শাহেদ শাফায়েত একজন প্রখ্যাত কবি ও লেখক। সর্বউত্তরের জেলা হিমালয় কন্যা পঞ্চগড়ের করতোয়ার পাড় ঘেঁষা এক ছোট্ট পাড়াগাঁয়ে ১৯৬৯ সালের ১ জানুয়ারি জন্মগ্রহন করে। তাঁর ও আমার বাড়ি পাশাপাশি হওয়ার কারণে ব্যক্তিগতভাবে তাকে চিনি ও জানি। ছোটবেলা থেকে তাঁর বেড়ে উঠা,সাহিত্য চর্চা ও বিভিন্ন সময়ে জীবনপ্রবাহে ঘটে যাওয়া বিষয়গুলো খুব কাছ থেকে প্রত্যক্ষ করেছি। তাঁর সাথে ব্যক্তিগতভাবে জানাশোনা ছিল ও প্রায় সময়ই একান্তভাবে সাহিত্য আলোচনা হতো। যখন শাহেদ শাফায়েত দেবীগঞ্জ নৃপেন্দ্র নারায়ণ উচ্চ বিদ্যালয়ে নবম-দশম শ্রেণীর ছাত্র ছিল তখন থেকেই সে লেখালেখি করতো। হয়তোবা এর আগে থেকেও সে লেখালেখি করেছে। তবে আমার গোচরে আসে, সে নবম-দশম শ্রেণীর ছাত্র থাকা অবস্থায়। সে কবিত্বে আরও বেশি শক্তিশালী হয়ে উঠে যখন আমি বি.এ পড়ি। তখন সে সবেমাত্র নৃপেন্দ্র নারায়ণ উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মেট্রিক পাস করে দেবীগঞ্জ মহাবিদ্যালয়ে ইন্টারমিডিয়েট এ ভর্তি হয়েছে। তখনকার সময়ে শাহেদ শাফায়েত, রাজ্জাক দুলাল, রবিউল ইসলাম, শাহ্ আনিস ও আমি সহ উত্তরাঞ্চলে সাহিত্য সংসদ গঠন করে নিয়মিত সাহিত্য আড্ডা ও সাহিত্য আলোচনা করতাম। তখনই লক্ষ্য করি শাহেদ শাফায়েতকে একজন তুখোড় মেধাবী লেখক হয়ে উঠতে। এর কিছু সময় পরে ১৯৮৭/১৯৮৮ সালের দিকে উত্তরাঞ্চল সাহিত্য সংসদ ব্যানারে শাহেদ শাফায়েত ও আমরা সবাই মিলে দেবীগঞ্জ ইউএনও অফিসের পিছনে অধুনালুপ্ত শিশুপার্কে রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তী উৎসবের আয়োজন করি। সেসময় দেবীগঞ্জের দায়িত্বে থাকা সাব-জজ সত্যেন্দ্রনাথ রায় এ ব্যাপারে বেশ ভালো ভূমিকা রাখেন ও আমাদের উদ্বুদ্ধ করেন। তিনি ভাওয়াইয়া শিল্পী যতীন্দ্রনাথ রায়ের ভাই ছিলেন।
কালক্রমে উত্তরাঞ্চল সাহিত্য সংসদের নামে রঙতুলি পত্রিকা প্রকাশ করা হয়। তবে সেটা ছিলো অনিয়মিত এবং দুইটি অথবা তিনটি সংখ্যা প্রকাশ করার পর আর পত্রিকা প্রকাশ করা হয়নি। রঙতুলি পত্রিকার সম্পাদনা সে সময়ে শাহেদ শাফায়েত করতো। প্রচ্ছদ করতেন তপন কুমার রায়। আমি তখন থেকে একজন পাঠক ও সাহিত্য অনুরাগী ছিলাম। সবার সাথে থাকার কারণে একটু আধটু লেখালেখি করতাম। তবে সবচেয়ে বেশি ও ভালো মানের লিখতো শাহেদ শাফায়েত। উত্তরাঞ্চল সাহিত্য সংসদের কোনো অফিস ছিলো না। আমরা নৃপেন্দ্র নারায়ণ উচ্চ বিদ্যালয়ের মাঠে দক্ষিণ দিকে নিয়মিত বসতাম ও সাহিত্য চর্চা করতাম। বর্তমানে সে জায়গায় নৃপেন্দ্র নারায়ণ উচ্চ বিদ্যালয়ের তিনতলা ভবনটি দাঁড়িয়ে আছে। শাহেদ শাফায়েতর প্রিয় জায়গা ছিল উক্ত বিদ্যালয় মাঠের যেখানে আমরা সাহিত্য চর্চা করতাম। দক্ষিণ দিকে বল আকৃতির ভাষ্কর্য বিশিষ্ট একটি সুদৃশ্য প্রবেশদ্বার