শাহেদ শাফায়েত একজন কবি, তবে এর আগে আমি তাকে প্রকৃত মানুষ বলতে চাই। কবি হতে যতোটা ভাবুক হতে হয়, নয়তো কবি হওয়া যতোটা কঠিন তার থেকেও হাজারগুন কঠিন একজন প্রকৃত মানুষ হওয়া। প্রকৃত মানুষ হওয়া মাত্রই একজন কবি সু-খ্যাতি কুড়ান এবং সু-লেখক হয়ে উঠেন। আমার ব্যক্তিগত ভাবনা বলে- কবি শাহেদ শাফায়েত একজন প্রকৃত মানুষ। কারণ খুঁজলে পাওয়া যাবে প্রকৃত মনুষ্যশক্তি ছাড়া মানবতার মুক্তির কথা ভাবা বেশ ভার। মানুষের দুুঃখ-কষ্ট, নিষ্পেষিতের আহাজারি তিনি বুঝেছেন এবং অনাচারকারীদের বিরুদ্ধে তার শব্দমালা প্রতিবাদে সোচ্চার। কবিতায় দেখি তাঁর কলম যেন ইস্পাত কঠিন শক্তি নিয়ে শব্দবাণে ছিন্নভিন্ন করে অনাচারকারীদের। কল্পনার উচ্চস্তরে পৌঁছে জীবন অভিজ্ঞতার উপাদানগুলোই তাঁর কবিতায় উপজীব্য হয়েছে বারবার। কবিতায় তিনি প্রাণহীনে প্রাণ আবহ ছুঁড়ে দিয়ে প্রাণ সঞ্চারের কাজটিও সুচারুভাবে করেছেন। কবিতায় এনেছেন বিপ্লব, ভালবাসা, প্রতিবাদ; দেখিয়েছেন নতুন স্বপ্ন, এনেছেন নতুন করে চলার শক্তি।
আমার ক্ষুদ্র ভাবনা থেকে যতটুকু উপলব্ধি করতে পারি, তিনি তাঁর কবিতায় মানবিক মমত্ববোধ জাগ্রত করার প্রয়াস চালিয়েছেন। তাঁর কবিতায় ব্যক্তি জীবনের ছাপ খুঁজে পাওয়া যায় না কবিতায়। কিন্তু একই এলাকার অর্থাৎ দেবীগঞ্জের স্থায়ী বাসিন্দা হওয়ার কারণে এবং টুকিটাকি লেখালেখি করার সুবাদে খুব অল্প কিছুদিন তার সাথে চলাফেরা করার সুযোগ হয়েছে এবং যতটুকু কাছাকাছি হলে খানিকটা অনুধাবন করা যায়, ভালবাসা যায়, জানা যায় জীবন অভিজ্ঞতার গল্প ঠিক ততোটাই কাছাকাছি ছিলাম তাঁর। পরিচয়ের প্রথমদিকে তিনি আমার নাম ভুলে যেতেন এবং দেখা হলেই আগে নাম জিজ্ঞেস করে নিতেন। আশ্চর্যের বিষয়, তিনি কখনো ব্যক্তিজীবনের দুঃখ-দুর্দশার কথা বলতেন না কাউকে; ব্যক্তিগত জীবন সংগোপনে রেখে গঠনমূলক কথাই বেশি বলতেন। আমাকে কবিতা লেখার প্রতি উৎসাহ দিতেন এবং প্রায়ই বলতেন প্রতিশ্রুতিশীল কবি হতে হবে।
আমার কাছে তিনি একজন তুলনাহীন ব্যক্তি ছিলেন এবং হঠাৎই কখনো কোথাও দেখা হয়ে গেলে কথায় কথায় আড্ডা জমে উঠতো, ঘন্টার পর ঘন্টা তার কথা শুনতাম। ফলে আমার জীবন ঝুড়িতে নতুন নতুন জ্ঞান সংগ্রহ ক্রমান্বয়ে ভারী হয়ে উঠতে শুরু করেছিল। সহসাই দেখা হয়ে গেলে চা পান করার ছলে তার সাথে গল্প ও আড্ডা দেয়ার সুযোগটা কখনোই হাতছাড়া করতে চাইতাম না। তার যথেষ্ট কারণও আছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো তাঁর সরল-সাবলীল ও সুন্দর বাচনভঙ্গি, যা আমাকে বারবার কাছে টানতো। তিনি আমাকে ডেকে নিতেন আর কবিতা দেখতে চাইতেন, আমিও লেখার হাত শক্ত করার আশায় ছুটতাম তাঁর