বসন্তের গোধুলীতে চার পাশের পরিবেশ লাল হয়ে উঠছে। সবুজ ঘাসে পড়েছে সেই লাল আভা। কয়েকজন সেই ঘাসে হাটছে। সবার পায়ে কালো রংয়ের জুতো। হালকা শীতের কাপড়ও আছে। এক অন্যরকম অপেক্ষায় পাগুলো হাটা হাটি করছে। টিনের চালের একতলা এই বাড়িটাতে প্রায়ই অতিথি থাকে। সেই সাথে একদল তরুণ নাট্যকর্মী, সাহিত্যিক, কবি আর চিত্রকর। আমি ঢাকা থেকে বিদায় নিয়ে পঞ্চগড়ের এই বাড়িটিতে আশ্রয় নিয়েছি। ভাড়া থাকি। বাড়িটির সামনে ৭ শতক জমির উপর ফাঁকা যায়গা। সেখানে ঘাসের বিছানা। ছোট্ট এই বাড়িটির চারপাশে ইটের দেয়াল। সামনে একটি বড় দরজা। আপাতত: দরজা আটকানো। রাতের আয়োজন খিচুরী আর মুরগী ভূনা। সবকিছু ঠিক ঠাক। কিছুক্ষনের মধ্যে অতিথি আসবেন। সেই সাথে নাট্য কর্মীরাও আসবেন। আজ সন্ধ্যের পরেই আড্ডা শুরু হবে।
দরজায় শব্দ হলো। কে যেন এসেছে। একজন গিয়ে দরজা খুলে দিল। নীল শার্টের উপর পুরোনো কালো কোর্ট পরা একজন লম্বা মানুষ। পুরোনো জিন্স প্যান্ট। চুল এলোমেলো। হাতে একটি বই। দেখেই চিনে ফেললাম কবি শাহেদ শাফায়েত।
শাহেদ শাফায়েত সম্পর্কে এর আগে একটু জেনেছিলাম। কার কাছে মনে নেই। তারপর দেবীগঞ্জে তার সাথে দেখা হয়েছিলো। তবে বিস্তারিত জানা নেই তখনো। আমি তখন নতুন নাট্য নির্মাণ নিয়ে নানা রকম ভাবনার মধ্যে পার করছি সময়। পঞ্চগড় নিজের জেলা হলেও আমার জন্য নতুন শহর। কারন এই শহরে এর আগে কখনো খুব বেশি দিন রাত্রী যাপন করা হয়নি। সময়টা ২০১০ সাল।
কবিকে আমরা অবিভাদন জানালাম। কিছুক্ষণ বাইরেই কাটালাম আমরা। এরই মধ্যে সন্ধ্যের আলো আঁধারি শুরু হয়েছে। শাহেদ শাফায়েতের মুখমন্ডলে এরকমই আভা। মলিনতার উষ্ণতা ছড়ানো লুকোনোবিদ্রোহ । কোথায় কি যেন নেই তার। আমরা সবাই ঘরের ভেতরে গেলাম। ভূমিজের ছোট্ট স্টুডিও। এখানেই নাটকের মহড়া হয়। সেদিন মহড়া ছিলোনা। তারপরের দিন একটা মানববন্ধনের প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম আমরা। সেই মানববন্ধনে কবি শাহেদ সাফায়েত অংশ নেবেন। তাই তাঁকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। আমাদের ডাকে সারা দিয়ে কবি ছুটে এসেছেন। আমরা বসলাম। কবি তার বই বের করলেন। আলাপ শুরু হলো। একের পর এক সূত্র ধরে নানা বিষয়ের আলাপ। কবিকে জানার জন্য নানা প্রশ্ন করা হলো । তিনি একটার পর একটা উত্তর দিচ্ছেন। এরই মধ্যে আমরা জেনে গেছি শাহেদ শাফায়েত একজন বড় মাপের কবি। আলোচনার গভীরতা, কবিতার সময়কাল এবং সমসাময়িকতাকে তিনি নানা ভাবে তার স্মৃতির সঙ্গে যুক্ত করে আমাদের বলে যাচ্ছেন। আমরা মুগ্ধ হয়ে শুনছি।
তার ব্যক্তিগত জীবন নিয়েও নানা প্রশ্ন করা হলো। ঠিক এই ক্ষণে এসে তিনি কিছুটা উদাসীন হয়ে উঠলেন। হৃদয়ের ভেতরে বয়ে বেড়ানো কষ্টগুলো হঠাৎ মুখচ্ছবিতে ঢেউয়ের মতো বয়ে গেলো। কিন্তু খুব বেশিক্ষণ নয়। গল্পের ভেতরে রাজা মহারাজার গল্প জুড়ে দিয়ে বললেন তিনি একসময় ফায়ার সার্ভিসের বিশাল কর্মকর্তা ছিলেন। একটা অনিয়ন্ত্রিত সরলতা আর আমাদের যাপিত জীবনের পরিচয় কেন্দ্রীক কুটিল জিজ্ঞাসায় নিজেকে এভাবে তুলে ধরার বাসনা আমাকে হতভম্ভ করলেও আমি তার অন্তর্গত বেদনা বুঝেছিলাম। কবি নিজের ব্যক্তিগত চলাচল সম্পর্কে আর বেশি কিছু বললেন না আমাদের। সেই থেকে এ বিষয়ে আর কোনদিন বিশেষ কিছু আলোচনা হয়নি।
