আশির দশক, সে-এক সময় এসেছিল আমাদের জাতীয় জীবনে। সদ্যস্বাধীন রাষ্ট্র নানা চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে এগিয়ে চলছে। স্বাধীনতা নিয়ে নাগরিকের স্বপ্নভঙ্গ হয় হয় অবস্থা। রাষ্ট্রের সর্বত্র জেঁকে বসেছে স্বৈরাচার। নাগরিকদের মধ্যে সবচেয়ে সরব ও বাঙ্ময় অংশ হয়েও তরুণ কবি-লেখক-শিল্পী তাদের দ্রোহ এবং নিরীক্ষাকে উপস্থাপনের যথার্থ প্লাটফর্ম পাচ্ছে না। প্রতিনিধিত্বশীল দৈনিকের সাহিত্যপাতা প্রচল দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী কবি-সাহিত্যিকদের করায়ত্তে। এমন বাস্তবতায় এই সাহিত্যের রঙ্গমঞ্চে সৈয়দ রিয়াজুর রশীদের আবির্ভাব।
লিটলম্যাগাজিন মুভমেন্ট
লিটলম্যাগের প্রায়োগিক সংজ্ঞা, গোষ্ঠী কাগজের সঙ্গে এর সম্পর্ক ইত্যাদি নিয়ে যে মত ভিন্নতাই থাকুক না কেন, এই বঙ্গদেশে তিনি লিটলম্যাগাজিন মুভমেন্টের আইকনিক ক্যারেক্টার এ ব্যাপারে কারো বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই, যদিও তিনি নিজে কোন ছোটকাগজ সম্পাদনা করেননি। কেন করেননি?—সম্ভবত সকলের কাছেই সমান গ্রহণযোগ্য থাকতে চেয়েছেন। নেতৃত্ব দিতে চেয়েছেন। সকল লিটলম্যাগের দার্শনিক ভিত্তিভূমি ও অভিমুখের মাঝে যথেষ্ট সাযুজ্য থাকলেও অনেকটা নিজস্বতা নিয়ে ছোটকাগজগুলোর উদ্ভব। সেক্ষেত্রে সকল ছোট কাগজে লেখা একজন দ্রোহী-সংবেদনশীল ক্রিয়েটিভ পারসনের পক্ষে সম্ভবপর কি?
বহুকথিত উবাচ, যে শিক্ষিত জন যৌবনে মার্কসিজমে আকৃষ্ট হয় না সে হৃদয়হীন। আর এর ফাঁক-ফাঁকি অনুধাবন করে পরিণত বয়সে যে বাস্তবানুগ হয় না সে কাণ্ডজ্ঞানহীন। এই কথার সারবত্তা যা-ই থাক না কেন এটা স্পষ্ট, যৌবনের রোমান্টিকতা পরিণত বয়সের জীবনাভিজ্ঞতায় বদলে যায়। যদি না হয় তবে বুঝতে হবে তা নিছক রোমান্টিকতামাত্র ছিল না।
তিনি যখন লিটলম্যাগাজিন মুভমেন্টে যুক্ত হন তখনই ছিলেন পরিণত, সম্ভবত বিবাহিত। যদিও তাঁর পরিপার্শ্বের প্রায় সবাই ছিলেন ব্যাচেলর। এখন পর্যন্ত তিনি লিটল ম্যাগাজিনের ঝান্ডা উড়িয়েই চলেছেন। জয়তু চিত্তব্রতী জীবনরসিক রিয়াজ ভাই!