ছিলো। তার দু’পাশে ছিলো সাইকাস গাছ। সাহিত্য আড্ডা ছাড়াও বিভিন্ন সময়ে সেখানে তাকে একা সময় কাটাতে দেখা যেতো। পাশাপাশি বিদ্যালয় মাঠের মাঝখানে শহীদ মিনারও তার প্রিয় জায়গা ছিলো। মাঝেমধ্যে করতোয়ার তীরে ছুটে যেতো। সে সময় করতোয়ার উপর সেতু ছিলো না। প্রকৃতিক সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে নদীর পাড়েও সময় কাটাতে দেখা যেতো তাকে।
দেবীগঞ্জ মহাবিদ্যালয় থেকে ১৯৮৮ সালে ইন্টারমিডিয়েট শেষ করার পর তাকে আমি প্রথম ঢাকায় নিয়ে যাই এবং সে সময়ে ঢাকায় অবস্থান করছিলো রাহিদুল ইসলাম মিন্টু। আমি তাকে নিয়ে ঢাকার বাসাবো’তে গিয়ে মিন্টুর ওখানে মেসে উঠি। সেখানে রাহিদুল ইসলাম মিন্টু তাকে হাবিবুল্লাহ্ বাহার কলেজে ডিগ্রি পাস কোর্সে ভর্তি করায়। ১৯৮৯ এ শাহেদ শাফায়েত সহ ঢাকার বিভিন্ন স্থানে ঘোরাঘুরি করি ও সময় কাটাই। ঐ সময়টাতে তার ‘কোরপাটেলিক’ কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ হয় অমর একুশে বইমেলায়। সেসময় বাংলা একাডেমির এতো প্রসারতা ছিলো না। আমরা সেখানে যাই এবং বইমেলায় ছিলাম শাহেদ শাফায়েত সহ। শাফায়েত ঢাকায় থাকার সুবাদে ঠাকুরগাঁওয়ের রাজা সহিদুল আসলাম এর সাথে পরিচয় হয় ও সখ্যতা গড়ে উঠে। ১৯৯০ সালের মাঝামাঝি সময়ে রাজা সহিদুল আসলামকে নিয়ে শাহেদ শাফায়েত দেবীগঞ্জে আমার বাড়িতে আসে, আমার সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়ার জন্য। এভাবেই সে ঢাকায় থাকা অবস্থায় বড় বড় লেখক, কবি, সাহিত্যিকদের সাথে উঠাবসা শুরু করে। আর নিয়মিত দেবীগঞ্জ ও ঢাকা যাতায়াত করতো। একবার সে হঠাৎ দেবীগঞ্জ আসে আর আমাকে নিয়ে ঢাকায় যায়। তাঁর সাথে সেবার ঢাকায় সাত দিন থাকি। তখন সে আমাকে আহমেদ নকীব, হোসেন মোতাহার তাঁদের সাথে দেখা করে পরিচয় করিয়ে দেয়।
শাহেদ শাফায়েতকে আমার সবচেয়ে বেশি মনে পড়ে যখন রংপুর ঘুরতে যাওয়ার কথাটি স্মরণ হয়। ১৯৮৮ সালে আমি রংপুরে এক আত্মীয়ের বাসায় বেড়াতে যাই শাহেদ শাফায়েত সহ। বাড়ির সামনে ছাদে খুব সুন্দরী এক মেয়ে কাপড় শুকাতে দিচ্ছিলো, আর বিল্ডিংয়ের দেয়ালে ছিলো মাধবীলতার গুল্ম। তাকে বললাম এখানে একটা কবিতা লিখো। সে তাৎক্ষণিক আমার সামনেই একটি কবিতা লিখে ফেলে এবং আমি আশ্চর্য ও মুগ্ধ হয়ে পড়ি। তার এই তাৎক্ষণিক কবিতা লেখা আমাকে বেশ নাড়া দেয়। এটা ভুলে যাওয়ার মতো নয়। তার ওই কবিতাটি পরবর্তীতে ‘কোরপাটেলিক’ কাব্যগ্রন্থে ‘আইভিলতার পাশে শঙ্খচুড় নারী’ শিরোনামে প্রকাশিত হয়। কবিতাটি-
চুর্ণ কাঁচের ভেতর ভাসছে মুখরৌদ্র আসা একটুকরো ভাসলো মেঝেমুখ তবু ধরে আছো প্রিজম চাতুরীঅজানা নারীর একরাশ খোলাচুলপৃথিবী কাঁপিয়ে চাঁদের বাগানে ওড়েঘরের ভেতর ঘুমের দুচোখ দেখেআইভিলতার পাশে শঙ্খচূড় নারী...
