.header-button .inner > span { font-size: 18px !important; } .header-button .inner i.fa { font-size: 40px !important; } .comment-form-message { background-color: #f4f4f4 !important; font-size: 14px !important; }

একটি বাতির শিখা থেকে / শিবলী মোকতাদির

একটি বাতির শিখা থেকে / শিবলী মোকতাদির
দোয়েলের শিস শুনতে গেলে বেঁচে থাকতে হয়, এই পৃথিবীতেই বাঁচতে হয়, কারণ দোয়েলও এই পৃথিবীর বাসিন্দা। বাঁচতে হয়, সহবাসিন্দার দিকে তাকাতে হয়, তাকে মনে ঠাঁই দিতে হয়, তবেই শোনা যায় দোয়েলের শিস, সে খুব ভাগ্যের ব্যাপার। সবার ভাগ্যে তা হয় না, কেননা সবাই দোয়েলের সহবাসিন্দা নন। একজন শাহেদ শাফায়েতের কিছুটা হলেও সেই ভাগ্য ছিল। পৃথিবীর সবচেয়ে ভালো জ্যামিতি আঁকা থাকে ময়ূরের পেখমে, তাকে দেখার দৃষ্টি দুর্মূল্য কষ্টে, দীক্ষায়, অপেক্ষায় অর্জন করতে হয়। এই অর্জনের ভাগিদার ছিল শাফায়েত। খুব ঘন করে, তরিয়ে তরিয়ে শাহেদ-কে যতটুকু দেখেছি, শুনেছি, বুঝেছি তাতে পৃথিবীর সাম্রাজ্যের সম্রাট হওয়া যায়। শিল্পের অনেক রকম ডালপালাতে তার বিচরণ ছিল। তার সঙ্গ, ভরাট গলায় আততায়ী আড্ডায়, বিশেষ করে আধ্যাত্মবাদ নিয়ে তার কাছ থেকে যেটুকু শুনেছি মনে হয় কিছুটা হলেও কেটে গেছে আমার পাপবোধ। বিচ্ছেদ, একাকিত্ব, উপশমহীন যন্ত্রণার বোধি শাফায়েত মুচকি হেসে লাঘব করে দিতো মাদকের মন্ত্র দিয়ে।

কবিতা নিয়ে নতুন কাজ হবে, এটা সচলতার লক্ষণ। আমি একে আমন্ত্রণ জানাই। এতদিনের অভ্যস্ত কবিতার চেহারা না পাল্টালে, ভাষাকে আমূল বদলে দিতে না পারলে বাংলাকবিতা তার স্বর, সুর হারিয়ে দাঁড়িয়ে পড়বে পূর্ণযতির আকারে। আমাদের ব্যক্তিগত বোধ, পর্যবেক্ষণ, প্রতিবাদ অবশ্যই কবিতার কেন্দ্রে থাকবে। তবে তার সঙ্গে এসে মিশতে হবে একদিকে শেকড় সংলগ্নতা, অন্যদিকে বৈশ্বিক বোধ, ইতিহাস সচেতনতা, সমাজ মনষ্কতা। ভাষা নিয়ে করতে হবে নিরন্তর পরীক্ষা, এবং সর্বোপরি মানুষের কাছে দায়বদ্ধতা। তা না হলে কবিতা হারিয়ে ফেলবে তার সামাজিক আবেদন। বাড়বে জনবিচ্ছিন্নতা।

প্রয়াত কবি শাহেদ শাফায়েত কবিতার মধ্য দিয়ে নিজেকে জানার জন্য জানালার দু’টি কপাটই খুলে দিয়েছিলেন দিগন্তের দিকে। বিশ্বাস আর ভালোবাসার কোরক ফাটিয়ে তিনি হতে চেষ্টা করছেন বিচিত্রগামী ও বিশ্বচারী। শাশ্বত চিরন্তন মূল্যবোধের পাশাপাশি তার কবিতায় আমরা দেখতে পাই প্রাচীন শব্দপুঞ্জের ব্যবহার। যা সুন্দর অনুরণন তোলার পাশাপাশি জীবন পদচারণায় কিছুটা হলেও আড়ষ্টতা সৃষ্টি করে বৈকি! এই যে প্রবীণে-নবীনে সখ্য গড়ে ওঠে তার কবিতায় এটা যেন মন্দ-মাদলের সুরসুষমা।

