস্র জন্তু। কমান্ডার মিয়া মন্টুর ভাই রাজাকার পাহলোয়ান মিয়া যে ঘাতক সিপাহসালারের ন্যায় যুদ্ধ শুরু থেকে কমান্ডার আদেশ মান্য করেছে। এবং জয়বাংলা বলা স্যার দীননাথ মাস্টারকে হত্যা করতে তার বাড়ি থেকে চোখ বেঁধে তুলে এনে তাকে হত্যা করে।
সে এখন এই দ্রিম দ্রিম বোমাভিযানে নিজের লাশের অগ্রিম মরা, পঁচা গন্ধ নিজের নাকের ভিতর দিয়ে সুড় সুড়িয়ে মগজের মধ্যে টের পায়। এবং চোখের সামনে সিনেমা দেখে, একপাল বেঙ্গলি তাকে ঘিরে, হুংকার দিয়ে, এক পাবলিক নিয়ে এলো একটি লোহার রড, গনগনে অংশটা তার বাইরে রেখে বাকি দিকটা স্রেফ পোন্দের মধ্যে খ্যাচ করে ঢুকিয়ে শেষ পর্যন্ত শরীর থেকে চামড়া ছিলে নিল। এভাবে পাহলোয়ান মিয়া তার কৃত পাপ বোধের গভীরে ঢুকে যায় ।
বোমাভিযানের যুদ্ধ শেষ।
মৃত দীননাথ মাস্টার এখন পাহলোয়ান মিয়ার ঘুমে ও জাগরণের অনুভূতিতে ভূত। সেই ভূত এখন তাকে সর্বক্ষণ যেন তাড়া করে ফেরে। ফলে পাহলোয়ান মিয়ার সমস্ত সজীব অনুভব, অনুভূতি আজ বিবস, নিষ্প্রাণ। এটা মানবিক ও খুনি রাজাকার পাহলোয়ান মিয়ার মানবিক পাশবিক বোধ চৈতন্যের হানাহানি। সেহেতু পাহলোয়ান এক মুহূর্তে যে এমন এক স্তরে পৌঁছায় থ্রি নট থ্রি রাইফেলে নিজে লোড হয়ে ট্রিগারে চাপ খেয়ে, ফুটে ফেটে বেরিয়ে যেতে চায় ।
চতুর্থ ও শেষ গল্প
লাশ নাই
এ গল্পটি আঁকা রূপকথার সুরে ও অনেকটা কাব্য আঁচড়ে। '৭১-এর ঘাতক যুদ্ধবাজদের বর্বর অত্যাচারে যখন ঘরে ঘরে শিশুর কান্না, এমনকি আদম সন্তান জন্ম ও নিস্তব্ধ । সেই সঙ্গে মসজিদের আজান। শুধু কি তাই? ঘাতক পিশাচেরা এ যুদ্ধকে হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িকতার পশুপৃষ্ঠে তুলে দিতে আপ্রাণ সচেষ্ট। এজন্য ওরা সাধারণকে ধরে ধরে তাদের মুখে কলেমা ও কাপড় উল্টে শিশ্ন পরখ করে। মসজিদ মোয়াজ্জেম তালেব আলিও এ থেকে বাদ যায় না। অথচ এই বাংলা-পাখিদের, মেঘেদের, স্বচ্ছ রোদের, ফসলের, নীল-সবুজের, তিতুমীরের, সূর্যসেনের, মুজিবের, লালনের, রবীন্দ্রনাথের, বাঙালির। যুদ্ধে যুদ্ধে লাশের স্তুূপ। এত লাশ যাচ্ছে কোথায়? মোয়াজ্জিম তালেব আলির গভীরে এ জিজ্ঞাসা। গ্রামে মানুষ একটু বেশি মরলে তার ১ খাটিয়ায় কুলায় না। কিন্তু এখন তার খাটিয়া শুধুই পড়ে থাকে।
শব-ই বরাতের রাত। তালেব আলি আল্লার করুণা প্রার্থী হয়ে ধ্যানমগ্ন। হঠাৎ ধ্যান ভেঙে সচকিত হয়। পাশে ২/১ জন মানুষ। এ মুহূর্তে যাদেরকে তার মানুষ বলে মনে হয় না। সে ওদের শরীরে হাত বুলিয়ে আশ্বস্ত হয়, হ্যাঁ মানুষ বটে। এদের সঙ্গে একজন মুক্তিযোদ্ধার লাশ। যুদ্ধে শহিদ হয়েছে। এ দেহটির দাফন-কাফনের জন্য খাটিয়া চাই। আগত মানুষেরা এ খবর জানিয়ে নিমেষে উধাও হয়ে যায়। তালেব আলি ভাবনায় পড়ে। বিচিত্র ভাবনার খোঁচা খেতে থাকে, এভাবে তার ভেতর থেকে থেকে যেন একজন বেরিয়ে তার পাশে এসে বসে। এ সময় মোয়াজ্জেমের প্রচণ্ড অন্তর্দ্বন্দ্ব। এক পর্যায়ে তারই ভেতর থেকে বলে ওঠে, খবরদার, মুক্তিযোদ্ধা কখনো শহিদ নয়, বরং মুরতাদ। পাকিস্তান মানে ইসলাম। ইসলামের শত্রু মুরতাদ!
এর পরক্ষণেই তার গভীরে ঝলকে ওঠে –পাখির মতো মানুষ মারা! শুধু মেরে ফেলা? কথা নাই, বলা নাই, মেরে ফেলা? এই দ্বন্দ্বের রশি তালেব আলিকে দু'দিক থেকে টানতে থাকে বেদম। অতঃপর তালেব আলি একবার তার সমস্ত শক্তি জড়ো করে যেন ব্ৰহ্মাণ্ড কাঁপানো চিৎকার দিয়ে বলে উঠতে পারে, না–। তারপর সে বুক চিতিয়ে দেখে, সেকি আন্তরিকতায়! মোহে! সারা জগত তার প্রতি অবনত !
এরপর এক মুহূর্তে বাংলার সবুজ ঘাসে তালেব আলির রক্তধারা মিশে যায়। মোয়াজ্জিন নিষ্প্রাণ পড়ে থাকে মসজিদের লাশ শূন্য খাটিয়ায়। এই রক্ত যত ঘণীভূত হয়, বাংলার সবুজ তত গাঢ় হয়ে ওঠে।
লাশ নাই এ গ্রন্থের প্রচ্ছদ ও ভেতর চিত্রণে শিল্পী রনি আহমেদ। যার স্কেচ-চিত্রমালা সমন্বয়ে ১৯৭১ এর যুদ্ধের ভয়াবহ দুঃসময় যেন জীবন্ত হয়ে ফুটে উঠেছে। মুক্তিযুদ্ধের এ এক অজর চিত্র।
সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ ও ‘লাশ নাই’ গল্পগ্রন্থ
অসিত বিশ্বাস
অসিত বিশ্বাস
মন্তব্য