অদম্য সাহিত্য-সাধক, সংশপ্তক অভিযাত্রী
সম্প্রতি তার রচনাবলীর প্রথম খন্ড আলোর মুখ দেখেছে। তিনি উপন্যাস ছাড়াও নাটক, ট্রাভেলগ, নিবন্ধ, ছড়া, গান ও কবিতা লিখেছেন। তবুও মূলত গদ্যকার হিসেবেই তাঁর পরিচতি। যেমন রবীন্দ্রনাথ সাহিত্যের প্রায় সব অনুষঙ্গ চর্চা করেও জনসাধারণ্যে কবি বলেই জ্ঞাত।
রিয়াজুর রশীদ ডিটেইলিংসহ আইডিয়া-নির্ভর গল্প লিখতে অভ্যস্ত। প্রান্তিক মানুষ ও তাঁদের জীবনকে তিনি পরিপার্শ্বের নানা অনুষঙ্গ সহযোগে তাঁর গল্পে তুলে ধরেন। আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে প্রান্তজনের এই জীবন তুলে ধরা প্রকল্পে তিনি মতাদর্শ-নির্ভর নন; কিন্তু একটু সাবধানী পর্যবেক্ষণেই বোঝা যায়, তিনি যে মতাদর্শ-পরিচালিত নন তা বোঝাবার সযত্ন প্রয়াস আছে তাঁর সৃষ্টিকর্মে।
তাঁর গদ্য তৎসম শব্দবহুল। লেখক হিসেবে তাঁর দৃষ্টিকোণ ও প্রবণতা তাঁকে ক্লাসিসিস্ট হিসেবে চিহ্নিত করতে প্ররোচিত করে। তাছাড়া তাঁর সৃষ্টিকর্মে প্রান্তিক জন ও তাঁদের জীবন যেন অনেকটাই ক্ষমতাকেন্দ্রের ভাষায় লিপিবদ্ধ। তৎসম শব্দের অধিক ব্যবহার ও একাডেমিক ডিসকার্সিভ ভঙ্গি তাঁর গদ্যকে একই সঙ্গে আড়ষ্ট ও সংহত করে তোলে । এই আড়ষ্টতাও ধ্বনি ও চিত্রের সমন্বয়ে, জনপ্রিয় ভাষায় কবিত্বের গুণে, প্রায়শ উপভোগ্য হয়ে ওঠে। কিন্তু রিয়াজুর রশীদের ক্ষেত্রে তা ঘটে কি?
প্রকৃত প্রস্তাবে, বিকল্প মাধ্যমে যাঁরা কবিতা, গদ্য, পদ্য, ছড়া, নাটক, উপন্যাস ইত্যাদি চর্চা করেন তাঁদের আলাদা নন্দনের নির্মাণ অতিজরুরি; যেন কথিত মূলধারা থেকে তাঁদের সহজেই পৃথক করা যায়। যেমনটা করেছেন মার্ক্সিস্ট সাহিত্যিকেরা তাঁদের সৃষ্টিকর্ম তাঁদের কাউন্টার পার্ট থেকে। কিন্তু এই অভাগা বঙ্গদেশে যাঁরা শুধুমাত্র লিটলম্যাগে শিল্প-সাহিত্যচর্চায় রত তাঁরা তা করতে নিদারুণভাবে ব্যর্থ হয়েছেন। অদম্য সাহিত্য-সাধক, সংশপ্তক অভিযাত্রী সৈয়দ রিয়াজুর রশীদের উপর্যুক্ত পরিপ্রেক্ষিতে একটি চেষ্টা আছে। অবশ্য কে-না জানে, এক চড়ুইয়ের ডাকে বসন্ত আসে না।
এক্টিভিস্ট ও মানুষ সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ
সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ অবস্থাপন্ন পরিবারেব সন্তান। প্রথাগত দৃষ্টিকোণ থেকে তিনি প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা, সাহিত্যোন্মাদনা, লিটিলম্যাগ ইত্যাদি করতে করতে কিছুটা ডিক্লাস হয়েছেন, হয়েছেন নিঃসঙ্গ।
তিনি কমিটমেন্টহীন বাজারি লেখা ও লেখকের সঙ্গে কখনো আপস করেননি। অনুমোদন করেননি নিছক নন্দনের কচকচানিকেও। তাই সহজেই অনুমেয় লিটারারি এরিনায় তার বন্ধুসংখ্যা হাতে গোনা-ই হবে। তাছাড়া কিছু ক্ষেত্রে মতভিন্নতায়- মনভিন্নতা হয়নি এমনও বোধ হয় না।