দশক, ভীষণ ঘোলাটে ব্যাপার। সাহিত্যের মহাজনরা তাকে আশির মধ্যে আবদ্ধ করেছে। আমি সুদকষা অঙ্ক মেনে শাহেদকে নব্বইয়ের ঘরে রাখতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি। নব্বইয়ের দশক--কবিতায় জ্বালিয়েছে কৃষ্ণচূড়ার আগুন। কী ভাষায়, কী চিত্রকল্পে, কী অলংকারে, কী ছন্দে, কী বোধে চরম সব ইউটার্ন নিয়েছে। পিছনের দশককে সামান্যতম সিগন্যাল না দিয়ে। তাতে বিশুদ্ধ কবিতার বনভূমি নিয়ে ঝড় উঠেছে। নিন্দার ঢেউ বয়ে গেছে। নাদানে বলে--বন থাকবে স্নিগ্ধ আর সবুজে ভরপুর। বন দেখবে প্যারালাল, সমতলে হেঁটে হেঁটে। অথচ নব্বই তা দেখতে চেয়েছে পাশ থেকে, বনের গহীন ভিতর থেকে, মাঝারি উচ্চতা থেকে। সর্বোপরি ওপর থেকে। চিলের চোখ দিয়ে। অজস্র কোণ থেকে, জুমইন আর জুমআউটের ব্যাখ্যা থেকে। নানা আলোকরশ্মিতে বাঁধতে চেয়েছে তাকে। আর এমনই নব্বইয়ের অনেক তুর্কি তরুণের একজন শাহেদ শাফায়েত হতে পেরেছে। বা হবার চেষ্টা করেছে। চেষ্টা বলছি এ কারণে, সময় তাকে সময় দিলো না যে। সমাজ তাকে সাহায্য করল না যে। রাষ্ট্র তাকে রহিত করল যে!

জানি, এ পৃথিবীতে শিল্পের নেই কোনো শাশ্বত মানদণ্ড তবু তর্ক হতো বাহাস আর বিতর্কে বাতাস ভারী হয়ে উঠত। শাহেদ বোঝাত সব কুয়াশাই কেটে যায়, আবার নতুন করে জমে নতুন বাষ্পকণা, বিলীন কুয়াশা অথবা নতুন মেঘ-বৃষ্টি-জল যার কোনো অগ্রিম হিসেব থাকে না। সময়ের দাসানুদাস আমরা সবাই। সত্যিই তাই, দেখতে দেখতে প্রাণোচ্ছল বন্ধু আমার হারিয়ে গেল। যেন পায়ের নিচে এই গ্রহ নেই, যেন হারিয়ে গিয়েছে বালক, লুকিয়েছে বা লুকোচুরি খেলার ছলে। কেউ কি আর খুঁজে নেবে তাকে, খুঁজে পাবে কেউ? এই পৃথিবীতে তার ঠিকানা নেই। তারা জ্বলে, জ্বলতে জ্বলতে নিভেও যায় একদিন। শাহেদ শাফায়েত--যাকে নিয়ে অনেক কিছু লেখা সম্ভব। সে আমার সমবয়সী, সখা বা সুহৃদ এটুকু বলার স্পর্ধাও আমার আছে। এই তো গত বছরের মে মাসেই কথা হল আমাদের কবিতা নিয়ে, কৃষ্টি নিয়ে, গান নিয়ে, রাজনীতির নোংরামো নিয়ে অথচ মনে হয় কত হিমযুগ, কত পর্বতনিক্ষেপ কত জীবাশ্মের স্তরীভবন দেখলাম যেন। পাল্টে যাচ্ছে পৃথিবীর মানচিত্র, সঙ্কুচিত হচ্ছে মহাদেশগুলো, আমাদের পা পড়ছে নব সমুদ্রচিহ্নে, অপরিণত ভূগোলে এবং সদ্য আবিষ্কৃত মরু-মেরু-অরণ্য চিহ্নিত হচ্ছে। সবকিছু ঠিক থাকলে শাহেদ বাংলা কবিতার বিশেষ অধ্যায় হয়ে উঠতে পারত। তার থেকে যেটুকু নির্যাস আমি পেয়েছি, এক কথায় ধন্য, রিপ্লেতে ধন্যবাদ দিলাম শাহেদ, তুমি গ্রহণ করিও। ব্যক্তিগতভাবে আমিও কবিতার মানুষ। কষ্টে অনাহারে যা কিছু, যেটুকু পারি ফুটিয়ে তুলতে চেষ্টা করি কবিতায়। খুব অবাক লাগছে ভাবতে, জীবদ্দশায় ব্যক্তি বা কবি শাহেদকে নিয়ে কেউ না লিখুক আমি কেন কিছুই লিখলাম না?