কবি শাহেদ শাফায়েত ১৯৯৪’র দিকে দেবীগঞ্জে চলে আসে। কিছুদিন নিয়মিত ঢাকায় যাতায়াত করে কিন্তু পরবর্তীতে তা আর নিয়মিত হয় নি। দেবীগঞ্জে চলে আসার পর স্থায়ীভাবে দেবীগঞ্জে না থেকে বিভিন্ন সময়ে ঠাকুরগাঁওয়ে যাওয়া আসা করতো। সেখানকার আল্পনা সাহিত্য তার ভালো লাগতো। আর রাজা সহিদুল আসলামের সাথে সখ্যতা থাকায় সেখানে বার বার ছুটে যেতো। মাঝেমাঝে সে তার প্রকাশিত ফোল্ডিং পেপারে কবিতা নিয়ে আমার কাছে আসতো। সে ঢাকা থেকে চলে আসার পর উত্তরাঞ্চল সাহিত্য সংসদের আমরা পাঁচ জন আর তেমন ভাবে একত্রিত হতে পারিনি। সবাই কর্মব্যস্ততায় নিজ কর্মস্থলে নিযুক্ত থাকায়। কিন্তু শাহেদ শাফায়েত’র সাথে তখনও গভীর সম্পর্ক ছিলো। সে আমাকে চাচা বলে সম্বোধন করতো এবং আমার কাছে চলে আসতো। আমরা পরস্পর কথা বলতাম, সাহিত্য আলোচনা করতাম। বাংলা সাহিত্যের সামগ্রিক বিষয় নিয়ে সে গভীর আলোচনা করতো।
শিল্প-সাহিত্যমুখী হওয়ায় সে কোনো ব্যক্তিগত আলোচনা করতো না। এমনকি পছন্দও করতো না। ঢাকা থেকে আসার পর বিভিন্ন সময়ে সে উপলব্ধি করেছে এবং বলেছিল দেবীগঞ্জ তার কাছে ক্ষুদ্র। এখানে সে তেমন কিছু করতে পারবে না সাহিত্যের জন্য। যদিও বারবার ঢাকায় ফিরে যেতে চেয়েছে কিন্তু কোনো এক অদৃশ্য সুতোয় মায়ার টানে দেবীগঞ্জ ছেড়ে যেতে পারেনি। নাকি দেবীগঞ্জের সাথে তার এই সম্পর্কটা ছিন্ন করতে চায়নি তা অজানা। শাহেদ শাফায়েত আবেগপ্রবণ ছিল না। সে তার ব্যক্তিত্ববোধ ও নিজস্ব স্বকীয়তায় অনড় অটল ছিল। তার সাথে আমার মাঝখানে যোগাযোগ কিছুটা কম হয়েছিল। তবে ২০১৭ সালে অসুস্থতায় আমি বাড়িতে অবস্থান করায় তার সাথে আবারও পুরোদমে কথা হতো,আড্ডা হতো, আমার বাসায় এসে বই নিয়ে যেতো। তার প্রকাশিত বই আমাকে দিতে আসতো। নতুন ভাবে সাহিত্যের সামগ্রিক বিষয়ে গভীর আলোচনা করতো। সে শাহ্ আব্দুল করিমের একজন অনুরাগী ও ভক্ত ছিলো। চিন্তা চেতনায় সে উদার ও সৎ ব্যক্তি ছিলো। সমাজের পাপ পঙ্কিলতা তাকে স্পর্শ করেনি। তার দ্বি-মুখী চরিত্র ছিলো না। আমি মনে করি সে ছিলো শিশুর মতো। কারণ খুঁজলে বলবো, তার চিন্তা চেতনায় বৈষয়িক কোনো বিষয় আসেনি কখনো। শাহেদ শাফায়েত শেষ সময়ে এসে আর আগের মতো লিখতে পারছিলো না। তার কাজ-ভাবনা এক জায়গায় থেকে যাচ্ছিলো। হয়তো তার লেখা ধরা দিচ্ছিলো না তার কাছে। এ নিয়ে তার ভাবনার অন্ত ছিলো না। শাহেদ শাফায়েত’র শেষ ইচ্ছা ছিলো অমর একুশে বইমেলা ২০২৩ এ যাওয়া এবং যাদের সাথে বহুকাল ধরে যোগাযোগ নেই, দেখা নেই, আড্ডা নেই, তাদের সাথে দেখা করা। কিন্তু তার এই শেষ ইচ্ছা পূর্ণতা পায়নি। চির শিশু, চির কিশোর শাহেদ শাফায়েত সবাইকে ছেড়ে ৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ খ্রিস্টাব্দে পরপারে পাড়ি দিয়েছে।
মন্তব্য