তিনি এদেশে স্বাধীনতা-উত্তর লিটলম্যাগ চর্চার সাক্ষী ও প্রহরী। ক্ষেত্রবিশেষে তাঁর কোন আচরণে কেউ কেউ খানিকটা প্রতিহত বোধ করতে পারেন। এখানে স্মর্তব্য যে, তিনি সর্বক্ষেত্রে ক্রিয়া করেছেন লিটলম্যাগ-প্রতিনিধি হিসেবে, ব্যক্তি রিয়াজুর রশীদ হিসেবে নয়। সান্নিধ্যে, কাছ থেকে দেখলে এই বটবৃক্ষের ছায়া কিছুটা টের পাওয়া যায়। অনুজগণের কেউ কেউ অগ্রজের উপহার হিসেবে তাঁর নিঃশব্দ স্নেহের পরশ-ও হয়ত পেয়ে থাকবেন।
স্মৃতিচূর্ণ
প্রথম কবে কখন তার সঙ্গে আলাপ হয়েছিল ঠিক মনে নেই। তবে এটা মনে আছে লিটলম্যাগের সিনিয়র লেখকদের মাঝে রিয়াজ ভাই-ই প্রথম এই অধমকে বাসায় পানাহারে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। আমিও তাঁকে গ্রাম থেকে আগত কয়েক থোকা কাঁচা আম উপহার দিয়েছিলাম। মনে হয় তিনি খুশিই হয়েছিলেন। ২০১১-তে আমার প্রথম বই ব্যক্তিকতায় নৈর্ব্যক্তিক আলোর মুখ দেখে। তিনি বইটির ফ্ল্যাপ লিখেছিলেন। আমি তার কয়েকটি টেক্সটের মৌখিকভাবে পাঠ-প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিলাম। মনে হয়েছিল, ক্রিটিক্যাল অ্যাপ্রিসিয়েশন তাঁর খুবএকটা মনঃপুত হয়নি। মনে পড়ে আমাদের বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের সান্ধ্য আড্ডায় তিনি একবার আমন্ত্রিত হয়েছিলেন তাঁর টেক্সট-এর ওপর আলোচনা ছিল বলে।
প্রত্যেকের কাছে তিনি হয়তো একই রকম নন। আমার অভিজ্ঞতায় তিনি এমন একজন সিনিয়র লেখক যিনি বৈকালিক সাক্ষাতে অবলীলায় বলতে পারেন, ‘হ্যাংওভারে আছ?’
দূরত্বের সুন্দর, নৈকট্যেও কি?
কথিত আছে, পরিবার সমাজ বিপ্লবকে পছন্দ করে, বিপ্লবীকে নয়। লিটারেরি এরিনায় যিনি মূলধারার গড্ডালিকা প্রবাহকে চ্যালেঞ্জ করেন তার ক্ষেত্রে এর অন্যথা হবার কোন কারণ নেই। লিটারারি এক্টিভিজমের ফলে বিভিন্ন পারিবারিক কিংবা সামাজিক দায়িত্ব পালনে তাঁর সীমাবদ্ধতায় আত্মীয়-স্বজন কিংবা পাড়া-প্রতিবেশী খুশি হবেন এমনটা ভাবা বোকামি। জানা যায়, লিটারারি এরিনাতেও তাঁর বিভিন্ন স্ট্যান্ডপয়েন্ট কোনো কোনো জুনিয়রের জন্য সুখকর হয়নি । হতে পারে তাঁদের এই অসন্তুষ্টি অযৌক্তিক নয়।
শেষ কথন
হালআমলে মানুষজনের অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের আগ্রহ কর্পূরের মত উবে গেছে। লিটলম্যাগও যেন মরুপথে দিশা হারিয়েছে। তাই সৈয়দ রিয়াজুর রশীদের মত যাঁরা শুধু ছোটকাগজকেই চর্চার একমাত্র প্ল্যাটফর্ম হিসেবে বেছে নিয়েছেন তাঁদের সৃষ্টিকর্মের মূল্যায়নে সাবধানী হওয়াই বাঞ্ছনীয়। কেননা, এই মুভমেন্ট ও এতে তাঁদের সঙ্গে সক্রিয়তার ধরনকে বিবেচনা ব্যতিরেকে শুধুমাত্র তাঁদের সৃজনকর্মের মূল্যায়ন হবে নিতান্তই খণ্ডিত ও একদেশদর্শী।
পরিশেষে বলতেই হয়, জয়তু রিয়াজ ভাই! অভিনন্দন জানাই আপনার এই অমৃতরস অনুসন্ধানকে, সাহিত্যে জীবনের সমান চুমুককে।
সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ: এক অমৃতরস-ব্রতচারী, লিটারারি অ্যাক্টিভিস্ট
আহমেদ লিপু
আহমেদ লিপু
মন্তব্য