গৌরবময় নব্বইয়ের দশক কবিতার একটি যুদ্ধক্ষেত্র যা তরুণ টগবগে মন ও মেধায় পূর্বসূরীদের অতিক্রম করার এক তীব্র প্রস্তুতি। আর সেইসব কবিরা যারা অনুভব এবং দৃষ্টির সামনে কলম নামক একটি অস্ত্রের সঞ্চরণে সাদার ভিতর শব্দের রেখাঙ্কন করে তুলেছেন সৃষ্টির তুমুল উন্মাদনার কাল, স্ফুরিত স্ফুলিঙ্গের চমকে কুসুমি বাহার বিচিত্র বিস্ময়। সেই টগবগে প্রতিভামণ্ডিত কবিদের কাতার থেকে আলোচ্য এই কবি, এই সন্ত--শাহেদ শাফায়েত বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

চলে গেছে শাহেদ কিন্তু রেখে যাওয়া তার আখ্যানপর্ব গেঁথে আছে আমাদের ব্যক্তিগত বুকসেলফে, হৃদয়ে, মনে, মননে। উত্থান-পতন, নানা ঝড়-ঝঞ্ঝায় যে টলেনি একরত্তি। ভেসে যায়নি অকাল স্রোতে। বরং ঘাপটি মেরে বসে বসে চেয়ে দেখেছে কোথায় স্থলন, কোথায় পতন, কোথায় নিমজ্জিত হচ্ছে সাহিত্যের! বিরাগ আর বিভীষিকার এই কালে কে কার আঙুল ছেড়ে ছুটে যাচ্ছে প্রেমের প্রয়াণকে উহ্যে রেখে। বিচ্ছেদ, বিরাগ, মান-অভিমান, তাপ-সন্তাপ, ক্ষেদ, বিভেদ, গরল, উষ্মা, শ্লেষ, তর্ক-বিতর্কের বিবিধ যতিচিহ্নের ধেয়ে আসা আগমনকে এক ধমকে থমকে দিয়ে শাফায়েত তার টেক্সট দিয়ে বলতে পেরেছেন-ওহে! পথ ছাড়ো। তুমি চলো তোমার রাস্তায়। আমি যাব বরাবর, আমার ডিকশনকে সঙ্গী করে। চাইলে আসতে পারো নইলে পথ ছাড়ো।

আমার বন্ধু, আমার কবি, হৃদয়ে যার উভয়ের আনাগোনা। মন যার উভয়ের ভাড়ায় চালিত। সেই প্রিয় মানুষটি। আহা! আকার আর আয়তনে স্রেফ নাই হয়ে গেল। যদিও এ-শব্দে ঘোরতর আপত্তি আমার। কেমন ইন্ডিকেট করার মতো। কেমন জেলভাঙা ঘুঘুর মতো। নিষ্কামী কামুকের মতো। আচমকা চোর বলে গালি দেবার মতো। সেই গুপ্ত আর সন্দেহপ্রবণ শব্দরাশি মৃত্যুতে নিজেকে উজার করে দিলো। স্যরি, বাংলাতে দুঃখিত আমি। প্রচল ভাঙতে পারিনি আজও। কাজেই সেই শব্দই-বিদঘুটে, বেঢপ ‘মৃত্যু’ শব্দটি ঘুরেফিরেই লিখতে হচ্ছে। আমাকে ক্ষমা করো শাহেদ ।