কবি তার বইয়ের পাতা মেলে ধরলেন। একটার পর একটা কবিতা শোনাতে লাগলেন। তাঁর প্রকাশিত বই
'বালিঘর ও প্রতিটি ভোরের গান' থেকে। কবি যেন বসে আছে বালি ঘরে। আর প্রতিটি ভোরে গাইছেন প্রার্থনা সঙ্গীত। তার ‘শস্যগাথা’ কবিতাটি পড়ার সময় এমনটাই মনে হলো আমার।
অই অন্ধ বালকের জন্য বসে থাকিও গেছে বনের ভেতর থেকে ফেরাতেঘোড়াগুলো আরআনবে সঙ্গে করে অনেক নরম শিকড়গাছিবন্য কীটের তৃণধ্বনি সহকারে
ওই অন্ধ বালকের জন্য বসে থাকেন কবি? নাকি কবিই সে অন্ধ বালক? কবিতায় মধ্যযুগীয় এক ঘোর তৈরী করে তিনি পরাবাস্তব চিত্রের মধ্য দিয়ে আমাদেরকে সুন্দর মানুষের কথা বলে গেলেন। আবৃত্তি নয় কিন্তু তার কণ্ঠে কবিতা আমাদেরকে মোহগ্রস্থ করেছিলো।
সিগারেটের পর সিগারেট চলছে। রাতও বাড়ছে । বইয়ের পাতা উল্টে পাল্টে দেখা হলো। কবিই পড়ে শোনালেন আরও কিছু কবিতা। আমি উল্টে পাল্টে দেখলেও তখনো তাঁর বই পড়িনি।
পরদিন সকাল ১১ টায় চৌরঙ্গী মোড়ে শহীদ মিনারের সামনে আমরা মানবন্ধনে দাঁড়ালাম। খুব বেশি লোকজন নেই। ভূমিজের কয়েকজন নাট্যকর্মী। সব মিলিয়ে ১৫ থেকে ২০ জন। একটা ব্যানার। ব্যানারে বড় বড় অক্ষরে লেখা আছে ‘পঞ্চগড়ে সাংস্কৃতিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবিতে মানববন্ধন’। কবি শাহেদ শাফায়েত তার বক্তব্যে বললেন ‘একটি সাংস্কৃতিক বিশ্ববিদ্যালয় আমাদের প্রাণের দাবি’।
কবি বিদায় নেন সেদিন বিকেলে। তারপর থেকে কবির সাথে আমাদের আবেগময় বন্ধন সৃষ্টি হয়। তিনি আমাদের অংশ হয়ে ওঠেন। ভূমিজের প্রায় সকল আয়োজনে তার সর্বপ্রাণ উপস্থিতি উপভোগ করেছি। অনেকদিন পর কবিতা পড়ার স্বাদের সময় হাতে তুলে নিই ‘বালিঘর ও প্রতিটি ভোরের গান’। পাতা উল্টাতেই এক পরাক্রম ভূমিকা চোখে পড়ে। কবিতাকে তিনি যুদ্ধ, ভৌগলিক বিস্তার ও শুন্যতর বৃত্তের সাথে তুলনা করে যাত্রা শুরু করেন। এখানেই কবির অভিযাত্রাকে বোঝা যায়। তিনি কবিতার মধ্য দিয়ে পৃথিবী পরিভ্রমণ করতে চেয়েছিলেন অসীম শুন্যতায় সুগোপন হয়ে। তিনি জীবনানন্দের ছোঁয়াও একেঁছেন ‘হাজার জন্ম শেষে তবে এই বৃক্ষকে পেয়েছি’। তাঁর কবিতায় উত্তর বঙ্গের সহজ সরলতার দর্শন ফুটে উঠেছে। শব্দ উপমায় আর চিত্রকল্পে উত্তরের ঘাস লতাপাতা বালুকাময় দুপুরের উত্তাপ খুঁজে পাওয়া যায়। খুঁজে পাওয়া যায় সহ্যের সহ্যতর জীবনবাহিকা।
ভোজনবিলাসী পুরুষ খেয়েছে পাতাঅগ্নিদ্রবণ, নির্বাপনের স্বাদ-আমাদের পিঠে কালো মোহরের ছাপআমাদের ঘরে ঘুণপোকাদের ঘর;
মৃত্যু অনিবার্য্য হলেও কিছু মৃত্যু আমাদের শোকাহত করে। আমাদের হৃদয়কে চুরমার করে। শাহেদ সাফায়েতের মৃত্যু আমাদের অবিরাম বেদনা। কিন্তু তিনি কবিতায় স্বকিয়তা রেখে গিয়ে অমরত্ব লাভ করেছেন। চেনা অচেনার মধ্য দিয়ে তিনি বিষন্ন আলোর ভেতর এক বিবর্ণ বাতিঘর।
মন্তব্য