বেদনাকে ভালোবেসে নিকোটিন ঠোঁটে অল্প বয়সেই যিনি হয়ে উঠেছিলেন কবিতা কোকিল, তিঁনি আমাদের শাহেদ শাফায়েত। সুঠাম দেহ, মাথা ভর্তি ঝাঁকড়া চুলের বিন্যাসে বিন্যাসে লুকিয়ে রাখতেন তাঁর যাপিত জীবনের দীর্ঘশ্বাস। মায়াভরা ভরাট কণ্ঠে নিজস্বী কবিতা পাঠে ছিল দ্রোহ ও চেতনাবোধের গান। আয়ুর দোরঘন্টির আওয়াজে অতি কম সময়েই তিঁনি চলে যাবেন না ফেরার দেশে, কবিতা প্রেমীদের কাছে যা ছিল অপ্রত্যাশিত, অনেকটা বজ্রপাতের মতো।
কৃষিভিত্তিক ভূগোলে যে সভ্যতা যাত্রা শুরু করেছিল, সেই প্রাচীন জীবন এবং আধুনিক জীবন যন্ত্রণা নাগরিক সভ্যতায় যে ক্ষত সৃষ্টি করেছিল, তা নানা প্রতীক ও উপমায় এবং শব্দের নিগুঢ় ব্যঞ্জণায় কবি শাহেদ শাফায়েত তাঁর প্রতিটি কাব্য ও কবিতায় এক মৌলিক কাব্যরীতিতে সৃজন করেছিলেন।
১৯৮৯ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ, “কোরপাটেলিক”। কোরপাটেলিক-এর প্রতিটি কবিতায় বেজে উঠেছিলো এক নতুন ধারার অপূর্ব সুর ঝংকার। তাঁর কবিতায় প্রাচীন, আধুনিক ও মহাকালের শব্দ বিন্যাস কবিতাকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে। অনেক ক্ষেত্রেই কবিতাকে উপলব্ধির জন্য সাধনার দরকার হয়, হৃদয়ে-মননে দিগন্ত প্রসারিবোধের জন্ম দিতে হয়। কবি শাহেদ শাফায়েত তাঁর কবিতার অন্তঃমূলে যেন তাই তুলে আনার চেষ্টা করেছেন। তাঁর কবিতা নান্দনিক ও অলংকার সমৃদ্ধ, যা বারে বারে পাঠককে মায়ামন্ত্রের মায়াজালে আবদ্ধ করে রাখে।
তাঁর ‘ঘোর’ কবিতায় দেখি- সাতটি কিশোরের পাঠশালার প্রতীকের বিপরীতে ট্রাফিক কৌশলে আনন্দময় কৈশোরের লাটিম খেলা, মগডালে উঠার অপার আনন্দ যেন নাগরিক জীবনের আবেগহীন অন্ধকারের প্রতিচ্ছবি। তথাকথিত নাগরিক শিক্ষার আনন্দ প্রকৃতির আনন্দের কাছে অতি নগণ্য, ‘ঘোর’ কবিতা তারই প্রতিধ্বনি। ‘ঘোর’ কবিতায় তাই তিনি লিখে গেছেন-
সাতটি কিশোরের ভ্রমণ ঘরে এলেনগর পান করে তীব্র হাড়িয়া।
কবি শাহেদ শাফায়েতের কাছে প্রেম ছিল গতানুগতিক অবয়বের বাইরে একটি ভিন্ন সত্বা। শাফায়েতের নারী বাস্তবের নারী থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। সে নারী মায়াময়, ঐশ্বরিক, প্রেরণাদায়ী। “আইভিলতার পাশে শঙ্খচূড় নারী” কবিতায় তিঁনি লিখেছেন-
চূর্ণ কাঁচের ভেতর ভাসছে মুখরোদ এসে একটুকরো ভাসালো মেঝেমুখ তবু ধরে আছে প্রিজম চাতুরী।
প্রথাবিরোধী এই কবি ছিলেন জীবন সম্পর্কে বড্ড উদাসীন অথবা জীবনের অভিজ্ঞানে ছিলেন কালদর্শী। তাই সময়ের মাপকাঠিতে তিঁনি জীবন এবং মানবতা, শব্দ অথবা কবিতা কোনোটাই ঘড়ির কাটায় মাপেননি। তিঁনি সবার উপরে কল্পনা করতেন মানুষের আনন্দময় জীবন। সময়ের অভাব বা বিভাজন জীবনকে যদি সংকটাপন্ন করে, তবে কি লাভ সেই সময়ের দাস হয়ে?
তাই তাঁর ২০২১ সালে প্রকাশিত সর্বশেষ কাব্যগ্রন্থ “চরকা কাটার গান” এর প্রথম কবিতায় উঠে এসেছে জীবনের সেই অভিজ্ঞান-
আমার তো প্রয়োজন নেইঘড়িওঘন্টায়।
মন্তব্য