১৯৮৯ সাল। সেকালে প্রযুক্তির এত আস্ফালন আসেনি। তাছাড়া ঘটা করে ঘটনাকে ঘরবন্দি করতে চাইনি আমরা। মনেও আসেনি কোনোদিন। আলপনা সাহিত্য সংসদের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী অনুষ্ঠানে বগুড়া থেকে দশ/বারোজনের কবিতাবান্ধব দলের সাথে প্রথম গিয়েছিলাম ঠাকুরগাঁয়ে। লম্বা, লিকলিকে একহারা গড়নের শাহেদ তীব্র শীতের ভোরে কুয়াশা কেটে কেটে আমার রুমে এসে হাজির। হাতে এক ফর্মার ‘কোরপাটেলিক’। স্মিত হেসে আমার হাতে দিয়ে বললÑপড়বে। দেবীগঞ্জ আরও দূরে। এক ঝটকায় আমাকে তুমি সম্বোধনের এই স্মার্টনেস মুগ্ধ করেছিল আমাকে। বয়সের ভারে অনেক স্মৃতিই সাদা আর ফকফকা হয়ে গেছে আজ। তবু কিছু কিছু মুহূর্তের ছবি, গান, সুর, সময় অজান্তেই খুঁজে পাই। এ রকমই দু’চারটে ছবি, কবিতা, ওর লেখা, নোট, চিঠি আজও রয়ে গেছে আমার কাছে। বর্ণনাতীত বর্ষায়, হেমন্তের হিসাবী রৌদ্রে, সহনীয় শীতে, চৈত্রের চঞ্চলতায়--এ মন যখনই অস্থির, আবেগ আর অহংকারে আঁকুপাঁকু করে, আমি মেলে ধরতাম গোপনে সেসব ছবি। প্রাণ ভরে দেখতাম। হাসতে হাসতে পুলকে যৌবন ফিরে আনতাম। গোপন কখনো কখনো ফ্লাস হয়ে যায়। জেগে উঠে মাঝরাতে এমন দৃশ্যে আমাকে মুগ্ধ হতে দেখে, অগভীর সন্দেহে চেয়ে থাকে বউ। সন্দেহের তির ছুড়ে মারে। তাকে আস্বস্ত করতে গল্পের ঝাঁপি খুলে নতুন কাহিনির বয়ান শুরু করি। সে হাই তোলে, এক সময় ঘুমিয়েও পড়ে। আমি শাহেদের হাজারো আখ্যান অলিখিত পাত্রে ভরে ভরে ভরপুর করে তুলি।

‘তোমার জৌলুস মাখা প্রতিটি ভোরের গান’ যতটা ভালো লেগেছিল শেষ গ্রন্থটি সেরকম লাগেনি। শাহেদ প্রায়ই প্রতীকের আচ্ছাদনে তুলে ধরত কবিতার মধ্য দিয়ে তার বক্তব্য। ব্যক্তিগতভাবে যা শুনতে খুব মসৃণ মনে হয় না। আমি চাই কবিতায় থাকুক প্রতীকের বৈচিত্র্য, চিন্তামূলকতা, সাহিত্যের সামগ্রিক ধূসরতা যা কবিতার নতুন বর্ণ প্রলেপণের তেজ হিসেবে কাজ করে। ঝিনুকে খাঁটি মুক্তার আকার নিতে যথেষ্ট সময় দিতে হয়। সইতে হয় বেদনার অনেক বাতাবরণ। সর্ট সিলেবাসের সংবিধান এখানে এখতিয়ার বহির্ভূত। কাজেই একজন কবির রেলগাড়ির মতো বিরতীহীন ঝমাঝম ছুটে চলা এক সময় ক্লান্তিকর হয়ে দাঁড়ায়। এঞ্জিনের আয়ু কমিয়ে দেয়। কাব্যে ভারাক্রান্ত হলে কথিত কবিতার মডেলগুলোয় যেসব গেমপ্ল্যান থাকে তার হুঙ্কার শেষ অবধি পাঠকের কানে পৌঁছতে সময় লাগে। নিদ্রাহীনতায় কবিতা হয়ে ওঠে কোষ্ঠকাঠিন্যে ভরপুর। ফলে একঘরে হওয়ার রিস্ক থেকে যায়। শাহবাগের আড্ডাতে এসব নিয়ে বাহাস হতো। নেশায় চুর হয়ে থাকা আরেক বন্ধু শামীম কবীর চুপচাপ শুনত। শাহবাগ যতটা তাকে মাথায় তুলেছিল আমার বিশ্বাস ঠিক ততটাই পতন করেছে।