কাছে। কবিতার ভুলভ্রান্তি কোথায়, শব্দের অমিল ও নানাভাবে আমাকে তিনি কবিতা লেখতে সাহায্যে করেছেন সাথে উৎসাহ যুগিয়েছেন। এমনকি তিনি যেদিন দুনিয়া ছেড়ে পরপারে পাড়ি জমালেন গত ০৮/০২/২০২৩ খ্রিষ্টাব্দে, তার কিছু পূর্বে অর্থাৎ ০৫/০২/২০২৩ তারিখে তাঁর সাথে দেবীগঞ্জ চৌরাস্তার মোড়ে দেখা হয়, তবে ব্যস্ততার কারণে তাড়াহুড়ার মধ্যেই সালাম বিনিময় করে রওয়ানা করি কাজের উদ্দেশ্যে। সেদিনও তিনি আমাকে কবিতা নিয়ে দেখা করতে বলেন আর আমি পরে দেখা করবো বলে কথা দিই। কর্মব্যস্ততায় সে কথা ভুলে গিয়েছি আর যখনি তার পরপারে পাড়ি জমানোর কথা শুনি তখন আমি ভীষণভাবে মর্মাহত হয়ে পড়ি। কী করবো ভেবে পাচ্ছিলাম না, তাঁর স্মরণে এই লেখা লেখতে গিয়েও আমি মেনে নিতে পারছি না তিনি আর নেই।
তিনি একজন প্রখ্যাত কবি ও বড় মাপের সু-লেখক। যদিও আমি তাঁর সর্ম্পকে লিখতে বসেছি, কিন্তু আমি মনে করি তাঁর সর্ম্পকে লেখার মতো যোগ্যতা আমার নেই, আমি ক্ষমাপ্রার্থী শুধুমাত্র তাঁর স্মৃতি স্মরণে আমার এই লেখা।
মানুষ এমনও হতে পারে আমি তাকে দেখে শিখেছি, নিজের দুঃখ-কষ্ট সব একপাশে সরিয়ে রেখেছিলেন তিনি। নির্মোহ একজন মানুষকে দেখেছি খুব কাছ থেকে। সাহচর্য পেয়েছি খুব অল্প সময়। সময়টা অল্প হলেও এখন মনে হচ্ছে ওই সময় আর পাওয়া হবে না, অল্প সময়ের স্মৃতিগুলোই সাথে থাকবে, থাকবে কবির থেকে পাওয়া সময়ের প্রতি কৃতজ্ঞতা। তাঁর সাথে কোনো এক ক্ষণে আড্ডায় তিনি আমাকে বলেছিলেন, ‘বন্ধুত্ব হতে হবে সৎ উদ্দেশ্যে, বন্ধুত্ব কখনো বয়স দেখে হয় না।’ তুমিও আমার বন্ধু হতে পারো যদি তুমি সুস্থ মননের অধিকারী হও।
তার সাথে আমি পরিচিত ছিলাম না, তাকে কবিতায় চিনতাম এবং শুধু দূর থেকে দেখতাম। তাঁর লেখা কবিতা ফ্রেন্ডস ক্লাবের বইয়ে প্রকাশ হতো আমি মুগ্ধ হয়ে পড়তাম। তখনও আমি হাইস্কুলের গন্ডি পার করিনি। অনেকদিন পর কবিতার রাজকুমারের সাথে পরিচিত হওয়ার সুযোগ হলো দেবীগঞ্জ সাহিত্যে পরিষদে যুক্ততার সুবাদে। তার পরথেকেই কবির সাথে অল্প-স্বল্প ওঠাবসা। কিন্তু অদ্ভূত বিষয় হল, তাঁর চলাফেরা দেখে ভাবতাম তিনি খুব গম্ভীর এবং প্রচন্ড রাগী মানুষ, কিন্তু যখন কাছে গিয়েছি, মিশেছি, অনুভব করেছি, তখন আমার ধারনা ভ্রান্ত প্রমাণিত হয়েছে। তিনি একজন মিশুক, উদার ও আনমনে ভাবুক ব্যক্তি। আমার গর্ব হয়, এমন একজন প্রখ্যাত কবি ও লেখক পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জের বাসিন্দা। আমি একজন ভাগ্যবান ব্যক্তি যে, তাঁর মতো বাংলা সাহিত্যের এক অমূল্য রত্নের সাহচর্য পেয়েছি। তিনি বাংলা সাহিত্যকে আরও বেশি সমৃদ্ধ করার প্রয়াসে নিরন্তর কাজ করে গেছেন আজীবন।
মন্তব্য