১৯৮৯ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২২ সালের মে, দীর্ঘ এই জার্নিতে কতবার কোথায় কোথায় কীভাবে যে দেখা, আড্ডা, আলাপ জমেছে তার ফিরিস্তি দিতে গেলে রাত কেঁদে ভোর হয়ে যাবে। সেদিকে না যাই, বরং গত বছরের মে মাসের শেষ দেখাটুকু, শেষ আলাপ বা প্রলাপটুকু, দেবীগঞ্জের করতোয়ার স্বচ্ছ জলের দিকে তাকিয়ে দুই বন্ধুতে সেল্ফিবন্দি হওয়াটুকু এবং অতি অবশ্যই ওর শেষ কাব্যগ্রন্থ ‘চরকা কাটার গান’ আমার হাতে দিয়ে বলা--বাড়ি ফিরে পড়বে! সেই লিকলিকে শাহেদকে দেখলাম কেমন সুঠাম, খানিকটা টল মনে হল। কখন যে বুকে টেনে নিলাম! সবই আজ ভ্রম মনে হচ্ছে!

আমি কথা রেখেছিলাম। ফিরে এই গ্রন্থের কবিতাগুলো পড়লাম। মন লাগিয়ে। খুব চড়া তারে তারা যে বাঁধা নয় এটা বুঝলাম। তবে স্থিরও নয়, প্রবাহমান। কবিতার আবহ বোঝাতে শাফায়েত ব্যবহারযোগ্য শব্দাবলীকে কবিতাসাপেক্ষ কৃত্রিম জটিলতার জালে না চুবিয়ে নিজের কায়দায় সোজাসুজি সাজাতে চেষ্টা করেছে। কতটা পেরেছে তা হয়ত কাল বলে দেবে সে প্রশ্নের উত্তরলিপি। ছন্দ-টন্দের দিকে মনোযোগ দেয়নি মোটেই। ছন্দ সংক্ষিপ্ত ভাষণের মধ্য দিয়ে ভাবকে দ্যুতিময় করে তোলে। তার অতিরিক্ত গদ্যময়তা অতিভাষণের রূপ নিয়েছে কখনো কখনো। একদিন ফোনে দীর্ঘ আলাপে এসব বললাম তাকে। বললাম--প্রথমেই তোমাকে স্থির হতে হবে। অসম্পূর্ণ ধারণা, দিকহীনতা এবং এলোপাথারি হাতরে বেড়ানোর টেনশান থেকে মুক্ত হতে হবে। তুমি তো নাগরিক কবি, সুতরাং বুদ্ধিশাসিত। নগরজীবনের বিচিত্র জটিলতায় ব্যক্তি হৃদয়ের যে বিচিত্র বিকাশ তাকে তুমি অভিব্যক্ত করতে পারো সুন্দরভাবে। আর বুদ্ধির শাসন তোমার প্রেমের কবিতা পর্যন্তও প্রসৃত এবং সবশেষে তোমার কবিতায় একটা পরিণতির সুর বেজেছে যা অনেকটা স্থির নিশ্চয়তার, প্রগাঢ়, প্রশান্তির।

এ লেখা লিখতে গিয়ে আমি ইচ্ছে করলেই শাহেদের অনেক কবিতাকে কোড করতে, ব্যাখ্যায় উত্তর লাগাতে পারতাম। আমি করিনি তা। ইচ্ছে করে এড়িয়ে গেলাম। আজ নয়, সে হবেক্ষণ, অন্য আর একদিন। আজ শুধু কবিত্বের, কী করে কোথা হতে ওহীর আছর লাগে আজ শুধু সেটুকু ভাবার দিন।

‘মানুষ মানুষের জন্য’ এ বাক্যে আজকাল ভাওতা আর ভসকা গন্ধ খুঁজে পাই আমি। কী করেছি আমরা, শাহেদকে নিয়ে? এ কাতারে আমি নিজেও সমান অপরাধী। এ আমাদের লজ্জা, করুণ ব্যর্থতা। ভাব দেখাই সর্বহারা, আসলে পুঁজিবাদি। রাজধানী ছেড়ে প্রান্তের শহর পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জে স্থিতু হয়েছিল সে। একবিন্দু শান্তির আশায়। কিন্তু কেউ কী দিলো? একান্তই পারিবারিক এবং স্থানীয় দু’চারজন খাঁটি বন্ধুদের চেষ্টায় এলোমেলো শাহেদ ফের সহজ, সরল হয়ে আসছিল। এরকম সংবাদ পেতাম কথাশিল্পী, ‘চালচিত্র’ সম্পাদক রাজা সহিদুল আসলাম ভাইয়ের মারফতে। বহুদিন পর গত বছরের মে মাসে দেবীগঞ্জে সাহিত্যের এক অনুষ্ঠানে গিয়ে হাসিখুশি শাহেদকে পেলাম। মাত্র ক’টা মাস। আমি আবার যাব। কথা দিয়েছিলাম। ওর সঙ্গে ময়নামতীর চরে ডানা মেলে উড়ে বেড়াব। কিন্তু ভাষার এ মাসে তার অকাল প্রস্থান এ কীসের আলামত! আমি বুঝি না শাহেদ। বোঝার ব্যাখ্যাও চাইনি কারও কাছে। মৃত্যুর অপর নাম বেঁচে যাওয়া। তুমি কি তবে বেঁচে গেলে শাহেদ শাফায়েত?

বিপুলা এই পৃথিবীতে আমাদের আসা হয়তো একবার-ই। এখানে যা-কিছুই চলমান তার চূড়ান্ত নৈরাজ্যের স্বাদ নিতে, রকমারি রহস্যের বৃত্তকে ভাঙতে আমরা যতটা পারি তারও চাইতে অধিক কল্পনা করি। আমাদের সত্তার বা আত্মার দুঃখের, বেদনার ভাষাকে অনুভূতির অনন্য রঙে রাঙাতে মরিয়া হয়ে উঠি। ঘুম থেকে ঘুম, মাঝে বহমান এই যে জাগরণ সেখানে কত কত মুখ, কত কাহিনি, কত বিলাপ, কত আহাজারি, কত পাওয়া না-পাওয়া, দুঃখ-শোক, ক্লান্তি-জরা, ক্ষুধা-খরাÑপ্যানারোমার মতো ভেসে যাচ্ছে বেশ্যা, মাতাল, চোর, পকেটমার, খুনী, ভণ্ড, জারজ, উন্মাদ, সুদখোর, অন্ধ, ভিখারি। ভিড়ের মধ্যে অই দূর অন্ধকারেও সামান্য আলো হয়ে চেয়ে চেয়ে দেখছেন কেবল একজনই। তিনি কবি। খাঁটি কবি। চেরাগের শেষ আলোটুকু দপ করে নিভিয়ে দিয়ে চলে গেলে আনোখা কবিতার রাজ্যে। চারিদিকে ঝলমলে বসন্ত, কত রং নিয়ে উড়ে যাচ্ছে প্রজাপতি, বর্ষায় হে বৃষ্টির ফোঁটা তুমি ফুল হয়ে ঝরে যাবে, কত নিবেদন, কত নৈবেদ্য ঝরে পড়ছে, অচেনা দেশের প্লেন মাঝরাতে উড়ে যাবে অন্য মহাদেশে, কত ক্রোধ কত প্রতিবাদ জমা হবে আত্মায়। হায় রে শাহেদ! তুমি কিছুই, কিচ্ছুটি জানবে না। তোমার বয়স থেমে গেছে। আহা রে অঙ্ক! এই সন্দেশে কোটি কোটি সন্দেশের ভাগিদার হলে বন্ধু।

মৃত্যুকে যে নামেই ডাকি না কেন, সকল মৃত্যুই শ্রদ্ধেয়। কিন্তু কিছু মৃত্যু মহান, যদি হয় বীরের মৃত্যু। বলি রাত বাড়ছে, অন্ধকারে আলোর মশাল জ্বেলে, আহ! একটু আস্তে চল না ধীর। এপারে সব চোরকাঁটাতে ভরা। ডাকছে শাহেদ, সবুজ শাহেদ, বন্ধু শাফায়েত। দুলছে দূরে শিউলি শাখা, সঙ্গে নিয়ে ব্যূহ চক্র তির!

জানি মুগ্ধতার কোনো বিশ্লেষণ হয় না। শাহেদের মনোজগৎ ছিল বৃহৎ আর গতিশীল। চোখেমুখে ভাসত অন্তহীন জিজ্ঞাসা আর জিজ্ঞাসা। গোপন রহস্য জানার জন্য উচাটন হয়ে থাকত। প্রচলিত ছকের বাইরে গিয়ে নতুন নতুন পথ ও পন্থার হদিস জানাতে গেলে সে প্রথমেই যে মেনে নিতো তেমনটা না। সহজেই হাল ছাড়ত না। দারুণ কণ্ঠ ছিল তার। ভালো বলতে পারত। এমনভাবে বলত যাতে হারিয়ে না যায়! তার বক্তব্যগুলো শাক্ততন্ত্রের মতো গূহ্য, আবরিত। চর্চার ফলে তার কথার মূল অর্থ বুঝতাম, তৃপ্ত হতাম। আমার সাথে শাফায়েতের রেখে যাওয়া আলাপগুলো জীবনের সুখ-দুঃখ, উত্থান-পতন, বিপর্যয়, অসহয়তা ও অন্ধকার দূরীকরণে ভীষণভাবে কাজে লাগে, অনেক সময় অবলম্বন হয়ে দাঁড়ায়। শুধু কষ্টটা এখানেই সে তুলনায় আমি আমরা কিছুই দিতে পারলাম না। রাষ্ট্র তো নয়ই। শাহেদ শাফায়েত আমি বলছি--সর্বনাশের আয়োজনের বিরুদ্ধে আমাদের লড়াই, এই লড়াইয়ে বাংলা সংস্কৃতিই জয়ী হবে। প্রিয় বন্ধু সেদিনই হবে তোমার যথার্থ স্বীকৃতি-সম্মান। যে যাই বলুক, আড়চোখে কথা হবে আমাদের।   

 একটি বাতির শিখা থেকে 
শিবলী মোকতাদির

মন্তব্য

নাম

অনুবাদ,32,আত্মজীবনী,26,আর্ট-গ্যালারী,1,আলোকচিত্র,1,ই-বুক,7,উৎপলকুমার বসু,23,কবিতা,303,কবিতায় কুড়িগ্রাম,7,কর্মকাণ্ড,14,কার্ল মার্ক্স,1,গল্প,54,ছড়া,1,ছোটগল্প,12,জার্নাল,4,জীবনী,6,দশকথা,24,পাণ্ডুলিপি,10,পুনঃপ্রকাশ,14,পোয়েটিক ফিকশন,1,প্রতিবাদ,1,প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা,4,প্রবন্ধ,152,প্রিন্ট সংখ্যা,4,বর্ষা সংখ্যা,1,বসন্ত,15,বিক্রয়বিভাগ,21,বিবিধ,2,বিবৃতি,1,বিশেষ,23,বুলেটিন,4,বৈশাখ,1,ভাষা-সিরিজ,5,ভিডিও,1,মাসুমুল আলম,35,মুক্তগদ্য,36,মে দিবস,1,যুগপূর্তি,6,রিভিউ,5,লকডাউন,2,শাহেদ শাফায়েত,25,শিশুতোষ,1,সন্দীপ দত্ত,8,সম্পাদকীয়,16,সাক্ষাৎকার,21,সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ,18,সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ,55,সৈয়দ সাখাওয়াৎ,33,স্মৃতিকথা,14,হেমন্ত,1,
ltr
item
বিন্দু | লিটল ম্যাগাজিন: একটি বাতির শিখা থেকে / শিবলী মোকতাদির
একটি বাতির শিখা থেকে / শিবলী মোকতাদির
কবি শাহেদ শাফায়েত প্রসঙ্গে শিবলী মোকতাদিরের প্রবন্ধ
https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEhdC6fuEQayWpZbQqVI4dKsl-sqoR62sMMa4j3Eoi4ODt_t-qtKwg74Nnneub345-YsfhrgBYpoGGNhjLxXJ3BaO8jTRJaViXSDIFdlJHoyu--F2zfyM-lm-YqYwebIq9CpcoLgFp1f77Cnr4rC64OcNqbI6m-HvRW_UjmLRSxp9VAJ16PPNl_sAiIw/w640-h360/%E0%A6%95%E0%A6%AC%E0%A6%BF-%E0%A6%B6%E0%A6%BE%E0%A6%B9%E0%A7%87%E0%A6%A6-%E0%A6%B6%E0%A6%BE%E0%A6%AB%E0%A6%BE%E0%A7%9F%E0%A7%87%E0%A6%A4-%E0%A6%B8%E0%A6%82%E0%A6%96%E0%A7%8D%E0%A6%AF%E0%A6%BE-%E0%A6%AC%E0%A6%BF%E0%A6%A8%E0%A7%8D%E0%A6%A6%E0%A7%81-%E0%A6%B2%E0%A6%BF%E0%A6%9F%E0%A6%B2%E0%A6%AE%E0%A7%8D%E0%A6%AF%E0%A6%BE%E0%A6%97.jpg
https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEhdC6fuEQayWpZbQqVI4dKsl-sqoR62sMMa4j3Eoi4ODt_t-qtKwg74Nnneub345-YsfhrgBYpoGGNhjLxXJ3BaO8jTRJaViXSDIFdlJHoyu--F2zfyM-lm-YqYwebIq9CpcoLgFp1f77Cnr4rC64OcNqbI6m-HvRW_UjmLRSxp9VAJ16PPNl_sAiIw/s72-w640-c-h360/%E0%A6%95%E0%A6%AC%E0%A6%BF-%E0%A6%B6%E0%A6%BE%E0%A6%B9%E0%A7%87%E0%A6%A6-%E0%A6%B6%E0%A6%BE%E0%A6%AB%E0%A6%BE%E0%A7%9F%E0%A7%87%E0%A6%A4-%E0%A6%B8%E0%A6%82%E0%A6%96%E0%A7%8D%E0%A6%AF%E0%A6%BE-%E0%A6%AC%E0%A6%BF%E0%A6%A8%E0%A7%8D%E0%A6%A6%E0%A7%81-%E0%A6%B2%E0%A6%BF%E0%A6%9F%E0%A6%B2%E0%A6%AE%E0%A7%8D%E0%A6%AF%E0%A6%BE%E0%A6%97.jpg
বিন্দু | লিটল ম্যাগাজিন
https://www.bindumag.com/2023/06/shibli-moqtadirs-essay-on-shahed-shafayet.html
https://www.bindumag.com/
https://www.bindumag.com/
https://www.bindumag.com/2023/06/shibli-moqtadirs-essay-on-shahed-shafayet.html
true
121332834233322352
UTF-8
Loaded All Posts Not found any posts আরো Readmore উত্তর Cancel reply মুছুন By নী PAGES POSTS আরো এই লেখাগুলিও পড়ুন... বিষয় ARCHIVE SEARCH সব লেখা কোন রচনায় খুঁজে পাওয়া গেল না নীড় Sunday Monday Tuesday Wednesday Thursday Friday Saturday Sun Mon Tue Wed Thu Fri Sat January February March April May June July August September October November December Jan Feb Mar Apr May Jun Jul Aug Sep Oct Nov Dec just now 1 minute ago $$1$$ minutes ago 1 hour ago $$1$$ hours ago Yesterday $$1$$ days ago $$1$$ weeks ago more than 5 weeks ago Followers Follow THIS PREMIUM CONTENT IS LOCKED STEP 1: Share to a social network STEP 2: Click the link on your social network Copy All Code Select All Code All codes were copied to your clipboard Can not copy the codes / texts, please press [CTRL]+[C] (or CMD+C with Mac) to copy